Skip to content
KP Imon
KP Imon

Words Crafted

  • গুহামুখ
  • সূচিপত্র
  • গল্প
    • রম্য
    • জীবনধর্মী থৃলার
    • সাইকোলজিক্যাল
    • রোমান্টিক
    • ক্রাইম
    • সাসপেন্স
    • জীবনধর্মী
  • নন-ফিকশন
    • থট প্রসেস
    • উচ্চশিক্ষা
    • আমেরিকা-নামা
    • জীবনোন্নয়ন
    • তাত্ত্বিক আলোচনা
    • ডায়েরি
  • প্রকাশিত বইসমূহ
    • প্রকাশিত বইসমূহ
    • যেসব গল্প সংকলনে আছে আমার গল্প
KP Imon
KP Imon

Words Crafted

হেডহান্টারস

Posted on October 24, 2023

১
স্বাধীন পাখিগুলো নীড়ে ফিরছে।
সন্ধ্যার আবহটা আমার কাছে সব সময় চমৎকার লাগে। এটাই একমাত্র পরিবেশ যেটা আমাকে মনে করিয়ে দেয় পৃথিবীতে একাকীত্বের মাঝে একটা আলাদা সুখ আছে। একাকীত্ব উপভোগের মত সময় অবশ্য এটা নয়। সামনের গলির দুইপাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলো দেখছি আমি।
এর মধ্যে লাল গেইটের বিল্ডিংটাই আমার টার্গেট।
ঢাকার বাসাগুলো হঠাৎ করেই বেড়ে ওঠে একসাথে – এটা একটা মজার ব্যাপার।
শহরের ধারে থাকা জনবহুল এলাকাগুলোতে এই কাজটা হয়। হয়ত একসাথে তিনটি চারতলা বিল্ডিং ছিল – একবছর পরেই দেখা যাবে একই সাথে বিল্ডিংগুলো ছয়তলা হয়ে গেছে!
বাড়িওয়ালারা কি নিজেদের সাথে কম্পিটিশন করে এই কাজ করে নাকি একই সাথে তাদের বাজেট বেড়ে যায়, সে এক রহস্য।
তবে সেসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কাজ শুরু করতে হবে।
বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে গেলাম।
আস্তে করে কোটের ভেতরের দিকে হাত দিয়ে নিশ্চিত হলাম হোলস্টারে চুপচাপ বসে আছে আমার বিশ্বস্ত গ্লক টুয়েন্টি-থ্রি।
আজ ওর কাজ আছে। লাল গেইটের দিকে পা বাড়ালাম আমি। ধীরস্থির একটা ভঙ্গী ধরে রাখলাম চলার মাঝে, যেন এখানে প্রতিদিনই আসি।
ভেতরে ঢুকতেই চেয়ারে ঝিমাতে থাকা সিকিউরিটি গার্ডের শুভদৃষ্টি আমার ওপর এসে পড়ল। ঝটপট ঝিমানোর ভাবটা চলে যায় ইনার মুখ থেকে। উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গল লোকটা।
‘কোন ফ্ল্যাটে যাইবেন?’
‘টপ ফ্লোরে।’ শান্ত কন্ঠে উত্তর দেই।
‘ওহ, আসাদ স্যারের বাসায়?’ দেওয়ালে ঝোলানো রিসিভারটার দিকে এগিয়ে যায় সিকিউরিটি গার্ড, ‘কি নাম বলব?’
লোকটার পিছু নিয়ে এগিয়ে গেছি আমিও।
ঘাড়ের ওপর একটা মাপমত আঘাত করতেই টু শব্দটা না করে মাটিতে লম্বা হয়ে গেল গার্ড।
‘টপফ্লোর মিনস… রুফটপ।’ অজ্ঞানটাকে উত্তর দিলাম।
ওটাকে তুলে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। বেকায়দা ভঙ্গীতে চোখ বন্ধ করে ঘাড় এলিয়ে পড়ে থাকে মানুষটা।
তা থাকুক।
সবমিলিয়ে আমার দরকার মাত্র আধাঘন্টা। তবে শুধুমাত্র এই বিল্ডিংয়ে আমার অতটুকু সময়ও প্রয়োজন নেই। মিনিট দেড়েক হলেই চলবে। সিঁড়ি ভাঙ্গার ঝামেলায় গেলাম না। লিফটটাকে ডেকে নামিয়ে চট করে উঠে গেলাম।
যন্ত্রকক্ষটা চূড়োয় থামলে শান্ত পায়েই বের হলাম। কোন তাড়াহুড়োর ছাপ নেই আমার আচরণে। বাইরে অপেক্ষমাণ এক যুগলকে দেখা গেল। একে অন্যের হাত জড়িয়ে লিফটের অপেক্ষা করছিল।
নিউলি ম্যারিডম খুব সম্ভব! ওদের উদ্দেশ্যে একটা ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে লিফট থেকে বের হয়ে যাই।
ওপরের দিকে আরেকতলা সিঁড়িতে করে পার হতেই ছাদে বের হওয়ার দরজাটা চোখে পড়ল।
যথারীতি তালাবদ্ধ একটা দরজা। ঢাকার বাড়িওয়ালাদের ছাদ দখলের চিরন্তন মানসিকতা।
পকেট থেকে একটা বোতল বের করলাম। ভেতরের তরলটা আস্তে করে তালার গর্তে ঢুকিয়ে দিতেই বেচারার দফারফা হয়ে যায়।
ছাদের মুক্ত বাতাসে পা রেখে স্বস্তি অনুভব করি।
পাশের বিল্ডিংটা এর থেকে আটফিট দূরে।
একেবারে কম নয় দূরত্বটা। চোখ দিয়ে একবার মেপে নিয়ে দৌড় শুরু করি।
প্রথমে আস্তে আস্তে এবং ধীরে ধীরে বেগ বাড়তে বাড়তে এখন বুলেটের মত ছুটছি ছাদের রেলিংয়ের দিকে – সামনে তিন ফিট রেইলিংটা পড়তেই ছোট একটা লাফের সাহায্যে ওটার ওপরের অংশে পা রেখে মাটির সাথে সমান্তরাল ভাবে নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম।
আশি ফিট নিচে একটা ভাঙ্গা সাইকেল দেখা যায়। কে এনে রেখেছে – সেটা কে বলতে পারে?
তবে ওইপাশে পৌঁছতে না পারলে আমার অবস্থা সাইকেলের চেয়েও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ঠিকমত ল্যান্ড করে আবারও শান্ত পায়ে হাঁটলাম এই ছাদের রেলিংয়ের দিকে।
কোটটা খুলে একপাশে সরিয়ে রাখলাম। তারটার একপ্রান্ত বাঁধতে হবে ছাদের মাঝেই কোথাও।
কোটের ভেতর কাঁধের সাথে ছিল তারের রীলটা।
একপ্রান্ত অ্যান্টেনার লোহার রডটার সাথে বেঁধে তারটা আলগোছে ঝুলিয়ে দিলাম নিচে। এই পথেই ভাগতে হবে। চারতলা নেমে যুদ্ধ করে পালানোর চেয়ে তিনতলা ওপরে এসে ছাদ থেকে কেটে পড়া ঢের সহজ।
আবার এগুতে থাকি দরজার দিকে।
এই ছাদে আমি বাইরে থেকে দরজাটা দেখতে পাচ্ছি – কাজেই তালাটা ভেতরের দিকে।
লাথিয়ে ভাঙ্গতে হবে। এই দরজা খোলার আর কোন প্ল্যান নেই।
তারপরও সারপ্রাইজিং এলিমেন্ট কিছু থাকছে। এই বিল্ডিংয়ের নিচ থেকে উঠতে গেলে সেটা পাওয়া যেত না।
আখতারকে ধরার সুযোগ বার বার আসবে না। এই একবারেই কাজ সারতে হবে।
গডফাদার রাবেকের ‘হেডফাইভস’-এর একজন এই আখতার। আজকের জন্য ওর অবস্থান জানতে পারাটাই একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। এরপর এরকম সুযোগ আর নাও আসতে পারে।
হেডফাইভস!
পাঁচজন মানুষ।
এরাই দাঁড় করিয়ে রেখেছে রাবেকের সব কার্যক্রম। রাবেকের সাথে কেবল এই পাঁচটি মানুষেরই সরাসরি যোগাযোগ হয়। কাজেই একজন জীবিত হেডফাইভকে পেলে রাবেককেও পাওয়া যাবে – সমীকরণটা সহজ।
প্রকান্ড লাথিটা দরজাতে ফেলেই থমকে গেলাম। শব্দটা আরেকটা শব্দ ঢেকে দিয়েছে!
নীচ থেকে একই সাথে হওয়া শব্দটা আমার অভিজ্ঞ কান চিনে নিল নিমেষেই!
মসবার্গ শটগানের শব্দ ওটা!
দড়াম দড়াম করে ছয় লাথিতে ছুটিয়ে ফেললাম দরজা। নীচে এরই মাঝে যুদ্ধ বেঁধে গেছে!
আক্রমণকারীরা নীচতলা থেকে ওপরের দিকে উঠে আসছে। আখতারের লোকেরা প্রাণপনে চেষ্টা করছে বাঁধা দেওয়ার – তবুও টিকতে পারছে না ওদের সামনে।
স্তব্ধ হয়ে সিঁড়ি ঘরের ছাদের কাছে দাঁড়িয়ে আছি আমি।
রাবেকের হেডফাইভের একজনকে হামলা করতে আসতে পারে কে?
প্রশ্নোত্তরের সময় নেই – প্রবল বিক্রমে ছাদের দিকে উঠে আসছে হানাদারদের দুইজন।
গ্লক থেকে দুটো গুলি ছুঁড়তেই ওদের নড়াচড়া থেমে গেল।
চারতলায় আখতার ছিল।
এই মুহূর্তে সেই ফ্লোর থেকে তিনতলা ওপরে দাঁড়িয়ে আমি। কানের সমান্তরালে পিস্তলটা ধরে রেখে ধীরে ধীরে নামতে থাকি সিঁড়ি বেয়ে।
একটু আগে গুলি করা দুইজনের মাথা ভেঙ্গে রক্ত গড়িয়ে নামছে – ওটা এড়িয়ে চলতে হচ্ছে।
এতে পা পিছলালে দেখার মত দৃশ্য পাবে হেডফাইভ আখতার আর তাকে আক্রমণকারীরা।
সাবধানে পাঁচতলাতে নেমে আসতে আসতে নিচের গোলাগুলির শব্দ একেবারেই থেমে গেল। কোন একপক্ষ একেবারে নিঃশেষিত নিশ্চয়?
দেখতে হচ্ছে।
একমাত্র জীবিত মানুষ আখতার হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। রাবেকের মত একটা ঘোস্টের পিছু নিয়ে লাভ হবে না। কিন্তু হেডফাইভের কাওকে জীবিত ধরতে পারলে চিরশত্রুকে নিঃশেষ করে দেওয়া সম্ভব।
ধীরে ধীরে মাথা বের করলাম চারতলা এবং পাঁচতলার সংযোগস্থলে।
পরমুহূর্তে একটা তীব্র বিস্ফোরণ।
উড়ে গেল চারতলার অ্যাপার্টমেন্টের দরজা – পেছনে আগুনের শিখা।
সরে যাওয়ার চেষ্টা করেও খুব একটা কাজ হল না। দরজার অংশবিশেষ আঘাত হানল বুকে। শকওয়েভের তীব্রতায় একই সাথে ছিটকে সিঁড়িঘরের অন্যপাশের ল্যান্ডিংয়ের সাথে সেঁটে গেছি।
হাঁফাচ্ছি চোখ বন্ধ করে। কান বেয়ে একফোঁটা রক্ত পড়তে শংকা অনুভব করি। ইন্টারনাল ব্লিডিং না এক্সটার্নাল?
বাইরে একটা গাড়ির ইঞ্জিন গর্জে উঠল। কিছুই আমার পরিকল্পনা অনুসারে হচ্ছে না!
পালাচ্ছে আখতার? নাকি তার আক্রমণকারী কেউ?
পিছু নিতে হবে ওর! তাগাদা অনুভব করি প্রবলভাবে।
পায়ে জোর নেই শকওয়েভের ধাক্কায় – তবুও ছুটে বের হতে চাই সর্বশক্তি একত্র করে – ফলস্বরূপ সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চারতলার ধ্বংসস্তুপে এসে থামে আমার দেহ।
গরম ধ্বংসস্তুপে পড়ে হতাশায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে আমার।
রাবেকের আরেকটা ট্রেইল হারিয়েছি আমি এইমাত্র।

