অধ্যায় ০১ ⌛ থট প্রসেস
চিন্তা করতে পারা মানুষের জন্য বড় একটা গুণ। পশুর থেকে মানুষের পার্থক্য কোন জায়গায় তা নিয়ে অনেক আলতু-ফালতু কথা বাজারে প্রচলিত আছে। কিন্তু পশুর থেকে মানুষের পার্থক্য মূলতঃ চিন্তা করতে পারাতেই। এখান থেকেই গণিত এসেছে। বিজ্ঞান এসেছে। মানুষ অট্টালিকা বানাচ্ছে, রকেট বানাচ্ছে, আপনি আমার লেখা পড়তে পারছেন।
মানুষ চিন্তা করে কোনও রকম চিন্তা না করেই। মানুষ এরকমই একটা প্রাণি। অর্থাৎ মানুষ তার বিশেষ এই গুণটি কোনওরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই পেয়েছে। ট্রেনিং ছাড়া চিন্তা করতে শেখার মাধ্যমে কি হলো জানেন? আমরা এত বড় একটা টেকনলজি ভেতরে নিয়ে ঘুরতে শিখলাম, অথচ সেটা সচেতনভাবে চালাতে শিখলাম না। আপনার হাতে একটা বই দেওয়া হয়েছে আর আপনি সেটার পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে হাসিস টানেন। আপনার কাছে একটা স্মার্টফোন আছে আর আপনি ওটা দিয়ে ঠুকে ঠুকে পেরেক পোঁতেন। ভাবেন, “স্মার্টফোনটা তো দারুণ কাজের!”
চিন্তাশক্তিরও অবস্থা একই। ব্যবহার করতে জানি না বলে আমরা সেটা ব্যবহার করি পশুদের মতো। অর্থাৎ কোনও পরিস্থিতিতে পড়ে গেলে চট করে আমরা একটা উপসংহারে আসি। আগুনের কাছে গেলে যেমন “গরম, দূরে যাই।” ভাবি – এটাও কিন্তু চিন্তা। এই চিন্তা পশুও করে। আপনি মস্তিষ্ককে চিন্তার পেছনে এত সামান্য খাটালে আপনার সঙ্গে পার্থক্য রইলো না পশুর।
হয়তো ভাবছেন, আপনি তো এত সাধারণ চিন্তাই করেন না। কোনও ভয়াবহ সংবাদ পত্রিকায় পড়লে সে বিষয়েও বেশ ভাবেন। তখন ক্রিটিকাল থিংকিং কি করছেন না?
উত্তরটা অধিকাংশ সময়ই, “না!”
কারণ, আপনার চিন্তাভাবনা একটা পশুর মতোই আটকে আছে অভিজ্ঞতার কুয়োতলে। ছোটবেলা থেকে আপনি যা শিখেছেন, তার ওপর ভিত্তি করেই চিন্তা করছেন আপনি। একটা পশু তা-ই করে থাকে। জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। পথঘাট ভাঙা দেখলে বোঝে, তান্ডব চালিয়েছে হাতি। সে পথ সে এড়িয়ে চলে, যদি বোঝে পালটা কাছেই আছে। এটা সে শিখেছে কোত্থেকে? অতীত অভিজ্ঞতা থেকে। এ কারণে, পশুর চিন্তাভাবনা কম হলেও তা তার নিজের জীবনে অ্যাকুরেট হয়। কিন্তু আপনার চিন্তা সাধারণতঃ পশুরও অধম। কারণ, একে তো চিন্তাটা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে। তারওপর এই চিন্তা স্বাধীন নয়।
কেননা, অধিকাংশ সময় সেই অভিজ্ঞতা এসেছে অন্য মানুষদের জীবন থেকে।
জীবনে আপনি অটোমেটিক যা শিখেছেন, সবটুকুই যদি বর্জন করতে না জানেন, তাহলে আপনি এখনও চিন্তা করতে শুরুই করেননি। আপনার প্রশ্নটা কি হতে পারে আমি ধরতে পারছি। এক জীবনে কত কিছু শিখবো? পূর্বপুরুষ যেভাবে ঠিক আর ভুল নির্ণয় করেছেন তাই মেনে নেওয়া দরকার। এটা তাদের লাইফটাইম অভিজ্ঞতার ফসল। এখানে আমি একমত পোষণ করবো। অনেক কিছুই আমাদের অন্য মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে নিতে হয়। কারণ, এক জীবনে এত কিছুর অভিজ্ঞতা নেওয়া সম্ভব নয়।
তবে, পূর্বপুরুষের অভিজ্ঞতা মানেই সঠিক ধরে নিলে সমস্যা যেটা হবে, তাদের দশটা চিন্তার নয়টা ঠিক আর একটা ভুল হলে আপনি সেই ভুলটাও সঠিক বলে ধরে নেবেন। কাজেই, বিষয়টা বুঝতে হলে আমাদের সবগুলো চিন্তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে। অত্যন্ত সেন্সিটিভ চিন্তাগুলোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে। তারপর যদি মনে হয়, এটা ঠিক – তবে গ্রহণ করতে হবে। ভুল মনে হলে করতে হবে বর্জন।
আমরা অটোমেটিক পেয়ে যাওয়া চিন্তাগুলোকে একটা প্রশ্ন করবো, “কেন করবো?”
অথবা, “কেন করবো না?”
