অধিক নৈতিকতাই বাংলাদেশের সর্বনাশ করেছে
প্রায় শুনি, মানুষের মধ্য থেকে নৈতিকতা উঠে যাচ্ছে। আমার তা মনে হয় না। উঁহু। মানুষ কোড-ভিত্তিক প্রাণি। তার মোরাল কোড থাকে, থাকতে বাধ্য। যে ভয়ঙ্কর খুনি, তারও থাকে কিছু নিজস্ব নীতি, যদিও সভ্য সমাজ তার সে কোডকে ছিঃছিক্কার করে, তবে কোড তো আছে কিছু তারও।
দুটো দশক এ সমাজে বাস করে যা অনুভব করেছি, তাকে নৈতিকতার অভাব বলা যায় না। বরং অধিক নৈতিকতা আমাদের বাংলাদেশকে নোংরা ও কদর্য একটি স্থানে পরিণত করেছে।
মানুষ মোরাল কোড বেছে নিতে ও তা মেনে চলতে ভালোবাসে। আইন ভাঙার থেকে আইন মানার ব্যাপারে এই প্রাণিটির টেনডেন্সি বেশি। এটা মূলতঃ আসে আমাদের প্যাকে (similar to wolf packs ) চলাফেরার অভ্যাসের কারণে, এবং আপনি আমার কথায় দ্বিমত করতে পারেন, কারণ দেশে তো কাউকে আইন মানতে দেখা যায় না। 😉 ব্যাখ্যা করতে দিন।
মোরাল ডিলেমা নিয়ে আগে আলাপ করা যাক। মোরাল ডিলেমা – যেখানে পরস্পর বিপরীত দুটো বিষয়কে আপনার কাছে সঠিক মনে হতে পারে, নৈতিকভাবে। ধরুন, চোর। তিন দিন ধরে খায়নি। ক্ষুধার জ্বালায় চুরি করেছে। ধরা পড়েছে। তাকে দোকানের মালিক নিয়ে এলো। আপনি মোরাল ডিলেমায় পড়ে যাবেন। চোরের শাস্তি আছে। তবে মানুষ অভুক্ত থেকে মারা যাবে কারণ তার টাকা বা খাবার নেই তা-ও নৈতিকতার বিচারে সঠিক নয়। এই চৌর্যবৃত্তিটিকে নৈতিকতার পরিপন্থি বলা হবে কি না! এই হচ্ছে মোরাল ডিলেমা।
আমাদের বাংলাদেশে নৈতিকতার অভাব নেই। বরং প্রাচুর্য আছে। এই প্রাচুর্যের ঠেলায় মোরাল ডিলেমা সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ মুহুর্মুহু মোরাল ডিলেমায় পড়তে পছন্দ করে না। মোরাল ডিলেমা সপ্তাহে দু-একবারের বেশি হওয়ার কথা নয়। অথচ যখন তারা দিনে দশবার এই ডিলেমায় পড়ে তখন তারা মোরালি কনফিউজড হয়ে যায়। যা আমাদের দেশে একটি সাধারণ দৃশ্য।
মোরাল ডিলেমাটি “কাহাদের সৃষ্টি” – সে ডিবেটে যাবো না। আমার কাজ আপনাদের কাছে তার স্বরূপ তুলে ধরা। বাদবাকি বিচার বিবেচনা আপনাদের।
বাংলাদেশি মাত্রই তাকে একটি নয়, দুটি নয়, তিনটি সংবিধান ধরিয়ে দেয়া হয়।
১। বাংলাদেশের সংবিধান – যা সর্বসম্মতিক্রমে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত আমাদের দেশের আইন ও যা মেনে চলতে নাগরিক বাধ্য। নইলে আইন ও বিচার বিভাগের তরফ থেকে শাস্তির বিধান রয়েছে।
২। বাঙালিয়ানা সংবিধান – যা বাঙালিদের অতি-উৎসাহে আমাদের দেশের সিউডো-আইন ও যা মেনে চলতে নাগরিককে বাধ্য করা হয়। নইলে সামাজিক শাস্তির বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের জন্ম বাঙালিয়ানা থেকেই হয়েছে বলে এটি নিয়ে গোঁড়ামি আছে। শহীদ মিনারের সামনে ইংরেজি বা হিন্দী গানের তালে নাচাকুদো করলে বাঙালিয়ানা ভঙ্গ হয় ও সমাজ নাগরিককে শাস্তি দেয়। বিকিনি পরে কক্সবাজারে হাঁটলে বাঙালিয়ানা ভঙ্গের অভিযোগে বাঙালিরা নাগরিককে শাস্তি দেন, ইত্যাদি, যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে এরা কোনও অপরাধ নয়।