২
‘আরেকজন হেডফাইভ দরকার আমার।’ এলোমেলো চুলে বলি আমি।
‘একটা দিন পরে আবার কাজে নামতে পারিস।’ মিনহাজ বলে।
হতাশা নিয়ে সারা শরীরের ব্যান্ডেজগুলোর দিকে তাকালাম।
গডফাদার রাবেক ঈশিতাকে খুঁজছে ওর সাম্রাজ্যে বসানোর জন্য। একই সাথে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে পথ থেকে একমাত্র বাঁধাটা দূর করে দিতে। আমার হাতে একদিন সময় নেই।
হাসপাতালে বসে আছি আমি। বাল্যবন্ধু মিনহাজ এবারের কাজটায় আমাকে গোড়া থেকেই সাহায্য করছে।
এই দফা অন্তত রাবেকের থেকে এগিয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মাঝখানে অনাহূত থার্ড পার্টি এসে পড়ায় ঝামেলা হয়ে গেল।
‘আখতারের প্রতিটা মানুষকে মেরে ফেলা হয় ওখানে।’ বিড় বিড় করে মিনহাজকে জানালাম, ‘কিন্তু মারল কারা? অন্তত এই জিনিসটা খোঁজ নিয়ে দেখ – ঢাকার কোন গ্যাং কারও ওপর আজ হিট নিয়েছে কি না। হেডফাইভ খুঁজে পাওয়ার থেকে এটাই বেশি সহজ হবে।’
‘তুই নিশ্চিত সামলে নিতে পারবি?’ আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চায় মিনহাজ।
‘আরে ধ্যাত!’ ধমকে উঠি আমি মৃদুস্বরে, ‘গুলি তো আর খাইনি। এটা এমন কিছু না। একটু পরেই বের হয়ে যাব আমি।’
তাও সন্দেহের চোখে তাকায় মিনহাজ। তবে জানে একবার যখন বলেছি আমি এখান থেকে একটু পরে বেরিয়ে যাচ্ছি – আমাকে হাসপাতালে আটকে রাখার সামর্থ্য কারও নেই।
মিনহাজ বেরিয়ে যেতে পুরো ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করলাম।
ডন রাবেকের সাথে আমার শত্রুতা আজকের নয়। আমার মায়ের হত্যাকারী মানুষটা। শেষবার যখন আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম, ঈশিতা ছিল সাথে।
খুব জঘন্য একটা দিন ছিল সেটি।
ওর অনুরোধে রাবেকের মাথাতে একটা বুলেট না ঢুকিয়েই বেরিয়ে এসেছিলাম ঠিকই – কিন্তু ভবিষ্যতে সেই ছাড় তাকে আর দেওয়া হবে না।
নার্স এসেছে।
‘শুয়ে পড়ুন। ইঞ্জেকশন দেয়ার সময় হয়েছে।’ খুব ছটফট করে বললো সে। নার্স মেয়েগুলো কি শান্ত গলায় কথা বলতে পারে না?
‘বসে থাকলে হবে না?’ পাল্টা প্রশ্ন করতে মন চাইলেও করলাম না। একটু পর কেটে পড়ছি এখান থেকে।
শুয়ে পড়তেই আমার হাতের দিকে এগিয়ে আসে নার্স।
পরক্ষণেই ‘ক্লিক’ জাতীয় শব্দটা সবকিছু স্পষ্ট করে দেয়।
নার্সও কি রাবেকের লোক?
নাকি অ্যান্টি-রাবেক এ?
আমার বাম হাতটা হসপিটাল বেডের সাথে আটকে দেওয়া হয়েছে একটা হ্যান্ডকাফের সাহায্যে।
আলতো করে দুইবার টান দিয়ে দেখলাম। অযৌক্তিক।
চাবি ছাড়া মুক্তির উপায় নেই।
সুন্দরী নার্সের মুখে আলাদা রকম একটা হাসি ফুটেছে।
আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে বুকের কাছ থেকে গ্লকটা সরিয়ে নেয় ও। তারপর বেডের পেছন দিকটা ধরে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকে।
আস্তে করে বলল শুধু, ‘চোখ বন্ধ করে থাকুন।’
আর উপায় কি?
কাজেই শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে থাকি আমি। নার্স ঠেলে নিয়ে যেতে থাকে ঝড়ের বেগে।
বাইরে আমার জন্য কোন ট্রান্সপোর্টেশন অপেক্ষা করছে – গায়ে অ্যাম্বুলেন্সের ছাপ মারা – এটা বুঝতে জোতিষ্যি হওয়া লাগে না।
কিছুক্ষণের মাঝেই যখন লিফটের টুং-টাং শুনলাম তখনই স্পষ্ট হয়ে গেল আমার ধারণার সত্যতা।
চোখ বন্ধ করেই তারপর আবারও চাকার গড়গড়ানি শুনতে থাকি।
আশে পাশে শুধু হাসপাতালের একটা অদ্ভুত গন্ধ।
অবশেষে প্রায় একযুগ পর একটি পুরুষকন্ঠ শোনা যায়, ‘মেরে ফেলেছ নাকি?’
‘নাহ। একটু শাসানী দিয়েছি। এখন বাধ্য ছেলের মত চুপ করে আছে।’ আনন্দের সাথে জানায় মেয়েটা।
‘উই হ্যাভ হিম, বস!’ এবার পুরুষকন্ঠ রিপোর্ট করে।
‘ড্রাইভ কর। পেছনে বসছি আমি।’
আস্তে করে তাকালাম। আস্ত বেড সহ আমাকে অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।
ভেতরে দুইজন মানুষমাত্র।
নার্সরূপী মেয়েটি নার্সের পোশাক খুলে ফেলেছে। ওগুলোর আর দরকার নেই।
চোখে খুনীর দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে এ।
অপরজন পুরুষ। বয়েস কম না – পঞ্চাশের ঘরে পা রেখেছে এটুকু নিশ্চিত।
অনেক প্রশ্ন মনে জমা হয়ে আছে – তবে চুপ করে থাকলাম। যা বলার ওদেরই বলার কথা। মেরে ফেলতে চাইলে মেয়েটা হাসপাতালের ভেতর একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে চলে আসতে পারত।
‘উঠে বসতে পার হে!’ গলায় কৌতুক ফুটিয়ে বলে লোকটা, ‘যদি ততটা দুর্বল না বোধ কর।’
এরপর আর শুয়ে থাকা চলে না। উঠে বসে লোকটার মুখোমুখী হলাম। হাত এখনও হ্যান্ডকাফের সাথেই আটকানো।
‘কে আমি – কেনই বা তোমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছি – এসব জানতে চাইবে না?’ আবারও বলে মানুষটা।
একমুহূর্ত চিন্তা করে উত্তর দিলাম, ‘ডন রাবেকের একজন হেডফাইভ আপনি। ইয়াসির মির্জা সম্ভবতঃ – কারণ হেডফাইভদের মাঝে সবচেয়ে সিনিয়র এই বেজন্মাই।’
একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা। বন্দী যে তার এমন পরিচয় দিতে পারে – সেটা বোধহয় কল্পনা করতে পারে নি ইয়াসির।
অবশেষে প্রফেশনালি নিজের রাগটা দমন করল হেডফাইভ ইয়াসির। তার মুখের কোণে একটা বিদ্রুপের হাসি।
‘চমৎকার ধরেছ। তারমানে আসলেই যা শুনেছিলাম সত্যি। হেডফাইভদের একে একে খুন করে ফেলার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে একা এক যোদ্ধা।’ অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে ফার্স্ট এইড কিট বের করে ইয়াসির।
‘হেডফাইভদের খুন করার ইচ্ছে আমার কখনই ছিল না। তার থেকে একজন জীবিত হেডফাইভই আমার জন্য বেশি উপকারী হবে। আ’ম কাউন্টিং অন ইউ ফর দ্যাট, ইয়াসির।’ ঠান্ডা গলাতেই জবাব দেই আমি।
ইয়াসির ফার্স্ট এইড কিট খুলে একটা চমৎকার চকচকে স্ক্যালপেল বের করেছে। আলতো আঁচড়ে মাংস কেটে অনেক গভীরে ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব এটা দিয়ে। সার্জারীর সময় স্ক্যালপেল ব্যাবহারের কারণেই সবচেয়ে কম সংখ্যক কোষের ক্ষতি করে সবচেয়ে গভীরতম ক্ষতগুলো করা যায়। আমরা দুইজনই সম্মোহিতের মত স্ক্যালপেলটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
নার্স মেয়েটার কোন বিকার নেই – ও জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছে!
হেডফাইভের একটা হাত উঠে যায় – সেই সাথে স্ক্যালপেলটাও। ইয়াসিরের হাতটা নড়ল কি নড়ল না – বাম গালটা বেশ বাজে ভাবে চিড়ে গেল আমার।
রক্তের একটা স্রোত চিবুক বেয়ে গলার দিকে নামছে স্পষ্ট অনুভব করলেও কোন শব্দ করলাম না। চোখ খুঁজছে ডানদিকে কাজে লাগানোর মত কিছু একটা। একটা হাত এখনও খোলা আমার।
‘হেডফাইভ আখতারের হাইডআউটে গতকাল সন্ধ্যাতেই হামলা চালানো হয়েছে। একেবারে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে ওকে। কাজটা যে তোমার আর তোমার লোকেদের সেটা বুঝে নিতে বেশি ভাবতে হয় না। এখন আমাদের দাবী সাধারণ, হেড ফাইভের বিরুদ্ধে তোমার যে কয়জন লোক আছে – প্রত্যেকের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে যাও।’
‘চমৎকার।’ হাসিমুখে বলার চেষ্টা করি কিন্তু গালের ক্ষতটার জন্য হাসি ঠিক জমল না! ‘বিনিময়ে আমাকে কি অফার করছেন?’
‘শান্তিপূর্ণ একটা মৃত্যু।’ হাতের স্ক্যালপেল দুলিয়ে বললো হেডফাইভ।
একে বলে লাভ নেই যে ওখানে একটা থার্ড পার্টি ছিল।
একে বলে লাভ নেই আমি একা কাজ করি।
সে যখন ধরে নিয়েছে কাজটা আমারই, এখান থেকে তাকে আর টলানো সম্ভব হবে না।
কিন্তু ছেদো কথায় কিছুটা সময় নষ্ট করা গেলে আশা করা যায় বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও বাড়তে থাকবে।
‘অসাধারণ আপনার অফার। আগে পেমেন্টটা অ্যাডভান্স করে দিন, তারপর জানাচ্ছি আপনাদের তথ্য।’ গলায় খুশি খুশি ভাবটা ধরে রেখে বললাম।
হঠাৎই হাতের সার্জিক্যাল নাইফটা আমার বাম কাঁধের নিচে ঢুকিয়ে দেয় ইয়াসির, হিস হিস করে বলে ওঠে, ‘সব কাজ ফেলে আমি নিজে ছুটে এসেছি এই হাসপাতালে। আমাকে খুন করতে চাওয়া মানুষটার সাথে নিজে ডীল করতে। বাস্তবতা মেনে নাও ছোকড়া – এখন অথবা পরে – গান তোমাকে গাইতেই হবে!’
বাম কাঁধে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। বেশিদিন নয় ওদিকেই একটা গুলি খেয়েছিলাম আমি।
এই হারামজাদা দেখছি বেশ জ্বালালো! একই জায়গাতে বার বার খোঁচাখুঁচি কেন? তবে একটা সুবিধেও আছে – সার্জিক্যাল নাইফটা এখনও আমার বাম কাঁধে গাঁথানো। হেডফাইভ ইয়াসির আমার একটু বেশি-ই কাছে।
আর আমার ডানহাতটা মুক্ত!
নার্স মেয়েটাও বাইরের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছে।
বাইরেটা একটু আমিও দেখে নেই। সামনেই একটা ব্রীজ আছে।
মনটা খুশি হয়ে ওঠে। চট পট বুড়োটাকে কাবু করে ফেলে নার্সটার কাছ থেকে হ্যান্ডকাফের চাবি ছিনিয়ে নিতে হবে।
তারপর বুড়োকে নিয়ে সটকে পড়তে হবে। রাবেকের আরেকটা ট্রেইল ধরিয়ে দিতে পারে এই হেডফাইভ।
বিদ্যুতবেগে নড়ে উঠছি, তবে কিছুই করতে পারলাম না।
চেঁচিয়ে ওঠে নার্স, ‘অ্যামবুশ!’
পরমুহূর্তে যেন নরক ভেঙ্গে পড়ে আমাদের চারপাশে!

৩
বুলেটবৃষ্টি চলছে।
তারমাঝে কোনমতে মাথাটা নামিয়ে রেখেছি।
ছোট একটা পিস্তল বের করে ধাই ধাঁই গুলি ছুঁড়ছে মেয়েটাও। হেডফাইভ চট করে শুয়ে পড়েছে – অ্যাম্বুলেন্সের মেঝে হাতড়াচ্ছে। ওখানে কি গুপ্তধন রেখেছে কে জানে!
ব্রীজের মাঝখানে আছে অ্যামবুশ করে থাকা ওই ওরা। আর আমাদের গাড়িটা আরেকটু পর ওদের অতিক্রম করে গেলেই আর কোন ভয় নেই। তবে তারপর কপালে হেডফাইভ ইয়াসিরের জেরা তো আছেই।
অর্থাৎ আমার জন্য লাল-নীল দুটোই সমান।
এই সময় স্প্রের মত রক্ত এসে লাগল আমার চোখে মুখে।
চোখ কুঁচকে ফেললাম। রক্তের সাথে হাড়ের কুঁচিও এসে লাগছে। চোখে পড়লে চুলকাবে অনেক।
খুলির একাংশ উধাও হয়ে আছে – এই অবস্থায় হেডফাইভ ইয়াসিরের শরীরে ঢলে পড়ে মেয়েটা।
এই সময় সাঁই করে বাতাস কেটে ওদের ছাড়িয়ে যায় আমাদের অ্যাম্বুলেন্স। তবে পেছন থেকে গুলিবৃষ্টি এখনও চলছে!
একই সাথে ড্রাইভিং সীট থেকে একটা আর্তচিৎকার শুনতে পাই আমরা। ঘটনার তাৎপর্য বুঝেছে ইয়াসির; শরীরের ওপর থেকে কোনমতে মেয়েটাকে সরিয়ে ড্রাইভিং সীটের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরতে চায় স্টিয়ারিং।
আরেকপশলা গুলি ডান দিকের চেসিস ভেদ করে ঢুকে পড়ে ভেতরে।
ড্রাইভারের ঘাড়ে লাগে তাদের একটা।
ইয়াসির কিছু করার আগেই মৃত্যুকালীন রিফ্লেক্সে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ফেলেছে ড্রাইভার।
রেইলিং ভেঙ্গে নদীর বুকে আছড়ে পড়ে আমাদের মাইক্রো-অ্যাম্বুলেন্স।
এক সেকেন্ড ভেসে থাকে চুপচাপ – তারপরই ডুবতে শুরু করে।
বাঁহাতে হাতকড়া আর হাতকড়ার অন্যপ্রান্তে হাসপাতালের একটা ভারী লোহার বেড নিয়ে নদীর বুকে ডুবতে থাকার অনুভূতি তলপেটে খামচি দিয়ে ধরে আমার। দিনের প্রথমবারের মতো টের পেলাম ও জিনিস!
নিখাদ এক আতঙ্ক!
কিন্তু ফিরে আসছে না কেন হেডফাইভ ইয়াসির?
যেই অ্যাঙ্গেলে বসে আছি সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও বুঝতে পারলাম মাথায় একটা বুলেট এরও লেগেছিল তখনই।
রাবেকের ট্রেইল বের করার আরেকটা সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে অবশ্য এখন আক্ষেপ করার সময় নেই। মৃত্যুফাঁদে আটকে আছি আমি। বের হতে হবে এখান থেকে।
*
অ্যাম্বুলেন্সে পানি বাড়ছে।
ভেতরে হুড় হুড় করে পানি ঢোকা শুরু করবে। ড্রাইভিং সীটের পাশের জানালা পর্যন্ত ওয়াটার লেভেল পৌঁছানোর যা দেরি। হা করে খুলে রেখেছিল ওটা ড্রাইভার।
এখনও নিচের বিভিন্ন ফাঁকফোকড় দিয়ে পানি ঢুকছে – তবে তুলনামূলক ধীরগতিতে।
মরা নার্সের দিকে হাত বা পা বাড়ানোর চেষ্টা করে লাভ হল না – একেবারে ড্রাইভিং সীটের পেছন দিকে গিয়ে পড়েছে ও ইয়াসিরের ধাক্কার সময়। এদিকে প্রাণপনে চেষ্টা করেও বেডটাকে একচুল নড়াতে পারছি না। হাতও হ্যান্ডকাফে আটকে আছে।
নড়াতে পারার কথাও অবশ্য না – অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর আস্ত বেড ঢোকাতে গিয়ে একেবারে টাই টাই করে ঢোকাতে হয়েছে। অতিরিক্ত একটা ইঞ্চি জায়গাও নেই। কাজেই বেড নড়িয়ে মৃত মেয়েটার কাছে গিয়ে চাবী উদ্ধারের চেষ্টা করে লাভ নেই।
বেশ গ্যাড়াকলেই পড়া গেছে!
ভবিষ্যত চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি – পানিতে সব কিছুর ওজন কমে যেতে পারে – কিন্তু লোহার এই খাটটা যেভাবে অ্যাম্বুলেন্সের সাথে এঁটে আছে – আমার কোন উপকার তাতে হবে না।
অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরটা ভালো করে দেখলাম। কিন্তু কিছুই নজরে আসছে না যা কাজে দেবে।
অক্সিজেনের সিলিন্ডার একটা আছে বটে – তবে ওটা থেকে মেয়েটার লাশই কাছে!
মুক্তির জন্য ঝড়ের বেগে ভাবনা চলে মাথায়। কিন্তু বাস্তবতা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না।
এরই মধ্যে উইন্ডো লেভেলে পানি চলে এসেছে – ড্রাইভারের খোলা জানালা দিয়ে খুব দ্রুত পানি ঢোকা শুরু করল।
সেই সাথে ঝট করে কাত হয়ে যায় অ্যাম্বুলেন্স। আড়চোখে একবার দেখি।
মেয়েটার লাশ আমার দিকে একটু এগিয়ে এসেছে – কিন্তু এখনও নাগালের বাইরেই।
আর শুরু হয়েছে বুকের জ্বলুনী। হেডফাইভ ইয়াসির সার্জিক্যাল নাইফ যেখানে গাঁথিয়ে দিয়েছিল তার চারপাশে মনে হয় নরকের সব প্রেতাত্মারা নাচছে। আমার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষার সময় নেই হয়ত ওদের।
বুক ভরে বাতাস নিতে থাকি আমি।
আরেকটু পর একেবারেই ডুবে যাবে অ্যাম্বুলেন্সটা। স্পষ্ট বুঝতে পারি এই শেষবারের মত বাতাস টেনে নিচ্ছি বুক ভরে, তারপর আর পাবো না। কেন জানি তবুও শান্তি লাগে না একটুও – কোন স্বাদ পাই না সেই বাতাসে।
ঝুপ করে ডুবে গেলাম।
ডুবে যাওয়ার সাথে সাথেই সামনের দিকটা উঁচু হয়ে যায় একটু। পানির নিচেই তাকিয়ে তামাশা দেখছি।
সামনের দিকটা উঠে গেল কেন? অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো ওপরের দিকে চাপ দিচ্ছে নাকি? আমার ভাবনা শুনলে যেকোন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক গাট্টা লাগাতেন সন্দেহ নেই – কিন্তু ব্যাখ্যার দিকে যাই না আমি আর।
অ্যাম্বুলেন্সের বক্রতায় নার্সের লাশটা সরে এসেছে এদিকে। সেই সাথে আমার নাক মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় বেশ কিছু বুদবুদ। ফুসফুসের রিজার্ভ প্রায় ‘এম্পটি’।
ডান হাতে মেয়েটার লাশ ধরে আরও কাছে টেনে এনে পাগলের মত চাবিটা খুঁজি।
কোথায় রেখেছে?
মেয়েটার কোমরে হাত পড়তেই থমকে যাই।
আমার গ্লকটা।
.40 ক্যালিবারের অস্ত্র দিয়ে পানির নিচে গুলি করা যায় না – বিস্ফোরিত হবে পিস্তলের ব্যারেল!
সাথে করে নিয়ে যাবে আমাকেও!
ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেই – আমার গ্লকে মেরিটাইম স্প্রিং কাপ বসিয়েছিলাম গত বছর।
কাজেই নিখুঁতভাবে পানির নিচেও গুলি করা সম্ভব।
পাঁচ সেকেন্ড পরই অ্যাম্বুলেন্সের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসি আমি।
ওপরের দিকে উঠতে থাকি সাঁতরে।
বাতাসের অভাবে ফুসফুসটা ফেটে যাচ্ছে!

