মিথরাস
বিশাল বাড়িটার সদর দরজাতে দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখে চারপাশটা একবার দেখে ক্রিশ্চিনা।
ঘন কালো চুল ওর – তবে ছোট করে কাটা কোঁকড়া চুলগুলো ফর্সা কপালে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। ডান হাতটা একবার ওই চুলে চালিয়ে ফিরে তাকায় ও জারাফের দিকে।
‘তুই শিওর?’ কটমট করে বয়ফ্রেন্ডের দিকে তাকায় ও।
জবাব না দিয়ে এক পা এগিয়ে বাড়িটায় ঢুকে পড়ে জারাফ। বিশাল বাসাটা এখন শুধুই ওদের। অন্তত উপস্থিতির দিক থেকে।
পোড়োবাড়ি বলে খ্যাতি আছে এই জায়গাটার। ঠান্ডা দৃষ্টিতে চারপাশে তাকায় জারাফ। শুভ্র মুখটা এখন বরফের মত চকচক করছে। দস্তানা পড়া হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসে ওর। ফিরে তাকায় ক্রিশ্চিনার দিকে।
‘বাচ্চাটাকে নিয়ে আয়। কুইক!’
বাড়িটার সামনে থেমে আছে কালো গাড়িটা। ওটার ট্রাংকে আটকে রাখা হয়েছে তিন বছরের একটা খ্রিস্টান মেয়েকে। পাঁচ মিনিটের মাঝেই ওকে নিয়ে ফিরে আসে ক্রিশ্চিনা। বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে শিশুটি। মার্গারেট এর নাম – জানে ওরা। তবে এখানে তার উপস্থিতিকে গায়ে লাগায় না জারাফ।
পুরোনো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করেছে ওপরের দিকে। পিছু নেয় ক্রিশ্চিনা। একহাতে ধরে আছে মার্গারেটের একটা হাত।
এক
ক্লাসরুমে বসে দুই হাতের তালু ঘষছে নীরব। এসির ঠান্ডা বাতাস তার সহ্য হয় না।
সহপাঠীদের বলে লাভ নেই। সবগুলোর গন্ডারের চামড়া। ভবিতব্য ধরে নিয়েই এখানে বসে আছে ও।
প্রতিদিন তাই করে।
সহপাঠীদের দিকে এক ঝলক তাকায়। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। ফারহা আর ইকরাকে দেখা যাচ্ছে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে কথা বলছে। এই মাত্র রোকনকে আঁচড়ে দিল প্রিয়াংকা। শাহেদ যথারীতি এই হট্টগোলেও একটা বই খুলে বসে আছে। ছেলেটা গল্পের বইয়ের পোকা একেবারে!
মৃদু হাসে নীরব ওদিকে তাকিয়ে।
তারপরই ওর চোখ পড়ে ক্রিশ্চিনার দিকে। মেয়েটা অসাধারণ দেখতে। ওকে দেখলেই বুকের ভেতরে একটা হাহাকার বয়ে যায় নীরবের। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে অন্যদিকে তাকায় ও।
ক্রিশ্চিনার বয়ফ্রেন্ড জারাফ মেয়েটার চুলে মুখ ডুবিয়ে কিছু বলছে, ক্লাসের মধ্যেই। গা জ্বলে যায় নীরবের।
তবে এখানে নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া নীরবের আর কি-ই বা করার আছে?
ও কিছু করেও না। হেলান দেয় নিজের সীটে। স্যার আসুক। ক্লাস শুরু হোক। তারপর হতচ্ছাড়া ইউনিভার্সিটিটা থেকে বের হয়ে যেতে পারলে হয়। এখানে আর মন টেকে না নীরবের।
আস্তে করে ওর পাশে চলে এসেছে দিনার। তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে ও।
ওর পিঠ চাপড়ে দেয় দিনার, ’খবর কি, ফ্রেন্ড?’
‘ভালো। খুব ভালো। তোমার?’ ভদ্রতা করে জানতে চেতেই হয় নীরবকে।
‘জোসিলা। দারুণ একটা জিনিস নিয়ে তোমার সাথে আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। আগের দিনই বলতাম – কিন্তু কি একটা ঝামেলা শুরু হয়ে গেল – দেখলেই তো!’
একটু বিব্রত বোধ করে এবার নীরব। গতকালকের ঘটনাটা খুব একটা গর্ব করার মত কিছু না।
ক্লাসমেট একটা ছেলের নাক-মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে নীরব। সুইমিং পুলের ধারে।
বিষয়টা কেউ তুলবে আজ ক্লাসে আসলে – এটা আশা করেছিল ও। তবে ছেলেটা যে দিনার হবে – সেটা আশা করেনি। এটা একটা কারণ বটে – আজ একটু বেশিই চুপচাপ সবাই ওর প্রতি।
সায়েম ছেলেটা একেবারে নিখুঁত একজন প্লে বয়। ভার্সিটির মেয়েদের মাঝে একটা লিস্ট আছে তার। চার বছর পার হওয়ার আগে এদের সাথে সে অন্তত তিনবার করে বিছানাতে শোবে।
তেইশ জনের লিস্টের পনেরজনকে জিতে ফেলেছে সে।
অদ্ভুত ব্যাপার হল – মেয়েগুলো জানত সায়েমের বেডলিস্টের কথা। তবুও তারা না করেনি। স্বেচ্ছায় এসেছে। ওদের চিন্তাভাবনা ছিল এক কাঠি সরেশ। তাদের প্রত্যেকের আত্মবিশ্বাস ছিল – সায়েম তাদের সাথে একবার অন্তরঙ্গ হলে আর অন্য দিকে মন দিতেই পারবে না!
প্রত্যেকের ধারণাই ছিল ভুল।
‘কাজ’ হয়ে গেলে সায়েম নিত্যনতুন টার্গেট ধরে গেছে।
এবারের টার্গেট তার ভার্সিটির হটেস্ট মেয়েটাকে। মেয়েটির নাম ক্রিশ্চিনা। নীরব যার ওপর প্রথম দিন থেকে ক্রাশ খেয়ে বসে আছে।
সুইমিং পুলের ওখানে সায়েম যখন ক্রিশ্চিনার শরীর নিয়ে বাজে রসিকতা করে শোনাচ্ছিল তার বন্ধুদের – পাশ দিয়ে যাচ্ছিল নীরব। বন্ধু কিরণকে খুঁজতেই পুলের এদিকে আসা। এসময় তার কানে চলে আসে সায়েমের রসিকতা।
নীরব ঠান্ডা চোখে একবার তাকিয়েছিল সায়েমের দিকে। দৃষ্টিটা খেয়াল করে উঠে এসেছিল সায়েমও। ঠাট্টার সুরে জানতে চেয়েছিল, নীরব এখনও অন্যের গার্লফ্রেন্ডের পেছনে ঘুর ঘুর করে কি না।
তারপর হাসিমুখেই ক্রিশ্চিনার সাথে মেলে – এমন একটা নোংরা জোকস শুনিয়ে দেয় নীরবকে।
মাত্র দুইবার মেরেছিল নীরব ওকে – প্রথমে পেটে – তারপর মুখে। এতেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় সায়েম।
সায়েমের সার্কেল এগিয়ে আসতে চাইলেও পরক্ষনেই থমকে যায়। নীরবের মত একটা ছেলে সায়েমকে দুই ঘুষিতে নক আউট করে দেবে – এটা তারা ভাবেনি।
তবুও লাফিয়ে এসেছিল মিফতাহ – একহাতে টেনে ধরে ছিল চলে যেতে থাকা নীরবের শার্ট – বাম হাতটা ছিঁড়ে তার হাতে চলে গেছিল তখন।
ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর বুকে একটা ঘুষি বসাতেই নিঃশ্বাস আটকে যায় মিফতাহের। মারামারির সখ উধাও হয়ে গেছে সঙ্গে সঙ্গে।
কোনদিকে না তাকিয়ে চলে এসেছিল নীরব।
তবে দূর থেকে অনেকেই এটা দেখেছে। তাদের মাঝে যে দিনারও ছিল সেটা জানত না ও। এখন জানল।
ঝুঁকে পড়ে ও দিনারের দিকে।
‘লিসেন, সায়েমের মুখ ফাটানোর জন্য আমার কোন অনুশোচনা নেই। ওটা যদি জানতে চাও এটাই বলব।’
হাসে দিনার, ’আমারও নেই। আমার পছন্দের মেয়েটার সাথে একাধিকবার শুয়েছে বাস্টার্ডটা।’
অন্যদিকে তাকায় নীরব রাগত মুখ নিয়ে।
আঙুল ফোটায় দিনার, ’যাই হোক। আমি এখানে এসেছি – তোমার সাথে ক্রিশ্চিনা মেয়েটাকে নিয়ে কথা বলা দরকার। তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন। গতকাল বাম হাতে একটা উল্কি দেখেছিলাম। আশা করছি তোমার থেকেই সাহায্য পাবো আমি।’
‘ক্রিশ্চিনা?’ চোখ কুঁচকে তাকায় নীরব।
‘হুঁ। ওর বাসায় গেছিলাম আমি কয়েকদিন আগে। একটা অদ্ভুত বিষয় দেখে এসেছি। একটা রহস্য তো আছেই। মেয়েটার বয়ফ্রেন্ডকেও সুবিধের কেউ বলে মনে হয় না।’
একবার জারাফ আর ক্রিশ্চিনাকে দেখে নীরব। নিজেদের নিয়ে একেবারেই মেতে আছে ওরা। কোন দিকেই খেয়াল নেই তাদের!
দিনারের দিকে তাকায় আবার, ’এই যদি হয় তোমার মন্তব্য – আমি বলব, আমি আগ্রহ বোধ করছি। কথা তো আর ক্লাসরুমে বলা যায় না। কোথায় বলবে?’
ইতস্তত করে দিনার, ’আমাদের একটা সোসাইটি আছে। সিক্রেট সোসাইটি। আসলে শুধু আমি না – ওদের একজনের চোখেই প্রথমে অসঙ্গতি চোখে পড়ে। আমরা সেখান থেকেই কাজ করে যাচ্ছি। তদন্ত চলছে। তোমাকে এর সভ্য করা যাবে?’
‘কেমন সোসাইটি?’ চোখ বাঁকা করে জানতে চায় নীরব।
‘এ-এম-এস। অ্যান্টি ম্যাজিকাল সোসাইটি। আমরা যাদুবিদ্যার বিরুদ্ধে। তবে ক্লাসের সবাই তা না। পৃথিবীতে এখন তো ওই দিকে ঝুঁকে পড়া মানুষের সংখ্যাই বেশি!’
ধীরে ধীরে মাথা দোলায় নীরব।
‘এই যদি হয় তোমাদের উদ্দেশ্য – তাহলে আমি খুবই আগ্রহী। তোমাদের সাথেই আছি। কিভাবে সভ্য হতে হবে?’
‘হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাবো তোমাকে আজ রাতে। প্রতিজ্ঞা করতে হবে ওখানে।’
‘অলরাইট।’ মেনে নেয় নীরব, ওদিকে ক্লাসে স্যার ঢুকে পড়েছেন।
সেদিকে মনোযোগ দেয় ওরা।
দুই
‘তোমার হাতের উল্কিটা দেখাও ওদের।’ হেডকোয়ার্টারে বসে হাসিমুখে বলে দিনার।
বাম হাতা গুটিয়ে সবাইকে দেখায় ওটা নীরব।
সবাই বিস্ময়সূচক একটা শব্দ করে।
ব্যাখ্যা দেয় দিনার, ’চমৎকার একটা উল্কি। এটাতে কিছু ল্যাটিন আর কিছু সিম্বল আছে। এক কথায় যদি বলি, এখানে বলা হয়েছে, “যাদুবিদ্যার বিরুদ্ধে – অশান্তির উর্ধ্বে”। আমার এরকম একটা উল্কি করানোর ইচ্ছে ছিল – তবে সঠিক মাপ পাইনি। শুধু ইন্টারনেটে দেখেছিলাম এ জিনিস। প্রাচীন পুঁথিতে আঁকা, অ্যাকুরেট নয় কোনটাই।’
নীরব এসব শুনছে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের তিনজনের দিকে।
চঞ্চল প্রিয়াংকা, ভদ্র দিনার আর বইপড়ুয়া শাহেদ! এরা মিলেই কি না সিক্রেট সোসাইটি এ-এম-এস খুলে বসে আছে!
‘আমাদের কাজের কথাতে যাওয়া উচিত।’ বলে নীরব। একটু আগে সভ্য হয়েছে ও এই সংঘের।
‘হুঁ। প্রিয়াংকা, প্রথমে তুই বল। ক্রিশ্চিনা সম্পর্কে কি কি জানিস?’
ক্রিশ্চিনার নাম শুনেই বুকের কোথাও হাল্কা একটা খোঁচা অনুভব করে নীরব। মেয়েটাকে ও কতটা ভালোবাসে সেটা ও নিজে জানে। অন্য কেউ কি বুঝতে পারবে সেটা?
ক্রিশ্চিনার নামে ম্যাজিকের অভিযোগ শোনা যখন যাচ্ছে – এখন নীরব আরও বেশি আগ্রহী। মেয়েটাকে রক্ষা করতে হবে।
‘ক্রিশ্চিনা – মেয়েটা খ্রিস্টান। অথচ আচার আচরণে তাকে খ্রিস্টান বলে মনে হবে না। এই যুগে ধর্ম–কর্ম কেউই মানতে চায় না। আমি সে কথা বলিনি। সেটা বোঝাতেও চাইনি। বলছি – যদি সে খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন হত – তাহলে মেনে নেওয়া যেত। তাকে অন্য কিছু নিয়ে উৎসাহী দেখা যায়। সেটা খ্রিস্টধর্ম না।’
দুই হাত এক করে নীরব, ’সেটা কি?’
শুন্য দৃষ্টিতে তাকায় প্রিয়াংকা, ’আমি জানি না ঠিক। তবে সূর্যের প্রতি মেয়েটার দুর্বলতা আছে। সবার চোখের আড়ালে তাকে স্যালুট করতে দেখেছি। সূর্যের দিকে মুখ করে।’
‘আচ্ছা।’ মাথা দোলায় নীরব।
বাকিরা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আগে থেকেই জানে ওরা এসব – বুঝতে পারে নীরব।
তবে ওদের কাছে খুব সম্ভব – কোন ব্যাখ্যা নেই।
‘আরও কিছু আছে তো মনে হয়। ব্যাখ্যা দেবে এবার দিনার। তুমি বলেছিলে, ক্রিশ্চিনার বাসাতে গিয়ে এমন কিছু দেখে ফেলেছ – যা তোমার মাঝে সন্দেহের উদ্রেক ঘটিয়েছে?’
নড়ে বসে দিনার, ’হুঁ। ক্রিশ্চিনা আর আমার বাসা পাশাপাশি। ছোটবেলা থেকেই আমি ওকে চিনি। তবে সেরকম বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠতা কোনদিনই গড়ে ওঠেনি। সেদিন তার কাছে আমাকে যেতে হয়েছিল – কারণ রাত তখন আটটা। আমার ইন্টারনেট কানেকশন কাজ করছিল না। পরের দিনের অ্যাসাইনমেন্টের অনেক কাজ পড়ে ছিল।’
মনোযোগ দিয়ে শোনে নীরব, ’তারপর?’
‘তারপর – আমাকে দেখে ওর আম্মু খুশি হয়ে গেলেন। ওদের বাসাতে খুব কম যাই আমি। আর আমাকে কেন জানি আন্টি বিশেষ পছন্দ করেন। সোজা আমাকে ক্রিশ্চিনার রুমে চলে যেতে বললেন উনি। আমিও গেলাম। রুমটা চিনি। নক করেছিলাম কয়েকবার।’
‘দরজা খুলল না?’ জানতে চায় নীরব।
‘না। খুলল না। তখন বাধ্য হয়েই আস্তে করে নব ঘুরিয়ে খুলে ফেলি আমি দরজা। দেখলাম -’
দিনার থেমে গেছে।
ওর চোখ দেখে বোঝা যায় যে কথাটা বলতে চাইছে সে – সেটা নিজেই বিশ্বাস করে না।
‘একটা পেন্টাকল আঁকা ঘরের মাঝে। সেখানে হিবিজাবি অনেক কিছু লেখা ছিল ল্যাটিনে। আর পেন্টাকলের ঠিক মাঝে একটা কালো ছায়া। পুরো ঘরে আর কেউ নেই। শুধু ওই ছায়াটা। ছায়াটা মোটেও মানুষের মত কিছু না। আকৃতিতে একটা পিলারের মত বলা চলে। গোল, আর লম্বা এক পিলার। সেখান থেকে আমি স্পষ্ট শুনলাম ক্রিশ্চিনার গলা, অসন্তোষ সেখানে, “দূরে সরে দাঁড়াও, দিনার!” তারপর হঠাৎ সব কালো অন্ধকার হয়ে যায়। আমার মনে হয় আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।’
ঢোক গেলে দিনার সেদিনের অভিজ্ঞতা মনে পড়াতে।
তারপর আবার বলে যায়, ’মেয়েটাকে আমি পরের সেকেন্ডে দেখি। ঠিক আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একই ঘরে। তবে কোন পেন্টাকল সেখানে নেই। আমাকে একটা পেনড্রাইভ ধরিয়ে দেয় ও তাড়াহুড়ো করে, শুধু একবার বলল, “অ্যাসাইনমেন্টের পুরোটাই আছে। নিজের মত এডিট করে নাওগে।” অথচ ওকে আমি তখনও বলি নি আমার অ্যাসাইনমেন্ট দরকার।’
সবাই চুপ হয়ে যায়, মাথা দোলায় নীরব।
‘ইন্টারেস্টিং। বুঝতে পারলাম।’
একসাথে প্রশ্ন ছুটে আসে ওর দিকে, ’কি?’
‘ক্রিশ্চিনা।’ উঠে দাঁড়ায় নীরব, ’নিজেও একটা সিক্রেট সোসাইটির সাথে যুক্ত। তোমাদের কথা যদি ঠিক হয়ে থাকে – মেয়েটা একসাথে দুই নৌকাতে পা রেখেছে। আমি জানি না এর পরিণাম কি হতে পারে। হয়ত একেবারেই উন্নতির শীর্ষে চলে যাবে ও – পাবে প্রচন্ড ক্ষমতা। অথবা টুকরো টুকরো হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে ও।’
‘আমাদের কি জানাবে ঠিক কি নিয়ে কথা বলছ তুমি?’ অধৈর্য হয়ে যায় সদানিশ্চুপ শাহেদও।
ওর দিকে তাকায় নীরব, ’মিথরাস। সিক্রেট সোসাইটি মিথরাসের নাম শুনেছে এখানে কেউ?’
সুন্দর চুলগুলো দোলায় প্রিয়াংকা, ’আমি শুনেছি। সূর্যদেবতা। তাই না?’
প্রশংসার দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায় নীরব, ’ঠিক সূর্যদেবতা বলেই রেখে দিলে হবে না – মিথারাসের পরিধি অনেক বিস্তৃত। প্যাগানিজম নিয়ে জানো তোমরা?’
ক্লাস নেওয়ার মত করে সবার দিকে তাকায় নীরব।
‘পেগানিজম – আর খ্রিস্টধর্ম – একে অপরের সাথে কিছুটা জড়িত, ডিয়ার ফেলোস। পেগানিজম হল সেই বিশ্বাস – যেখানে একেশ্বরবাদকে সম্পূর্ণ বিরোধীতা করা হয়। পেগানিজমে বিশ্বাসীদের বলা হয় পেগান। এরা যে কোন শক্তিকেই – তাদের প্রভু হিসেবে বিশ্বাস করতে প্রস্তুত ছিল। বহু-ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলেও এদের ঈশ্বরদের কিন্তু সনাতন ধর্মের – মানে, হিন্দুদের দেবতাদের মত নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। পেগানরা ক্ষণে ক্ষণে তাদের ঈশ্বর পাল্টে ফেলত। যখন যা তাদের প্রভাবিত করছে – সেটাকেই তারা দেবতা বলে মেনে নিত। কারণটা সহজ, ওরা পাগল ছিল না। তবে ওদের ধারণা ছিল – ঈশ্বর নিজেকে পাল্টে ফেলেন তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী। এজন্যই অকুন্ঠ শ্রদ্ধা ওরা দিত তাদের প্রয়োজনে আসা সব প্রভাব রাখার মত বস্তুকেই।’
মাথা চুলকায় দিনার, ’পেগানদের রোমের শাসকরা ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিয়েছিল না? খ্রিস্টধর্মে নবদীক্ষিত সম্রাটদের মতে বহু-ঈশ্বরে পূজো করা স্রেফ ভন্ডামি। এর শাস্তি মৃত্যুদন্ড – এরকম কঠোর হস্তে তাদের দমন করা হয়েছিল। দলে দলে লোকেরা গ্রহণ করেছিল খ্রিস্ট ধর্ম। তাই না?’
মাথা দোলায় নীরব, ’বন্দুকের নল সব সময় ক্ষমতার উৎস হয় না হে। পেগান থেকে খ্রিস্টান হয়েছিল এমন সবাই সম্ভবতঃ খ্রিস্টান বলে নিজেদের মানেনি। শুধু ভেক ধরেছিলেন নিজেদের খ্রিস্টান পরিচয় দিয়ে। মনেপ্রাণে থেকে গেছিলেন পেগান। পরবর্তীতে – এদের অনেকের বংশধররাই খ্রিস্টধর্মকে মেনে নেয়। কারণ, বাবাদের বা দাদাদের মনের মাঝে কেনই বা পেগানিজম লুকিয়ে আছে – তার তাৎপর্য তাদের জানার কথা নয়। চারপাশে খ্রিস্টান পরিবেশ। কেনই বা পেগান হবে তারা? জেনারেশন বাই জেনারেশন খাঁটি খ্রিস্টান হয়ে ওঠে তারা। যদি খ্রিস্টধর্মকে খাঁটি বলা যায় আর কি!’ মুখ বাঁকায় নীরব।
‘কিছু একটা এড়িয়ে যাচ্ছ?’ পাশ থেকে জানতে চায় শাহেদ।
‘পেগানদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে বড় ধরণের ভুল করেছিলেন সম্রাটরা। খ্রিস্টধর্মে পেগান বিশ্বাস চলে এসেছে অনেকগুলোই। তাদের মাঝে অনেকগুলো আজ প্রতিষ্ঠিত।’
হাত তোলে দিনার, ’আমি যতদূর জানি, ঈসা(আঃ) – যাকে খ্রিস্টানরা যীশু খ্রিস্ট বলে – তাঁর জন্ম এপ্রিলে। অথচ পেগান উৎসবের তারিখ ২৫ শে ডিসেম্বর মেনে নিয়ে তারা সেটাকেই আজও ক্রিসমাস ডে বলে বিবেচনা করে। পেগান ক্রস একটু পাল্টে ক্রিস্টানদের ক্রসে পাল্টে গেছে আজ। খ্রিস্টানদের প্রার্থনাভঙ্গী আসলে পেগানদের প্রার্থনাভঙ্গীই। পেগানদের অনেক কিছু এক অর্থে আজকের খ্রিস্টধর্মে ঢুকে গেছে পুরোপুরি।’
মাথা নাড়ে নীরব, চেহারাতে স্পষ্ট বিরোধীতার ভাব, ’এখানেই – মাই ডিয়ার দিনার, ভুল করে সবাই। পেগানদের দিকে সবার নজর। কিন্তু আসলে, পেগান নয় – খ্রিস্টধর্মে ঢুকে গেছে মিথরাসের বিশ্বাস।’
চমকে ওঠে প্রিয়াংকা, ’মিথরাস?’
সম্মতিসূচক মাথা দোলায় নীরব, ’মিথরাস।’
তিন
মৃদু আলোতে তিনজোড়া চোখের আগ্রহী দৃষ্টি দেখতে ভালো লাগে নীরবের।
‘মিথরাস – আগেই বলেছিলাম, সূর্যের দেবতা বলা যায় একে। পেগান সভ্যতার ধর্ম পেগানিজম ছিল না। ধর্মটা ছিল মিথরাস। ইন্দো-ইরানিয়ান সূর্য দেবতা। পারসিয়ানদের মাঝে এই ধর্ম প্রচলিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের দিকে। বুঝতেই পারছ – পেগানদের উৎস কোনটা? এই মিথরাস। পারসিয়ানরা বল একে’মেহের’। মেহের ছিল তাদের রক্ষাকর্তা। অসীম ক্ষমতা ছিল মেহেরের – অন্তত পারসিয়ান ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী।’
ওদের শ্বাস টেনে নেওয়ার শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোন শব্দ নেই। সবাই কান পেতে শুনছে নিরবের কথা।
‘হিন্দু ধর্মের দিকে যদি চোখ ফেরাই এবার আমরা, ’মিত্রা’ বলে একজন দেবতাতে তারা বিশ্বাস রাখে। যদিও’বরুণ’ দেবতার সাথে একে স্মরণ করা হত। এজন্যই বরুণের ছায়াতে ধীরে ধীরে কালক্রমে ঢেকে গেছে মিত্রা। তবে এই মিত্রাটি হল সেই সূর্যদেবতা – যেটা কিনা পারসিয়ানদের মেহের। ঋদ্বেগে আছে মিত্রাকে নিয়ে স্তুতিবাক্য। পারসিয়ানরা যখন নিজেদের ধর্ম থেকে সব দেবতাদের অস্বীকার করছিল তখনও মিথরাসকে তারা রেখে দেয়। তাকে ওরা মেহের বলে – যার অর্থ হল বন্ধুত্ব, ভালোবাসা এবং সূর্য। মজার ব্যাপার হল মিশরীয়দের সূর্যদেবতা “হোরাস” কিন্তু অনেকটা এমনই ছিলেন।’
বাঁধা দেয় প্রিয়াংকা এবার,
‘মিথরাস নিয়ে জানাটা দরকার কেন? ক্রিশ্চিনা সেই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে পারে? আমার জানা মতে মিথরাস শয়তানের বিরোধী সত্ত্বা বলে বিশ্বাস করা হয়। আর এদিকে দিনার যা দেখে এসেছে – তা কিন্তু স্পষ্ট করে আমাদের ক্রিশ্চিনা শয়তানের পূজো করে।’
ওর দিকে তাকায় নীরব, ’পেন্টাকল আর ল্যাটিন প্রমাণ করে না ক্রিশ্চিনা শয়তানের পূজারী। আমাকে একবার দেখতে হবে ওটা। তবে সেটা তো সম্ভব না। এখানে বসে যদি আমাকে অনুমান করতে বল তোমরা – আমি অনুমান করব ক্রিশ্চিনা শয়তানের পূজারী।’
অবাক হয় প্রিয়াংকা, ’এই মাত্র না বললে, তুমি পেন্টাকল আর ল্যাটিন দেখে মানতে চাওনা ক্রিশ্চিনা শয়তানের পূজারী।’
হাসে নীরব, ’না। মানা উচিতও না। তবে আমার বিশ্বাস ও শয়তানের পূজো করছে – কারণ, ওই মিথরাস।’
‘মিথরাস শয়তানের বিরোধী সত্ত্বা।’ আবার বলে প্রিয়াংকা। শক্ত হয়ে আছে মুখ।
‘চাইনিজ মিথোলজী তাই বলে। মিথরাস শয়তানের হাত থেকে ত্রাণকর্তা। তবে শয়তান আসলে কে? শয়তান কাকে বলা হচ্ছে এখানে? আবার ফিরে যাই যদি আমরা ভারতীয় ’মিত্রা’র দিকে? বরুণ আর মিত্রার মিলিতরূপ হল অসুর। এখানেই আসছে শয়তান।’
হা হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে শাহেদ আর দিনার। প্রিয়াংকা একটু কষ্ট করে মেনে নেয় ওর কথাগুলো এতক্ষণে।
‘এবার মাই ডিয়ার ফেলোস, আরেকটা চমকের জন্য অপেক্ষা কর। পেগানদের কথা বলেছিলাম। তবে তারা কিন্তু শুধুই মিথরাসদের শাখা বা বিবর্তিত রূপ বলা চলে। অনেকে মনে করে পেগান উৎসবের তারিখ ২৫ শে ডিসেম্বর? আরে না – মিথরাস দেবতার জন্মদিন ২৫ শে ডিসেম্বর। সূর্যদেবতা। মনে আছে? ২৫ শে ডিসেম্বরই পৃথিবী সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান করে। শীতের চরম রূপ। এরপর ধীরে ধীরে সূর্যের দিকে এগিয়ে আসে পৃথিবী। শীত দূর হয় ল, গ্রীষ্ম আসে। সূর্যের কাছে এগিয়ে আসাটাই কি সূর্যের জন্মদিন নয়? সেখান থেকেই খ্রিস্টধর্ম প্রভাবিত। মিথরাস দেবতার জন্ম ভার্জিন মাতা থেকে। মিথরাস রবিবারকে পবিত্র মনে করে। ওদের হতে হয় ব্যাপ্টাইজড। যেটা খ্রিস্ট ধর্মে ঢুকে গেছে ওতোপ্রোতভাবে। তারপর মিথরাস ফাদার আর ক্যাথলিক ফাদারদের মাঝে মিল তো আছেই। খেয়াল করে দেখ – পেগানদের সাথে মিল খুঁজলে পাবে কিছু, তবে সবটা নয়। অথচ মিথরাসের সাথে খুঁজলে সব বের হয়ে আসছে ওদের সদৃশ।’
একটু কেশে নেয় এবার শাহেদ, ’তাহলে, মিথরাস হল খ্রিস্টধর্মের ভেতর পর্যন্ত প্রভাব রাখা একটা ধর্ম। তারওপর শয়তানের রাস্তা এর থেকে খুবই কাছে? ক্রিশ্চিনার ব্যাপারটা তাহলে কি?’
‘ক্রিশ্চিনা দুই নৌকাতে উঠছে। ওকে সূর্যের দিকে তাকিয়ে কি চোখে রোদ না পড়ে এমন করতে দেখেছিলে? নাকি স্যালুট করছিল?’
কাঁধ ঝাঁকায় প্রিয়াংকা, ’স্যালুট করছিল। আর্মিদের মত।’
‘মাই গড!’ বিড় বিড় করে নীরব।
ধরে ফেলে ওটা দিনার, ’কি হয়েছে? স্যালুট করাটা কি বিশেষ অর্থ?’
তার দিকে না তাকিয়েই বলে নীরব, ’অবশ্যই। ধারণা করা হয় রোমান মিথরাসের কাছ থেকেই আসে স্যালুট আর হ্যান্ডশেকের ধারণা। মুসলমানরা এজন্য হ্যান্ডশেকের ঘোর বিরোধী – তারা করে মুসাফাহা। খ্রিস্টান প্রথাতে ওটা আছে আবার। মিথরাসরা সূর্যের দিকে তাকিয়ে স্যালুট দেয়। এটাই ওদের প্রথা। প্রথার বাইরে যায় নি ক্রিশ্চিনা। আমার ধারণা – ক্রিশ্চিনার পরিবার – মানে, ওর পূর্বসূরীদের কেউ ছিলেন মিথরাস। আজকের যুগে তারা ক্রিস্টান নাম নিয়ে চলছে – কারণ তাঁদেরও কেউ জোরপূর্বক চাপে এনে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করিয়েছে।’
মাথা চুলকায় শাহেদ, ’এখানে শয়তানের সম্পর্কটা ঠিক বুঝলাম না।’
হাসে নীরব, হাসিতে তিক্ততা, ’বলেছিলাম না আরেকটা চমক আছে তোমাদের জন্য? পেগানদের বিশ্বাস ছিল আগুন,মাটি, পানি, বাতাস – মানে ইলুমিনেটাস নিয়ে। আর আসলে ওটা ছিল মিথরাস ধর্ম – মিথরাস বিশ্বাস। মিথরাসদের আরও দুটো শাখার নাম শুনবে? নাইট টেম্পলার এবং ফ্রি-মেসনারী।’
এবার তিনজনই প্রায় লাফিয়ে ওঠে।
চিৎকার দিয়ে ওঠে দিনার, ’ফ্রি মেসন? ফ্রিমেসনরা এসেছে মিথরাস থেকে? এরাই কি তারা না যারা শয়তানের পূজো করে দাজ্জালকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য? শয়তানের একনিষ্ঠ পূজারী তারা! ধারণা করা হয় আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের প্রত্যেকেই এর সদস্য ছিলেন। পৃথিবীটাকে যদি কেউ গ্রাস করে নেয় তবে এই ফ্রি মেসন। ক্রিশ্চিনাও ফ্রিমেসনের সদস্য?’
‘সম্ভবতঃ।’ মাথা দোলায় নীরব, ’আমেরিকার প্রতিটি প্রেসিডেন্ট ফ্রিমেসন ছিলেন কিনা তা হয়ত বলা যাবে না। তবে বিশতম প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড যে নিঃসন্দেহে এজকন ফ্রিমেসন ছিলেন – তা সন্দেহের উর্ধ্বে। এটাই ফ্রি-মেসনের সাথে মিথরাসের সম্পর্কের অকাট্য দলীল। ১৮৭০ সালে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে একেবারেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল ডকুমেন্টে কি লেখা ছিল জানো?’
একবার দম নেয় নীরব, ’Garfield, James Abram,. Address at the Mitharas Lodge of Sorrow, Washington, November 10, 1881’
মিথরাস লজ অফ সরো!
ওদের পিঠের শীতল একটা অনভূতি হয়। শয়তানের পূজারির আধিক্য অবশ্যই অ্যান্টি-ম্যাজিকাল সোসাইটির বিরুদ্ধে যায়।
সেই সাথে যাচ্ছে পৃথিবীর বিরুদ্ধেও।
‘আরও আছে – ব্রিটিশ জাদুকর অ্যালিস্টার ক্রউলি – বিখ্যাত তিনি। ইনি মিথারাস কাল্টের প্রধান ছিলেন সম্ভবত ১৯২২ সালে। এত সাল তারিখ মনে থাকে না। ওদিকেই কিছু একটা হবে। তবে কথা হল – ইনি ফ্রিমেসন হিসেবেও নিজেকে পরিচয় দিতেন। শয়তানের কট্টর উপাসক ছিলেন এই লোক।’
শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করে দিনার, ’ক্রিশ্চিনার হতে বাধা কোথায় তাহলে?’
প্রিয়াংকার চেহারাও ফ্যাকাসে হয়ে আছে, ভয় পেয়েছে মেয়েটা।
মৃদুস্বরে বলে ও, ’ক্রিশ্চিনার ছোটবোনটা কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ, পুলিশ অনেক খুঁজেছে। দুঃখ পেয়েছিলাম তখন শুনে। পরে দেখলাম ক্রিশ্চিনার মধ্যে বিকার নেই। ক্লাসে ধুমিয়ে প্রেম করে যাচ্ছে জারাফের সাথে। এখন তো মনে হচ্ছে কাজটা ক্রিশ্চিনারই।’
ঝট করে ঘুরে তাকায় নীরব, ’কি বললে?’
‘ক্রিশ্চিনার ছোটবোন কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ। কেউ জানিস না?’ অবাক হয় প্রিয়াংকা এবার।
‘ম্যাগাস! ড্যাম ইট!’
নীরবের শান্ত চেহারা থেকে এরকম একটা চিৎকার বের হতে পারে ওরা না দেখলে বিশ্বাসই করত না।
চোখ দুটো জ্বলছে নীরবের প্রচন্ড রাগে। দরজার দিকে রওনা দেয় ও।
খপ করে ওর হাত আটকে ফেলে দিনার, ’কি হয়েছে? যাচ্ছ কোথায়?’
হাতটা ছাড়িয়ে নেয় নীরব, ’ক্রিশ্চিনার বাসাতে।’
‘কেন?’ এবার পথরোধ করে প্রিয়াংকা।
‘ম্যাজিস্টার টেমপ্লি ধাপে ছিল ক্রিশ্চিনা – শয়তান সাধনাতে। এটা এখন সুনিশ্চিত! এরপর একটি শিশুর বলী দিতে হয় পরের ধাপে উঠতে। ম্যাগাস স্তর। সেখানে উঠেছে বদ মেয়েটা। নির্ঘাত বলী দিয়েছে নিজের ছোটবোনকেই! পিশাচিনী!’
ক্রোধে মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে যায় শাহেদের হাতও, ’এখন ওর বাসাতে গিয়ে কি লাভ?’
‘অর্ডার অফ দ্য সিলভার স্টার!’ ব্যস্ত স্বরে বলে নীরব, ’ম্যাজিস্টার টেমপ্লি হল অষ্টম স্তর। নবম হল ম্যাগাস। আরেকটা ধাপ পিছিয়ে দশম আর সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছতে ওর! ইপসিসিমাস স্তরে একবার পৌঁছে গেলে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে মেয়েটা। স্রেফ শয়তানের পূজারী থেকে শয়তানের বন্ধুতে রূপান্তরিত হবে ও! যেখানে সেখানে নিমেষে চলে যাওয়ার ক্ষমতা সে পাবে! আর ঠেকানো যাবে না ওকে!’
ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলে নীরব, ’তাছাড়া, এই কাজে সফলতার জন্য একজন কুমারী মেয়েকে বলী দিতে হবে ওর। আসছ তোমরা?’
চার
চারজনের ছোট্ট দলটা যখন গাড়িতে করে এসে থামে ক্রিশ্চিনাদের বাসার সামনে – চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
দিনার যেহেতু আন্টির কাছে পরিচিত – ওকেই ভেতরে পাঠায় ওরা।
একটু পরেই হতাশ হয়ে ফিরে আসে ও।
‘কি হল?’ জানতে চায় নীরব।
‘আন্টি বলল, আজ রাতে বাইরে থাকবে ক্রিশ্চিনা। আন্টির মন মেজাজ ভালো দেখলাম না। ছোট্ট মার্গারেটকে খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনও।’
ড্যাসবোর্ডে ঘুষি মারে শাহেদ, ’বদ মেয়েটা বলী দিয়েছে নিজের বোনকে! মার্গারেটের মত ফুটফুটে একটা মেয়েকে জবাই করতে ওর হাত কাঁপে নি?’
ওকে স্পর্শ করে শান্ত করে নীরব। একবার তাকায় দোতলা বাড়িটার দিকে।
‘দিনার, আমাকে তথ্য দাও। কোন ঘরটা ক্রিশ্চিনার?’
ভ্রু কুঁচকে তাকায় দিনার, ’তুমি নিশ্চয় ভাবছ না -’
অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নীরব।
আর বাক্যবিনিময় না করে দোতলার একটা ঘর দেখিয়ে দেয় এবার দিনার।
কোনদিকে না তাকিয়ে একটা পাইপ বেছে নেয় নীরব। তারপর বেয়ে বেয়ে উঠতে থাকে।
দশ মিনিটের মাঝেই অবশ্য যে পথে গেছিল সেপথেই নেমে আসে নীরব।
‘পেয়েছি। একটা ঠিকানা। পরিত্যক্ত এই বাসাটার ছবি আর ডিটেইলস কেন রাখবে ক্রিশ্চিনা তার ল্যাপটপে?’
একটা ঠিকানা দেখায় নীরব তার স্মার্টফোনে। ঝুঁকে আসে সবাই।
‘চলো, যাওয়া যাক।’ গাড়ি স্টার্ট দেয় শাহেদ।
‘খালি হাতে? সম্ভবতঃ ওখানে আজ কুমারী বলী দিতেই গেছে ক্রিশ্চিনা।’ বিড় বিড় করে বলে নীরব।
‘তাহলে?’ শুকিয়ে যাওয়া গলা নিয়ে তাকায় প্রিয়াংকা।
‘একটা কাজ কর – তোমরা পুরো শহরকে জাগিয়ে নিয়ে আসো ওখানে। সবাই যাতে হাত মশাল আর পবিত্র পানি রাখে। ঠিক আছে? একটি প্রাণ হয়ত বাঁচবে। শুধু দিনার আসো আমার সাথে। আমরা আগে গিয়ে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করব ওদের।’
মেনে নেয় ওরা। গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটে চলে দিনার আর নীরব।
উদ্দেশ্য – শয়তানের আখড়াতে ঢোকা।
*
বিশাল বাড়িটার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখে চারপাশটা একবার দেখে দিনার। ছেলেটা ভয় পাচ্ছে।
ওর কাঁধে দুইবার চাপড়ে দেয় নীরব।
‘কি?’ প্রশ্ন করে দিনার।
‘দিনার, ছেলে হিসেবে খুব একটা মন্দ নও তুমি। তোমাকে আমি ভেতরে ঢুকতে দিতে পারি না। প্রাণ হারাবে – নিঃসন্দেহে।’
নীরবের চকচকে চোখের দিকে তাকিয়ে দিনারের বুকের ভেতরটা শুকিয়ে যায়। অশুভ একটা দৃষ্টি ফুটে আছে নীরবের চোখে। যেন বহুদিনের ক্ষুধার্ত।
সেই সাথে হাতে বের হয়ে এসেছে একটা পিস্তল। নীরব পিস্তল সাথে রাখে কবে থেকে?
‘আমি কি করব তাহলে?’ শুকিয়ে যাওয়া গলা দিয়ে কোনমতে বলে দিনার।
‘এখানে অপেক্ষা কর। এলাকাবাসী আসলে একসাথে ঢুকবে। আমি ঢুকছি এখনই। তবে আমাকে ফলো করার চেষ্টা করবে না।’
মাথা ঝাঁকায় দিনার। নীরবের যে চেহারা সে দেখছে – তাতে আর ফলো করার ইচ্ছে থাকার কথাও না।
দিনারের বড় বড় হয়ে যাওয়া চোখের সামনে দিয়ে অন্ধকারে ঢুকে যায় নীরব।
ঠক ঠক করে কাঁপে দিনার এতক্ষণে। কেন জানি তার মনে হয় হঠাৎ করেই তাপমাত্রা কমে গেছে এলাকার।
এর একটা কারণ হতে পারে – পুরোনো এই বিল্ডিংটা থেকে ভেসে আসছে একটা গমগমে শব্দ। ভেতরে কেউ মন্ত্র পড়ছে।
নির্ঘাত বলী দেওয়া হবে এখানে আজকে। কেউ মারা যাচ্ছে আজ রাতে – যদি না নীরব সেটা ঠেকায়। অথবা এলাকাবাসীকে নিয়ে প্রিয়াংকা ঢুকে পড়তে পারে সময়মত।
পরমুহূর্তেই একটা প্রশ্ন ধাক্কা দেয় দিনারকে, নীরব এত দ্রুত কিভাবে ক্রিশ্চিনার ল্যাপটপ হ্যাক করে ঠিকানা পেয়ে গেল?
তাও হাজার হাজার মেগাবাইটের ভেতরে ঠিক ওই তথ্যটাই? এই বাসার ঠিকানা?
নীরবের মাথায় এখন প্রশ্ন আসার সম্ভাবনাই নেই। খুব সাবধানে একটা একটা পা ফেলছে ও। হাতে তুলে রেখেছে উদ্যত পিস্তলটা।
ছাদের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ও। সিঁড়িঘর থেকে হাল্কা উঁকি দিয়ে দেখে ছাদটা।
চকচকে পরিষ্কার একটা ছাদ। ঠিক মাঝখানে একটা বিশাল বৃত্ত এঁকে রাখা হয়েছে। বৃত্তটার আশেপাশে রক্তের ছাপ।
যদিও এখানে মৃত বা আহত কেউ নেই। ধরে নেয় নীরব, এসব মার্গারিটের রক্ত। ক্রিশ্চিনার ছোটবোনের।
এই মুহূর্তে ছাদের মাঝে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়ছে একজন মানুষ।
আর বৃত্তে বেঁধে রাখা হয়েছে একটি মেয়েকে। অসামান্য সৌন্দর্য্য এখন হয়ে গেছে ম্লান।
ছাদের মাঝে উঠে আসে নীরব। ঘুরে তাকাচ্ছে মন্ত্র পড়তে থাকা মানুষটা – টের পেয়ে গেছে পেছনে কারও উপস্থিতি!
একটি মাত্র গুলির সাহায্যে তার মাথাটা বিস্ফোরিত করে দেয় নীরব।
বিড় বিড় করে বলে, ’টোমা মি রিগ্যালো!’
গুলির শব্দটা দূর থেকে দূরে প্রতিধ্বনীত হয়। সেই সাথে দূরে কোথাও হৈ হৈ শব্দ শোনা যায়। ছুটে আসছে এলাকাবাসী।
গুলির শব্দ তাদের কানে গেছে!
চক্রের মাঝে হাত পা বাঁধা মেয়েটা কাঁদছে। চাঁদের আলোতে ফিরে তাকায় নীরব ওর দিকে।
‘ডিয়ার ক্রিশ্চিনা! তুমি ভার্জিন!’ কৃত্রিম বিস্ময়টা ফুটিয়ে তোলে নীরব।
তারপর ফেটে পরে হাসিতে। যেন এর চেয়ে বড় রসিকতা আর কিছুই হতে পারে না!
পড়ে থাকা জারাফের শরীরটাকে জোরে লাথি দেয় নীরব।
চিত হয়ে যায় মানুষটা।
‘তোমাকে কেন বের করছি না আমি এখান থেকে? সেটাই ভাবছ তো? না না – নিজের বোনকে জবাই করে ম্যাগাস স্তরে ওঠার জন্য তোমাকে আমি দোষ দেই না। এই কাজ আমাকেও করতে হয়েছে একদিন।’
হা হয়ে তাকিয়ে থাকে ক্রিশ্চিনা। হাসে নীরব সুন্দর করে।
‘আমি একজন ফ্রিমেসন, ক্রিশ্চিনা। এবং মিথরাস। ঠিক তোমারই মত। তোমার সাথে আমার জমত ভালো! তবে কুমারী পাওয়া তো আর চারটি খানি কথা না। এলাকায় তোমাকে শয়তানের পূজারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিতও করেছি। আমাকে আগেও কেউ খোঁজেনি। এখনও খুঁজবে না।’
আস্তে করে জারাফের লাশের হাতে ধরে রাখা ছুরিটা তুলে নেয় নীরব। ক্রিশ্চিনার চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসে।
মন্ত্র পড়ছে নীরব। এলাকাবাসীর হুংকার আরও কাছে এখন।
দরজা থেকে যখন আর মাত্র বিশ গজ দূরে জনতার কোলাহল – মন্ত্র আবৃত্তি শেষ হয় নীরবের।
ছুরিটা তুলে ধরে ও।
কোমল গলাতে বলে, ’একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। আমিও ম্যাগাস স্তরে। তবে আর কয়েক মুহূর্তের জন্য! দশম স্তর ইপসিসিমাস না – আমি চলে যাব একাদশ স্তরে আজ রাতে – যেটার কথা কেউ জানেই না। তোমার গাধা বয়ফ্রেন্ড জারাফকে ধন্যবাদ। নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছে ও। জোড়া বলী দিতে পেরেছি আমিও। ধন্যবাদ, ক্রিশ্চিনা।’
তীব্রবেগে নামিয়ে আনে নীরব ছুরিটা।
একবার মুচড়ে উঠে স্থির হয়ে যায় ক্রিশ্চিনা। সুন্দর চোখ দুটোতে বেদনার চেয়ে বেশি কাজ করছে বিস্ময়!
পরিশিষ্ট
কাঁপা গলাতে শুধু বলতে পারে দিনার, ’ভেতরে। ও ভেতরে।’
প্রিয়াংকা এক হাত খামচে ধরে ওর। তারপর এলাকার সবার সাথে ঢুকে পড়ে ওরাও বাসাটাতে। সবার হাতে জ্বলছে মশাল। আগুণের সামনে দুর্বল হবে প্রতিপক্ষ!
দিনার নিজেকে দোষারোপ করে যাচ্ছে।
মনে মনে।
একটা উল্কি দেখে কিভাবে ও বিশ্বাস করতে পারল নীরবের মত একটা উচ্চপর্যায়ের সাধককে?
সবার সাথে টলতে টলতে ছাদে যাচ্ছে ও ঠিকই – জানে ওখানে কি পাওয়া যাবে।
কানে বাজছে নীরবের কথা, ’অর্ডার অফ দ্য সিলভার স্টার! ম্যাজিস্টার টেমপ্লি হল অষ্টম স্তর। নবম হল ম্যাগাস। আরেকটা ধাপ পিছিয়ে দশম আর সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছতে ওর! ইপসিসিমাস স্তরে একবার পৌঁছে গেলে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে মেয়েটা। স্রেফ শয়তানের পূজারী থেকে শয়তানের বন্ধুতে রূপান্তরিত হবে ও! যেখানে সেখানে নিমেষে চলে যাওয়ার ক্ষমতা সে পাবে! আর ঠেকানো যাবে না ওকে!’
ছাদে উঠে সবাই চুপ হয়ে যায়।
পড়ে আছে দুটো মৃতদেহ।
কোথাও চিহ্নও নেই নীরবের।
— ০ —
রচনাকাল – জুলাই ০৩, ২০১৪
Leave a Reply