প্রশ্ন না করে কোনও কাজ করে যাবে না। কোনও চিন্তা করা যাবে না। সেক্ষেত্রে এটা হয়ে যাবে পশুর চিন্তা। সবাই এমন করে, তাই আমাকেও তাই করতে হবে। এটা ভুল। আবার আমরা সবকিছুই সমাজের শিক্ষার উল্টোটা করবো, তাও না। সেটাও হবে ভুল। বরং র্যাশনাল বিইং হিসেবে আমরা প্রতিটা কাজকে ফিল্টার করে নেবো। সবার জন্য ভালো হলে সেটা গ্রহণ করবো। নয়তো বর্জন করবো।
এভাবে ভাবার সবচেয়ে বড় শত্রুটা হলো, সামাজিক হিপনোটিজম।
এই নামকরণ আমার করা। তবে এর চেয়ে যথার্থ নামকরণ হয়তো সম্ভব ছিলো না। এক সামাজিক হিপনোটিজম দিয়েই থট প্রসেসের সবটা ব্যাখ্যা করা যাবে।
সামাজিক হিপনোটিজম কি?
একটা বাচ্চা যখন একদমই শিশু থাকে, সে চিন্তা করার ব্যাসিকটা শেখে। তখন তাকে যা শেখানো হয় তাকেই সে সারাটা জীবন সঠিক মনে করে। সচরাচর মানুষ যে ধর্মে জন্মগ্রহণ করে সে ধর্মকেই সত্য ও সঠিক ধর্ম বলে প্রচার করে, কারণটা এই। জীবনের প্রথম কয়েকটা বছর সে যা অভিজ্ঞতা লাভ করে তার ভিত্তিতেই সে বাকি জীবন চিন্তা করতে শেখে। ওটাই তার ব্যাসিক। ধরুন আপনি আজ ইংরেজি শিখবেন। Dog লেখা দেখলে আপনি ভাবেন কুকুরের কথা। তারপর আপনি কুকুর দেখতে পান। একটা ইংরেজি বাক্য বলার আগে আপনার মাথায় সেই বাক্যের বাংলাটা আসে। অর্থাৎ আপনার রেফারেন্স পয়েন্ট বাংলা। তেমন, আপনি এই মুহূর্তে যা চিন্তা করছেন সবটুকুরই রেফারেন্স পয়েন্ট আপনার শৈশব।
পরে আপনি পিএইচডি করবেন। ডক্টর হবেন। নেদারল্যান্ডে চার বছর থাকবেন। অথচ আপনার চিন্তাভাবনা রয়ে যাবে আপাদমস্তক এক শিশু-আপনারই। মুক্তভাবে চিন্তা করতে না জানলে, প্রত্যেকের জীবনকেই শেপ করে তার আর্লি চাইল্ডহুড। এমন কিছু স্মৃতি আপনার চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে যা আপনি হয়তো এখন মনেও করতে পারেন না। ধরা যাক, আপনি দুই বছর বয়সে রিকশায় বসে একটা এক পা কাটা মানুষ দেখেছেন রেল লাইনের পাশে। আপনার সারাজীবনই বাস জার্নি প্রেফার করার অভ্যাস থাকতে পারে। কেন? আপনি জানেন না। কারণ দুই বছরে কি দেখেছেন তা আপনার মনে নেই। অথচ আপনার থট প্রসেস নিয়ন্ত্রণ করছে সেই চাইল্ডহুড।
আবার আপনাকে বাবা-মা যা শিখিয়েছে, মামা-চাচাকে যেসব জিনিস করতে দেখেছেন, তাই আপনি শিখেছেন। যদি পরিচিত কেউ বলেছে “অমুক কাজটা খারাপ,” আপনি ধরে নিয়েছেন ওটা খারাপ। অর্থাৎ আপনি খুব সামান্যই নিজের চিন্তা নিয়ে চলাফেরা করেন। পাঁচ-ছয় বছরের আপনার স্মৃতি আর রাজ্যের সব লোকজনের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে আপনার চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রিত হয়।
বড় হয়ে আপনি কেবল সেসব চিন্তাকে ডিফেন্ড করা শেখেন। পিএইচডি হোল্ডার আপনি বলবেন, “ট্রেন ভালো লাগে না, কারণ ওতে ভিড় থাকে।”
আপনাকে ফার্স্ট ক্লাসের কথা বললে বলবেন, “তাও, হ্যাসল তো। এজন্য যাই না আরকি।”
শুনে মনে হবে খুবই ভাবনা-চিন্তা করে বলছেন, অথচ আপনার চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করছে কি, তা ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না কিন্তু। ভালো লাগা বা না লাগার ওপর কারও হাত নেই, কথাটা সত্য না। আমাদের ভিড় ভালো লাগে, নাকি একাকী থাকা? প্রেমের বিয়ে ভালো লাগে, না অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ? প্রতিটা চিন্তার পেছনেই নিয়ন্ত্রক আছে। নিয়ন্ত্রক সরাতে না পারলে আপনি চিন্তা করা শেখেনইনি।
কেবল ডিফেন্ড করতে শিখেছেন আপনার ছোট্টবেলার অভিজ্ঞতাগুলোকে।
এটা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কি করতে হবে?
যা শিখেছেন, সব কিছুই ভুল হতে পারে, এটা মেনে নিতে হবে। এটাই প্রথম ধাপ। এমনকি ধ্রুব সত্য বলে যাদের জানেন তারাও হতে পারে ভুল। এটা অ্যাকসেপ্ট করতে যতদিন না পারবেন, আপনি সামাজিক হিপনোটিজমের শিকার।
আপনি হিপনোটাইজড!
এটা থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে পরের অধ্যায়ে কথা হবে আরও।
দ্বিতীয় অধ্যায় ⌨ যা জানেন ভুলে যান
Leave a Reply