৪
কোনমতে নিজের হাইডআউটে ফিরে এসেছি।
ডন রাবেকের মত ভয়ানক একজন মানুষের সেরা পাঁচজন অপারেটরকে কেউ সরিয়ে নিতে চাইছে। রহস্যটা আমার কাছে মোটেও স্পষ্ট নয়। মজার ব্যাপার হল – ডন রাবেক বা হেডফাইভের ধারণা কাজগুলো আমার।
এই তৃতীয়পক্ষটা কোথা থেকে আসল?
ঝট করে মাথায় একটা সম্ভাবনা দেখতে পাই – ঈশিতার আগমনকে কি ডন রাবেকের উচ্চপর্যায়ের লোকেরা মেনে নিয়েছে সহজভাবে? দলের জন্য কাজ করতে থাকা অনেকেই হয়ত রাবেকের পরে ডন হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল । অথচ বুড়ো বয়সে রাবেকের ভীমরতি ধরলো। নিজের টিন-এজ মেয়েকে সে এখন গ্রুম করে সিংহাসনে বসাবার পরিকল্পনা কষেছে। দলের ক’জন একে ভালো চোখে দেখছে?
হামলাগুলো করছে কে?
আরেকজন হেডফাইভ?
সম্ভাবনাটি উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
মিনহাজকে খুঁজে বের করা দরকার। আর কোন আপডেট কি বের করতে পেরেছে কি না কে জানে!
সেকেন্ডারী ফোনটা হাতে তুলে নিলাম।
বাইরে থাকলে মাঝে মাঝেই মোবাইল ফোন হারানোর মত ঘটনা ঘটতে পারে – একটু আগে যেমনটা ঘটেছে! এখন অন্তত দুটো নাম্বার আমার নাগালে থাকে। একটা হারালে যেন আরেকটা দ্রুত ব্যবহার করতে পারি। এসব আমার বন্ধুদেরও জানা আছে।
বেয়াল্লিশটা মিসকল!
ফারিহা!
দ্রুত কলব্যাক করলাম।
‘হ্যালো, ফারিহা।’
‘রবিন!’ ফারিহার গলা একেবারে শান্ত। একেবারেই স্বাভাবিক।
‘কি হয়েছে?’ ভয়ের একটা অনুভূতি চারপাশ থেকে চেপে ধরে আমাকে। ও এত চুপচাপ কেন বেয়াল্লিশবার ফোন দিয়ে? ‘অ্যাই ফারিহা?’
‘এক ঘন্টা আগে আমাদের বাসার সামনে তিনটা গাড়ি এসেছিল।’ চুপচাপ শোনে ইরফান, ‘বাবাকে গুলি করেছে ওরা। ঈশিতাকে নিয়ে গেছে সাথে করে যাওয়ার সময়।’
ফোনের ওপাশের কথা শুনতে শুনতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে একহাতে গ্লকটা আবার তুলে নিয়েছি আমি – হোলস্টারে ভরে হাঁটা শুরু করেছি দরজার দিকে। রাবেক এরই মধ্যে ঈশিতাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছি তা খুঁজে বের করে ফেলল?
‘রিজভী আংকেলের কি অবস্থা?’ ঝটপট জানতে চাই আমি। ফারিহার বাবা উনি। এঁর কাছেই রেখে গিয়েছিলাম ঈশিতাকে। আমার কারণে পরিবারটির ওপর আরও একবার একটা ঘূর্ণিঝড় নেমে এল!
‘জানি না। বাবার কিছু লোক বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।’ হঠাৎই কেঁদে ফেলে ফারিহা। শক কাটিয়ে উঠেছে যেন। ‘তুমি কোথায়, রবিন? আসো প্লিজ। তোমাকে খুব দরকার যে আমার!’
মিনহাজকে ফারিহার ঠিকানা দিয়ে মোটরসাইকেলটা ছুটাই পূর্ণগতিতে।
মাথা ভারী হয়ে আছে একগাদা দুশ্চিন্তায়। রিজভী আংকেলের মত চমৎকার একজন মানুষের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকাটা নিয়ে একধরণের কষ্ট আর নিজের একমাত্র জীবিত আত্মীয় ঈশিতাকে আরেকবার হারানোর ভয়ে মাথার ভেতর সব কিছু জট পাকিয়ে যায় আমার।
*
সেই পরিচিত বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আবারও।
ফারিহাকে কিডন্যাপ করার রাতে ওকে এখানেই ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম। এরপরে আরেকবার আসা হয়েছে ঈশিতাকে রাবেকের খপ্পর থেকে প্রথমবার মুক্ত করে। সেবারে এখানে সাতদিন ছিলাম। আহত অবস্থায়।
ফারিহা সেসময় সেবা করেছে প্রাণপণে! রাতে ঘুমায় নি – দিনে নিজেকে সময় দেয় নি বিশ্রামের। যেন এক মুহূর্ত আমাকে চোখের আড়ালে রাখলেই কেউ একজন এসে আমায় শেষ করে দেবে!
অথচ মেয়েটার সাথে বন্ধুত্বের বাইরে কিছুই নেই আমার। অজান্তেই বিভিন্ন দিক থেকে এই পরিবারটার সাথে বাঁধা পড়ে গেছি আমি আর ঈশিতা।
ফারিহা বাইরেই অপেক্ষা করছিল।
আমাকে দেখে এগিয়ে এল ক্লান্ত পায়ে। প্রায় একমাস দেখা হয় না আমাদের।
ফারিহার সুন্দর মুখটায় ক্লান্তির ছাপ – আর অনেকখানি বেদনা। বাবা ছাড়া ওরও কেউ নেই এই পৃথিবীতে – আমাকে আর ঈশিতাকে গোণার বাইরে রাখলে।
এক মুহূর্ত একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা। তারপর আমার বুকে মাথা রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা।
মুক্তোর মত কয়েক ফোঁটা পানি গড়ায় ওর গাল বেয়ে – ওপর থেকে দেখি আমি।
শক্ত একটা আলিঙ্গনে বাঁধি ওকেও – যেন বোঝাতে চাই আমার কাছে ও সম্পূর্ণ নিরাপদ।
সেই সাথে খোঁচাতে থাকে একটা অক্ষম ক্রোধ।
ফারিহা আমাকে তার সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় পায়নি কাছে।
আস্তে করে ওকে ছেড়ে দিলাম কয়েক মিনিট পর।
‘আমাকে জানাও কি হয়েছিল ঠিক। একেবারে যেভাবে দেখেছ সব ঘটতে।’
ধীরে ধীরে বলতে থাকে ফারিহা।
ওর কথা থেকে জানা যায় – দুপুরে রিজভী আকন্দ হঠাৎ ফিরে আসেন বাইরে থেকে। ফারিহা আর ঈশিতা গল্প করছিল ভেতরে। বাবাকে অসময়ে দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে ওঠে ফারিহা। জানতে চায় দুপুরে খাবে নাকি বাড়িতে, কিন্তু মি. রিজভী জানান সামান্য একটা কাজে এসেছেন। একটা ফাইল নিয়েই বেরিয়ে যাবেন। তারপর যখন বাইরের দিকে রওনা দিয়েছেন, এসময় বাইরে থেকে তিনটা গাড়ি এসে থামে। এবং নেমেই কোন রকম জানান না দিয়ে ফায়ারিং শুরু করে ওরা।
বাইরের সিকিউরিটি গার্ডরা পাল্টা আক্রমণ করেছিল – কিন্তু এরই মাঝে রিজভী আকন্দের পিঠে একটা বুলেট গেঁথে যায়
বাবাকে ‘বাই’ বলে দোতলায় উঠে গেছিল ফারিহা – ওখান থেকেই দেখতে পায় বাবাকে পড়ে যেতে। অবাক বিস্ময়ে ও লক্ষ্য করে একজন মানুষ ছুটে গেছে বাবার পাশে।
ঈশিতা।
ঈশিতাকে দেখেই অ্যাটাকিং প্ল্যান পাল্টে ফেলল আক্রমণকারীরা। সিকিউরিটি গার্ডদের দিকে কাভারিং ফায়ার ছোঁড়ে কয়েকজন – দুইজন এইফাঁকে এসে ঈশিতাকে ধরে সরিয়ে নেয় গাড়ির দিকে। দ্বিগুণ উৎসাহে গুলি ছোঁড়ে সিকিউরিটি গার্ডেরা – তবে ঠেকাতে পারে নি ওদের তবুও।
গাড়িগুলো চলে যেতে রিজভী আকন্দকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায় ওরা।
‘তিনটা গাড়ির সাথে ফাইট করল কি করে তোমাদের সিকিউরিটি গার্ডেরা?’ একটু অবাকই হই আমি।
‘বলেছিলে তো ঈশিতার জীবন নিরাপদ না – সেজন্যই কড়াকড়ি বাড়িয়েছিল বাবা।’ চোখ মোছে ঈশিতা, ‘তবে আমার একটা ব্যাপার খটকা লেগেছে।’
‘কি ব্যাপার?’
‘বাবা কেবলমাত্র একটা ফাইল নিতে বাসায় ফিরবেন কেন? এতটুকু করে দেয়ার জন্য লোকের অভাব নেই।’
‘হুম।’ বলি শুধু।
আরেকটা মটরসাইকেলের শব্দে আমাদের দুইজোড়া চোখ ঘুরে যায় শব্দের উৎসের দিকে।
মিনহাজ।
*
ফারিহার দায়িত্ব মিনহাজকে দিয়ে এসেছি। কাজের কাজ করে এসেছে ছেলেটা।
আরেকজন হেডফাইভের নাম দিতে পেরেছে আমাকে।
প্রথম দুইজন হেডফাইভের মৃত্যুর পর এত অল্প সময়ে আরেকজন হেডফাইভকে পাওয়া যাবে বলে ভাবিনি।
ছুটে যাচ্ছি শ্যাওড়াপাড়ার দিকে।
সাদা রঙের একটা বাড়ি। মিনহাজ জানিয়েছে সিকিউরিটি থাকতে পারে কিছু।
সাবধানে বিল্ডিংটাতে ঢুকতে গিয়ে কারও সাথে ধাক্কা খেলাম।
ক্যাপ বাঁকা হয়ে গেল ছেলেটার।
‘সরি।’ জানালাম ছেলেটাকে। বয়সে আমার চেয়ে ছোটই হবে দুই একবছর। চেনা চেনা চেহারা।
‘ইটস ওকে ব্রাদার। ফিফটি পারসেন্ট ফল্ট ওয়াজ মাইন।’ একটু হেসে বলে বেড়িয়ে যায় ছেলেটা।
ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করি। হেডফাইভ মিলনকে পাওয়া যাবে তিনতলায়।
সিঁড়ি বেয়ে তিনতলাতে পৌঁছতেই ঘাড়ের পেছনের চুল দাঁড়িয়ে যেতে থাকে আমার। তিনতলার দরজার নিচ থেকে রক্ত গুড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে বাইরে।
চট করে গ্লকটা বের করে ধাক্কা দেই দরজাটায় – আস্তে করে খুলে যায় পুরোটা।
ভেতরের দৃশ্য গা গুলানোর মতই – ঝাঁঝরা হয়ে গেছে অপরপাশের দেওয়াল। তারমাঝেই ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সাতটা লাশ। তাদের মাঝে কালো সানগ্লাসের পাশে পড়ে থাকা মানুষটাই হেডফাইভ মিলন।
সানগ্লাস ছাড়া কোথাও যায় না মিলন। দরজার ঠিক সামনের লাশটা থেকে রক্ত গড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে পড়ছে এখন।
গ্লকের গ্রিপে শক্ত করে আঙ্গুল চেপে বসে আমার। রাবেকের পেছনে কোন ট্রেইলই পাওয়া যাচ্ছে না!
তৃতীয় হেডফাইভকেও মৃত দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে!
বুঝতে পারছি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে গুলি চালিয়েছে কেউ সাবমেশিনগান দিয়ে।
না – ধারণাটা পাল্টাতে বাধ্য হলাম। দুইহাতে দুটো অটোমেটিক পিস্তল দিয়ে গুলি করেছে আততায়ী এক্ষেত্রে। দেওয়ালের ক্ষতগুলো সেটাই বলছে।
একটু আগে ধাক্কা খাওয়া ছেলেটাকে কোথায় দেখেছি চট করে মনে পড়ে যায় আমার হঠাৎ। পিস্তল উদ্যত রেখেই চট করে ঘুরি যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে।
সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা।
একই সাথে একে অন্যের দিকে অস্ত্র তাক করি আমরা।
সময় যেন থমকে যায় আমাদের ঘিরে।

৫
‘রাবেকের হেডফাইভদের মেরে ফেলছ তুমি। কেন?’ পিস্তল একচুল না সরিয়ে জানতে চাই আমি।
‘বাহ! তোমার তাই ধারণা?’ তিক্ত কন্ঠে বলে ছেলেটা।
‘ধারণা না করার কোন কারণ আছে কি? হেডফাইভ আখতার যেখানে মারা যায় তার পাশের বিল্ডিংয়ে সেই সময়েই দেখি আমি। লিফটে ঢুকে যাচ্ছিলে একটা মেয়ের সাথে। আসলে বোমা ডিটোনেট করার জন্য পাশের বিল্ডিংয়েই আশ্রয় নিয়েছিলে, তাই না? রেঞ্জের বাইরে যেতে চাওনি।’
‘একই কথা আমি তোমার ব্যাপারেও বলতে পারি, হুয়েভার ইউ আর! সেদিন একই বিল্ডিংয়ে দেখার পর আজ হেডফাইভ মিলনের মৃত্যুর পরও একই বিল্ডিংয়ে তোমার সাথে আমার দেখা হবে কেন?’
একমুহূর্ত চুপ হয়ে যাই দুইজনেই।
হঠাৎ ব্যাপারটা চোখে পড়ে আমার। বিস্ময়ের একটা ধাক্কা খাই ভেতরে ভেতরে।
‘তুমি হেডফাইভ আখতার। হেডফাইভদের তুমি মেরে বেড়াচ্ছ না।’ হাত নামাই আমি। আখতারের দিকে অস্ত্র তাক করে রাখার কোন মানে হয় না।
‘হেডফাইভদের ওপর হিটগুলো তোমার নেওয়া নয় – যদিও এখন বুঝতে পারছি তুমি কে হতে পার। দ্যা ফ্যান্টম বয়। ইরফান। অন্য সময় হলে তোমাকে এইমুহূর্তে গুলি করতাম। তবে এখন পরিস্থিতি আলাদা।’ একই সাথে সিদ্ধান্তে পৌঁছে আখতার। হাতের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনের নাইন মিলিমিটারটা নামায় সেও। আবার নিস্তব্ধতা নেমে আসে সিঁড়িঘরে।
‘আমাদের কথা বলা দরকার।’ নিস্তব্ধতা ভাঙ্গি আমি নিজেই।
‘নিরাপদ একটা জায়গা প্রয়োজন।’ গাল চুলকাতে চুলকাতে পিস্তলটা হোলস্টারে রাখল আখতার।
‘জিয়া উদ্যান। এতটা নিরাপত্তা আশেপাশে আর কোথাও পাবে না। পিস্তলটা বেশ ভালো করে লুকিয়ে রাখো হে – এলাকা পুলিশে গিজ গিজ করে। ধরা পড়লে জবাব নেই। লেটস গো।’
নামতে থাকি আবার আমরা।
*
‘অবস্থা এমন হয়েছে – নিজেদের কাহিনী বলে ফেলাটাই মনে হচ্ছে একমাত্র চয়েজ।’ মুখ খুললাম পানির পাশে বসে। সতর্ক চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। রাবেককে কোন বিশ্বাস নেই।
ধীরে ধীরে গত কয়েকদিনের কথা খুলে বলি আমি রাবেকের একজন ‘মৃত’ হেডফাইভকে। চুপচাপ সব শোনে আখতার।
‘অনেকগুলো ব্যাপার স্পষ্ট হল।’ এতটুকুই বলে শুধু।
তারপর সিগারেট ধরায় একটা।
অযথাই কাশি দেয় দুইবার।
বুঝতে পারি, সারাজীবন গোপনীয়তার মধ্যে থেকে অভ্যস্ত ‘রাবেকীয়’ মাফিয়ার কনিষ্ঠতম হেডফাইভ জীবনের প্রথমবার গোপনীয়তার খোলস ভেঙ্গে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। একটু অপ্রস্তুত হবে এমনটিই স্বাভাবিক। তাকে আমি সময় নিতে দিলাম।
কয়েক মিনিট উশখুশ করে শুরু করলো সে, ‘আমাদের হেডফাইভদের লোকেশন কম্প্রোমাইজড হয়ে গেছে – এই খবরটা আমার ওপর হিট নেয়ার আগেরদিন জানানো হয় আমাকে। খবরটা দিলো তিন্নি, বহুদিন ধরে একসাথে কাজ করছি আমরা। অন্য কেউ হলে খুব একটা পাত্তা দিতাম না।’ অযথাই জোরসে সিগারেটে কয়েকবার টান দিল আখতার, ‘ওর কথাতে বিশ্বাস করতে পারিনি। তবে একেবারে উড়িয়ে দিতেও পারিনি। ডন রাবেক নিরাপদে থাকেন কারণ ওকে আমরা নিরাপদে রাখি। আর এই একটা কথার গুরুত্ব বুঝতে পারছ তো?’ আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চায় আখতার।
‘হুম। তোমাদের নিরাপত্তার কথাই রাবেক সবার আগে ভাববে। যেহেতু তোমাদের কাওকে চিনে ফেললে অ্যানিহাউ ব্রেক করে ছাড়বে শত্রুপক্ষ।’
মাথা দোলায় আখতার, ‘রাইট। কিন্তু আমাদের লোকেশন কিভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে তাহলে? মধ্যরাত পর্যন্ত তবুও দলের অনেকের সাথে কথা বললাম। দেখার চেষ্টা করলাম কোন লীক আছে কি না। তেমন মনে হলো না। ইনফর্মার মেয়েটার কথা ভুল ধরেই নিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন মনে হল কাছ থেকে ব্যাপারটা টেস্ট করে দেখা যেতে পারে। একই সাথে দুটো বিল্ডিং নিলাম। অফিসকে জানালাম একটি বাসার ঠিকানা। আমাদের ব্যাপারগুলো সরাসরি ডন রাবেকই হ্যান্ডেল করেন। যাই হোক – পাশের বিল্ডিংয়ে অপেক্ষা করতে করতে অর্গানাইজেশনের কিছু কাজ সেরে ফেললাম আমি আর তিন্নি। তারপর সেখান থেকে বের হতে গিয়ে দেখলাম লিফট থেকে তোমাকে বের হতে – যদিও তখন সন্দেহ করিনি কিছু।’
একটু হাসল দুইজনই। আবার বলতে শুরু করে আখতার, ‘আধঘন্টার মাঝে গাড়িগুলো এসে একেবারে সাফ করে ফেলল আমার লোকেদের! বোমাটা আগেই পেতে রেখেছিলাম – এরকম সিচুয়েশন দেখা দিলে নিজের মৃত্যুটা সাজানোর জন্য। সময় হতেই ফাটিয়ে দিলাম পাশের বাসার গ্যারাজে দাঁড়িয়ে।’
‘আরেকটু হলে আমাকে সহই ফাটিয়ে দিয়েছিলে!’ গোঁ গোঁ করে বলি আমি।
‘সরি।’ আখতারের হাসির মাঝে অবশ্য দুঃখের কোন লক্ষণ দেখা যায় না – একঝিলিক কৌতুক উঁকি দেয় শুধু। ‘যাই হোক – এরপরদিনই শুনলাম হেডফাইভ ইয়াসিরের মৃত্যু। অ্যামবুশ। গানফাইট। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলালাম তখনই। তিন্নি যখন সাবধান করেছিল, তখন ভেবেছিলাম তোমার ব্যাপারে। রাবেকের সাথে তোমার চুলকানির কারণটা হেডফাইভেরা জানে। কিন্তু ঘটনা দুটোর পর বুঝলাম কাজটা তোমার না। একা চল তুমি। তিন বহর গাড়ি নিয়ে হামলা দেয়াটা ঠিক তোমার সাথে যায় না।’
‘আর আজকের ব্যাপারটা?’ আবার প্রসঙ্গে ফিরে আসি আমি।
‘যাদের সাথে এখনো ভালো সম্পর্ক আছে এমন মানুষজনের সাথে দেখা করলাম। হেডফাইভ মিলনের ঠিকানাটা জোগাড় করে এসেছিলাম তার সাথে দেখা করতে। এসে দেখলাম কাজ হয়ে গেছে।’
মাথা নামায় আখতার। আবার তুলল মিনিট দুই পর। সিগারেটটা সামনের পানিতে ফেলে দেয় ছুঁড়ে।
‘কিভাবে বুঝলে?’ বিশেষ কিছুর প্রতি ইঙ্গিত না করলেও কিসের কথা জানতে চাইছে বুঝতে পারি আমি।
‘ভেতরের তান্ডবটা মেশিন পিস্তল দিয়ে ঘটানো হয়েছে। তোমার হাতে ছিল একটা এস অ্যান্ড ডব্লিউ। তাহলে – খুনগুলোর সাথে তুমি জড়িত না। অথচ, আখতারের বাসার পাশে তোমাকেই দেখেছি। যার অর্থ একটাই হতে পারে – আখতার তুমি নিজেই।’
একটু হাসল আখতার।
‘থার্ড পার্টির ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।’ মাথা নাড়ে আখতার। ‘কে জানবে আমাদের ব্যাপারে?’
‘ডন রাবেক।’ জানিয়ে দিলাম ওকে আমার ধারণা।
‘নেভার।’ তীব্র আপত্তি জানায় আখতার, ‘ডন রাবেকের নিরাপত্তা আমরাই নিশ্চিত করি। আমাদের ছাড়া অর্গানাইজেশন চলবে কি করে?’
‘হয়ত তোমাদের অজান্তেই আরও পাঁচজনকে প্রস্তুত করে ফেলেছে ও। যারা রাবেকের লোকেশনও জানবে না। রাবেক ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব না একে একে সব হেডফাইভের ব্যাপারে জানার। বাই দ্যা ওয়ে – তুমি কি রাবেকের লোকেশন জানো?’
আইডিয়াটা কিছুটা হলেও ধরল আখতারকে এবার।
‘না। শেষ বার আমি আপডেট দেয়ার পর রাবেক নিজের লোকেশন নিয়ে কিছু বলেনি। হেডফাইভকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়াটা রাবেকের প্ল্যান হলেও হতে পারে। কিন্তু সেখানে উদ্দেশ্যটা কি?’
‘খুবই সাধারণ। হেডফাইভের সাথে ডন রাবেকের একটামাত্র প্রশ্নেই অবিশ্বাস। ডন রাবেক এখন কিংবা আগে এই পদ্ধতিতে অর্গানাইজেশন চালিয়ে নিরাপদ থাকতে পারে – কিন্তু আমার স্কিলের ব্যাপারে রাবেকের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আর আমি হয়তো খুঁজে বের করে ফেলতে পারি হেডফাইভদের – এবং সেখান থেকে রাবেককে। কাজেই তার একমাত্র উইকপয়েন্ট ছিলে তোমরা। হেডফাইভস। নতুন কোন পদ্ধতি অর্গানাইজেশন চালানোর কথা হয়ত রাবেক ভেবেছিল – কিন্তু সেটা তোমাদের সরিয়ে দেয়ার পরই বাস্তবায়ন করা হত হয়ত।’
আমার কথাতে আখতার কিছুটা প্রভাবিত হল বলেই মনে হয়।
‘যাই হোক – আমাদের তিনজন হেডফাইভের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে। আর দুজনের সাথে দেখা করাটা জরুরী।’ উঠে দাঁড়ায় আখতার।
ওকে স্তব্ধ করে দেই আমি একটামাত্র বাক্য উচ্চারণ করে, ‘তিন নয়, আখতার। চারজন।’
আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আখতার।
‘আমার সাথে আসতে পারো। একজন পুরোনো সহকর্মীর সাথে দেখা করবে।’

৬
টর্পেডোর মত ফ্রন্ট বাম্পারের ধাক্কায় গেইট উড়িয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে গাড়িটা – তবে থামে না।
স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে কালো সানগ্লাসে চমৎকার লাগছে আখতারকে।
চলন্ত অবস্থাতেই একহাত স্টিয়ারিংয়ে রেখে অন্যহাতে ধরে থাকা ক্যালিকো এম-নাইনসিক্সটিটা থেকে ফুলঝুরির মত গুলি বর্ষণ শুরু করে ও।
বিশাল বাগান বাড়িটা স্থানে স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সিকিউরিটি গার্ডেরা অতর্কিত হামলায় চমকে উঠলেও খুব দ্রুতই সামলে নিতে থাকে। অর্ধেক গার্ড এতক্ষণে শুয়ে পড়েছে অবশ্য প্রাণহীন দেহে। কিন্তু বাকিরা দ্রুত কাভার নেয়ার চেষ্টা করল।
বিশাল একটা চক্কর দিয়ে আবার ফিরে আসতে থাকে আখতার গাড়ি নিয়ে – এর মধ্যে রিলোড করে ফেলেছে।
বাড়িটার ছাদের একটা মূর্তিকে দেখা যায় – হাতে বাজুকা নিয়ে আখতারকে টার্গেট করার চেষ্টা করছে। কারবাইনটাকে সিঙ্গেল শটে নিয়ে একটা মাত্র গুলি খরচ করলাম ওদিকে।
প্রাচীরে গা ঢাকা দিয়ে এতক্ষণ অবস্থা যাচাই করছিলাম।
আখতার দারুণ দেখাচ্ছে। আরেকটু কমে আসলেই ভেতরে ঢুকে যাব আমরা।
বেড়ার ওপর থেকেই একের পর এক গুলি চালিয়ে রাবেকের সৈন্যদের বেড়া পার করতে থাকি আমরা।
‘ডান। চল ঢোকা যাক।’ আখতারের কন্ঠ স্পষ্ট শুনতে পাই রেডিওতে। ওপর থেকে নেমে আসলাম।
ক্লোজ রেঞ্জে আমার কারবাইন কোন কাজে আসবে না। আখতারের গাড়িতে অস্ত্রটা রেখে গ্লকটাই বের করলাম।
নাঈমকে ধন্যবাদ; এত অল্প সময়ের নোটিশে আমাদের চাওয়া প্রতিটি অস্ত্র ম্যানেজ করে দিয়েছে। অবশ্য চোরাকারবারীর অস্ত্র ব্যবসায় নাঈমের সমকক্ষ কেউ নেই বাংলাদেশে।
সিংহদরজাটার দুই কবাটে ধাক্কা দিই আমরা দুইজন। তবে ধাক্কা দিয়েই ঢুকে পড়লাম না, বরং সরে গেলাম দুইপাশে।
এখন ভেতর থেকে প্রাণের সুখ মিটিয়ে গুলি চালাচ্ছে রাবেক বাহিনীর অবশিষ্টাংশ।
কান পেতে কিছুক্ষণ গুলির ধরণ আর প্রকৃতি বুঝার চেষ্টা করি। তারপর দরজার এপাশের প্রান্ত থেকে আখতারকে ইঙ্গিতে দেখাই, ‘তিন’।
মাথা ঝাঁকাল আখতার।
ভেতরের শব্দ থেমে গেছে। প্রথমে দরজা খোলার সাথে সাথেই ইন্সট্যান্ট রিঅ্যাকশন দেখিয়ে ফেলেছিল, এরপর বুঝে শুনে গুলি চালাবে ওরা। কয়েকটা মুহূর্ত ভাবলাম, একটা গেম-প্ল্যান প্রয়োজন। একসাথে তো আর তিনজনকে সামলানো সম্ভব নয়!
বুঝতে পারলাম কী করতে হবে। গুলির শব্দ কোন দিক থেকে এসেছিল তা মনে করলাম আরেকবার, আশা করি আমার ধারণা সঠিক। বিশাল দরজাটার তিনদিকে তিনজন বসে আছে। মানে অ্যাংগেল বানিয়ে নিলে একবারে একজন করে পাওয়া সম্ভব। সামান্য সরালাম আমার চোখ। আস্তে আস্তে শূন্য ডিগ্রী অ্যাংগেল থেকে এক দুই তিন – চার ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে যেতেই একজন মানুষের অংশবিশেষ দেখতে পেলাম। বাম হাতে গ্লকটা তুলে শুধু হাত লম্বা করে ওদিকে দুটো গুলি পাঠিয়ে দিতেই ভেতর থেকে কাতর আর্তনাদ ভেসে আসল।
আমার পদ্ধতি ফলো করে আরেকজনকে ফেলে দিয়েছে আখতার ক্যালিকোর বর্ষণে।
এবার আখতারকে সংকেত দিয়ে দুইজনই গড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে একযোগে গুলি চালাই তৃতীয় ডিফেন্ডারের ওপর, গুলির ধাক্কায় মাটি ছেড়ে উঠে গেল মানুষটার পা। এই শরীরটা আছড়ে পড়তেই চারপাশটা চুপচাপ হয়ে যায়।
তারপরই তালির শব্দ।
দোতলায় উঠে গেছে ডুপ্লেক্স বাড়িটার সিঁড়িটা। দুই হাতে হাত তালি দিতে দিতে সেখানে দাঁড়ায় একজন মানুষ।
রাফসান বেগ কবীর ওরফে রাবেক!
ডন রাবেক।
*
আখতার আর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম হাসপাতালে। জিয়া উদ্যান থেকে চলে এসেছি সরাসরি এখানে।
ফারিহা আমাকে একবার জড়িয়ে ধরল শুধু।
ওর কাছে রিজভী আকন্দের শরীরের অবস্থা জেনে নেই। জ্ঞান ফিরেছিল উনার। এখন আবার ঘুমাচ্ছেন।
তবে ডাক্তার বলেছে প্রাণের ভয় আর নেই। তবে তাঁকে নড়াবারও জো নেই। দুর্বল শরীর, রক্তক্ষরণ কম হয়নি। বয়েসটাও তো দেখতে হবে! এখনও নাকি আরেকব্যাগ রক্ত দিতে হবে অন্তত। আর এখানে দুই সপ্তাহ চেক-আপের মধ্যে থেকে বাড়ি ফিরেও যেতে পারবেন।
‘ফারিহা?’ ইতস্তত করে বলেই ফেললাম, ‘একটু বাইরে অপেক্ষা করবে?’
ফারিহা কোন প্রশ্ন না করেই বাইরে চলে গেল। মেয়েটার এই গুণটা আমাকে আকৃষ্ট করে। অহেতুক প্রশ্নের মধ্যে সে নেই। ঘটনার গভীরতা এবং তাৎপর্য বোঝে।
ফারিহা বের হতেই চোখ মেললেন ‘মৃত-প্রায়’ এবং ‘ঘুমন্ত’ মি. রিজভী, ‘থ্যাংকস আ লট, রবিন। মেয়ের সামনে জীবনে মুখ দেখাতে পারতাম না আমি। বাবা হিসেবে আমাকে অনেক উঁচুতে স্থান দেয় মেয়েটা।’
‘একজন হেডফাইভ হতে পারেন কিন্তু মানুষ হিসেবে আপনি আসলেই অসাধারণ , স্যার।’
না বলে পারলাম না আমি, মানুষটা কথা রাখতে জানেন। ‘রাবেকীয়’ মাফিয়ার একেবারে উচ্চপর্যায়ের মানুষ হয়েও ঈশিতাকে সত্যিকার অর্থেই প্রটেকশন দিয়েছিলেন তিনি এতদিন। আমার ব্যাপারে জানার পরও আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মেয়ের প্রতি অপার স্নেহও এর একটা কারণ হতে পারে!
‘আপনারা দুইজনই শেষ হেডফাইভস।’ আবার বলি আমি, ‘রাবেকের প্ল্যান ছিল আপনাদের সরিয়ে ফেলার। ঠিক যেমন আমার প্ল্যান ছিল আপনাদের কাওকে ব্রেক করে রাবেকের লোকেশন জানার। লোকটার মাথা ভয়ানক চালু। আমার প্ল্যান গেস করে আগেই অ্যান্টি-প্ল্যন করে ফেলেছে!’
রাবেকের প্রশংসা বাধ্য হয়েই করতে হল আমাকে এখানে।
‘আখতার বেঁচে গেলে কিভাবে? সবাই তোমার মৃত্যুর খবর জেনেছি। একদিন শোকও পালন করা হয়েছে তোমার জন্য।’ বিস্ময় চেপে শুধু জানতে চান মি. রিজভী।
‘বিশাল ইতিহাস, মি. রিজভী।’ এড়িয়ে যায় আখতার প্রশ্নটা, ‘ডন রাবেক আমাদের সরিয়ে দিতে চাইছে। এবার আমাদের প্ল্যান কি হওয়া উচিত?’
‘কাজটা রাবেকের সেটা আমার ওপর অ্যাটাক হওয়ার পরই বুঝতে পেরেছিলাম।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন রিজভী, ‘আর পঞ্চম হেডফাইভের কি হল?’
‘আমাদের ধারণা পঞ্চম হেডফাইভ রাবেক নিজেই।’ জানালাম আমি, ‘কারণ আপনারা চারজন একে অন্যকে চিনলেও পঞ্চম হেডফাইভকে কেউ চেনেন না। রাবেক না হয়ে যায় না সেটা। এখন রাবেকের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিতে চান বলুন।’
আমরা দুইজনই তাকিয়ে থাকলাম দূরদর্শী মানুষটার দিকে।
‘অ্যাটাক অ্যান্ড ডেস্ট্রয় হিম। এরকম একটা ঘটনার পর একটা ফ্যামিলিতে আর বিশ্বাসের জায়গা থাকতে পারে না।’
‘আমারও একই মত, মি. রিজভী।’ বলল আখতার।
বাইরে বেরিয়ে ফারিহার কাছ থেকে বিদায় নিলাম আমি, ‘ঈশিতাকে নিয়েই ফিরব আমি।’
কথা দিলাম ওকে।
চলে আসার সময় ওর বড় বড় চোখদুটোতে কিছু একটা দেখতে পাই আমি। ভালোবাসা?
*
হাত তালি থেমে গেল রাবেকের।
লোকটার সাহস দেখে অবাক হলাম আমি। কোন ভয় নেই এর জীবনের।
মাত্র পঞ্চাশ ফিট দূরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি – তাও কী সাবলীলভাবেই না কথা বলা শুরু করে রাবেক!
‘কংগ্র্যাচুলেশন্স! এই পর্যন্ত আসতে পেরেছ। তোমাদের মনে থাকবে আমার। যেটুকু জানার জন্য এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছি – আমাকে বার বার খুঁজে পাচ্ছ কিভাবে , রবিন? হাজার ভেবেও ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি।’
‘মায়ের রক্ত লেগে আছে আপনার হাতে। খুঁজে না পেয়ে উপায় আছে? একটা অস্ত্র তুলে নিন হাতে, রাবেক।’ হুংকার ছাড়ি আমি।
রাবেককে খুন করে ফেলার জন্য সামান্য একটা ছুতোই দরকার আমার।
‘সেই আশা পূর্ণ হবে না তোমার, রবিন। আমাদের মাঝে কেউ মারা গেলে সেটা তুমিই হতে যাচ্ছ। ঈশিতাকে বের করে ফেল কিভাবে বার বার – এই কৌতূহল মেটাবার সম্ভাবনা নেই সেটা জানা ছিল আমার। তবুও দেখা করার জন্য একটু থামলাম। দেখাসাক্ষাৎ আমাদের সম্প্রীতি বাড়িয়ে তোলে, রবিন। আফটার অল, আমি তোমার বাবা। দেখা হল – কাজেই …’
দুই আঙ্গুলে টাটা দেখিয়ে সিঁড়ির মাথা থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় রাবেক।
একই সাথে বাড়িটা হাল্কা কেঁপে – বাইরের শব্দটাও অতি পরিচিত আখতার বা আমার।
দৌড়ে ওপরে উঠতে থাকি আমরা।
ছাদের দরজাটা খোলা। সেদিক দিয়ে ঢুকতেই মাত্রই উঠে যেতে দেখা গেল কুটিল গডফাদারকে।
অপেক্ষমাণ হেলিকপ্টারটা তার রোটর ঘোরাচ্ছে পূর্ণগতিতে। সেটা নয় – ভেতরে বসে থাকা ঈশিতাকে দেখে হৃৎপিন্ডটা গলার কাছে উঠে আসতে চায় আমার।
একই সাথে আমাকে দেখলো ঈশিতা – ওর বিষন্ন মুখে একটা হাসির রেখা এতদূর থেকেও দেখতে পাই আমি।
একপাশে বসে থাকা মেশিনগানার তার মেশিনগানের নল আমাদের দিকে ঘোরাতে শুরু করেছে ততক্ষণে।
হেলিকপ্টারটা ছাদের সারফেস থেকে উঠতে শুরু করে – একবুক আশা নিয়ে দেখলাম মেয়েটা আচমকা লাফ দিয়েছে! ছাদের ওপর পড়লো ঈশিতা, উচ্চতা একেবারে কম ছিল না, উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার পড়ে গেল। একঝটকায় গ্লকটা বের করে ম্যাগাজিনের তেরটা গুলির প্রতিটি পাঠালাম কপ্টারের দিকে। রাবেককে থামাতে হবে।
আখতারের হাতের ক্যালিকো সাবমেশিনগানটাও গর্জে ওঠে আরেকবার – একই সাথে ফুলকি দেখা যায় কপ্টারের মেশিনগানের নলের সামনে।
ডাইভ দিয়ে ভেতরে চলে আসি আমি।
ঈশিতার কাছে ছুটে যাওয়ার জন্য ভেতরটা আকুলিবিকুলি করছিল, তবুও মাথাটা নামিয়ে রাখতে হলো। বাইরের তান্ডবের শব্দ থামার বিরাম নেই।
অবশেষে থামলো গুলির শব্দ। রোটরের শব্দ দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। ছুটে বের হয়ে এলাম ছাদে।
শুয়ে আছে আখতার। নিষ্প্রাণ দুই চোখে শূন্যতা।
প্রয়োজন ছিল না – তবুও পালস চেক করলাম। নেই।
দূরে ছাদের মাঝে বসে আছে ঈশিতা। চারপাশে পড়ে আছে মেশিনগান শেল।
ওকে গিয়ে ধরি আমি, ‘ঠিক আছিস?’
কিছু না বলে আমার কাঁধে মুখ লুকোয় ঈশিতা। একদিনে যথেষ্ট হয়েছে ওর জন্য।

পরিশিষ্ট
‘রবিন?’
পেছন থেকে রিজভী আকন্দের গলা শুনে ফিরে তাকালাম।
ধীরে ধীরে হাঁটতে পারেন এখন তিনি। এগিয়ে গিয়ে তাঁকে সাহায্য করলাম রেলিংয়ের কাছে আসতে।
ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। চাঁদ দেখছিলাম একাকী। আবারও ফিরে এসেছি রিজভী সাহেবের বাড়িতে।
‘আমি সত্যিই দুঃখিত। কিন্তু আমারও কালো অতীত আছে একটা। জানোই তো – সবারই থাকে।’ ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বলেন রিজভী আকন্দ।
‘আপনার নীতিতে আপনি ঠিক ছিলেন – এটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট, স্যার।’ আর কথা বাড়াতে দেই না উনাকে।
‘ফারিহা আর ঈশিতা ঘুমাচ্ছে।’ জানালেন তিনি।
‘এখান থেকে আগামীকালই সরিয়ে নেব ওদের। আপনাকেও, স্যার। রাবেকের কাছ থেকে এখন কেউ নিরাপদ না।’
একয়দিন আমি এখান থেকে নড়িনি। অন্য কারও ওপর ওদের নিরাপত্তার ভার দিয়ে আর নিশ্চিত হতে পারছি না।
দুইজনই কিছুক্ষণ চুপ করে রাতের কালো আকাশ দেখি।
‘ইয়াসির তোমাকে পেয়েও মেরে ফেলার অর্ডার কেন পেল না রাবেকের কাছ থেকে – ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।’ হঠাৎ বলেন মি. রিজভী।
‘রাবেক চেয়েছিল একঢিলে দুই পাখি মারতে, স্যার। ইয়াসির আর আমি এক গাড়িতে ছিলাম তা জানা ছিল ওর।’
‘কিভাবে বুঝলে আমিও একজন হেডফাইভ?’ জানতে চাইলেন অবশেষে প্রশ্নটা।
‘ফারিহার বর্ণনা স্যার। তখনও অ্যাটাকটাকে থার্ড পার্টির বলে মনে করছিলাম। কিন্তু আপনাকে দেখা মাত্র শূট করা আর ঈশিতাকে দেখে আক্রমণের ধরণ পাল্টে ওকে সাথে করে নিয়ে যাওয়ায় বিষয়টা খটকা লাগে আমার। নিশ্চিত হই ওটা রাবেকের কাজ।’
‘কিন্তু তোমার তো ভাবার কথা ছিল ঈশিতার জন্যই এসেছে রাবেকের লোকেরা। আমাকে হেডফাইভ কেন ভাবলে?’
‘আপনার রুটিন পাল্টে যাওয়াতে। নিজেই ফাইল নিতে চলে এসেছেন দেখে অবাক হয় ফারিহা। তখনই সন্দেহটা হল। নিশ্চয় রাবেক নিজেই বলেছিল আপনাকে ওটা আনতে? এমন কিছু যা আনতে হলে আপনাকেই বেরুতে হবে। কর্মচারী দিয়ে আনা যাবে না। খুব গোপনীয় কিছু, যা থাকতে পারে একজন হেডফাইভের বেডরুমের লকারে। যাতে আপনার লোকেশনটা জানাতে পারে ও তার কিলারদের?’
‘হুঁ। চীপ বাস্টার্ড।’ রেইলিংয়ে থাবা দেন রিজভী আকন্দ।
তারার আলোতে দাঁড়িয়ে থাকি দুইজন মানুষ – মতাদর্শের পার্থক্য থাকলেও নীতিগত দিক থেকে যাদের চিন্তা ভাবনা একরকম।
জীবনটাকে হঠাৎই বড় অদ্ভুত বলে মনে হতে থাকে আমার!

চতুরঙ্গ

আমার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে স্বাগতম!

সাপ্তাহিক চতুরঙ্গ ইনবক্সে পাওয়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন! এতে আপনি প্রতি সপ্তাহে পাচ্ছেন আমার বাছাইকৃত চার লেখা!

আপনার কাছে কোন স্প্যাম ইমেইল যাবে না। নিউজলেটার ইমেইল ইনবক্সে খুঁজে না পেলে স্প্যাম কিংবা প্রমোশনাল ফোল্ডার চেক করুন!

Check your inbox or spam folder to confirm your subscription.

ক্রাইম গল্প

Post navigation

Previous post
Next post

কিশোর পাশা ইমন

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Related Posts

গোয়েন্দাগিরি

Posted on February 26, 2023

‘সাবাশ!’ গোবদা হাত দিয়ে ওর পিঠ চাপড়ে দেয় জুয়েল।’ প্রায় সবকিছুই ধইরা ফেললি! আরেকটা জিনিস বাকি – লেখাটা একটা মাইয়ার। সম্ভবতঃ – হাতের লেখা পাল্টাইছে যে লেখছে। মানে তোর পরিচিত ওই মাইয়া। আর না পাল্টাইলে অন্য কাওরে দিয়ে লেখাইছে।’
জুয়েল কলেজে গোয়েন্দা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

Read More

দ্য ফিফথ হেডফাইভ

Posted on October 24, 2023

আমার মত জীবন যাদের তাদের জন্য কোন কাকতালীয় ঘটনা নেই। কোন দুর্ঘটনা নেই।
যা হয় তার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে বাধ্য।

Read More

সামাজিক হিপনোটিজম

Posted on May 28, 2023

অবাক হতে ওর চোখে চোখ রাখলো শুভ্র, “তোমাকে না বললাম, বাসার সবাই গ্রামে গেছে?”
দুই হাত বুকের কাছে বাঁধলো তিথি। এবার সত্যিই রাগ হচ্ছে ওর।
“খালি বাসায় আমাকে আনলে কেনো?”
মুচকি হাসলো শুভ্র, “তোমার পর্ন ভিডিও বের করার জন্য। আমি এটাই করি। একা একটা মেয়েকে নিজের বাসায় এনে তার সাথে অনৈতিক কাজ কর্ম করি। আমার ক্ষুদে রোবটেরা তা ভিডিও করে। তারপর সেই সব ভিডিও চড়া দামে বাজারে বিক্রি হয়। আমার উদ্দেশ্য তোমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে?”

Read More

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সর্বশেষ লেখাগুলো

  • ওয়ান ফর মাই সৌল
  • আমার যত প্রকাশক
  • কেপির সেরা লেখা কোনটি – জরিপ ২০২২
  • আন্ডারএইজের বই পড়া
  • অমুক পড়ে আসেন… সমস্যাবলী

Analytics

009435
Total Users : 9435
Total views : 23711
Who's Online : 0
Powered By WPS Visitor Counter
©2025 KP Imon | WordPress Theme by SuperbThemes