KP Imon

Words Crafted

সামাজিক হিপনোটিজম

এক.
অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে আসার পর থেকেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে তিথির। শেষ বর্ষের ছাত্রছাত্রিদের বিদায় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে কালচারাল শো ছিলো। সেখানে টানা তিনটি হিন্দী গান তোলার পর আর নিতে পারেনি সে। সোজা বের হয়ে চলে এসেছে। এয়ার কন্ডিশনড রুম থেকে আচমকা কড়া রোদে বেরিয়ে আসার কারণে সামান্য অস্বস্তিও হচ্ছে। গায়ে মাখলো না ওটুকু, তবে সামনের দৃশ্যে কিছু একটা ভুল রয়েছে এটা বুঝতে পারছে। এই বিষয়টা গায়ে না মেখে উপায় রইলো না তিথির।

বিআরটিসি কাউন্টারের সামনে যাত্রিদের বসে থাকার জন্য রাখা হয়েছে সিমেন্টের সীট। তাতেই বাদুড়ের মতো ঝুলে আছে একটা ছেলে। বসার জায়গাটায় পিঠ দিয়ে লটকে আছে, হেলান দেওয়ার অংশ বরাবর দুটো পা বাড়িয়ে দিয়েছে আকাশের দিকে। এমন দৃশ্য প্রতিদিন দেখা যায় না। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে পা বাড়ালো তিথি।

আরেকটু কাছাকাছি আসতে ছেলেটাকে চিনতে পারলো ও, মেকানিক্যালের শুভ্র। সাধারণতঃ চশমা পরে, চশমা খোলা রাখায় একটু অদ্ভুত লাগছে তাকে। প্রথমে চেনা যায়নি তাই। ছেলেটা একটু পাগলাটে টাইপের। রোবোটিক্সের বিভিন্ন কম্পিটিশনে ধারাবাহিকভাবে পুরষ্কার পেয়ে এসেছে বলে কেউ তার পাগলামি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না। কথায় আছে, জিনিয়াসেরা একটু পাগলাটে গোছের হয়। সেই তকমাটাই পিঠে নিয়ে মহানন্দে ক্যাম্পাসের এদিক থেকে ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে শুভ্র। বেশিদিন আগে নয়, জুনিয়র একটা মেয়েকে চলন্ত সাইকেল থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো। এরকম একটা মানুষকে সহজে কেউ ঘাঁটাতে চায় না। তারপরও তার পাশে গিয়ে বসে পড়লো তিথি।

শুভ্রের ঝলমলে চুলগুলো মধ্যাকর্ষণের টানে নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে, চোখ সরাসরি নিজের উর্ধ্বগামী পায়ের দিকে নিবদ্ধ।
তিথির দিকে একবারও না তাকিয়ে বললো, “তুমি তিথি না? ইলেক্ট্রিক্যালের।”

জিনিয়াস পাগল তাকে দেখামাত্রই চিনতে পেরেছে সেটা ভালো খবর কি খারাপ তা তিথি জানে না। কাজেই সামান্য ভ্রু নাচিয়ে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ। চিনলে কিভাবে? আমাদের আগে দেখা হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না।”

চুলগুলোয় ঘূর্ণি তুলে সোজা হয়ে বসলো শুভ্র, বাদুড়ঝোলা অবস্থা থেকে সোজা হতে যথেষ্ট কসরত করা লাগলো তাকে। পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে থাকা দু’জন স্কুলছাত্রি ফিকফিক করে হাসতে হাসতে চলে গেলো।
“আমাকে চেনো তুমি?” শুভ্র জানতে চাইলো।
একটা কাঁধ তুলে ছেড়ে দিলো তিথি, “তোমাকে ক্যাম্পাসের সবাই চেনে।”
হাসলো ছেলেটা, তিথি লক্ষ্য করলো তার হাসির মধ্যে ভালো লাগার মতো কিছু নেই। হয়তো অবজ্ঞা বা আত্মদম্ভের ভাবটুকু বোঝা যায় বলে এমনটা মনে হলো ওর। নিশ্চিত হতে পারলো না সে।
তিথির কথাটাকেই অবশ্য প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় রেফারেন্স ধরে নিলো শুভ্র। বললো, “এইটাই পয়েন্ট। এই ক্যাম্পাসের সবাই সবাইকে চেনে।”

ঠোঁটদুটোকে চেপে বিজ্ঞের মতো মাথা দোলালো তিথি। একমত হয়ে যাওয়াটাই হয়তো এখানে তার জন্য ভালো।

বুক পকেট থেকে চশমাটা বের করলো শুভ্র। বেশ মোটা কাঁচের চশমা। চোখটাকে ছেলেবেলা থেকেই খেয়েছে সে, তবে বাদুড় ঝোলার সময় অজ্ঞাত কোনো কারণে চশমা খুলে রেখেছিলো। চশমা চোখে দিতে দিতে বললো, “তবে তোমাকে চশমা ছাড়াও চিনতে পেরেছি অন্য একটা কারণে।”

আগ্রহ নিতে তার দিকে তাকালো তিথি।
“কোন কারণে?”
একটু কাশলো শুভ্র, “আসলে, ফার্স্ট সেমিস্টারে তোমার ওপর ক্রাশ খেয়েছিলাম।”
মৃদু হাসলো তিথি, “কিউট তো!”
“প্রোগ্রামে যাওনি?” প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো শুভ্র।
“গেছিলাম। একটার পর একটা-”
“হিন্দী ঝাড়ছে, তাই তো?” মিটিমিটি হাসে শুভ্র, “আমিও সেজন্য বেরিয়ে এসেছি। দেশে মনে হয় ভাষার খুব আকাল পড়েছে! নোয়াখালি, চিটাইঙ্গা, বরিশাইল্যা বা সিলেটিতে গান করলেও মেনে নিতাম। তারা বর্ডার পেরিয়ে যাবে। একেবারে সীমানা পেরিয়ে, ভারতমাতার আঁচল তলে।”

ক্ষুব্ধ শুভ্রকে ভালো লেগে যায় তিথির, একটু আগের ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। খোলা মনের ছেলে, ক্রাশ খাওয়ার কথাটা ক্রাশের সামনে চটপট বলে ফেলে না নাহলে কেউ। তারওপর হিন্দী সহ্য করতে পারে না। রক্তাক্ত বায়ান্নোর পর বিজাতীয় ভাষাকে বাংলার ওপর প্রাধান্য দিলে কোনো সচেতন বাংলাদেশিই তার নিন্দা না করে পারে না। ভালো না লাগার কোনো কারণ নেই।

“ভাবছি এই প্রোগ্রামই বর্জন করবো নাকি।” শুভ্রকে বললো ও।
ছেলেটা অবশ্য কোনো মন্তব্য করলো না। তিথির কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত নজর বোলাচ্ছে। একটু অস্বস্তিই হলো ওর। পরক্ষণেই কেটে গেলো শুভ্রের কথাটা শুনতে পেয়ে,

“ধ্যাত, জিন্স পরোনি। নাহলে তুমিও বাদুড় হয়ে থাকতে পারতে এখানে।”
উঠে দাঁড়িয়ে ওপরে হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙ্গলো শুভ্র। পাশেই চা-সিগারেটের দোকান পেতে বসে আছেন রইসুদ্দি মামা। ভার্সিটির সবার প্রিয় মুখ। ব্রেক টাইমে অনেকেই এই কাউন্টারের সিটগুলোতে বসে আড্ডা দেয়। সেই সাথে রসদ নেয় রইসুদ্দি মামার দোকান থেকে। তার দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই একটা মার্লবোরো আর লাইটার হাতে চলে এলো শুভ্রর।

রোদের আক্রমণ থেকে চোখ বাঁচাতে অযথাই খানিক পিটপিট করলো সে। সিগারেটে আগুন ধরিয়ে পরিমিত টান দিলো বারকয়েক। তাতেই এলাকা ধোঁয়ায় ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। তিথির দিকে তাকিয়ে মুখ নাচালো তারপর।
“প্রোগ্রাম বর্জন করবে যখন, চলো।” আবারও চোয়াল বাঁকিয়ে মুখ ঝাঁকালো শুভ্র, “বাসায় চলো।”
“ও হ্যাঁ, তুমি তো আবার লোকাল।” এতটুকুই বললো তিথি। ছেলেটার স্ট্রেটফরোয়ার্ড কথা বার্তায় রীতিমতো স্তব্ধ সে।

একটু আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় হয়েছে তাদের। এর মধ্যে অনায়াসে তাকে জানিয়ে দিয়েছে একটা সময় (কিংবা হয়তো এখনও) তার প্রতি দুর্বল ছিলো সে। তারপর তাকে রীতিমতো ‘স্ক্যান’ করেছে। এবং এখন প্রস্তাব দিচ্ছে তার বাসায় যাওয়ার জন্য। শুভ্রের পরের কথাটা আরও চমকে দিলো তাকে।

“কই, চলো?” হাত বাড়িয়ে কাওকে ডাকলো সে, “একটা রিকশা নেই।”
রিকশাওয়ালা এসে গেছে, তিথি এখনও কিছু বলার সুযোগই পায়নি। সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে তিথির সামনে এসে দাঁড়ালো শুভ্র। ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, “এসো। খুব দূরে না আমার বাসা।”

“তোমার বাসায় যাবো কি করতে?” না বলে আর থাকতে পারলো না তিথি, “এখানে থাকতেই ভালো লাগছে আমার।”
বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠলো শুভ্রের মুখে, “বুঝেছি। বাসায় গিয়ে তোমার সাথে কি করবো সেটা ভাবছো তো? আরে সেই ভয় নাই। একদম খালি বাসা। মম-ড্যাড গ্রামের দিকে গেছে। দুই তিন দিন পর আসবে হয়তো।”

রীতিমতো ক্ষেপে উঠলো তিথি। তবে কিছু বলতে পারলো না। শুভ্রের চোখে চোখ পড়তে বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। ওর সাথে মজা করছে ক্যাম্পাসের জিনিয়াস পাগল! পিত্তি জ্বলে গেলো তিথির।

ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়ালো এবার, “চলো।” রিকশাতে উঠে গেলো সরাসরি, “তোমার বাসাতেই যাবো এখন।”
ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে হাসতে আর ফক ফক করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রিকশাতে উঠে পড়লো শুভ্রও।

দুই.
তিনতলা বাড়িটার সামনে থেমে গেলো রিকশা। ক্যাচ ধরে ধরে চাবির গোছাটা নিয়ে খেলছে শুভ্র। পাশে হেঁটে আসা তিথির দিকে যেনো কোনো নজরই নেই। বিশাল গ্যারেজের দরজার এক কোণে ছোটো দরজা, সেটা খুলে ফেললো নির্দিষ্ট চাবি ব্যবহার করে। তারপর ধরে থাকলো কিছুক্ষণ, তিথিকে ঢোকার সুযোগ করে দিচ্ছে। ভেতরে পা রেখে একটু চমকালো ও, গ্যারেজে যে চারটা গাড়ি আছে, তার তিনটার কোনটাই কয়েক কোটির কম দামের নয়। রেসিং কারই দুটো।

শুভ্রদের টাকা আছে, ভাবলো তিথি।

সিঁড়িঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শুভ্র, তাকে একটু জোরে পা চালিয়ে ধরে ফেললো তিথি।
“তোমাদের গ্যারেজের ভেতরে যা যা আছে তা বিক্রি করে দিলেই তো আরেকটা অডিটোরিয়াম বানাতে পারবে ভার্সিটি।” কথার কথা হিসেবেই বললো যেনো তিথি।
হাহা করে হাসলো শুভ্র, “ফুটানি দেখানোর জন্য কিনেছিলো বাবা। এখন পড়ে আছে। ওই টাকাটা আমাকে দিলে দুনিয়ার স্যাটেলাইট হিস্টোরিই পাল্টায়ে দিতাম।”

আর কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিলো তিথি। দোতলার দরজায় এসে আরেকটা চাবি বের করলো শুভ্র। বড় একটা তালা ঝুলছে ওদের দরজায়। খটকা লাগলো তিথির। এতো মূল্যবান গাড়িগুলো পাহারা দেওয়ার জন্য নিচে একজন মানুষও নেই। কেনো? দারোয়ান তো একজন রাখাই যেতো। তাছাড়া এই গাড়িগুলো বের করার সময় গ্যারেজের দরজা খোলা আর লাগানোর জন্য হলেও একজন গেট ম্যানের তো দরকার। কিন্তু কেউ ছিলো না নিচে। কেনো ছিলো না? আবার এখানে শুভ্র তার বাড়ির দরজা থেকে তালা খুলছে।

তাহলে, আসলেই তার বাসায় কেউ নেই।
ফাঁকা বাসায় তিথিকে নিয়ে এসেছে শুভ্র। কি তার উদ্দেশ্য?

এক পা পিছিয়ে গেলো তিথি। “তোমার বাসায় কেউ নাই?”
অবাক হতে ওর চোখে চোখ রাখলো শুভ্র, “তোমাকে না বললাম, বাসার সবাই গ্রামে গেছে?”
দুই হাত বুকের কাছে বাঁধলো তিথি। এবার সত্যিই রাগ হচ্ছে ওর।
“খালি বাসায় আমাকে আনলে কেনো?”
মুচকি হাসলো শুভ্র, “তোমার পর্ন ভিডিও বের করার জন্য। আমি এটাই করি। একা একটা মেয়েকে নিজের বাসায় এনে তার সাথে অনৈতিক কাজ কর্ম করি। আমার ক্ষুদে রোবটেরা তা ভিডিও করে। তারপর সেই সব ভিডিও চড়া দামে বাজারে বিক্রি হয়। আমার উদ্দেশ্য তোমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে?”

থমথমে মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো তিথি। গনগনে আঁচ বের হচ্ছে যেনো মুখ থেকে। ফর্সা মুখটা এখন টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তিথির নিজেরই মনে হচ্ছে তার কান গরম হয়ে গেছে। রাগে না লজ্জায় তা সে বুঝতে পারছে না। সিঁড়িঘরের ভেতরটা খানিক অন্ধকার। কিন্তু কেনো জানি বন্দীত্বের অনুভূতি হচ্ছে না তার।

“চলে এসো ভেতরে।” ঢুকে পড়লো শুভ্র, তিথির ওপর আক্রমণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না তার মধ্যে, “আগেই তো বলেছি তোমার ওপর ফার্স্ট সেমিস্টারে ক্রাশ খাওয়া আমি। ভয় পাচ্ছো কেনো? খুব বেশি কিছু হলে জাপ্টে ধরে চুমু-টুমু খেয়ে ফেলতে পারি, এর বেশি আর কিছু ক্রাশের সঙ্গে করা যায় নাকি? তোমার ভয় পাওয়ার কিছু তো দেখি না।”

বিষয়টা তিথির কাছে ঠিক স্পষ্ট হচ্ছে না। শুভ্রর মতো ছেলে সে জীবনে একটাও দেখেনি। তার ব্যাপারে অনেক প্রশংসা শুনেছে এতোদিন, তবে ব্যক্তিগতভাবে শুভ্রকে চেনে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ব্যক্তি শুভ্রকে চিনতে তিথির কেমন লাগছে সেটা সে বুঝতে পারছেন না। কখনো মনে হচ্ছে শুভ্রকে জানতে পারাটা একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। আবার কখনো মনে হচ্ছে এটা আর এগিয়ে যেতে না দেওয়াটাই উচিত।

সামনে শুভ্রের বাসায় ঢোকার মূল দরজা হা করে খোলা। তাকে হাতছানি দিয়েছে শুভ্রও, তবে এর ভেতর ঢুকে পড়া উচিত হবে কি না তা সে বুঝতে পারছে না। ধীর ও কম্পিত পায়ে ঢুকে পড়লো তিথি। শুভ্রের হাতে মোবাইলফোন। একটা কিছু করতেই পেছনে দড়াম করে দরজাটা লেগে গেলো।

“অ্যান্ড্রয়েড একটা অ্যাপ বানিয়ে নিয়েছি। আমাদের সিকিউরিটি খুবই স্ট্রং।” সগর্বে বললো শুভ্র, “কেউ ঢুকতে বা বের হতে পারবে না, যদি আমি না চাই।”
“তাহলে বাইরে পুরাতন আমলের অ্যানালগ লক ঝোলানোর দরকার কি ছিলো?” ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো তিথি।
“ওল্ড ইজ গোল্ড।” ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেলো সে। তিথি কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা কাঁচের বোতল তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে সে। শুন্যে খপ করে ধরে ফেলতে ফেলতেও ফেলে দিচ্ছিলো তিথি, আরেকটু হলেই মেঝে ভেসে যেতো কোক আর কাঁচের টুকরোয়। অস্ফূট আর্তনাদ বেরিয়ে গেলো তার মুখ থেকে।
“আমার রুমে চলো।” সরসরি সামনে হাঁটা দিলো শুভ্র।

বদ্ধ এই দরজাটাও মোবাইলের সাহায্যে খুললো সে। তারপর সরে জায়গা করে দিলো তিথির ঢোকার জন্য। ছিমছাম ঘর। একটা ডাবল বেড, কম্পিউটার টেবিল আর একটা চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই। দেওয়ালের সাথে লাগিয়েই বানানো হয়েছে বইয়ের তাক। সেগুলোতে ঠাসা নানা ভাষার বই। ডাবল বেডের ঠিক মাথার কাছে দেওয়াল জুড়ে সাঁটা হয়েছে পূর্ণাঙ্গ নগ্ন নারীদেহের ছবি। নারীটির মাথায় ঘন সোনালিচুল, দৃষ্টিনন্দন দেহসৌষ্ঠব। চেনা চেনা মনে হলেও তিথি নিশ্চিত হতে পারলো না।

“কিসা সিনস।” শুভ্র বললো খাটের পাশে দাঁড়িয়ে, “আমার প্রিয় পর্ন তারকা। জনি সিন্সের ওয়াইফ।”
মাথা দোলালো তিথি, “জনি সিন্স কে?”
“আরেকজন পর্ন স্টার।” অবাক হয়ে উত্তর দিলো শুভ্র, এতো সহজ প্রশ্ন যেনো জীবনে শোনেনি, “কিসা সিন্সের হাজব্যান্ড।”
“ও।” এতটুকুই বললো তিথি। স্কুলটা নদীর সামনে, আর নদীটা স্কুলের পেছনে জাতীয় উত্তর দেওয়া হলে আর কি বলার থাকে?
“তুমি বসো। আমার পিসিটা অন করি।” দেওয়ালের সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলো সে। এর সঙ্গে মনে হয় অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সংযোগ রাখা যায়নি।

ডাবল বেডে বসে তিথির দেহে চনমনে একটা ভাব চলে আসলো। ঝকমকে ঘর, দেওয়ালে উত্তেজক পোস্টার আর শুভ্রের খোলামেলা কথা, সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক আকর্ষণ। তিথির মনে হলো সে সামান্য সম্মতি দিলেও এই ঘরে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে আজ। শুভ্র জানে, সে-ও জানে এমন কিছু আজ এখানে হবে না। অথচ সম্ভাবনা তো রয়েছে। বিন্দুমাত্র হলেও! সেটাই চনমনে অনুভূতিটার পেছনে কাজ করছে।

অবাক হয়ে তিথি লক্ষ্য করলো, শুভ্রকে সে বিশ্বাস করে। কেনো? এটা সে জানে না।

“আংকেল আন্টি কিছু বলে না?” গলা খাকারি দিয়ে জানতে চাইলো তিথি।
“কি বলবে?” সেই চিরায়ত অবাক অবাক দৃষ্টি এখন শুভ্রর চেহারায়। ও আবিষ্কার করলো এই অভিব্যক্তিতে ছেলেটাকে বেশ সুন্দর দেখায়।
“এই যে…” আরেকবার কাশলো তিথি, “কিসা সিনসের ন্যুড ফটোগ্রাফ বেডরুমে রেখেছো।”
কাঁধ ঝাঁকালো শুভ্র, “আরে আমার পেশাই তো ওই। মেয়েদের ধরে এনে এনে তাদের পর্ন ভিডিও বের করা। ওই খাটে কতোজনের ইজ্জত গেছে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”

ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো তিথি, “সিরিয়াসলি? এসব লো ক্লাস জোকস ছেড়ে কি লাভ হচ্ছে, শুভ্র?”

ঝট করে মাথা ঘুরালো শুভ্র।
এক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো তিথির চোখে চোখ রেখে। শিউরে উঠলো ও, অদ্ভুত এক ঠাণ্ডা অনুভূতি হচ্ছে। এক সেকেন্ডকে মনে হচ্ছে অনন্ত কাল। কালো চোখের তারায় অশুভ কিছু আছে ছেলেটার। সে যা বলছে সবই কি মীন করে বলেছে? তিথির এতো অনিশ্চিত লাগছে, এমন আগে কখনও হয়নি। অথচ চলে যেতে ইচ্ছে করছে না। ছেলেটা অন্যরকম। তার সান্নিধ্য ভালো লাগছে ওর।
ভীতিকরও লাগছে!

“এগুলো জোকস মনে করছো কেনো, তা কি তোমার জানা আছে তিথি?” কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠে দাঁড়ালো শুভ্র। অজান্তেই হাতে ধরে রাখা ঠাণ্ডা বোতলটা চেপে ধরলো ও। কিন্তু তার দিকে আসছে না ছেলেটা, দেওয়ালের কাছে একটা তাকের সামনে দাঁড়ালো। বটল ওপেনার বের করলো একটা। নিজের কোকটা খুলে তিথির দিকে ছুঁড়ে দিলো। এবার অল্পের জন্য কপাল কাটা থেকে রক্ষা পেলো ও।

“জিনিস ছুঁড়ে দেওয়ার অভ্যাসটা খুব খারাপ তোমার।” ঝাঁঝিয়ে উঠে কোকটা খুললো তিথি।
“আসলে, তুমি সামাজিক হিপনোটিজমে আটকে গেছো। দ্যাটস অল।” নিজের কথার খেই ধরলো শুভ্র, “সেজন্য আমি যাই বলি তোমার কাছে অন্যরকম লাগে। নতুবা ধরে নাও স্রেফ জোকস ছাড়ছি।”

খাটে উঠে তিথির মুখোমুখি বসলো সে। বোতলটা একটু সামনে এনে ঠুকে দিলো মেয়েটার বোতলে, “চিয়ার্স।”
শুভ্রের শরীরে গন্ধ পেলো ও, এখনও মাংসপেশি টান টান হয়ে আছে তিথির। সাবধানে চুমুক দিলো বোতলে।

হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলো শুভ্র, “ফাইন। আমি পর্ন-টর্ন বানাই এসব সত্যি না। ওসব লো ক্লাস জোকস-ই ছিলো।” তারপরই তিথির পিত্তি জ্বলে যাওয়ার মতো হাসি হাসলো সে, “কিন্তু সেই লো ক্লাস জোকসেই তোমার চেহারার যে দশা হয়েছিলো!” মেয়েটার উরুতে মাঝারি এক চাপড় দিয়ে উঠে দাঁড়ালো শুভ্র, “টেনশনের কিছু নাই। কোকটা শেষ করো। আমি লাঞ্চের ব্যবস্থা করি। বিফে তোমার প্রবলেম আছে?”

কটমট করে তার দিকে তাকালো ও, “হ্যাঁ। আমাদের ধর্মে নিষেধ আছে, জানো না?”
গাল চুলকাতে চুলকাতে কিচেনের দিকে চলে গেলো অদ্ভুত ছেলেটা।

তিন.
ক্লাস থেকে বের হতেই নেহালের সাথে দেখা হয়ে গেলো তিথির। কাঁধে ব্যাগ আর হাতের বোঝা সদৃশ খাতা নিয়ে হাঁসফাঁস করছে। ওদের সিআর (ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ)দ্বয়ের একজন এই ছেলেটা, তবে কাজের সময় তার আশেপাশে কাওকে দেখা যায় না। মায়াই হলো তিথির।

“দে, আমার হাতে দে কিছু।” এগিয়ে গিয়ে বললো ও।
করুণ একটা হাসি হাসলো নেহাল, একটা বান্ডিল ওর হাতে তুলে দিলো, “থ্যাংকস। কি খবর তোর?”
“তোর চেয়ে ভালো, যা দেখতে পাচ্ছি।” চোখ টিপলো তিথি।
“গর্তে পড়লে হাতিকে চামচিকাও লাথি মারে। পরীক্ষিত।” হতাশ কণ্ঠে বললো নেহাল।
“নিজেকে চামচিকা প্রমাণের চেষ্টা না করে অন্য সিআরটাকে একটু ঝাড়ি-টারি দিস। সব দায়িত্ব তো তোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বিদেয় হয় দেখি।” কপট রাগের সাথে বললো তিথি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটলো ওরা। গন্তব্য, ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং। স্যারের রুমে সব খাতা জমা দিয়ে এসে শান্তি। নিস্তব্ধতা ভাঙ্গতে মুখ খুললো নেহালই।
“শুভ্রর সাথে তো তোকে রেগুলার দেখা যাচ্ছে শুনলাম।” অর্থবোধক উচ্চারণে বললো নেহাল।
“তো? একসাথে রেগুলার বের হলে তো রেগুলারই দেখতে পাবি। অবাক হচ্ছিস যে?”
“অবাক হবো কি আর? জানতে চাইলাম, প্রেম ট্রেম করছিস কি না, তাই আরকি। করলেই আমাদের লাভ, স্বীকার করতে বাঁধা নাই।”
“আমি প্রেম করলে তোদের কি লাভ?”
“ট্রিট পাবো যে। গ্র্যান্ড ট্রিট।”

ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং থেকে ফেরার সময় ক্যাম্পাসের আগুন ধরানো সুন্দরী মেহজাবিনের সাথে দেখা হয়ে গেলো তিথির। মডেলিং-টডেলিংও করছে আজকাল। তিথিকে দেখতে পারে না এই মেয়ে, কেনো কে জানে। অবশ্য মেহজাবিন ক্যাম্পাসের কোনো সুন্দরী মেয়েকেই দেখতে পারে না। মুখে প্রকাশ না করলেও তার আচরণ তেমনটাই বলে। বরাবরের মতো তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছিলো তিথি, পারলো না।

আগ্রহী মেহজাবিন গায়ে পড়ে কথা বলতে এলো আজ। “কি রে সুন্দরী, কি খবর তোর? তোকে কয়েকদিন ধরে খুঁজছি আমি।”
“আমাকে খুঁজছিস?” অবাক হয়ে গেলো তিথি। “কেনো?”

মেহজাবিন ওকে একটা কারণেই খুঁজতে পারে। হয়তো কোনো প্রতিযোগিতায় দুইজনই অ্যাটেম্পট নিয়েছিলো, তাতে তিথি বাদ পড়েছে তবে মেহজাবিন টিকে গেছে। তেমন কোনো খবর জানানোর জন্যই কেবল এই মেয়ে অন্য কোনো সুন্দরীকে খুঁজে। এসব তিথির জানা আছে। মনে করার চেষ্টা করলো, এর মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলো কি না। মনে তো হয় না।

“আরে, শুভ্র তোর বেস্ট ফ্রেন্ড না?” শুরু করলো মেহজাবিন। একটু আগেই তিথির খবর জানতে চেয়েছিলো এবং তিথি যে সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি সেদিকে তার আর নজর নেই এখন। আসল কথা পাড়তে পারলে ফরমালিটিতে সময় নষ্ট করে কে? “শুভ্রর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে হবে তোকে। পরিচয় মানে ডেট। একটা ডেট ম্যানেজ করে দিবি তুই আমাকে। পারবি না?”
মুচকি হাসলো তিথি, “শুভ্র তোর সাথে ডেট করতে রাজি হবে কেনো?”
“হবে নাই বা কেনো? ভালো ছেলে ও, ফ্রি মাইন্ডেড। অরাজি হওয়ার তো কিছু দেখি না। অবশ্য তোকে এসব বলে কি লাভ? তুই ওকে আমার চেয়ে ভালো চিনিস।” তিথির হাতে চিমটি কাটলো মেহজাবিন, ন্যাকামি দেখে তিথির গা জ্বলে যেতে থাকলেও কিছু বলতে পারলো না।

মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে বলে চললো মেহজাবিন, “পারবি তুই, আমি জানি। আর শোন্, ওকে কিন্তু ভালোমতো বানিয়ে দিতে হবে। বুঝিয়ে দিস আমি ওর ওয়ান নাইটার হতে চাইছি। সেক্স-টেক্স নিয়ে আমার কোনো বাড়তি কুসংস্কার নাই। এটা যেনো সে জেনে রাখে।”
তিথি কিছুই বুঝতে পারছে না এখন, “ওকে এক রাতের জন্য বিছানায় তুলে তোর কি লাভ?”
“তুই গাধা নাকি? ওর ডিজাইন করা স্যাটেলাইট যে ইউরেনাস যাচ্ছে সামনের বছর তা জানা আছে তোর?”
কাঁধ ঝাঁকালো তিথি, “জানবো না কেনো? দারুণ কাজ করেছে ও। বাংলাদেশের জন্য গর্বের হবে এটা।”
“সেইজন্যই ওকে আমার লাগবে রে। প্লিজ দোস্ত, ম্যানেজ করে দে না?” মেহজাবিন পারলে তিথির পায়ে পড়ে যায়, “অবজার্ভার টিভিতে কাজ করার সুযোগ পেতে যাচ্ছি আমি, শুনেছিস? আমার প্রোগ্রামে একবার শুভ্রকে নিয়ে যেতে পারলে কি হিট হবে চিন্তা করে দ্যাখ? ক্যারিয়ার আমার রকেটের বেগে ওপরের দিকে ছুটবে।”

আচ্ছা! এবার সবটা স্পষ্ট হলো তিথির কাছে। এখন শুভ্রর সাথে একরাত কাটাতে পারলে তার সঙ্গে একটা ইন্টিমেসি হবে। এরপর এক বছর পর শুভ্র হয়ে যাবে ন্যাশনাল হিরো। সঠিকভাবে বললে ইন্টারন্যাশনাল হিরো। গোটা দুনিয়ায় তাকে নিয়ে মাতামাতি হবে। এই ছেলে নাসাতে ঢুকে যাবে এটাও অনেকে নিশ্চিত। বাংলাদেশের সবাই ডক্টর ইউনুসের পর পরই চিনবে তাকে। বলাবলি করবে, ইউরেনাসকে চক্কর দিতে থাকা স্যাটেলাইটটা বানিয়েছে আমাদের একজন। একজন বাংলাদেশি। তখন সেই বাংলাদেশিকে নিয়ে স্টুডিওতে যাবে মেহজাবিন। একবছর পর। মেয়েটার দূরদর্শিতা দেখে চমৎকৃত হলো তিথি।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে অবশ্য উল্টোটা বুঝলো মেহজাবিন, “কিরে, তোদের মধ্যে কি প্রেম চলে? তোর আর শুভ্রর?”
মাথা নাড়লো তিথি, “না রে। ও মুসলিম না? আমার সাথে প্রেম কিভাবে?”
“আরে বাদ দে। হিন্দু মুসলমান সে দেখে বলে মনে হয় না। আমার কি ধারণা জানিস? শুভ্র নাস্তিক। তুই জিজ্ঞাসা করে দেখিস একদিন। যাই হোক, প্রেম করছিস না দেখে ঝামেলা কমলো। নাহলে ওর সাথে শোয়ার জন্য তোর অনুমতিও লাগতো।”
মুচকি হাসলো তিথি, “এর আগে এই কাজ যাদের সাথে করেছিস সবার গার্লফ্রেন্ডের অনুমতি নিয়েছিলি?”
মাথা নাড়লো মেহজাবিন, “তাদের গার্লফ্রেন্ডদের কেউ আমার ফ্রেন্ড তো ছিলো না। অবশ্য শুভ্রকে আমি এতো সহজে ছাড়বো না। এক রাত ওকে পেলে, ছিবড়ে বানিয়ে ফেলবো একেবারে। এর পর আরও অনেকবার সে নিজে থেকেই আমার কাছে আসবে। ছেলেরা কি পছন্দ করে আমার জানা আছে। তুই শুধু ফার্স্ট নাইটের সেটআপটা করে দে। বাকিটা দেখছি। শুভ্রকে আমি হিট করে দেবো।”

সেই সাথে নিজেও হিট হবা, মনে মনেই বললো তিথি। সব কথা মেহজাবিনের মুখের ওপর বলতেই হবে এমন তো না। আরও কিছুক্ষণ বক বক করলো মেহজাবিন। পুরোটা সময় অনেক কষ্টে হাসি আটকে রাখলো তিথি। বিদায়ের সময়ও আদিখ্যেতার চূড়ান্ত করলো সে। ক্যাম্পাসের মাঝখানেই বেস্ট ফ্রেন্ডদের মতো তিথির গালে চুমু খেলো, তারপর দুই আঙুল নেড়ে টাটা দিলো তাকে। মেহজাবিনের সব কাজের পেছনেই স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। ক্যাম্পাসের কেউ এসব কাজে এখন আর পাত্তা দেয় না। তারপরও আড়ালে হাসলো কেউ কেউ।

সেদিন হলে ফেরার সময় শুভ্রের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনটা মনে করলো তিথি, প্রায় একবছর হয়ে গেলো!
হ্যাঁ, খুব নার্ভাস ছিলো সে ওইদিন। অসহায়ও ছিলো। শুভ্রের সুরক্ষিত বাড়ির ভেতরে একদম কোণার ঘরে শুভ্রর সঙ্গে বন্দী। বাসায় আর কেউ ছিলো না। শুভ্র তার সঙ্গে যা ইচ্ছে করতে পারতো। কোনো সাক্ষী ছিলো না সেদিন। কিন্তু কিছুই করেনি সে। দু’বার ওকে স্পর্শ করেছে কেবল। হাসিচ্ছ্বলে একবার উরুতে চাপড় দিয়েছে ওকে বোকা বানিয়ে, আরেকবার ফিস্ট বাম্প করেছে, বিদায়ের সময়। আর কিচ্ছুটি না।

শুভ্র জানে না, ওই দুটো স্পর্শের সময়ই তিথির বুকে ঝড় উঠেছিলো।

চার.
মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারে কাজ করছে শুভ্র। মনিটরে দেখা যাচ্ছে অসম্পূর্ণ একটা ডিজাইন। কিসের, তা আরও অস্পষ্ট। তবে সেটা বোঝার চেষ্টাও করলো না তিথি। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো শুভ্রকে।

“তিথি নাকি?” মনিটর থেকে চোখ না সরিয়েই জানতে চাইলো শুভ্র, “তোকে খুব খুশি খুশি লাগছে মনে হচ্ছে।”
ওকে ছাড়লো না তিথি, “খুশি হওয়ার কারণ আছে। তোর কাজটা শেষ কর, আমরা বাইরে ডিনার করছি আজ।”
মাউস থেকে হাত সরিয়ে তিথির দিকে মুখ ফেরালো শুভ্র, নাকে নাক ঠেকে গেলো ওদের, “বাইরে কেনো রে? ঘরে অনেক খাবার আছে, মম রাতে স্পেশাল আইটেম করছে আজ। বাইরে যাওয়াই যাবে না।”

শুভ্রের কথা শেষ হওয়ার আগেই “মম” ঢুকে গেলেন ভেতরে। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স হবে ভদ্রমহিলার। দেখতে একেবারে বলিউডের কোনো বর্ষীয়ান হিরোইন। তিথি যতবার তাঁকে দেখে, ওর মনে হয় শুভ্রের চেহারার সৌন্দর্যটা হয়তো মায়ের দিক থেকেই এসেছে।

“কি? আমাকে নিয়ে কি ব্যাকটকিং করছিস তোরা?” হাসিমুখে জানতে চাইলেন তিনি।
শুভ্রকে জড়িয়েই রাখলো তিথি, “না আন্টি, তোমার প্রিন্সকে বাইরে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সে তো যেতেই চাইছে না। কি করা যায় বলো তো।”
“যাবে কি রে?” অবাক হয়ে যাওয়ার অভিব্যক্তি এখন মহিলার মুখে, ঠিক শুভ্রের মতো। তিথির হাসি পায় খুব, “আমি রান্না করছি আজ কতোদিন পর, আর তোরা বাইরে যাবি মানে? কোথাও যাওয়া চলবে না।”

আলতো করে মাথা ঝাঁকালো তিথি, এটা কোনো সমস্যা না। অন্য কোনোদিন গেলেই চলবে। মুখে শুধু বললো, “ওকে, আন্টি।”
বের হওয়ার সময় কিসা সিন্সের পোস্টারটার দিকে চোখ পড়লো আন্টির, “আর শুভ্র, তুই এই এক মেয়ের মধ্যে কি এমন পেয়েছিস রে? দেখতে দেখতে আমারই চোখ পচে গেলো। বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখেছিস, যত্তোসব! দুনিয়ায় আর মেয়ে নাই?”

গজ গজ করতে করতে চলে গেলেন তিনি। হেসে ফেললো তিথি, কিসা সিন্সের যে পোস্টারটা এখন পুরো একটা দেওয়াল জুড়ে আছে তা অবশ্যই এক বছর আগের ছবিটি নয়। এর মধ্যে খুব সম্ভবতঃ সাতবার পোস্টার পাল্টেছে শুভ্র। প্রতিবারই কিসা সিন্সের ছবি ঝুলিয়েছে এবং প্রতিবারই সম্পূর্ণ নগ্ন সে ছবিগুলো। তবে এসবে ওদের পরিবারের কারও চোখ বা ভ্রু কুঁচকে যায় না। এগুলো তাঁরা খুব স্বাভাবিকভাবে নেন। আন্টির আপত্তি কিসা সিন্স নিয়ে। তার শরীর চোখের সামনে এতোবার পড়েছে তিনি আর মেয়েটাকে সহ্যই করতে পারছেন না।

তিথি প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে পারতো না। একটু অস্বাভাবিক মনে হতো ওদের পরিবারটিকে। তবে এখন আর তেমনটা লাগে না। মনে হয় এটাই হয়তো সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি। ওরা সমাজে নিষিদ্ধ আর ‘অ’নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে একই পর্যায়ের খোলামেলা আলোচনা করেন। এজন্য তাদের সামনে তাদের ছেলেকে ছেলের বান্ধবী জড়িয়ে ধরতে পারে, নগ্ন পোস্টার দেখলে তাঁরা চোখ কপালে তুলে ফেলেন না। শুভ্রকে কখনও মেয়েদের প্রতি বাজে কোনো ধারণা রাখতে দেখেনি তিথি। তাদের ছোটো করতেও দেখেনি। পজেটিভ চিন্তাভাবনা গুলো হয়তো পরিবারের সুশিক্ষার কারণেই সে পেয়েছে। এখন আন্টি আর আংকেলের কাজটাকেই ঠিক মনে হয় তিথির।

“নতুন কিছু পেয়েছিস মনে হচ্ছে। আমাকে শোনাবি দেখে চলে এসেছিস। আর সেইটা বাইরে নিয়ে বলার জন্য ডিনার বাইরে করতে চাইছিস।” কম্পিউটার ছেড়ে সুইভেল চেয়ার ঘুরিয়ে তিথির মুখোমুখি হলো শুভ্র, “তাই না?”
“তুই তো জিনিয়াস পাগল। তোর কাছে লুকানো সম্ভব না কিছু।” হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বললো তিথি।
“তাহলে বলেই ফ্যাল, এবারের হট নিউজটা কি?” চোখ নাচিয়ে জানতে চাইলো শুভ্র।

একটু পিছিয়ে গিয়ে ধপাস করে শুভ্রের খাটে শুয়ে পড়লো তিথি। দুই হাত ছড়িয়ে দিয়েছে দুই পাশে, চুল এলিয়ে দিয়েছে পেছনে। পালকের তোষকের এই খাট খুবই আরামদায়ক। শুলেই ঘুম পায় ওর। আরামে চোখ বন্ধ করে বললো, “নিউজটা হট-ই। মেহজাবিন রিলেটেড।”
“কোন মেহজাবিন, আইপিই’র? প্র্যাক্টিক্যাল একটা মেয়ে। ভালো মেয়ে।” শুভ্র বললো।
চোখ খুলে গেলো তিথির, “কি রে? এতো অ্যাডজেক্টিভস? প্র্যাক্টিক্যাল, ভালো? আরে ব্যাটা ওই মেয়ে তোর সাথে একরাত কাটাতে চাইছে। পবিত্র মেয়ে তোমার, কুমারী নাম্বার ওয়ান।”

চোখ পিট পিট করলো শুভ্র, “তাতে কি হলো? অবজার্ভারে কাজ পেয়েছে ও, একটা সায়েন্স রিলেটেড শো-র অ্যাংকর। আমার সাথে মনে হয় ঐ স্যাটেলাইটের ব্যাপারটার জন্য রাত কাটাতে চাইছে। আগামী বছর লঞ্চ করবে স্যাটেলাইট, এটা নিয়ে সারা পৃথিবীতে খুব হই চই হবে। অবশ্য লাইম লাইটটা আমারও দরকার, বাংলাদেশের সোসাইটি নিয়ে আমার প্ল্যান আছে। দেশের মিডিয়া কাভারেজের একটা অংশ যদি মেহজাবিন দেয়, তাহলে খারাপ কি? ওর প্রস্তাবটা আমি ফেলবো না।”

উঠে বসলো তিথি, “মানে তুই ওর সাথে শুবি? ওরকম নষ্টা একটা মেয়ের-”
“ওকে নষ্টা বলছিস কেনো?” এক হাত তুলে তিথিকে থামিয়ে দিলো শুভ্র, “অনেকের সাথে সেক্স করে এসেছে এটাই তো অভিযোগ? একটু আগে ওকে অপবিত্রও বললি। আচ্ছা, একটা মেয়ে কয়েকজনের সাথে সেক্স করলেই কি সে অপবিত্র হয়ে যায়?”

তিথির চোখমুখ কঠিন হয়ে গেছে, “অবশ্যই হয়।”
“কেনো হয়? তার দেহের কোনো উপাদানে তো পরিবর্তন আসে না। তাহলে কেনো তাকে অপবিত্র ঘোষণা করা হয়?”
তিথি এর জবাব দিতে পারলো না। কিন্তু হার মানতে চাইলো না সে, জোর গলায় প্রতিবাদ করলো, “অবশ্যই কোনো না কোনো পরিবর্তন আসে। নাহলে বেশি মানুষের সাথে শুলে ছেলে বা মেয়ের যৌনরোগ হয় কেনো?”
“প্রটেকশন নেয় না তাই।” মুচকি হেসে বললো শুভ্র, তিথির কাছে বিষয়টা যতো সিরিয়াস, তার কাছে এটা ততোই হাস্যকর। একটি কৌতুক ছাড়া আর কিছু তো নয়। “প্রটেকশন থাকলে কোনো রোগও হয় না। অর্থাৎ প্রটেকশন থাকলে পবিত্রতা নষ্ট হয় না।”

“একটা মেয়ে তার সবকিছু আরেকজনকে এক রাতের জন্য দিয়ে দেবে অথচ তার পবিত্রতা নষ্ট হবে না?” ক্ষেপে উঠলো এবার তিথি, “ওই মেহজাবিন তো একটা মাগি। মাগির সাপোর্টে কতো কথা তোর! ওর সাথে শোয়ার খুব ইচ্ছা থাকলে শো না, যা। সেইটাকে পবিত্র করতে চাইছিস কেনো?”
“একরাতের জন্য তার সঙ্গে আমি যদি থাকি, কি হবে তুই জানিস তো?” মৃদু হাসিটা এখনও ধরে রেখেছে শুভ্র, “আমি তার সবকিছু দেখতে পাবো, স্পর্শের অধিকার পাবো, তার সঙ্গে সেক্সুয়াল ইন্টারঅ্যাক্ট হবে। এই দুটো ছাড়া আর কিছু তো নয়। একটা মানুষের লুকিয়ে রাখার আছেই বা কি। এতে করে তার দেহের গঠন পাল্টে যাচ্ছে না যেহেতু, আমার সাথে কাটানো রাতটার আগের দিন সে যতোটুকু পবিত্র ছিলো, পরের দিনও ততোটুকুই থাকবে। অন্য কারও সাথে রাত কাটানোয় একটা মেয়ের চরিত্র নষ্ট হয় না। পবিত্রতাও নষ্ট হয় না।”

লাল হয়ে এসেছে তিথির মুখ, “একটা কথা ঠিক বলেছিস অন্তত। মেহজাবিনের পবিত্রতা তোর সাথে শোয়ার আগে যা ছিলো পরেও তা থাকবে। আগাগোড়াই নষ্টা যে, তার পবিত্রতা তো নতুন করে যাওয়ার নাই। কিন্তু তোর মতামতে যদি এটা চরিত্র নষ্ট না করে, কোনটা করবে আর? কাকে তুই দুশ্চরিত্রা বলিস?”
খুব সহজ প্রশ্ন করা হয়েছে এভাবে তার দিকে তাকালো শুভ্র, “যে তার ম্যারেজ পার্টনারকে চিট করে সে-ই দুশ্চরিত্র। ধর, মেহজাবিন কাওকে বিয়ে করলো। তারপর সে আমার সাথে ওয়ান নাইটার হলো হাজব্যান্ডকে না জানিয়ে, তখন সে দুশ্চরিত্রা বলেই আমার কাছে পরিচয় পাবে। কারণ, তার ম্যারেজ পেপারে এ বিষয়ে একটা চুক্তি সে করে এসেছে। আদারওয়াইজ, শি ইজ আ নাইস গার্ল। প্র্যাক্টিক্যাল অ্যান্ড রেসপেক্ট্যাবল।”
“রেসপেক্ট্যাবল!”
“হুঁ।”
“জানিস ও কি বলেছিলো আমাকে? আমার সাথে তোর প্রেম চলে কি না তা জানতে চাইছিলো। আমাদের রিলেশন থাকলে সে আমার পারমিশন নিয়ে তোর সাথে শোবে, তাই।”
মাথা দোলালো শুভ্র, “এজন্যই তো আমি ওকে আর ওর মতো মানুষগুলোকে সম্মান করি। ওরা দারুণ মানুষ। মোটেও দুশ্চরিত্রা না। এটাই তোকে বোঝানো যায় না। এক বছরে কিচ্ছুটা শিখতে পারিসনি আমার কাছে।”

ছুটে আসা বালিশটা কোনোমতে এড়ালো শুভ্র। মুখ থেকে হাসি মোছেনি এখনও। ক্ষেপে বোমা হয়ে থাকা এলোমেলো চুলের তিথিকে দেখতে তার ভালোই লাগছে। রীতিমতো চিৎকার করছে এখন মেয়েটা।
“তুই যা। আজ রাতেই মাগির সাথে শুয়ে পর। পা ফাঁক করেই আছে মেহজাবিন মাগি। আমি এখনই ফোন করে বলে দিচ্ছি তুই রাজি। শালা…”

আরও কি কি জানি বলতে বলতে দরজার দিকে রওনা দিলো তিথি।
গলা চড়িয়ে ডাকলো শুভ্র, “আরে কই যাস? মম রান্না করছে। খেয়ে তো বের হ!”
কোনোভাবেই থামানো গেলো না তিথিকে। ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেলো সে।
পেছন থেকে শুভ্রর গলায় শেষ যে কথাটা শুনতে পেয়েছিলো তা ওকে এই প্রথমবারের মতো শুনতে হয়নি।

“হিপটোনাইজড শালী!”

অন্ধকারে হলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটা লক্ষ্য করেছিলো, গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার।

পাঁচ.
আজ রাতেই ওরা শোবে।

বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে তিথি। ঘুম আসছে না। রুমমেট নাবিলা ওকে এরকম করতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়েছে। “কি রে, তোর শরীর খারাপ করছে নাকি?” বলে কপালে হাত বুলিয়েও দেখেছে। কিন্তু তিথির পড়ে পড়ে গড়াগড়ি খাওয়ার রহস্য ভেদ করতে পারেনি। তিথির চোখে আজ ঘুম নেই কারণ আজ রাতেই ওরা শোবে। শুভ্র আর মেহজাবিন। শুধুমাত্র স্বার্থের জন্য।

শুভ্রর সাথে পরিচয়ের পর পর ওর সাথে সামাজিকতার নানা দিক নিয়ে আলোচনা হতো তিথির। বাংলার সমাজ তার সদস্যদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, তার মধ্যে বড় একটা অংশ “সে নো টু…” দিয়ে পরিপূর্ণ। এটা করা যাবে না, ওটা করা খারাপ, এটা অপরাধ, ওটা নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞাসমূহের বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে এমন সব কর্মকাণ্ডের তালিকা যেগুলো যথারীতি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষতির কারণ নয়। তারপরও তারা অপরাধ।

“মূল্যবোধ আর নৈতিকতা কি?” জানতে চেয়েছিলো শুভ্র, “স্রেফ কতোগুলো ধ্যানধারণা। আর সেগুলো এসেছে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। অর্থাৎ, পূর্বপুরুষেরা যা করা সঠিক মনে করেছে তাই তারা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। তাদের চোখে যা করা ভুল, তা আমাদের চোখেও যেনো ভুলই হতে হবে। এর বাইরে তুমি যেতে পারবে না। গেলেই নৈতিকতা আর মূল্যবোধের প্রশ্ন আনা হবে।”

তখনও তিথির সঙ্গে শুভ্রর তুই-তোকারি শুরু হয়নি। শুভ্রের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলো ও। কিছু বুঝতে পারছিলো। আর কিছু বুঝতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো মানব সমাজের হাজার বছরের কুসংস্কার।

“আমার কাছে নৈতিকতা দুই রকমের,” বলে গেছিলো শুভ্র, “প্রকৃত নৈতিকতা, আর বানোয়াট নৈতিকতা। প্রকৃত নৈতিকতার মধ্যে পড়বে এমন সব কিছুই, যা অন্য কারও ব্যক্তিঅধিকারে প্রভাব ফেলে। ধরো, আমি একজনের ফাইলটা আটকে রাখলাম যেটা ছেড়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। সেটা নৈতিকতার অবক্ষয়। কারণ একজন মানুষ ন্যায্যভাবে যেটা পেতে চলেছিলো তা সে পাচ্ছে না। তাকে সেজন্য কেনো ঘুষ দিতে হবে? অথবা, ধরো আমি পাশ দিয়ে চলে যাওয়া কোনো মেয়েকে টিজ করে বসলাম। এটা নৈতিকতার অবক্ষয় হিসেবে আমি মেনে নেবো। এটা কিন্তু পূর্বপুরুষেরাও মানতেন, তাও আমি মানবো। কারণ কারও সঙ্গে কথোপকথনের গভিরতা দুই পক্ষের সম্মতিতে নির্ধারিত হয়। টিজিং এই ব্যক্তিঅধিকার লঙ্ঘন করে। তুমি আমাকে এধরণের যতো নৈতিকতা মেনে নিতে বলবে, আমি সহমত প্রকাশ করবো।”

“তাহলে সমাজের সঙ্গে তোমার সমস্যাটা কোথায়?” বিষয়টা স্পষ্ট করার জন্য জানতে চেয়েছিলো তিথি।

“ধরো, তুমি আজ সিগারেট খেতে খেতে ফুটপাতে হাঁটছো। কি দেখবে?”
“রাস্তার অর্ধেক লোক আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কানাঘুষো হবে। দুটো কথা শোনাতেও কেউ ছাড়বে না।” বিন্দুমাত্র দেরি না করে বলে ফেললো তিথি।
“অর্ধেক নয়, সবগুলো লোকই তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তোমাকে সদুপদেশ দেওয়ার মানুষের অভাব হবে না। এমনকি পুলিশি হ্যারাসমেন্টের শিকারও হতে পারো।”
“হ্যাঁ। কারণ, একটা মেয়ে ফুটপাতে হাঁটবে আর সিগারেট ফুঁকবে সেটা আমাদের সমাজে অ্যাকসেপ্টেড না।”
“অথচ পুরুষেরা এই কাজ অহরহ করে। কেউ চোখের পাতাটাও ফেলে না।” যোগ করলো শুভ্র, “তাহলে ভেবে দেখো, পুরুষ সিগারেট খেতে পারবে প্রকাশ্যে। অথচ নারী পারবে না। এই কুসংস্কার জন্ম নিলো কোথা থেকে?”

কাঁধ ঝাঁকালো তিথি, “এভাবে দেখলে তো হবে না। নারীরা সব কিছু পুরুষদের মতো করতে পারে তাই? তোমরা গরমের সময় খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতে পারো। একটা মেয়ে কি জামা খুলে হাঁটতে পারবে?”
নিজের পায়ে থাপ্পড় দিয়ে উঠলো শুভ্র, পয়েন্টটা তিথি ধরে দেওয়াতে বেজায় খুশি হয়েছে সে, “এইটাকেই আমি বলি সামাজিক হিপনোটিজম, সিস্টার। সমাজ তোমাকে হিপনোটাইজ করে রেখেছে। সমাজ এই কোটি কোটি মানুষকে হিপনোটাইজ করে রেখেছে। তুমি একটা মেয়ে হয়েও সিগারেট খেতে না পারার ব্যাপারে মেয়ে সমাজের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণকে সমর্থন করতে পারছো না। ছেলেরা কি করে পারবে? ফুটপাতে সিগারেট খাওয়ার প্রসঙ্গ তুমি ডিফেন্ড করছো প্রকাশ্যে জামা খুলে ফেলার প্রসঙ্গ দিয়ে। কারণ, তুমি সমাজের হিপনোটিজমে পড়ে গেছো। ইউ আর হিপনোটাইজড, তিথি। ইউ অল আর।”

“তাহলে তুমি চাইছো সিগারেট খাওয়াটা সবার জন্য বৈধ হোক। এটা কি স্মোকিংকে উৎসাহ দিচ্ছে না? দেখো, পুরুষেরা স্মোক করলেও নারীরা করতে পারছে না। বা করলেও তাদের কম করতে হচ্ছে। এটা তো অনেকের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হচ্ছে। পুরুষ আর নারীর সংখ্যা প্রায় সমান ধরা হয়। অর্থাৎ সমাজের অর্ধেক সদস্য স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা পাচ্ছে।” যুক্তি দেখিয়ে গেছিলো তিথি।

“আরেকটা হিপনোটাইজড উত্তর দিলে, সিস্টার।” হাসিমুখে বলেছিলো শুভ্র, “তোমার কি মনে হয় ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে একটা মেয়ে সিগারেট খেলে সেটার প্রতিবাদে এগিয়ে আসা পুরুষ এবং নারীদের প্রথম মাথাব্যথার কারণ নারীর স্বাস্থ্য হয়? স্বাস্থ্যরক্ষায় স্মোকিংয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াও, পুরুষ হোক আর নারী হোক, প্রকাশ্যে স্মোকিংয়ে বাঁধা দাও, আমিও তোমাদের সঙ্গে থাকবো। এ বিষয়ে কিন্তু জরিমানার আইনও আছে। কিন্তু যতোক্ষণ ছেলেরা সিগারেট খাচ্ছে, কিছুই আসে যায় না কারও। কিন্তু একটা মেয়ে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলেই সবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। এর পেছনে শুধুমাত্র আছে তোমাদের পুরুষশাষিত সমাজের ইগো। সমাজের হিপনোটিজম। মেয়েরা খেতে পারবে না সিগারেট। মেয়েরা খেলতে পারবে না খোলামেলা শরীরে খেলা কোনো খেলা। তাও মার্গারিটা মামুন নিয়ে মাতামাতি কম হয়নি। যাহোক, কারণ হিসেবে সমাজের হিপনোটিজমের অংশ হিসেবে দেখাবে ধর্মের অনুশাসন। কিন্তু ফুটবল খেলায় পুরুষের সতর ঢাকা না হলেও কেউ প্রতিবাদ করবে না, অথচ ধর্মে পুরুষের হাঁটু পর্যন্ত না ঢাকা আর নারীর স্লিভলেস পরা একই জিনিস। তাও শুধুমাত্র মেয়েদের দলকে হাফপ্যান্টে নামাতে গেলেই প্রচুর কথা আসবে। তোমরা মা বোনদের ন্যাংটা করে মাঠে নামাচ্ছো। ধর্মের অনুশাসনের দিক থেকে দেখলেও দুই পক্ষ করছে আইন ভঙ্গ। অথচ সমাজের চোখে পুরুষের সাত খুন মাফ। যতো সমস্যা তোমাদের মেয়েদের নিয়ে। এমনকি ক্রিকেটেও প্র্যাকটিসে হাফপ্যান্ট পরে পুরুষ ক্রিকেটারগণ নামলে কারও জাত যায় না। মেয়ে ফিজিও হাফপ্যান্ট পরে মাঠের মাঝে গেলে দর্শকদের উত্তেজিত শিসের শব্দ শোনা যায়। এখানেই আমার সমস্যা, পুরুষের ক্ষেত্রে সমান প্রতিবাদ আসলে আমি এগুলোকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে ধরে নিতাম। কিন্তু এখন আমি এই সব প্রথাকেই মনে করি সামাজিক অবক্ষয়। বুঝতে পারছো, সামাজিক হিপনোটিজমে আমরা সমাজের নৈতিকতাকে মানদণ্ড ধরে নিয়ে কতো বড় ভুল করেছি? এটা আমাদের মূল্যবোধ ধ্বংস করেছে। নিরীহ নারীদের প্রকাশ্যে কুপিয়ে ফেলে যাচ্ছে ব্যর্থ প্রেমিক। একা পেলেই একটা মেয়ের শরীর স্পর্শ করার চেষ্টা করছে পুরুষ। ভরা রাস্তায়ও করছে, ভিড়ের সুযোগে। হিজাব করে আসা মেয়ে হোক আর না হোক, ছাড় কিন্তু কাওকে দেওয়া হচ্ছে না। একটা মেয়ে হাফপ্যান্ট আর টপস পরে রাস্তায় জগিং করতে নামলো বাংলাদেশের রাস্তায়। প্রতি পঞ্চাশ ফিটের মধ্যে একবার তাকে টিজ করা হবে। সবাই চেষ্টা করবে তার ভাঁজগুলোয় চোখ বোলানোর। ভুল কিছু বললাম?”

“কিছু পুরুষের জন্য সবার দোষ হতে যাবে কেনো?” তিথি গতানুগতিক সব যুক্তিই সেদিন চেষ্টা করেছিলো।

“সামাজিকভাবে হিপনোটাইড একটা মানুষ তুমি। এই ধরণের ডিফেন্স যারা দাঁড় করায় তাদের সবাই সামাজিক হিপনোটিজমের শিকার। তুমি কি জানো, এই ‘কিছু’ পুরুষের প্রকৃত সংখ্যাটা কতো?” তিক্ত একটা হাসি ফুটে উঠেছিলো শুভ্রের মুখে, “দুই কোটি মাত্র। মোট জনসংখ্যার আটভাগের একভাগ। মোট পুরুষ জনসংখ্যার ওয়ান-ফোর্থ। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ জনসংখ্যার অর্ধেক।”

“হোয়াট! এতো বেশি হতেই পারে না-” প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো তিথি। তাকে একটা হাত তুলে থামিয়ে দিলো শুভ্র।

“এরচেয়েও বেশি হতে পারে। এরা সবাই টিজ করে না, কিন্তু বন্ধুর আড্ডায় হলেও মেয়েদের খেলো করে দেখে। পরিচিত মেয়েদের অঙ্গ প্রতঙ্গ নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করে। সবই ব্যক্তিঅধিকার লঙ্ঘন। আর দুই কোটি মানুষ এরকম নারীদেহ ভোগের জন্য ব্যক্তিঅধিকার ছাড়িয়ে যাওয়া আচরণ করছে কেনো জানো তুমি?”
তিথি এবার কোনো কথাই বললো না।
“কারণ, সমাজ আমাদের হিপনোটাইজ করে এমন কিছু বিষয়কে ট্যাবু বানিয়ে রেখেছে যেগুলো আমাদের মূল্যোবোধের বারোটা বাজিয়েছে। সমাজ আমাদের ব্যক্তিঅধিকারকে সম্মান করতে না শিখিয়ে শুধু শিখিয়েছে সংখ্যালঘুদের দৃষ্টিভঙ্গিকে অসম্মান করতে। একজন স্বাধীনচেতা মেয়ে এদেশে বিকিনি পরে সুইমিংপুলে নিজের মোটরসাইকেল ড্রাইভ করে যেতে পারবে না। সমাজ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। কারণ, তারা ওই মেয়েটির দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান দেখাতে প্রস্তুত নয়। কারণ সে সংখ্যালঘু। সমস্যাটা তুমি বুঝতে পারছো?”

“তুমি তাহলে সমাজের থেকে কি আশা করো?” হাল ছেড়ে দিয়ে জানতে চেয়েছিলো তিথি।
“সিম্পল। প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিঅধিকারকে সম্মান করতে শেখা হোক। ফালতু সব বিষয় থেকে ট্যাবু উঠিয়ে দেওয়া হোক। তুমি কি জানো, এদেশের পুরুষেরা স্লিভলেস জামা পরা মেয়ে দেখলেই উত্তেজিত হয়ে যায় কেনো? এমনটা গোটা দুনিয়ার কোথাও দেখবে না তুমি। আমি চাই সমাজ এইসব সমস্যার সমাধান গোড়া থেকে করুক। অকাজের কিছু মূল্যবোধ ধরিয়ে তা চর্চা করে এইসব সমস্যা আরও বাড়িয়ে না তুলুক।”

“এসব সমস্যার গোড়া বলতে কি বোঝাচ্ছো?”
“ট্যাবু। মূল্যবোধ আর নৈতিকতার নাম করে একপালা আজাইরা ট্যাবুতে ভরে আছে সমাজ। এই ট্যাবুগুলো তুলে ফেলতে হবে। নারী অধিকার এদেশে সবখানে খর্বিত এইসব ট্যাবুর জন্য।”

“এদেশেও প্রচুর সফল নারী রয়েছেন।” যথারীতি দ্বিমত পোষণ করলো তিথি।

“আর সেসব প্রতিটি সফল নারী হাজারো টিজ হজম করে, হাজারো নারীত্বের অপমানের শিকার হয়ে, হাজারো পিছুকথার প্রসঙ্গ হয়ে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, লাখ লাখ মানুষের চোখে স্রেফ একজন মাগি হয়েই সেই সফলতার চূড়োয় উঠেছেন। এখন আমার প্রশ্ন হলো, তাঁকে লাখ লাখ মানুষের কাছে মাগি হতে হলো কেনো? তোমার আর তোমার মতো হিপনোটাইজড মানুষগুলোর জন্য। একদিন তুমিও সমাজে সফল একজন নারীকে মাগি বলে গালি দেবে। সেদিন হয়তো বুঝবে আমার কথার সার্থকতা। সফল সাংবাদিক, সফল আর্কিটেক্ট, সফল অভিনেত্রি, সফল চিকিৎসক, কোন নারীচরিত্রটিকে যুবসমাজের বড় একটা অংশ চরিত্রহীন মনে করে না?”

“ওই পর্যায়ে পৌঁছাতে অনেকেই চরিত্র খুঁইয়ে আসেন।” সোজাসাপ্টা বললো তিথি, “তো কি মনে করবে তাদের?”
“চরিত্র খুইয়ে আসে কিভাবে একজন মানুষ? বড়জোর আরেকজনের সঙ্গে শোয় কিংবা মিডিয়ার সামনে খোলামেলা হয়ে আসে, তাই তো? এটা কি করে চরিত্র খোয়ানো হলো? এখানে আরেকটা বড় প্রশ্ন চলে আসে, আসলেই যারা টাকার বিনিময়ে যৌনতায় অংশ নেয়, অর্থাৎ পতিতারা, তাদের কেনো সমাজ সম্মান করে না? মানুষের সম্মান তাদের কেনো দেওয়া হবে না?”
“এসব তর্ক অর্থহীন।” মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছিলো তিথির।
“না, হিপনোটাইজড মানুষগুলো এসব এড়িয়ে যায়। সবশেষে ক্ষতিটা হয় সমাজের। আরও একজন অসহায় নারীকে কুপিয়ে ফেলে রাখা হয়। আরও একজন মানুষের পর্ন ভিডিও নিয়ে মানুষ মাতামাতি করে, আরও একজন মানুষকে মানুষ মাগি পরিচয় দিয়ে সমাজে অচ্ছুত করে দেয়। এটা সলিউশন না, আলোচনাটা এড়িয়ে যাওয়া কখনোই সমাধান না, তিথি।”

“সলিউশন তাহলে কি?”
“অকারণ ট্যাবু সরিয়ে ফেলা। দেশে কো-এডুকেশন কয়টা প্রতিষ্ঠানে হয় বলো তো? ছেলে আর মেয়েকে আলাদা জায়গায় রেখে পড়াশোনা করানোর অর্থটা পরিষ্কার। দুই লাখ বখাটে আর নারীলোলুপের জায়গায় দুই কোটি বখাটে এবং নারীলোলুপ জনসংখ্যার জন্ম দেওয়া।”
“তোমার মনে হয় এরা ছেলেমেয়ে একসাথে বড় হলে নারীদের প্রতি-”
“হ্যাঁ, তারা নারীদের সম্মান দিতে শিখতো। জানতো মেয়েরা তাদের মতোই মানুষ। জানতো মেয়েদের শরীর আর তাদের শরীরের বিশেষ পার্থক্য নেই। একটা মেয়ের কনুই দেখেই মাথা ঘুরে যেতো না তাদের। তারা জানতো একটা মেয়েকে যৌনতা ছাড়াও ছুঁয়ে দেওয়া যায়, যেভাবে একটা ছেলেকে ছোঁয়া যায় যৌনতা ছাড়া। বন্ধুর সঙ্গে হাত মেলানো যায়, জড়িয়ে ধরা যায় যেমন, তা বান্ধবীকেও করা যায়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরার সঙ্গে কামুকতার সম্পর্ক নেই তাও তারা শিখতো। কিন্তু তারা শিখেনি কিছুই। হয় তারা তাদের দেবী বানিয়েছে, নয়তো বানিয়েছে সেক্স ডল। মানুষ হিসেবে নারীকে দেখেনি ওরা। তুমি জানো আমার প্রতিটা শব্দ সত্যি। শুধুমাত্র সামাজিক হিপনোটিজমের প্রভাবে স্বীকার করতে বাঁধবে তোমার।”

ছয়.
তিথি খেয়াল করলো চোখের পানিতে কখন বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে সে। হ্যাঁ, সেদিনই ও মেহজাবিনকে মাগি বলেছে। নিজে একজন মেয়ে হয়েও তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান দিতে শেখেনি। তিথি মনের ভেতরে কোথাও জানে শুভ্রের প্রতিটা কথা সত্য। তুখোড় বুদ্ধিমত্তা দিয়ে হাজারবার এই দর্শনটাকে যাচাই করে তবেই সে মেনে নিয়েছে। স্রেফ আবেগের বশে অথবা কিছু নব্য সমাজবিরোধীদের মতো প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে এসব বুলি সে আওড়ায় না। তার কথা শুনে প্রাথমিকভাবে তিথি মনে করতো ছেলেটা মনে হয় ফ্রি-সেক্স প্রতিষ্ঠা করতে চায় এদেশে, হয়তো নিজের সুবিধার্থেই। একবছর তার সাথে থেকে এটুকু বুঝেছে, সেক্স নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণে অকারণে তিথিকে ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টাও সে কখনো করেনি।

হ্যাঁ, তিথিকে শুভ্র ছুঁয়ে দেয় মাঝে মাঝে। তবে সেটা ঠিক ততোটাই যতোটা সে কোনো ছেলে বন্ধুর সঙ্গে করে। মেকানিক্যালের নাফিসকে সে যেভাবে কনুই দিয়ে খোঁচা দেয়, যেভাবে তার সঙ্গে হাই ফাইভ বিনিময় করে, তিথির সাথেও ততোটাই। শুভ্রের মধ্যে কামুক কোনো স্বভাব নেই। রয়েছে শুধু ব্যক্তিস্বাধীনতার চূড়ান্ত মূল্যায়ন। ব্যক্তিজীবনের মূল্যহীন ট্যাবু এড়িয়ে চলা। তাই সে বাকিদের মতো লুকিয়ে পর্ন দেখে না। সাউন্ডবক্সে পর্ন প্লে করতে তার আপত্তি নেই, সঙ্কোচ নেই বেডরুমে কিসা সিন্সের নগ্ন ছবি টাঙ্গিয়ে রাখতে। এবং তার পরিবার হিপনোটিজম থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারাও এমনটাই আশা করে তার থেকে। যৌনতা আর ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ট্যাবু করার কারণেই সামাজিক মূল্যবোধের এতো অবক্ষয় তা তারা মানে, তবে এর যথেচ্ছ প্রয়োগ কখনোই করে না। তারা যৌনতার লোকদেখানো স্বাধীনতা চায়নি কখনো, বরং সহজাত মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো লুকিয়ে রেখে সামাজিক অপরাধ প্রবণতা প্রকট করাতেই তাদের আপত্তি।

তিথি এখনও জানে না, এটাই এই ঘুণে ধরা সমাজের একমাত্র চিকিৎসা কি না। বাংলাদেশের আর সব মানুষের মতো তারও ধারণা ছিলো কেবলমাত্র ধর্মীয় অনুশাসনই পারে সমাজকে সবার জন্য সহনীয় একটা স্থানে পরিণত করতে।

শুভ্র বলেছিলো, “এটা তুমি ঠিক বলেছো। ধর্ম সমাজটাকে সবার জন্য শান্তিপুর্ণ একটা স্থান বানাতে পারে। যখন প্রতিটা মানুষ ধর্মীয় অনুশাসণ মেনে চলতে প্রস্তুত, তখন। যখন মানুষ হৃদয়ে ধর্মকে ধারণ করে, আবেগে নয়, তখন। বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখো। কতোজন হৃদয়ে ধর্মকে ধারণ করে? চার শতাংশও কি হবে?”

একশ জনে চারজন? তিথি এটা মেনে নিতে পারেনি। প্রতিবাদ করে বলেছিলো, “আমাদের দেশটা ধর্মপ্রাণ হিসেবে পরিচিত কিন্তু।”

“আবেগে আর কথায়। কাজে নয়। এটা এখনও এদেশি জনগণ বুঝে উঠতে পারেনি। এটা খুব খুবই হতাশাজনক।” বলেছিলো ও, “তুমি কি জানো, ইসলামে গান শোনা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, গাইরে মাহরাম (বিয়ে নিষিদ্ধ) সম্পর্কের সব মেয়েদের দিকে তাকানো নিষিদ্ধ, বিবাহপূর্ব যৌনমিলনের শাস্তি আবশ্যকীয় ভাবে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড?”
“তো?”
“এদেশে কয়জন রাস্তায় বের হলে সামনে মেয়ে পড়লে চোখ সরিয়ে নেয়? তাকায় পর্যন্ত না তাদের দিকে? এদেশে কতোজন মানুষ গান শোনা ছেড়েছে ধর্মীয় কারণে? এদেশে কতোজন মানুষ বিয়ের আগে প্রেম করেনি? একশতে চারজন কি খুব বেশি হয়ে গেলো না? একশ’তে একজনও কি পাবে তুমি এমন?”
“মানছি, এতো সাধু সন্ত আমরা এক হাজারে একজন পাবো। কিন্তু তুমি ধর্মকে দায় দিচ্ছো কেনো? ধর্ম না মানা তো ব্যক্তির ব্যর্থতা।”

হেসে ফেললো শুভ্র, “আমি ধর্মকে দায় দিচ্ছি না। বরং সব সময় বলে এসেছি ধর্মীয় অনুশাসন একটি সমাধান। তুমি একটা সমাজে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে কোনো অনাচার চলবে না। পারফেক্ট সমাজ ব্যবস্থা সেটা।”
“তাহলে একটু আগে যে বললে-”
“আমি দায় দিচ্ছি বাংলাদেশের মানুষের। আমরা ছিলাম বৌদ্ধ, হয়েছি পরে পৌত্তলিক, তারপর হয়েছি মুসলিম, এরপর খেয়েছি ইংরেজের ধাতানি। আমাদের হৃদয়ে ধর্ম নেই, তিথি। বাংলাদেশের মানুষ হৃদয়ে ধার্মিক নয়, তারা কথায় বুলি ফোটায়। আবেগে জেহাদী জোশ দেখায়। হৃদয়টা ফাঁকা। একারণেই এদেশে জঙ্গি রিক্রুট করা এতো সহজ।”
“তুমি আশা করতে পারো না একটা প্রগতিশীল দেশের একশ জন মানুষের মধ্যে আশিজনই প্রবলভাবে ধার্মিক হবে।”

হেসেছিলো শুভ্র, “তুমি আমার কথার মূলভাবটাই ধরতে পারোনি। বেশিরভাগ মানুষই পারে না। এর পেছনেও আছে সামাজিক হিপনোটিজম। আমার বক্তব্যের একটা স্পষ্ট উদাহরণ দেই তোমাকে। কাল থেকে ঘোষণা করা হলো, কারও বাড়ির ভেতর থেকে গান-বাজনার আওয়াজ পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতার করে দশ বছরের জেল দেওয়া হবে। কেউ প্রেমিকার সাথে বিছানায় গেলে সেটা যদি ধরা পড়ে, প্রেমিক-প্রেমিকাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। চুরি করে কেউ ধরা পড়লেই তার হাত কেটে দেওয়া হবে। এগুলো কিন্তু এই ক্রাইমগুলো ঠেকাতে খুব কার্যকর। আমি এই আইনগুলোর প্রশংসা করি, কারণ এগুলো প্রচণ্ড ভীতি ছড়াতে পারে। অপরাধ কমে আসতে পারে এভাবে। কিন্তু আমার বক্তব্য ছিলো, বাংলাদেশের মানুষ এটা নিতে পারবে কি না সেই প্রশ্নের ওপর। বাংলাদেশিরা কি রাজি হবে গান শুনতে ধরা খেলেই কারাগারে গিয়ে ঢুকতে? কিংবা প্রেমিকার সাথে শুয়ে মুণ্ডু হারাতে? তারা রাজি হবে না। একশজনের মধ্যে চারজনকেও এর সপক্ষে পাবে না তুমি। বাংলাদেশিরা বলবে, এসবই লঘু পাপে গুরু দণ্ড। যদি মুখে ধর্মীয় অনুশাসনের ভয়ে নাও বলে, বাংলাদেশি হৃদয় এসব আইন মেনে নিতে চায় না। তুমিই বলো, তোমার রুমমেটকে যদি পুলিশ এসে নিয়ে যায় তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে শোয়ার অপরাধে তারপর তাকে মেরে ফেলা হয়, তোমার মুসলিম বন্ধুদের কারও হৃদয় কি মেনে নেবে সেটা?”
মাথা নাড়লো তিথি, “না মনে হয়। ধর্মে আছে বলে হয়তো কিছু বলবে না, তবে মেনেও নিতে পারবে না।”
“আর তুমি মনে করছো ইসলামী অনুশাসন এই দেশের সমাজের জন্য অ্যাপ্লিকেবল? তুমি যেটা অ্যাপ্লাই করতেই পারবে না সেটা কি করে সামাজিক সমস্যার সমাধান হবে? সমাজ তো মানবগোষ্ঠী নিয়েই গঠিত। মানুষ যদি প্রস্তুত না থাকে তাহলে কি করে তুমি সেই সমাজে একটা সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করে শুধরে নেবে?”

“সেজন্য ধর্মীয় অনুশাসন সঠিক পদ্ধতি হলেও বাংলাদেশের জন্য কোনো সমাধান নয়।” মাথা দোলালো তিথি, “কথাগুলো তুমি সঠিক বলেছো, অন্তত।”

শুভ্র একটা সিগারেট ধরিয়েছিলো, “অথচ তুমি চাইলেই এদেশি জনগোষ্ঠীকে কো-এডুকেশনে পাঠাতে পারো। অযথা ট্যাবুগুলো তুলে ফেলতে পারো। মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নেওয়ার চেয়ে বেশি প্রস্তুত ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে। বাংলাদেশের সমাজ থেকে নারীত্বের অবমাননা সরিয়ে নিতে এর চেয়ে নিখুঁত আর প্রয়োগযোগ্য আর কোনো সমাধান আমার চোখে পড়ে না। ধর্মীয় সমাজব্যবস্থাগুলো নিখুঁত, তবে বাংলাদেশি সমাজে প্রয়োগের অযোগ্য।”

এপাশ ওপাশ করতে শুভ্রের সঙ্গে হয়ে যাওয়া কথাগুলোই বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবছে তিথি। ছেলেটার মাথা পরিষ্কার। বাংলাদেশী সমাজকে মেয়েদের জন্য সহনশীল করে তুলতে চেয়েছিলো ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সম্মান দেওয়ার মাধ্যমে। এর চেয়ে সহজ সমাধান আসলেই আর হয় না। শুধু প্রয়োজন প্র্যাকটিস। কোনো বাড়তি আইন মানার চাপ নয়, প্রাণ খোয়ানোর ভয়ে নতুন বিশৃঙ্খলা নয়, শুধু অপরজনকে সম্মান করতে শেখা। সহজাত মানববৃত্তীয় আচরণগুলোকে লুকিয়ে না রেখে প্রকাশ্য করে ফেলা। লিঙ্গ বৈষম্য কমাতে দুই জাতির মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনা।

তিথি কখনোই সেগুলো মেনে নিতে পারেনি।
হাজার বছরের হিপনোটিজম সে এড়িয়ে যেতে পারেনি। আজকে রাতে শুভ্র মেহজাবিনের সঙ্গে শুতে চলেছে সেটা সে একেবারেই মেনে নিতে পারছে না।

ফোনের শব্দে ধ্যান ভাঙ্গলো ওর। চোখ মুছে হাতে তুলে নিলো যন্ত্রটিকে।
শুভ্র!

পরিশিষ্ট.
বিআরটিসি কাউন্টারের সামনে এসে তিথিকে কিছু খুঁজতে হলো না। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে একটা ছেলে বসার জায়গায় পিঠ দিয়ে আকাশ পানে পা দুটো তুলে মূর্তিমান বাদুড় হয়ে আছে। প্রকাশ্য দিবালোকে এই পাগলামি, তিথির রাগ না উঠে কেনো জানি হাসি আসে। হারামজাদা সমাজের বিরুদ্ধে একেবারে মূর্তিমান এক বিদ্রোহ!

“তিথি।” চশমা ছাড়াই বললো শুভ্র, মুখে হাসি।
ওর পাশে ধপ করে বসে পড়লো ও, “খুব কেলাচ্ছিস? করলি না কেনো?”
চশমা পরলো না ছেলেটা, ঝলমলে চুল মধ্যাকর্ষণ শক্তিবলে নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে, “কি করলাম না?”

শুভ্রের চেহারায় এই অবাক হয়ে যাওয়ার অভিব্যক্তি দেখতে অসাধারণ লাগে তিথির। হা করে সেদিকেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ও।

“মেহজাবিনের সাথে কালকে রাতে ডিনারে তো গেছিলিই, করলি না কেনো?”
হেসে ফেললো শুভ্র, “গাধীটা তোকে বলে দিয়েছে, তাই না?”
“আরে আমাকে দোষ দিয়ে গেছে সে। আমার দোহাই দিয়ে নাকি এড়িয়ে গেছিস। ছি ছি, তোর দর্শনের উল্টোদিকে গেলো না এসব?”
“কোথায়? আমি কি করবো তা তো আমার ব্যক্তিস্বাধীনতায় পড়ে। আমি আমার ব্যক্তিস্বাধীনতা খাটিয়েছি।”
“মেহজাবিন তো বললো অন্য কথা।” হাত বাড়িয়ে শুভ্রের রেশমি চুল ছুঁয়ে দিলো তিথি, “তুই নাকি ওকে বলেছিস, অ্যানিথিং ফর তিথি’স ফ্রেন্ড।”
চোখ বন্ধ করে ফেললো শুভ্র, “হ্যাঁ। তিথির ফ্রেন্ড আমার ইন্টারভিউ নেবে, এতে আপত্তির কি আছে। যতোবার ডাকবে যাবো। এজন্য ওর সাথে বিছানায় যাওয়ার দরকার কি আমার ছিলো, বল্?”

একটু হেসে হাতব্যাগটা পাশে রেখে দিলো তিথি। শুভ্রের চোখ খুলে গেলো আবার। ঘোলা চোখেই তিথির কোমর থেকে পা পর্যন্ত চোখ বোলালো।

“জিন্স পরেছিস মনে হচ্ছে?”
“চুপ করে শুয়ে থাক। এতো পর্যবেক্ষণে কাজ কি তোর?”
দুষ্টু হাসি শুভ্রের মুখে, “বাদুড় হবি?”
“বাদুড় হওয়ার অধিকারই বা একলা তোকে দিয়েছে কে? প্রেসিডেন্ট স্যার ইস্যু করেছেন?”

খানিক বাদেই এলাকাবাসী অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো বাইশ-তেইশ বছরের দুই তরুণ তরুণী সিমেন্টের সিটের বসার জায়গায় পিঠ দিয়ে দুই জোড়া পা সরাসরি আকাশ পানে তুলে শুয়ে আছে।

মুখ ফিরিয়ে শুভ্রের দিকে তাকালো তিথি। ছেলেটাও তার দিকে মুখ ঘুরিয়েছে, চশমা নেই চোখে। চুলগুলো চোখে এসে পড়ছে। হতাশ হলো তিথি, ছেলেদের এতো রেশমি চুল থাকতে নেই। অপার্থিব মায়ার জন্ম দেয় তারা।

“মেহজাবিনের সাথে তুই শুলে সেটা আমার সামাজিক হিপনোটিজমের জন্য খারাপ লাগতো না রে।” ফিসফিস করে বললো তিথি।
“জানি।” নির্বিকারভঙ্গিতে বললো শুভ্র।
তিথির সুন্দর ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেছে, “কিভাবে জানিস?”
“কারণ, মেহজাবিনের সাথে আমিও শুতে পারিনি অন্য একটা কারণে। সেই কারণটাও সামাজিক হিপনোটিজম না।”
“বাসিস?” কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে তিথির গলা।
“বাসি।”

কি সুন্দর পিটপিট করে তাকাচ্ছে এখন জিনিয়াস পাগলটা! তিথির ভেতরে গিয়ে লাগে চোখজোড়ার মায়া।

“ট্যাবু ভাঙ্গতে শুরু করি, চল্।” দুষ্টুমি ঝিলিক দিয়ে উঠলো মেয়েটির চোখের তারায়।

অবাক বিস্ময়ের যেসব এলাকাবাসী এতোক্ষণ তাদের লক্ষ্য করছিলো, তাদের চোখগুলো কপালে তুলে দিতেই যেনো আরও কাছে চলে এলো বাদুড় হয়ে থাকা মানুষদুটোর মাথাজোড়া।
তারপর টুপ করে ডুবে গেলো একে অন্যের ঠোঁটের অতল গভিরতায়!

— ০ —

রচনাকাল – নভেম্বর ২২, ২০১৬

স্ল্যাং

‘শালার পুতেরে আজ ফাইড়া লামু।’
তুষারের ফুলে ওঠা নাকের দিকে চিন্তার সাথে তাকিয়ে থাকে রেজা। চিন্তিত মুখ হওয়ার কারণ আছে।
যাকে শালার পুত বলে সম্বোধন করা হচ্ছে সে ওদের কলেজেরই একজন ছাত্র এবং এই শালার পুতকে তুষার ফাঁড়তে পারবে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সাইজে ওপরে এবং পাশে সে তুষারের দেড়গুণ করে এগিয়ে। মানুষটার নাম ইন্তিসার।
ঘরের মাঝে ফোঁত জাতীয় একটা শব্দ এই সময় হল। শব্দের মালিক নেই, তবে মালকিন আছে।
তন্বীকে দেখা যায় একটা সুন্দর টিস্যু বের করে নাকে হাল্কা ঘষা দিতে। মেয়েটার সব সুন্দর, নাকও সুন্দর। শুধু কান্না করার ধরণটা সুন্দর না। কেমন একটা পেঁচী পেঁচী ভাব এখন চলে এসেছে। রেজা ওদিকে তাকায় না।
‘থাক, মারামারি করার দরকার নাই।’ পেঁচীটা বলল।
ঘরের শেষ সদস্য হুমায়ূনপ্রেমী আসাদ মাথা নাড়ে এবার, ‘অবশ্যই দরকার আছে। একশবার দরকার আছে। নারী হল পবিত্র জাতি। মাতৃপ্রতিনিধি তারা। নবীজি বলেছেন মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। সেই জাতিকে অপমান! ইন্তিসারের চামড়া আমরা খিঁচবো।’
‘এর মাঝে আবার খেঁচাখেঁচি কেন?’ আহ্লাদী কণ্ঠে তন্বী জানতেই চায়।
‘না না…’ ভুল ভাঙ্গাতে এগিয়ে আসে তুষারই, ‘ওটা হল চামড়া খেঁচা। মানে, ইন্তিসারের চামড়া- তুলে নেব আমরা। তারপর সেটাকে পা দিয়ে খুঁচব। চামড়া হবে খেঁচা।’
আসাদ কাজের কথায় চলে আসে, ‘এই বাবা-মার অবৈধ সন্তানকে আমরা পাচ্ছি কোথায়?’
হেঁচকি ওঠার মত একটা শব্দ করে তন্বীর কান্না থেমে যায়, ‘আংকেল-আন্টি – কিভাবে জানো তুমি?’
আবার এগিয়ে আসে তুষারই, ‘আরে ওই গদ্যকারের কথা ধরছ কেন? ও বলতে চেয়েছে হারামজাদা ছেলেটাকে পাচ্ছি কোথায়?’
‘ইন্তিসারের সাইজ দেখেছিস? ভোটকা হালায়। সহজে পারা যাবে না।’ প্রথমবারের মত রেজা মুখ খোলে এখানে।
‘মারামারির দরকার…’ তন্বী কথা শেষ হওয়ার আগেই আসাদ একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি দেয়। যার অর্থ, দরকার আছে।
‘রেঞ্চ বাইর কর। আংকেলের গ্যারাজে থাকতে পারে।’ পরামর্শ দেয় তুষার।
‘অস্থিমজ্জাতে ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত পড়লে সেটা সহজে নিরাময় করা যায় না। যন্ত্রণা তাকে আমরা দেবো, আর ওটা থাকবে মাসব্যপী।’ আসাদের মন্তব্য।
চোখ পাকিয়ে তাকায় রেজা, ‘হাওয়ার নাতি – তুমি সোজাসাপ্টা কথা বলা শিখো। বইয়ের ভাষা টোটানো লাগবে না। বললে কি সমস্যা যে হাড্ডিতে রেঞ্জের বাড়ি পড়লে হালার পো একমাস নড়তে পারবে না?’
তন্বীর কানে নতুন শব্দটা ঘুরছে। চোখে আরেকবার টিস্যু চালিয়ে জানতে চায়, ‘টোটানো মানে কি?’
এদিক ওদিক তাকায় রেজা সাহায্যের আশাতে। এলিট মেয়েগুলো কী! ছেলেরা গালি ছাড়া কথা বলতে পারে নাকি? এর মাঝে এসে বসে থাকে। এরা আবার হয় অতি সভ্য। বাজে কথা বলতে নারাজ। শুনতেও। অনেক মেয়ে ছেলেদের ব্রাদারহুড সম্পর্কে কিছুই জানে না।
এখনও!
সাহায্যে আবারও তুষার, ‘ও কিছু না। একটা গালির কাছাকাছি শব্দ।’
আরেকটু ধরিয়ে দেয় আসাদ, ‘শুরুটা চ-বর্গের একটি অক্ষর দিয়ে।’
ঘাড় মটকায় রেজা, ‘প্রথমটা।’
পরিস্থিতি বুঝে তন্বী একেবারে চুপ।
আসাদদের বাসায় ওরা আছে। তাই নিশ্চিন্ত। ছেলেটার বাবা-মা প্রথম শ্রেণির। এখন ও যাচ্ছে রেঞ্চ আনতে। রেজাকে ‘ফাঁড়তে’ হবে।
আসাদের বাবা-মা ভাগ্য এতটাই ভালো, সহপাঠী থেকে শুরু করে এলাকাবাসী তাকে হিংসে করে। তার কোন কথায় তাঁদের অমত নেই। ছেলেটা গুন্ডা হতে পারতো, তা না করে সে হচ্ছে লেখক। সারাদিন লেখে। কাগজে-কলমে। হাজার চেষ্টা করেও তাকে কম্পিউটারে লেখা শেখানো যায়নি।
আসাদের যুক্তি, ‘টাইপ শিখতে আমার যে সময় লাগবে তাতে আরও দুটো ছোটগল্প আর এক উপন্যাসের অষ্টমাংশ লেখে ফেলা যাবে।’
এই মুহূর্তে আসাদ নিচের দিকে নেমে যায়। বাড়িটা ডুপ্লেক্স। এত বড় মাপের বড়লোক ঘরের সন্তান হয়েও আসাদের মাঝে মধ্যবিত্তদের ছোঁয়াই বেশি কাজ করে। তাদের সাথেই সে ঘোরে। এমনকী সেরকম কলেজেই তাকে পড়ানো হয়। বাংলা মিডিয়াম। আসাদের বাবা নিজে মধ্যবিত্ত ছিলেন বলেই উচ্চশ্রেণিতে একটি নির্দিষ্ট বয়েসের আগে ছেলের প্রবেশ করেছেন নিষিদ্ধ।
ছেলে তুলনামূলক দরিদ্র ছেলেমেয়েদের সাথে চলবে। জীবন কতটা কঠিন শিখবে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবে উচ্চবিত্তের ছোঁয়াতে। তাহলে তার গোল্লায় যাওয়ার সুযোগ নেই।
এই মুহূর্তে আসাদের বাবার মুখ এজন্য হয়ে আছে গম্ভীর। ছেলের কাছে আজ এক মেয়ে এসেছে। যে ফেরারী মেয়েটি ড্রাইভ করেছে– সেটা উচ্চবিত্তের পরিচয় বহন করে। ছেলে কলেজে পড়ে এখন। যথেষ্ট বড় হয়েছে, একটা প্রেম সে করতেই পারে। থাকতে পারে একজন গার্লফ্রেন্ড।
এসব তিনি বোঝেন এবং মানেন। মেয়েটাকে যথেষ্ট আপসেট বলে মনে হয়েছে। সম্ভবতঃ প্রেম-বিষয়ক জটিলতা। কিন্তু এরকম একটি মেয়ের সাথে আসাদ চলবে কেন? বড়লোকের ছিঁচকাদুনী মেয়ে জীবনের কি বোঝে? ছেলে তো নষ্ট হবে দেখা যায়।
লোয়ার ক্লাস ফ্যামিলির সংগ্রামী মেয়ে কি ছিল না একটাও এদেশে?
ঠোকা না খেলে কেউ বড় হতে পারে না। ‘ঠোকা’টা যে আসাদ কবে খাবে! ছেলের ভবিষ্যত চিন্তাতে কালো হয়ে যায় আসাদের বাবার মুখটা। আরও কয়েক ডিগ্রী।
তবে মেয়েটা সুন্দর আছে। লম্বা এবং ফর্সা। চেহারার খাঁজে খাঁজে আভিজাত্য। এই কারণেই অবশ্য তিনি চান না ছেলের সাথে ওরকম কোন মেয়ের প্রেম হোক। কারণ এরা হল ‘পৃথিবী’ নামক গেমটির চীট-কোড সুন্দরী। অভিজাত বংশের মাঝে বিয়ে হয়ে হয়ে এদের জন্ম। ফিল্টারড। আর্য। চীটকোড দিয়ে খেলাটা রহমান সাহেবের পছন্দ না।
চায়ের কাপটা তিনি মাত্র টেবিলে রেখেছেন, চুপ চুপ করে তার পাশে এসে দাঁড়ায় আসাদ।
‘বাবা? ব্যস্ত?’ শুরুতেই জানতে চায় ছেলে।
একটু হাসেন রহমান সাহেব, ‘না রে। কিছু বলবি?’
‘বড় দেখে একটা রেঞ্চ লাগবে। তোমার গ্যারেজে আছে না?’
‘তা আছে। কেন?’ অবাক হন তিনি।
স্বাভাবিকভাবেই বলে আসাদ, ‘ইন্তিসার নামে আমাদের ক্লাসে এক ছেলে আছে। অনেক লম্বা আর স্বাস্থ্যবান।’
রহমান সাহেবের বুঝতে এবার আর সমস্যা হয় না, ‘ও, ছেলেটার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে? আমাদের ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দাও। ওর লোকেশন জানো তো?’
ঘাড় শক্ত হয়ে যায় আসাদের, ‘না। গাড়ি ওর ঠিক আছে। রেঞ্চ লাগত অন্য কারণে।’
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন রহমান সাহেব।
‘মানে, ওটা দিয়ে মারতাম আর কি।’ জানায় আসাদ।
রহমান সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। চোখে মুখে হতচকিত ভাব। তারপর ছেলেকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন বাড়ির বাইরের দিকে। গ্যারেজে ঢুকেও হাত ছাড়লেন না। তারপর টুলবক্স খুললেন। সবচেয়ে বড় রেঞ্চটা বের করে তুলে দিলেন আসাদের হাতে।
‘যা, ব্যাটা। ফাটিয়ে দে। একেবারে ফেঁড়ে ফেলবি!’ হুংকার দেন তিনি।
খুশির সাথেই হাতে রেঞ্চ নিয়ে বাসার দিকে রওনা দেয় আসাদ। এই না হলে বাবা!
পেছনে চমৎকার হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন রহমান সাহেবও। ছেলে ‘ঠোকা’ খেয়েছে। এটাই এখন সবচেয়ে বড় কথা।
নাহ, বড়লোকের মেয়েরা সবাই অকাজের হয় না দেখা যাচ্ছে। ধারণা পাল্টানোর শপথ নিতে নিতে মূল বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে যান তিনি।

দুই
যাকে ফাটিয়ে আর ফেঁড়ে ফেলতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ তুষারের ‘শালার পুত’ ইন্তিসার এই মুহূর্তে একটা চায়ের দোকানে বসে আছে।
শার্টের ডান হাত গেছে ছিঁড়ে। বেকায়দাভাবে বাতাসে উড়ছে ওই অংশটা। সেই হাতে আধ-টুকরো কলা আর এক টুকরো রুটি। এটা খেলে দিনের প্রথম ও শেষ খাওয়াটা তার হয়ে যায়। এরপরে একটা সিগারেট। গোল্ডলীফই ইন্তিসারের পছন্দ। কিন্তু এই কলা আর রুটির দাম মেটাতে গেলে ওর আর গোল্ডলীফ কেনার টাকা থাকবে না। শেখ খেতে হবে মনে হচ্ছে আজকে।
টাকা মানুষকে শ্রেণিতে ভাগ করে। আর ক্ষুধা আনে এক কাতারে। ব্যাপারটা ইন্তিসার ভালোই টের পাচ্ছে। ওর সামনে বসে থাকা ছেলেটার নাম নিতাই। সে একটা বাসী রুটি খাচ্ছে। তার হাতেও একটা কলা। তবুও ছেলেটাকে যথেষ্ট সুখী দেখায়। ছোট ছোট চুল-সম্বলিত একটা মাথা এই ছেলের আছে।
কলাটা তার কাছে ছিল না। ওটা কিনে দিয়েছে ইন্তি। শুধু শুকনো রুটি খাচ্ছিল দেখে ওটুকু করতে তার তখন খুব ইচ্ছে হচ্ছিল।
ইন্তিসার আজ দুই দিন ধরে পলাতক। প্রি-টেস্টের রেজাল্ট কলেজ দিয়েছে। আর তাতে ও করেছে দুই বিষয়ে ফেল। তাকে টেস্ট পরীক্ষা দিতে দেবে না আর।
কলেজ থেকে বাসাতে গিয়েই রেজাল্টের কথা ও বলে দিয়েছে। নিমেষেই মা ছেঁচকি নিয়ে তাড়া করে ওকে বের করে দেন। ছেঁচকির তাড়া খাওয়া খুব একটা সুখের ব্যাপার না। ছেঁচকির ভয়েই হোক আর আত্মসম্মানবোধের তাড়নায় – সেই থেকে ও বাসার বাইরে। সাথে ছিলই পঞ্চাশ টাকা। তিন দিনে সব শেষ।
আয়েশ করে সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলল তারপর। এর পরে আর সিগারেট পাওয়া যাবে না সহজে।
কলেজ ড্রেস পরেই আছে। ওই অবস্থাতেই সে বিতাড়িত। সাথে আছে ব্যাগও। কাজেই গত তিনদিনই ক্লাস করতে সে গেছিল। কাজের কাজ কিছু হয় না। তবে সময় কাটে।
‘ভাইজান, আরেকটা কলা লইলাম?’
নিতাইয়ের ডাক শুনে তাকাতেই হয় ওকে, ছেলেটা ইন্তিসারের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই কলা ছিঁড়ে ফেলেছে আরেকটা। ওটার দাম কিভাবে দেবে সেটা এখন একটা ভালো প্রশ্ন হতে পারে – তবে তা নিয়ে ভাবতে ইন্তি চায় না।
‘তোর বাড়িতে আর কে কে আছে?’
কলায় রাক্ষসের মত কামড় দিয়ে পিচ্চিটা তাকায় পিটপিট করে, ‘একগা বাইয়ার মা।’
চোখ কুঁচকে যায় ইন্তির, ‘খেয়ে বল। মুখে খাবার নিয়ে কথা বলার দরকার তো নাই।’
‘একডা বাই আর মা।’ বলেই হাসে নিতাই।
ছোট্ট একটা নাকের দুই পাশে দুটো সুন্দর সুন্দর চোখ। ইন্তিসারের দেখতেই ভালো লাগে। তন্বীকে দেখাতে পারলে হত। পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটা একবার স্পর্শ করে ও। বের করে না। করে লাভ নেই। চার্জ পায় না আজ কয়েকদিন। চার্জারটাও বাসায়। নিতাই ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে।
‘বাড়ি থেকে পলাইছেন নি?’
ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে ইন্তিসার, তারপর মৃদু ধমক দেয়, ‘একদম চুপ করে থাক। চুপচাপ কলা খেয়ে ভাগ চোখের সামনে থেকে।’
নিতাইয়ের হাসি এতে কমে না। ভাইজান লোক খারাপ না, এটা তার বোঝা হয়ে গেছে।
‘হাত ছিঁড়া জামা পিন্দে ঘুরে না কেউ। আপনেরে আমি কাইলকাও দেখছি। হাত ছিঁড়া জামা পিন্দে ঘুর ঘুর করতেছেন।’
‘আর তাতেই ধরে ফেললি আমি বাড়ি থেকে পালাইছি? থাপড়ায়ে তোর চাপা আলগা করে ফেলব।’
‘বাড়ি থেকে না পলাইলে কেউ রুটি আর কলা খায় না রাইত দশটায়।’ মুখ বাঁকায় নিতাই।
‘আমি খাই। ঠিক আছে?’
ইন্তিসারের রাগত চেহারার দিকে তাকিয়ে নিতাই থম মেরে যায়, ‘ঠিক আছে।’
দুইজন কিছুক্ষণ একেবারেই চুপ চাপ থাকে। কথাবার্তা ছাড়াই শেখে টান দিয়ে যাচ্ছে ইন্তিসার। একের পর এক।
নিতাইয়ের কলা খাওয়া শেষ। ছোট ছেলেটা আকাশের দিকে মুখ করে আছে। থুতনিটা সরাসরি ইন্তিসারের দিকে তাকিয়ে আছে যেন।
ইন্তিসারও আকাশের দিকে তাকায়। আজকের আকাশে মেঘ আছে। পাতলা মেঘ না, কালো মেঘ। চাঁদের একটা টুকরো দেখা গেলেও হতো। তাও দেখা যাচ্ছে না।
‘ভাইজান?’ নিতাইয়ের ডাকে আবার তাকাতে হয় ওকে।
‘তোর কলা খাওয়া হয়েছে?’
‘জ্বে।’
‘তাইলে ফোট।’
নিতাই ‘ফোটে’ না। আরেকটু কাছে সরে আসে, ‘ও ভাইজান।’
‘কিছু বলবি? টাকা শেষ কিন্তু – আবদার করলে রাখতে পারবো না।’
‘না ভাই। আবদার করতাম না। কইতেছিলাম, কাল রাইতে ছিলেন কই?’
পিচ্চি কি গোয়েন্দা নাকি? বিরক্ত লাগে ইন্তিসারের, তবুও উত্তর দেয়, ‘বড় মাঠের এক কোণে শুয়েছিলাম। রাস্তায় ধুলোবালি বেশি। মাঠে মশা অনেক জ্বালালেও ধুলো তো নেই।’
অনুনয় ভরা চোখ মেলে দেয় নিতাই, ‘আইজকা আমাগো বাড়িতে ঘুমাইবেন, চলেন।’
ইন্তিসার একবার ওই চোখের দিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘না।’
শরীফ মামার কাছে আজ থেকে চা-সিগারেট খায় না ইন্তিসার। গত তিন বছরের বাঁধা কাস্টোমার। কাজেই একটা কলার দাম পরে দিতে চাওয়ার প্রস্তাবটা তিনি হাসিমুখেই মেনে নিলেন।
ইন্তিসার রাতের রাস্তায় হাঁটছে। পথ দেখাচ্ছে নিতাই। ওদের বাসাটা বস্তির ভেতর।
মুখে না বললেও ইন্তিসার সেখানেই যাচ্ছে। বাসার অবস্থা জানতে চাইলে নিতাই বলেছে, চারদিকে ‘বোড’ আর ওপরে ঢেউটিন। পানি-টানি নাকি ঢোকে না বৃষ্টির সময়। আকাশে যে মেঘ দেখে এসেছে আজ রাতে বৃষ্টি নামতেই পারে।
মাঠে শুয়ে বৃষ্টির পানি নিয়ে কান ভর্তি করে ফেলার চেয়ে নিতাইয়ের কুটিরে জায়গা নেওয়া ভালো কাজ।
ইন্তিসার রওনা হওয়ার দেড় মিনিট পরেই রেজা, তুষার আর আসাদরা গাড়ি থেকে নামে। শরীফ মামার দোকানে ইন্তিসারকে পাওয়া যাবে এটা তল্লাটের প্রত্যেকে জানে। কাজেই এতদূর আসতে তাদের কোন অসুবিধে হয়নি। শরীফ মামা জানালেন বন্ধুরা দেরী করে ফেলেছে। ইন্তিসার লক্ষার বস্তিতে গেছে। সাথে আছে নিতাই নামের এক হতচ্ছাড়া শিশু।
গাড়ির ভেতর থেকে তন্বী আরেকবার মিন মিন করে বলে, ‘মারামারির কি খুব দরকার ছিল?’
আসাদ একনজর তাকায়, ‘দরকার নিশ্চয় ছিল। সংবাদ শোননি? আমাদের শত্রু কীয়ৎকাল পূর্বেই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে।’
ট্রান্সলেট করে দেয় তুষার, ‘হালারে সেইরাম ঘাড়ানো দরকার। ভাগতেছে হালায়!’
ইন্তিসার আর নিতাইকে খুঁজে পেতে ওদের বেশিদূর যাওয়া লাগল না। দৌড়ে এসে তিনদিক থেকে ওকে ঘিরে ফেলে ওরা।
তুষার ছুটে গিয়ে বড় সাইজের রেঞ্চটা দোলাতে দোলাতে পেছন থেকে আঘাত করে ওর মাথাতে।
মনোযোগ দিয়ে নিতাইয়ের কথা শুনছিল ইন্তিসার– মাথার ভেতরে যেন গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয় ওর। চরকির মত যন্ত্রণার উৎসের দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই ওদের তিনজনকে চোখে পড়ে। রেঞ্চ তুলে আবারও আঘাত করতে যাচ্ছে তুষার।
এবার ইন্তিসার প্রস্তুত ছিল – খপ করে ধরে ফেলে রেঞ্চটা। মাথা ঝিম ঝিম করছে ওর। খুলির পেছনে অবর্ণনীয় একটা ব্যথার অনুভূতি। মাথাটা কি ফেটে গেছে?
একজন মানুষ আরেকজন মানুষের মাথা কিভাবে ফাটাতে পারে?
তবুও শান্ত কণ্ঠেই প্রশ্ন করে ও, ‘তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তুষার?’
‘খানকির পোলা!’ দাঁতে দাঁত চেপে হুংকার ছাড়ে তুষার, ‘তন্বীকে বাজে বলার আগে তোর দুইবার ভাবা উচিত ছিল।’
দুই পা বাড়িয়ে ইন্তিসারের চোয়াল বরাবর ঘুষি হাঁকায় এবার রেজা। দুই হাতে তুষারের হাতের রেঞ্চ আটকে রাখাতে একেবারেই অরক্ষিত হয়ে ছিল ও – এবার ছিটকে পড়ে মাটিতে। হাত থেকে রেঞ্চ ছুটে গেছে।
ওটার দিকে আবারও হাত বাড়িয়েছে তুষার – কিন্তু তাকে বাঁধাই দিতে পারে না ইন্তিসার। মহিষের মত ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে আসাদ। কাজেই তার দিকে মনোযোগ দেয় ও – প্রকাণ্ড ঘুষিতে কাঁপিয়ে দেয় আসাদকে।
সাহিত্যিকের খুলি নড়ে গেছে। পা ছড়িয়ে রাস্তাতে বসে পড়ে মানুষটা। এই ফাঁকে চট করে ঘুরে দাঁড়াতেই রেজার পরের ঘুষিটা আসতে দেখে ও।
ঝট করে একপাশে সরে গিয়ে আঘাতটা এড়াল ও – কানের পাশ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে শক্তিশালী হাতটা, ওটার সাথে শরীরের সংযোগ যেখানে, তার একটু নিচে বুকের পাঁজরের ওপর পর পর দুইবার ঘুষি মারে ইন্তিসার।
রেজার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। ফুসফুস আঘাত সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে সে এখন। বড় করে হা হয়ে শ্বাস নেওয়ার প্রচেষ্টায় তাকে দেখায় ডাঙায় তোলা এক মাছের মতো। তার বুকে একটা জোর ধাক্কা দিতেই হুড় মুড় করে মাটিতে পড়ে গেল ছেলেটা।
তুষারের রেঞ্চের আঘাতটা এবার ভয়ানক ছিল। গায়ের জোরে মেরেছে – ইন্তিসারের মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে।
আরও একবার হাত তোলে তুষার। মরণ আঘাতটা হানে তখনই। চোয়ালের ওপর আছড়ে পড়েছে রেঞ্চ। কড়কড় শব্দ শুনে ইন্তিসার বুঝে নেয় হাড় ওখানে কিছু ভাঙলো।
টলে উঠে ও মাটিতে শুয়ে পড়ে শক্ত শরীরটা নিয়ে। চলে যাচ্ছে না ওরা তিনজন? তন্বীকে নিয়ে কি বলেছে ও? ও হ্যাঁ – গালি দিয়েছিল। এজন্য মেয়েটা ওর পেছনে এদের লেলিয়ে দিয়েছে? ইন্তিসারের বিশ্বাস হতে চায় না।
পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে নিতাইয়ের গলা শোনা যাচ্ছে না?
‘ভাইজান! ভাইয়া – ও ভাই গো… ‘

তিন
থানা থেকে লোক এসে বসে আছে, শুনে নিচে নামতেই হল রহমান সাহেবকে।
ব্যাপারটা তিনি সাথে সাথেই বুঝে নিলেন। সুপুত্র আসাদ কারও মাথা ফাটিয়ে এসেছে।
রোজ একটা ছেলে কারও না কারও মাথা ফাটালে ওটা হতে পারে গুন্ডামি। কিন্তু গার্লফ্রেন্ডের সাথে অবিচারের প্রতিবাদে বছরে একটা মাথা ফাটানো প্রশংসার দাবী রাখে। রহমান সাহেব এর মাঝে দোষ খুঁজে পান না। ব্যাপারটা হল, ছেলে পৃথিবীর মাঝে লড়াই করতে শিখছে। লড়াইয়ের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। খুব আছে।
কাজেই সন্তুষ্ট রহমান সাহেব নিচে নেমে আসলেন এবং ওসির সাথে নিজে কথা বললেন।
ওসি সাহেব এতক্ষণ অপেক্ষা করে চা-টুকু খেয়ে শেষ করে ফেলেছেন। একটু একটু করে চানাচুর মুখে দিচ্ছিলেন। চানাচুরটা টাটকা না। চারপাশে তাকিয়ে যতদূর দেখা যায় এবং চারপাশে কান পেতে যতটুকু শোনা যায় – রহমান সাহেব যথেষ্ট বড়লোক।
বড়লোকদের রান্নাঘরে কি বাসী চানাচুর থাকে? থাকার তো কথা না।
পরক্ষণেই জাঁদরেল ওসি ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন, এরা নিঃসন্দেহে টাটকা চানাচুরের কিছু বয়াম দুই বছরের জন্য স্টোর রুমে ফেলে রাখে। এতে ওটা হয় বাসী। তারপর তাকে আলাদা মর্যাদা দিয়ে রান্নাঘরে রাখা হয়। যখন এমন কোন মানুষ আসে বাসাতে যাকে সোজা বাংলাতে বলা হয় ‘অনাহূত অতিথি’ – তখন তাকে ওই বয়াম থেকে এক বাটি চানাচুর আর এক কাপ চিনি ছাড়া চা দিয়ে বোঝানো হয়, ‘তোমাকে আমরা চাই না। তুমি মারা খাও।’
বড়লোকরাও কি ‘মারা খাও’ টার্মটা ব্যবহার করে? আজকের তরুণ সমাজে সেই চলছে শব্দ দুটো। ওসি মাজহার আলম সন্দেহের মাঝে পড়ে যান।
এই মুহূর্তে তিনি তাকিয়ে আছেন রহমান সাহেবের দিকে। ভ্রু দুটো আছে বেশ কুঁচকে।
‘বুঝলেন তো। আসাদের ঝামেলাটা এড়ানো যাবে না মনে হচ্ছে।’
‘কেন?’ অবাক হয়ে গেলেন রহমান সাহেব, ‘কে কোন গলিতে মার খেয়ে পড়ে থাকলে সেটাতে আসাদের নাম কেন আসবে?’
‘আপনাদের একটা অডির গাড়ি ছিল। আইডেন্টিকাল জিনিস। এলাকাতে আর কারও তো নেই। বাংলাদেশেই আছে তিনটি। কাজেই কেসটা বেশ শক্ত হয়ে গেল।’
‘আমার নামে কেস করবেন আপনি?’ হাসির কোন কথা শুনেছেন এভাবে বলেন রহমান সাহেব।
‘ছি ছি। আপনার নামে কেস করতে পারি? কেসটা আসাদের নামে চলে যাবে মনে হচ্ছে। আর তার বন্ধুদেরও সমস্যা হবে। একটা মেয়ে বোধহয় ওখানে ছিল। তন্বী। আসলে, গাড়িটা না নিয়ে গেলে আমরা কেসটা ছেড়ে দিতে পারতাম। এখন তো সম্ভব না। অনেকে দেখে ফেলেছে।’
‘কয়জন দেখেছে?’ চোখ সরু করে অর্থপূর্ণভাবে জানতে চান রহমান সাহেব।
আমতা আমতা করেন ওসি, ‘মানে – দেখেছে কিভাবে বলি – কিন্তু, চারজন সাক্ষী দিয়েছে পুলিশকে।’
‘ধামাচাপা দেওয়া যাবে না?’ গলা নামিয়ে বলেন আসাদের বাবা।
ওসির গলাও নেমে যায়, ‘কিছু পাত্তি লাগবে স্যার। মুখ বন্ধ করতে হবে – পোস্ট-মর্টেমের রিপোর্ট এদিক ওদিক করে দিতে হবে – এইসব স্যার!’
‘পোস্ট-মর্টেম! হারামজাদা মরে গেছে নাকি? মার্ডার কেস? মারা খাইলাম দেখি!’ হড়বড় করে বলে ফেলেন রহমান সাহেব।
এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। ছেলে মারামারি করে এসেছে জেনে স্বাভাবিক ছিলেন। দেখা যাচ্ছে খুন করে ফেলেছে সে! খুনের কেস সহজে মেটে না, জানেন তিনি। ভয়টা এখানেই পেয়েছেন।
ওসি বড়লোক মানুষটাকে চিমসে যেতে দেখে একটু হাসলেন। এই লোক এবার মারা খেয়েছে। টাকা বের হয়ে আসার তো কথা।
‘ঠিক মারা যায়নি এখনও, তবে যাবে। প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে, পাবলিক এক হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে আছে শালা। যে কোন সময় মরে গিয়ে আমাদের কাজ বাড়াবে।’
‘ওকে তাড়াতাড়ি ভালো একটা ক্লিনিকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করুন। আর টাকা নিয়ে ভাববেন না। ধামাচাপা দিতেই হবে ব্যাপারটা। অল্প বয়েস – রক্ত গরম, বোঝেনই তো।’
ওসি মাথা নাড়লেন। তিনি এখন সব বুঝতে প্রস্তুত। আজগুবী অলৌকিক যাই বলে বসুন রহমান সাহেব, ওসি এখন তাই বুঝবেন। কারণ এখন টাকা কথা বলছে।
যখন টাকা কথা বলে, আর সবাই চুপ হয়ে যায়।

চার
‘তাহলে তোমরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসো না?’ তৃতীয়বারের মত প্রশ্নটা করেন রহমান সাহেব।
তাঁর ভয় হচ্ছে ছেলে-মেয়ে দুটো একে অন্যকে পছন্দ করে কিন্তু সহজাত সামাজিক ভয়ে বাবাকে বলতে পারছে না। তিনি বাবা হলেও এসব ফালতু সংস্কার নিয়ে ভাবেন না – এটা তারা কবে বুঝবে?
‘আমরা বন্ধু। শুধুই বন্ধু। কিন্তু, কেন বাবা? এসব প্রশ্ন করছ কেন?’ অসহিষ্ণু হয়ে জানতে চায় আসাদের বাবা।
‘কারণ অডির গাড়িটা নিয়ে তোমার বের হওয়ার কারণে ফেঁসে গেছ তোমরা। বোঝা গেছে?’
চুপ হয়ে যায় আসাদ। রহমান সাহেব কড়া দৃষ্টি মেলে দেন তন্বীর দিকে। এই মেয়ে আসলেই অলুক্ষণে। জানে না দুনিয়ার হালচাল – ছেলেকে দিয়েছে উস্কিয়ে।
‘অ্যাই মেয়ে, তোমার নাম কি?’ রুক্ষভাবে জানতে চান রহমান সাহেব।
‘ত-তন্বী।’
‘যে ছেলেটাকে মারলি তোরা তার নাম কি?’
‘ইন্তিসার।’ দুইজনই বলে একসাথে।
‘সে কি করেছিল?’ চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করেন তিনি।
‘তন্বীকে বাজে কথা বলেছিল, বাবা। খুবই বাজে।’
‘শোনা যাক। কি বলেছিল? বলার অযোগ্য কিছু?’
মাথা নামায় তন্বী, ‘ইয়ে – ও বলেছিল আমার আম্মু নাকি ড্যাডি ছাড়া আর কেউ– ইয়ে – তারপর আমার জন্ম।’
চোখ কপালে উঠে যায় রহমান সাহেবের, ‘কেন একথা বলল সে?’
আমতা আমতা করে তন্বী আবারও, ‘আমি ওর শার্টের হাতা ছিঁড়ে দিয়েছিলাম। তাই।’
‘হায় রে দুচির ভাই! এত বদ ছেলের তো মরাই উচিত। এত অল্প ঘটনায় এভাবে বড়দের নিয়ে নোংরা কথা-’
কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি। একটা ছেলে কেন এত সুন্দর একটা মেয়ের বাবা মাকে নিয়ে বাজে গল্প রটাবে চারপাশে? এমনটা তো ঠিক নয়। ব্যাপার তখন আসলেই পার্সোনাল হয়ে যায়। কাকে দোষ দেবেন তিনি এখন? ইন্তিসারকে না তার ছেলে ও ছেলের বন্ধুদের?
ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না রহমান সাহেব।
‘এক সেকেন্ড!’ হাত তোলেন তিনি একটা দিক মনে হতেই, ‘ঘটনা তো এমন ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে না। হিসাব আমার মেলেনি। ঠিক কি এই কথাই বলেছিল তোমাকে ইন্তিসার?’
মাথা নাড়ে মেয়েটা, ‘ঠিক তা না – একটা গালি দিয়েছিল।’
‘তারপর?’
‘আসাদের কাছে ছুটে আসলাম পুরো অর্থটা জানতে। ছেলেরা কোন কথা কেন বলে আমি আজ ঠিক মত বুঝে উঠতে পারিনি।’
‘ক্লাসে শুধু তুমি আসাদের সাথেই মেশো শুনেছিলাম। কেন? স্ট্যাটাস দেখে ফ্রেন্ডশিপে তুমি বিশ্বাসী?’
হঠাৎ রহমান সাহেবের প্রশ্নটা শুনে চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে তন্বী। এর উত্তর সে দেবে না।
মেনে নিয়ে মাথা দোলান আসাদের বাবাও, এজন্যই বড়লোকি দেখিয়ে বেড়ানো মেয়ে তাঁর পছন্দের না।
তন্বী চুপ হয়ে আছে তার পেছনে একাধিক কারণ আছে। আসলেই সে লোয়ার ক্লাসের মানুষকে পছন্দ করে না। তাদের মুখ থেকে গালি শুনতে সে নারাজ। দ্বিতীয়তঃ এই ছেলেকে রিফিউজ করার চেয়ে কঠিন মারের সাথে রিফিউজ করা ভালো। ইন্তিসারের তার প্রতি দুর্বলতা আছে। দুর্বলতা কাটাতে হবে এবং এভাবে কাটানোটাই সবচেয়ে ভালো পথ। অন্তত তন্বীর মতে।
‘সে যাকগে – তাহলে বলবে – ঠিক কি উচ্চারণ ইন্তিসার করেছিল। মানে তোমাকে বলা ইন্সাল্টিং বাক্যটা?’
‘উম – ও বলেছিল -’ একটু ভাবে তন্বী, ‘ও এরকম কিছু বলেছিল- “হারামজাদী, শার্টটা ছিঁড়ে দিলি যে!”’
অবাক হয়ে যান রহমান সাহেব এবার আসলেই, ‘ এতো আজকের তরুণ সমাজের স্বাভাবিক আচরণ। “আম্মুকে আংকেল” তত্ত্ব আসল কোথা থেকে তাহলে?’
‘আসাদকে হারামজাদীর মানে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।’ বিড় বিড় করে জানায় তন্বী।
‘সে কি বলল?’ অগ্নি দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন রহমান সাহেব।
‘যদি কারও আম্মুকে তার আব্বু বাদে আর কেউ ‘ইয়ে’ করে আর তারপর তার জন্ম হয় – তবে সে হয় হারামজাদী।’
মাথায় হাত চাপড়িয়ে বসে পড়লেন রহমান সাহেব। আজকের দিনে যে ভাষা ছেলে-মেয়েরা ব্যবহার করে – তার তলা খুঁড়তে গেলে মহা ফ্যাসাদে পড়তেই হবে। ‘চ’-বর্গীয় গালির তো অভাবও নেই মাশাআল্লাহ, তার ওপর আছে দেদারসে ব্যবহার। বুৎপত্তিগত অর্থ খুঁজলে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। আর তাই করেছে তাঁর গুণধর ছেলে।
‘আর এই জন্যই খুন করে ফেললি তোরা ছেলেটাকে?’ হুংকার ছাড়েন তিনি।
‘খুন?’আঁতকে ওঠে তন্বী।

পরিশিষ্ট
মাথায় নরম একটা হাত চুলে আদর করে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করেই টের পায় ইন্তিসার।
তন্বী কি বুঝতে পেরেছে ওকে তেমন কিছুই সে বলেনি। রাগে একটু ধমক দিয়েছে খালি। তাও তো দিতো না। দুইদিনের খিদে ছিল পেটে। তাই দিয়েছে।
ভালোবাসার মানুষটাকে কি আর মন থেকে গালি দেওয়া যায়?
নিজের ভুল বুঝেই কি হাসপাতালে এসেছে তন্বী ওকে দেখতে? চোখ বন্ধ করে ওর ওরকমই লাগে।
নরম হাতটা এবার ওর গালে এসে থামে। হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে ওকে।
‘তন্বী?’ চোখ মেলে ইন্তিসার অনেক কষ্টে।
নিতাইয়ের গম্ভীর মুখটা দেখা যায় সামনেই।
‘ভাইজান উঠতাছেন ক্যান? ঘুমায় থাকেন। আমি আপনেরে ঘুম পাড়ায় দেই?’
চারপাশে তাকায় ইন্তিসার। নতুন কোন জায়গা মনে হচ্ছে। ভালো কোন ক্লিনিক।
আসাদের বাবার কাজ হয়তো। ঝামেলা দেখে ওকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।
আঁতিপাতি করে তন্বীকে খোঁজে ইন্তিসারের চোখ দুটো। কিন্তু মেয়েটি নেই কোথাও। উচ্চবিত্তের একটি মেয়ে যখন নিজের ভুলে মধ্যবিত্তের একটি ছেলেকে মৃত্যুশয্যায় ঠেলে দেয় – তারা সেই শয্যার ধারে কাছে আসে না। ক্ষমা প্রার্থনা শব্দটি তাদের জন্য নয়। ছিল না কোনদিনও।
আস্তে করে শুয়ে পড়ে ও আবারও। নিতাইয়ের চোখে অনুনয়। আজও।
‘ঠিক আছে, নিতাই।’ বিড় বিড় করে বলে ইন্তিসার, ‘আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দে।’

— ০ —

আমি আবার তোমার আঙুল…

পিঠ চুলকাচ্ছে।
কিছুক্ষণ বিছানায় মোচড়ামুচড়ি করলাম। তারপর হাল ছেড়ে দিলাম। এভাবে হবে না।
মিনিট দশেক পর ছোটভাইটা কি একটা খুঁজতে যেন এ ঘরে এল। ওকে ডাক দিলাম।
“পিঠটা একটু চুলকে দাও তো।”
আমার দিকে তাকিয়েই ওর মুখটা গরুর মত হয়ে গেল। এটা হয়েছে আরেকটা সমস্যা, ওই ঘটনার পর থেকে আমাকে দেখলেই গরুর মত মুখ করে ফেলে সে। এজন্য ওকে দোষ দেই না অবশ্য। ছোট একটা ভাই থাকার সুবিধা লুটছি। সময়ে-অসময়ে পিঠ চুলকিয়ে নিচ্ছি ওকে দিয়ে। মন্দ কি?
“না না, আরেকটু ডানে।” নির্দেশনা দিলাম।
“একটু ওপরে। আর এত জোরে না। আস্তে। একটু আস্তে।” আবারও নতুন হুকুম। কোনদিনই ঠিক জায়গাটা চুলকাতে পারল না লিয়ন।
ওপরে চুলকাচ্ছে সে এখন, জানতে চাইল, “এখানে?”
কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলাম, ওখানেই কি না। তারপর বিরক্ত হয়ে বললাম, “বালামার!”
“কি হল?” বুঝতে পারল না ও।
“এখন আরেক জায়গায় চুলকাচ্ছে।”
ইতস্তত করল লিয়ন। এতক্ষণে খেয়াল করলাম ওর পরণে স্কুলের পোশাক। এখানে এসেছিল মনে হয় কাঁধের ব্যাজটা খুঁজতে। এসে আটকে গেছে।
ওকে বললাম, “স্কুলে চলে যাও। চুলকানি চলে গেছে।”
“চলে যাবেই তো। এটা ঠিক চুলকানি না। এটা হল-” কথাটা শেষ করল না সে। এতটুকু বলে ফেলার জন্যই অনেক দুঃখী মনে হল তাকে। মুখ ফস্কে বের হয়ে গেছে কথাটা।
গরুর মত মুখ নিয়ে চলে গেল লিয়ন। স্কুলে যাবে।
আমার ইউনিভার্সিটি নেই তেমনটি নয়। রুয়েট এখন খোলা, পুরোদমে ক্লাস চলছে। ল্যাবগুলো সামলাতে গিয়ে নাভিঃশ্বাস উঠে যাচ্ছে ক্লাসের আর সবার। এষার কথা মনে পড়ল খুব। আজ বিকেলে ওর আসার কথা। আমিই যাব কি না ভাবছি।
লিয়ন কোন কথাটা অর্ধেক বলে রেখেই চলে গেছে, তা আমার জানা আছে। যখন কারও হাত বেঁধে রাখা হয় তখন এমনিতেই চুলকায় শরীরের নানা স্থান। শারীরিক নয়, মনস্তাত্বিক চুলকানি। আমার শরীর চুলকানো অস্বাভাবিক না এখন। হাত বেঁধে রাখার চেয়েও চমৎকার পরিস্থিতি আমার।
কব্জির সামান্য ওপর থেকে দুই হাতই কাটা আমার।

১.
রাজশাহী শহরে অটো চলে বেশি। ট্যাক্সির বালাই নেই, সিএনজি কিছু আছে। আর আছে লাখ লাখ অটো। অটোর আন্তর্জাতিক অর্থ অটোমোবাইল, তবে এখানে যেসব বাহনকে অটো বলে ডাকা হয় তারা অনেকটা সিএনজির মত দেখতে, ব্যাটারিতে চলে। সিএনজি যদি “হাইবর্ন সান” হয়, তো অটোরা “বাস্টার্ড”।
এমন একটা অটোতে উঠে বসে আছি। এষার সাথে দেখা করার কথা আছে। ফুলহাতা শার্ট পরে আছি, সব সময় এমন কিছু পরেই বের হই। মানুষজন প্রথমে হাত-না-থাকার বিষয়টা খেয়াল করে না। রাস্তার সবাই ঘুরে ঘুরে তাকায়ও না। কানে ইয়ারফোন।
ইয়ারফোনে আমি গান শুনছি না। ওটা সব সময় কানেই থাকে। বিশেষ উপকার হয় এতে। বাইরে বের হলে আমার মোবাইলফোন পকেটে থাকে। ওটা বের করে আনা আমার পক্ষে সম্ভব না। কাজেই ইয়ারফোনটা কানে রাখা ভাল একটা পদ্ধতি। কাটা হাত দিয়ে চাপ দিয়ে ফোন রিসিভ করা যায়। ডায়াল করা যায় না, তবে ওটা খুব একটা দরকারি কোন কাজ নয়।
গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। অটোওয়ালাকে বললাম, “নামিয়ে দেন, মামা।”
অটোওয়ালা অটো থামিয়েছে।
নেমে তার দিকে পশ্চাদ্দেশ এগিয়ে দিলাম। বিহ্বল অটোওয়ালা অবশ্য এর অর্থ বুঝল না।
“মানিব্যাগটা বের করেন।” বলতেই হল তাকে।
অটোওয়ালাকে ‘পাছা দেখানো’র উপযুক্ত কারণ আছে। কাজটা আগে করতাম সহযাত্রীদের কারও সাহায্য নিয়ে। যাত্রী কমিউনিটির সদস্য হিসেবে চালকের আগে সাহায্যের জন্য যাত্রীদের কাছে যাওয়াটা তো বেশি যৌক্তিক, তাই না?
নিউমার্কেটে গেলাম সেদিন। আমার বয়েসী এক ছেলে পুরোটা রাস্তা ফটর-ফটর করতে করতে এল। কি সহানুভূতি তার! “ভাই, খান কি করে”, “ভাই, টয়লেটে যান কি করে”, “আহারে ভাই আপনার লাইফটা শ্যাষ হইয়া গেল”, ইত্যাদি ইত্যাদি। একেবারে পটে গেলাম। ফলাফলস্বরূপ নিউমার্কেটের সামনে নেমে তাকে পাছা দেখানো হল। আক্ষরিক অর্থেই মেরে দেবে জানলে অবশ্যই দেখাতাম না।
বললাম, “প্লিজ।”
সে শুধু বলল, “আরে ভাই, এটা আর বলা লাগে। উঠসেন কোথা থেকে?”
অটোওয়ালা বলল, “ভাড়া হইছে ৭ টাকা।”
এর ঠিক ছয় সেকেন্ডের মাথাতে আমি বাংলাদেশের উসাইন বোল্টকে দেখে ফেললাম। আমার বয়েসী এক ছেলে। শক্ত করে মানিব্যাগটা নিয়ে প্রানপনে ছুটছে রাস্তার অন্যপাশে। আমিও ছুটতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলাম না।
হাত বাঁধা থাকলেই দৌড়ানো যায় না ঠিকমত, আমার তো হাতই নেই। দুটো সমানভাবে কাটলে একটা কথা ছিল। বাম হাত নয় ইঞ্চি কাটা। ডানহাত এক ফুট নাই। ব্যালেন্স পাই না। দৌড়াদৌড়ি করে জুত করা গেল না খুব।
অটোওয়ালা আমার দিকে গরুর মত মুখ করে তাকিয়ে থেকেছিল কিছুক্ষণ। তারপর বিমর্ষ মুখে বলেছিল, “ভাই, আপনের ভাড়া লাগবো না।”
নিউমার্কেট থেকে বাসা পর্যন্ত হেঁটে ফিরেছিলাম সেদিন। এরপর থেকে যাত্রী কমিউনিটির মাকে আমি আন্টি ডাকি। সরাসরি ড্রাইভারের সঙ্গে হয় লেনদেন। টাকাটা মানিব্যাগ থেকে বের করে নিল অটো ড্রাইভার। তারপর মানিব্যাগ ফেরত দিল পকেটে।
রাস্তার ভুল দিকে নেমেছিলাম। আরেকটু হলেই ধাক্কা দিয়েছিল এক সাইকেল-আরোহী। ক্ষমাপ্রার্থনার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল সে। আমিও মাথা হাল্কা দুলিয়ে “ইট’স ওকে” বুঝিয়ে দিলাম।
গায়ে বাতাস লাগিয়ে হাঁটলাম সামনের দিকে। গোলাপের মত ফুটফুটে চেহারার এক মেয়ের সাথে দেখা করার জন্য। হাত দুটো হারানোর পর থেকে অনেক কিছু হারিয়েছি আমি। এই একটা মানুষকে হারাইনি এখনও।
মোবাইল ভাইব্রেট করছে। ইয়ারফোন ব্যবহার করে রিসিভ করে ফেললাম।
এষার পরিচিত গলাটা শোনা গেল, “বাসায় আছো না তুমি? আসছি আমি।”
আমতা আমতা করে বললাম, “আমি তো ক্যাম্পাসে।”
পাশ দিয়ে দুটো মেয়ে চলে গেল। কলেজের ছাত্রী হবে খুব সম্ভব। একে অন্যকে গুঁতো দিয়ে বলল কিছু। শুনতে পাইনি এমন ভান করে হাঁটতে লাগলাম। এষা কোথায় আছে জানিয়েছে।
পথচারী মেয়েটা বলেছিল, “দ্যাখ দ্যাখ, ওই লোকটার দুইটা হাতই কাটা।”

২.
শহীদ মিনারের সামনে পাওয়া গেল এষাকে। বসে বসে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। আমাকে দেখে থেমে গেল। থমথমে মুখ। শয়তানের মত হাসি দিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। পাল্টা হাসল না সে।
“একা একা বের হয়েছ আবার?” মেঘের মত গলা ওর। মিষ্টি কণ্ঠের সাথে মেঘগলা যাবে না ভেবেছিলাম। দেখা গেল জানায় ভুল ছিল।
“এতে অভ্যস্ত হতে হবে তো।” ওর পাশে বসতে বসতে বললাম, “সব সময় সাথে কাওকে নিয়ে ঘুরব নাকি?”
কিছু না বলে আমার কনুইয়ের ওপরটা জড়াল ও।
ক্যাম্পাসের বড় ভাই-ছোট ভাই আমার দিকে তাকাচ্ছে দূর থেকে। ক্যাম্পাসে এখন আমি সেলিব্রেটি হয়ে গেছি। হলে থাকা হয়নি কখনও, কাজেই অনেক অপরিচিত মুখ রয়েছে ভেতরে। তাছাড়া লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকার কারণে আমার ভার্সিটি লাইফটা ঠিক আর দশজনের মত ছিল না। তেমন কেউ চিনতই না আমাকে। দুইবার ঘুরেও তাকাত না। এখন সবাই চেনে। সবাই ঘুরে তাকায়।
রুয়েটিয়ান উইদাউট হ্যান্ডস। সেলিব্রেটি(!) ফিগার। মানে, মুখ অথবা হাত দেখেই চেনে সবাই।
অথবা, হাত না দেখে!
করুণা মিশ্রিত একটা দৃষ্টি উপহার দিতে ভুলে গেছে এমন কোন মানুষ পাওয়া যায় না অবশ্য। বন্ধুদের ছোট্ট সার্কেল আর এই মেয়েটার কথা আলাদা।
“ক্লাস করতে আসো না কেন?” জানতে চাইল এষা।
বিষণ্ন একটা হাসি দিলাম। কিছু বললাম না।
“হাসবা না। একদম হাসবা না তুমি!” ঝাঁঝিয়ে উঠল মেয়েটা।
“আর কী করব?” হাসিটা মুছে গেল না আমার মুখ থেকে, “ক্লাসরুম তো আর ফিল্ম ফেস্টিভাল না, গিয়ে সামনের সারিতে বসে থাকব। দারুণ কোন দৃশ্য দেখে হাততালি দেওয়া যাবে।” একটু থমকে গেলাম, “মানে, পা-তালি দেওয়া যাবে।”
ঝাঁকিটা খেয়ে চমকালাম। এক হাতে আমাকে ধরে এত জোরে ঝাঁকি দিতে পারবে ছোটখাটো শরীরের একটা মেয়ে, তা ভাবিনি।
“মাঝপথে এসে ছেড়ে দিবি?” কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইল সে, “দেড় বছর বাকি আর। মাত্র দেড় বছর!”
রেগে গেলে ও আমাকে তুই-তুই করে বলে। বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের সূত্রপাত তো! এষা রেগে গেছে। দ্রুত হাসিটা সরালাম মুখ থেকে। এষার রাগ মানে আমার দুটো দিন খারাপ যাওয়া।
“তো? ক্লাস করে লাভ কি বল? লিখতে তো পারব না কিছু। পরীক্ষা দেওয়া লাগবে না আমার আর। সামহাও পরীক্ষা দিতে পারলেও কাজের কাজ কিছু হত না। ম্যাথ-ট্যাথ কিছু পারতাম না। খাতায় প্র্যাকটিস না করে পারা যায় এসব বল?”
“সেটা তো পরের চিন্তা। তুই চেষ্টা করতে থাকলে স্যারেরা নিশ্চয় তোর জন্য আলাদা কিছু ব্যবস্থা করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তোর ইচ্ছা আছে চেষ্টা করার?”
দুইপাশে মাথা নাড়লাম। মুখে উত্তর দেওয়ার মত কোন প্রশ্ন ছিল না ওটা।
আমার থুতনি ধরে নিজের দিকে ঘোরাল ও, “তোমার সমস্যাটা আমি জানি।”
বুঝতে পারলাম না ওর কথা, “কোন সমস্যা?”
হাতের দিকে তাকালাম। মাথা নাড়ল ও, “উফ, ওইটা না। তুমি সব কিছু ছেড়ে দিয়েছ। আন্টির সাথে আমার কথা হয়েছে।”
আগে বাসায় ওর ব্যাপারে প্যাসিভ ভয়েসে আলাপ হতো আর যে কোন বাঙালি ছেলের মতো। তবে ঘটনার পর থেকে নিয়মিত বাসায় এসে আমাকে দেখে যায় এষা। আম্মুর সাথে কথা হবে এটাতে আশ্চর্যের কি? হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝুলিয়ে বসে থাকলাম।
“খাওয়া দাওয়া তো ছেড়েছই। ঘুমাও না! তারপর নাকি-”
“গোসলও করি না।” চট করে জানিয়ে দিলাম।
“সে তো আমি বুঝতেই পারছি। খাটাসের মত গন্ধ আসছে।” গজ গজ করে উঠল এষা।
“লাভ কি বল?”
“শোনো, তোমার এসব ন্যাকামি আমার একদম অসহ্য লাগছে বুঝছো? খাওয়া নাই, গোসল নাই, ঘুম নাই! সারাদিন চুপচাপ বিছানাতে শুয়ে থাকো। এইসব ফাইজলামির মানেটা আমাকে বলবা তুমি?”
“ফাইজলামির কি আছে? আমার করার মত কোন কাজ নেই। মানে, এমন কিছু তো নেই যেটা আমি করতে পারি!”
কৃত্রিম বিস্ময় ফোটানোর চেষ্টা করলাম চেহারাতে, ঠিক কি বলতে চাইছে সে আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সেটা ওকে বোঝাতে দিতে চাই না। চাই ও প্রসঙ্গটা পাল্টে ফেলুক। এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে না হোক আমাদের।
“রাইট! তোমার মন-মেজাজ ভাল থাকে না সেজন্য নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছ, তা আমার বোঝা হয়ে গেছে। টিপিক্যাল রোমিও! কিন্তু তুমি টিভি দেখ না, মুভি দেখ না, তোমার যে কাজটা সবচেয়ে প্রিয়, সেই গল্পের বইও পড় না। সারাদিন চুপচাপ শুয়ে শুয়ে ফ্যান ঘোরা দেখ। এটা স্বাভাবিক না, কেপি!”
কিছু বললাম না। অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হইয়াছে।
জুরিদের রায় হওয়া উচিত : গিল্টি!
এষার চোখে পানি দেখলাম। গোপন করার চেষ্টা করল না সে। আমার হাতের কাটা অংশের সামান্য ওপরে শক্ত করে আটকালো নিজের হাত।
“তোমার সমস্যাটা শরীরে না। মনে।”
“তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।” ওকে এতটূকুই বললাম।
“তোমার হাত-” একটু অপেক্ষা করে যথেষ্ট সাহস অর্জন করার চেষ্টা করল মেয়েটা। তারপর বলেই ফেলল, “তোমার হাত নেই দেখে সারাদিন শুয়ে আছ, এই কথা আমি বিশ্বাস করি না।”
“আর কোন কারণ থাকার দরকার আছে বলে তোমার মনে হয়?”
সন্ধ্যা নেমে আসছে ধীরে ধীরে। আলো কমে এসেছে। পাখিরা ডাকছে বেশি। পাখিদের হঠাৎ করে ঈর্ষা হল খুব। শালাদের হাত নেই, তাও দিব্যি শান্তিতে আছে। ডাকছে।
“তোমাকে আমি চিনি।” একটু থেমে বলল এষা, “তুমি বর্ন ফাইটার। চ্যালেঞ্জ ভালবাসো। চ্যালেঞ্জ না থাকলেই বোরিং ফীল কর। সেই তুমি জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটার সামনে এসে হার মেনে নিচ্ছ? প্রথম প্রথম তোমার প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ভাবতাম। কিন্তু তিন মাস পার হয়ে গেছে, কেপি। হাসপাতাল থেকে তিন মাস হল ফিরে এসেছ তুমি! অথচ ফাইট ব্যাক করার কোন চেষ্টা নেই… দ্যাটস সো …”
আগ্রহের সাথে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
“…নট ইউ।”
“কিছু কিছু চ্যালেঞ্জের সাথে লড়া যায় না, এষা।” ওকে বললাম, “কিছু কিছু পরিস্থিতির ক্ষমতা তোমার আমার ক্ষমতার চেয়ে বেশি।”
“তোমার স্ট্রেন্থের প্রশ্ন আসছে না এখানে। তোমার সমস্যা অন্য কোনখানে।” বিরক্ত হয়ে বলল ও, “কিছু একটা জ্বালাতন করছে তোমাকে। মেন্টালি। কি সেটা?”
একদম ঠিক জায়গাতে হাত দিয়েছে এষা। কয়েক সেকেন্ড ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। গালে এক ফোঁটা পানি। আমাকে জিততে দেখে অভ্যস্ত মেয়েটা আমার পরাজয় মেনে নিতে পারছে না।
“এষা …” মিনিট দুয়েক পর বললাম ওকে, “আমি আসলে … আমি আর লিখতে পারছি না।”

