KP Imon

Words Crafted

আমেরিকান বইপড়ুয়ারা

জেলিকসের বাইরে মাঝে মাঝে একটা রোলস রয়েস দাঁড়িয়ে থাকে। তিন গোয়েন্দা পড়ার সুবাদে আমাদের জানা আছে এই জিনিস কিশোর পাশা জিতেছিল দানা গুণে। আমার এক ইরানী বন্ধু একবার রোলস রয়েস দেখে বলেছিল, “ভাই, এটার সামনে একটা ছবি তুলে দিবা? এর সামনে ছবি না তুললে আমার জীবনই বৃথা।”

তুলে দিয়েছিলাম।

কালের পরিক্রমায় রোলস রয়েসের মালিক জন এখন আমার খুব কাছের বন্ধু। বয়েস তার ৬৫। জেলিকস বারে আমি ড্রিংক করেছি অন্তত ৪০০০ ইউএস ডলারের সমমূল্যে। কিন্তু আমার পকেট থেকে গেছে ২০০ ডলারও না। কারণ আমার একজন অসমবয়েসী বন্ধুর আছে দুটো রোলস রয়েস, আরেকজন হলো রিজুল কালা। নামে কালা হলেও ছেলে ধলা। এমপ্যাথ। তার সামনে মানিব্যাগ বের করলে পারলে ধরে মারে। ওদিকে জোড়া রোলস রয়েসের মালিকও রীতিমতো অফেন্ডেড হয়ে যায় কেউ বিল দেবার চেষ্টা করলে। এমন নয় যে আমি চেয়ে নিচ্ছি, কিছু বোঝার আগেই জিনিস হাজির। কী একটা বিপদ।

জেলিকস বারে এটা হচ্ছে আমার “দ্য বয়েজ” সার্কেল। মজার ব্যাপার হলো জন এতো লোককে এখানে চেনে, বলার মতো না। তবে সবাইকে ও টেবিলে ডাকে না। আমাকে পেলে কোথাও যেতে দেবে না। কারণও আছে অবশ্য।

কঠিন ঠাণ্ডার এক রাত ছিল ওটা, যেদিন জোড়া রোলস রয়েসের মালিক জনের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম শালার পুত এক ভ্যাগাবন্ড। বোকাচোদার মতো জামাকাপড় পরে বসে ছিল এক কোণে । আমার সাথে দেখা হয়েছিল স্থানীয় ইয়ে-মানে-নাম-বলা-যাবে-না সংস্থার একজন অপারেটিভের সাথে। চৌকস সেই অপারেটিভ সাত ঘাটের জল ঘোলা করে আসা মানুষ। আমরা প্রায়শঃই বিশ্বরাজনীতি নিয়ে আলাপ করি। একদিন দেখলাম জনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আমার। পরিচিত হতে আমার আপত্তি নেই, হয়েছিলাম।

জন বোধহয় ট্রিলিয়নিয়ার। এই স্যান মার্কোসে কী করে জানি না। ওর এতোগুলো গাড়ি যে গোটা স্যান মার্কোসকে বিক্রি করে দিলেও তার দাম উঠবে না। আমি অতোকিছু জানতাম না তখন। সে রাতে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে অপারেটিভের মাধ্যমে। সে ভেগে যেতে চাইলো রাত দশটায়, অথচ ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে নয়টা। তারপর আমার সাথে পরিচয় হয়ে গেল বেচারা টেক্সান ‘শেখ’-এর। আর যাবে কোথায়।
দশটা পেরিয়ে এগারোটা, তারপর বারোটা।

অপারেটিভ বললো, “ভাই, যেতে হবে। কাল কাজ আছে।”

ও যখন বলে কাজ আছে, আমাদের কারো এত বড় বিচি নেই যে কাজটা কী জানতে চাইবো। হি ইজ আমেরিকান গভর্নমেন্ট হিমসেলফ। মাইক্রফট হোমসের মতো। আমরা জানতে চাইলাম না। কিন্তু জন বললো, “আমি আরেকটু থাকি। কেপির সাথে আরেকটু আলাপ করে যাই। ব্যাটা ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার।”

সেই রাতে যখন প্রায় দেড়টা বাজে, আমাকে বললো, “ভাই, তুমি বারে গেলে কি আমার জন্য একটা শাইনার বক আনতে পারবা?”

তারপর মানিব্যাগ বের করতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
আমার তো বাঙালি হৃদয়। আমি ওকে চিনিও না। ভেবেছি কোন না কোন চুদির ভাই। হবে হয়তো হোমলেস কোন বোকাচোদা। কাজেই হা হা করে বললাম, “আরে ভাই, তোমাকে টাকা দিতে হবে না। আমি তোমার ড্রিংক নিয়ে আসছি।”

ঐ মুহূর্তে আমরা এতো দারুণ আলাপ করছিলাম মুভি আর লিটারেচার নিয়ে, যে বলার মতো না। আড্ডা যদি হোমলেসের সাথে হয় তো হলো, এটা মিস করা যাবে না। অথচ আমার ব্যাংকে তখন ১,৫০০ ডলারের ঋণ। ক্রেডিট। ফকিরেরও অধম। তাও আমি ওকে বিয়ার কিনে দেবো। নিতানত অপারগ না হলে একটা মানুষ কিছু চেলে তা দেব, এটাই আমার বাঙালি শিক্ষা।

দিলাম।
ও বললো, “ভাই, তুমি তো রেকর্ড করে ফেললা।”
আমি বললাম, “আরে ভাই, তোমাকে অফেন্ড করলাম নাকি, বাড়া? এটা আমার ধান্ধা ছিল না।”
জন বললো, “আমাকে কেউ কখনো ড্রিংক কিনে খাওয়ানোর সু্যোগ পায়নি। তোমার কাছে তো ঋণী হয়ে গেলাম।”
আমি পুরো বোকচোদ হয়ে গেছি। এ দেখি হেঁজিপেঁজি লোক নয়। বললাম, “আরে ভাই, এটা স্রেফ একটা শাইনার বক। এমন কিছুই না।”

পরের দিন দেখি ও দুটো রোলস রয়েসের মালিক।
ট্রিলিয়নিয়ার গাই। মলাট দেখে বই বিচার না করার শিক্ষা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হল। আমাকে বারের আশেপাশে দেখলে যদি ধরে নিয়ে এসে নিজের পাশে না বসিয়েছে তো মদ-ই হজম হবে না তার।

যাকেই দেখবে তাকে ডেকে নিয়ে এসে বলবে, “হি ইজ ফ্রম ব্যাংলা-ফাকিং-ড্যাশ! সেরা মাল। কঠিন মাল, ভাই।”

এক রাতে ৬ ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে কেউ আমাকে এত পছন্দ করে ফেলতে পারে তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। মাঝে মাঝে মন খুব ভালো হয়ে যায় বাংলাদেশের নামে সে এত ভালো ভালো কথা লোককে বলে তা দেখে।

মাঝে মাঝে চোখে পানি চলে আসে।
নিজেকে বলি, “চুদির ভাই, তুই না জাতীয়বাদে বিশ্বাস করিস না। ফোঁত ফোঁত করবি না। একেবারে ফোঁত ফোঁত ফোঁত করবি না।”

কিন্তু খুব একটা সুবিধে করা যায় না।

২.
আজকে বন্ধু রিজুল আমাকে পাছা থেকে গলা পর্যন্ত মদ খাইয়ে দিয়েছে। একটা পয়সাও খরচ করা গেল না। দিতে চাইলেও নেবে না। বললো, “বিজনেস মিটিং তো। পাঁচ বছর পর আমরা এই জেলিকস-ই কিনে নেবো। তখন সব টাকা উঠে আসবে।”

রিজুলের সাথে আমার রোজকার আড্ডায় একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আমরা একটা বিজনেস প্ল্যান করে ফেলেছি। ধান্ধা, পয়ত্রিশ বছরের মধ্যে নিজেদের কোম্পানি খুলে ফেলতে হবে। এতো শুয়োর চোদা যাবে না। অন্যের কোম্পানিতে চাকরি করে আর যা-ই হওয়া যাক, বড়লোক হওয়া যায় না। বাড়ি-টাড়ি কেনার ধৈর্য বা প্রোফাইল আমাদের নাই। কাজেই আমরা সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে সেফ কিন্তু কার্যকর পথটা বেছে নিলাম। কুত্তার মতো পড়া লাগবে বটে, তবে একটা লাইসেন্স পাশ করতে পারলেই কেল্লা ফতে। নিজেদের বিজনেস খুলে আমেরিকার পাছা মেরে দেবো। এই হলো ধান্ধা।

সেই থেকে সে আমাকে একটা পয়সাও খরচ করতে দেবে না। অবশ্য জানে আমার কী অবস্থা। দেড় হাজার ডলারের ঋণ এতো সোজা ব্যাপার নয়। আমি তো বাইরে কোথাও বসতেই চাই না আর, কিন্তু আমার সাথে আলাপের সুযোগ সে ছাড়বে না। কাজেই বারে না এলে মাথায় বন্দুক ধরে আনবে।

আজকেও ম্যাটেরিয়ালস নিয়ে আলাপ করতে হলো। আগামি বছর এই সময়ের মধ্যে আমার পরীক্ষায় বসতে হবে। পাশ করলেই এলাকা প্রকম্পিত করে ব্যবসা খুলে ফেলবো আমরা। তারপর ঘণ্টায় ৯০ ডলার। এ কেবল শুরু, ব্যবসা বড় হলে মাসে হান্ড্রেড থাউজ্যান্ড হয়ে যাবে নির্ঘাত। তবে সেটা হতে হতে আরও ৭ বছর লাগবে।

আমরা দুইজনই ঘাউড়া। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে অভ্যস্ত, তবে শর্ট টার্মে আমাদের দেখলে যে কেউ মনে করবে ভ্যাগাবন্ড। ঠিক ঐ জনের মতো। একই সাথে এটাও নির্ঘাত যে কোন কোম্পানিতে চাকরি করে কখনোই ৭ বছরের ব্যবধানে প্রতি মাসে হান্ড্রেড থাউজ্যান্ড কামানো যাবে না। জিন্দেগিতেও না।

রিজুল বিদায় হলো বটে, তারপর বাসায় ফিরে এলাম। বাজে মাত্র সাড়ে সাতটা। এপাশ ওপাশ করে বুঝলাম ঘুমের ঘ-ও আসবে না। ওদিকে এই শহরে যত মেয়ে আমার প্রতি আগ্রহী আছে সবাইকে ভূত দেখানো হয়েছে। এরা বলে ঘোস্টিং। কাজেই কাউকে নক-টক দেয়ার ঝামেলায় না গিয়ে কাঁধে ল্যাপটপটা নিয়ে ফিরে এলাম জেলিকসে। একটা বিয়ার নিয়ে বসে পরের উপন্যাসের পরের চ্যাপ্টারটা লিখে ফেলবো।

মন মেজাজ আজ বেশ ভালো।
প্রফেসরের সাথে গ্রুপ মিটিংয়ে তিনি বলেছেন, “আরেব্বাস, এটা তো একটা ব্রেকথ্রু!”

ওটা আসলে বালের ব্রেক-থ্রু। তবে প্রফেসর জানেন কচুটা। আমি জানি রিসার্চ কই যাচ্ছে। সামনে কী কী ঝামেলা হবে অক্ষরে অক্ষরে জানি আমি। আমার বোকাচোদা প্রফেসর তার বালও জানে না। তবে আজকের জন্য এটা একটা উইন।

কাজেই কাঁধে ফুলি চার্জড ল্যাপটপ নিয়ে বারে ফিরে আসলাম। গল্প লেখা যাক।

৩.
বেশিদূর যাওয়ার কপাল আমার ছিল না। কেউ একজন ডাকলো। তাকিয়ে দেখলাম জন নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে একটা বাঁদরের মতো লাফাচ্ছে। ডাকছে, “এই কেপি। আরে কেপি, এইদিকে!”

কী বিপদ। এগিয়ে গিয়ে ওর সাথে কোলাকুলি করতেই হলো। ট্রিলিয়নিয়ার মানুষ। উপেক্ষা করার কোন উপায় নেই। তাছাড়া লোকটাকে আমার পছন্দ। টেক্সাসের পোলাপানের মতো ছাগল না। বয়স হয়েছে, তার সাথে মুভি, বই, মনস্তাত্ত্বিক আলাপ করা যায়। এসবে ছোকরাদের মধ্যে খুব বেশি মানুষের আগ্রহ নেই। মেয়ে কিছু আমার আশেপাশে থাকলেও কারো সাথে ঝুলে পড়ি না একই কারণে। আমি বরং রিজুল বা জনের সাথে দশ ঘণ্টা আড্ডা দেব, কিন্তু কোন বোকাচোদা মেয়ের সাথে আমি এক মিনিটও কথা বলবো না। যতই সুন্দর হোক আর হট।

কেউ আমাকে বোর করলেই আমি “বিদায়। খোদা হাফেজ। আলবিদা। গুড নাইট।” বলে উধাও হয়ে যাই।

জন এক ইন্টারেস্টিং চরিত্র। ডাকলো যখন, গেলাম। ওর সামনে বসে আছে দুই মেয়ে। ট্রিলিয়নিয়ারের সামনে মেয়ে থাকবে না তো জোকারের সামনে থাকবে? ওদের সাথে হাত মেলালাম।

জন বললো, “কোন চিপাচুপায় ভাইগা যেয়ো না। বিয়ারটা নিয়ে এইখানে ফিরে আসো। আলাপ করা দরকার।”

এলাম। ওদিকে জনের এক বন্ধু এসে হাজির। এই নতুন লোকটার বয়স ৬২ বছর। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো টেক্সান শেখ। যথারীতি প্রচণ্ড উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে বাকিদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো, “হি ইজ ফ্রম ব্যাংলা-ফাকিং-ড্যাশ! সেরা মাল। কঠিন মাল, ভাই।”

আমি ভাবলাম, শালার এই কথাটা শুনতে এত ভালো লাগে কেন! কেন লাগে? বাংলাদেশ কিংবা ভারত, আমেরিকা কিংবা কানাডা – সব বর্ডারকেই তো আমি অস্বীকার করি। কেন লাগবে!

তার থেকেও ভয়ানক কথা, কোন দুঃখে এই এতগুলো মানুষ আমাকে এমন করে ভালোবাসবে? কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপ ছাড়া আর কী দিয়েছি আমি তাদের? কিচ্ছু না। অথচ আমাকে ফিরে আসতে হলো একটা বিয়ার নিয়ে। আমার খুব ভালো মতো জানা আছে বন্দুক তাক করলেও রোলস রয়েসের মালিক আমাদের কাউকে আর কিছু আনতে দেবে না। ইনার সার্কেলে যে ঢুকেছে তার বিল বারের কেউ নিলে তার গর্দান যাবে।

কিন্তু তার বন্ধুর সাথে আলাপ হওয়ার সাথে সাথে সে বললো, “বাংলাদেশ? তোমরা পাকিস্তানের অংশ ছিলে না?”
আমি কোনরকম আমেরিকান ভব্যতার ধার না ধেরে বললাম, “তা ছিলাম। তবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পুটকি মেরে বেরিয়ে গেছি ভাই। লম্বা ইতিহাস।”

জনের বন্ধুটি দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বললো, “তা জানি। তুমি নাকি বইপত্র লেখ? কী ধরণের?”

দেখলাম আসলেই জানে, ভূগোল নিয়ে তার ধারণা আমার থেকে বেশি টনটনে। কথা এখান থেকে উঠে আসলো উপন্যাস লেখা থেকে শুরু করে আমার আবিষ্কৃত যাবতীয় লিটারেরি টুলের ব্যাপারে। আমার বইগুলো ৪০০ পৃষ্ঠা বা ৬০০ পৃষ্ঠার বেশি হয় শুনে বললো দুইশ পৃষ্ঠার বই লিখতে আমেরিকানদের জন্য। বড় বই নাকি এই পোলাপানের মনোযোগ আর রাখতে পারে না।

একটা মানুষ ১০০০ পৃষ্ঠার বই আর পড়ে না এখন প্রসঙ্গে বললাম, “আমি জানি, পড়ার কথা নয়। তাই আমি একটা নতুন লিটারেরি টুল ব্যবহার করি। এই জেন জি কিংবা ফেসবুক-টিকটকের যুগে অ্যাটেনশন স্প্যান যখন ছোট হয়ে এসেছে, আমাকে কিছু করতে হতো। আমার টুল বেশ কাজ করেছে বটে, এখন এই জেন জি আমার ১০০০ পৃষ্ঠার জাদুঘর সিরিজ পড়ে ফেলেছে।”

তারপর তাকে খুব ভালো মতো বুঝিয়ে বললাম এই টুলটার ব্যাপারে। এর সর্বোচ্চ প্রচার করা যাবে না বলে স্ট্যাটাসে অবশ্যই লিখবো না।

কথা প্রসঙ্গে চলে এলো জাদুঘরের ব্যাপারটা। আমাকে জন প্রশ্ন করলো, “বইটার নাম কী?”
খাস বাংলায় বললাম, “‘জাদুঘর পাতা আছে এই এখানে’। দ্বিতীয় পর্ব হচ্ছে ‘এইখানে জাদুঘর পাতা আমাদের’।”
জনের বন্ধু জানতে চায়, “ইংরেজি করলে কী হবে?”

বললাম, “এটার ইংরেজি করা সহজ নয় এতো। এটা একটা নার্সারি রাইম থেকে নেয়া, প্যারোডি-”

শওকত আল বাশারের সাধারণ ছাত্র থেকে ভয়ঙ্কর এক চরিত্রে পরিণত হওয়ার গল্পটা বললাম তখনই। মনোযোগ দিয়ে শুনলো ওরা, আঁতকে উঠলো কখনো, কখনো চমৎকৃত হলো।

আমার মনে হলো, বইপত্র লেখা বাদ দিয়ে স্টোরিটেলার হয়ে গেলেই হতো। আমেরিকানদের সাথে প্রায় দুই বছর মিশে যাচ্ছি। স্রেফ আমেরিকায়-থাকা-মার্কা মেশা না, প্রতিদিনই ক্যাজুয়াল আর সোশাল এলাকায় দেখা হচ্ছে কয়েক ঘণ্টার জন্য। ক্লাসরুম আর ল্যাবের বাইরেও আমি অনেক কিছু করে থাকি। ওদের সত্যিকারের আঁতকে ওঠা আর স্রেফ উৎসাহ দিতে হ্যাঁ-হু করার পার্থক্য আমি বুঝি।

রাত তখন বাজে নয়টা, তবে আমি জানতাম, জেলিকস থেকে আজ আর রাত ২ টার আগে কেউ উঠতে দেবে না আমাকে। উঁহু, সম্ভবই না।

জনের বন্ধুর কাছে জানলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেনে। তার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আরেকজন বিখ্যাত ক্যারিবিয়ান লেখক। গীতাঞ্জলি কিনে রেখেছে। নামটা বললো অবশ্য ‘গিতালি?’

ঠিক করে দিলাম, “গীতাঞ্জলি। তবে কাছাকাছি গেছ। জন কিটস অনুবাদে সহায়তা করেছিলেন।”

সে চেনে সত্যজিত রায়কেও। ফেলুদার ব্যাপারে জানে। ফেলুদাকে মনে করতে পারছিল, কিন্তু সত্যজিতকে না। গুগল করে দেখাতেই হাততালি দিয়ে উঠলো। অরুন্ধতী রায়কেও চেয়ে সে। আমাকে একটা কাগজে তার নাম লিখে দেখানোর চেষ্টা করছিল। গুগল করে বের করে দিলাম। দ্য গড অফ স্মল থিংস।

আমি বললাম, “রবী ঠাকুর আর সত্যজিত রায় দু’জনেই বাঙালি ছিলেন। একজন জিতেছিলেন নোবেল প্রাইজ, আরেকজন অস্কার। বাঙালির ক্যালিবার ওটাই। তবে গত কয়েক দশকে অলসতার দরুণ আমরা বাইরের দেশে তেমন একটা আসতে পারিনি। এটা সমাধান করতেই আমি আমেরিকার মাটিতে পা রেখেছি।”

জনের বন্ধুটি বিদ্যাবাগীস বটে। নোবেল উইনার ওলগা তোকারচুকের একটা বই আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। বইটা পড়তেই আসলে বারে এসছিল সে, কিন্তু আমাদের পেয়ে আড্ডায় ঢুকে গেছে। বললো, “ভাই আমি সপ্তাহে পাঁচটা করে বই পড়ি। আমার এই রুটিনের কোন ব্যত্যয় হয়নি গত ৪০ বছরে।”

জানলাম। শিখলাম। ওর কাছে আরও পেলাম তাহির শাহের লেখা কিং সলোমন মাইনস। এই তাহির শাহের বাবা আবার বিখ্যাত ইরানি সুফি লেখক। তারপর ও দিলো আমাকে উত্তর আমেরিকার লেখক রবার্তো বোলানোর খবর। সবচেয়ে বিখ্যাত লেখা তার “দ্য স্যাভেজ ডিটেকটিভস”, তবে রেকমেন্ড করলো “২৬৬৬” বইটা। ওটা নাকি তার খোপরিই উড়িয়ে দিয়েছে! আরও বললো, “ভাই তোমার বইগুলোর কাহিনী শুনে আমার মনে হলো এর থেকে রিলেটেবল কাউকে পাবে না।”

রবার্তো বোলানোর ব্যাপারে এরপর বললো ত্রিশ মিনিট। আমি যত শুনছি ততো মনে হচ্ছে চিলির এই লেখক আমার কার্বন কপি। আর কিছু হতেই পারে না। এর মধ্যে আমাদের বের করে দেয়ার সময় হয়ে গেছে। প্রায় দুটো বাজে। দুটোয় এটা বন্ধ হবেই।

জন আমাদের বিদায় দিয়ে রোলস রয়েস ড্রাইভ করে চলে গেল। ওদিকে সেই রাত নয়টা থেকেই স্যামকে দেখতে পাচ্ছি। আমাকে দেখে একবার এগিয়ে এসে কথা বলেও গেছে। কিন্তু মেয়েটাকে পাত্তা দেবার মতো অবস্থায় আমরা কেউ নেই। এখন সাহিত্য নিয়ে কথা হচ্ছে, বয়েজ ব্যান্ড থেকে আমাকে কেউ হাতি দিয়েও তুলতে পারবে না। এই মুহূর্তে আমরা শুধু তাকেই গ্রহণ করবো যার সাহিত্যে দখল যথেষ্ট।

আমরা কথা বললাম ক্যাপোটি থেকে ম্যানসন ফ্যামিলি, কিছু সিরিয়াল কিলার, তা থেকে তারান্তিনো, ইয়ান ফ্লেমিং থেকে রবার্ট লুই স্টিভেনসন নিয়ে, বললাম জোনাথন সুইফট থেকে এরিক মারিয়া রেমার্ক নিয়ে। তারপর এলো বোলানো, এলো তোকারচুক, এলো গ্রেগরি ডেভিড রবার্টস।

গ্রেগরির ওপর আর কথা হতেই পারে না। অস্ট্রেলিয়ান লেখক। মুম্বাই নিয়ে খুঁটিনাটি সব জানেন। “শান্তারাম” নামে এক বই লিখে ফেললেন তিনি। মুম্বাইয়ের মাফিয়া নিয়ে তার থেকে ভালো কেউ জানে না। সে জিনিস নিয়ে নেটফ্লিক্সে নাকি মুভি না ওয়েব সিরিজও যেন চলে এসেছে, তবে সেটা নাকি ‘বাল’। পড়তে হবে বইটা, সেটিই সেরা।

কাহিনী যতই বলে যাচ্ছে জনের বইপড়ুয়া বন্ধু, আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠছে। এক পর্যায়ে মুম্বাই অ্যাটাকে চলে এল ওর আলাপ। এবার আর থাকতে না পেরে গুগল বের করে বললাম, “যে মাফিয়ার গল্প দিচ্ছ, দাউদ ইব্রাহিম এটা। এর লাইফ থেকে ইন্টারপ্রিট করেছে ওর গল্প।” তারপর বের করলাম সঞ্জয় দত্তের পেইজ, “আর এই সুপারহিট ভারতীয় নায়কের এখানে জড়িয়ে যাওয়ার কাহিনী-”

এই কাহিনীটা আমি জেনেছিলাম এক ভারতীয়র কাছ থেকে। ওকে ওটা আমার বলতেই হতো।

এই পর্যায়ে এসে আমাদের সামনে বসে থাকা মেয়ে দুটো বিদায় নিলো। বারে এসে বহু মাতাল দেখেছে, বহু ক্রিপ দেখেছে, আমাদের দুটোর মতো মাদারচোদ দেখেনি – যারা মেয়ে-মদ সব বাদ দিয়ে বই নিয়ে ফটর ফটর করে যাবে পাঁচ-ছয় ঘন্টা।

শুধু ওরা কেন? এক ঘণ্টা পার হয়েছে কি হয়নি, আরেক আপদ এসে হাজির!

কানের কাছে গেট কিপার এসে বললো, “কেপিদা, পায়ে পড়ি, বিদায় হও। বার তো বন্ধ করে দেবো।”
আমি আর জনের বন্ধু হা হা করে উঠলাম, বললাম, “অবশ্যই। এই যে যাচ্ছি।”

গেলাম ঠিকই। খিদেয় মারা যাচ্ছিলাম। রাত বাজে দুইটা পনেরো। বাসায় ঢোকার সময় মনে হলো ট্রিলিয়নিয়ারের বন্ধুটির নাম জানা হলো না।

নামে কী এসে যায়?
এমন বইপড়ুয়া কাউকে পাওয়া গেল এটাই অনেক। নামে কিছু এসে যায় না। নইলে আমার নাম কিশোর পাশা ইমন থেকে বদলে রাখতে পারতাম ভারিক্কী কিছু।

কিন্তু নয়।
নাম যা-ই হোক না কেন, গ্রেট থিংস করলে সেটা নিয়েই সেজদার পর সেজদা পড়ে যাবে।

আর কাজের কাজ কিছু করতে না পারলে নাম হুমায়ূন আহমেদ রেখেও লাভ নেই।

এখানের ৫% লোকও আমার নাম জানে না। কিন্তু ওরা আমাকে ভালোবেসেছে, জায়গা দিয়েছে ইনার সার্কেলে। এভরি সিঙ্গেল ওয়ান অফ দেম। যে কোন বয়েসের, যে কোন লিঙ্গের, যে কোন আগ্রহের লোকের সাথে কথা বলতে পেরেছি কয়েকমিনিট আর তার আমার সাথে ৫ ঘণ্টার আড্ডা জুড়ে দেয়নি এমন হয়নি।

তাই তো!
নামে কী এসে যায়!

** যারা মনে করে আমেরিকান মানেই রিটার্ড, বইপত্র পড়ে না, উচ্ছনে গেছে সব– তাদের জন্য এটা লেখা দরকার ছিল। আমেরিকানদের মধ্যে এমন এমন বইপোকা আছে, আমাদের ঢাকার ২০ জন বইপোকা জোড়া দিলেও তাদের একটার সমান হবে না।

স্মৃতিকথা – আমেরিকা-নামা
রচনা ও ঘটনাপ্রবাহ – ৮ই মার্চ, ২০২৩

জেলিকস

এক বেচারি মেয়েকে লাগানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে ছিল এক লোক। মেয়েটা ত্রিশ মিনিট আগে আমার কাছে এসে একটা সিগারেট চেয়েছে, ওকে বললাম, “যদি পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা করতে পারো, তোমাকে সিগারেট এনে দিচ্ছি।”

সিগারেট আমারও লাগতো। কাজেই আমাকে ওটা আনতে হতোই। এনে দেখি ঐ লোক বেচারির পিছে লেগে আছে। লাগানোর ধান্ধা।

ওকে সিগারেটটা দিয়ে বললাম, “খাও ভাই যতো ইচ্ছে।”
একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “আমার নাম জেনিফার।”
হ্যান্ডশেক করে বললাম, “বন্ধুরা আমাকে কেপি বলে ডাকে। সমস্যা হচ্ছে তোমার নামটা বিপদজনক। আমার এক্সের নামও ছিল জেনিফার।”

ওদিকে লোক তো লেগে আছেই। মেয়ে না লাগিয়ে যাবে না। আমাকে এড়িয়ে ফিসুরফাসুর করে ফেললো। তারপর গেল ড্রিংকস আনতে। আমি বললাম, “আমি খুবই দুঃখিত যদি আমি তোমাদের কাউকে অফেন্ড করে থাকি। আসলে ও কী বললো তা শুনতে পাইনি।”

জেনিফার ফিকফিক করে হেসে বললো, “আরে, ওই ব্যাটা লাগানর ধান্ধায় আছে। আমি ওকে না করলাম। তবে ছাগলটা বুঝলো কি না বুঝলাম না।”

পরের ত্রিশটা মিনিট আমরা থিওলজি আর অরিজিনাল থিংকিং নিয়ে আলাপ করলাম। বিদায় হবার আগে জেনিফার আমার ফোন নাম্বারটা নিলো। স্টকারের মুখটা কালো হয়ে গেল, কারণ মেয়েটা চালাক। জীবনেও নিজের নাম্বার আমাকে বলবে না। বরং আই-ফোনটা বাড়িয়ে দিলো যেন আমি আমার নাম্বার তাকে সেভ করে দিতে পারি আর নিজেকে পাঠাতে পারি একটা মেসেজ।

তারপর বেচারি উঠলো, “অস্টিনে থাকি। ড্রাইভ করতে হবে। যাইগা।”
রাত তখন বাজে দেড়টা। আমি আমার পাছার একটা মাসলও নড়াতাম না ওর এই কথায়। কিন্তু স্টকার লোকটা ঘ্যা ঘ্যা করে বললো, “চলো চলো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই। কী বলো?”

সব আমেরিকান সিটিজেন। আমি এক খানকির ছেলে। বহিরাগত। কাঁধ থেকে ব্যাকপ্যাকটা খসে পড়লো আমার।
আমার সামনে মেয়ে স্টক করা হচ্ছে? বাঙালি চেননি, অ্যাঁ?

মেঘের মতো গলায় বললাম, “জেনি, তোমাকে গাড়িতে পৌঁছে দেব?”

ভীত সন্ত্রস্ত একটা মুখ একবার, তারপর কয়েকবার মাথা নাড়লো। শয়তানটা আমাকে বললো, “তোমার কষ্ট করতে হবে না। আমি ওকে পৌঁছে দিচ্ছি।”

ঘাউড়াটাকে পাত্তা না দিয়ে বললাম, “চলো।”
গাড়ির কাছে এসে ওকে বললাম, “কিছু মনে করো না। আমি এসেছি স্রেফ যেন তোমাকে কোন ক্রিপ গাড়ির সামনে এসে চাপাচাপি করতে না পারে, তাই।”
জেনিফার বললো, “থ্যাংকস।”
আমি হাসলাম। বললাম, “আই উইশ, আমাকে কোন মেয়ে এভাবে অন্য মেয়েদের থেকে বাঁচাতো। বহু গোয়ামারা খেয়েছি ভাই। তোমাদের প্যারাখানা বুঝি।”

ফিরে এসেছি। গেটকিপার আমাকে পেয়েই থামালো। বললো, “আরে ভাই, তোমারেই তো খুঁজি। লিগ অফ লেজেন্ডস খেলো না? তুমি তো ক্যাপ্টেন টিমো নিয়ে খেলো? টপ গাই?”
আমি জোরদার মাথা দোলালাম, “আমি-ই সেই মাদারচত। ঘটনা কী?”
সে বললো, “এই ক্যারেকটারটা দ্যাখো। টপের জন্য পারফেক্ট।”

তারপর একটা ইউটিউব ভিডিয়ো ধরিয়ে দিলো। আমি চোদনা হয়ে গেলাম। লেভেল-ই আলাদা।

গেটকিপার জানতে চাইলো, “ফিরে আসলে যে?”
আমি বললাম, “জেনিকে এক ক্রিপ তাড়া করেছিল। মেক শিওর করলাম নটির ছেলে ওকে আর জ্বালাবে না। চিন্তার কিছু নেই, শি ইজ সেইফ নাও।”

এর মধ্যে এক মেয়ে এসে আমার ছয় ইঞ্চির মধ্যে থেমেছে। বললো, “তোমার কী অবস্থা? কেমন আছো?”
আমি হাসলাম। বললাম, “বেঁচে আছি। নিঃশ্বাস নিচ্ছি। এর বেশি আর কী দরকার, বলো?”
ও হেসে ফেললো। একটা হাত বাড়িয়ে বললো, “আমি স্যাম। তোমার নামটা তো জানা হলো না।”
বললাম, “বন্ধুরা আমাকে কেপি বলে ডাকে। এই নামে উপন্যাস লিখে থাকি তো। ইনিশিয়ালস।”

এর মধ্যে দুই চুদির ভাই লাইনটা দখল করে ফেলার পাঁয়তারা কষছে। স্যামের হাতটা ছেড়ে বললাম, “ইয়ে, কিছু যদি মনে না করো – ইনকামিং। চুদিরভাই।”

স্যাম আর গেট কিপার হেহে করলো। দৌড়ে গিয়ে নিজের স্পট ধরলাম। ফিরে এসে অনেকক্ষণ পর ফোনটা বের করেছি। দেখছি কে কীভাবে আমার গোয়া মারছে। দুই একটা কমেন্টের রিপ্লাই দিচ্ছি। লোকজন আমাকে বোকাচোদা বলে গালাগাল করছে কারণ আমার গার্লফ্রেন্ড বা বউ অন্য কাউকে চুদে দিলে আমার দিক থেকে কোন রাগ বা ঝগড়া তারা দেখবে না। আমি মুচকি হাসছি আর রিপ্লাই দিচ্ছি। এর মধ্যে সামনে বেশ সুন্দর একটা মেয়ে এসে ধপ করে বসে পড়লো। আজকে মনে হয় আমার সুন্দরী ভাগ্য ভালো। এক রাতে তিন সুন্দরী আমাকে খুঁজে বের করছে এটা বিরল। খুব সম্ভবতঃ আমার চুলের বর্তমান স্টাইলের কারণে।

আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম। মেয়ে বললো, “শুনলাম, তুমি নাকি স্যান মার্কোস থেকে যাবাগা?”
আমি বললাম, “একটা সম্ভাবনা আছে। আমার ইউনি অবশ্য বেটার অফার দিচ্ছে অন্য শহর থেকে। লাথিগুঁতো খেলে থেকে যেতেও পারি। কিন্তু তোমাকে তো চিনলাম না।”

হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “আমি এরিকা। তোমার নামটা ভুলে গেছি।”
বললাম, “বন্ধুরা আমাকে কেপি বলে ডাকে। এই নামে লেখালেখি করি তো টিনেজ বয়েস থেকে।”
মেয়েটা হাসলো, তারপর বললো, “তাহলে তুমি আমাকে তোমার বন্ধুরা যে নামে ডাকে সে নামে ডাকতে অনুমতি দিচ্ছো? এটা এত সুন্দর!”

আমি হেহে করলাম। বললাম, “যতক্ষণ পিঠে ছুরি মেরে না দিচ্ছো ততক্ষণ বন্ধু তো বটেই। এর বেশি কিছু এক্সপেক্ট করি না। তবে তোমার নামটা আমাকে ট্রিগার করছে।”
মেয়েটার চোখেমুখে অপার বিস্ময়, “কীভাবে?”
আমি বললাম, “ডিট্যাচমেন্ট মুভিটা দেখেছ?”
ও বললো, “না। ঘটনাটা কী?”
আমি কথা হারিয়ে ফেললাম। আমি, কিশোর পাশা ইমন, যে খোদা কেয়ামত ঘটিয়ে দিলেও দমটা নাকে তুলে বসে থাকবো যেন শেষ কথাটি আমিই বলতে পারি। সেই আমি কথা হারিয়ে ফেলেছি!

বললাম, “ইয়ে, মুভিটা নিয়ে কথা বলা কঠিন। আমার সাথে এতো রিলেটেবল। তো, ওখানে একটা মেয়ে থাকে এরিকা নামে। মাথায় যদি তোমার বিয়ারের বোতলটা না ছুঁড়ে মারো, তো বলি-”

এরিকা আমাকে আশ্বস্ত করলো ও আমার মাথায় বিয়ারের বোতলটা ছুঁড়ে মারবে না।

বললাম, “মেয়েটা একজন যৌনকর্মী। টিনেজার। রানঅ্যাওয়ে। কিন্তু প্রোটাগনিস্ট ওকে নিজের বাসায় ডেকে আনে। কিন্তু অন্য কোন উদ্দেশ্যে না। ও চায় সবাইকে রক্ষা করতে। সেজন্য যে কোন কিছু করতে সে প্রস্তুত। তবে-”

এরিকা আমাকে থামিয়ে দেয়, “মুভিটার নাম কী বললে?”
বললাম, “ডিট্যাচমেন্ট।”
ওর চোখেমুখে কেমন এক পরিবর্তন এলো। খুব খারাপ একটা প্রশ্ন করে ফেললো সে, “তুমি বললে মূল চরিত্রের সাথে তোমার মিল পেয়েছো। তুমি কী সবার থেকে ডিট্যাচড থাকো?”

এমন বেকায়দায় শেষ পড়েছিলাম যখন আনসার আল ইসলাম আমার মাথাটা কেটে ফেলার চেষ্টা করেছিল। আমতা আমতা করে বললাম, “আমি এখানে ইম্পর্ট্যান্ট না। কথা হচ্ছিল তো ডিট্যাচমেন্ট মুভি নিয়ে-”

এরিকা আমার হাতে একটা বাড়ি দিয়ে বললো, “না। এখানে তুমিই ইম্পর্ট্যান্ট। বলো।”
বড় করে শ্বাস নিলাম, “আমি যদি কারো সাথে কথা বলি তাহলে আমি কথা বলি এআই-এর মতো। এআই বোঝ?”
ও বললো, “আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ। আমি কথা বলি ওভাবেই। ছেলে-মেয়ে কিংবা আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ফারাক করি না। আমি দূরত্ব রাখি।”
এরিকা জানতে চাইলো, “কেন?”

ভাষা হারিয়ে ফেললাম। এত বড় প্রশ্ন আমাকে কেউ করেনি। এই টেক্সাসে জন্মানো, বড় হওয়া, ফার্স্ট ইয়ারের নাই-ইভ একটা মেয়ে কীভাবে আমাকে এমন একটা প্রশ্ন করে ফেললো!

এরিকা বললো, “তোমার অরিজিনাল থিংকিং নিয়ে লেকচার শুনে ফেলেছি। ওটার জন্য তোমাকে ডিটাচড থাকতে হবে? কারো কাছে যেতে পারবে না?”

আমি কিছুই বলতে পারলাম না।

মেয়েটা আবারও জানতে চাইলো, “কী হবে কারো কাছে গেলে?”
সবটুকু শক্তি একত্র করে ফিসফিস করে বললাম, “বিকজ আই কেয়ার টু মাচ। আই ক্যান্ট অ্যাফোর্ড ইট। আই ক্যান্ট।”

এরিকার চোখেমুখে যে পরিবর্তনটা দেখলাম, তা কোন ভালো লক্ষণ নয়। কুকুরের মতো হেসে বললাম, “কথা সেটা না। তুমি ডিট্যাচমেন্ট মুভিটা দেখবে। এটা তোমাকে দেখতেই হবে।”
ও বললো, “দেখবো। অবশ্যই দেখবো। এরা আমাদের এখন বের করে দেবে। কিন্তু তুমি আমাকে সব সময় এখানে পাবে। আমি এখানেই পড়ে থাকি। দয়া করে এরপর যখন আমাকে দেখতে পাবে ডিট্যাচমেন্ট প্র্যাকটিস না করে একটু ডেকো।”

সুন্দরীর কাছ থেকে এমন একটা অফার পেয়েও আমার মুখে কোন শব্দ এলো না। ভুতের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছি। এই অচেনা অজানা মেয়েটা আমার সবটুকু ভালনারেবিলিটি কীভাবে ধরে ফেললো!

লম্বা করে আমার বিয়ারে একটা চুমুক দিলাম।
চেষ্টা করলাম চকচকে চোখে তাকিয়ে থাকা এক অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়ের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে।

এভাবে ধরা কেন পড়ে গেলাম!

যীশুর হত্যাকারী

“নিরাপদে থাকবে কেবল যীশুর অনুসারীরা। সত্যিকারের বিশ্বাসীরা।”
ত্রিশ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচালো আমেরিকানটা।

আমি আর সুমিত দাঁড়িয়ে আছি জ্যাক ইন দ্য বক্সের সামনের পার্কিং লটে। আমার পকেট গড়ের মাঠ। সুমিত আমাকে একটা বার্গার খাওয়াচ্ছিল। পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে আছি সুমিতের উবার আসার অপেক্ষায়। তখনই একটা লোক একটা কুকুর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আমাদের দেখে বললো, “আশা করি তোমরা পানি জমিয়ে রেখেছ!”

বালটাও বুঝলাম না। তবে সচরাচর যা করে থাকি, জ্যাকি চ্যানের মতো একটা ভদ্রতাসূচক হাসি হাসলাম।
কাজ হয়ে গেল।
লোকটা ওখানে একটা খাম্বার মত দাঁড়িয়ে গেল। ভ্রু কপালে তুলে বললো, “তুমি হাসছো, অ্যাঁ? টেক্সাসের গভর্নর বলেছে আগামি নয় মাস কারেন্ট থাকবে না। পানি থাকবে না সেজন্য। বাড়িতে আমি নয় মাস একটা গোটা ফ্যামিলিকে খাওয়ানোর মতো খাবার জমিয়ে রেখেছি। জানো এটা কেন হবে? কারণ এরপর যে সমস্যাটা আসবে পৃথিবীতে তা হচ্ছে খাবারের সমস্যা। বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ খাবার না পেয়ে মরবে। এটার শুরুটা কোথায় হবে, জানো?”

এতক্ষণে আমি ঘটনা বুঝে গেছি। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা একজন মস্ত বেকুব, রিপাবলিকান, ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান, এবং একজন কনজার্ভেটিভ। সচরাচর এগুলো একটা প্যাকেজ হিসেবেই আসে। মোট আটটি বৈশিষ্ট্য আছে যাদের যে কোন একটা পাওয়া গেলেই ধরে নিতে পারেন বাকি সাতটা তাদের মধ্যে থাকবে এই সম্ভাবনা ৮৯%।

(১) বেকুব কিন্তু নিজেকে জ্ঞানী মনে করে
(২) প্রো-গান
(৩) প্রো-গড
(৪) প্রো-লাইফ
(৫) রিপাবলিকান
(৬) ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান
(৭) কনজারভেটিভ
(৮) সায়েন্স এবং তার লোকজনকে দেখতে পারে না।

ঘটনা বুঝে ফেলার কারণে আমি বললাম, “না, এর শুরু কোথায় হবে তা তো জানি না।”

লোকটা তড়পে উঠলো। বললো, “আমি চৌদ্দ বছর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে কাজ করেছি। আমি স্মার্ট লোক, বুঝলে? এর শুরুটা হবে টেক্সাসে। রক্ষা পাবে কারা এ থেকে জানো? শুধুমাত্র খ্রিস্টানরা।”

ওদিকে সুমিতের উবার চলে এসেছে। সে ওদিকে রওনা দিলো। কিন্তু একটা হাতি দিয়ে বেঁধে টান দিলেও আমি এখন এই পার্কিং লট থেকে নড়বো না। এরকম প্রতিটা মানুষ পাওয়া মাত্র খুঁটি গেড়ে আমি দাঁড়িয়েছি। কান পেতে শুনেছি তাদের কথা। ক্ষেত্রবিশেষে বাচাল হলেও, বিরুদ্ধমতের কারো সামনে আমার থেকে ভাল লিসনার আর কোথাও পাবেন না আপনি।

লোকটা আমাকে জুতমতো জ্ঞান দেয়া শুরু করলো, “ইউনিভার্সিটিতে পড়া বুড়োখোকাদের ব্যাপারে তোমাকে একটা কথা বলে যেতে পারি। এরা সব প্রতিবন্ধি, ভাই। বোকাচোদা। এরকম চার-পাঁচ জনের সাথে কথা বলেছি আমি। আমার কোন কথাই তাদের ভালো লাগে নাই। ভেবেছে সব গুজব। আমি তো আর বোকা না। ফ্লোরিডায় আমার পাঁচ মিলিয়ন ডলারের বাড়ি আছে। সেখানে না থেকে আমি টেক্সাসে থাকি। কারণ যুদ্ধটা শুরু হবে এখান থেকেই।”

বিড়বিড় করে আমি বললাম, “গাজওয়ায়ে হিন্দ আরকি।” মুখে বললাম, “যুদ্ধ?”

বোকাচোদাটা বললো, “ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের যুদ্ধ। খাবারের ক্রাইসিস শুরু হলেই আমরা যুদ্ধে নেমে যাবো। আমেরিকা সরকারের তখন প্রচুর যোদ্ধার দরকার হবে। তোমার কি মনে হয় এই যে তোমাদের বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছে, মেধার জন্য আনছে? না, আনছে কারণ তাদের যুদ্ধের জন্য লোক দরকার হবে। তখন আমেরিকার মাটিতে যারা থাকবা সবাইকে যুদ্ধে যেতে হবে।”

আমি তখন তাকে লাই দিলাম, “অবশ্যই যাবো। আমার তো আজন্ম স্বপ্ন আমেরিকার হয়ে যুদ্ধ করার।”

লোকটা খুশি হয়ে বললো, “তুমি সত্যিকারের পুরুষ। আজকালকার চ্যাংড়াদের মধ্যে এমন বেশি দেখা যায় না। আর তোমাকে একটা সত্য কথা বলি – যখন তুমি বুঝে ফেলবা একজন পুরুষ হিসেবে তোমার সত্যিকারের ক্ষমতা কতখানি তখন আর মেয়েদের অধিকারের নাটক তোমার ভালো লাগবে না। গর্ভপাতের অধিকার চায়। মজাটা বুঝেছ? পুতিন কী বলেছে শোননি? বলেছে পশ্চিমাবিশ্ব তার শত্রু নয়। তার শত্রু হচ্ছে ওক কমিউনিটি। এরা ওক কমিউনিটির নামে যা শুরু করেছে তা হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত কেড়ে নেয়ার পায়তারা। মেয়েদের অধিকার, সমকামীদের অধিকার। ছোহ।”

একটা গাড়ি তখন পার্কিং লট থেকে বেরুতে গিয়ে ওর কুকুরকে মাড়িয়ে দিয়েছিল প্রায়।
কুকুরটা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। আমি তাকে দেখতে দেখতে ভাবলাম, কুকুরটাও কি রিপাবলিকান?
কুকুরটাও কি প্রো-গড, প্রো-গান, প্রো-লাইফ? কুকুরটা তো ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান হবার কথা নয়। কিন্তু কে জানে! হতেও পারে।

লোকটা কুকুর সামলে আবার শুরু করলো, “টেক্সাস হবে যুদ্ধের শুরু। কারণ এখানে তখন এগিয়ে আসবে মেক্সিকান কার্টেলগুলো। বন্দুক তোমরা দেখবে। আমরা তখন যুদ্ধে নেমে দক্ষিণে পুশ করবো। এই যুদ্ধ কোথায় শেষ হবে জানো?”

আমি বললাম, “না। আমি একটু মূর্খ এবং বোকাচোদা, স্যার। দ্বীন-দুনিয়ার খবর তেমন রাখি না। আমাকে ক্ষমা করবেন। বরং আমার জ্ঞাননেত্র বিকশিত করে দিন। বলুন, যুদ্ধটি কোথায় শেষ হবে?”

বলদটা বললো, “আর্জেন্টিনা। কারণ আমাদের পুরো মহাদেশটাই দখল করতে হবে। মারতে হবে সবাইকে। আর খাবারের সংকট বাড়লে গোটা আমেরিকার লোকই ছুটে আসবে টেক্সাসের দিকে। আমরা তখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করবো। শেষ মাটিটা পর্যন্ত দখল করবো আমরা।”

আমি বললাম, “ওয়াও।”

মূর্খটা নিজের বুকে টোকা দিয়ে বললো, “আমি একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান। বাকিদের মত দুর্বল নই। মানুষ খুনে আমার হাত কাঁপবে না, কারণ আমি ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য খুন করায় খারাপ কিছু দেখি না।”

তারপর আরও দশ-পনেরো মিনিট আমাদের আলাপ হলো। লোকটা আমাকে খুব যত্নের সাথে বোঝালো আগামি ২৮ বছরে কোথায় কী হবে। বিশ্বের কোন জায়গা কেমন থাকবে। এটাও বললো ভারত একমাত্র জায়গা হবে যেখানে খাবারের সঙ্কটে লোক মরে সাফ হবে না। ঠিক কখন ডেমোক্রেট খানকিরা (এর থেকেও কিছু বাজে বিশেষণ সে ব্যবহার করলো, বন্দুক নিয়ে প্রথমে এ কাদের শিকার করবে তা আমার বোঝা হয়ে গেল) তাদের প্রকৃত চেহারা দেখানো শুরু করবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। (হানিফ সঙ্কেত)
তারপর সে বিদায় নিলো অবশেষে।

আমি বললাম, “আপনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান একজন মানুষ, স্যার।”
লোকটা খুশি হয়ে বললো, “তোমার মতো ছেলে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই ওক পোলাপান। দিনটি চমৎকার কাটাও।”
আমি বললাম, “আমি বাড়ি ফিরেই পানি জমানো শুরু করবো। চিন্তার কোন কারণ নেই।”

বাড়ি ফেরার সময় চিন্তা করছিলাম, আমাদের জেনারেশনের সবার উচিত টেক্সাসে এসে কয়েক মাস কাটানো। রিপাবলিকান হেভি যে কোন আমেরিকান স্টেটে তাদের কিছু সময় কাটিয়ে যাওয়া উচিত অন্তত। তাহলেই বুঝতে পারবে ঈমানী জোসে তারা যা যা ভাবে সবই কেমন বুলশিট। এবং ঠিক একইভাবে চিন্তা করে কীভাবে গোটা বিশ্বের নিম্নোক্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের লোকজন
— ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান/মুসলিম/হিন্দু/যে কোন ধর্ম
— কনজারভেটিভ
— বিজ্ঞান বলে কিছু নাই, সব পশ্চিমাদের/ডেমোক্রেটিক ষড়যন্ত্র
— মেয়েদের কিংবা সমকামীদের অধিকার দেবার তেমন কিছু নাই

আপনারা অক্ষরে অক্ষরে একইরকম চিন্তা করেন। প্লট সবার সেইম। শুধু কেউ বলে আল্লাহ, কেউ বলে গড। কেউ গর্বিত মুসলিম। কেউ গর্বিত খ্রিস্টান। কেউ গর্বিত হিন্দু।

অথবা, এই আমেরিকান লোকটিকে আমি যদি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে পারতাম, তবেও দারুণ হতো।
নিমেষেই নিজের বলদামি ধরা পড়তো তার চোখে। ঠিক যেমন ধরা পড়তো আপনাদের বলদামি আপনাদের চোখে।
দুনিয়া বিচিত্র এবং মজার।

বাংলাদেশে বেড়ে ওঠায় আমি অনেকবারই কৃতজ্ঞ বোধ করেছি। টেক্সাসের ছাগ*লদের সাথে যতবার কথাবার্তা হয়েছে আমাকে তেমন কিছুই করতে হয়নি, তিনটি বাক্য শোনার আগেই আমি স্বজাতিদের চিনতে পেরেছি। কারণ চায়ের দোকানে, রাস্তায়, বাসের পাশের সিটে আমি এমন স্বদেশী ছা*গলের সাথে অনেকবার বিশ মিনিট, আধঘণ্টা, এক ঘটণা আলাপ করেছি। প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাদের কথা শুনেছি।

এই আমেরিকানের কপিক্যাট আলাপই তারা করেছে। ফ্রেজগুলো বদলে গেছে খাদ্যসঙ্কট>ইমাম মাহদি, খ্রিস্টান>মুসলিম, ওক>নাস্তিক, গড>আল্লাহ, ডেমোক্র্যাট>আওয়ামীলীগ, যুদ্ধ>গাজওয়ায়ে হিন্দ প্রভৃতিতে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে মালিবাগের মোড়ের ধর্মপ্রাণ মুসলিম আর টেক্সাসের ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান কিছু কিছু শব্দ একেবারে হুবহু ব্যবহার করেছে। এরা প্রত্যেকেই নিজেদের ‘রিসার্চ’ করেছে। অ্যাপারেন্টলি, মূর্খতার নিজস্ব ভাষা আছে।

আপনি ভাবেন, আপনি স্পেশাল? আপনি সিরাতুল মুসতাকিমে আছেন?
আপনি আছেন বালের ওপর।
আমি কেবল আশা করি, এই জেনারেশনের পোলাপান অন্তত বিষয়টা নিজে নিজে দেখতে পাবে।

নভেম্বর ২৫, ২০২২

 

যীশুর মেয়ে

মসীহ ঈশার মতোই আমার নীতি হচ্ছে, আমি সব মানুষের সাথে চলি। টেক্সাসে অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং দুই বান্ধবীর পার্সপেক্টিভ জানার সুযোগ এভাবেই হলো।

বান্ধবীর আলাপ আসছে, কারণ প্রেগন্যান্সি নিয়ে যে নাটক আমেরিকায় হয়েছে তা অনেকেই জেনে থাকবেন। বন্ধুর থেকে বান্ধবীর মতামত প্রকাশ বেশি জরুরী। ইউএসএ-তে মিড টার্ম ইলেকশন হলো। বিশেষ করে বেশিরভাগ মেয়ে দম আটকে দেখছিল এই ভোটে জনগণের মতামত কোনদিকে যায়।

প্রথম বান্ধবী হচ্ছে যীশুর মেয়ে। ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান। আমাকে টেনে-হিঁচরে একদিন চার্চে নিয়ে গেল। এতগুলো ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানের মধ্যে জমপেশ একটা নাটক হয়ে গেল তারপর। গসপেল পাঠ করছিল যে ছেলেটা – তরুণদের ধর্মগুরু, তার পাশেই বসার জায়গা হলো আমার। সব রিচুয়াল শেষে সে আমাকে বললো, “কেমন বোধ করছো? তোমাকে বেশ চুপচাপ মনে হচ্ছে।”
আমি ওকে বললাম, “ইয়ে, আমার দুটো দোষ আছে।”

পুরো ঘরের স্পটলাইট দেখলাম আমার ওপর। সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
ব্লন্ড যে মেয়েটা বাইবেল পাঠ শেষ হওয়া মাত্র গিটারটা নিয়ে টুংটাং যীশুর বন্দনা শুরু করেছিল, তার গিটারও বন্ধ হয়ে গেল।

ধর্মগুরু শুধালেন, “আহা। কী সেটা?”
আমি বললাম, “আমার মুখের গর্তটা ফাঁকা হলে অনেকসময় সেটাকে মানুষ ভালোভাবে নেয় না।”
ধর্মগুরুর সাথে ঘরের সবাই হা হা করে উঠলো। বললো, “কোন চিন্তা নেই। এইখানে তুমি যা ইচ্ছে তাই বলতে পারো। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। সব মতামতই স্বাগত।”
আমি বিনয়ের সাথে তাদের ধন্যবাদ জানালাম।

ওদিকে বান্ধবী আমার ইন্ট্রোডাকশন করিয়ে দিয়েছে, “বাংলাদেশি” এবং “এই প্রথম চার্চে ঠ্যাং রেখেছে” হিসেবে। ঘরের পরিবেশ অত্যন্ত অনুকূল। সবার মাথায় কী চলছে তা আমার কাছে সুস্পষ্ট। যীশুর লুঙির তলে আমি ঢুকে পড়বো আজ অথবা কাল – এটাই তাদের চোখেমুখে পরিষ্কার।
ধর্মগুরু জানতে চাইলেন, “তা তুমি নিশ্চয় আমাদের ধর্মে বিশ্বাস করো না?”
আমি বললাম, “আজ্ঞে না। আমি অ্যাগনস্টিক।”
ধর্মগুরু এবার সুঁইয়ের মতো মিহি গলায় প্রশ্ন রাখলেন, “তা যীশুকে তোমার কেমন লাগে?”
আমি আরও বিনয়ের সাথে বললাম, “আমার দ্বিতীয় দোষটি আগে শুনুন, স্যার।”

ধর্মগুরুর সাথে ঘরের সবাই আবারও স্পটলাইট আমার দিকে ফেললো। কোনও লোক তার দোষ স্বীকার করছে এটার চেয়ে বিনোদন আর কিছু হতে পারে না চার্চে।

ধর্মগুরুর অশেষ ধৈর্য। তিনি জানতে চাইলেন, “বলে ফেল বাছা। বলে ফেল।”
আমি বিনয়ে নুয়ে পড়তে পড়তে বললাম, “জীবন-মরণ সমস্যা না থাকলে, কিংবা দেশের স্বার্থে না হলে আমি কখনো মিথ্যা বলি না।”

সবাই বা-বা করে উঠলো। ধর্মগুরু বললো, “একে দোষ বলছো কেন? এ তো ভালো জিনিস।”
আমি যথাসম্ভব নরম গলায় বলে ফেললাম, “এরকম একটা সেটিংয়ে যীশুকে আমার কেমন লাগে প্রশ্ন করা হলে এই ভালো জিনিসটা দোষ বৈকি।”

অনেকে একটু অস্বস্তির সাথে নড়েচড়ে বসলো। ওই ব্লন্ড যে আমাকে তার গিটার বাজিয়ে জীবনেও শোনাবে না তা আমি লিখে দিতে পারতাম তখন।

ওইখানে পরের ত্রিশটা মিনিট খুব মিনিংফুল আলাপ হলো আমার। থিওলজি, সাইকোলজি নিয়ে তুমুল আলোচনা। চার্চ থেকে বেরুবার সময় আমার খেয়াল হলো, এই কথা কোন বাংলাদেশের মসজিদে বললে মাথা আর জায়গামতো থাকতো না।*

তো এই হচ্ছে আমার ধার্মিক বান্ধবীর সার্কেল। এরকম আরও অসংখ্য সার্কেলে আমি ওর সাথে গেছি। ধর্মপ্রাণ মুসল্লি দিয়ে ভর্তি। এবং তাদের মাঝে গিয়ে বসে তাদের মেকানিজম আর সাইকোলজি বোঝাই আমার লক্ষ্য। টেক্সাসের এমন এমন ধার্মিক কমিউনিটির সাথে আমার ওর থ্রুতে পরিচয় হয়েছে যারা আমার মতাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে। ঈশ্বরের নাম নিতে নিতে মুখে ফেনা তুলে ফেলা জনতা আরকি। কী যে ভয়ানক ভয়ানক কুসংস্কার বিশ্বাস করে বললে ভাববেন গুল মারছি। অথচ এখানে যা বলেছি তা অক্ষরে অক্ষরে ঘটেছে। বাঙালির খ্রিস্টান ভার্সন – সোজা বাংলায়। যীশুর সন্তানেরা।

তো টেক্সাসে নির্বাচনে জিতেছে গ্রেগ অ্যাবট। লোকটা এমনই এক বদমাশ যে মেয়েদের মানুষ মনে করে না। অ্যাবরশন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি সে এমন সব কথাবার্তা বলে থাকে যা শুনলেই বোঝা যাবে মেয়েরা তার কাছে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন। একেবারে খাটি ওয়াজি। সে আবার টেক্সাসের গভর্নর। এখানে তো ধর্মান্ধ লোকে ভর্তি, কাজেই উপযুক্ত লোকের হাতেই উঠেছে ঝাণ্ডা।

অ্যাবটের খুঁটিনাটি জানার ভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল ইলেকশনের রাতে। যে দুই বান্ধবী আজকের আলোচনায় মুখ্য তাদের দ্বিতীয়জন রাত তিনটায় আমাকে বেহুদা মেসেজ দিচ্ছিল। মেসেজের হালচাল দেখে বুঝলাম, ক্ষেপে আছে। ক্ষেপে আছে বললে কম হবে, আসলে বোমা হয়ে আছে। নির্বাচন নিয়ে চিন্তায় মারা যাচ্ছে। আবার ওদিকে তখন ভোট গোণা হচ্ছে। সবার গলার কাছে উঠে আছে হৃৎপিণ্ড। টেক্সটে কুলাচ্ছিল না, ও আমাকে ফোন দিলো। ধরামাত্র বুঝলাম অন্তত আটটা মদ পেটে চালান করে দিয়েছে। পুরা চোদ।

ফোন ধরা মাত্র ও একটা হুঙ্কার দিলো, “খানকির পোলা কী বলসে তোমারে বলি –”

যীশুর মেয়ের একদম একশ’ আশি ডিগ্রি দূরে ওর প্রোফাইল। ধর্ম গোণার সময় তার নাই, মদে আপত্তি নাই (ও-ই তো আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে খাঁটি স্যান মার্কোসের সন্তানেরা ডাউনটাউন হিট করে, এবং সেই রাতে আমাকে হামাগুড়ি দিয়ে বাসায় ফেরা লেগেছে), কনজারভেটিভ দেখতে পারে না, আদর্শ লিবারেল। পরের পঞ্চাশটা মিনিট অ্যাবট কেমন হারামজাদা তার ফিরিস্তি আমাকে বর্ণনা করলো ও। খুঁটিনাটি বোঝালো টেক্সাসের ভোটের। বর্ন অ্যান্ড রেইজড ইন টেক্সাস। সে ভোট দিতেই গেছে ওরা যেন অ্যাবরশন নিয়ে অত্যাচারী আইন বন্ধ করা যায় এবং মেয়েদের স্বাধীন করা যায় তাই।

টেক্সাসে যারা আছে সবাই ওই রাতে উৎকণ্ঠা নিয়ে জেগে ছিল। আমার মাথায় ইলেকশনের ব্যাপারটা থাকলেও তারিখটা ছিল না অবশ্য, তারিখ তো মনে থাকে না। তবে ওই রাতে আমরা বসে বসে ভোট গুণলাম। বান্ধবী একটার পর একটা বোতল খুলে গেল ওদিকে। অথচ পরে খারাপ মানুষটাই জিতে গেল। মদারুদের দোয়া কী আর কবুল হবে? কবুল হয়েছে খ্রিস্টানদের দোয়া। ৫১% এর ওপরে উঠে যাওয়ার পর আমরা আর নিতে পারলাম না। পরিষ্কার বুঝলাম ফোনের ওপাশে মেয়েটা আরেকটা বিয়ারের ক্যান খুলে ফেলেছে। খুব স্বাভাবিক। মানুষের স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস করে তাদের সবার মন মেজাজ বিলা হয়ে গেছিল সে রাতে।

পরদিন যীশুর মেয়ের সাথে সন্ধ্যার দিকে দেখা হয়েছে। আমি নির্বাচনের কথা আর তুললামই না। ছুরি মোচড়াবার দরকার নেই ভাবলাম। একই সাথে যীশুর যে কোন সন্তানই নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হতে পারে এবং হবে – এই আশঙ্কা ছিল। বাংলাদেশে তো তাই। প্র্যাক্টিসিং মুসলমান মানেই নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী না। কারণ ধর্মেই বলা আছে পর্দা করতে হবে, স্বামীকে অমুক স্থান দিতে হবে, পিতার সম্পদের ভাগে ভাইয়ের অর্ধেক নিতে হবে, ইত্যাদি। কেউ প্র্যাকটিসিং মুসলমান হলে আর নারীকে স্বাধীনতা দূরে থাকুক, সমান অধিকার দিতে পারবে না। কেউ নারীর সমান অধিকারে বিশ্বাস করলে সে অবশ্যই মুরতাদ। ইসলামের আকিদা না মানা এক জিনিস আর অবিশ্বাস করা আরেক জিনিস। নারীর সমান অধিকার বিশ্বাস করার অর্থ আপনার ঈমান নেই। খ্রিস্টানরা এর থেকে ভালো হবে নাকি? আর যীশুর মেয়েকে তো আমি চিনি ভালোমতো।

রাত দেড়টার দিকে বাসায় ফিরছি। পুরোটা সময় ইলেকশনের ব্যাপারে আলাপ হয়নি। এখন ও বিদায় হবে, পার্কিং লটের দিকে এগিয়ে দিচ্ছি কেবল। যীশুর মেয়ের সাথে মারামারি বেঁধে যাওয়ার সম্ভাবনা এড়ানো গেছে ভেবে কেবল স্বস্তির নিঃশ্বাসটা ফেলবো, এমন সময় ও বলে ফেললো, “খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম গতকাল রাতে, বুঝলে?”

আমি অবাক হয়ে গেলাম। আরে, চার্চগোইং লিবারেল নাকি?
তারপর সে তার বাক্যটা শেষ করলো, “অ্যাবট হারলে সর্বনাশ হয়ে যেত।”

মনে মনে কেবল বললাম, “চুদসে আমারে।” মুখে বললাম, “কেন?”

ও জানালো, “ওর অফিসে আমার পীসতুতো ভাই কাজ করে তো। ভাইয়া তো ভদ্রলোকের ডানহাত। ওর চাকরিটা যেত হয়তো। যে গাড়িটা হাঁকাচ্ছে তার খরচা আর দেয়া লাগতো না পরের মাসে।”
আমার কান থেকে তখন ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
এবার কথাটা শেষ করলো সে, “তাই আমরা সবাই অ্যাবটকে ভোট দিয়েছি। তাছাড়া ভাইয়ার সুবাদে গেছি তো উনার অফিসে। দেখাসাক্ষাত হয়েছে বার কয়েক। উনারা জোস মানুষ।”

আমি বললাম, “ওই যে তোমার গাড়ি। গুড নাইট।”
এর বেশি কিছু বলতে গেলে আমার মুখ থেকে যা বের হবে তা যীশুর ক্ষমাশীল সন্তানরাও নিতে পারবে বলে আমার মনে হলো না।

টেক্সাসের লিবারেল আর কনজারভেটিভদের সাথে এবং তাদের সার্কেলে আমি যথাসম্ভব নিউট্রাল হয়ে মেশার চেষ্টা করেছি এতগুলো মাস। আগে থেকে কোন কিছুই ধরে নিতে চাইনি। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, আমার মনে হচ্ছে আসলেই ধর্মটা যতো নষ্টের গোড়া। ধার্মিক মানেই সে প্রো-গড, প্রো-গান, প্রো-লাইফ। এই তিন একেবারে প্যাকেজ, এবং সব্বোনাশ! মানে বন্দুক ছোঁড়ার জন্য চেঁচাবে, মেয়েদের অ্যাবরশন নিষিদ্ধ করার জন্য চেঁচাবে। যারা একটু নাস্তিক গোছের তারা বন্দুক ব্যান করার জন্য এবং মেয়েদের স্বাধীনতা দেয়ার জন্য চেঁচাবে।

দূর থেকে এমনটাই সবার ধারণা হয়। আমি তাই কাছে গিয়ে মিশেছি। মিশছি।
দেখছি আসলেও তাই।

বাংলাদেশেও তাই। যে ব্যাটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা ধার্মিক তার কাছে ব্যক্তিস্বাধীনতার ভ্যালু নাই, সে অন্যের ওপর অত্যাচারী আইন-কানুন চাপাতে সব সময় ব্যস্ত। যারা মডারেট মুসলিম বা ধর্মচ্যুত – তারাই ভালো মানুষ। মডারেট খ্রিস্টান এবং মডারেট মুসলমান একই কাতারের লোক। বিবেকবুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করে।

যারা প্রবল বিশ্বাসী তারা প্রত্যেকে এমপ্যাথিলেস, থটলেস, ডাম্ব।
আমি এই সমাজটাকে আরও কয়েকটা মাস দেখার সুযোগ পেলে হয়তো এর উলটো উপসংহারে পৌঁছাবো।
হয়তো আমি ভুল ভাবছি।
হয়তো আমি ভাবছি উলটো।

হয়তো যারা এমপ্যাথিলেস, থটলেস, ডাম্ব, তারাই প্রবল বিশ্বাসী!

* ধর্মগুরুর সাথে আমার পরে আরও আলাপ হয়েছে কফি শপে। ফ্রি হলেই ভদ্রলোক আমাকে টেক্সট করে ডাক দেয়। বলে, “এসো, আড্ডা হয়ে যাক।” মনের গহীনে সে হয়তো আমাকে কনভার্ট করার জন্য ডাকে, তবে আমাদের কানেকশনটা ভিন্ন। আমরা আদতে প্রিচার। সে যীশুর বানী প্রচার করে। আমি ভিন্ন বাণী প্রচার করি। কাজেই আমরা আলাপ করি জনতা কীভাবে কোন জিনিসটা নেয়, কী টেকনিক ব্যবহার করলে লোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে ইত্যাদি। সে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অ্যাঙ্গেল থেকে প্রিচিং নিয়ে আলাপ করে, আমি ‘জীবনবাদ’ প্রচারের লক্ষ্য থেকে প্রিচিং নিয়ে আলাপ করি। ও একমত হয় প্রচারের অনেক টেকনিক নিয়ে, অনেক সময় নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলে কেমন ঝামেলা তমুক টেকনিকে আছে। এবং যেহেতু লম্বা একটা সময় সে জনতা নাচিয়ে বেড়াচ্ছে, আমি তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি। নিজের ধর্ম প্রচার করার সময় এসব আমার কাজে লাগবে। প্রিচিং হলো গিয়ে প্রিচিং। আর লোকটা বেশ ভালো প্রিচার। গতকাল কয়েকশ ছেলেমেয়ের সামনে সে আগুনঝড়া সাইকোএনালিটিকাল বক্তব্য রেখে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেছে শুনলাম অন্যদের থেকে। আমাকে দাওয়াত দিয়েছিল, আমি যেতে পারিনি। রিপোর্ট লিখতে বেশি ব্যস্ত ছিলাম। তবে এসব প্রিচার কীভাবে লোকের মাথা খায় তা শেখার প্রয়োজন আমার আছে।

 

ইউনিভার্সিটিতে বোমা!

সকালের প্রথম টেক্সট এলো কেইলিনের কাছ থেকে, “এই, বোমার ঘটনা শুনেছো? ক্যাম্পাসে নাকি আজ বোমা মারবে। তুমি কই?”

আমি তখন হিমশিম খাচ্ছি প্রপোজালের প্রেজেন্টেশন তৈরির চাপে। আজকে আমার ডেমো প্রেজেন্টেশন দেয়ার কথা প্রফেসর, এবং তার ল্যাবের জনগোষ্ঠির সামনে। এর মধ্যে বোমা এল কোত্থেকে!

আমি এক হাতে পাওয়ারপয়েন্টের স্লাইড বানাতে বানাতে অপর হাতে ওকে রিপ্লাই দিলাম, “কোন বোমা? কীসের বোমা?”

তখন ও আমাকে একটা স্ক্রিনশট পাঠালো। টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির ইমেইল। কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছে, “বিশ্ববিদ্যালয়ের চারিটি দালান বোমা মারিয়া উড়াইয়া দেবার হুমকি দিয়া কে বা কাহারা লিফলেট বিতরণ করিয়াছে। দালানগুলো হইলো হাওয়ার্স, থিয়েটার, কেমিস্ট্রি, আর এজুকেশন বিল্ডিং। পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সশস্ত্র অবস্থান নিয়াছে এবং প্রতিটি দালানের কোনাকাঞ্চিতে উঁকি মারিয়া দেখিতেছে। চিন্তার কোন কারণ নাই, আমাদের পুলিশের সঙ্গে আরও কাজ করিতেছে নিয়াছে এটিএফ, ইউটি অস্টিন পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এবং এফবিআই।”

এটিএফ, হোমল্যান্ড, আর এফবিআই। কর্ম সেরেছে!
জাদুঘর পাতা আছে এই এখানে!

কেইলিন জানালো একটু পর ওর ক্লাস আছে বটে, তবে ওসব কোন বিল্ডিংয়ে নয়। জানালো, “পুলিশ তো কুকুর নিয়ে ঘুরঘুর করছে সবখানে। শুনলাম ফিজি ফ্র্যাটারনিটির দুটো ছেলে এই ঘটনার পেছনে নাটের গুরু।”

ওর কাছে ভেতরের খবর থাকা স্বাভাবিক। থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। ক্যাম্পাসে কে কোথায় পাদ মারলো তার বিশদ তথ্য ওদের কাছে থাকে। আন্ডারগ্র্যাডে থাকা অবস্থায় আমরাও তাই করতাম। বলতাম, ক্যাম্পাসে দেয়ালেরও কান আছে।

ভেতরের তথ্য জানামাত্র লক্ষ্য করলাম আমার বুকের গভীর থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেছে। অথচ তখনো বোমা খুঁজে পাওয়ার বা না পাওয়ার কোন খবর পুলিশ দিতে পারেনি।

স্বস্তির মূল কারণ হচ্ছে বোমার হুমকি দেবার ঘটনাটি ঘটিয়েছে যারা তাদের কেউ বাংলাদেশি নয়, এবং আগামী দিনগুলোতে স্রেফ বাংলাদেশি বা ভারতীয় চেহারার অধিকারী হওয়ার কারণে আমাকে কারও লাথি খেতে হবে না।

কিছুদিন আগে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল লাইব্রেরির ফার্স্ট ফ্লোরে। এক ছেলে এক মেয়েকে যৌন হয়রানি করে পালিয়ে গেছিল। তার ছবি সাথে সাথে সিসি ক্যামেরা থেকে বের করে টেক্সাস স্টেটের প্রতিটা ছাত্র-ছাত্রীকে পাঠানো হয়েছে এক ঘণ্টার মধ্যে। আমি যুগপৎ ক্রোধ নিয়ে শুয়োরটিকে দেখলাম। আমাদের জাতিগোষ্ঠীর লোক। ভারতীয়, বাংলাদেশি, কিংবা শ্রীলঙ্কান। লজ্জায় মারা গেলাম।

বদমাশটিকে টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির পুলিশ সে রাতেই গ্রেফতার করতে পেরেছিল। ছবি ছড়িয়ে যাওয়ার পর তাকে ধরিয়ে দিতে বেশি সময় লাগেনি। ভূত থেকে ভূতের চাইতেও বেশ কার্যকর পদ্ধতি ওটা। ব্যাটাকে গ্রেফতারের পর স্বস্তি পেয়েছি ঠিক, একই সাথে মনের ভেতর খচ খচ করাটা থামেনি। আমি জানি আমাদের সাউথ এশিয়ানদের মধ্যে মেয়েদের কীভাবে দেখার প্রবণতা আছে – তারা মেয়েদের সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন মনে করে অভ্যস্ত। সেটা রাষ্ট্র হয়ে গেল যা হোক। স্রেফ সাউথ এশিয়ান বলে আমার চেহারাটা দেখা মাত্র আমার ক্যাম্পাসের মেয়েরা মনে করবে আমি সুযোগ পেলেই তার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকবো! কী একটা লজ্জার ব্যাপার।

এটা যে বাড়িয়ে বলছি এমন নয়। আমাদের যে মেয়েদের না দেখার ভান করা সমস্যা আছে, এবং দেখলে আবার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকার দোষটি আছে – এমনটা ওরা ফিল করেছে তা সরাসরি এখানকার এক মেয়ের সাথে আলাপ করে আমি জেনেছিলাম। তাকে ছাত্রী না, ‘স্রেফ একজন মেয়ে’ ফিল করিয়েছিল আমারই গর্বিত দেশবাসীরা। তারা বাংলাদেশের নাম রওশান করায় আমার মনে হয়েছিল একটা গর্ত করে মাটিতে ঢুকে যাই। সেদিন আমি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক একটি কাজ করেছিলাম। বাংলাদেশের ছেলেদের ব্যাপারে সুগারকোট করে অনেক কিছু বলেছিলাম। বলতে পারিনি, “বইন গো, বেশিরভাগই বাইনচোদ। তোমার পিছে তোমারে নিয়া নোংরা কথা বলে।”

এই জাতির একজন হয়ে জন্মেছি যখন, এমন কিছু জাতিগত ট্যাগ তো পড়বেই আগে কিংবা পরে।
বোমা হামলাকারীদের প্রসঙ্গে তাই সবার আগে চলে এসেছিল সেই উদ্বেগ।
ইসলামফোবিয়ার সময় এসেছিল যখন নাইন এলিভেনের পর পর, তাদের অনুভূতি কেমন ছিল তা চিন্তাও করা যায় না। ভালো মানুষরা বিব্রত হয়েছিলেন এমন, তবে ওটা ছিল আরও সিভিয়ার। হামলাও হয়েছে তখন। কিন্তু খারাপ মানুষরা তখনও ইনিয়ে বিনিয়ে মুসলমান সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে সাফাই গেয়েছিলেন।

আমার জাতির লোক আছে এমন। যারা খারাপ। তারা বলে ফেলে, “তাকানোর মতো জামা পরলে তো তাকাবই।”

মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশিদের জন্য যে সম্মানটা কিছু মানুষ অর্জন করেছিল, তা দুই সপ্তাহের মধ্যে ধ্বংস করেছে অন্য বাংলাদেশিরা। লাখ টাকার বাগান খেয়েছে এক টাকার ছাগলে। বোমাবাজির হুমকি দেয়া লিফলেটের পর কেইলিন যখন আমাকে বলেছিল এটা ফিজি ফ্র্যাটের তথা ফাই গামা ডেলটার কাজ – স্বস্তির নিঃশ্বাস কেন ফেলেছিলাম তা হয়তো এখন স্পষ্ট হয়েছে।

২.
বোমার হুমকির পর কর্তৃপক্ষের যে দিকটা সবচেয়ে চোখে পড়েছে, তা হল – এরা কোনরকম টেরোরিজমের সাথে কম্প্রোমাইজ করেনি। একটা বিল্ডিংও বন্ধ করে দেয়নি, করেনি ইভ্যাকুয়েট। তাদের কথা হচ্ছে, স্রেফ হুমকি দিলেই বাড়ি বন্ধ করে দেব – এমন দিন আজও আসেনি। এই মনোভাবকে আমি দাঁড়িয়ে স্যালুট দেই। গোটা জীবন আমি এটাই ধারণ ও প্রচার করে এসেছি।

কেউ এসে আমাকে ‘মাথা ফেলে দেব’ বলা মাত্র সব বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে যাবো এমন শিক্ষা আমি পাইনি। আমি জেনেছি, সন্ত্রাসীরা সবচেয়ে বড় কাপুরুষ। কারণ তারা নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে অস্ত্র ও বোমা দিয়ে ভয় দেখায়। তাদের কাছে নতি স্বীকার করার প্রথম ধাপটা হচ্ছে তাদের ভয় পাওয়া। অধিকাংশ মানুষ তাদের ভয় পেয়ে থাকেন। সেটা ছাত্রলীগ হোক কিংবা জ’ঙ্গিবাহিনী।

জ’ঙ্গিবাহিনী অমুক বাড়ি উড়িয়ে দেব বলামাত্র ভিডিয়ো ডিলেট করা কাপুরুষ আমরা দেখেছি। অন্তত আমি খুশি, টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটি আজ তেমন কিছু করেনি। সত্য কথাটা হচ্ছে, সত্যিকারের বোমা যদি থেকেও থাকতো আর তাতে আমিসহ উড়ে যেতাম – সেটা টেন টাইমস বেটার, সন্ত্রাসীর হুমকি পাওয়া মাত্র টিভি থেকে শো নামিয়ে ফেলা, ইউটিউব থেকে ভিডিয়ো নামিয়ে ফেলা, ফেসবুক থেকে পোস্ট ডিলেট করে ফেলা, কর্মীকে ছাটাই করে দেয়া ইত্যাদির থেকে।

বোমায় ২০০ জনের মৃত্যু হলে তা অপূরণীয় ক্ষতি, বিশেষতঃ অসম্ভব সম্ভাবনাময় ছাত্র-ছাত্রীরা মারা গেলে তো আরও। কিন্তু এই ক্ষতি একটি সিস্টেমের, একটি দেশের, একটি প্রকাশনীর, একটি রাষ্ট্রের সন্ত্রাসীর কাছে জিম্মি হয়ে যাওয়ার থেকে অনেক অনেক কম ক্ষতি।

কাজেই, টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে আজ আমরা শিক্ষা নেবো।
প্রাণ গেলে যায় যাক, কখনোই সন্ত্রাসীদের হুমকির কাছে মাথা নত করবো না আমরা।

** পরিস্থিতি সন্ধ্যা পাঁচটা চল্লিশের দিকে স্বাভাবিক হয়ে আসে, যখন পুলিশ সবগুলো বিল্ডিং সুইপ করে নিরাপদ ঘোষণা করে। তবে আগামি কিছুদিন পুলিশি তৎপরতা থাকবে ক্যাম্পাসে।

১৫ই নভেম্বর, ২০২২

টেসলায় আমন্ত্রণ

টেসলায় আমন্ত্রণ পাওয়া আর ওদের হেডকোয়ার্টারে ঠ্যাঙ রাখার সৌভাগ্য হলো। মনে রাখার মতো একটা অভিজ্ঞতা, অথচ এটা কোনও “কনগ্র্যাচুলেশনস” মার্কা খবর না। ঘটনা হলো, টেসলা এমন একটা গুপ্ত ইভেন্ট চালু করেছিল, যেখানে কেবলমাত্র টেক্সাসের ছাত্রছাত্রীদের আবেদন করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল (সিক্রেট ইন্টারনাল লিংক, গুগলে এসব আসে নাই)। সেই আবেদনকারীদের মধ্যে একাংশকে তারা এই ঘরোয়া পরিবেশের বিয়ে(!)তে দাওয়াত দিয়েছে।

অ্যাটেন্ডি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমেই সাইন করেছি আমরা NDA তথা নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্টে। কাজেই ভেতরে গিয়ে কী দেখেছি, কী আলাপ হয়েছে, বা কী করেছি তা বলাটা নীতিগতভাবে ঠিক হবে না (যদিও ফেসবুকে আমি নিশ্চয় তাদের টেকনিকাল আর অর্গানাইজেশনাল ফাইন্ডিং নিয়ে আলাপ করতাম না। তাও।)

এখানে সাফল্য বা ব্যর্থতার বিষয় নেই। তবুও দিনটা আমার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন হয়ে থাকবে, কারণ ইলন মাস্কের জার্নিটা আমার অনেক দারুণ পছন্দের একটা জার্নি। এই ঘাড়ত্যাড়া এবং একরোখা ভদ্রলোকই আজকের দিনটা এত দারুণ লাগার কিংবা উপভোগের মূল কারণ। টেসলার যে জিনিসটা আমার ভালো লাগে, প্রত্যেকটা কর্মী প্যাশনেট – কিছু না কিছু নিয়ে, সেটা তার নিজের কাজ করার জায়গা হোক বা না হোক, অনেকে একটু আউট অফ দ্য বক্স। এলন মাস্ক আউট অফ দ্য বক্স পছন্দ করেন, অ্যাজ আ কোম্পানি টেসলাও।* পাগলাচোদাদের আড্ডাখানা। এদের আমি বুঝি। এদের চারপাশে কিছুটা ‘অ্যাট হোম’ ফিল পাওয়া যায়।

ভেতরের খবর বলা যাচ্ছে না ঠিক, তবে আজকের দিনে টেসলা-কর্মী এবং বাকিদের সাথে যে কৌতুকটা প্রায়ই করতে হয়েছে –
“আমরা ভেবেছিলাম এসে দেখবো ইলন মাস্ক হচ্ছে এলিয়েন। সৌরজগতের বাইরে থেকে তিনি এসেছেন, আর NDA সাইন এজন্যই করতে হয়েছে আমাদের। ভদ্রলোকের শুঁড় দেখতে পারবো কিন্তু বাইরে এসে আর বলতে পারবো না।”

(কাল যদি আমাকে ৪৩ বিলিয়ন ডলারের মামলা খেতে দেখেন, বুঝবেন তিনি আসলেই এলিয়েন, আর ব্যাপারটা ফাঁস করায় আমার মুন্ডুটা গেছে।)

এই কৌতুকটা যে ভদ্রলোকের দিকে ছুঁড়লাম, তিনি ৮ বছর ধরে টেসলার সাথে আছেন। জাতীয়তায় ইরানী ছিলেন এককালে। ছাত কাঁপিয়ে হাসলেন বটে, তারপর যোগ করলেন, “আসলে টেসলায় যারা কাজ করে, সবাই-ই ভাই এলিয়েন। আমরা সবাই। যে টাইট স্কেজিউল সামলিয়ে যাচ্ছি আমরা বছরের পর বছর, ও ছাড়া সম্ভব ছিল না।”

টেসলা থেকে দেয়া স্যুভনির মডেল কার

টেসলা যাদের ড্রিম কোম্পানি তাদের জন্য টেক্সাসে পড়তে আসা একটা ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে। টেসলা গিগাফ্যাক্টরি, টেক্সাস হচ্ছে বিশ্বব্যাপী টেসলার হেডকোয়ার্টার। কিছুদিন আগে পালো অ্যাল্টো, ক্যালিফোর্নিয়া (মজার ব্যাপার হচ্ছে পালো অ্যাল্টো আমার আগের অফিস অগমেডিক্সের অপারেশন রিজিয়ন ছিলো, আমি যে গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টের সাথে ৪ মাস কাজ করেছি, ভদ্রলোক ওখানেই প্র্যাকটিস করতেন) থেকে সরিয়ে টেক্সাসের অস্টিনে নিয়ে এসেছেন মাস্ক। এখন টেক্সাসের অস্টিনে দুটো গ্রেট কোম্পানির হেডকোয়ার্টার – ডেল এবং টেসলা। সামনে আরও আসবে। আমি টেক্সাসের মোটামুটি ভক্ত নানা কারণে, তাদের মধ্যে এটা একটা কারণ নয় যে কোম্পানিদের হেডকোয়ার্টার এখানে, আমি ভক্ত কারণ এখানকার আবহাওয়া আমার বেশ পছন্দের। সেই সাথে ক্যালিফোর্নিয়ায় রূপান্তরিত হবার পথে হাঁটছে টেক্সাস এই সময়টায়, উত্থানটা দেখতে ভালো লাগছে। ভালো লাগার কারণ, এখনো ক্যালিফোর্নিয়া হতে পারেনি এই স্টেট, অন্তত ২০-৩০ বছর তো লাগবেই, এবং সেই সুবাদে আমরা একটু কম খরচে বেঁচে থাকতে পারছি এখানে। 😛

যাই হোক, নন-ডিসক্লোজার না ভেঙে কিছু আলাপ করা অন্তত যায়। প্রথমতঃ গিগাফ্যাক্টরি তো এমনি এমনি বলা হচ্ছে না। এটি তো আর কিলো-ফ্যাক্টরি নয়। মেগা-ফ্যাক্টরিও নয়। গিগা। এতো বড়, যেটা চোখের সামনে না দেখলে কল্পনাতে কুলায় না, যতই ভিডিয়ো দেখুন না কেন ইউটিউবে কিংবা এরিয়াল শট থেকে।

দ্বিতীয়তঃ ওটা গিগাফ্যাক্টরি তো বটেই, দুর্গও বটে। এমপ্লয়ী ছাড়া আর কেউ ওখানে মাথাটা গলাতে পারবেন না। আমাদের ওরিয়েন্টেশনের জন্য ওরা একটু পাশে কিছু ট্রেইলার জড়ো করেছিল, নইলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এসপিওনাজে ছেয়ে যেত হয়তো দুনিয়া। যাতায়াতের খরচ টেসলা বহন করেছিল আমাদের, উবার-ভাউচার, দুটো রাইডের জন্য, টু-অ্যান্ড-ফ্রম গিগাফ্যাক্টরি।

গিগাফ্যাক্টরির বিশালত্ব প্রকাশে একটা কথোপকথনই মনে হয় যথেষ্ট। আমাদের ওই মাগনা (টেসলার পয়সায়) উবার রাইডে সাথে ছিলো ঋভু ভাই (চুয়েট ’১০) আর জাবেদ ভাই (রুয়েট ’০৮) – আমি উনাদের দিকে ঘুরে কেবল বললাম, “ভাই, যদি ওয়েলকাম সেন্টারে পৌঁছাবার পর যদি দেখি টেসলার পোলাপান বলতেছে আমাদের ফ্যাক্টরির অন্যপ্রান্তে হেঁটে যেতে হবে, আমি ভাই সোজা দুসরা ভাউচার বের করে বাড়ি ফিরে যাবো। লাগবে না ডেমো দেখা।”

ম্যাসিভ!

দারুণ উপভোগ্য দিনটা আসলে উপভোগ্য হয়েছে মূলতঃ কথোপকথনের জন্য। প্রচুর আলাপ করেছি প্রচুর মানুষের সাথে। কিন্তু সেসব আলাপের টুঁ শব্দটাও বাইরে বলা যাচ্ছে না, এনডিএ। সঙ্গে পেলাম টেসলার মডেল কার, দারুণ একটা স্যুভনির। জীবন ভবিষ্যতে আমাকে যেখানেই নিয়ে যাক, দারুণ একটা দিন হিসেবে স্মৃতির পাতায় এই ২১শে এপ্রিল থাকবে বহুদিন।

টেসলাকে ধন্যবাদ।

* তবে সমস্যা হচ্ছে, কোনটা রাইট কাইন্ড অফ আউট অফ দ্য বক্স, আর কোনটা রং – তা জানা কঠিন। আউট অফ দ্য বক্স জিনিসটা অনেকটা হিট অ্যান্ড মিস।

** টেসলার ভেতরে হুদাই গুঁতাগুঁতি করার সুযোগ আমরা সবাই পেয়েছিলাম, সেই মুহূর্তের ছবি স্মৃতিতে ধরে রেখেছেন ঋভু ভাই।

 

ইরানী বালিকা

ইরানী বালিকার জন্য ডেরিক হলের বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। ল্যাবের কাজ আজ বাদ দিয়েছি তার সাথে দেখা করার জন্য। মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব ডিজাইন অফ এক্সপেরিমেন্টস কোর্সটা নেবার পর থেকে। বন্ধু, বড়ভাই ও ছোটভাই পই পই করে মানা করেছিলো ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের কোর্সটা নিতে। ম্যাথের মাস্টার্স লেভেলের কোর্স একটু কঠিন হয়ে থাকে একই কোর্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল এঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকেও করা সম্ভব ছিলো। তবে ওদের ক্লাস শুরু হতো সন্ধ্যা ৬টায়। এত ঢঙ করার উপায় আমার ছিলো না। কঠিনেরেই ভালোবাসিলাম। কয়েকটা ক্লাস করার পর বুঝলাম দাঁত ফোটানো অনেক সময় অসম্ভব হয়ে উঠছে। কেন সবাই পই পই করে মানা করতো তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। এলিয়েনদের মতো রঙ করা চুলের মেয়েটা আমাকে বাঁচালো। স্ট্যাটিস্টিকসের ছাত্রী।

যে কোর্সখানায় ভেবেছিলাম পাশ করাই দুষ্কর হয়ে উঠবে তাতে ওর কল্যাণে এ পেয়ে গেলাম। প্রফেসর সান রীতিমতো মাদার ফিগার, ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের মানুষদের মধ্যে এটা আমি দেখেছি। আমাদের এঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে সবাই দাঁত বের করে থাকে। যেন সুযোগ পেলেই কামড়ে দেবে। ম্যাথ ডিপার্টমেন্টে একটা স্নিগ্ধ-শান্ত পরিবেশ। প্রফেসর সানকে তার ছাত্রছাত্রীরা প্রফেসর না ডেকে পারলে আম্মু ডাকে। তিনি বিজ্ঞের মতো মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, “এই তো, এঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলেরাও কতো সুন্দর পারছে। গণিতের সৌন্দর্য এটাই।”
আমি মনে মনে বললাম, “বলেছে আপনাকে। মনি না থাকলে তো গেছিলাম।”

ওর অফিসে একদিন ধরে নিয়ে গেল। বললো, “চা খাও?”
বললাম, “আবার জিগায়।”
ব্যাপারটা হলো আকস্মিকভাবেই। আমেরিকায় আসার পর কফিখোরের সংখ্যাধিক্যই দেখেছি, মনি বোধহয় আমার দেখা একমাত্র অবাঙালি যে চায়ের জন্য কিছু আবেগ শেয়ার করে। আমাকে পেয়ে ও শুরু করলো এক্সপেরিমেন্ট। এইচ-ই-বির চিপাচুপিতে পাওয়া যায় খোলা স্পাইস, তাদের কীভাবে সে চায়ে রূপান্তরিত করে তা এক শিল্প। কোথাও ভেষজ কিছুর গন্ধ পেলেই সে সবার আগে গিয়ে তা সংগ্রহ করে ফেলবে। তারপর বানাবে ‘আর্বাল টি’। মনির সাথে আমার দেখা হতো মূলতঃ চায়ের দাওয়াত রক্ষা করতেই।

তবে আজ সে উদ্দেশ্যে আমি আসিনি।
আমি ঠিক করেছি, একটা ছোট্ট ভিডিয়ো বানাবো। আমার পরিচিত র‍্যান্ডম ইরানিয়ানদের মুখে শুনতে চাইবো কীভাবে তারা এই ভয়াবহ জঘন্য একটা পরিস্থিতিতে ঢুকে পড়েছে। তারা ক্যামেরায় তা বলবে। প্রয়োজনে মুখ না দেখিয়ে বলবে।

আমার উদ্দেশ্যে গতকালই পানি ঢেলে দিয়েছে এঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেণ্টের অন্য এক ইরানিয়ান ছাত্রী মারিয়াম, অর্ধেক ডিপার্টমেন্টের ক্রাশ। পয়লা সেমিস্টারেই শয়তানটা আমাকে ভিডিয়ো করেছিলো, কাজেই আমি যাদের ভিডিয়োতে রাখবো তার টপ থ্রিতে মারিয়ামের নামটাও এলো। অথচ সোজাসাপ্টা সে জানিয়েছে এমন কিছু হলে খারাপ হয় এমন নয়, তবে সে এটা করতে পারবে না। আমি তাকে মনে করিয়ে দিতে ভুললাম না যে তার চাঁদবদনখানা দেখাতেই হবে তা না। জবাবে মেয়েটা যা বলেছিল তা আমার বাকি জীবন মনে থাকবে।

“মানসিক অবস্থা খুব ভালো নয়। আমার মনে হয় না ভিডিয়ো বানাবার মতো শক্তি আমার আছে।”

কাজেই ল্যাবের কাজ ফেলে আমি এসেছি মনির সাথে দেখা করতে। আজকে স্রেফ চা খেতে নয়, আমাকে জানতে হবে ইরানে কী হচ্ছে। কেন মারিয়াম আমাকে একটা ত্রিশ সেকেন্ডের ভিডিয়ো দিতেও রাজি হলো না, এমনকি স্রেফ কণ্ঠ হলেও!

ডেরিক হলের বাইরে বেঞ্চে বসে আমাদের অনার সোসাইটির ডিসকাশন থ্রেডে STEM ফিল্ডে লিবারেল আর্টের ভূমিকা নিয়ে নানা আলাপ করে সময় পারছি, এ সময় একটা ঘটনা ঘটলো।

(টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আসার পর যে তিনটি ঘটনা আমার কাছে সেরা তিনে থাকবে তাদের মধ্যে এটি একটি। তবে এটা আমি হয়তো আত্মজীবনীমূলক আলাপে লিখবো। আজকের প্রসঙ্গ সেই ঘটনা নয়।)

২.
আমার জন্য ঘটনার শুরুটা হয়েছিলো বন্ধু আলীরেজার আইফোন থেকে। সে একজন ইরানি যুবক। সব সময় চিল। আমরা তাকে প্রায় মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করি সব সময় চিল হবার জন্য গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের বেশি একটা সুযোগ রাখা হয়নি। তার উচিত ঘন ঘন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া ও পানি খাওয়া। আমাদের নিষেধাজ্ঞাবাণীর থোড়াই কেয়ার করে আলি। কোথায় সুন্দর মেয়ে আছে এবং কোথাইয় ন্যাস্টি মদ আছে তার সবটা তার নখদর্পণে।

ওর সাথে পরিচয়ের খানিক বাদে নতুন কেউ অবশ্যই প্রশ্ন করবে, “কী ব্যাপার, আমরা তো ভাবতাম ইরানে মদ খাওয়া নিষিদ্ধ। তুমি তো কুমিরের মতো গেলো। শিখলে কোথায়?”
আলি চোখ টিপে বলতো, “প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক। এটা সত্য যে আমাদের দেশে মদ বিক্রি করা আইনসম্মত নয়। আর একই কারণে এটাও সত্য যে আমাদের প্রায় সবাই নিজেরাই মদ বানাতে পারি। একদিন হোম ডিপোয় চলো, মদ বানানোর সব সরঞ্জাম পাওয়া যাবে। তারপর এমন ঘরে বানানো মদ দেবো তোমাদের যে তাগ লেগে যাবে।”
অতিউৎসাহী কেউ যদি প্রশ্ন করে, “কিন্তু তোমাদের ধর্মে যে বলা হয়েছে ওটা হারাম? তোমরা কী করে -”
আলি হাসে, “স্ট্যাটিসটিকসে দেখবে নব্বইভাগ মুসলমান, তবে আমাদের জেনারেশনে অন্তত এমন না। সবাই কাগজে কলমে মুসলমান। কারণ ইসলামের বাইরে গেছে বললে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। আর মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আসলে আমাদের নব্বই পার্সেন্ট মুরতাদ।”

আলির কথা আমি অতোটা বিশ্বাস করিনি আমি। বাংলাদেশের ছেলে হয়ে জানতাম আমারও তাই মনে হয়। আমারও মনে হয় নব্বই পার্সেন্ট মুসললাম পরিসংখ্যানে থাকলেও আসলে আরবান অঞ্চলের মেজরিটিই ধর্মহীন। ইসলামী পরিবারে জন্ম নিলেও ধর্মটির নানা কদর্য দিক দেখে তা ছেড়ে দিয়েছে আমাদের বেশিরভাগ মানুষ। সহজ করে বললে, প্রতি বছর নতুন দশ হাজার মানুষের গায়ে টুপি আর বোরখা উঠে যদি, ত্রিশ হাজার মানুষ নাস্তিক হয়ে যায়, কিংবা আরও বেশি। ইরানের সাধারণ মানুষও নিশ্চয় বাংলাদেশের মতোই হবে, ধর্ম-টর্ম নিয়ে মাথা ঘামানোর যুগ ২০২২ সাল নয়। সরকার যা-ই হোক না কেন, ইরান কিংবা বাংলাদেশ পৃথিবীর বাইরে অবস্থান করে না। তাই বলে তরুণদের নব্বই ভাগ মানুষ নিশ্চয় নাস্তিক নয় ইরানের, ওটা আলির একটু বাড়িয়ে বলাই হবে – ভেবেছিলাম।

সেদিন আলি এসে বললো, “এই, ইরানের একটা মেয়েকে মেরে ফেলেছে বোরখা না পরার জন্য, শুনেছো?”
আমি মুখ ভার করে বললাম, “হ্যাঁ।”
ও অবাক হয়ে গেল, “আরে, আজ সকাল থেকে যাকেই প্রশ্ন করি বলে জানে না। তুমি কীভাবে জানো?”
বললাম, “আমাদের দেশেও এমন মাদারচোদ অনেক তো, মেয়ে কী পোষাক পরলো না পরলো তা নিয়ে অনেক বানচোতেরই মাথায় অনেক ব্যথা। কাজেই আমরা এইসব খবরে খুব সজাগ দৃষ্টি রাখি যেন আমাদের দেশটায় এসব কখনো মাথাচাড়া না দিয়ে ওঠে।”
একটা ভিডিয়ো দেখালো আলি, “দ্যাখো তারপর ইরানের প্রত্যেকটা শহরের প্রত্যেকটা রাস্তায় কীভাবে মানুষ নেমে এসেছে। আমাদের মোরাল পুলিশকে কীভাবে চুদলো জনগণ দেখাই দাঁড়াও।”

অসংখ্য ভিডিয়ো দেখলাম তারপর আমরা, পুলিশকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দিচ্ছে জনগণ।
আলি বলে যাচ্ছে, “এরা গত কয়েক দশক ধরে আমাদের ছাড়খার করে দিয়েছে। ইরানের ভেতর কোন বালই করতে পারবা না। আমাদের দেশটা কিন্তু এমন ছিলো না। এত দারুণ ইতিহাস আমাদের অথচ ইসলাম ঢুকে সব শেষ করে দিয়েছে।”

ইসলাম ঢুকে ইরানকে শেষ করে দেয়ার কথা আলি সুযোগ পেলেই বলে। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বলে। এমনকি পাবলিক স্পিচেও বলে। গত সেমিস্টারে ইরানি প্রফেসর ডক্টর আসিয়াবানপুর ছিলেন আমাদের একটি কোর্সের ইনস্ট্রাক্টর। অ্যাডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং। ওতে একটা প্রেজেন্টেশন ছিলো – কালচারাল প্রেজেন্টেশন। জনতার ভোটে একজন তা জিতবে। সেই প্রেজেন্টেশনে আমি নিজের বইপত্র লেখা, স্ক্রিনপ্লে রচনা, অনুবাদসহ যাবতীয় ক্রিয়েটিভ কাজ প্রেজেন্ট করেছিলাম। নিরঙ্কুশভাবে জিতেছিলাম এবং পেয়েছিলাম কেয়া কসমেটিকসের সৌজন্যে একটি মগ, যা দিয়ে আমি আজও চা খেয়ে থাকি। তবে সেই প্রেজেন্টেশনে আলিও ছিলো। ও প্রেজেন্ট করেছিল ইরানকে। এবং ঘরভর্তি লোকজনের সামনে সে সরাসরি বলেছিল, “ইসলামের হানাদার অনুপ্রবেশের পর থেকে সব বদলে গেছে। তবে আমাদের দেশটা এমনভাবে সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ছিলো।”

প্রেজেন্টেশন শেষ হওয়ার পর ওকে রিজুল প্রশ্ন করেছিল, “কী রে ভাই, সরাসরি ইসলামরে যেমনে সাইজ করতেছিলা, এমনে না করলেও পারতা।”
আলি বলেছিল, “শুয়োরের বাচ্চারা আমাদের দেশটাকে আসলেই শেষ করে দিয়েছে।”

দুই দিন আগে আলি আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে কিছু নতুন ইন্সটা রিল শেয়ার করলো। যেখানে মেয়েদের সাথে মোরাল পুলিশ কী করে তার নানা ভিডিয়ো দেখা যাচ্ছে। আলির মেসেজটা ছিল সংক্ষিপ্ত, তবে স্পষ্ট, “তোমাদের দেশটাকে আমাদের মতো হতে দিয়ো না। যে কোন মূল্যে ইসলামি উত্থান ঠেকিয়ো।”

আলির সাথে নানা লিকড টেলিগ্রাম ভিডিয়ো দেখছিলাম আমি ল্যাবে বসে। ইরানের তরুণরা পুলিশকে – আমাদের ভাষায় – ‘চুদে খাল’ করে দিচ্ছে, যেমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি। ইরানের মেয়েরা ইরানের রাস্তায় হিজাব টেনে ছিঁড়ে আগুনে ফেলে দিচ্ছে, যেমনটা চিন্তা করার সাহসও আগে করা যেত না। ইরানের শাহবাগ নেই, তবে ইরানের তরুণরা আসলে ইসলামকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ঘৃণা করে, এবং আলি ৯ টা মাস আগে আমাদের যেভাবে বলেছিল তরুণদের ৯০ ভাগই আসলে নাস্তিক প্রকৃতির – ইসলামকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে একটা নোংরা ময়লার মতো – তা একেবারে মিথ্যা বলে আর মনে হচ্ছিল না আমাদের।

৩.
মনির সাথে দেখা করতে করতে প্রায় দুটো ঘণ্টা দেরি হয়ে গেল। ডেরিক হলে তার অফিস প্রফেসর ইমামির সাথে। দিলখোলা এক ভদ্রমহিলা, স্বামীপ্রবর ইলেকট্রিকাল এঞ্জিনিয়ার, কিছুদিন আগে উনি একটি বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানিতে আরও একটা প্রমোশন পেয়েছেন। এখন তাঁর ওপর আছে কেবল সিইও। এখানে চায়ের জন্য এসেছি অনেকবার, প্রফেসরের সাথে আলাপ হয়েছে অনেক। উনার আইফোনটা নিউজিল্যান্ড থেকে কীভাবে কিনেছিলেন তার গল্প শুনতে হয়েছিল তাদের ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্সের হিসেব নিতে গিয়ে। চমৎকার একজন শিক্ষক। আজ মনির অফিসে গিয়ে উনাকে অবশ্য দেখলাম না। অফিসের দরজাটা হা করে খোলা।

ভেতরে দুষ্ট প্রকৃতির এক আফ্রিকান আমেরিকান বাচ্চাকে তখন অঙ্ক কষাচ্ছে মনি। বেচারার গাণিতিক ধারণার অবস্থা খুবই করুণ মনে হলো। এক থেকে দুই বিয়োগ করলে যে তিন নয়, নেগেটিভ ওয়ান হবে তা তাকে বোঝাতে গিয়েই বেচারির খবর হয়ে যায়। কাজেই আমি আমার বাচ্চাকাচ্চাদের গ্রেডিংয়ের দায়িত্ব তুলে নিলাম নিজের কাঁধে। বাচ্চাকাচ্চা বিদায় করতে আরও সময় লাগলো।

তারপর ও জানতে চাইলো, “তোমার খবর-টবর কি? ঘুমাও টুমাও না মনে হচ্ছে।”
হেহে করলাম। বললাম, “সখ করে তো আর জেগে থাকি না। ঘুমাতে পারি না আরকি। ডাক্তাররা একে বলে রেস্টলেস থটস।”
মনি বললো, “কীভাবে পারো জানি না, ভাই। না ঘুমালে আমার মাথা কাজ করে না।”
আমি বললাম, “আমার করে। তোমার কী খবর? ক্যাম্পাসে আসছো কখন আজ?”
ও জানালো, “সকাল আটটায়। তারপর জিমে গেলাম। ভালো কথা, আমার সাথে জিমে আসো। তোমার ঘুম আসবে না মানে! তোমার বাবারও ঘুম চলে আসবে।”
আমি হাসলাম, “সেজন্যই তো যাবো না। জিমে গেলে আমার এই কম ঘুমানো, কম খাওয়া লাইফস্টাইল আর সাপোর্ট করতে পারবো না।”
“ও হ্যাঁ। তুমি তো আবার খাও না। আমার এইটা দরকার। দিন দিন হাতি হচ্ছি।”
এবার সত্যিই হেসে ফেললাম, “দুনিয়াতে একটা মেয়েও দেখি নাই যে এইটা দাবী করে না। মোটেও হাতি হচ্ছো না তুমি। তবে আমার মনে হয় মেয়েরা এমনটা দাবী করে যেন সামনে যে আছে সে বলতে পারে সে হাতি হচ্ছে না।”
মনি বললো, “আরে নাহ, দুই বছর আগে আমাকে দেখোনি তাই এমন বলছো। তোমার পেছনের দেয়ালটা দেখো।”

তাকালাম। অনেকগুলো ছবি সাঁটানো। পারিবারিক ছবি। অনিন্দ্যসুন্দর কিছু মেয়ে আর সিনিয়র দুই প্যারেন্টস।
“দ্যাখো কত্তো স্লিম ছিলাম। ওই জায়গায় ফেরার চেষ্টা করছি এখন আবার।” সবগুলো ছবি দেখালো আমাকে ও, “আমার দুই বোন। এটা আব্বু। এটা আম্মু। আর এই যে আমাদের বেড়ালটিকে আমরা ছেড়ে দিয়েছি গ্রামের প্রকৃতিতে। তবে এটা তার আগের ছবি।”
অবাক হয়ে গেলাম, “তোমরা ছেড়ে দিলে আর চলেও গেল? অকৃতজ্ঞ বেড়াল তো!”
ও আরেকটা ছবি দেখালো। কয়েকটা পিচ্চি। বললো, “বদের আখড়া। আমার কাজিন আর নিফিউয়ের দল। এদের মধ্যে কে যেন বেড়ালটাকে প্যারা দিয়েছিলো। তাই চলে গেছে।” তারপর মনি আসল কথায় চলে এলো, “একটা নয়া ফ্লেভার পেয়েছি। ওটাকে চা করার ইচ্ছে আজ। কোনটা খাবে? ল্যাভেন্ডার না *&& -”

শেষ ফ্লেভারটার নাম উচ্চারণও করতে পারলাম না। কোত্থেকে কোত্থেকে এই মেয়ে যে নানা ভেষজ জিনিস আবিষ্কার করে জানি না। হাজারো শোকর যে সে তাদের চা বানিয়ে খায় এবং খাওয়ায়। যেদিন আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া বানিয়ে খাবে ও খাওয়াবে সেদিন বাঁধবে বিপত্তি।

আমি কেবল মিনমিন করে বললাম, “চা খেতে তো আসিনি, এসেছিলাম তোমাদের গ্যাঞ্জাম নিয়ে আলোচনা করতে।”

সাথে সাথে মনি খেয়াল করলো, দরজা এখনো হা করে খোলা, বাইরের করিডোরের যে কেউ আমাদের আলাপ শুনতে পারবে। চটজলদি দরজা লাগিয়ে লক করে দিলো ও। বাইরে থেকে যে কেউ এই দৃশ্য দেখলে নানা গল্প ফাঁদবে সন্দেহ নেই, ওদের মোটা মাথায় ঢুকবে না আমরা এখানে বিপ্লবের আলাপ করছি। ওকে এমন আতঙ্কিত হয়ে উঠতে অবশ্য আমি আগে দেখিনি। কেবল পরিবেশ হাল্কা করতে হেহে করে বললাম, “ও হ্যাঁ, আমরা তো এখন সিআইএ।”

মনি বললো, “তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আমি এখানে একটা ভিডিয়ো বানালে আমার পুরো পরিবারকে ওরা শেষ করে দেবে না? ওরা তো সবাই ইরানে!”
আমি বললাম, “তোমার তো চেহারা যাবে না।”
ও বললো, “তাতে কী? তোমার সব সোশাল মিডিয়া আমি দেখেছি। সবগুলোতে তোমার আসল তথ্য দেয়া। আমরা যে সব এক শেয়াল তা যে কেউ জানবে। তোমার ভিডিয়ো যদি ইন্টারন্যাশনালি ভাইরাল হয় বুঝেই তো যাবে টেক্সাস স্টেটের কোন মেয়ে তা করেছে। যদি কোন কারণে আমাকে বের করতে চায় অবশ্যই বের করতে পারবে। আর সে ক্ষেত্রে আমার ফ্যামিলির জন্য তা মৃত্যু।”

অজান্তেই আমার চোখ চলে গেল পেছনের দেয়ালে। অনেকগুলো ছবি সাঁটানো। পারিবারিক ছবি। অনিন্দ্যসুন্দর কিছু মেয়ে আর সিনিয়র দুই প্যারেন্টস।

আমি বললাম, “কমফোর্টেবল না হলে অবশ্যই করবে না। আমি কেবল ভেবেছিলাম আমার জনগণকে দেখাই আমি র‍্যান্ডমলি যে কয়জন ইরানিকে চিনি তাদের মধ্যে চিন্তাধারা কেমন। অ্যাক্টিভিস্টদের বা সাধারণ মানুষদের যারা এখন কথা বলছে তাদের চিন্তাধারা আর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যারা আমাদের চারপাশেই আছে তাদের চিন্তাধারায় যে একটা মিল আমরা দেখতে পাই এটা আমার দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে এসবই ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।”

“আমি ভিডিয়োতে এলেও ওরা বলবে, আমরাও ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছি।”
“তা হয়তো বলবে, তবে প্রেজেন্স, ওয়ার্ডস আসলে চেঞ্জে হেল্প করে। সত্যি বললে এই ভিডিয়োটা আমি করতে চাইছিলাম আমাদের দেশের মানুষের জন্য, মূলতঃ – কারণ তোমাদের মতো না হলেও আমাদের দেশে ইসলামী একটা শক্তি থাবা পাতার চেষ্টা করছে অনেকদিন ধরেই। ওটার পরিণতি কী ঘটে তা আমার দেশের লোকের জানা দরকার।”

ওকে ব্লগার হত্যার আলাপ শোনালাম। নরসিংদীতে কিছুদিন আগে পোষাক নিয়ে কী ঘটেছিল বললাম। জানালাম তারপর আমাদের নির্লজ্জ আদালত কী বলেছে। যোগ করলাম, “এমনটা আদালতের বা রাষ্ট্রের বলার কথা নয়। বলেছে কেন জানো? ওই ইসলামি অপশক্তি সাধারণ মানুষকে খুব ইসলামের জন্য গর্বিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারই প্রভাবে আমাদের এমন জাজ আছে যারা ওদের ঘেঁষা। এমন আর্মি অফিসার আছে যারা ওদের ঘেঁষা। গভর্নমেন্ট অফিশিয়াল থেকে শুরু করে রাস্তার টোকাই – সবখানে কিছু লোক আছে যারা মনে করে ইসলামের শরিয়ত ভালো। ধর্মটা সবাইকে চাপাতে হবে। আমরা এখন লাস্ট লাইন অফ ডিফেন্স। সমস্যা হলো আমাদের সরকারও করাপ্ট।”
ও বললো, “তোমাদের সরকারের থেকে বিপদটা কেমন?”
বললাম, “আজকে যদি ফেসবুকে লেখো এই সরকার অবৈধ ও ভোটহীন নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছে, তোমার কপাল খারাপ হলে কালই এর জন্য গ্রেফতার হয়ে যাবে ও সাজা হবে ৭ বছরের জেল।”
মনি একমত হলো, “এই সমস্যাতে আছে বাকিরা। তবে আমার মতে, এরা ইসলাম বা ধর্মীয় শাসন থেকে অন্তত ভালো।”

হা হয়ে গেলাম।
টেক্সাসের মাটিতে বসে একজন ইরানি বালিকার মুখ থেকে আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ সমর্থন আশা করিনি।
ওকে শুধু বললাম, “চমৎকার। তোমাকে এই মুহূর্তে টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রলীগের সভাপতি পদে মনোনয়ন দেয়া গেল।”
বিভ্রান্ত দেখায় ওকে। এত বড় সম্মান আশা করেনি।

আমি বললাম, “জানি না কী করা উচিত। আসলে জানি। আমি জানি এই ভিডিয়ো বানিয়ে আসলে লাভ নেই কোন। একমাত্র কাজের কাজ করছে যারা এই মুহূর্তে ইরানের রাস্তায় আছে। আমরা স্রেফ সার্ভাইভারস গিল্টে ভুগছি। ভালো কথা, তোমাদের এই আন্দোলনের ভেতরের খবরটা বলো তো। কোন লিডারশিপ কি গ্রো করছে? এমন গণমানুষের আন্দোলনে সব সময় লিডারশিপ গড়ে ওঠে, যারা বদলে দেয় একটা দেশকে।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বললাম। মুক্তিযুদ্ধের কথা বললাম। ইসলামের চোদন থেকে আমরা কীভাবে মুক্তি পেয়েছিলাম জানালাম। ঠিক তখনই আমার চেনা একজন খুব সাধারণ স্ট্যাটিস্টিশিয়ানটি আমাকে একটা অসাধারণ প্রশ্ন করলো।
জানতে চাইলো, “পেয়েছো নাকি?”
বোকা বনে গেলাম, “কী?”
“মুক্তি?”
থতমত খেয়ে গেলাম আমি। খুব সত্য কথা। খুবই সত্য কথা।
বললাম, “খুব অল্প সময়ের জন্য পেয়েছিলাম। দেশ এখন তোমাদের পথে হাঁটছে।”

মনি এখন আর আমার দিকে তাকাচ্ছে না। সামনের দেয়ালের দিকে তাকালো ও। সব সময় হাসিখুশি মেয়েটাকে এত দুঃখী দেখালো যে আমি ওর দিকে আর তাকাতে পারলাম না।

মনি এখন যেন নিজের সাথে কথা বলছে।

“আমার মনে হয় ওই রাস্তার আন্দোলনেও কাজ হবে না। আমার মনে হয় ওই মাটি নষ্ট হয়ে গেছে। যত যাই করো কিছু বানচোতই ওটা শাসন করবে। ধর্মের পতাকা নাড়বে। কিছুতেই আসলে কিছু লাভ নেই। ছোট যখন ছিলাম তখন হায়ার স্টাডির ব্যাপারে যা জানতাম সবই আমাদের ইসলামী আগ্রাসনের আগের যুগের গল্প। লাখ লাখ ইরানি ছেলেমেয়ে তখন আমেরিকায় পড়তে আসতো। ইংল্যান্ডে যেত। আবিষ্কারের আনন্দেই যেত। আর এখন?”

মনির গলাটা ভেঙে গেল, ওর দিকে আবার তাকালাম, ওর চোখে পানি টলমল করছে। বলে যাচ্ছে এখনো, “আমি এখানে এসেছি পালিয়ে। তুমি হয়তো কথা বলতে পারো, তুমি গায়েব হয়ে গেলে কথা হবে – তুমি তোমার দেশে, ইন্ডিয়ায় কিছু পরিচিতি পেয়েছ। আমি হলে? আমি হলে কেউ জানবেও না। আমি কত্ত কিছু করতে চেয়েছিলাম। এই প্রটেস্ট শুরুর পরও কত কী বলতে চেয়েছিলাম। পারিনি। আমার ফ্যামিলির সবাই আমাকে বলেছে দেশের জন্য যদি কিছু করতে চাই তাহলে আমার উচিত হবে এখানে ডিগ্রি নেয়া, চাকরিতে ঢোকা, গ্রিন কার্ড পাওয়া এবং সিটিজেনশিপের জন্য আবেদন করা। তার আগে আমি কিছু বললেই আমার বিপদ। একদিন হয়তো আমেরিকা আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেবে, তখন আমাকে মেরে ফেলবে। দেশে পাঠাবার আগে আমার পরিবারের সবাইকে বেঁধে নিয়ে যাবে। আমাদের দেশে এত ট্যালেন্টেড মানুষ ছিলো, আছে, অথচ এই সময়ে এসে আমরা কীসের জন্য আন্দোলন করছি? চুল দেখানো বা না দেখানোর স্বাধীনতা নিয়ে। এই যে আন্দোলনটা হচ্ছে, অনেকে মারা গেছে এরই মধ্যে। আরও মারা যাবে। অনেক মানুষ মরবে এই আন্দোলনে। আমার সরকারকে আমি চিনি। যে কয়জন মারা গেছে তাও আমরা টেলিগ্রামের সিক্রেট গ্রুপগুলোর কারণে, ইরানিদের যারা আমেরিকার সিটিজেনশিপ পেয়েছে তাদের সাহসী কণ্ঠের জন্য জানতে পারছি। কত কিছু জানতেও পারছি না। এতসব হচ্ছে কীসের জন্য? কিছু শুয়োরের বাচ্চা তাদের ক্ষমতা আর বিত্ত ধরে রাখতে এটা করছে। ধর্ম নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে করো? পৃথিবীতে যে কোন জায়গায় যে কেউ যখন ধর্ম পালন করার বদলে বা পাশাপাশি অন্যকে ধর্ম পালনে বাধ্য করে – তখনই বুঝে নেবে এ থেকে তারা আখিরাতের নয়, দুনিয়ার লাভই খুঁজছে। আমরা যখন রাস্তায় লড়ছি, ওরা ওদিকে আখের গোছাচ্ছে।”

আমাকে একটা ইমেইল বের করে দেখালো মনি, “দ্যাখো। টেক্সাস স্টেট আমাদের ইমেইল করে বলেছে যে কোন মানসিক সমর্থন দেবে। কিন্তু কোন দেশের সরকার কোন অফিশিয়াল স্টেটমেন্ট এখনো দেয়নি। মানসিক সমর্থন! কী লাভ? কাউন্সেল করে কিছু হবে? ওরা কী আমাদের যন্ত্রণাটা বুঝবে? যদি বুঝেও, তাতে কী হবে? রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে?”

ওকে এই প্রশ্নের উত্তরটা দিতে পারলাম না।
ইরানি নাগরিকটির প্রতিটা কথাই আমি বুঝতে পেরেছি।
মনি তখন দেয়াল দেখছে। তার গলা ভাঙা। চোখে পানি।

আমি পাষাণহৃদয় মানুষ, জড়িয়ে সান্ত্বনা দেবার মানুষ নই। কাজেই কেবল বললাম, “আমাদের আসলে দরকার ছিলো আয়রন ম্যানের স্যুট। গিয়ে এক রাতে সরকার ফেলে দিলে আর কোন সাধারণ মানুষকে মরতে হতো না। ডেমোক্রেটিক ইরান পেয়ে যেতাম। আর লিখে রাখতে পারো, ইরানের পথে যারা আছে তারা সরকার ফেলে দিতে পারলে আগামিকালই আমেরিকা ওই সরকারকে স্বীকৃতি দেবে।”

মনি আমার দিকে ঘুরে তাকালো, লক্ষ্য করলাম চোখজোড়ায় শোকের থেকে শক্তির পরিমাণ অনেক, অনেক বেশি।
ও কেবল ছোট্ট করে বললো, “আমাদের জনগণ রাস্তা সহজে ছাড়বে না। এই সরকার বিদায় হবার আগে নয়।”

আমার যদিও অনেক সন্দেহ আছে এ ব্যাপারে – কারণ ওদের লিডারশিপের জায়গাটি নেই। ভালো লিডারশিপ ছাড়া লম্বা সময় ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে লক্ষ্য করলাম, আমার মন এতশত যুক্তির আলাপ বুঝতে পারছে না। সে চাইছে ইরান বদলে যাক। মুক্তি পাক।

তবে মনে পড়ে গেল আজকের শোনা সবচেয়ে গভীর প্রশ্নটা।
অতি সাধারণ, রাজনীতি থেকে সব সময় দূরে থাকা এক পরিসংখ্যানের ছাত্রী আমাকে যে প্রশ্নটা করেছিল।
মুক্তি পেলেও, কতক্ষণের জন্য?

বিকালের দিকে মনি বাস ধরতে চলে গেল। আমি রওনা দিলাম আমার অ্যাপার্টমেন্টের দিকে। ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম এক আপু ছবিটা পোস্ট করেছেন। এক ইরানি মেয়ে তার জামা খুলে প্রতীকি প্রতিবাদ জানিয়েছেন পোষাকের স্বাধীনতার। শ্রদ্ধায় আমার মাথা নিচু হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল, অনেক অনেক আগে কবি নজরুল লিখেছিলেন –

ইরানী বালিকা যেন মরু-চারিণী
পল্লীর-প্রান্তর-বনমনোহারিণী
ছুটে আসে সহসা গৈরিক-বরণী
বালুকার উড়নী গায় –

(আমি অনেকবার বলেছি, বাংলাদেশের পরবর্তী সফল আন্দোলন ছাত্রলীগ করবে না, ছাত্রদল করবে না, মুসলমানের পাল করবে না, তা করবে বাংলাদেশের মেয়েরা। কেন বলেছিলাম তা ইরানিরা দেখিয়ে দিচ্ছে। তাদের সফলতা কামনা করি।)

আত্মকথা – ২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০২২

#MahsaAmini

ক্যানিয়ন লেকে এক সন্ধ্যাবেলা

দুটো চকচকে তরুণী ঝকঝকে হাসি হেসে আমাদের সাথে বেশ গায়ে পড়ে আলাপ করতে এলো। ঝলমলে চুল নাড়িয়ে একজন জানতে চাইলো, “তোমাদের তো আগে কখনো দেখিনি। নয়া মাল নাকি?”

মান্দেশ আর আমি হেহে করলাম, “ওই আরকি। টেক্সাস স্টেটের গর্বিত সন্তান আমরা।”
“ছবি তোলা কেমন হচ্ছে?” আগ্রহের সাথে আরেকজন জানতে চাইলো। উঁকিঝুঁকি মেরে আমাদের ভিউ ফাইন্ডার দেখার চেষ্টাও করলো একটুখানি। আমরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। ভাবনাখানা, ক্যামেরা দেখলে তরুণীরা বেশ উৎসুক হয়ে ওঠে – এই কথাটা মনে হচ্ছে মার্কিন মুলুকেও খুব একটা অমূলক নয়। পীথাগোরাসের সূত্রের মতোই সবখানে খাটার মতো জিনিস। তবে ঘটনা তখনও আরও বাকি ছিলো খানিক।

আমরা দুই বাউন্ডুলে এখানে এসেছিলাম নেহায়েতই ভালো উদ্দেশ্যে। ছবি-টবি তুলবো। বিদায় হবো। মেয়ে আমাদের সিলেবাসে ছিলো না। কিন্তু দেখা গেল সিলেবাসের বাইরের প্রশ্ন এসে পড়েছে।

ঝলমলে চুলের অধিকারিণী আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ালো। জানতে চাইলো, “কিন্তু স্যান মার্কোসেই কী তোমরা থাকো?”

আমরা এই প্রশ্নের মানে বুঝতে পারলাম না এমন নয়। সেদিন বাস স্টেশনের বাইরে একজন সমকামী কৃষাঙ্গের পাল্লায় পড়েছিলাম। সেখান থেকে বিষয়টা একটু শিখতে হয়েছে। সখে নয়, দেখেও নয়, ঠেকে।

সেদিন আমি যাচ্ছিলাম ভাইয়ার বাসায়। অস্টিনে বাস থেকে নেমেছি। ভাই আমার পরিষ্কার ভদ্রলোক। হারাম খায় না, ত্রিশ মাইল ড্রাইভ করে হলেও সে হালাল শপ খুঁজে বের করবে, সিগারেট কিংবা মদ থেকে তাকে সর্বদা তিনশ’ মাইল দূরে পাওয়া যাবে। একেবারে সাচ্চা ঈমানদার লোক। অথচ আমার আবার ওই – সিগারেটটা না হলে চলে না। কাজেই এক ঘণ্টার বাস জার্নির পর নেমেই ভাইয়ার গাড়িতে উঠে যাবো এমন বান্দা আমি নই। সামনের দরজা দিয়ে বের না হয়ে বেরিয়েছিলাম পেছনের দরজা দিয়ে। উদ্দেশ্য, এখানে একটা ফুঁকে সামনে চলে গেলেই হবে। কেউ জানবে না।

ভারতীয় সাধুর মতো বেশ লম্বা চুল আমার তখন। কাকের বাসা হয়ে গেছে এরই মধ্যে। দরজা খুলে বাইরে থামতেই আমেরিকার পতাকার মতো পত পত করে উড়তে শুরু করলো তারা। প্রবল বাতাসে লুঙ্গি পরা কেউ থাকলে তাদের লুঙ্গি নির্ঘাত উড়ে যেত আকাশে। সৌভাগ্যক্রমে পান্তুলুন না পরা কাউকে এলাকায় দেখা গেল না। কায়দা করে একটা সিগারেট ওই ঝড়ো বাতাসেও ধরিয়ে ফেললাম। রুয়েটে যখন পড়তাম এমনটা প্রায়ই করতে হতো। আমার ঘরে কোনও ভেন্টিলেটর ছিলো না। ছয় ফিট বাই সাত ফিটের একটা কুঠুরিমতো ঘর। রাজশাহীর গ্রীষ্মকালে তা হয়ে উঠতো সাক্ষাত জাহান্নাম। বাইরে তাপমাত্রা যখন উঠতো পয়তাল্লিশ, আমার ঘরের ভেতরে তা থাকতো পঞ্চাশ।

কাজেই প্রাণে বাঁচার তাগিদে আমাকে দুটো ফ্যান চালিয়ে রাখতে হতো। একটা মাথার ওপর, আরেকটা টেবিল ফ্যান, আমার নাক বরারবর তাক করা। যেহেতু ভেতরে জায়গা তেমন ছিলো না, ফিল্টারটাকে মাটিতে রেখে তার স্ট্যান্ডের ওপর তুলে দিতে হতো ফ্যানের গোড়া। প্রবল বাতাসে আমার কানে কোনও শব্দ ঢুকতো না। তবে শোব্দ না ঢোকার পেছনে আরো কারণ ছিলো। বাস্তবতা থেকে পালিয়ে থাকার জন্য আমি সহায়তা নিতাম হেডফোনের। সারাটাদিন ও সারাটা রাত আমার কানে চলতো উঁচু তালে ও লয়ে বাজতে থাকা কোনও না কোনও পপ কিংবা রক মিউজিক। আইসোলেশন ও দুনিয়ার জাহান্নামে মানিয়ে নেয়ার পাশাপাশি আমাকে আরো একটা বিষয়ে ট্রেনিং নিয়ে ফেলতে হলো অচিরেই। তা হলো, প্রবল বাতাসেও ম্যাচে একটা কাঠি খরচ করে সিগারেট জ্বালিয়ে ফেলার প্রশিক্ষণ। আমার ঘরে অন্যান্য বন্ধুবান্ধবরা আসতো। তারা এটা নিয়ে বেশ অবাক হয়ে যেত অবশ্যই। কারণ তাদের সৌভাগ্য হোক কিংবা দুর্ভাগ্য – তাদের কখনোই আমার মতো যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে হয়নি। একবারব বন্ধু কাফি এসে বললো, “আমিও ধরাবো।”
তাকে বললাম, “ধরা না, কে মানা করছে তোকে।”
কাফি চেষ্টা করলো। পারলো না। তারপর ঐ দিন যতগুলো সিগারেট আমরা কজেয়েছি, ততগুলোই সে ধরাবার চেষ্টা করেছে। প্রথম কিছুবার তেমনটা না পারলেও দু’ঘণ্টার মধ্যে শিখে ফেললো। এই অল্প সময়ে আমরা কতগুলো সিগারেট খেয়েছিলাম তা জিজ্ঞাসা করে লজ্জা দেবেন না।

কাজেই, অস্টিনে বাস স্টেশন থেকে বের হয়ে নিদারুণ দক্ষতায় লুঙ্গি-ওড়া-বাতাসে আমাকে সিগারেট ধরাতেই হতো এবং তা ধরাতে হতো বেশ কায়দাকেতা করে। নিজের সুনাম তো ধরে রাখতে হবে। এমন নয় যে কেউ সে ট্র্যাকের রেকর্ড রাখছে, তবুও আত্মসম্মান বলেও তো একটা ঘটনা আছে। বিড়িটা ধরাতে না ধরাতেই দেখলাম ধরা পড়ে গেছি।

পার্কিং লটের শেষ প্রান্তে এক দীর্ঘকায় কৃষাঙ্গ ব্যক্তি, আমার দিকে ঝকঝকে হাসি হেসে তাকিয়ে আছে। তারপর… তারপরই – হ্যাঁ, হাত নাড়া শুরু করলো। আমিও ভদ্রতা করে একবার হাত নাড়লাম। এমনটা এখানে সবাই সবাইকে করে। চোখে চোখ পড়ে গেলে একটা হাই কিংবা ওয়েভ – এমনটা না করাই অভদ্রতা। এমন নয় যে মাঝে মাঝে আমরা অভদ্রতা করি না। সব সময় এতো রাজা রামমোহন রায় মার্কা সামাজিকতা রক্ষা করার মুড অবশ্যই থাকে না। এমন নয় যে এমনটা কেবল আমার সাথেই হয়ে থাকে, এখানে যারা আছে এবং পুরোদস্তুর সাদা চামড়ার, তারাও মন মেজাজ খারাপ থাকলে আপনার দিকে তাকিয়েও একটা হাত না নাড়িয়ে চলে যেতে পারে। তবে প্রচলিত প্রথা হিসেবে এমনটা কেউ করছে মানে এই নয় যে আপনার সাথে শোয়ার জন্য সে মারা যাচ্ছে। কাজেই আমিও স্বাভাবিকভাবেই হাত নাড়াবো এমনটাই ঘটার কথা।

কিন্তু ওকি, সে এগিয়ে আসছে দেখা যায়। একেবারে আমার তিন ফিটের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে গেল ভদ্রলোক। তারপর বললো, “আমি তোমার ব্যাপারে জানতে চাই।”
আমি খাঁটি বাংলায় বললাম, “আকাশ ভরা তারা, আমার হোগামারা সারা।”
সে জানতে চাইলো, “তোমার প্রিয় রঙ কি, যুবক?”

হাত নাড়ার বাতিক ওদের থাকতে পারে, তবে আপনাকে দেখলেই যে প্রিয় রঙ জানতে চাইবে এবং গলাভর্তি মধু নিয়ে “আমি তোমার ব্যাপারে আরো জানতে চাই” বলে বসবে এমন নয়। এমনটা তারা করে থাকলে বুঝবেন, ইঙ্গিত দেয়া হয়ে গেছে, এরপর আরো শরবৃষ্টি আসার সম্ভাবনা আছে।

এলোও। কৃষাঙ্গ ভদ্রলোক একেবারে গায়ে পড়ে আমার ব্যাপারে নানা প্রশ্ন করা শুরু করলেন। পাছাটা না মেরে যেতে দেবেন এমন লক্ষণই নেই। কাজেই আমাকেও ডিফেন্সিভ শট খেলে যেতে থাকতে হলো। এমনও নয় যে সরাসরি আমাকে কিছু প্রস্তাব তিনি করছেন। এক পর্যায়ে জানতে চাইলেন, “হোয়ার আর ইউ ফ্রম, ম্যান?”

ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। ঠিক তেমনটা ইঙ্গিত পাওয়ারই কথা আমি ক্যানিয়ন লেকের ব্যাপারে বলছিলাম। আমার এই খাঁটি ইন্ডিয়ান চেহারাখানা দেখে তারা জানতে চায় আমরা বিদেশী কি না, বাইরে থেকে এলাম কি না, এলেও বা কোত্থেকে এসেছি, ইত্যাদি।

রহস্যময় সমকামী যুবককে ঠিক তাই উত্তর দিলাম, ঢাকার যে কোনও মেয়ে অচেনা গায়ে পড়া লোকের পকপকানির পর অতিষ্ঠ হয়ে যেটা উত্তর দেয়। “মিরপুরেই থাকি, আমার দাদার বাড়ি এখানে।”

আজ্ঞে না, আমার উত্তর ওটা ছিলো না। ওটা হয় ঢাকায় অতিউৎসাহী জনতার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য দেয়া মেয়ের উত্তর। আমার উত্তর হলো, “আম ফ্রম স্যান মার্কোস, ব্রো।”

ভুলেও বলা যাবে না যে আমরা এসেছি বাংলাদেশ থেকে। এমন নয় যে আমাদের অ্যাকসেন্টে আমরা ধরা পড়ে যাচ্ছি না। তবে তারপরও কথা থাকে। আপনি যখন বলবেন আপনি স্যান মার্কোস থেকে এসেছেন তখন ওরা অন্তত ধরে নেবে এখানে গত ৫ বছর ধরে হয়তো আছেন। অথচ আমি তখন এখানে এসেচি দেড় মাসও হয়নি, মানে গোটা মার্কিন মুলুকেই। সেটা তো আর আমার পাছার দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি দেয়া সমকামী ভদ্রলোককে বলা যায় না। কাজেই এভাবে চাপ মারতে হলো।

তবে ক্যানিয়ন লেকের বাঁধের ওপর দু’দুটো ক্যামেরা বাগিয়ে থাকা আমি আর মান্দেশ মেয়েদের সামনে অবশ্যই মিথ্যে চাপাবাজির চেষ্টা না করে স্বীকার করে নিলাম, “আমি এসেছি বাংলাদেশ থেকে। মান্দেশের টেক্সাস স্টেটেই আন্ডারগ্র্যাড।”

সোনালিচুলো আরো দ্বিগুণ উৎসাহে বললো, “আহ, দুনিয়াজুড়ে দৌড়াদৌড়ি – কী এক অ্যাডভেঞ্চার তোমাদের জীবনে। আমরাও অবশ্য কিছুটা এমন। এখানকার কেউ নই। ঐ যে ওদিকে একটা চার্চ দেখতে পাচ্ছো না? ওটার কাছেই আমরা থাকি। আছি মিশনারিদের সাথে। লর্ড জেসাসের বাণী প্রচার করি। ভালোবাসা ছড়াই।”

মান্দেশকে দেখা গেল একটা পা পিছিয়ে গেল, তবে শারীরিকভাবে না, অভিব্যক্তিতে। ঘটনা তার বোঝা হয়ে গেছে। এখানে এই দারুণ বেশভূষার তরুণী দ্বয় আমাদের ক্যামেরা ও ছবি তোলার সখ দেখে পাগলিনী হয়ে চলে এসেছে এমন নয়। তারা আমাদের কাছে এসেছে যীশুর বাণী প্রচার করতে। কে জানে, হয়তো ওরা এভাবেই তরুণীদের ছেড়ে দেয় যেন তারা আলোর পথে কিছু পথভ্রষ্ট তরুণকে নিয়ে আসতে পারে। এমনটাই তো দেখা যায় দ্য ম্ন্যাট্রিক্স মুভিতে, ট্রিনিটি এভাবে চেষ্টা করেছিলো নিও নামের এক অকাজের ধাড়িকে আলোর পথে নিয়ে আসার। (আমার সেই লেখাটি পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।)

ক্যানিয়ন লেকে পা রাখার পর এমনটাই ঘটলো। বিনা প্রতিরোধে পড়ে গেলাম যীশুর মেয়েদের সামনে। আমি যতখানি সম্ভব কেলিয়ে বললাম, “দ্য ওয়ার্ল্ড নিডস দ্যাট, ইউ আর ডুইং আ গ্রেট জব।”

ভালোবাসা ছড়ানোর কথা যতক্ষণ কেউ বলবে ততক্ষণ আমি এইটা অবশ্যই বলবো। তবে দেশি মোল্লাদের মতো আল্লাহর বাণী ছড়াই, মুহাম্মাদের কথা ছড়াই বললে মেয়ের খবর ছিলো। সে বলেছে, তারা ছড়ায় ভালোবাসা। এদের দেখেও যদি দেশি মোল্লারা একটু শিখতে পারতো। তারা এসেই দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করতে চায়, “আল্লাহ যা বলে সব ঠিক কি না? ঠিক। আল্লাহ যেটা হুকুম করসে সেটা না করলে ঈমান থাকবে? না। হিন্দুর সাথে পূজো দেখতে গেলে, হিন্দুর হাতের মাংস খাইলে সেটা হারাম না হালাল? শিরক কি না? অস্বীকার করলে ঈমান থাকবে?”

এসব শুনলে আপনার ইচ্ছে করবে হুজুরের দাঁড়ি ধরে টেনে একটা বিশাল চড় বসিয়ে দিতে। তারা চাইলেই বলতে পারতো, “আমরা এখানে সম্প্রীতি ও ভালোবাসার আলাপ করতে এসেছি। এর বাইরে আর কোনও উদ্দেশ্য আমাদের নাই। আমরা চাই হিন্দু আর মুসলমান একসাথে থাকবো। পাশাপাশি থাকবো। তবে কিছু বিষয়ে আমাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে, ধর্মে কিছু হারাম হালালের ব্যাপার আছে, শিরক-বিদআতের ব্যাপার আছে। সেটা এমন গুরুত্বপূর্ণতাও নয়, কারণ, যেসব কাজে হিন্দু ও মুসলমানের সম্পর্কসুসংহত হচ্ছে তার মূল্য অবশ্যই সব কিছুর উর্ধ্বে। শিরক ঠেকাতে গিয়ে হিন্দুর সাথে দূরত্ব আসার বদলে যদি শিরক করেও ঐক্য আসে, তাতে সমস্যা নাই। প্রথম দিনেই আপনি সাহাবাদের সমান ঈমান আনতে পারবেন এমন না। বহুদিনের চর্চাতে তা আসবে। এই মুহূর্তে আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে মাখলুককে ভালোবাসা। হারাম-হালাল, শিরক-বিদআত হিসাব করবেন ক্লাস টেনে উঠে। ক্লাস ওয়ানের পাঠ সকল মানুষে ঐক্য সৃষ্টি করা। সেটা যখন রপ্ত হবে, ক্লাস টু-তে উঠবেন। আজকে যারা মন্ডপে যান ও পূজোয় অংশ নেন, আজকেই আপনাকে শিরক নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আগে মানবপ্রেম জারি করুন।”

ঐ মিশনারির মেয়ে দুটোও দারুণভাবে তাই করলো। আমাদের এসে বলার চেষ্টা করলো না যে ছবি তোলা হারাম। বলার চেষ্টা করলো না কিছুই। বললো, তারা ভালোবাসা ছড়ায়, যীশুর আলাপ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার কারণ ওটাই। আমিও তাকে পালটা প্রশ্ন না ছুঁড়ে দিয়ে বলতে বাধ্য হলাম, “দুনিয়াতে এমন কাজ আরো দরকার আছে।”

ওরা আমাদের দারুণ ক্যান্ডিডেট হিসেবেই পেয়েছিলো সন্দেহ নেই। আঠার মতো লেগে ছিলো, যাবে না। একটু বাধ্য হয়েই আমাদের বলতে হলো, “দ্যাখো, সূর্যাস্তের আলো তো চলে যাচ্ছে, যদি কিছু মনে না করো তো…”

সবগুলো দাঁত বের করে ও একই সাথে জিভে একটা কামড় দিতে দিতে সুন্দরীদ্বয় জানালো, তারা বড্ড ভুল করে ফেলেছে, আমাদের ছবি তোলার মাঝে কোনও ধরণের সমস্যা সৃষ্টি করতে তারা চায়নি। আমরাও ফোঁকলা দাঁতে হেসে বললাম, “ও কিছু নয়। চমৎকার একটি সন্ধ্যা তোমরা কাটাবে এই কামনা করি।”

যীশুর সৈনিকদ্বয় ওদিকে কোথায় যেন চলে গেল। আমরাও মহা ব্যস্ত হয়ে শাটার দাবাতে থাকলাম। ক্যানিয়ন লেকের মাঝে একটা লাইটহাউজ। তার সামনে প্রচুর বোট রাইডার দেখা যায়, তবে অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করার পর একটা একটা করে বোট কমে আসতে দেখবেন অবশ্যই।

একেকজনের আছে একেক ফূর্তি। পঞ্চাশোর্ধ্ব এক শ্বেতাঙ্গ আংকেল আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন, “ভালো কিছু পারলে ধরতে?”

আমরাও উষ্ণ হেসে বললাম, “কী যে ধরছি তা তো বাড়ি গিয়ে বোঝা যাবে। এখানে এই ছোট্ট স্ক্রিনে সব ছবিকেই দ্য ভিঞ্চির আর্ট মনে হয়। বাস্তবতা অবশ্য এর থেকে অনেক বেশি দূরের কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”

ভদ্রলোক হেসে চলে গেলেন। পেছনে তার স্ত্রী বোধহয়, একটা কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমিও রাস্তায় প্রায় শুয়ে পড়ে একটা ফ্রেম ধরার চেষ্টা করতে থাকলাম। একটু পর দেখলাম ভদ্রলোক ফিরে আসছেন, আমার সামনে আরেকবার থেমে বললেন, “তোমার চেহারার সাথে এক ভারতীয় নায়কের মিল আছে। কিন্তু তার নাম আমি মনে করতে পারছি না। ঠিক এই রকম চুল, এই রকম হাসি।”

চোদনা হয়ে গেলাম, ভদ্রলোক চোখের মাথা খেয়েছেন সন্দেহ নেই। তবে হে-হে করে তাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুললাম না। ওদিকে ঝিলিক দিচ্ছে কী যেন। ভদ্রলোকের আর তার কুকুরসঙ্গিনীর ফিরে আসার কারনটাও স্পষ্ট হয়ে গেল।

পাহাড়ি এলাকার একটা ছোটখাটো সমস্যা হচ্ছে ঝপ করে সন্ধ্যা নামে। এই সূর্য আছে, এই নেই – এমন একটা ঘটনা ঘটবে তা আমাকে মান্দেশ আগেই বলেছিলো। ও জানে। ক্যানিয়ন লেকে এই প্রথমবারের মতো ছবি তুলতে সে আসেনি। তার কথার সত্যতা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। বোধহয় ত্রিশ সেকেন্ড আগেও সূর্যটা ছিলো, দুম করে নেই হয়ে গেল। এর মধ্যে ঝড়োগতিতে আমাদের ছবি তুলে যেতে হলো তো বটেই। ইচ্ছেমতো থাকা যাবে এমনটাও নয়। রাতের বেলা ক্যানিয়ন লেক প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে জানে। ২০২১ সালে এই লেক মানুষ ডুবে মরাতে রেকর্ড পর্যন্ত করেছে। (পড়তে পারেন এখানে – Record high drowning deaths at Canyon Lake this year)

কাজেই, সন্ধ্যা হলেই পুলিশের একটি গাড়ি চলে আসে। খেদিয়ে সবাইকে উঠিয়ে আনে মেইন রোডে। অবশ্যই লাঠিসোঁটা নিয়ে নয়। নীরবে মাথার ওপর ঝলমলানি আলো জ্বালিয়ে এগিয়ে যায় ওরা। ওটাই সঙ্কেত, “কেটে পড়ো, বাপু।”

কেউ যদি গ্যাঁট মেরে থাকে তাহলে তার পাশে গাড়িটা থামিয়ে তারা জানায়, “জায়গাটা অন্ধকারে নিরাপদ নয়। ধড়ের ওপর যদি মাথা একটার বেশি না থাকে তো…”

কাজেই আমরা সুবোধবালকের মতো সুরসুর করে ফেরত এলাম মেইন রোডে। মান্দেশের ঝরঝরে গাড়ির দরজাটা খুলে ভেতরে নিজেকে কসরত করে গলিয়ে দিয়েছি, ছেলেটা বলে উঠলো, “এই যাহ!”

