KP Imon

Words Crafted

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০২ – জিআরই এবং IELTS/TOEFL

জর্জ বুশ ইন্টারকন্টিনেন্টাল এয়ারপোর্ট, হিউস্টন।
কাঁচের ওপাশে বসে থাকা কাস্টোমসের নীলচোখের ভদ্রলোক আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছেন। সরু চোখে তাকিয়ে থাকার পেছনে তার যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। যতোই চেষ্টা করি, সামনের প্যানেলে আমার ফিঙারপ্রিন্ট মিলছে না। এর দুটো অর্থ হতে পারে – যন্ত্রটি নষ্ট, নইলে, আমি একজন ফ্রড। ভুয়া নাম পরিচয় দিয়ে আমেরিকায় ঢোকার চেষ্টা করছি। এবং তিনি জানেন যন্ত্রে কোনরকম ত্রুটি নেই।
দেশের বাইরে এই প্রথম ভ্রমণ আমার, পা রাখতে যাচ্ছি বাংলাদেশের প্রাণপ্রিয় মাটি থেকে সরাসরি আমেরিকান সয়েলে। কিছুটা নার্ভাস তো বটেই। এখানে আমাকে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস দেখাতে হবে যেন ওরা আমাকে গ্রহণ করে। বেমক্কা প্রশ্নও করতে পারে। ভুল হলে ব্যাক টু প্যাভেলিয়ন। তারওপর গায়ে আছে ২৩ ঘণ্টা ভ্রমণের ক্লান্তি। তার সাথে যোগ দিয়েছে কাস্টোমসের দীর্ঘ লাইন। করোনাভাইরাসের কারণেই কি না জানি না, ৪০ মিনিটের বেশি সময় গেছে সর্পিল এই লাইন ধরে ধরে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াতে। ক্লান্তির পাশাপাশি আছে ভারী ব্যাকপ্যাকটার ওজনের ধাক্কা। আঙুলের ছাপ না মেলা একটা চিন্তার ব্যাপার বটে।
নীলচোখের ভদ্রলোক অগত্যা করোনাভাইরাসের গুল্লি মারলেন। একটা হাত কাচের ভেতর থেকে বের করে আমার হাতের ওপর রেখে চেষ্টা করলেন আঙুলগুলোকে জায়গামতো বসাতে। তৃতীয়বারের মাথায় মনে হয় কিছু পাওয়া গেল।
উত্তেজনাহীন কণ্ঠে বললেন, “নাউ দ্য থাম্ব, প্লিজ। ট্রাই টু কিপ ইয়োর এলবো দিস ওয়ে।”
নিশ্চয়! প্রতিবন্ধিদের মতো কনুই না বাঁকালে আঙুলের ছাপ যন্ত্রটি পাচ্ছে না। এ দফায় একাধিক চেষ্টাতে আঙুলের ছাপগুলো বসানো গেল বটে, একটু হেসে বললাম, “তোমাদের এই যন্ত্রটা আমার উচ্চতার তুলনায় একটু ছোট।”
কাস্টোমসের অফিসারটি হাসলেন। বললেন, “তুমি আসলে অ্যাভারেজের থেকে বেশি লম্বা।”
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলাম। দেশের ভেতর তো বটেই, আমেরিকায়ও এরপর যেখানেই গেছি, মানুষ আমাকে নিয়ে প্রথম যে মন্তব্যটি করেছে তা আমার উচ্চতা নিয়ে। এর কিছুদিন বাদে ইফতি ভাই, চাঁদনী আপুদের সাথে দেখা হয়েছিলো ভেরাইজনের কাস্টোমার কেয়ারে। চাঁদনী আপু বলেছিলেন, “তুমি দেখি সেই লম্বা।”
আমি হেসে বলেছিলাম, ‘ছয় বছর আপু। শেষ ছয় বছর ধরে আমি অপেক্ষা করছি প্রথম দেখায় কেউ আমাকে এই কথাটি ছাড়া অন্য কিছু বলবে।”
মজার ব্যাপার হচ্ছে এর ঠিক ৩৫ মিনিট পর আমরা পাশের Rooms to Go ফার্নিচার শপে যাই। ভেতরে ঢুকতেই একজন টাকমাথার ভদ্রলোক এসে আমাদের ধরলেন, “কোনও বিশেষ কিছু দেখতে চান কি না?”
ভাইয়া বললো, “না, আমরা একটু ঘুরে দেখি আরকি।”
“তা বেশ। তা বেশ, তা বেশ।” তা যে বেশ নয় তা নিশ্চিত করতে করতেই যেন রুমস টু গো-র ভদ্রলোক বললেন। তারপর আমার দিকে ফিরে আরেকটি কথা তিনি বলেছিলেন। “আরে আরে, তুমি দেখি আমার থেকেও লম্বা।”
চোখ মটকে চাঁদনী আপুকে বললাম, “ছয় বছর, আপু।”
কাস্টোমসের অফিসার ফিঙারপ্রিন্টগুলো নেয়ার পর আমার পাসপোর্ট ও আই-২০ ফেরত দিলেন। ওটা ডান হাত দিয়ে নিতে নিতে বড় করে শ্বাস নিলাম। তাকালাম আমার ডানদিকে। ওদিকেই মুক্তির পথ। আমেরিকায় ঢোকার পথ।
জানতে চাইলাম, “আর কিছু কি করার আছে এখানে আমার?”
তিনি বললেন, “না। ওয়েলকাম টু আমেরিকা।”
হাসলাম চওড়া, যতখানি হাসা যায়। তারপর কাস্টোমসের ভদ্রলোককে বললাম, “থ্যাংক ইউ। হ্যাভ আ গ্রেট ডে অ্যাহেড।”
বিশ মন ওজনের ব্যাকপ্যাকটা আবার পিঠে তুলে নিলাম। ডান হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছি স্ট্র্যাপ, বাঁ হাতে পাসপোর্ট আর আই-২০। বুক চিতিয়ে হাঁটা দিলাম ব্যাগেজ কালেকশনের জন্য।
মিনিট তিনেক পর যখন দু’হাতে দুটো ব্যাগ হাঁটিয়ে (চাকায়) বেরিয়ে আসছি, লাগেজ চেক হওয়ার কথা থাকে সাধারণতঃ, অথচ ছয়জন কালো পোষাকের অফিসার আমাকে নিরাসক্ত চোখে যেতে দেখলেন। আমেরিকায় কেউ আমার ব্যাকপ্যাকও স্ক্যানারে পাঠায়নি। একেবারে বিনা চেকাপে (যেটা আইডিয়াল নয়, আমি করোনাভাইরাসের কারণে হাল্কা চেকআপে পড়া সৌভাগ্যবান ব্যক্তিবর্গের মধ্যে একজন) বেরিয়ে এলাম ইন্টারন্যাশনাল অ্যারাইভালস লবিতে। অনেকেই হাতে নানা নাম ও প্ল্যাকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের অগ্রাহ্য করে খোলামেলা একটি জায়গায় এসে থামলাম। বসে পড়লাম খালি দেখে, এয়ারপোর্টের ওয়াইফাই ব্যবহার করে ফোন দিলাম আমার ভাইকে। এই মুহূর্তে সে কর্মরত অ্যাপলে, বুয়েটের ছাত্র ছিলো একসময়। পিএইচডিটা করেছিলো ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটায়, বব ডিলানের বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তার ফোনে রিং হচ্ছে, আমি যেন পরিষ্কার শুনতে পেলাম তার সাথে হওয়া দেড় বছর আগের কনভার্সেশন। এমনই এক হোয়াটসঅ্যাপ কলে তখন কথা হয়েছিলো আমাদের। আমি আমেরিকাতেই পড়তে যেতে চাই, কাজেই আমার লক্ষ্যের ব্যাপারে ভাইয়ার জানা ছিলো। তবে আমার ঢিলেমি তাকে যথেষ্ট বিরক্ত করেছিলোও মনে হয়। বারান্দায় বসে আমি জানতে চেয়েছিলাম, “এখনই জিআরই দেবো? আমার প্রিপারেশন কিন্তু নেই।”
ভাইয়া বলেছিলো, “এখনই রেজিস্ট্রেশন করবি। আজকে কালকের ডেট তো আর নিচ্ছিস না। ২-৩ মাস পরের ডেট রাখ। তারপর এর মধ্যে প্রিপারেশন নিবি।”
আমি মিন মিন করে বলেছিলাম, “নতুন অফিসে জয়েন করলাম, ট্রেনিংয়ের শো-ডাউনেই তো দাঁড়াতে পারছি না অফিসে। তারওপর একটা বই লিখছি। এতো কিছুর মধ্যে প্রিপারেশন নিলেও তা ভালো কিছু হবে না।”
ভাইয়া আমাকে তখনই রেজিস্ট্রেশন করে ফেলায় জোর দিলো।
বিষয়টা আমি সেই ফোনকল রাখার কিছুক্ষণ পরই বুঝেছিলাম। আসলে মানুষের জীবন এমনই। সব সময়ই কিছু না কিছু চলবে। আমি ৫০০ পৃষ্ঠার বিশাল উপন্যাস সব সময়ই লিখবো। আমার অফিসে ট্রেনিং থাকবে, নইলে থাকবে নতুন কোনও প্রজেক্ট। এসবের কারণে GRE কিংবা TOEFL/IELTS দেয়া পিছিয়ে লাভ নেই। অনেকেই তা করেন। ভাবেন “আরেকটু স্টেবল হয়ে প্রিপারেশন নিয়ে ফাটায়া দিবো হে জনতা। দেখায়া দিবো আমি কি জিনিস!”
কিছু ছাত্রছাত্রী দারুণ ব্লেসিং পান, কিছুই করেন না, বিএসসি-র পর তারা চাকরিও খোঁজেন না, বইপত্র লেখা তো রেয়ার কেস, কাজেই তারা ফুল-টাইম হায়ার স্টাডির জন্য রিসার্চ করেন। অ্যাপ্লাই করেন। প্রফেসরদের ইমেইল করেন। GRE এর জন্য পড়েন। TOEFL এর জন্য পড়েন। আমার কপাল তেমন নয়। আমি জীবনযুদ্ধে থাকা অবস্থাতেই সব করতে হবে। এক হাতে ছয় পেটাতে হবে অফিসে, অন্য হাতে ছয় পেটাতে হবে উপন্যাসে, একই সাথে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে গিয়ে হিট করতে হবে GRE এবং TOEFL এ।

 🇺🇸 অল্প সময়ে ভালো প্রস্তুতি নিতে পেরেছিলাম? উত্তরটা হচ্ছে না। GRE তে আমি প্র্যাক্টিস টেস্টে ৩২০ এর মতো তুলেছি তবে আসল টেস্টে পেয়েছিলাম ৩০৭। TOEFL এ ১২০ এ ১০০ পাই, ঠিক জানতামও না কেমন পরীক্ষা প্রশ্ন আসে, স্যাম্পলও দেখিনি। তবে মাইন্ডিং ইউ, আপনি একটা চাকরি যদি করেও থাকেন, আশা করি আমার মতো বিশাল বই লেখারও বাড়তি চাপ নেই। দুটো ক্যারিয়ার একসাথে টানা না লাগলে হয়তো প্রস্তুতি আরেকটু ভালো হতো। আপনাদেরটাও হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে নিচের প্যারাগ্রাফে আমি ব্যাখ্যা করবো কেন এই কাজটি সবার আগে করে ফেলা, পুরোপুরি রেডি না থাকলেও, এত গুরুত্বপূর্ণ।
🇺🇸 আমেরিকায় পড়তে হলে প্রায় সবখানেই আপনাকে GRE স্কোর সাবমিট করতে হবে, প্রফেসর ইমেইল করতে গেলেও তা করতে পারলে ভালো। এবং IELTS/TOEFL তো বাধ্যতামূলক (প্রায় সবখানেই)। আপনি অ্যাপ্লাই করতে গেলে আপনার হাতে যে তিনটি বিষয় প্রথমেই প্রস্তুত থাকতে হবে তা নিম্নরূপ –
১। আপনার বিএসসির সার্টিফিকেট
২। লেটার অফ রেকমেন্ডেশন
৩। GRE/TOEFL স্কোর

এর বাইরে ফান্ডিং নিয়ে প্রফেসরের সাথে মুলামুলি, যত মন চায় করুন, ওপরের তিনটা ফরজে আইন। কাজেই সবার আগে এই তিনটি প্রস্তুত করতে আমি জোর দেবো। যদিও লোকে সচরাচর এদের বাদ দিয়ে প্রফেসর ইমেইল করতে বলে থাকেন আগে। আমার মনে হয় প্রফেসর ইমেইলের থেকে বেশি গুরুত্ব ওপরের তিন জিনিস রেডি করতে দিন। সেই সাথে তা-ও করতে থাকুন। তবে প্রায়োরিটিতে ইমেইলিং এদের পর। আপনি যদি অ্যাপ্লাই করতে না পারেন, ডেডলাইন মিস করেন, তাহলে প্রফেসরের সাথে আলাপ দিয়ে কিছু আসে যাবে না। প্রায়োরিটি স্ট্রেইট করতে হবে হবে সেজন্য।

পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ০৩ – শুরু থেকে শেষটা ঝাপসা জানা

 

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *