KP Imon

Words Crafted

অধ্যায় ০২ ⌛ যা জানেন ভুলে যান

অধ্যায় ০১ ⌛ থট প্রসেস

সামাজিকভাবে আপনি হিপনোটাইজড কি না কি করে বুঝবেন? সারাদিন নিজের সবগুলো চিন্তা আর কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করুন। যেসব কাজ একেবারে প্রেটি অবভিয়াস কাতারে পড়ছে, তাদের ঠিকমতো প্রশ্ন করতে পারাই এই পরীক্ষার আসল দিক। কারণ, ওগুলো আপনার চোখ এড়িয়ে যাবে। উদাহরণ : ডান হাতে জিনিস দেওয়া বা নেওয়া। আপনি এটা ছোটবেলা থেকে করে আসছেন হয়তো। কখনও কি প্রশ্ন করে দেখেছেন, যে কাজটা কেন করছেন? 

করেননি। এটা প্রেটি অবভিয়াস যে কিছু দিলে ডান হাতেই দিতে হবে, নিলে ডান হাতেই নিতে হবে। কেন?

সমাজ আপনাকে এটা শিখিয়েছে। মেজরিটির সমাজ হয় চতুর্মুখী। 

১। বাঙালি 

২। মুসলিম 

৩। বাংলাদেশি

৪। নিজের জেলার লোক 

এই চার সমাজ মিলে হয় বাংলাদেশের সমাজ, তার অধিকাংশ আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এই সমাজ। এই চারের প্রভাবে আপনি অনেক কিছুই জ্ঞান হওয়ার আগ থেকে শোনেন এবং শিখেন। কোনধরণের চিন্তা ছাড়া আপনি যা শেখেন তাই সামাজিক হিপনোটিজমের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ এদের সবাইকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে। এটা করার জন্য আপনাকে নিজের কমিউনিটি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই পর্যায়ের নাম আমি দিয়েছি, এভরি ম্যান ফর হিমসেলফ।

এভরি ম্যান ফর হিমসেলফ

নামটা সেক্সিস্ট হয়ে গেল। মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই ধারণাটির মূলকথা একটাই, আপনি নিজেকে কোনও জাতি বা দলের একজন বলে গর্ববোধ করতে পারবেন না। সেখান থেকে বেরিয়ে আসাটাই প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ। এর অর্থ কি জন্মসূত্রে আপনার বাঙালি, বাংলাদেশি, মুসলমান এবং খুলনাবাসী হওয়া থেকে নিষেধ করা হচ্ছে? উঁহু। মোটেও তা নয়। 

বরং আপনাকে প্রথমে এতটুকু স্বশিক্ষিত হতে হবে যে আর দশজন বাঙালি, বাংলাদেশি, মুসলমান, খুলনাবাসী যা ভাবছে, যেভাবে ভাবছে তা সঠিক নাও হতে পারে। কাজেই, আপনি কোথায় জন্মেছেন তা কখনোই ভুলবেন না। তবে তাদের একজন বলেই আপনি জাতির ভুল নিজে করবেন এমনটা যেন না হয়। এজন্যই প্রথমে নিজেকে বের করে আনা। নয়তো সমাজের প্রভাবে আপনি ভুল করবেন এবং সেই ভুল নিয়ে গর্ববোধ করবেন। 

সামাজিক হিপনোটিজমের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো, এটা আপনাকে দিয়ে অন্যায় করাবে। তারপর সেই অন্যায়ের জন্য আপনি লজ্জিত না হয়ে হবেন গর্বিত।

আমরা জাতিগত কারণে গর্বিত কোন কোন কারণে  

কোনও কিছু পরিশ্রম করে অর্জন করতে না পারলে ব্যক্তির যে গর্ব, তা কখনোই নির্দোষ নয়। বড়লোক বাবার ছেলের যদি টাকা-পয়সা দিয়ে ফুটানি দেখায় সেটা কেমন কুশ্রী? তেমনই কুশ্রী আপনার পূর্বপুরুষের গ্লোরি নিয়ে বুক ফুলিয়ে গর্ব করা। যেমন ১৯৭১ এবং মুক্তিযুদ্ধ। এটা নিয়ে গর্ব করতে পারেন মুক্তিযোদ্ধারা। সমসাময়িক প্রতিটি মানুষ। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কিংবা সাধারণ এক বাংলাদেশি এ নিয়ে গর্বিত হলে হবেন কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। তিনি এটা অর্জন করেছেন। তবে অ্যাজ আ পার্সন, এটা নিয়ে ফুটানি দেখানোর অধিকার বাংলাদেশির নেই। আপনি যদি জনতার অধিকার আদায়ে একটা সংগ্রাম করে দেখাতে পারেন আজ, সেটা সমসাময়িক বাংলাদেশির জীবনে কিছু গৌরব যোগ করতে পারে। 