৩। শরীয়তের সংবিধান – যা মুসলিম জনগোষ্ঠীর অতি-উৎসাহে আমাদের দেশের সিউডো-আইন ও যা মেনে চলতে নাগরিককে বাধ্য করা হয়। পর্দা করেননি বলে নাগরিককে শাস্তি দেয়া হয় (সোশাল শেমিং)। লিগাল বার থেকে মদ খাচ্ছে বলে হট্টগোল করা হয়, কারণ ধর্মে ওটা নিষেধ। অথচ বাঙালিয়ানা ও বাংলাদেশ সংবিধানের দৃষ্টিতে এরা কোনও অপরাধ নয়।
খেয়াল করলে দেখবেন এটি স্রেফ সামাজিক সমস্যা নয়। পুলিশ এসে সুন্দর কিন্তু ব্যতিক্রমী হেয়ারস্টাইলের ছেলেদের ধরে ফেলে। তারপর চুল কেটে দেয়। প্রেমিক-প্রেমিকাকে হেনস্থা করা হয়। হোটেলে-মোটেলে পুলিশ মাঝে মাঝেই “অসামাজিক কার্যক্রমের দায়ে” যুগলদের বন্দী করে ও নিজেরাই বাদী হয়ে মামলা করে দেয়, যদিও তারা পর্নোগ্রাফি ভিডিয়ো বানাচ্ছিলো না কিংবা প্রস্টিটিউশনের সাথে জড়িত ছিলো না। এসব মাত্রাতিরিক্ত নৈতিকতা বাংলাদেশের সংবিধান পরিপন্থী কাজ, অথচ ইসলামিক আইন ও বাঙালিয়ানা আইনে জায়েজ। তাই পুলিশ পর্যন্ত – যারা কিনা আইনের ধারক ও বাহক- এই অলিখিত, অসংবিধানিক আইনের ওপর অ্যাক্ট করে। পাবলিক বে-আইনী এসব কর্মকান্ডে হাততালি দিয়ে থাকেন।
এর প্রভাবটা এবার দেখা যাক। একজন তরুণী মোরাল ডিলেমায় পড়ে যান। তিনি একজন সৎ ও সুনাগরিক। ট্যাক্সপেয়ার। শিক্ষিতও বটে। দেশের অ্যাসেট। তবে ২০২১ সালে পৃথিবীর আর ২০০ কোটি তরুণীর মতো তিনি জীবন যাপন করেন। পর্দাপ্রথা তার পছন্দ নয়। তিনি মুখ খোলা রেখে চলাফেরা করতে পছন্দ করেন। এটি তার ব্যক্তিগত অধিকার ও নিজস্ব পছন্দ। তবে তাকে একশ’জন প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়, “পর্দা করা ফরজ, এটা তোমার করা উচিত”। ফরজ মানে কী? সওয়াবের বালতি নয়। ফরজ অর্থ অবশ্য পালনীয় আইন। বাংলাদেশে পর্দা করা আসলে ফরজ নয়, দেশের সংবিধানে তা নেই। কাজেই তরুণী মোরাল ডিলেমায় পড়ে যাচ্ছেন। “আমি কি আইন ভাঙছি? না। কিন্তু ওরা বলছে ভাঙছি।”
একসময় তিনি হয় মনে করেন তিনি আসলেই আইন ভাঙছেন এবং অন্যদের এই চাপ দেয়া শুরু করেন। অথবা তিনি হয়ে ওঠেন প্রতিবাদ-মুখর নারীবাদী। উভয় ক্ষেরেই (পক্ষ না নিয়ে বলছি) বিষয়টি সোশাল ইমব্যালেন্স ক্রিয়েট করে।
বাঙালি তিনটি আইনের বই মেনে চলার চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে অনেক ব্যাপারে তিনটি আইনের বই তিন অবস্থান রাখে। তারা বাংলাদেশের সংবিধান মেনে চলেন। তারা বাঙালিয়ানা মেইনটেইন করার চেষ্টা করেন। তারা ইসলামের হুকুম-আহকাম মেনে চলতে চান।
তাদের চোখে দেশের আইন না মানা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, বাঙালিয়ানা ইগনোর করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ (একজন বিতর্কিত মন্ত্রী বাংলা সাইনবোর্ড না থাকলে তা গায়ের জোরে “ভেঙে দেওয়ার” জন্য ফেসবুকের ভেরিফাইড পেইজ থেকে তরুণদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, বিশ্বাস করতে পারেন?) এবং আল্লাহর আইন মেনে না চলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অর্থাৎ নৈতিকতার অভাব বাংলাদেশিদের নেই। প্রাচুর্য আছে। মানুষের মস্তিষ্ক তিনটি সংবিধান, তিনটি ভিন্ন কোড মেনে চলার জন্য তৈরি নয়। তারা তিন “ALPHA” মানার মতো প্রাণি নয়। মানুষ নেকড়েদের মতো। ALPHA WOLF মেনে চললে নেকড়ের পাল দীর্ঘদিন টিকে থাকে। মানুষ তেমন “একটি” ALPHA মানতে সক্ষম। তিনটি আলফা? মানতে তারা পারবে না। প্রতিবার ব্যর্থ হবে, মোরাল কম্পাসের কাঁটা বিক্ষেপ দেবে গ্যালভানোমিটারের মতো।
দিচ্ছেও। নীলক্ষেতের চুরি করা কপি পড়ে আমরা হয়ে যাচ্ছি ইঞ্জিনিয়ার। ফ্রি ডাউনলোডের বই থেকে শিখেছি ম্যাথমেটিকস। এসব আইনগতভাবে বাংলাদেশে অনৈতিক নয়, কারণ পরিস্থিতির কারণে উপায় নেই। তবে ইসলামের চোখে এই জ্ঞানার্জন পুরোটাই হারাম। এই নীলক্ষেত প্রিন্ট পড়ে বিএসসি ডিগ্রি আর সার্টিফিকেট অর্জন যে করলো আর তা দেখিয়ে চাকরি যে নিলো তার প্রতিটা পায়-পয়সা হারাম। হারাম মানে গুনাহের বালতি কেবল তা নয়, হারাম মানে আইনতঃ নিষিদ্ধ। কার আইন? আল্লাহর আইন। নাগরিক পড়ে গেলেন কোথায়? মোরাল ডিলেমায়। তিনি জানেন তিনি সাক্ষাত শয়তান।
বাংলাদেশের সংবিধানে তিনি জান্নাতী, সাক্ষাত ফেরেশতা, বাঙালি আইনে দেশপ্রেমিক ও ফেরেশতা। আল্লাহর আইনে সাক্ষাত শয়তান। এটি যে তার আত্মার ওপর জুলুম তা তিনি বোঝেন। তিনি ট্রিগারড হন, আরেকজনকে বলতে থাকেন, “নামাজ পড়ো। আল্লাহর আইন মানো। শরীয়ত মানো।”
কারণ তিনি তো শরিয়তের আইনে সাক্ষাত পিশাচ। মানুষ যতই ভালো হন না কেন। এই গিল্ট তার মধ্যে আছে কেন? নৈতিকতার অভাবে? নয়। চরম ও অতিরিক্ত নৈতিকতার কারণে।
এর প্রতিকার কী?
আমার সাথে সাথে উচ্চারণ করতে পারেন, “যাহা সংবিধানে অপরাধ নহে, তাহার সবই হয় সঠিক, নয়তো ধূসর কর্ম। খারাপ কিছু নয়।”
ধূসর অঞ্চল বা গ্রে এরিয়ার সাথে পরিচিত হন। এটি আদতে আমাদের দৈনন্দিন ৯০% কাজকর্ম। বন্ধুর পিঠ চাপড়ে দেয়া। প্রেমিকার হাত আঁকড়ে ধরা। দোকানদারের সাথে মৃদু ঝগড়া করা। ইত্যাদি। এরা কি ন্যায় না অন্যায়? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা ধূসর, তবে অন্যায় নয়। ধূসর, কারণ এক নাগরিক এসে বলবে “ইহা পাপাচার” আবার অপর এক নাগরিক এসে বলবেন, “ইহাই সভ্যতা।”
দেশের আইন কী বলে? তা নাগরিকের ব্যক্তি-অধিকার।
কাজেই সামাজিক, বাঙালিয়ানা, ও শরিয়তের আইন এখানে বিবেচ্য নয়, ধূসর কাতারে চলে যাবে। যতই ধর্মপ্রাণ হয়ে থাকুন না কেন, একই সাথে তিন আইনের বই মানতে যাবেন না। নিজের ধ্বংস ডেকে আনবেন। দেশের ধ্বংস ডেকে আনবেন। পাড়া-প্রতিবেশির ধ্বংস ডেকে আনবেন। পরিবেশটা বানাবেন টক্সিক।
আমরা বাংলাদেশি। আমরা একটি আইন মানবো কেবল।
বাংলাদেশের সংবিধানের আইন।
এর বাইরে কে কোন ট্রেডিশন পালন করছে তা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কারো মনে চাইলে সুন্নতি জীবন যাপন করবে। মাথায় পাগড়ি দেবে, পাঞ্জাবি পরবে, হাতে রাখবে তসবীহ। কেউ আবার হয়ে যাবে মাইকেল জ্যাকসন। চুল থাকবে লম্বা, ট্যাংড্যাং করে গিটার বাজাবে, উদ্দাম জীবন-যাপন করবে। দুটোর কোনটি-ই অন্যায় নয় ও সমান সম্মানের, ধূসর এলাকার। এই কথাটি বার বার আমাদের বলতে হবে।
প্রতিনিয়ত আউড়াতে হবে, “যাহা সংবিধানে অপরাধ নহে, তাহার সবই হয় সঠিক, নয়তো ধূসর কর্ম। খারাপ কিছু নয়।”
নৈতিকতার প্রাচুর্যে আমরা কনফিউজড ও ইমমোরাল হয়ে উঠেছি।
এত নৈতিকতার দরকার নেই।
একটি নৈতিকতার বই যথেষ্ট।
আর তা হলো বাংলাদেশের সংবিধান।
মে ৩০, ২০২১
Leave a Reply