KP Imon

Words Crafted

যীশুর হত্যাকারী

“নিরাপদে থাকবে কেবল যীশুর অনুসারীরা। সত্যিকারের বিশ্বাসীরা।”
ত্রিশ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচালো আমেরিকানটা।

আমি আর সুমিত দাঁড়িয়ে আছি জ্যাক ইন দ্য বক্সের সামনের পার্কিং লটে। আমার পকেট গড়ের মাঠ। সুমিত আমাকে একটা বার্গার খাওয়াচ্ছিল। পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে আছি সুমিতের উবার আসার অপেক্ষায়। তখনই একটা লোক একটা কুকুর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আমাদের দেখে বললো, “আশা করি তোমরা পানি জমিয়ে রেখেছ!”

বালটাও বুঝলাম না। তবে সচরাচর যা করে থাকি, জ্যাকি চ্যানের মতো একটা ভদ্রতাসূচক হাসি হাসলাম।
কাজ হয়ে গেল।
লোকটা ওখানে একটা খাম্বার মত দাঁড়িয়ে গেল। ভ্রু কপালে তুলে বললো, “তুমি হাসছো, অ্যাঁ? টেক্সাসের গভর্নর বলেছে আগামি নয় মাস কারেন্ট থাকবে না। পানি থাকবে না সেজন্য। বাড়িতে আমি নয় মাস একটা গোটা ফ্যামিলিকে খাওয়ানোর মতো খাবার জমিয়ে রেখেছি। জানো এটা কেন হবে? কারণ এরপর যে সমস্যাটা আসবে পৃথিবীতে তা হচ্ছে খাবারের সমস্যা। বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ খাবার না পেয়ে মরবে। এটার শুরুটা কোথায় হবে, জানো?”

এতক্ষণে আমি ঘটনা বুঝে গেছি। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা একজন মস্ত বেকুব, রিপাবলিকান, ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান, এবং একজন কনজার্ভেটিভ। সচরাচর এগুলো একটা প্যাকেজ হিসেবেই আসে। মোট আটটি বৈশিষ্ট্য আছে যাদের যে কোন একটা পাওয়া গেলেই ধরে নিতে পারেন বাকি সাতটা তাদের মধ্যে থাকবে এই সম্ভাবনা ৮৯%।

(১) বেকুব কিন্তু নিজেকে জ্ঞানী মনে করে
(২) প্রো-গান
(৩) প্রো-গড
(৪) প্রো-লাইফ
(৫) রিপাবলিকান
(৬) ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান
(৭) কনজারভেটিভ
(৮) সায়েন্স এবং তার লোকজনকে দেখতে পারে না।

ঘটনা বুঝে ফেলার কারণে আমি বললাম, “না, এর শুরু কোথায় হবে তা তো জানি না।”

লোকটা তড়পে উঠলো। বললো, “আমি চৌদ্দ বছর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে কাজ করেছি। আমি স্মার্ট লোক, বুঝলে? এর শুরুটা হবে টেক্সাসে। রক্ষা পাবে কারা এ থেকে জানো? শুধুমাত্র খ্রিস্টানরা।”

ওদিকে সুমিতের উবার চলে এসেছে। সে ওদিকে রওনা দিলো। কিন্তু একটা হাতি দিয়ে বেঁধে টান দিলেও আমি এখন এই পার্কিং লট থেকে নড়বো না। এরকম প্রতিটা মানুষ পাওয়া মাত্র খুঁটি গেড়ে আমি দাঁড়িয়েছি। কান পেতে শুনেছি তাদের কথা। ক্ষেত্রবিশেষে বাচাল হলেও, বিরুদ্ধমতের কারো সামনে আমার থেকে ভাল লিসনার আর কোথাও পাবেন না আপনি।

লোকটা আমাকে জুতমতো জ্ঞান দেয়া শুরু করলো, “ইউনিভার্সিটিতে পড়া বুড়োখোকাদের ব্যাপারে তোমাকে একটা কথা বলে যেতে পারি। এরা সব প্রতিবন্ধি, ভাই। বোকাচোদা। এরকম চার-পাঁচ জনের সাথে কথা বলেছি আমি। আমার কোন কথাই তাদের ভালো লাগে নাই। ভেবেছে সব গুজব। আমি তো আর বোকা না। ফ্লোরিডায় আমার পাঁচ মিলিয়ন ডলারের বাড়ি আছে। সেখানে না থেকে আমি টেক্সাসে থাকি। কারণ যুদ্ধটা শুরু হবে এখান থেকেই।”

বিড়বিড় করে আমি বললাম, “গাজওয়ায়ে হিন্দ আরকি।” মুখে বললাম, “যুদ্ধ?”

বোকাচোদাটা বললো, “ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের যুদ্ধ। খাবারের ক্রাইসিস শুরু হলেই আমরা যুদ্ধে নেমে যাবো। আমেরিকা সরকারের তখন প্রচুর যোদ্ধার দরকার হবে। তোমার কি মনে হয় এই যে তোমাদের বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছে, মেধার জন্য আনছে? না, আনছে কারণ তাদের যুদ্ধের জন্য লোক দরকার হবে। তখন আমেরিকার মাটিতে যারা থাকবা সবাইকে যুদ্ধে যেতে হবে।”

আমি তখন তাকে লাই দিলাম, “অবশ্যই যাবো। আমার তো আজন্ম স্বপ্ন আমেরিকার হয়ে যুদ্ধ করার।”

লোকটা খুশি হয়ে বললো, “তুমি সত্যিকারের পুরুষ। আজকালকার চ্যাংড়াদের মধ্যে এমন বেশি দেখা যায় না। আর তোমাকে একটা সত্য কথা বলি – যখন তুমি বুঝে ফেলবা একজন পুরুষ হিসেবে তোমার সত্যিকারের ক্ষমতা কতখানি তখন আর মেয়েদের অধিকারের নাটক তোমার ভালো লাগবে না। গর্ভপাতের অধিকার চায়। মজাটা বুঝেছ? পুতিন কী বলেছে শোননি? বলেছে পশ্চিমাবিশ্ব তার শত্রু নয়। তার শত্রু হচ্ছে ওক কমিউনিটি। এরা ওক কমিউনিটির নামে যা শুরু করেছে তা হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত কেড়ে নেয়ার পায়তারা। মেয়েদের অধিকার, সমকামীদের অধিকার। ছোহ।”

একটা গাড়ি তখন পার্কিং লট থেকে বেরুতে গিয়ে ওর কুকুরকে মাড়িয়ে দিয়েছিল প্রায়।
কুকুরটা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। আমি তাকে দেখতে দেখতে ভাবলাম, কুকুরটাও কি রিপাবলিকান?
কুকুরটাও কি প্রো-গড, প্রো-গান, প্রো-লাইফ? কুকুরটা তো ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান হবার কথা নয়। কিন্তু কে জানে! হতেও পারে।

লোকটা কুকুর সামলে আবার শুরু করলো, “টেক্সাস হবে যুদ্ধের শুরু। কারণ এখানে তখন এগিয়ে আসবে মেক্সিকান কার্টেলগুলো। বন্দুক তোমরা দেখবে। আমরা তখন যুদ্ধে নেমে দক্ষিণে পুশ করবো। এই যুদ্ধ কোথায় শেষ হবে জানো?”

আমি বললাম, “না। আমি একটু মূর্খ এবং বোকাচোদা, স্যার। দ্বীন-দুনিয়ার খবর তেমন রাখি না। আমাকে ক্ষমা করবেন। বরং আমার জ্ঞাননেত্র বিকশিত করে দিন। বলুন, যুদ্ধটি কোথায় শেষ হবে?”

বলদটা বললো, “আর্জেন্টিনা। কারণ আমাদের পুরো মহাদেশটাই দখল করতে হবে। মারতে হবে সবাইকে। আর খাবারের সংকট বাড়লে গোটা আমেরিকার লোকই ছুটে আসবে টেক্সাসের দিকে। আমরা তখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করবো। শেষ মাটিটা পর্যন্ত দখল করবো আমরা।”

আমি বললাম, “ওয়াও।”

মূর্খটা নিজের বুকে টোকা দিয়ে বললো, “আমি একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান। বাকিদের মত দুর্বল নই। মানুষ খুনে আমার হাত কাঁপবে না, কারণ আমি ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য খুন করায় খারাপ কিছু দেখি না।”