এক শ্রেণির মুসলমান আছেন। সংখ্যাই তারা মেজর। তাঁরা মনে করেন মুসলমানদের অনেক অর্জন। সে কারণে নানা রকম বড় বড় কথা বলে ফেলেন। দেখান অহংভাব। এটা দেখানোর অর্থ তিনি একজন নগণ্য মানুষ। নিজের জীবনে কিছু করতে পারেননি। তাই পূর্বপুরুষের অর্জন নিয়ে প্রচুর গর্ব। সামান্যতম সেলফ রেসপেক্ট থাকলে এমনটা কেউ করবেন না। বড়লোক বাবার ছেলের যেমন টাকার অহংকার বেমানান ও কুশ্রী। আপনার পূর্বপুরুষের লাখ লাখ অর্জন নিয়ে আলোচনা করা তেমনই কুশ্রী। তবে আজ আপনি যদি মুসলমান হিসেবে একটা কিছু অর্জন করতে পারেন, সমসাময়িক মুসলমানের জীবনে কিছু গৌরব যোগ করতে পারে তা। 

বাঙালি হওয়ার কারণেও অনর্থক গর্ব আছে। যেমন সত্যজিত রায় নিয়ে গর্ব। সত্যজিত রায়ের অর্জন কেবল সত্যজিত রায়েরই। খুব বেশি হলে সমসাময়িক বাঙালির। আজকের দুনিয়ার বাঙালির নয়। আপনি যদি আজ অস্কারে উঠতে পারেন, সেটা কিছু গৌরব যোগ করতে পারে বাঙালি কমিউনিটিতে।

গর্বে সমস্যা কোথায়? 

আপনি নিজের জাতিকে নিয়ে গর্ববোধ করার অর্থ, তাদের একজন বলে আপনি এতটাই গভীর থেকে বিশ্বাস করেন, তারা যেদিকে রওনা দেবে আপনি নিজেও সেদিকে চোখ-কান বন্ধ করে রওনা দেবেন। এতে করে জাতির সাথে আপনার পতনও হবে বিরাট। তবে আপনি যদি নিজেকে নিজের সম্প্রদায় থেকে আলাদা করে ভাবতে পারেন, ভাবতে পারেন এভরি ম্যান ফর হিমসেলফ – জাতির ক্রান্তিকালে আপনি হয়তো হয়ে যাবেন কান্ডারি।

চিন্তার ভুল সব সমাজেই আছে

আপনি যদি ওপরে উল্লেখিত পথে হেঁটে নিজেকে নিজের সম্প্রদায়ের ভিড় থেকে বের করে ফাঁকা একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারেন, তবেই কেবল লক্ষ্য করতে পারবেন অন্যান্য সম্প্রদায় কিভাবে চিন্তা করছে। খেয়াল করে দেখবেন, তাদের চিন্তাধারা আর আপনার চিন্তাধারা একই রকম।

বাংলাদেশি যেমন বাংলাদেশি হতে পেরে গর্বিত। ভারতীয় তেমন ভারতীয় হতে পেরে গর্বিত। বাংলাদেশি মনে করে বাংলাদেশ-ই পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দেশ। সকল দেশের রাণী। ভারতীয় মনে করে ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দেশ। বাংলাদেশি মনে করে পৃথিবীর সবাই তার দেশ নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভারতীয় মনে করে দুনিয়াবাসী সবাই তার দেশকে স্বর্গ ভাবে। আসলে ঘণ্টা। যে যার দেশকেই শ্রেষ্ঠ ভাবে। গাঁয়ে মানুক আর না মানুক, আপনি মোড়ল সবাই। অর্থাৎ, দাঁড়ালো কি? আপনার দেশপ্রেমের দুই পয়সাও দাম নেই। নিজেকে তো সবাই শ্রেষ্ঠ মনে করে। 

বাঙালি যেমন বাঙালি হতে পেরে গর্বিত, তামিলনাড়ুর মানুষ তেমন তেলুগুভাষী হতে পেরে গর্বিত। ইংরেজের গর্বের তো সীমা নেই। তাদের ধারণা তারাই সবচেয়ে চমৎকার ভাষাটিকে নেটিভ হিসেবে পেয়েছে। বাঙালি বলে আমরা রক্ত দিয়েছি। প্রেম আমাদের বেশি। তামিল জনতাও ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। তারাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? তারা বলে, আমাদের প্রেম সবার থেকে বেশি। যারা রক্ত দেয়নি, তারা এই প্রসঙ্গে কথা হলে বলে, প্রয়োজন পড়লে আমরাও দিতাম। পড়েনি, তাই দেইনি। অর্থাৎ আবার যে কার সেই। সবার ধারণা, সে নিজেই শ্রেষ্ঠ।

মুসলিম পপুলেশনের মেজরিটি মনে করেন তাঁরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। তাঁরাই আছেন সীরাতুল মুস্তাকিমে। কাজেই তারা ঠিক পথে হাঁটছেন, বাকিরা ভুল পথে। এজন্য মুসলিম জাতিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ। কেন? কুরআনে এর স্বীকৃতি আছে। অথচ খ্রিস্টানরা মনে করেন তারাই একমাত্র সঠিক পথে আছেন, বাকিরা ভুল পথে। কেন? এই কথা আছে বাইবেলে। ইহুদিরা সুনিশ্চিত, তারাই শ্রেষ্ঠ। কারণ, তোরাহে এটাই বলা হয়েছে। এদের কেউ বিশেষ কিছু অর্জন করে এই বিশ্বাস খুঁজে পায়নি। যে মুসলিম নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, সে জন্মের পর থেকে মুসলমান পরিবারের শিক্ষা পেয়ে ভেবেছে এই কথাটাই সত্য। আবার যে খ্রিস্টান নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, সে জন্মের পর থেকে খ্রিস্টান বাবা-মার থেকে জেনেছে সে যা জানে তা-ই সত্য। একজন মুসলমান যদি খ্রিস্টানকে ভুল ভাবে, কিংবা খ্রিস্টান যদি মুসলমানকে ভুল ভাবে, দু’জনের কে সঠিক? দু’জনই নিজ নিজ পরিবারের থেকে শিশুকালে যা শিখেছে তার ভিত্তিতে বায়াসড বা পক্ষপাতযুক্ত উপসংহারে পৌঁছেছে। নিজেরা চিন্তা করতে পারেনি। তাই ওরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবলো আর অন্যকে মনে করলো ঠিক। অর্থাৎ আবারও আমরা চলে গেলাম সেখানে, যেখানে গাঁয়ে মানুক আর না মানুক। আপনি সবাই মোড়ল।

এমন তো হওয়ার কথা নয়। একজন ঠিক হলে আরেকজন বাতিল। অর্থাৎ সম্প্রদায়ের ভেতর চিন্তায় ভুল থাকে। চিন্তার এই ভুলগুলো আপনি সম্রপদায়ে ঢুকে বসে থেকে জীবনেও দেখতে পাবেন না। গায়ের জোরে নিজেকে সঠিক বলে প্রচার করতে করতে ভুলগুলোকেও আপনার চোখে ঠিক মনে হবে। কাজেই প্রথমে বেরিয়ে আসতে হবে নিজের গোষ্ঠীর পরিচয় থেকে। তবেই ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে সত্যটা। 

এই সত্য খুব সহজ। মাথা গুলিয়ে যাওয়ার মতো কিছু নয়। সত্যের এই সহজ রূপটা সামনে এলে বোঝা যাবে আপনি চিন্তা করতে সক্ষম হয়ে উঠেছেন। বিভ্রান্তিতে আপনাকে আর কেউ ফেলতে পারবে না। অবশ্য পৃথিবীর সব সত্যই খুব সহজ হয়ে থাকে। প্রচুর মাথা ঘামাতে হয় আর “আমি তো ভালো জানি না” ধরণের জটিলতা থাকে কেবল মিথ্যাতে। 

এই সত্যের সন্ধান পেতে হলে আপনাকে প্রথমে মেনে নিতে হবে, আমার জাতি ভুল করতেই পারে।

আপনি যদি মনে করেন নিজেকে সম্প্রদায় থেকে বের করে আনতে পেরেছেন, আপনি যদি উপলব্ধি করতে পারেন আপনার জাতি ভুল করতেই পারে, তাহলে এই অধ্যায়ের শুরুটা আপনি ঠিকমতো করতে পেরেছেন। চোখ বন্ধ করে অন্ধের মতো বার বার আউড়ে যাবেন না, আমার দেশের মানুষ এটা বলেছে বলে এটাই সত্য, আমার ধর্মের মানুষ এটা মানে বলে এটাই সত্য।

তাহলে আপনি দেশদ্রোহী হয়ে উঠবেন না, নাস্তিকও হয়ে যাবেন না। বরং সত্যগুলোকে আলাদা আলাদা করে খুঁজে বের করে মিথ্যেগুলোকে বর্জন করতে শিখবেন। আপনার সমাজ আপনাকে যা শেখায় তার সব সত্য নয়। কিছু মিথ্যে আছে। আপনার ধর্মের লোকজন যা যা বলে সবই ন্যায়ের কথা নয়, কিছু অন্যায় আছে। এদের আপনি বের করতে পারবেন, পরের অধ্যায়ে।

তবে সেজন্য আপনাকে হয়ে উঠতে হবে এমন কেউ, যে বিশ্বাস করে এভরি ম্যান ফর হিমসেলফ।

অধ্যায় ০২. ০১ বি আ রিজনেবল ম্যান

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *