অধ্যায় ০২. ০২. ⌛ কনফার্মেশন বায়াস
অধ্যায় ০১ • অধ্যায় ০২ • অধ্যায় ০২/০১
দ্বিতীয় অধ্যায়ের নামই “যা জানতেন ভুলে যান,” কিন্তু কিভাবে ভুলবেন?
কোনও কিছু মনে রাখার চেয়ে ভুলে যাওয়া কঠিন কাজ। তবে এই কঠিন কাজটা একজন সম্মোহনমুক্ত মানুষকে করতেই হবে। এটা ছাড়া সম্মোহন এড়ানো সম্ভব নয়। তারপরও কথা থাকে, আমরা ঠিক কি ভুলতে চাই? যা জানতাম সব ভুলে যেতে হবে অর্থ এই নয় যে আমাদের বাবা-মার নাম ভুলে যেতে বলা হচ্ছে। স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে আমরা কি কি ভুলতে চাই।
আমরা ভুলতে চাই যে কোনও জ্ঞান, যা আমরা কোনও ধরণের পরিশ্রম ছাড়া অর্জন করেছি। কারণ, সবাই করে, কিংবা প্রচলিত অর্থে যা যা সঠিক তার কোনটাই সঠিক না হতে পারে। আমরা শিশুকাল থেকে এমনটা দেখে দেখে বড় হই বলে আমাদের মনে হতে পারে এটাই সঠিক। যেমন, আজ যদি আমি বাংলাদেশে না জন্মে কোনও সভ্যতা বিবর্জিত গোত্রে জন্মাতাম, তবে তাদের আচরণই আমার কাছে ঠিক মনে হতো।
তখন আমিও নানা রকম মূর্তিকে সেজদা করতাম। গায়ের জোরে কোনও মেয়ে ধরে এনে ধর্ষণ করতাম। রাগের মাথায় হত্যা করতাম। এসবের কোনটাকেই আমার কাছে ভ্রান্ত মনে হতো না। কারণ, আমার সমাজ এমন। ছোট থেকে দেখে আসছি সবাই এটা করে। এসব কাজে কোনও অন্যায় নেই।
আপনি হয়তো তেড়ে এসে বলবেন, সবগুলোই অন্যায়। তবে ব্যাপারটা কি জানেন? আপনার সমাজব্যবস্থার কারণে আপনার কাছে ঐ জঙলীর জীবনযাত্রা অন্যায় মনে হচ্ছে। এটা কিন্তু খুব ঠাণ্ডা মাথায় বুঝতে হবে আপনাকে। কিন্তু ঐ জঙলী বুঝতে পারছে না, অন্যায়টা কি করলো!
ঠিক তেমনভাবেই আজ আপনি আপনার সমাজে ছোট থেকে বড় হওয়ার কারণে শিখেছেন অনেকগুলো অন্যায়কর্ম। অনেকগুলো। অথচ আপনার কাছে এগুলো খারাপ কিছু নয়। খুবই স্বাভাবিক। ঠিক যেমন ঐ জঙলীর কাছে ওসবই স্বাভাবিক। যেমন?