জানতে চাইলাম, “কী হলো?”
কিছু না বলে একদৃষ্টে ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিলো বন্ধুবর। এখানে আসার পথে আমাদের সামনেই একটা পিকআপ উলটে গেছিলো। তারপর রাস্তা বন্ধ করে একাকার অবস্থা। তেমন কিছু হলো নাকি আবার? বুকটা আমার ধ্বক করে উঠলো।

ক্যানিয়ন লেকে তখন নেমে এসেছে জমাটবাঁধা অন্ধকার।

আইরিশ ‘সাইকিক’ ও ভূতেদের দর্শন

স্যান মার্কোস কবরস্থানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের ধান্ধাও ভূত খোঁজা। ভূত আসার আগেই মরবো মনে হচ্ছে অবশ্য। ঠাণ্ডায়। তখন তাপমাত্রা শুন্য ডিগ্রি। ফিলস লাইক মাইনাস ফাইভ।

আমার গায়ে একটা মেয়েদের জ্যাকেট। বিকাল বেলায় যখন বেরিয়েছিলাম, ওয়েদার ফোরকাস্ট বলেছিলো রাতে তাপমাত্রা পনেরো ডিগ্রির নিচে নামবে না। একটা শার্ট চাপিয়ে লাফিয়ে বেরিয়েছিলাম। এইসব দশ-পনেরো ডিগ্রি আমাদের কাছে ব্যাপার না। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা কেঁচে গেল রাত এগারোটা বাজতে বাজতে। ঠাণ্ডায় আর টেকা যাচ্ছিল না বাইরে।

বন্ধুবর রিজুল তখন বিদায় নিয়েছে কেবল। আমি আর এক বান্ধবী বাংলাদেশ আর আমেরিকার অর্থনীতি এবং রাজনীতি নিয়ে আলাপ করছি। বেচারি বললো, “এখানে থাকলে তো বরফ হয়ে মরবো।”

বরফ হওয়ার আলাপে শিকাগোর কথা উঠে এলো। কনফারেন্সে শিকাগোতে গিয়ে ওরা দেখেছিল বিচি কাঁপানো ঠাণ্ডা। যারা শিকাগোর লোক তারা নেংটু হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টেক্সাসের জনগণ জবুথবু। অথচ আজ আমার হলো উলটো অনুভূতি।

এই ফ্রেন্ড টেক্সাসের মেয়ে। অথচ ওই রাতের ধাক্কা সে বেচারিও নিতে পারলো না। অবশ্য দোষ ওর-ও আছে। আমার মতোই ওয়েদার ফোরকাস্টের পাল্লায় পড়ে তার পরণে শর্ট জিনস। আর আমার বাংলাদেশী শরীরে এত বিরূপ আবহাওয়া সইবে কেন! হিহি করতে করতে বারের ভেতরে এসে বসতে হলো।

ফোন বের করে দেখলাম ১৮ ডিগ্রিতে বেরিয়েছিলাম তিন ঘণ্টা আগে। এখন ৫। তবে এখানে আগুন আছে। কাজেই বিশেষ চিন্তা না করে একটা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে ফেললাম। বেরিয়ে মরবো নাকি? কাজেই আমরা আরও দুটো ড্রিংক নিয়ে এলাম।

মেয়েটা বললো, “ইউরোপ ট্যুরে গিয়ে ভূত দেখেছিলাম।”
ভুত-প্রেতের আলাপে আমার আগ্রহ অসীম। জানতে চাইলাম ঘটনা কীভাবে ঘটেছিল। জানালো, “আয়ারল্যান্ডে গিয়ে মান্ধাতা আমলের এক দুর্গে এয়ার বিএনবি করে থাকতে পারলাম। রাতে কিছু করার নাই। নেটফ্লিক্স দেখছি। পাশের ঘরে আব্বু এতো জোরে নাক ডাকাচ্ছে যে ব্যারন সাহেবের আত্মাও বাগানের কবরখানা থেকে বেরিয়ে ছুটে পালাবে। সবই ঠিক ছিলো। তারপর শুরু হলো উৎপাত।”

“কেমন?”
“লিভিং রুম থেকে দুড়দাড় করে একজোড়া পায়ের ছুটন্ত পদশব্দ। এসে আমার দরজায় এসে থামলো। অথচ এইদিকে কেউ নেই। আমাদের ওয়েস্ট উইংটা দেয়া হয়েছে। নিচতলাও খালি। বাড়ির বর্তমান কেয়ারটেকাররা থাকে ইস্ট উইং। আর দুইয়ের মাঝে ফুটবল মাঠের থেকে বড় গ্যাপ। ওদিকে আমি তখনো আব্বুর করাতকাটা নাক ডাকার শব্দ শুনতে পারছি। একটা মানুষ তো আর নাক ডাকতে ডাকতে দৌড়াতে পারে না। তাহলে দৌড়ালো কে?”
এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারলাম না।

“সেখানেই শেষ হয়ে গেলে হতো। এরপর শুরু হলো হোয়াইট নয়েজ। ক্যার ক্যার করে একটা শব্দ হচ্ছিল সব খান থেকে। এমন না যে কোন উৎস আছে এটার। এক নিমেষে ছড়িয়ে গেল যেন সবখানে। সেই সাথে গোটা বাড়িতে দাঁপিয়ে বেড়ানো তো আছেই! এর কী ব্যাখ্যা দেবে তুমি, বলো?”

এর কোন ব্যাখ্যা আমি দিতে পারলাম না।
মেয়েটা বললো, “আমার মনে হয় বিশেষ কোন ক্ষমতা আছে এসব ফিল করার। কারণ পরের দিন সকালে আব্বু বলেছে, ‘অতি চমৎকার ঘুম হয়েছে। খাসা।’ এসব উৎপাতের কিছুই সে টের পায়নি। অথচ সকালে নাস্তার টেবিলে বসে দেখলাম ওদের মেনুর নিচে লেখা, ‘আমাদের বাড়িতে একটা ভূত আছে বটে, তবে বন্ধুত্বপূর্ণ সে ভূত। ঘাবড়াবেন না।’ এর নিচে একটা ভূতের সিম্বল আঁকা।”

গল্পটা এবার ইন্টারেস্টিং হলো কিছুটা।
বান্ধবী জানালো, “আমি ওই কেয়ারটেকার ভদ্রমহিলাকে প্রশ্ন করলাম, ভূতের ব্যাপারটা কি? উনি বললেন, ‘ল্যাসি, কিছু গেস্ট বলেন উনারা ভূতের পাল্লায় পড়েন। তবে চিন্তার কারণ নেই। ভূতটা ভালো।’ জানতে চাইলাম, ‘তারা এসে আপনাকে বলেটা কী?’ মহিলা জানালো, ‘শব্দের উৎপাত। তারপর স্বপ্নে দেখে বড় একটা পার্টি। কিংবা আগুন।’”

ও যে গতকাল ঘুমানোর পর একটা বম্বিংয়ের স্বপ্ন দেখেছে, সেটা সে আর মহিলাকে জানালো না। মানে মানে কেটে পড়লো। পরে গুগল করে ও জেনেছিল, এই বাড়িতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক পার্টি চলাকালে বোমা এসে পড়েছিলো। ওয়েস্ট উইং পুরোটাই আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছিল। ওই পার্টিতে যারা ছিল কেউ বাঁচেনি প্রাণে।

গল্প শেষ করে চোখ নাচালো মেয়েটা, “বলেছিলাম না, আমার একটা ব্যাপার আছে। এসব ভূত-প্রেত টের পাই।”
আমরা দু’জনই বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রী। কাজেই এত সহজে মেনে নিতে পারলাম না। একটু মাথা চুলকে বললাম, “তাহলে আমাদের কোন একটা হন্টেড হাউজে যাওয়া উচিত। নয়তো গোরস্থানে।”

মেয়েটাও চট করে রাজি হয়ে গেল। বললো, “আমাদের ক্যাম্পাসেই আছে তো সেমেটারি।” ঘড়ি দেখে বললো, “রাত এখন বাজে প্রায় দুটো। একেবারে মোক্ষম সময়। যাবে নাকি?”
দ্বিধা ছাড়াই বললাম, “যাবো। ক’টা ভূতকে শুনতে পাও দেখা যাবে তখন।”

বাইরে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে বিচি জমে গেল। অর্থনীতি আর ভূতের আলাপে কোনদিক দিয়ে চারটা ঘণ্টা চলে গেছে টের পাওয়া যায়নি। বাইরে এখন তাপমাত্রা শুন্য ডিগ্রি।

দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেতে খেতে ওর গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছালাম। ও বললো, “যাওয়ার পথে অ্যাপার্টমেন্টে থামবো। এইসব জামাকাপড় পরে কবরস্থানে গেলে আজ ঠাণ্ডাতেই মরে যাবো। ভূতের আর কিছু করা লাগবে না। তোমাকেও আমার একটা জ্যাকেট দেবো। নইলে মরবে।”

আমার তখন দাঁতে দাঁত এমনভাবে বাড়ি খাচ্ছে যে কথাই বলতে পারলাম না। কেবল দুর্বলভাবে মাথা দোলালাম।

২.
কাজেই গায়ে মেয়েদের একটা জ্যাকেট চাপিয়ে কবরস্থানের ভেতর দাঁড়িয়ে আছি। এক চোখ ভূতের দিকে। অন্য চোখ পুলিশের দিকে। এই রাত চারটার সময় কবরস্থানে হুমড়ি খেয়ে একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে পড়ে থাকতে দেখলে পুলিশের দল প্রথমেই ধরে নেবে গাঞ্জা খেতে এসেছে।

নয়তো খেয়ে এসেছে!

ওদিকে আমাদের সাইকিক তার কাজ করে যাচ্ছে। গলাভর্তি দরদ ধরে ভূতকে ডেকে যাচ্ছে সে।

“ঘোস্টি! লক্ষ্মী বাবারা, একটু দেখা দাও। আমরা ভালো নিয়তে এসেছি। একটা হাই বলো?” ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি গজ গজ করে বললাম, “শেষ রাতে এসে কবর দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদের ভালো নিয়ত মুচড়িয়ে মুচড়িয়ে আমাদের পেছন দিয়ে ভরে দেবে।”
ডাইনিটা বললো, “শুস। শব্দ করবা না।” তারপর আবার ভূতদের ডাকতে শুরু করলো সে।

এমন সময় আমি পরিষ্কার শুনলাম ফ্ল্যাগপোলটার ওপাশ থেকে কিছু মানুষ গুজগুজ করে কথা বলছে। কফিশপে যেমন বলে থাকে। কিংবা একটা বাজারে ঢুকলে যেমন শোনা যায়। তবে এই বিষয়ে কিছু বললাম না আইরিশটাকে। পরে দেখা যাবে আমার কথা থেকে তার হ্যালুসিনেশন হবে। আমাদের বিশাল অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে ধরে নেব।

মেয়ে তখনও ভূতেদের আকূল আবেদন করছে, “মাননীয় ভূত এবং ভূতনীরা, যথাযথ শ্রদ্ধানিবেদনপূর্বক জানাতে চাই, আমরা তোমাদের বন্ধু। তোমার যদি ওই কফিনের নিচ থেকে একটা হ্যালো করো তাহলে আমাদের খুব ভালো লাগবে। ইয়ে, ভূত স্যার-”

আমাদের ডান দিক থেকে অনেকটা দূরে, কবরস্থানের এক অন্ধকার কোণ থেকে অল্পবয়স্ক এক তরুণীর গলা থেকে শোনা গেল, “হাই।”

মেয়েটা যুগপৎ বিস্ময় নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো, “শুনলে, শুনলে তুমি?”
আমি বললাম, “ফ্ল্যাগপোল থেকে ক্যাচ ক্যাচ হচ্ছে। ওটাই মনে হয় কোনভাবে প্রতিধ্বনী হয়ে-টয়ে ওইদিক থেকে এমন হয়েছে।”

ওর গলায় এখন আর আগের জোর নেই। বিড়বিড় করে বললো, “ভূত ম্যাম, সাড়া দেবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার নাম অমুক। আপনাদের প্রেজেন্স পেয়ে যারপরনাই গর্বিত এবং আনন্দিত।”

তেল মেরে লাভ হলো না। ভূতের দল একেবারে চুপ করে আছে। ফোন বের করে একবার ঘড়ি দেখলাম। রাত প্রায় বাজে পাঁচটা। আঙুল আর একটাও অনুভব করতে পারছি না। এত ঠাণ্ডা। ফিলস লাইক মাইনাস ফাইভ। বান্ধবীর থেকে তিন তিনটা প্রটেকশন মেরে দিয়েছি। জ্যাকেটের তলে ওর দুইটা সোয়েটার। ওর ফ্রিজে দুটো বিয়ারের বোতল ছিল। তাও মেরে দিয়ে এসেছি বেরুবার আগে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে শীত আমার পাঁজর খামচে রেখেছে।

বললাম, “ভূতগুলো তো মাটির নিচে গরমে আরামেই আছে। আমরা মাঝ দিয়ে ঠাণ্ডায় মরবো।”
বান্ধবী এত সহজে হাল ছাড়তে নারাজ। বললো, “আর দশ মিনিট দেখি।”

ঘুঘুর মতো দাঁড়িয়ে কবরস্থান স্ক্যান করছি। বিচি বহু আগেই জমে গেছে। ঠাণ্ডাতে যতটা জমতে বাকি ছিলো সেটা ওই ভূতের ফিসুরফাসুরেই জমেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। যে পরিবেশে যে ঘটনা।

এমন সময় মেয়েটা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলো। বললো, “শুনলে! শুনলে!”
আমি মাথা নাড়লাম, “না তো। কোনটা?”
“আরেকটা গলা বললো, ‘হেই!’ কিন্তু ভারী গলা, বাজে আর – ডিমনিক!”
আমি তাকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করি, “বেচারার হয়তো গলাটাই শয়তানের মতো। কিন্তু লোক হয়তো ভালো। একটা মানুষের গলা খারাপ এটা তো তার দোষ হতে পারে না।”
ও বললো, “তা ঠিক। তা ঠিক। ভূত স্যার, আপনাকে আমরা অবশ্যই বেনিফিট অফ ডাউট দেবো।”
আমি গজ গজ করে বললাম, “ভোর রাতে এসে ওদের বাড়ির উঠানে দাঁপাচ্ছো আবার দিচ্ছো বেনিফিট অফ ডাউট। ভূতের জায়গায় আমি থাকলে ঘাড় দুটোরই মটকে দিতাম।”

আমাদের ভূত শিকারের গল্প এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল। ঠাণ্ডায় আর দাঁড়ানো যাচ্ছিলো না। এরপরের ছত্রিশ ঘণ্টায় পরিস্থিতি উত্তরোত্তর খারাপ হয়েছে। গতকাল বলা হয়েছিল রাউন্ড রক ক্যাম্পাস আজ বন্ধ থাকবে। তবে স্যান মার্কোস ক্যাম্পাস খুলবে। দেরিতে খুলবে, তবে খুলবে।

গতকাল রাতে ফিলস লাইক মাইনাস সেভেনে নেমে এলো তাপমাত্রা। সেই সাথে এলো সম্ভাব্য রেইন অ্যালার্ট। ফ্রিজিং টেম্পারেচারে বৃষ্টি পড়ার থেকে খারাপ কিছু নেই। পানি পড়ার খানিকবাদে বরফ হয়ে যায়। কাজেই আমাদের ক্যাম্পাসও আগামী দুটো দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

আমি টেক্সানদের কিছুটা চিনতে শিখেছি। আবহাওয়া বৈরী হয়ে উঠলে এরা সুপারশপের সব কিনে ফেলে। আমার ফ্রিজে খাবার নেই। গতকাল রাতে দ্রুত এইচ-ই-বি গেলাম। গিয়ে দেখি আলু আর মুরগি একেবারে সাফ করে ফেলেছে। কিছু বালমার্কা মুরগির প্যাকেট পাওয়া গেল। আর সবজির মধ্যে আছে কেবল ঢেঁড়স। আর সব লোপাট হয়ে গেছে। পেঁয়াজের র‍্যাকগুলোও ফকফকা। ভাগ্যিস সেটা ছিল।

টেক্সাস এমনই আনপ্রেডিক্টেবল। এই ফেব্রুয়ারি এসে এমন শীত আমরা কেউ আশা করিনি। এখন ধীরে ধীরে শীত কেটে যাওয়ার কথা ছিল।

সামনে কপালে বোধহয় খারাবী আছে।
তবে সৌভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে প্রফেসরের সাথে ফেইস-টু-ফেইস মিটিং ক্যানসেল হয়েছে। সেটি ঘটবে জুমের মাধ্যমে। প্রফেসর যদি জানতেন এই আবহাওয়ার ভেতর আমরা শশ্মানে-মশ্মানে ঘুরি তাহলে নির্ঘাত চিবিয়ে চিবিয়ে বলতেন, “বন্ধুবান্ধব তো ঠিকই বিপদজনক আবহাওয়ায় ভূত দেখতে যাও। রিসার্চের কথা বললেই কেবল আবহাওয়ার দোহাই, অ্যাঁ!”

জানুয়ারি ৩১, ২০২৩

আমেরিকানামা – খুচরো লেখা (১)

শহরপ্রেম
“তুমি তো ভাই ভেতরে ঢুকতেছো, ঢুকতেছো কি না বলো?”
আধমাতাল আমেরিকানের এই প্রশ্নের জবাবে কি বলবো বুঝে পেলাম না। দাঁড়িয়ে আছি জেলিকসের সামনে। টেক্সাস স্টেটের পোলাপান ফাঁক পেলেই এখানে এসে হাজির হয়ে যায়। মেরে দেয় এক পেগ। কিংবা পটিয়ে সঙ্গিনি নিয়ে যায় বাড়িতে। তার সামনে দাঁড়িয়ে পাঁচ ফুট ছয় এই দরাজদিল তরুণের হুঙ্কার। সেই সাথে বাড়িয়ে দিয়েছে ফিস্ট। আগে ফিস্ট বাম্প করলাম। তারপর বললাম, “ঢুকবো তো অবশ্যই। আমাদের গন্তব্যটাও, হেহে…”
পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আমেরিকান ও ইরানি বন্ধু। ইরানি বন্ধু আমেরিকায় ভেগেছে বাধ্যতামূলক মিলিটারি এনলিস্টেড হওয়া থেকে বাঁচতে। কয়দিন আগেও শালাকে বলেছি, “তুমি নাকি ইদানিং গে বারে ঘুরতেছো, ইরানে নাকি যাবা সামারে। তোমাকে ইরানি ইন্টেলিজেন্স তুলে নিয়ে পুটকি মারবে। যতসব নাজায়েজ কাজকারবার।”
ব্যাটা নির্লজ্জের মতো হেসে বলেছিল, “আরে বারটেন্ডারের পাছা বেরিয়েছিলো, মিয়া।”
নাক কুঁচকে বলেছিলাম, “সামারে দেশে যাবা যাও, ফিরতেছো না আর তা নিয়ে সন্দেহ নাই। তোমার হোগা মারা সারা।”
আমাদের তৃতীয় সঙ্গি, আমেরিকান বন্ধু আমেরিকান আর্মিতে এনলিস্ট হয়েছিলো, সার্ভিসে ছিলো। দু’শালা এমন বুক ডন লাগিয়েছিলো মাতাল অবস্থায়, ৭ মাস আগে, তার কথা আর মনে করতে চাইলাম না। লেগে গেছিলো দুটোর মধ্যে, তারা নাকি ৭০ এর বেশি পুশ-আপ পারে। মিলিটারি ইগো বলে কথা। তারপর পার্কিং লটে এক স্যান মার্কোসের ছোকরা এসে তাদের সাথে কম্পিটশন। শেষটায় আমার বন্ধুদ্বয় পারলে তার নাক ফাটায় আরকি। অনেক কষ্টে দুই মাতালকে ডি-এস্কেলেট করতে হয়েছিল সেদিন। তবে সেসব কথা ভুলে থাকতে হলো।
আধমাতাল দিলখোলা লোকটা জানতে চাইছে, “লেট মি বাই ইউ আ ড্রিংক, এহ! মদ তো খাও? ও, খাও তো। বলেছিলে আগের আলাপে -”
আমি কেবল চারপাশে তাকালাম অসহায়ের মতো, ভালোবাসার আহ্বান – প্রত্যাখ্যান করার মতো নয়। কেবল বললাম, “একটা সেকেন্ড একটু ভাবতে দাও। প্রফেসর যে পাছাটা মেরেছে একটু আগে আমার দলের-”
আমুদে হয়ে গেল বেচারার চেহারা, এক পা এগিয়ে বললো, “আরে ভাবাভাবির কি আছে। আইপিএ বিয়ার তো খাও, নাকি? নাকি পছন্দ না অমন?”
মক্কায় গিয়ে কাবাকে বাজে বলবেন না। আমার বিখ্যাত শিশুতোষ হাসিটা ছুঁড়ে দিয়ে যুবককে বললাম, “আরে কি কও মিয়া, আইপিএ তো সেরা!”
একটুও গলে গেল না ছোকরা। গলা একটু নামিয়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মতো বললো, “আরে বাড়া, বিয়ারে কি হয়, আরও কিছু বলো। এই এক হাল্কা ড্রিংক অর্ডার করে পাপী করো না আমায়। আমি খাওয়াচ্ছি তো, বাপ!”
ভুবনভোলানো হাসিটা উপহার দিতে দিতে আবার বললাম, “রাত তো শুরুই হয় নাই। কি কও! অর্ডার করো যাহা চায় পরাণে।”
পেছনে ফিরে দোস্তদের বললাম, “বন্ধুরা, এ হলো লোগান। মনে আছে, ডিসেম্বরে তোমাদের হোগা মেরে যে শুটিংটা করতে চাইছিলাম – ”
বন্ধুবরদের মুখ হিংসেয় এতখানি হয়ে গেল। লোগানের দিকে ফিরে বললাম, “আরে তোমার সাথে শুটিংয়ের আলাপ যে ছিলো। এর পর এই দুই বাইনচোদকে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। একটা আউটিংয়ের ডাকেও সাড়া দেই নাই। আর তুমি কি না বোকাচোদা চলে গেলা শহরের বাইরে।”
বিষয়টা বুঝে কৃতজ্ঞতায় ছেয়ে গেল যুবকের মন, আমার বুকে একটা ঘুষি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বললো, “ইউ বাস্টার্ড! এইভাবে বন্ধুদের গোয়া মেরেছো জানলে শহর ছাড়তাম না…”
হোয়াইট সুপ্রেমিস্ট টেক্সাসে কম নয়। এদের চোদনে টেকার উপায় নেই। বর্ণবিদ্বেষী আচরনের শিকার হয়েছিলাম এখানে আসার ৩ মাসের মাথায়। আমাকে ট্রেসপাসিংয়ের হুমকি দিয়েছিলো এক সাদা বারটেন্ডার, কারণ আমি তাদের দোকান খোলার ১৩ মিনিট আগে এসে পৌঁছেছি। হজম করে নিয়েছিলাম। কারণ ব্যাটা যা বলেছে আইন অনুসারে তা সঠিক। তবে আমাকে এটা বলেছে কারণ আমি সাদা নই। নইলে ভদ্রভাবে বলতো ১৩টি মিনিট পর বার খুলবে ওরা। আমি যেন একটু পরে আসি। ট্রেসপাসিং এবং গুলি ছোঁড়ার হুমকি সে দিত না। তারপর এ নিয়ে একটা ভেজাল লাগিয়েছিলাম বটে, তবে সে আরও পরের কাহিনী, লম্বা কাহিনী।
লোগানের ঘুষিটা বুকে আছড়ে পড়ার সাথে সাথে স্যান মার্কোসবাসীর যাবতীয় দোষত্রুটি ক্ষমা করে দিলাম। বন্দুকের মতো তাক করলাম একটা আঙুল, সরাসরি লোগানের কপাল বরাবর, “তুমি ভাই কম না, শহরের টপ খানকি। ডিসেম্বরে শুট করার কথা বলে নিজেই ভাইগা ছিলা। বালামার।”
হয়ে গেল। আমাকে প্রায় বগলদাবা করে কাউন্টারে নিয়ে গেল সে। এই লোগান উলভারিন নয়। কাজেই মনে কিছু নিলাম না। বন্ধুবরের দিকে ফিরে বললাম, “ও হচ্ছে “হালাল ক্লাবে”র ঔনার। নট দ্যাট ইউ কেয়ার, হেহে। তবে লোগান সুপার কুল একটা লোক। মনে আছে না ওর কথা? তোমাদের বলেছিলাম তো।”
ওদের চোখ হিংসেয় আরও ছোট ছোট হয়ে এলো। লোগান গলাটা যত সম্ভব নামিয়ে বললো, “আরে ঔনার না, ম্যানেজার বলো। ম্যানেজার বলো।”
আমি চোখ টিপলাম, “ম্যানেজার। কোট-আনকোট। বুঝোই তো।”
লোগান ওদের সাথে পরিচিত হতে হতে বললো, “আই রেসপেক্ট দিস গাই, ম্যান। ম্যাসিভ রেস্পেক্ট। যে একটা জীবন ওর, ভাইরে ভাই। সেরা।”
কোনও কারণ নেই, তবুও আমার গলার কাছটায় দলা পাকিয়ে উঠলো। আমাকে কেউ চেনে না এ শহরের লোক। বাংলা তারা পারে না। পড়েনি আমার একটাও বই। একটা ফেসবুক পোস্টও। আমার ইউনিভার্সিটিতেও পড়ে না ও। কিংবা ক্লোয়ি। কিংবা এক্স-ইউস-এয়ারফোর্স হেইডেন। কিংবা চুল কাটে যে ছেলেটা, ডালাস। কেবল মিশেছে আমার সাথে একটু। আলাপ করেছে। আর কিছুই নয়।
কিন্তু ভালোবেসেছে ওরা আমাকে। খোঁজ নিয়েছে আমার ব্যাপারে। সম্মান করেছে তারপর।
কোনও কারণ নেই। হোয়াইট সুপ্রেমিস্ট ভরা এই শহর। আমার মতো বিদেশিকে সহ্য করে বড়জোর , কিন্তু আপন করে নিতে নারাজ বেশিরভাগ মানুষ। কোনও কারণ নেই আমার।
তারপরও চট করে ভালোবেসে ফেললাম কাউন্টারে আমার পাশে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত হয়ে আমাকে এই ‘শট’টার উপাদানের ব্যবচ্ছেদ করতে থাকা লোগানের শহর স্যান মার্কোসকে। লোগান তখন আমার হাতে থাকা থ্রিডি প্রিন্টেড যন্ত্রাংশের দিকে আঙুল তুলে জানতে চাইছচে, “এই ধোনটা আবার কি?”
একটু হাসি আমি। বোঝাতে শুরু করি আমি ওকে যন্ত্রকৌশলের নানা কলাকৌশল। কীভাবে একটা আলো ফেলেই আমরা বানিয়ে ফেলবো গায়েবী যন্ত্রাংশ। শেষ করি ছোট্ট এক শব্দ দিয়ে, “ম্যাজিক!”
শুধু বলি না, “আই লাভ ইউ, স্যান মার্কোস। আই লাভ ইউ।”
– এপ্রিল ০৪, ২০২২
আমেরিকার হাইস্কুল, বা এক হতাশার গল্প…
গতকাল রাতে রুমমেটদের সাথে বহুদিন পর আড্ডা দেবার সময় হলো। রাত ১১টায় উঠেছিলাম এক কাপ চা খাবো বলে। চায়ের ভূত আমার মধ্যে প্রকট। কিচেনে গিয়ে দেখি ইস্টন আর উইল এক সাইফাই মুভির পিন্ডি চটকাচ্ছে। সামনে তাদের খোলা ইউটিউবের স্ক্রিন। দু’জনেই আন্ডারগ্র্যাডের ছাত্র। একজন ইলেকট্রিকাল, অপরজন ফিল্ম মেজর। চায়ের আলাপ উঠতেই সবটা দায় ব্রিটিশদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলাম। অম্লান বদনে বললাম, “আমার এই নেশা এসেছে ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ এর আফটার ম্যাথ থেকে।”
ওরা কিছুই বুঝলো না। কাজেই একটু খোলাসা করলাম, “ব্রিটিশদের থেকে। ব্যাটারা ঘাড়মোড় ভেঙে শাসন করেছে আমাদের। তোমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে ব্রিটিশ কেউ আছে নাকি হে?”
ইস্টন বললো, “আমার একসাইড আইরিশ। জাতিগোষ্ঠী হিসাব করলে ব্রিটিশ আমারও দেখতে পারার কথা না।”
হেসে ফেললাম, “আইআরএ নিয়ে টিভি সিরিজ আর মুভিগুলোতে যা দেখানো হয়, তেমনটাই তো মনে হয়। তবে আমাকে ভুল বুঝো না। ব্রিটিশদের আমি অপছন্দ করি এমন না। সব জাতিরই কলঙ্কিত ইতিহাস আছে, তা থেকে কোনও জাতির সবাই খারাপ হয়ে যায় না।”
আলোচনা চা থেকে দারুণ দিকে মোড় নিলো সেই সাথে। আমেরিকার ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলাপ উঠে এলো এভাবেই। ইস্টন বললো, “বর্ণবাদ নিয়ে কাজ হচ্ছে বলে ভেবো না খুব বেশি জাতিকে কাভার করা হচ্ছে। আমেরিকার প্রাচীন অধিবাসীদের নিয়ে তেমন কিছুই টেক্সটবুকে লেখা নেই, দুটো লাইন লিখেই অহেতুক বগল বাজানো, যেন কত না কী করে ফেলেছি আমরা, অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছি! আর এশিয়ানদের ওপর যে অত্যাচার আমরা করেছি, জাপানিদের ওপর – তা নিয়ে তো একটা বর্ণ নেই। ভয়াবহ অবস্থা।”
ইস্টন জানালো তার বাবা রেড ইন্ডিয়ানদের একটি সংস্থার অনারারী পদধারী। ডিএনএ থেকে তাদের সাথে মিল পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, যেহেতু ভদ্রলোক আইরিশ। তবে ইস্টন যখন ছোট ছিলো, তাকে মাঝে মাঝে তিনি ডেকে পাশে বসাতেন। তারপর শুরুটা করতেন এভাবে, “এখন আমরা একটু অস্বস্তিকর টপিকে কথা বলবো-”
তিনি ছোট্ট ইস্টনকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ঠিক কেমনটা অনাচার তাদের সাথে করা হয়েছে এবং হচ্ছে। মানুষ হয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার থেকে কথা দ্রুত ঘুরে গেল এনিমল ফার্মিং ও ভিগানদের নিয়ে। উইল র‍্যাঞ্চে বড় হয়েছে। টেক্সাসের খাঁটি সন্তান। ল্যাসো বানিয়ে গোরু আটকাতে পারে সে। বন্দুক চালাতে পারে এইটুকু বয়স থেকে। ঘোড়া দাবড়ানোও ছেলেখেলা। ফার্মিং তার রক্তে। সে ভিগানদের নিয়ে খুবই বিরক্ত। তার কথা হচ্ছে, এত লিভিংস্টক যে আছে এদের তাহলে কী করবো আমরা? তার ক্ষোভের কারণ আমরা বুঝি। নো শেভ নভেম্বরের মুভমেন্টে নাপিত যেমন বেজার হন, প্রাণি খাওয়া ছেড়ে দেয়ার কারণে উইল অবশ্যই বিরক্ত হবে। কিল অর টু বি কিলডে সে নিদারুণ বিশ্বাসী। কোনও কুকুর তাকে মারতে এলে সে যে কুকুরটিকে মারতে কসুর করবে না এবং এ নিয়ে তার বিবেক আটকাবে না তা বলতে গিয়ে র‍্যাটল স্নেক মারার গল্প উঠে এলো।
সাপ মারার অভিজ্ঞতা নেই এমন টেক্সাসের পুরোনো বাসিন্দা মনে হয় একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাপ মারার জন্য ইস্টনের বাবার একটা আলাদা বেলচাই ছিলো। ইস্টনের ভাষায় ওটা হলো ওদের পারিবারিক “কিলিং শোভেল”। ঘাসের মধ্যে নড়াচড়া দেখে সিনিয়র কেবল চাপা গলায় বলবেন, “এই আমার বেলচাটা বের করো তো।”
ওই সাপের দফারফা ওখানেই সারা। সেন্টিপিড নিয়ে কথা উঠলো সেই প্রসঙ্গে। উইল বললো, “সাপ আমি মেনে নিতে পারি। কিন্তু সেন্টিপিড আমি দুই চোখে দেখতে পারি না।”
বিটকেলে এক সেন্টিপিডকে শাবল গাঁথিয়ে দেবার পরও বাকি অংশটা কীভাবে তাদের কাঁচকলা দেখিয়ে ভেগে গেছিল সে আলাপ করতেই হলো তাকে। উইলরা অবশ্য সাপ বেলচা দিয়ে মারে না। তারা র‍্যাঞ্চের লোক। কথায় কথায় গুলি চলে। র‍্যাটলস্নেক সে প্রচুর মেরেছে বন্দুক দিয়ে। তার মতে, “সাপের বাচ্চা তো আর বুঝে না আমার হাতে ও কি জিনিস। তারা বন্দুক দেখে তো আর মানুষের মতো আঁতকে উঠতে শেখেনি। নইলে অনেক সাপই বেঁচে যেত। বন্দুক আমার হাতে, আর সাপ বোকাচোদা মনে করছে সে তখনও আপারহ্যান্ডে আছে…”
সাপ মারার আলাপ দ্রুতই মোড় নিলো আইন ও বিধানসভা নিয়ে। এর সাথে শিকারের সম্পর্ক আছে। প্রাচীন কিছু আইন অনুসারে আপনি আপনার বাড়ির দোতলা থেকে কোনও হরিণের দিকে গুলি ছুঁড়তে পারবেন না। জানতে চাইলাম, “তেতলা থেকে গুলি ছোড়ার ব্যাপারে আইনটা কি জানতে চায় আমার অবুঝ মন।”
ব্যাপক সমালোচনা আমরা করলাম পুরাতন আইন না সরানোর। ও সময় টেক্সাসে দোতলার ওপর বাড়িই ছিলো না বলতে গেলে। গেম ওয়ার্ডেনকে নির্ঘাত গুরুগম্ভীর গলায় বলা যাবে এখন, “দেখুন স্যার, গুলি কিন্তু দোতলা থেকে করিনি। তিন তলা থেকে করেছি। সাক্ষীসাবুদও প্রস্তুত। আইনের ওপর তো আর কথা চলে না স্যার…”
টেক্সাসের যে সংবিধান তা আমেরিকার সংবিধান থেকেও বড় এবং বিস্তৃত। তারা প্রায়ই দাবী করে থাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম হবার সামর্থ্য তাদের আছে।
জানতে চাইলাম, “ব্রেক্সিটের মতো বেকুবি তো আর টেক্সাসের লোকজন করবে না?”
ইস্টন হাসলো, “পাগল নাকি। এগুলো স্রেফ ইগো স্যটিসফাই করতে বলা। কারণ আমরা চাইলে আসলেই পারি। কিন্তু কেন করবো?”
এ সেই চিরায়ত বাংলা কবিতা। যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো? তাই তো। টেক্সাসের সংবিধানের আলাপ থেকে দ্রুতই উঠে এলো কিছুদিন আগে ধর্ষককে কীভাবে এয়ারপোর্টে হত্যা করে ভিক্টিমের বাবা প্রতিশোধ নিয়েছেন সে গল্প। মেয়েটিকে ধর্ষণ খুন করেছিলো, তবে না খাইয়ে মেরেছে তাকে। ধর্ষণের পর বেচারিকে পিটিয়ে ট্রাংকে ভরে রেখেছিলো। গলায় আগুন নিয়ে ব্যাখা করলো ইস্টন, “কোনও হত্যাই ভালো নয়, তবে তুমি যখন জানো কাউকে তোমার মারতেই হবে, অন্তত আহত অবস্থায় না খাইয়ে তুমি তাকে মারতে পারো না।”
উইল বললো, “বাবাটি একজন বীর, কোনও সন্দেহ নেই এই ব্যাপারে।”
আমি তাদের বাংলাদেশের হারকিউলিসের ব্যাপারে বলি। ভিজিলান্তে কেন ভালো নয় তা বুঝাই। ওরা একমত হয় এ বিষয়ে। আইন আদালত থেকে কথা ঘুরে যায় টেক্সাস ছাড়িয়ে আমেরিকার জাতীয় নির্বাচনে। কীভাবে লিবারেল আর কনজারভেটিভরা মনস্তাত্ত্বিক মুশকিলে পড়ে, কিন্তু কীভাবে আসলে আমেরিকার রাজনীতি ঠিক রাজনীতি নয়, এটি একটি “পলিটিক্স ইন্ডাস্ট্রি” তা নিয়ে কথা হয়। এবং তা থেকে চলে আসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের কথা, ইস্টন ও উইল দু’জনই এই প্রেসিডেন্ট সাহেবের ওপর বিশাল ক্ষ্যাপা বলেই মনে হলো। তুমুল গালি খেলো ছোট বুশ। তবে বড় বুশকে নিয়ে তাদের শ্রদ্ধা আছে।
ইস্টনের এক চাচা একবার ছোট বুশকে মাছ ধরতে দেখেছিলো। সিক্রেট সার্ভিসের কিছু লোক ছিলো আশেপাশে। বুশ তখন প্রেসিডেন্ট। এমনকি মাছ নিয়ে তিনি নাকি তখন একটা কৌতুকও করেছিলেন, খুব-ই স্থূল সে কৌতুক, “মাছ কই মারছি? ছিপ ফেলে তো ধরছি ডেমোক্র্যাট। হা হা হা।” টেক্সাসের গভর্নর ছিলো লোকটা, দুই দফায় দশ বছর মনে হয় (স্মৃতি থেকে বলছি, ক্যাপিটলের দেয়ালে জেনেছিলাম। এই মুহূর্তে গুগল করতে ইচ্ছে করছে না) – কাজেই টেক্সাসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বুশের আলাপ আসবেই। সে থেকে কেনেডির অ্যাসাসিনেশন নিয়ে আলাপ শুরু হলো। ইস্টন একজন প্রকৌশলবিদ্যার ছাত্র, যথেষ্ট স্মার্টও বটে, তবুও ও না বলে থাকতে পারে না, “কন্সপিরেসি থিওরিস্টদের দেখলেই আমার থাপড়াতে মন চায়, কিন্তু কেনেডির ব্যাপারটায় আমার ধারণা সিআইএ জড়িত ছিলো। তারা না হলেও কর্মটি যে আমাদের অজানা কোনও পক্ষ করেনি তা আমি নিশ্চিত।”
সে থেকে মার্টিন লুথার কিংয়ের অ্যাসাসিনেশন চলে আসে। এ নিয়ে বিশদ ঘেঁটেছে সে। একেবারে ডায়াগ্রাম এঁকে, নিজে জায়গামতো দাঁড়িয়ে দেখালো শুটারের যে বাথরুম পজিশনের কথা অফিশিয়ালে বলা হয়েছে, তা কতোখানি অযৌক্তিক। কিন্তু কথা ঘুরে ফিরে কেন যেন বার বার চলে আসে শিক্ষাব্যবস্থার দিকেই।
ইন্টারনেট আসার পর এর সাথে তাল মেলাতে কীভাবে ব্যর্থ হয়েছে এলিমেন্টারি ও হাই-স্কুলগুলো তাই উপজীব্য। বক্সারের যুদ্ধ কবে হয়েছিলো তা মুখস্থ রাখার দরকার ফুরিয়েছে। আমাদের আছে ক্লাউড এবং হাই স্পিড ইন্টারনেট। কিন্তু আমেরিকার পাঠদানপ্রক্রিয়ার অবস্থা অত্যন্ত জঘন্য। সেই মান্ধাতা আমলের। ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে অবস্থা নাকি আরও করুন।
ইস্টন বললো, “আমার স্কুলে কোনও শালা আমাদের পার্টস অফ স্পিচ পড়ায় নাই। একটু বড় হওয়ার পর আমি বই পড়তে গিয়ে নিজে নিজেই বুঝেছি যে নানা শব্দ নানাভাবে ব্যবহৃত হয়। তারপর আমি জানি পার্টস অফ স্পিচ বলে কিছু আছে। ডায়াগ্রামের কথা মনে আছে, উইল-”
উইল মাথা দোলালো।
আমি এদের স্কুলে পড়িনি। কাজেই জানতে চাইলাম, “ডায়াগ্রামটা আবার কী হে!”
ওরা আমাকে বোঝায়, একেকটা বাক্য দেয়া হতো পরীক্ষায়। সেখানে শব্দগুলোকে আলাদা করে পয়েন্ট আউট করতে হয় কোনটা কোন পার্টস অফ স্পিচ। কিন্তু কখনো ক্লাসে এসব তাদের পড়ানো হয়নি। আর আমেরিকায় ক্লাসে পড়াবে না কিন্তু বাসায় এসে সবাই বই খুলে বসে নিজে নিজে শিখবে – অন্তত স্কুলে এটা কল্পনাও করা যায় না।
ইস্টন বললো, “তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না, আমাদের রিডিং স্কিল কী বাজে। আমেরিকার বেশিরভাগ হাইস্কুলের ছেলে রিডিং পড়তে পারে না। তোমাকে একটা পাতা দেয়া হলে তো গড় গড় করে পড়তে পারবে। আর ওরা পড়ে কুঁতে-পেদে।”
এই তথ্যটা আমার কাছে একেবারেই নতুন। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমেরিকানদের যাদের আমরা চিনি তারা আসলে ভীষণ স্মার্ট। যারা গ্র্যাড স্কুলে আছে, পিএইচডি বা মাস্টার্স করছে – এরা অন্য লেভেলের। তবে এরাই তো গোটা আমেরিকা নয়। সাধারণ মানুষের আমেরিকায় রিডিং পড়তে পারে না হাইস্কুলের ছেলেমেয়েরা! ধরে নিন ক্লাস টেনে একটা ছেলে পড়ে, কিন্তু রিডিং পড়তে পারে না মাতৃভাষায়। কী করুণ হাল।
আমি জানতে চাই, “কারণটা কী? স্কুলে ৬-৭ বছর পড়েও মানুষ রিডিং কেন পড়তে পারবে না? বানান করে পড়তে হবে কেন?”
উইল তার চিরায়ত উত্তর দেয়, “এই শিক্ষাব্যবস্থার গোয়া মারা দরকার।”
ফিল্মমেকার হওয়ার জন্য কম্পিউটার সায়েন্স মেজর ফেলে দিয়ে ফিল্মে ঢুকেছে যে ছেলে সে প্রতিষ্ঠানকে গোয়া মারবে এটাই স্বাভাবিক। তবে তার কথার যুক্তিও আমি ফেলে দিতে পারি না। আমারও একই মত। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাও আমি পাল্টাতে চাই। তবে নিজ দেশের কারিকুলাম নিয়ে প্রশংসা করতে হলো কিছুটা, বললাম, “ব্রিটিশদের কারিকুলাম ফলো করি, কাজেই ব্রিটিশদের অবদান হয়তো অনেকটা, তবে আমাদের ইংরেজি পাঠের স্ট্রাকচার অন্তত তোমাদের থেকে ভালো, যা বুঝলাম। আর ফরচুনেটলি বাংলা ভাষার জন্য আমাদের ছেলেরা পুলিশের গুলিতে মারা গেছে বলেই আমরা স্বাধীন দেশ হয়েছি বিশ বছর পর, সেজন্য আমাদের দেশে বাংলা নিয়ে প্রচুর আবেগ। প্রতি তিন জনের মধ্যে একজন বাংলা নিয়ে এতটাই প্যাশনেট যে গল্প বা কবিতা পর্যন্ত লিখতে পারে। ভাগ্য ভালো, আমাদের জাতির ইতিহাসে ভাষাটা ছিলো। নইলে তোমাদের মতো অবস্থা যে হতো না তা বলা যায় না।”
এইসব ইতিহাস বেচারাদের আমি অন্তত ৩ বারের মতো শুনিয়ে ফেলেছি। বাংলাদেশিদের এই এক বদস্বভাব। যেখানেই যাবে সেখানেই গলা ফুলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আলাপ জুড়ে দেবে, প্রথম সুযোগেই। আর এমন সু্যোগ আমি পাইও বিস্তর।
ওরা জানালো, আসল সমস্যা হচ্ছে দক্ষ শিক্ষকের অভাব। আমি একমত হই। বলি, এ হচ্ছে ইউনিভার্সাল সমস্যা। সবখানেই একই বিপদ। আমার দেশে আমি যদি প্রধানমন্ত্রী হতাম তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকেও বেশি বেতন ও সুবিধা দিতাম এলিমেন্টারি আর হাইস্কুলের শিক্ষকদের। তবেই না পিএইচডি হোল্ডাররা ওখানে পড়াতে যাবে। আর যতদিন মোটিভেশন দিচ্ছো না, টাকা দিচ্ছো না সার্কুলারে, তো পাবেও ওই লেভেলের শিক্ষক। এটা সঠিক আমাদের কলেজে মাস্টার্স পিএইচডি করা শিক্ষকরা থাকেন, তবে কত শতাংশ? আর কাদের প্রথম পছন্দ হাইস্কুলের ছেলেমেয়ে পড়ানো? বুয়েটের ছেলেমেয়েরা হায়ার স্টাডি করে এসে স্কুলে পড়াক অনেকে – এটা আমি চাই। এটা আপনাদের চোখে ওয়েস্ট অফ রিসোর্স মনে হতে পারে – কিন্তু আসলে নয়। তাদের ইন্ডাস্ট্রিতে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে এককভাবে না ঢুকিয়ে স্কুলশিক্ষকের লোভনীয় অফার দিন, মাসে ৪ লাখ টাকা, আবাসন, পরিবহণ খরচ স্কুলের। তারপর দেখুন কতজন বিদেশফেরত ব্রিলিয়ান্ট ছাত্ররা হাইস্কুলে পড়াতে যাচ্ছেন। আর বুয়েটের শিক্ষক হিসেবে গবেষণা করতে পারতেন যেহেতু, হাইস্কুল শিক্ষক হয়ে কেন পারবেন না? গবেষকদের বড় একটি অংশ ক্লাসে পাঠ দেয়ায় বিরক্ত থাকেন। করতে হয়, শর্তে আছে বলে করেন। তবে সেন্ট্রালি সিদ্ধান্ত নেয়া গেলে তাদের হাইস্কুলের শিক্ষকতার চাকরির পাশাপাশি গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া কঠিন কিছু নয়। গবেষক গবেষণা করবেন ঠিকই, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের যদি টপ থ্রি পড়ান, ব্যাচের পরের ২০ জন হাই স্কুলের শিক্ষক কেন হতে পারবেন না?
ইস্টনদের আমেরিকা আর আমার বাংলাদেশ – দু’জায়গাতেই এক সমস্যা। প্রতিটি হাইস্কুলে অন্তত ২-৩ জন করে এই লেভেলের লোক শিক্ষক হয়ে আসেন না। কারণ আমার দেশে কেউ তাদের ৪ লাখ টাকা মাসিক বেতন দেবে না। ওদের দেবে না টু হান্ড্রেড থাউজ্যান্ড বছরে। কেন আসবে?
কে আসবে?
গোড়ার শিক্ষাতে যে সমস্যাটা, তাতে হাত না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এফিশিয়েন্সি বাড়াবার যে চেষ্টা তা অনেকোটা নিচের সূত্রমতো চলে।
স্কুলছাত্রদের মোট সম্ভাবনা x ২০% = কলেজে আসা অলরেডি ২০% এ থাকা জনগণ
কলেজের আধমরাদের (যা অলরেডি ৮০% হারিয়েছে স্কুলে) সম্ভাবনা x ২০% = বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা পুরা মরা।
এবার এই পূর্ণমৃতদের থেকে আমরা বাই লাক যে কয়জন উদ্যমী, পরিশ্রমী লোক পাচ্ছি তাদের দেখিয়ে বলছি বিশ্ববিদ্যালয় খুব ভালো চলছে। একে আমরা আরও উন্নত করবো। তা করবেন কীভাবে, স্যার? গোড়া তো উইতে কেটেছে…
এক কাপ চা খেতে গিয়ে বেশ কিছু কাপ খেয়ে ফেললাম। অবশেষে আমাদের আড্ডা যখন ভাঙলো ঘড়িতে তখন রাত ৩ টা… ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২