তারপর আরও দশ-পনেরো মিনিট আমাদের আলাপ হলো। লোকটা আমাকে খুব যত্নের সাথে বোঝালো আগামি ২৮ বছরে কোথায় কী হবে। বিশ্বের কোন জায়গা কেমন থাকবে। এটাও বললো ভারত একমাত্র জায়গা হবে যেখানে খাবারের সঙ্কটে লোক মরে সাফ হবে না। ঠিক কখন ডেমোক্রেট খানকিরা (এর থেকেও কিছু বাজে বিশেষণ সে ব্যবহার করলো, বন্দুক নিয়ে প্রথমে এ কাদের শিকার করবে তা আমার বোঝা হয়ে গেল) তাদের প্রকৃত চেহারা দেখানো শুরু করবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। (হানিফ সঙ্কেত)
তারপর সে বিদায় নিলো অবশেষে।

আমি বললাম, “আপনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান একজন মানুষ, স্যার।”
লোকটা খুশি হয়ে বললো, “তোমার মতো ছেলে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই ওক পোলাপান। দিনটি চমৎকার কাটাও।”
আমি বললাম, “আমি বাড়ি ফিরেই পানি জমানো শুরু করবো। চিন্তার কোন কারণ নেই।”

বাড়ি ফেরার সময় চিন্তা করছিলাম, আমাদের জেনারেশনের সবার উচিত টেক্সাসে এসে কয়েক মাস কাটানো। রিপাবলিকান হেভি যে কোন আমেরিকান স্টেটে তাদের কিছু সময় কাটিয়ে যাওয়া উচিত অন্তত। তাহলেই বুঝতে পারবে ঈমানী জোসে তারা যা যা ভাবে সবই কেমন বুলশিট। এবং ঠিক একইভাবে চিন্তা করে কীভাবে গোটা বিশ্বের নিম্নোক্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের লোকজন
— ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান/মুসলিম/হিন্দু/যে কোন ধর্ম
— কনজারভেটিভ
— বিজ্ঞান বলে কিছু নাই, সব পশ্চিমাদের/ডেমোক্রেটিক ষড়যন্ত্র
— মেয়েদের কিংবা সমকামীদের অধিকার দেবার তেমন কিছু নাই

আপনারা অক্ষরে অক্ষরে একইরকম চিন্তা করেন। প্লট সবার সেইম। শুধু কেউ বলে আল্লাহ, কেউ বলে গড। কেউ গর্বিত মুসলিম। কেউ গর্বিত খ্রিস্টান। কেউ গর্বিত হিন্দু।

অথবা, এই আমেরিকান লোকটিকে আমি যদি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে পারতাম, তবেও দারুণ হতো।
নিমেষেই নিজের বলদামি ধরা পড়তো তার চোখে। ঠিক যেমন ধরা পড়তো আপনাদের বলদামি আপনাদের চোখে।
দুনিয়া বিচিত্র এবং মজার।

বাংলাদেশে বেড়ে ওঠায় আমি অনেকবারই কৃতজ্ঞ বোধ করেছি। টেক্সাসের ছাগ*লদের সাথে যতবার কথাবার্তা হয়েছে আমাকে তেমন কিছুই করতে হয়নি, তিনটি বাক্য শোনার আগেই আমি স্বজাতিদের চিনতে পেরেছি। কারণ চায়ের দোকানে, রাস্তায়, বাসের পাশের সিটে আমি এমন স্বদেশী ছা*গলের সাথে অনেকবার বিশ মিনিট, আধঘণ্টা, এক ঘটণা আলাপ করেছি। প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাদের কথা শুনেছি।

এই আমেরিকানের কপিক্যাট আলাপই তারা করেছে। ফ্রেজগুলো বদলে গেছে খাদ্যসঙ্কট>ইমাম মাহদি, খ্রিস্টান>মুসলিম, ওক>নাস্তিক, গড>আল্লাহ, ডেমোক্র্যাট>আওয়ামীলীগ, যুদ্ধ>গাজওয়ায়ে হিন্দ প্রভৃতিতে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে মালিবাগের মোড়ের ধর্মপ্রাণ মুসলিম আর টেক্সাসের ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান কিছু কিছু শব্দ একেবারে হুবহু ব্যবহার করেছে। এরা প্রত্যেকেই নিজেদের ‘রিসার্চ’ করেছে। অ্যাপারেন্টলি, মূর্খতার নিজস্ব ভাষা আছে।

আপনি ভাবেন, আপনি স্পেশাল? আপনি সিরাতুল মুসতাকিমে আছেন?
আপনি আছেন বালের ওপর।
আমি কেবল আশা করি, এই জেনারেশনের পোলাপান অন্তত বিষয়টা নিজে নিজে দেখতে পাবে।

নভেম্বর ২৫, ২০২২

 

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *