কনফেশন অফ আ রাইটার
‘অ্যাই ছেলে, জামাটা কতদিন ধরে ধোস না তুই?’
আফরিতার কথা শুনে একটু হাসলাম। তারপর উদাস ভঙ্গিতে জবাব দিলাম, ‘যতদিন ধরে গোসল করি না।’
দ্বিগুণ বিস্ময়ের সাথে মেয়েটা প্রশ্ন করে, ‘কতদিন ধরে গোসল করিস না?’
পরীর মত মেয়েটার কথার উত্তর না দিয়ে আমি হাই তুলতে থাকি। আমার অসময়ে বেশরমের মত হাই তোলা দেখে পরীটি বিরক্ত হল।
‘বলবি না?’
গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে উত্তর দিলাম, ‘সাত দিন।’
আফরিতার মুখ বন্ধ হয়ে গেছে।
মুখ বন্ধ হওয়ার জন্য তাকে দোষ দিলাম না। অল্প শোকে কাতর – অধিক শোকে পাথর।
পাশে একটা পাথর-পরী নিয়ে বসে থাকার অনুভূতিটা খারাপ না।
পার্কের ভেতর বসে আছি। আশেপাশে একটা ভূতও নেই। মানুষ তো দূরে থাকুক।
একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এরকম একটা পরিবেশে আসলে মিষ্টি মধুর আলাপ করে। আর আমরা এখানে আলাপ করছি জামার দুর্গন্ধ কত হতে পারে, কয় দিনের পুরোনো হতে পারে – তা নিয়ে।
খারাপ কি?
বন্ধু পিয়াসের কথা মনে পড়ল।
ভূতুড়ে বাড়িতে কেস স্টাডি করতে যাব শুনে আমাকে ছেলেটা প্রশ্ন করেছিল, ‘ভূত যদি আসলেই চলে আসে – কি করবি?’
ঘাস চিবুতে চিবুতে বলেছিলাম, ‘মেরে ফেলব।’
অবাক হয়ে পিয়াস জানতে চেয়েছিল, ‘কিভাবে মারবি?’
থু থু দিয়ে ঘাসটুকু ফেলে দিয়ে বললাম, ‘থাপ্পড় দিয়ে।’
ফিক ফিক করে হেসে পাজিটা বলে দেয়, ‘এত কষ্ট করতে হবে না – তোর জামার গন্ধ শুঁকিয়ে দিস। ওখানেই মরে যাবে।’
ফিক ফিক হাসিটা সহ্য করতেই হল। আমার জামার গন্ধে ভূত পালালে সেটা অবাক করার মত ব্যাপার।
কারণ, এই গন্ধে ওদের মরার কথা। একেবারে স্পট ডেড!
পালানোর প্রশ্নই আসতে পারে না!
ভূত মরে যাওয়া গন্ধের জামা কাপড় নিয়ে বসে থাকলেও আফরিতা মরে যাচ্ছে না। এমনকী পালাচ্ছেও না।
পিয়াসের চেহারাটা দেখতে ইচ্ছে করছে। আফরিতাকে অক্সিজেন মাস্ক ছাড়াই আমার ছয় ইঞ্চি দূরে বসে থাকতে দেখলে ও স্রেফ হার্টফেল করবে।
আফরিতাকে বড় করে শ্বাস নিতে দেখলাম। বুঝলাম মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত।
মেয়েটা এখন বিশাল একটা ভাষণ দেবে।
যেটা শুনলেও আমার বিপদ। আবার না শুনলেও বিপদ।
উভয় সংকট আর কাকে বলে!
‘তোকে আমি আজ সাবান কিনে দেব। আর শ্যাম্পু। আমি জানি – এগুলার কিছুই তোর রুমে নাই। কন্ডিশনারও কিনে দেব তোকে। আর হুইল পাউডার। তারপর তুই তোর রুমটা ধুয়ে পরিষ্কার করবি। এর পর তোর জামা কাপড় সব ধুয়ে দিবি। তারপর তুই গোসল করবি। তারপর পরের দিন ক্লাসে আসবি। নোংরা জামা কাপড় পরে ক্লাসে আসলে তোর জামা আমি ছিঁড়ে ফেলব। বুঝতে পেরেছিস?’
আমি মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে মেয়েটাকে আশ্বস্ত করলাম – তার কোন কথা আমি বুঝতে পারিনি।
অথবা বুঝতে চাইনি।
আফরিতা কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি ওর দৃষ্টিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে আরেকটা হাই তুললাম। তারপর পকেট থেকে গোল্ডলীফের প্যাকেটটা বের করে কসরত করে সিগারেট ধরালাম একটা।
ধুঁয়ো উড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা আমার কাছে অসাধারণ লাগে। আমি হা হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকি।
ফোঁস ফোঁস শব্দ হচ্ছে।
ডান দিকে তাকাতে না তাকাতেই খপ করে আমার হাত থেকে সিগারেটটা কেড়ে নিল কেউ।
‘এখন আমি এটা টানি?’ ফোঁস ফোঁস শব্দের ধারা অব্যাহত রেখে জানতে চাইল আফরিতা।
‘ক্ষেপে আছিস কেন?’ জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না। সিগারেট হারানোর বেদনা প্রশ্নটার উদ্ভাবক হতে পারে – আমি নিশ্চিত নই।
‘রাতে ঘুমাবি না। দিনে গোসল করবি না। নোংরা একটা ঘরে থাকবি। খাবি না ঠিকমত। আবার সিগারেটও টানবি! তারপর আবার জানতে চাইবি ক্ষেপে আছি কেন?’
‘হুঁ।’ মাথা নীচু করে বললাম।
সিগারেটটা একদিকে ফেলে দিয়ে আমার কলার ধরে নিজের দিকে ফেরায় ও।
‘আমার দিকে তাকা!’
তাকালাম। নতুন কিছু নেই।
পরীর মত দেখতে একটা মেয়ে। দুই চোখে রাগ। ঠোঁট দুটো চেপে আছে একটা আরেকটার সাথে।
কান দিয়ে ধোঁয়া বের হলে আরও মানাত।
এই মেয়েটা কি আমাকে দেখলেই রেগে যায়? নাকি রেগে গেলে আমার সাথে দেখা করে?
রেগে না থাকা অবস্থায় ওকে আমি একদিনও দেখিনি।
আফরিতা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। একই ইউনিভার্সিটির একই সেকশনে পড়তে থাকা আমরা একজন আরেকজনকে চিনতাম না প্রথম কয়েক মাসেও।
ধীরে ধীরে যত দিন গেল – মেয়েটার ব্যাপারে আমি জানলাম। আমার ব্যাপারেও অনেক জানল বলে মনে হল মেয়েটার।
কিন্তু আসলে কতটুকু জানতে পেরেছে ও – সেটা নিয়ে এখনও আমি দ্বিধাগ্রস্থ।
এই যেমন এখন আমাকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে গেছে ও – কাজেই যে শব্দ দুটো শোনার জন্য ও অপেক্ষা করছে সেটা আমাকে বলতেই হল, ‘বলে ফেল।’
‘হাই তুলছিস যে মনের সুখে – কাল সারারাত কি করেছিস?’
আরেকবার হাই তুলে কোনমতে জানালাম, ‘লিখছিলাম।’
কলার ছেড়ে দেয় ও, ‘দিনে কয়টা করে গল্প লিখলে তোর পেট ভরে?’
‘কালকে তুই রাগ করে আমাকে ঘুমাতে ডাকিসনি। তাই ঘুমাতে পারিনি। সেজন্য গল্প লিখছিলাম।’ জানালাম ওকে।
‘তুই তো বেয়াদবী করে ফোন বন্ধ করে রেখেছিলি। ডাকব কেন?’ অভিমানী কন্ঠে বলে আফরিতা।
‘হুম।’ মন খারাপ করে বলি আমি।
ঘুমাতে আমি পারি না। চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে – কিন্তু বিছানাতে মরার মত পড়ে থেকেও ঘুমাতে পারি না আমি। ঘুমাতে দেয় না আমাকে আমার ভয়ানক সব অভিজ্ঞতা। তার মাঝেই পরিচয় আমার এই পাগলী মেয়েটার সাথে।
আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম – আফরিতার কন্ঠ আমার স্নায়ুগুলোকে কি অদ্ভুতভাবেই না শীতল করে দেয়! ঘুম চোখ থেকে মনের মধ্যে চলে যায় অনায়াসেই – আর টুপ করে ঘুমিয়ে পড়ি আমি।
‘আজ তোকে একটা কথা বলতে এখানে ডেকেছি।’ শান্ত গলাতে বলে আফরিতা।
‘বল।’ পরবর্তী হাইটা কোনমতে চেপে ধরে বলি আমি।
এর পর আর হাই তুললে এই মায়াবী মেয়েটা আক্রমণাত্মক ভূমিকাতে অবতীর্ণ হতে পারে!
‘একটা প্রশ্ন করব। সোজা সাপ্টা অ্যানসার দিবি?’
‘আমি সোজাসাপ্টাই অ্যানসার দেই।’
এবার আর চাপতে না পেরে হাই তুলে ফেলেছি। কুকুরের ডাকের মত শব্দ হচ্ছে।
আফরিতাকে দেখা যায় চিন্তিত মুখে সেটা শুনতে।
‘তুই তো দিন দিন কুকুর হয়ে যাচ্ছিস!’ অবাক হয়ে বলে ও।
‘হু।’ সায় দিয়ে বলি আমি, ‘সোজাসাপ্টাই অ্যানসার দিয়েছি কিন্তু!’
যারপর নাই অবাক হল এবার মেয়েটা, ‘কই? প্রশ্নই তো করতে পারলাম না!’
‘কুকুর হয়ে যাচ্ছি কি না জানতে চাইলি না?’
‘ওটা একটা কমপ্লিমেন্ট ছিল!’
কমপ্লিমেন্টের বাহার দেখে আমার মূর্ছা যেতে ইচ্ছে করলেও মূর্ছা যেতে পারলাম না। কারণ আফরিতা তার প্রশ্নটা করে ফেলেছে।
‘তুই কি আমাকে ভালোবাসিস?’
অধিক শোকে পাথর হয়ে গেলাম।
মেয়েটার গলা গতকাল রাতে শুনতে না পেরে এমনিতে নির্ঘুম চোখ নিয়ে হুতুম প্যাঁচার মত বসে আছি। তার মাঝে উল্টাপাল্টা জেরাও চলছে।
পকেটের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠতে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম অ্যানোনিমাস নাম্বারটাকে। এবং আফরিতার প্রশ্নটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মেসেজটা ওপেন করে উঠে দাঁড়ালাম।
‘সরি। যেতে হচ্ছে।’ বলে নাক বরাবর হাঁটা।
‘উত্তরটা তো দিয়ে যা!’ পেছন থেকে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে আফরিতা।
আমি উত্তর দেই না। টাইম শিডিউলে এমনিতেই পিছিয়ে আছি। আর আছে মাত্র নয় মিনিট চৌত্রিশ সেকেন্ড।
আমি ‘কিশোর পাশা’ নামক একজন ছদ্মনামী লেখক। আমার আসল নাম হাতে গোণা কয়েকজন জানেন। আর বাকিরা জানলেও জানেন নিকনেমটুকু। সারপ্রাইজিং রেটে গল্প লিখি আমি। আর ধুমাধুম পোস্ট করি ফেসবুকে।
আমার পোস্টের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে প্রায় চারহাজার জন আমাকে ব্লক করেছেন।
আর সাড়ে তিনশ করেছেন আত্মহত্যা!
পৃথিবীবাসীর কাছে আমার পরিচয় এতটুকুই। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে আমার একই নাম প্রচলিত আছে, অথচ দুই জগতের কেউই ব্যাপারটা ধরতে পারেন না। কারণটাও অনুমেয়, আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোকজন গল্প পড়েন না, এবং গল্প-পড়ুয়ারা সত্যিকারের জগতে কী চলে সে ব্যাপারে ঘণ্টাটাও জানেন না। কিছু ডকুমেন্টারি আর পেপার কাটিং পড়ে একেকজন যদিও নিজেদের ভাবেন বিদ্যাদিগগজ।
আমি একজন ফ্রি-লান্সার খুনী। খুন করার জন্য আমি টাকা নেই না। বরং কখনও কখনও খুব জটিল সিচুয়েশনে করা খুনগুলোর জন্য আমি টাকা অফার করি। কাজেই আন্ডারওয়ার্ল্ডে আমার কদর আছে।
সেখানে আমার পরিচয় খুবই সাদামাটা, ‘কিলার কেপি।’
কে – দিয়ে কিশোর, পি- দিয়ে পাশা।
আন্ডারওয়ার্ল্ডের ‘উহা’রা যদি জেনে ফেলে কিশোর পাশা নামের একজন গল্প লিখে ফেসবুকে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে – তাহলে আমার আসল লোকেশন বের করে ফেলত নিশ্চয়। অথবা পুলিশ বাহিনী যদি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করত সেই ‘কিলার কেপি’ আর রাইটিং মেশিন ‘কিশোর পাশা’ একই মানুষ! তাহলেই অবশ্য আমাকে আর দেখতে হত না!
আমার মেসের চারপাশে স্নাইপার বসিয়ে খুলি উড়িয়ে ঘিলু বের করে সেই খুলিতে করে চা খেতেন বাঘা বাঘা সব ক্রিমিনালরা। বিশেষ করে পেশাদার খুনীদের এই কাজটা উৎসাহের সাথে করতে দেখা যাবে।
কারণ, ফ্রি-তে মানুষ মেরে কেটে সাফ করে আমি তাদের একরকম বেকার বানিয়ে দিয়েছি।
আমার প্রতি তাদের যে ভালোবাসার অনুভূতি – সেটাকে আমরা সোজা বাংলাতে বলি ‘খিঁচ’।
আমার ওপর তাদের খিঁচ আছে।
আমার লোকেশন বের করতে পারলে তাদের অনেককেই সানন্দে আমাকে ‘ডাউনটাউনে’ পাঠানোর জন্য ভলান্টিয়ার হতে দেখা যাবে।
দেখা যাবে আমাকে ভূত বানিয়ে দেওয়ার পর আমার নিতম্ব দিয়ে বানানো কুশনে বসে পা দোলাচ্ছে ‘স্ট্রাইকার’ ইদরিস। এই পাকনা ছেলেটা রাজশাহীর রাস্তাতে ভাড়া খাটে।
‘ভাড়া খাটে’ শুনে নাক কোঁচকাবেন না – ইদরিস মেল-স্ট্রীপার নয়। ভাড়াটে খুনী।
একটা লাশ ফেলতে ও নেয় দশ হাজার।
দুটো ফেলতে বাইশ হাজার।
খুনের ক্ষেত্রে খুচরো পাইকারীর হিসেব উল্টো। যত পাইকারী অর্ডার – তত লস।
খুচরো খুনের অর্ডারেই ক্লায়েন্টের লাভ।
ক্লায়েন্টদের আরেকটা লাভের ক্ষেত্র হল ‘কিলার কেপি’। এই ব্যাটা যে একটা পয়সা চায় না কাওকে খুন করতে – সেই খবর আন্ডারওয়ার্ল্ডে দাবানলের মত ছড়িয়ে গেছে মাত্র কয়েক মাসে। খুব স্বাভাবিক এটা, মাগনার খবর বাতাসের আগে ধায়।
অনেক শিল্পপতি আমাকে তাঁর মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য খুঁজছেন বলে শুনেছি। তাঁদের কোটি টাকার ঝামেলা আমি এক লহমাতে সরিয়ে দিয়েছি – তাও বিনামূল্যে। আমার প্রেমে শিল্পপতিরা পড়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু তো দেখি না।
প্রেম বিষয়টা উঠতে আফরিতাকে মনে পড়ে গেল।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই – মেয়েটাকে আমি ভালবাসি।
আমার লেখা গল্পের এক তৃতীয়াংশই তাকে ভেবে নায়িকার চরিত্র সাজিয়েছি।
একই সাথে ইন্সপায়রেশন এবং প্রেম যেখানে কাজ করে – লেখক ব্যাটার না ফেঁসে উপায় নেই।
গভীর কুয়োতে ছিটকে পড়তে বেচারা বাধ্য।
আমি গভীর কুয়োতে না পড়ে সামনে এইমাত্র বিকট শব্দে ব্রেক কষা গাড়িটার ভেতরে পড়লাম।
আমাকে পেটে নিয়েই গাড়িটা ছুটতে শুরু করল। আর আমি আড়চোখে সময় দেখলাম।
ঠিক দুইমিনিট বাকি আছে আমার গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য।
ড্রাইভারের পাশের সীটে বসে আছি – চটপট একটা জিনিস বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় ড্রাইভার এক হাতে।
অন্যহাতে প্রাণটাকে মুঠো করে ধরে রাখার মতই স্টিয়ারিং মুঠো করে ধরে আছে ও। আমি আর দেরী না করে ‘জিনিস’টাকে হাতে নিলাম।
আমার চুল-মূল খাড়া হয়ে যেতে চাইল রিভলভারটার চেহারা দেখেই।
মাই গড!
একটা আরমিনিয়াস এইচডব্লিউ-ফাইভ! হাতে নিয়েই আমি আফরিতাকে ভুলে গেলাম।
এমন সুন্দরী একটা পয়েন্ট টুটু এলআর ক্যালিবারের অস্ত্র হাতে থাকলে মানবকন্যাদের কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যাওয়া দোষের কিছু নয়।
আটটা রাউন্ড থাকে এতে। পয়েন্ট টুটু এলআর ক্যালিবারের রিভলভারগুলোতে সাধারণত সিক্স-শুটার, আরমিনিয়াসের হিসাব আলাদা। ওজনেও যেকোন সেম ক্যালিবারের রিভলভারের চেয়ে কম।
রূপবতীই নয় শুধু, ‘মাল’টা সেরকম গুণবতীও বটে!
গুনবতীকে কোমরে গুঁজে জানতে চাইলাম, ‘টার্গেট?’
হোৎকামুখো ড্রাইভার আমার হাতে এবার একটা খাম তুলে দেয়।
চমৎকার চেহারার একজন যুবক। ছবিটি উল্টালাম। পেছনে ডিটেইলস লেখা আছে ছোকরার ব্যাপারে।
পাঁচ ফিট নয় ইঞ্চি।
আটাত্তর কেজি।
ডান কানের নিচে ক্ষত চিহ্ন আইডেন্টিফিকেশন মার্ক ইত্যাদি, ইত্যাদি – ইত্যাদি।
হানিফ সংকেতকে মনে মনে একটা স্যালুট ঠুকে নিচের লোকেশনটা দেখলাম।
ডেথ রিকুয়েস্ট – বুলেট থ্রু হিজ ফরহেড।
তার নিচে ‘মে বি হেভিলি গার্ডেড’ লেখাটা পড়ে আমার চোখ হাল্কা কোঁচকায়।
তবে হাল্কাই কোঁচকায়। শুডন’ট বি আ প্রবলেম।
গাড়িটি থেমে গেছে।
ঘড়িতে দেখলাম মাত্র দুই সেকেন্ড আগে পৌঁছেছি।
তবুও দেরী তো হয়নি!
আফরিতার প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে দেরী হয়েই যেত। মেয়েটা নিশ্চয় আমাকে ভুল বুঝেছে।
গাড়ি থেকে নেমে বাইরে পা রাখতে না রাখতেই দুই সেকেন্ড পার হয়ে গেল। পারফেক্ট টাইমিং যাকে বলে।
বাড়িটা বিশাল। কোন শালায় রাজশাহীর বুকে এত বড় বাড়ি বানিয়েছে কে জানে!
ওটা আমার মাথাব্যথা না।
আমার মাথাব্যথা বাড়িটার সামনে হাল্কা পায়ে পায়চারি করতে থাকা দুইজন গার্ড।
টার্গেট হারামজাদা কি সামনের বার ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছে নাকি? এত কড়াকড়ি কিসের?
তবে দারুণ ব্যাপারটা। নিখুঁতভাবে এই ব্যাটাকে মেরে ফেলতে পারলেই আগামী চারটা গল্পের জন্য মশলাপাতির অভাব হবে না আমার।
ফ্রি-লান্সার কিলার আমি এজন্যই হয়েছি। মাগনা প্লট পেলে ক্ষতি কি?
কোনদিকে না তাকিয়ে বাড়িটার পেছন দিকে চলে আসলাম। এদিকে বেশ কিছু গাছগাছরা আছে দেখা যাচ্ছে! সেই সাথে দেখা যাচ্ছে আরও একজন গার্ডকে, ওটা বোনাস।
তবে গাছগুলো কাজে দেবে।
গার্ড ব্যাটা অন্যদিকে হেঁটে যেতেই লাফিয়ে বেড়া টপকে বাড়ির ত্রিসীমানাতে ঢুকে পড়লাম।
তারপর সাপের মত দৌড় দিয়ে একটা মিনি-ঝোপের আড়ালে।
ফাঁকফোকর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি গার্ডের বাচ্চা আবার এদিকেই আসছে। আর আমি আমার দুর্গন্ধযুক্ত প্যান্টের বেল্টের নিচ থেকে পাতলা কিন্তু শক্ত ইস্পাতের তারটা বের করে ফেললাম।
কুকুরের মত শব্দ করে একটা হাই তুলে সারতে না সারতেই দেখতে পাই হারামজাদা গার্ড ব্যাটা আমার ঝোপ ক্রস করে আরও এগিয়ে গেছে। কাজেই আমি পড়ে গেছি তার পেছনে।
মাথা ঘুরালেই আমাকে দেখতে পাবে এই গার্ড এখন। তবে মাথামোটাটা মাথা ঘোরায় না।
অনায়াসে তার পিছনে পৌঁছে গেলাম।
আর দেরী কিসের?
চটপট তারটা ব্যাটার গলাতে পেঁচিয়ে ফেলে প্রচন্ড জোরে নিজের দিকে টানছি – যন্ত্রণায় হারামজাদা একেবারে বাঁকা হয়ে গেল!
আরে বাবা – গলাতে তার পেঁচিয়েছি – একটু ব্যথা তো লাগবেই। হ্যাক-হ্যাক জাতীয় শব্দ কেন করছে বদমাশটা?
আরও জোরে নিজের দিকে টেনে ধরলাম তারটা।
এবার কাজ হয়েছে। গলার নরম চামড়া কেটে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে তারটা। ভোকাল কর্ড কেটে তবে থামল।
হ্যাক হ্যাক শব্দ থেমে গেছে। বুঝলাম, বহুদিনের চর্চায় সদ্য জবাইজাত গার্ডের রক্ত আমার দেহ স্পর্শ করেনি।
মরাটাকে ঝোঁপের একেবারে গভীরে ঢুকিয়ে দিয়ে আস্তে করে বাড়িটার পেছনের দরজার দিকে হাঁটা দিলাম।
দরজাটা খোলা ছিল না। কাজেই পিনের মত শক্ত কিন্তু বেশ লম্বা তারটা বের করে পিকলক করতেই হল।
ঘরবাড়ি বিশাল বানালেও ভেতরে কাওকে চোখে পড়ে না। কোনমতে দোতলাতে পৌঁছাতে পারলেই আমার টার্গেটকে পেয়ে যাব। তারপর স্রেফ কপালের মাঝে একটা বুলেট।
মানে মক্কেল যেটা চাইছে আর কি!
তবে তার আগে আমি আমার মত খেলতে পারি। তাতে কেউ মানা করেনি।
আর ওটাই আমার বোনাস। ওটা দিয়েই চমৎকারভাবে লিখে ফেলব পরের থ্রিলারটা।
নিচ থেকে হাল্কা উঁকি দিয়েই পাথরমুখো গার্ড দুইজনকে দেখা যায়। ব্যাটারা একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কোন মহামান্যকে পাহাড়া দিচ্ছে বুঝতে বাকি থাকে না।
এখানেই আছে আমার টার্গেট মহাশয়!