বাংলাদেশি মেজরিটি মনে করেন বিশ্বের সব খারাপ কিছুর পেছনে আছে ইহুদি-খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্র। এটা একটা ভুল ধারণা। আপনার সমাজ ব্যবস্থা আপনাকে এই ভুল ইঞ্জেকশন দিয়ে রেখেছে, ঐ জঙলীর সমাজ যেমন তাকে দিয়ে রেখেছিলো। সে কারণে আপনি এটাকে ধ্রুব সত্য মনে করেন। কখনও চিন্তা করতে পারেননি। (নিজের সম্প্রদায়ের পক্ষপাত করা দৃষ্টিভঙ্গি চিন্তা নয়, বরং আপনার ভুল ধারণার পক্ষে প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা।)
যেমন, আপনি হয়তো মনে করেন সংসারে মেয়েরা থাকবে সাবমিসিভ। মেয়েমানুষের মতামতের তোয়াক্কা অনেকেই করেন না।
যেমন, আপনি হয়তো মনে করেন রাস্তায় মেয়েদের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকার মধ্যে তেমন কোনও অপরাধ নেই।
যেমন, আপনি হয়তো মনে করেন হিন্দুরা খুবই খারাপ জাতি। আপনি হয়তো মনে করেন ভারত সব সময় বাংলাদেশের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। হয়তো মনে করেন বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর আর কোনও চিন্তা নেই, কেবল ইসলামের ক্ষতি করার চিন্তা।
এসবই তেলাপোকার সমান মস্তিষ্ক ধারণ করার পরিচয়। কারণ, এধরণের অসংখ্য ভুল ধারণা বাংলাদেশি হিসেবে আপনার মাথায় সমাজ ইঞ্জেক্ট করেছে। আর আপনিও বিনা চিন্তায় তা গ্রহণ করেছেন। বড় হয়ে সার্চ করে দেখেছেন গুগলে। কিভাবে করেছেন সার্চ? ঠিক যা আপনার মাথায় আছে, ভুলটা, ওটা দিয়ে। কাজেই আপনি সার্চ করেছেন ওসব কি-ওয়ার্ড দিয়ে। এতে করে আপনি নিজের ধারণার পক্ষে প্রমাণ খুঁজেছেন, সত্য নয়। আর তা আপনি ভুড়ি ভুড়ি পাবেন। এখানে আসবে কনফার্মেসশন বায়াসের গল্প।
কনফার্মেশন বায়াস
ধরা যাক, আপনার সাথে আমার তর্ক লেগে গেল।
আপনার মতামত, কলা খারাপ ফল। খেলে ক্ষতি। না খাওয়াই ভালো।
আমার কথা হলো, কলা ভালো ফল। খাওয়া ভালো।
আমি আপনার, আপনি আমার কলার চেপে ধরলেন। গরম চোখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছি। এর মধ্যে আপনি বললেন, “যদি প্রমাণ করে দিতে পারি?”
কলার আমরা ছেড়ে দিলাম। আপনি কিবোর্ড নিয়ে গুগলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ইন্টারনেটে সবকিছু বিশ্বাস করা যাবে না। তাই আপনি করলেন কি, গবেষণাপত্র ঘাঁটলে। গুগল স্কলারে এমন অনেক জার্নাল পেপার আছে। এরা সবই গবেষণার ফল। হেঁজিপেজি ব্লগ পোস্ট নয়। এইসব গবেষণা করেছেন মাস্টার্সের ছাত্র, পিএইচডি করা ডক্টররা। বৈজ্ঞানিক রেফারেন্স আছে, নিরেট সব তথ্য আছে। অকাট্য প্রমাণ!
আপনি এমন পাঁচটা জার্নাল পেপার নিয়ে আমার মুখে ছুঁড়ে মারলেন। বললেন, “দ্যাখ ব্যাটা, প্রমাণিত হয়ে গেল, কলা খারাপ ফল। পাঁচ জার্নালেই এমন কিছু খারাপ দিক বলা হয়েছে।”
তাতে করে কি কলা খারাপ ফল হয়ে গেল? আমি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না। কাজেই এবার আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম কিবোর্ড নিয়ে। গুগল স্কলার ঘেঁটে পাঁচটা জার্নাল আমিও পেলাম। এগুলো থেকে প্রমাণিত হচ্ছে, কলা খুবই ভালো একটা ফল।
এবার আমি আপনার মুখে ওটা ছুঁড়ে মারলাম। বললাম, “খুব যে নেদাচ্ছিলি হারামজাদা, দ্যাখ, আমার কথাই সত্য। কলা ভালো ফল।”
আমি এবং আপনি এখানে একই ভুল করলাম। এটাকে বলা হয় কনফার্মেশন বায়াস।
ভুল কি করে হলো? আমরা তো পাক্কা তথ্য এনেছি! তাই ভাবছেন?
বলুন তো আপনি কি সার্চ করেছিলেন? Why the banana is a harful fruit?
ব্যাস, পেয়ে গেছেন আপনার মতবাদের ওপর ফলাফল।
বলুন তো আমি কি সার্চ করেছিলাম? Why the bananan is a useful fruit?
ব্যাস, পেয়ে গেলাম আমার মতবাদের ওপর ফলাফল।
অর্থাৎ, আমরা সত্যটা খুঁজতে যাইনি। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যা ভাবছি, তাই সঠিক। কাজেই আমরা আমাদের “ধরে নেওয়া সঠিক” ধারণার পক্ষে তথ্য খুঁজেছি এবং পেয়েছি। অর্থাৎ আমরা পুরো দৃশ্যটার মধ্যে যেটুকু আমার পক্ষে যায় তাই বেছে নিয়েছি। বাকি সবটাকে বাতিল করে দেওয়া যেন আমার জন্য সহজ হয় তাই।
এটা সত্য নয়। এটা স্রেফ কনফার্মেশন বায়াস।
ব্যবহারিক উদাহরণ
বাংলাদেশিদের বড় একটা অংশ এই কনফার্মেশন বায়াসে আক্রান্ত। আপনিও হয়তো এর বাইরে নন। যখন আপনি ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখতে যান “ইহুদি-জায়োনিস্টরা ইসলামের বিরুদ্ধে কি কি প্লট করছে” আপনি তেমন কন্টেন্টই পাবেন। আপনি ধরেই নিয়েছেন জাতিটা খারাপ, ধান্ধাই এদের ইসলামের ক্ষতি করা। কাজেই সার্চ দিচ্ছেন তা প্রমাণ করার জন্য। প্রচুর ‘প্রমাণ’ মিলবে এতে করে, তবে তা আসলে কোনও গুরুত্ব রাখে না।
হেল, এভাবে কনফার্মেশন বায়াসে থেকে সার্চ করলে আপনি “সাদ্দাম হোসেন এখনোও জীবিত,” “হিটলার ১৯৪৫ এ মারা যায়নি,” “আইএস ইহুদিরা বানিয়েছে” এসবের পক্ষেও প্রচুর প্রমাণ পাবেন। প্রচুর। তাই বলে এগুলো সত্য, এমন নয়।
এখন যদি আপনি উল্টোটা সার্চ করেন, তবে দেখবেন ইহুদিরা আসলে মানবজাতির কোটি কোটি উপকারও করছে। আপনি তুড়ি মেরে ওদের উড়িয়ে দিয়ে বলবেন, “ওরাই তো মিডিয়া কন্ট্রোল করে। এসবই ওরা প্রচার করবে। নিজেদের খারাপ কাজগুলো তো আর বলবে না।”
এই কথাটা আপনার মুখ থেকে বের হলো, অর্থাৎ আপনি ধরেই রেখেছেন “ওরা খারাপ,” আর সেই বক্তব্যের পক্ষে একটার পর একটা প্রমাণ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আপনি কনফার্মেশন বায়াসে আক্রান্ত।
সত্য আপনি খুঁজছেন না। আপনি স্রেফ নিজের ধারণা “অমুক খারাপ” সেটাকে প্রমাণ করার জন্য সত্য বা মিথ্যা তথ্য হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।
প্রতিকারের উপায়
কনফার্মেশন বায়াস ভয়াবহ জিনিস। এই লেখাটা পড়া শেষ হলেই যে আপনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসবেন সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবুও জন্মের পর থেকে সমাজ আপনাকে যা শিখিয়েছে, তার পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করবেন। ইন্টারনেট থেকে, ধর্মগ্রন্থ থেকে, পীরের বাণী থেকে আপনি প্রমাণ টোকানোর চেষ্টা করবেন যে আপনার ‘ধারণা’ই সঠিক। কনফার্মেশন বায়াস থেকে বেরিয়ে আসা এত সহজ কোনও কর্ম নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমার পাঁচ বছরের বেশি লেগেছে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে। সমাজের ভুল্ভাল বকার দৌরাত্ম্যে জীবনের পুরোটা সময়ই অন্ধকারে চলে যায়নি সেজন্য অবশ্য শুকরিয়া।
কনফার্মেশন বায়াস থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য আপনাকে পরিচিত হতে হবে নতুন এক ধারণার সাথে। আমি একে ডাকি ‘চিন্তার পরম অবস্থান।’ এ বিষয়ে পরবর্তী পরিচ্ছদে আরও আলোচনা হবে।
পরের অধ্যায় | অধ্যায় ০২. ০৩. চিন্তার পরম অবস্থান
Leave a Reply