দুই গার্ডকে মেরে ফেলে ওই শালাকে মারতে আমার মিনিট তিনেকের বেশি লাগবে না।
কিন্তু তাতে তো আর সাইকো-থ্রিলার লিখতে পারছি না! কাজেই সুড় সুড় করে বাইরে বের হয়ে আসলাম।
পাইপ বেয়ে বেয়ে দোতলায় উঠেছি – গরাদ বিহীন জানালাগুলো নিচ থেকেই দেখেছিলাম। প্রাচীন বাড়ি বলেই কি না, এরা আজকের যুগেও গরাদহীন জানালার বাড়িতে থাকে। বিষয়টা আমার জন্য দারুণ হয়েছে, যে কোন একটা দিয়ে ঢুকে পড়া যাবে।
তবে আমি যেকোন একটা দিয়ে ঢুকতে এখানে আসিনি। খুঁজে খুঁজে বের করলাম টার্গেটের রুমটা।
গাধাটা আমার দিকে পিঠ দিয়ে টেবিলে ঝুঁকে পড়ে কি যেন লিখছে।
জানালা একটা খোলাই ছিল, দো’তলার জানালা বলে নিরাপত্তা নিয়ে হয়তো শঙ্কিত নয় লোকটা। এসি আর ফ্যান বন্ধ করে প্রাকৃতিক হাওয়া খাওয়া হচ্ছে! সুড়ুৎ করে সেঁধিয়ে গেলাম।
সামনের পকেট থেকে টেপটা বের হয়ে এসেছে আগেই।
এবার পেছন থেকেই ঝটপট আমার টার্গেটের মুখে পেঁচিয়ে ফেলি ওটা। মদন মানুষ! নড়ারও সুযোগ পেল না – আর এখন সুযোগ পাচ্ছে না চিৎকার করার। সব সময় দেখেছি, আক্রমণ করা মাত্র মানুষ প্যারালাইজড হয়ে যায়। এমনটা নাকি রেইপ ভিক্টিমের সাথেও হয়। আতঙ্ক। শুনেছি প্রখর বুদ্ধিমত্তা যাদের আছে, তারা ট্রমাতেও বেশ নড়াচড়া করে থাকে। তবে আমার কপালে তেমন কেউ নেই। এত গাধা গাধা টার্গেট আমাকে কেন দেওয়া হয়?
হোয়াই মি? হোয়াই অলয়েজ মি?
হারামজাদার মুখ পেঁচানোর সাথে সাথে ট্রমার প্রাথমিক ধাক্কা থেকে বেরিয়ে এল বোধহয় মদন-মোহন। ছটফট করে চেয়ার ছেড়ে বের হয়ে এসে আমার মুখ বরাবর একটা ঘুষি চালিয়ে দিল। চট করে সরে গিয়ে ব্যাটার হাঁটুর বাটিতে গায়ের জোরে লাথি মারলাম।
কড়াৎ করে একটা বিচ্ছিরি শব্দের সাথে সাথে পা-টা বেকায়দাভাবে বেঁকে গেল। হাঁটুর বাটি একেবারে ছুটিয়ে দিয়েছি! চোখের পলকে জিপ-টাইয়ে আটকে দিলাম হাত।
তারপর দুমড়ে মুচড়ে মেঝেতে এই মাত্র পড়ে যাওয়া মানুষটার দিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টি না দিয়ে আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে ফিরে আসলাম।
দরজা লাগানোর দরকার ছিল। ওপাশে গার্ডদ্বয় খানিকবাদেই বুঝে ফেলবে এখানে খুব সুবিধের কিছু হচ্ছে না। বাগড়া দিতে আসবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই!
দারুণ একটা ওয়াকিং স্টিক টেবিলে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। সেটা আস্তে করে তুলে নিয়ে ফিরে আসছি – আমার টার্গেটের চোখে মুখে মৃত্যুভয় দেখতে পেলাম। জিপ-টাই কেটে বসেছে চামড়ায়, কারণ সে এখন চেষ্টা করছে হাতটা ছুটিয়ে নেবার। পারছে না।
মনটা আনন্দে ভরে গেল সাথে সাথেই।
গায়ের জোরে ওয়াকিং স্টিকটা দিয়ে পড়ে থাকা শালার আরেক পায়ের হাঁটু আর গোড়ালির মাঝে মারলাম।
কড়াৎ জাতীয় শব্দের সাথে সাথে ভেঙ্গে গেল হাড়টা।
শব্দটা আমার কানে মধুবর্ষণ করে! আর একই সাথে বাইরে থেকে গার্ডরা দরজা ধাক্কাচ্ছে।
‘স্যার আপনি ঠিক আছেন?’ জানতে চায় কেউ একজন।
‘এভরিথিং ইজ অলরাইট!’ হুংকার ছেড়ে জানাই আমিও।
দরজা ধাক্কানো থেমে যেতেই ওয়াকিং স্টিকটা মাথার ওপর তুলে এনে টার্গেটের ডান হাতের কব্জিতে মেরে দিলাম।
কড় মড় করে অনেকগুলো হাড় একসাথে ভেঙ্গে গেল। সেই সাথে মুখের টেপ ভেদ করে গোঁ গোঁ করে চেঁচানোর চেষ্টা করতে থাকে বেয়াদবটা।
আরে হাড় ভেঙেছে তো চেঁচানোর কি আছে?
আমার রাগ হতে থাকে।
ওয়াকিং স্টিকটা দিয়ে দমাদম কিছুক্ষণ বুকে পেটালাম।
মট- জাতীয় একেকটা শব্দ হতেই বুঝে গেলাম পাজরের হাড় কয়টা ভেঙ্গেছে।
ভোঁতা শব্দটাই সম্বল কারও পাজরের ভাঙ্গা হাড় গুণতে। এমন শব্দই হয় এখানে মারলে।
এখানে শব্দ হল মোট আটবার।
মানে – ইনার হাড় ভেঙ্গেছে আটটা।
চির নিশ্চয় সবগুলোতেই ধরেছে কমবেশি।
সাথে সাথে দরজাতে আবারও দমাদম শব্দ।
সিকিউরিটি গার্ডদের মাথা মোটা হতে পারে – তবে রেডিয়াসে যত হবে ভেবেছিলাম – তার চেয়ে কম বলেই প্রমাণিত হল।
ভেতরে যে ঘাপলা চলছে সেটা বুঝে ফেলেছে এরা এতক্ষণে!
আর বেশিক্ষণ মজা নেওয়া যাবে না। টার্গেটের বাম হাতটাই ভালো লাগল।
কারণ মেঝের সাথে আঁকড়ে ধরে রাখা হয়েছে ওটাই।
ওয়াকিং স্টিকটা ওপরে তুলে লম্বভাবে নামিয়ে আনলাম ওই হাতের ওপর।
কড়মড় শব্দের সাথে সাথে প্রতিটি আঙুল ভেঙ্গে গেল।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যন্ত্রণাকাতর মুখটা দেখি।
হুম – মুখের ভাজগুলো এভাবেই পাল্টে যায় তাহলে তীব্র যন্ত্রণায়?
দারুণ লাগছে অনুভূতিটা। নিজেকে দানব দানব মনে হচ্ছে।
আলগোছে ওয়াকিং স্টিকটা আবার তুলে চট করে ডানহাতেও নামিয়ে আনলাম।
একটু বেশিই জোরে মেরেছি মনে হয় এবার।
মধ্যমাটা ছিটকে আলাদা হয়ে গেল। গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে ওখান থেকে।
একই সাথে দড়াম করে খুলে গেল দরজাটা।
পাঁই ঘুরতে ঘুরতে কোমর থেকে আরমিনিয়াসটা বের করে দ্রুত বেগে ঢুকতে থাকা গার্ডদুইজনের একজনের কপাল বরাবর গুলি করলাম।
রিভলভারের গুলির শব্দ। একেবারে কাঁপিয়ে দিল বাড়িটা।
আর স্রেফ সেমি-ডিগবাজি খেয়ে ছিটকে পেছন দিকে পড়ে গার্ড। দ্বিতীয়জনের হাতেও উদ্যত পিস্তল – আর সেটা দ্রুত গতিতে আমার দিকে ঘোরাচ্ছে হারামজাদা।
একই সাথে গুলি করলাম দুইজনে।
আমি দুইবার। ও একবার।
বুকের ওপর হাতুড়ির বাড়ি মেরেছে আমার বুলেট দুটো – বাম দিকে গুলি খেয়ে শরীরের ওই অংশটা পেছনের দিকে চলে যায়। স্বাভাবিকভাবেই ডান হাত সরে যায় আরও বামে।
গার্ডের বুলেটটা আমার অনেকটা ডানদিক দিয়ে বেড়িয়ে গেল। ওপাশের জানালার গ্লাসে একটা ফুটো করে চলে গেছে বাগানের ওপর দিয়ে।
আমিও একই সাথে লাফিয়ে বের হয়েই বুঝলাম – ভুল করে ফেলেছি।
ভুলটা এজন্য নয় – যে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ড দুইজন ছুটে চলে এসেছে ভেতরে।
ভুলটা এজন্যও নয় – তাদের গর্জে ওঠা আগ্নেয়াস্ত্র থেকে নিরেট কাভার পাচ্ছি না আমি।
বরং ভুলটা এজন্য – টার্গেটের কপালে গুলি করা হয় নি এখনও। ক্লায়েন্টের আবদার!
মক্কেল আমার ওপর ভরসা করে আছে ব্যাটাকে কবরে পাঠানোর জন্য। হাসপাতালে নয়।
কিন্তু এখন ওসব নিয়ে ভাবার সময় নেই।
উৎসাহী গার্ড দুইজনের বুলেট থেকে বাঁচার জন্য ছয়ফিট দূরের পিলারটিকে বেছে নিলাম। সেটার দিকে ডিগবাজি খেয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে গার্ডব্যাটাদের দিকে দুটো গুলি করেছি।
একটা লাগল।
অপরটা লাগল না।
একজন গার্ডের গলায় বিশাল এক ফোকড় সৃষ্টি হয়েছে – সেটা থেকে চমৎকার ভাবে রক্ত বেরিয়ে আসছে – সেদিকে একবার তাকিয়ে দেখার ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু অন্য গার্ড সেক্ষেত্রে আমার তরমুজের মত মাথাটাকে একেবারে বিস্ফোরিত করে দেবে।
কাজেই পিলারের আড়ালে নাক লুকালাম।
‘একক’ গার্ড প্রাণের সুখে গুলি চালাচ্ছে পিলার বরাবর। পায়ের শব্দ শুনে বুঝতে পারছি ভালো একটা অ্যাংগেল খুঁজছে।
গার্ড ব্যাটা বামে যায়, তো আমিও ঘুঘুর মত একপা ডানে সরি। গার্ড ব্যাটা ডানে যায় – আমিও ঘুঘুর মত একপা বামে সরি।
ঘুঘুও দেখতে পায় না লোকটা, ফাঁদও পাততে পারে না।
ঠিক তারপরই এতক্ষণ যার জন্য আমার এত অপেক্ষা – সেই ‘ক্লিক’ শব্দটা শোনা যায়।
ম্যাগাজিন খালি করে ফেলেছে গার্ড – উত্তেজনা তে নিশ্চয় মনে ছিল না কয়টা ফায়ার করেছে?
উত্তেজিত গার্ড নড়ার আগেই কাভার থেকে বেড়িয়ে আসি আমি।
বিল্ডিং কাঁপানো আরেক গুলিতে একেবারে উড়িয়ে দিলাম হারামজাদার ডান চোখ।
দড়াম করে মাটিতে পড়ে গেল মরাটা। আর আমিও লাফিয়ে ঢুকলাম টার্গেটের রুমে।
এতগুলো ভাঙ্গা হাড় নিয়েও অজ্ঞান হয় নি শালা – গোঙ্গাচ্ছে।
কাজেই তার কপালে পিস্তল ঠেকালাম – এবং চোখে মুখে ফুটে ওঠা মৃত্যুভয়কে পাঁচ সেকেন্ড ধরে রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করলাম – পরে কোন গল্পে কাজে লাগবে।
তারপর টেনে দিলাম ট্রিগার।
একেবারে ছাতু হয়ে গেল মাথাটা। ঘিলু আর রক্তের স্প্রে আমার হাতে মুখেও লেগেছে। হাল্কা ছড়িয়ে এসে ভরিয়ে দিয়েছে বুকেও।
কাজেই ওখানে আর সময় নষ্ট না করে টার্গেটের বাথরুমে ঢুকে রক্ত পরিষ্কার করছি – দূরে কোথাও সাইরেন শোনা যায়।
দিন দিন রাজশাহীর পুলিশ বাহিনী তৎপর হয়ে যাচ্ছে দেখা যায়!
দ্রুত আবার বাগানে বেড়িয়ে এসে পেছনের দিক দিয়ে বাড়ির চৌহদ্দি টপকে পার হয়ে যাই।
মোবাইল বের করে টাইপ করছি, ‘মিশন অ্যাকমপ্লিশড’ – পাশ দিয়ে তীর বেগে ছুটে গেল দু-দুটো পুলিশের গাড়ি।
*
বিকেল বেলা। মিজান মামার দোকানে চা খাচ্ছি। লোকে লোকারণ্য জায়গাটা।
মিজান মামার হাতে যাদু আছে। কী দিয়ে চা বানায় দেখার আমার সখ ছিল বহুদিনের।
একদিন চুরি করে দেখেও ফেললাম এবং হতাশ হলাম।
লোকটা চা বানায় একেবারে আর সবার মতই। কিন্তু পরিমাণটা এমন নিখুঁতভাবে দেয় – অমৃত হয়ে যায় এক কাপ চা।
একটা গল্পের মাঝামাঝি এসে এখানে বসি আমি। চমৎকার এক কাপ চা খাই। তারপর ফিরে আসি আমার ডেরায়।
চিশতিয়া নিবাস (প্রাঃ) লিমিটেড।
একটি ছাত্রাবাস।
একটি মেস।
একটি জঞ্জাল।
আজও সেই উদ্দেশ্যেই এখানে আসা। সকালের মিশনটা দারুণভাবে শেষ করেছি বলে মনটাও ফুরফুরে।
চমৎকার এক কাপ চা খাওয়া ছাড়া আমার আর কোন বদমতলব ছিল না। সেই সাথে চলছে মেসেজিং।
আফরিতার সাথে। মেয়েটা মন খারাপ করে মেসেজ দিচ্ছে।
আমিও টুকটাক হিবিজিবি রিপ্লাই দিয়ে ওর মন ভালো করার চেষ্টাতে আছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। মন কেন খারাপ তা-ও ঠিক করে বলছে না।
তখনই ঢুকতে দেখলাম ওদের।
রাফি, সজল আর প্রান্ত।
আফরিতার মত এরাও আমার সেকশনেই পড়ে। কাজেই আমাকে না চেনার কোন কারণ নেই।
যদিও অতিরিক্ত ভীরের কারণেই খুব সম্ভব – আমাকে তাদের চোখেই পড়ে না।
অন্যদিন হলে হয়ত হাই-হ্যালো দিতাম। তবে আজ দিলাম না।
মাথাতে অর্ধসমাপ্ত প্লট। ওদের সাথে পরে অনেক কথা বলা যাবে। আজ থাকুক।
ডিটেক্টিভ আসিফের পরবর্তী গল্প নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। মার্ডার লুপ-থ্রি লিখতে চলেছি।
খুন তো এতদিন মার্ডার লুপগুলোতে রাখতাম তিনটা। এবার রাখব পাঁচটা।
পাঁচ খুনের হ্যাপা সামলাও এবার ডিটেক্টিভ আসিফ আর জিয়া মিয়া। ঠেলার কি দেখেছে এতদিন হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে?
বিশাল একটা ওয়েব মাথাতে। এর সাথে ও – তার সাথে সে – চক্র!
কার সাথে কার কানেকশন দিলে ভালো হবে? প্রস্টিটিউশন চ্যাপ্টারটাকে বাদ দিতে চাচ্ছি;
পরে আবার আনলাম মাথায়। থাকুক প্রস্টিটিউশন। পাঠকের সন্দেহ ওদিকেই যাক কিছুক্ষণের জন্য।
‘শরীরটাও কিন্তু দেখার মত। সব ঢেকে রাখে শালি – নাহলে সেই হত।’ কারও মুখ থেকে শুনে আগ্রহ অনুভব করলাম।
প্রস্টিটিউশন নিয়ে ভাবতে না ভাবতেই এসব গরম গরম বর্ণনা শোনা লাগলে কান পাতব না?
আফটার অল – আমি রাইটার মানুষ।
খেয়াল করে বুঝলাম তিন বেঞ্চ সামনে বসা সজলের কথা এটা।
কান খাড়া করে আরেকটু শুনি এবার, কোন মেয়ের ব্যাপারে এই কথা বলছে?
‘চরম বলেছিস, দোস্ত। প্রেম করতে পারলে হত!’ নিজের পায়ে হতাশায় একটা থাবা মারে রাফি।
‘হুম – একদিনের জন্য পটিয়ে রুম ডেটে নিতে পারলেই – উইসস -’ জিভ দিয়ে একটা বিশ্রী শব্দ করে সজল।
‘ফোন না দেওয়ার কথা ছিল – ওটার কাহিনী বল ব্যাটা আগে!’ প্রান্ত তাড়া দেয় সজলকে।
‘মাগনা কি আর শোনা যায় রে? চা আর বেনসন খাওয়া। বলছি সব।’ হাসিমুখে বলে সজল।
ঠান্ডা একটা বাঘের মত পেছনে চুপচাপ বসে থাকি আমি।
সজলের চা এল। সজলের বেনসনও এল।
আয়েস করিয়ে সেটাতে ধোঁয়া ধরিয়ে একটা টান দেয় ও। তারপর দুলে দুলে হাসে।
‘রাফি তো ক্রাশ খাইসিলো মাইয়াটার ওপর। ক্লাস টেস্ট কালকে – কিন্তু দুপুর থেকে পড়তে পারছিল না। মাথাতে শুধু আফরিতা ঘুরতেছে ওর।’
রাগের একটা হল্কা বয়ে যায় আমার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত।
আফরিতাকে নিয়ে এমন ভাষা ব্যবহার করতে পারছে আমারই সেকশনের ছেলেরা? আফটার অল – আফরিতা ওদেরও ক্লাসমেট।
অ্যাটলিস্ট!
অসামান্য ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়ে তবুও শান্ত হয়ে বসে রইলাম।
‘নাম্বারটা দে তো মাইয়ার। শালির পড়াশোনাও থামিয়ে দেই।’ চট করে মোবাইল বের করে প্রান্ত।
‘রাখ ব্যাটা। ওই কাজে দেরী করতে আছে নাকি? বাজায় দিসি না টান্ডি?’ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে সজল।
তারপর আরাম করে বেনসনে ও যখন টান দিচ্ছে – আমি পকেট থেকে গোল্ডলীফ বের করে ধরাই একটা।
আফরিতার মন খারাপের রহস্য এখন একটু একটু বুঝতে পারছি।
‘সেই টান্ডি বাজানোর কাহিনী শোনার জন্যই কিন্তু তোকে চা আর বেনসন খাওয়ানো হচ্ছে।’ ঝুলে থাকতে থাকতে বিরক্ত প্রান্ত বলে।
সুন্দরী ক্লাসমেট সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য শোনার জন্য কানের ফুটো একেবারে বড় বড় হয়ে আছে শালার – পরিষ্কার বুঝতে পারলাম আমি।
রাগে থর থর করে কাঁপছি – সেই সাথে টানছি সিগারেটের শলাটা।
এখানে মাথা গরম করা যাবে না। পরে সবাই আমাকে সন্দেহ করবে।
কিশোর পাশা ইমন কাঁচা কাজ করে না।
‘রাফির রুম থেকে এসেই ফোন লাফালাম আফরিতাকে। ধর – দেড় ঘন্টা আগে। ফোন ধরতেই জানতে চাইলাম, “আফরিতা না?” শালী বলে, “জেনেশুনেই তো ফোন করেছিস। বল কি বলবি?” শালীর দেমাগ দেখ! ধীরে সুস্থে প্রশ্নটা করে ফেললাম, “একটা ব্যাপার জানার ছিল।” মেয়ে বলে, “বল।” আমিও সুযোগ ছাড়লাম না, চট করে বলে ফেললাম, “তুমি তো খানকি একটা। আমিও জানি, ক্লাসের সবাইও জানে। শুধু জানি না তোমার ভাড়া কত। ওটা যদি বলতে – ”’
হাহা করে হাসিতে ফেটে পড়ে রাফি আর প্রান্ত। সজলের পিঠও চাপড়ে দেয় দুই বার।
আর এদিকে প্রচন্ড রাগে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি আমি।
মাথা নীচু করে দুই হাতের মুষ্ঠি শক্ত করে আটকালাম। নখের চাপে কেটে গেল হাতের তালু।
তবুও নিজেকে ধরে রাখলাম। কন্ট্রোল হারালে চলবে না।
মাথা রাখতে হবে ঠান্ডা।
বরফের মত ঠান্ডা।
ওদিকে সজল বলেই চলেছে, ‘আমার কথা শুনে মাগী একেবারে চুপ। আমি আরও উৎসাহ দিলাম, “বলে ফেল সোনা – টাকার কোন সমস্যা নাই এদিকে।”’
আবারও হাসিতে ফেটে পড়ে ওরা তিনজন। আর আমি দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরাই।
তারপর আস্তে করে পেছনের দিক দিয়ে বের হয়ে যাই দোকান থেকে।
এখানে আর পাঁচ মিনিট থাকলে সবার সামনেই খুন করে ফেলব সজল নামের একটা কুত্তার বাচ্চাকে।
রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ওখান থেকে দুটো জিনিস নিতে হবে। চট করে কোমরে আবার আরমেনিয়াসটা ভরে ফেললাম। ক্লায়েন্ট ফেরত চায়নি আর জিনিসটা।
এখন ওটা আমার।
আরেকটা ছোট ব্যাগ ব্যাকপ্যাকে ভরে সেটা কাঁধে চাপিয়ে সোজা চলে যাই তালাইমারির মোড়ে।
বন্ধুরা আছে। এদের সামনে নিজের চেহারা দেখাতে হবে কিছুক্ষণ। অ্যালিবাই।
ধুমিয়ে আড্ডা দিলাম টানা দুই ঘন্টা।
চোখ ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে। তবুও জোর করে টেনে জেগে আছি।
গতরাতে এমনিতে ঘুমাতে পারিনি – আফরিতার সাথে ঝগড়া করাটাই উচিত হয়নি।
তারওপর সকাল সকাল আফরিতার সাথে দেখা করতে গিয়ে আবার ক্লায়েন্টের কল।
ওখান থেকে ফিরে এসে পরবর্তী থ্রিলারের অর্ধেকটা লিখে আবার সজলের এই কাহিনী শোনা লাগল!
শালার – লাইফটা তেজপাতা বানিয়ে ফেলেছে!
ঘড়ি ধরে দুটো ঘন্টা পার হয়ে যেতেই আবার ফিরে আসলাম মুন্নাফের মোড়ে। এখানেই একটা মেসে থাকে সজল।
এদিকে রাত নেমে এসেছে।
সজল ছেলেটার সাথে আমার পারতপক্ষে কথা হয় না। একই ক্লাসে থাকলেও শালা একটা সাপের মত। মুখে কোন শব্দ নাই। চেহারাতে স্পষ্ট আঁতেলত্বের ছাপ। এই হারামজাদা যে আমার আফরিতাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করতে পারে – বিশ্বাসই হতে চায় না।
মেসটা দেখা যাচ্ছে।
আস্তে করে ঢুকে পড়লাম ভেতরে।
সৌভাগ্য আমার – নিচের মেইন সুইচটার কাছে একটা মানুষও নেই।
পকেট থেকে কলমটা বের করে বাটনে চাপ দিয়ে অ্যাসিডটুকু ঢেকে দিলাম মেইনসুইচের ফাঁক দিয়ে।
ঢেলেই দ্রুত সরে গেছি।
সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি – এই সময় ‘বুমম’ জাতীয় শব্দের সাথে সাথে একগাদা স্পার্ক ছড়িয়ে দেয় মেইন সুইচটি।
সাথে সাথে কালিগোলা অন্ধকারে ডুবে গেল গোটা মেসটা।
ভেবেছিলাম সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠবে – কিন্তু তা হল কই?
একজন জুনিয়র ছেলেকে নামতে নামতে বিড় বিড় করতে শুনলাম, ‘গেল আবার! এক মাসে তিনবার! অসহ্য!’
মনে মনে ভাগ্যকে একবার ধন্যবাদ দিয়ে তিনতলায় উঠে পড়লাম। একেবারে শেষ রুমটা সজলের।
একা থাকতে পছন্দ করে।
কাজেই সজলকেও একটা ধন্যবাদ।
আর আমাকেও আমার পরিচিত কেউ দেখেনি এখনও। সবকিছু ঠিকমতো যাচ্ছে।
সজলের রুমে পৌঁছে গেছি।
যেয়ে ধীরে ধীরে নক করতেই ভেতর থেকে মেঘ গর্জন করে ওঠে সজলের কন্ঠটা, ‘কে?’
‘আমি কেপি, দোস্ত। কালকের ক্লাসটেস্টের জন্য তোর খাতাটা দরকার ছিল। ছবি তুলতাম।’
চট করে দরজাটা খুলে গেল। কেপির নামে সকল দরজা উন্মুক্ত।
জনতার সেবাতে নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে আমার সুনাম আছে। শত্রুদের জন্য আমি যতটা কঠোর – বন্ধুদের বেলাতে ততটাই কোমল।
‘আরে দোস্ত – আয় আয়।’ ভেতরে ডেকে নিয়ে যায় আমাকে সজল।
শালার চেহারাটা দেখে মেজাজ খারাপ হতে থাকে আমার।
এই হারামজাদাই আমার আফরিতাকে নিয়ে বাজে কথা বলেছে আজ দুপুরে। এমন কিছু কথা – কোন ক্লাসমেটেরই সহ্য হওয়ার কথা না।
আর, আমি? আমি তো ওকে ভালোবাসি। কাজেই সজলের প্রতি ‘ভালোলাগা’ বেড়ে গেছে আরও কয়েক গুণ।
‘অসময়ে চলে এসেছি রে। কারেন্ট উড়ে গেছে তোদের মেসের।’ দুঃখপ্রকাশ করি আমি।
‘আরে ব্যাপার না। ফ্ল্যাশ আছে না তোর মোবাইলের? ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে পিক তুলে নিতে হবে।’
আমি কিছু না বলে ঘরের চারদিকে তাকাই।
একটা টেবিল ল্যাম্পের আলোতে আলোকিত ঘরটা।
বিছানা থেকে টেবিল পর্যন্ত সবখানে ইলেক্ট্রিক্যালের বই খাতা। চমৎকার পড়াশোনা চলছে এদিকে, আফরিতাকে ফোন করেছিলাম – কাঁদার কাছাকাছি পর্যায়ের মন খারাপ মেয়েটার। একটা লাইনও পড়তে পারছে না।
মেয়েটার পড়া নষ্ট করেই আঁতেল সজল কি ভীষণ খুশি!
আরে হারামজাদা – এটা করার জন্য তো আরও অনেক কিছু বলে একটা মেয়ের মেজাজ খারাপ করানো যায়।
সেসব করলে আমার মেজাজ খারাপ হতে পারত – কিন্তু এখানে আসতে হত না।
কিন্তু – বিশাল ভুল করে ফেলেছে সজল। আফরিতার চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলেছে ও।
কয়েকবার!
‘এই যে আমার ইলেক্ট্রিক্যাল খাতা।’ আমার দিকে খাতাটা বাড়িয়ে দেয় ও। আর আমি সাবধানে একবার দরজাটা দেখি। বন্ধ করেছে হারামজাদা ভেতর থেকে।
পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাক নামাই আমিও। আস্তে করে ডাক্ট টেপের ওপর হাত রেখে সজলের দিকে তাকিয়ে কোমল গলাতে বলি, ‘আফরিতাকে আজ দুপুরে ফোন দিয়েছিলে।’
প্রশ্ন নয় ঠিক। বিবৃতিমূলক বাক্য।
সজলের মুখটা বিস্ময়ে হা হয়ে যায়। নীচ থেকে বাম হাতের প্রচন্ড ঘুষিটা বেজন্মাটার মুখ একেবারে বন্ধই করে না শুধু – কামড় লেগে জিহ্বা একটুখানি কেটেও যায়।
আক্রমণটা এতটাই আচমকা করেছি – প্রতিরক্ষার কথা মাথাতেও আসে নি শালার।
পরের ঘুষিটা একেবারে দেওয়ালে আছড়ে ফেলে জারজ সন্তানটিকে। কোনমতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে হারামজাদা তবুও।
পেছন থেকে এই সুযোগে মুখে টেপ পেঁচিয়ে ফেললাম ভালো মত। আমার ধরণটাই এমন, কী আর করার!
সহজাত প্রবৃত্তিতে হাত মুখের কাছে চলে গেছে শালার – মুখ থেকে টেপ খুলে ফেলতে চায়।
সুযোগটা ছাড়লাম না – ব্যাগ থেকে ছয় ইঞ্চি লম্বা পিনটা বের করে সড়াৎ করে হাঁটুর পেছনে ঢুকিয়ে দিলাম ওটা।
সজলের দুই হাত মুখ থেকে বাম হাঁটুতে চলে গেছে। তীব্র যন্ত্রণাতে মুখ কুঁচকে উঠেছে ছেলেটার। প্রাণপনে চিৎকার করতে চাইছে – কিন্তু মুখে টেপ থাকায় মৃদু একটা গোঙ্গানি ছাড়া আর কিছুই আসছে না এখন।
সবার অজান্তে ছাত্রাবাসের একটি বদ্ধ রুমে চলছে প্রকৃতির প্রতিশোধের খেলা।
পিনটা টেনে বের করলাম। টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলোতে পিনটায় লেগে থাকা তাজা রক্ত হাল্কা ঝিলিক দিয়ে উঠে।
পিনটা বের করে ফেলাতে সজলের দুঃখ কমল – এমনটা নয়। ভেতরের সবকিছু ফুটো হয়ে গেছে এবং চমৎকারভাবে ইন্টারনাল ব্লিডিং চলছে সেখানে। ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে যায় আমার। ভেরিকোজ শিরার বারোটা বাজিয়ে দিতে পেরেছি কি না সন্দেহ হয় – তবে আশা করতে কোন দোষ দেখি না।
সজলের চোখের মাঝে তীব্র আতঙ্ক কাজ করছে।
এখনও দুই হাতে হাঁটুর পেছনের ক্ষতটা ধরে গোঙ্গাচ্ছে। মুখের টেপ খোলার খায়েশ উড়ে গেছে আরও আগেই।
ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম।
‘আফরিতার শরীর দেখতে তোমার খুব ভালো লাগে। তাই না?’ চমৎকার হাসিটি মুখে ধরে রেখেই জানতে চাইলাম আমি।
প্রচন্ড ভয়ে দ্রুত মাথা নাড়াচ্ছে সজল – তীব্র ব্যথা ওকে পাল্টা আক্রমণের অপশন যে আছে একটা – সে কথাটাই ভুলিয়ে দিয়েছে।
আমিও সময় নষ্ট না করে দড়াম করে একটা ঘুষি মারলাম শালার মুখে। টেপের ওপর দিয়েই।
দ্বিতীয় ঘুষিতে আবারও দেওয়ালের ওপর আছড়ে পড়ল ও। ওপাশে আর কোন রুম নেই – শেষ রুমটা সজলের। কাজেই কেউ টের পাচ্ছে না ব্যাপারগুলো।
তৃতীয় ঘুষিটা বেজন্মাটার মুখের ওপর ল্যান্ড করতেই কেঁপে ওঠে ওর সারা শরীর।
মুখের মাঝে রক্তের ধারা। সেটা বের হতে পারছে না টেপের কারণে।
চতুর্থ ঘুষিটা ওর দুটো দাঁত ফেলে দিল। বাইরে থেকে চোয়ালের নাড়াচাড়া দেখে অন্তত সেটাই মনে হল আমার।
পঞ্চম ঘুষির সাহায্যে ওকে ওর মুখেরই রক্ত মিশিয়ে দাঁতদুটো খেয়ে ফেলতে বাধ্য করলাম।
কাটা মুরগীর মত লাফানোর চেষ্টা করছে ছেলেটা প্রচন্ড যন্ত্রণাতে। আমার দিকে দুটো রক্ত মাখা হাত বাড়িয়ে রেখেছে।
ক্ষমা প্রার্থনা করছে কি?
রক্তটা এসেছে ওরই হাঁটুর পেছন থেকে। ভেরিকোজ ভেইন তাহলে ফুটো হয়েছে, অ্যাঁ?
ভ্রু কুঁচকে ছেলেটাকে দেখছি। একটা বিষাক্ত সাপকেও এত ঘৃণার সাথে দেখি নি আমি।
মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি – তার ব্যাপারে বাজে কথা বলার সাহস কোন দিক থেকে পায় এই কুকুর-প্রসূত মানুষটা?
আফরিতাকে ফোন দিয়ে কষ্ট দেওয়ার সাহসই বা এর বুকে ধরে কিভাবে?
‘সরি, সজল।’ আমার হাসি হাসি গলাতে অবশ্য আমাকে মোটেও দুঃখিত মনে হয় না, ‘আর কোন মেয়ের শরীর দেখার উপায় থাকছে না তোমার।’
দুই চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এসেছে সজলের। আতঙ্ক আর যন্ত্রণা।
আমার হাত থেকে মুক্তি নেই বুঝতে পারছে।
অনবরত পানি বের হতে থাকা চোখ দুটোতে একেবারেই আচমকা ডানহাতের তর্জনী আর মধ্যমা গেঁথে দিলাম।
ঘিনঘিনে একটা অনুভূতি হচ্ছে আঙুলের নিচে। পিচ্ছিল পিচ্ছিল কি সব জানি আমার আঙুল বেয়ে উঠে আসতে থাকে।
আসলে উঠে আসছে না – ফিনকি দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে চোখ থেকে।
আর এসবের মাঝেই আমি আরও জোরে ঠেসে ধরি আঙ্গুলদুটোকে – চোখের আরও গভীরে নেমে যাওয়ার চেষ্টায়।
পারলাম না।
শক্ত কিছুতে আটকে গেছে আঙুল দুটোই।
আর এবার সমগ্র শক্তি একত্র করে আমার হাতটাকে চোখ থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে সজল।
তারপর শুরু হয় লাফালাফি। তীব্র যন্ত্রণাতে চেঁচাতেও পারছে না কুকুরটা – সেই সাথে দাঁপাচ্ছে।
কেন? আফরিতার দিকে তাকানোর সময় মনে হয় নি – কেপি নামের কোন সাইকো থ্রিলার রাইটার মেয়েটিকে ভালোবাসে?
মনে হলেও মোটা মাথাটা খাটিয়ে কথাটার তাৎপর্য কি সে বের করতে পারেনি?
ছেলেটার প্রতি আমার ঘৃণা বেড়েই চলেছে।
আরে ব্যথা তো লাগবেই – এত লাফালাফির কি আছে?
আর এত লাফালে আমিই বা বেজন্মাটাকে গুলি করব কি করে?
কাজেই – জোর করে হারামজাদাকে চেপে ধরলাম – ওর ওপর উঠে পড়েছি।
অন্ধ সজল প্রাণপনে সরানোর চেষ্টা করছে – শুধু আমাকে নয়, বিভিন্ন অঙ্গের মরণ যন্ত্রণাটুকুও।
কিন্তু ও কোনটাই সরাতে পারে না।
আর – ব্যাগ থেকে তৃতীয় বস্তু হিসেবে বের করা ছুরিটা ঘ্যাচ করে বসিয়ে দিলাম পশুটার ডান হাতে।
তীব্র বেগে রক্ত বের হচ্ছে – তার মাঝেই ডান হাতে আবারও গাঁথিয়ে দেই ওটা। কাঁধের কাছে।
মূল্যবান কিছু রগ কেটে গেছে। চাইলেই আর তিড়িং বিড়িং করতে পারবে না বেয়াদবটা।
সবকিছু পলিথিনে ভরে ব্যাগে ভরে ফেললাম। আর চার নম্বর জিনিস হিসেবে বের করলাম হিরোইনের প্যাকেটটা।
আস্তে করে বিছানার তোষকের মাঝে ভরে ফেলি ওটা।
পুলিশ আর সাংবাদিকদের জন্য সহজ সমীকরণ।
দুই যোগ দুই।
চার।
খবরটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিঃ হেরোইন চালান নিয়ে সংঘর্ষে রুয়েটেরর মেধাবী ছাত্র খুন।
পিঠে ব্যাগটা ফেলে চট করে রিভলভারটা বের করলাম।
সজলের নিম্নাঙ্গে পর পর তিনবার গুলি করলাম। পুরুষ হলে কেউ মেয়েদের সাথে এধরণের ভাষা ব্যবহার করে না।
চতুর্থ গুলিটি করলাম সজলের গলায়।
পঞ্চম গুলিটি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিল টেবিল ল্যাম্পটি – আর দরজা খুলে বের হয়ে সরে পড়লাম রুমটি থেকে।
গুলির শব্দে দুনিয়াবাসী ছুটবে এখন ওদিকে।
ধারে কাছে থাকা যাবে না।
কিশোর পাশা ইমন কখনও কাঁচা কাজ করে না।
*
ক্লাসে বসে বসেই ঘোড়ার মত ঘুমাচ্ছি।
গতকাল রাতে মেসটা থেকে বের হয়ে পাশের পুকুরে রক্ত ধুয়ে ফেলেছিলাম শরীরের।
তারপর হাতের গ্লাভস দুটো খুলে শান্ত পায়ে ফিরে এসেছিলাম নিজের মেসে।
তারপরও তো শান্তি ছিল না – ক্লাসটেস্টের জন্য পড়ব কী – আফরিতার মন ভালো করতে করতে রাত চারটা বেজে গেল।
আজকে আফরিতা সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে সজল আসলেই তার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে – কিন্তু ছেলেটা না আসাতে হতাশই হল বেচারি।
একটা বিশাল চিৎকারে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।
রাফি চেঁচাচ্ছে।
এ তো আরেকটা বেয়াদব। চেঁচায় কেন?
কান খাড়া করলাম – আফরিতার সামনে গিয়েই তো চেঁচাচ্ছে দেখা যায়!
‘তুই – তুই খুন করিয়েছিস আমার সজলকে। তুই করিয়েছিস খুনটা! ফোনে বাজে বলার ঝাল ঝেড়েছিস -’
সারা ক্লাস স্তব্ধ হয়ে যায়। সজলের মৃত্যুর ব্যাপারে জেনে গেছে এতক্ষণে সবাই।
আস্তে করে উঠে দাঁড়ালাম।
রাফির আঙুল আফরিতার মুখের সামনে নাচানাচি করছে – ওটা মুচড়ে ধরে নিরেট একটা ঘুষির সাহায্যে স্টেজের ওপর ফেললাম রাফিকে।
‘সজল ড্রাগ কার্টেলের সাথে জড়িত ছিল। পুলিশের রিপোর্ট পড়েছিস তোরা?’ গমগমে গলায় হুংকার ছাড়ি, ‘ক্লাসের মাঝে নিজেদের মাঝে ঝগড়া বিবাদ করার কোন মানে হয় না। সজলের মৃত্যুতে আমরা কেউই কম কষ্ট পাইনি।’
অনেকে সায় দেয় এই কথাতে। রাফি উঠে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করতে থাকে – তবে তাকে পিয়াস ধরে সরিয়ে নিয়ে যায় অন্য দিকে।
আস্তে করে বাইরের বারান্দায় বেড়িয়ে আসি আমি। আজ ক্লাসটেস্ট তো দূরে থাকুক – ক্লাসও হবে না।
আমার পাশে এসে দাঁড়ায় কেউ।
আফরিতা।
‘দিনের বেলায় হাই তুলিস। দিন দিন চিকণ হচ্ছিস। সারাদিন সিগারেট খাস – রাতের বেলাতে ঘুমাতে পারিস না। তাই না?’
মেয়েটার গলাতে প্রচ্ছন্ন একটা সুর আছে। আমার কানে আটকে যায়। এই প্রথমবারের মত ভয় পাই আমি।
জীবনটা এমন – কাওকে কাছে আনাটা ঠিক হয়নি। এজন্যই পতন হতে পারে আমার!
কথা ঘুরাই আমি, ‘একটা প্রশ্ন করেছিলি – মনে আছে?’
‘সজলের ব্যাপারটাতে তোর হাত আছে!’ ফিস ফিস করে বলে আফরিতা।
‘সোজাসাপ্টা উত্তর দেব। এখনও জানতে চাস কি না সেটা শুধু বল?’ আমি ওই টপিকটা ইগনোর করি এবারও।
অদ্ভুত একটা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকায় মেয়েটা।
‘চাই।’ আবার ফিস ফিস করে বলে ও।
পেছনে গোটা ক্লাস আছে – তার তোয়াক্কা না করে আলতো করে হাত তুলে নেই আমি ওর, ‘আই লাভ ইউ, আফরিতা।’
রচনাকাল – এপ্রিল ২১, ২০১৪
Leave a Reply