৩.
“বিড়ি দে।” রাহাতের দিকে তাকিয়ে রীতিমত দাবী করে বসলাম।
বিরক্ত হল ছেলেটা, “থাম না রে বাপ। অর্ধেকও টানতে দিবি না?”
হলে এসে বসে আছি। শহিদ হল। নীচতলার প্রথম ঘরটাই আমাদের। মাঝে মাঝে এখানে এসে আড্ডা দেওয়া হত। গত পাঁচ মাস ধরে তেমন আসা হয় না। ওরাই বরং আমার ওখানে গিয়ে গিয়ে দেখে এসেছিল। হাসপাতালে। বাসাতে। অনেকদিন পর ফিরে আসলাম এখানে।
আগ্রাসী ভঙ্গিতে “বিড়ি” চাওয়ার পেছনে যথাযোগ্য কারণ আছে। হাত হারানোর পর থেকে সিগারেট খাওয়া হচ্ছে না। খাওয়ার উপায় নেই, হাত ছাড়া একটা মানুষ আবার কি করে সিগারেট খায়? এই বন্ধুদের সাথে থাকলে একটু আধটু সিগারেট খাওয়া চলে।
“একটা প্রশ্ন দোস্ত,” ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে হাঁক ছেড়ে প্রশ্নটা করল আশিক, “গত কয়েক মাস ধরে প্রশ্নটা মাথায় নিইয়া ঘুরতেছি। জিজ্ঞাস করা হয় নাই তোকে।”
আশিকের ঘরের অন্যপ্রান্তে থাকার কারণটা মোটামুটি স্পষ্ট। কান পাতলে তার ল্যাপটপ থেকে অশ্লীল শব্দমালা শোনা যাবে। পর্ন অ্যাডিক্ট হিসেবে ছেলেটার সুখ্যাতি আছে। কথায় আছে, আশিক প্যান্ট আর এইচডি পর্নক্লিপ ছাড়া কোথাও যায় না। ঘরের এক কোণে গিয়ে একা একা সিগারেট খাওয়ার কারণও ওই একটাই।
রাজ্যের সারল্য মুখে তুলে জানতে চাইলাম, “করে ফ্যাল। পায়খানা আর প্রশ্ন পেটে নিয়ে ঘোরা উচিত না।”
সিগারেটে আরও দুটো টান দিল সে। “হাত তো নাই তোর…“
“হ, নাই তো।” সর্বাত্মকরণে একমত হলাম।
“তাহলে হাত মারিস ক্যামনে?”
ঘরের প্রত্যেকে বিভিন্ন স্কেলে অট্টহাসি দিল এবার। না হেসে পারলাম না আমিও। এই শালার প্রশ্নটা কৌন বনেগা ক্রোড়পতি অনুষ্ঠানে ঢুকিয়ে দিলে কোন শালাকে আর কোটি টাকা জেতা লাগবে না। প্যান্ট আর পর্নক্লিপ নিয়ে স্টুডিও থেকে বের হয়ে যাবে সরাসরি।
“শালা!” বললাম খালি, “আমি টয়লেট প্রবলেমের সলিউশন বের করতেই মাস দুয়েক লাগায় ফেললাম। আর এ শালা আছে হাত মারার ধান্ধাতে।”
বিড়ি হস্তান্তর করল রাহাত। ঠিক হস্তান্তর বলা চলে না। আমার মুখে ধরল, আমি টানলাম।
কৌতূহলে ছোট ছোট হয়ে গেছে রাহাতের চোখ, “ওই প্রবলেমের সলিউশন কিভাবে করলি?”
“ছোট বাথরুমের ঝামেলা কম। আই গো কমান্ডো।”
“কমান্ডো?” বড় বড় চোখ করে জানতে চাইল জাহিদ, ছেলেটার খুব সখ ছিল আর্মিতে যোগ দেবে, “টয়লেটে তুই কমান্ডো হয়ে যাস?”
ভ্রু কুঁচকে গেছে আশিকেরও, “লাইক আলাদিন সেইড… You go to the bathroom after Osama, you will realize the true meaning of terrorism.”
আলাদিন দ্য ডিক্টেটরকে সব অ্যাঙ্গেল থেকেই গুরু বলে মানে পর্ন-আশিক। সময়ে অসময়ে গড়গড় করে তার উদ্ধৃতি আওড়ানো পুরানো স্বভাব তার। আমরা কিছু মনে করলাম না।
“না, সিরিয়াসলি, হাও ক্যান আ ম্যান গো কমান্ডো ইন দ্য টয়লেট!” মিলিটারি-জাহিদের আগ্রহটুকু জেনুইন এবং বাস্তব।
জামা সামান্য তুলে দেখালাম ওদের।
“ওহ মাই ফাক!” দূর থেকেই চিৎকার দিল আশিক, “গ্রেনেড! পুরাই গ্রেনেড!”
ঝলমলে হাসি উপহার দিলাম ওকে, “রাইট। চেইনের সঙ্গে একটা চাবির রিঙ লাগিয়ে রাখতে হচ্ছে এখন। বাথরুমের দরজার প্রয়োজনমত হাইটে লাগিয়ে নিয়েছি ছোট্ট একটা রড। ওটাতে আটকে চেইন খুলতে হয় আরকি। কঠিন, কিন্তু অসম্ভব না। নিজের কাজ নিজের করতে পারছি।”
“কমান্ডো।” বিড়বিড় করে স্বপ্নালু চোখে বলল জাহিদ।
“ইয়েপ। তবে আসল চ্যালেঞ্জ হল বড়টা করা।” ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচালাম।
“সেইটা কেমনে? একা একা তো পসিবল না…” রাহাত হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছে।
“পসিবল। আমিও একটা সময় মনে করতাম পসিবল না।” দীর্ঘশ্বাস চাপলাম, “থ্যাংকস টু টিম গ্রিফিন।”
“টিম গ্রিফিন কে?” দূর থেকে গলা চড়িয়ে জানতে চাইল আশিক। তার ল্যাপটপের ভেতর নারীকণ্ঠের গলাও চড়ে যাচ্ছে। বুঝলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সাথে যোগ দেবে আশিক।
“লেট মি গেস…” রাহাত বলল, “কেপি একজনের নাম নিয়েছে, যাকে আমরা চিনি না। তারমানে টিম গ্রিফিন একজন রাইটার। বই লেখেছে ও শালা। সেখান থেকে পড়ে সে কমান্ডো হওয়া শিখেছে।”
হেসে ফেললাম, “দ্যাটস অ্যাবাউট রাইট। বই পড়ে কমান্ডো হতে শেখা প্রথম মানুষগুলোর মধ্যে আমিও একজন। টিম গ্রিফিন বই লিখেছেন সেটাও সত্য। সেখানে বড়টা করার জন্যও চমৎকার সলিউশন দেওয়া আছে।”
“ট্যালেন্টেড লোক নিঃসন্দেহে।” জাহিদ বলল, “হাত থাকতে হাতের মর্যাদা বোঝে না বাঙালি। নন-বাঙালি বলেই বুঝেছে হয়ত।”
দুইপাশে মাথা নাড়লাম, “হাত থাকতে হাতের মর্যাদা নন-বাঙালিও বোঝে না রে। টিম গ্রিফিনের দুটো হাতই অকেজো হয়ে গেছে। মোটর-নিউরন ডিজিজ। তারপরই বইটা লিখেছে সে।”
ঘরের মধ্যে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে এল। মাথা খানিকটা চুলকাল জাহিদ। ঠিক সেই মুহূর্তে আমারও খুব ইচ্ছে করছিল মাথা চুলকাতে। সাইকোলজিকাল ইচ?
“ওয়েট আ সেকেন্ড। তাহলে তুইও লিখতে পারবি। আবার লেখালেখি শুরু করতে পারবি তুই।” পয়েন্টটা ধরল রাহাত, “শুধু জানতে হবে টিম গ্রিফিনের হাত নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর সে লিখল কি করে?”
“আধুনিক প্রযুক্তি আর অসম্ভব চমৎকার এক আদর্শ স্ত্রীর ভূমিকা আছে তার পেছনে।” দুঃখী একটা হাসি হেসে বললাম আমি।
“কালকেই এষার সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি।” পায়ে চাপড় দিয়ে উঠে দাঁড়াল আশিক। আমরা সবাই জানি ফুল লেন্থ ভিডিও দেখা শেষ হওয়ার সাথে তার ওই পা চাপড়ানোর সংযোগ আছে। “আর কোন আধুনিক প্রযুক্তি?”
“দুটোর কোনটাই পেতে যাচ্ছি না আমি। এষা আরও বেটার কাওকে ডিজার্ভ করে। আর…”
হঠাৎ খেয়াল করলাম ঘরের ভেতর হাল্কা পরিবেশটা আর নেই, “বাংলাতে লেখার জন্য নিখুঁত কোন স্পীচ-টু-টেক্সট সফটওয়ার নেই। ওই লেখক ব্যাটা ইংরেজিতে লিখতে পেরেছে কারণ ও ভাষার অনেক টেক সাপোর্ট।”
ঘরের আবহাওয়া আরও একটু নিরানন্দ হয়ে গেল এবার।
আশিকের দিকে তাকালাম।
নাক কুঁচকে বললাম, “আর শাওয়া তোমাদের হাত দিয়েই করতেছটা কি? খাচ্চর শালা।”
লজ্জিত মুখে কুঁচকি থেকে হাত বের করে আনল ও, “চুলকাচ্ছিল। এমন করিস ক্যান? জেলাস?”
হেসে ফেললাম। এই শালারা না থাকলে ছোট ছোট হাসির মুহূর্তগুলো থাকত আমার জীবনে?

৪.
“গল্প সংকলন-০১ ভালই চলছে।” প্রকাশক ভদ্রলোক জানালেন, “আলাদা বিজনেস চার্ম এসেছে, দ্য ম্যান উইদাউট হ্যান্ডস, পাঠকরা বলে। ভাবছি আগামী মাসে গল্প সংকলন-০২ বের করে ফেলব।”
শুকনো হাসলাম। এই আরেকটা মানুষ, যিনি আমার বাজে সময়ে আমাকে ছেড়ে যাননি। দুটো মাত্র উপন্যাস লিখতে পেরেছিলাম আমার রাইটিং ক্যারিয়ারে। তারপরই গেল হাতদুটো। অন্য কোন প্রকাশক হলে হয়ত দুটো সহানুভূতিসূচক কথা বলে ডুব মেরে যেতেন। ইনি যাননি। অনলাইন থেকে গল্পগুলোকে সংকলন বানাচ্ছেন। প্রতি সংকলনে ১৫টা করে গল্প। অনায়াসে ১৫টা বই বের করা যাবে ২৩০টা গল্প দিয়ে। গল্প সংকলন ১৫ পর্যন্ত। আইডিয়াটা আমি তাঁকে দেইনি। তিনিই নিজ থেকে এগিয়ে এসেছেন।
“গ্রেট। দ্যাট উইল বি গ্রেট।” বললাম।
“শরীর কেমন তোমার?” জানতে চাইলেন তিনি।
“খারাপ না স্যার। বেশ আছি।” মিথ্যে বললাম।
“নিজের খেয়াল রেখো। বাসায় তো আছ, নাকি হলে?”
“না, বাসাতেই।”
একটু নীরবতা। তারপর প্রশ্নটা করলেন তিনি, এতদিন পর।
“ঠিক কি ঘটেছিল আমাকে বলবে? অ্যাকসিডেন্টটা? … আসলে আমি এখনও জানি না।”
তিনি জানেন না সেটা আমিও জানি। কাওকে এ ব্যাপারে কিছু বলিনি। বলার মত মানসিক অবস্থা ছিল না অবশ্য। তবুও কিভাবে যেন রাষ্ট্র চাউর হয়ে গেল আমার হাত গেছে। গন ইন দ্য উইন্ড!
জাহিদের সঙ্গে সাইকেল চালাচ্ছিলাম আমি সেদিন। রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল অনেকদিনের। সেবার আমরা বাস্তবায়ন করছিলাম শুধু। দ্রুত সাইকেল না চালালে পৌঁছাতেই দুপুর হয়ে যাবে সেটা আমাদের জানা আছে, প্রাণপনে প্যাডেল মারছিলাম। চুল উড়ছিল বন্য বাতাসে, হাইওয়ের মুক্ত পরিবেশ।
হাতের পেশী ফুলে ছিল সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে থাকার কারণে। রীতিমত রেস করছিলাম আমরা। রেস করার জন্য এন্ডিং পয়েন্ট বের করাটা সহজ। “পরবর্তী চায়ের দোকান” হচ্ছিল আমাদের রেসিং এন্ডিং। এক চায়ের দোকান থেকে আরেক চায়ের দোকানের দূরত্ব কম না তো। বাইপাস পার হয়ে চাঁপাইয়ের পথে দোকানের ভালরকম আকাল আছে।
এর আগের দুই চায়ের দোকানে আমার আগে পৌঁছেছে জাহিদ। মিলিটারি ম্যান তো, তার জন্য সহজ হওয়ার কথা কাজটা, আমার চেয়ে শারীরিকভাবে বেশি ফিট সে। শালার স্ট্যামিনা আছে, টানা আধঘণ্টা মেশিনের মত প্যাডেল মেরেও সামান্য হাঁপায় না। ওর বউয়ের কথা চিন্তা করে আমার গলাই মাঝে মাঝে শুকিয়ে যায়।
ইজ্জতের প্রশ্ন এসে গেছে, পর পর তিন বার হেরে যাওয়া পুরুষ মানুষের জন্য অপমানের। শরীরের শেষ শক্তিবিন্দুটা খরচ করে সাইকেলের প্যাডেল মারছিলাম। এভাবে আর দশ সেকেন্ড চালিয়ে গেলেই জাহিদকে পার করে যাব। আমাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব কমে আসছিল দ্রুত।
বিপরীত দিক থেকে আসা ঢাকাগামী শ্যামলী আর দেশ ট্রাভেলসের মধ্যেও একই রকম রেস লক্ষ্য করা গেল। ওভারটেক করার জন্য পাগল হয়ে আছে শ্যামলীর বাস। আরেকটু হলেই আমার ওপর তুলে দিয়েছিল শালা ড্রাইভার।
প্রাণপনে বাসের গতিপথ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনলাম। গতি কমে গেল অজান্তেই। সামনে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসল জাহিদ। আবারও পিছিয়ে পড়েছি আমি। ওকে দেখে মনে হল ঈদের চাঁদ দেখেছে পিচঢালা রাস্তাতে। দাঁতে দাঁত পিষে আবারও গতি বাড়াচ্ছি। পেছনে ভারী ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, ট্রাক আসছে একটা। হর্নও দিল। ও শালাকে সাইড দেওয়ার মানসিকতা আমার নেই তখন।
“পারলে ওভারটেক করে যাও না বাপু, দেখছ না রেস করছি?” বিড়বিড় করে বললাম, “কানের পাশে পক পক করছ কেন?”
নিজের দুটো হাত আস্ত থাকা অবস্থাতে ওটাই ছিল আমার শেষ ভাবনা। পরের তিনটা সেকেন্ডই সবকিছু পাল্টে দিল। ধ্বংস করে দিল আমার পরিচিত পৃথিবীটা।
আচমকা সাইড রোড থেকে বের হয়ে এল মোটরসাইকেলটা। আঁতকে উঠেছে জাহিদ, পরিষ্কার শুনতে পেলাম। মোটরসাইকেল আরোহীও থতমত খেয়ে গেছে। জাহিদের সামনের চাকাতে প্রচণ্ড জোরে লাগল মোটরসাইকেলের সামনের চাকা। বাইক ঘোরাতে হল না আর, পুরো রাস্তা পার করে অন্যপাশের খাদে ছিটকে পড়ল ওটা, আরোহীসহ।
জাহিদ আছড়ে পড়েছে রাস্তার ওপরই, সাইকেলসমেত। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে তার দিকে ছুটে গেলাম আমিও। রিফ্লেক্সের বশে গতি পাল্টে নেওয়ার চেষ্টা করলাম, কাজ হল না। সরাসরি ওর সাইকেলে আটকে গেল আমার সাইকেল। পরমুহূর্তে টের পেলাম বাতাসে ভাসছি। হেলমেট নেই মাথাতে, শুন্যে ভাসতে ভাসতেই হাত দুটো উঠে গেছে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে।
বেঁচে থাকার তাগিয়ে একটা কথাই ভাবতে পারলাম, মাথাটাকে রক্ষা করতে হবে। চিত হয়ে রাস্তাতে আছড়ে পড়লাম হাত এখনও মাথার ওপরে তোলা, যতদূর পেরেছি উল্টোদিকে বাকিয়ে নিয়েছিলাম, তালুর উল্টোপিঠটা রাস্তাতে পড়ল আগে, হাড় ভাঙ্গার বিচ্ছিরি শব্দটা কানের খুব কাছে শোনা গেল।
উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, মাথা থেকে রাস্তার মাঝে যথেষ্ট ক্লিয়ারেন্স ভলিউম দিতে পেরেছে আমার হাত। গতিজড়তাতে ছিটকে পিছিয়ে গেছে মাথা, মনে হল ঘাড় ভেঙ্গে যাবে। তবে রাস্তার শক্ত তলে ঠুকে গেল না খুলি। ক্লিয়ারেন্স ভলিউমটুকু কাজে দিয়েছে। হাত দুটো ভেঙ্গে গেলেও মাথা বাঁচিয়ে দিতে পেরেছি আমি। স্বস্তির নিঃশ্বাস আর যন্ত্রণার আর্তচিৎকার একসাথে ছাড়তে যাব, তখনই দুই হাতের ওপর দিয়ে উঠে গেল ট্রাকের সামনের চাকা।
অপার্থিব, নারকীয় এক যন্ত্রণা হল্কা দিয়ে উঠে এল হাতের আঙুলের ডগা থেকে থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত। আর কিছু মনে নেই আমার।
“পরে অবশ্য শুনেছিলাম, রুটি বেলার মত অবস্থা হয়েছিল আমার হাতের। মানে…” কি বলব আর ভেবে পেলাম না, “তেমনটাই শুনেছিলাম আরকি…”
কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলেন প্রকাশক ভদ্রলোক।
“তুমি একটা কাজ কর, ইমন।” তারপর বললেন তিনি, “ঢাকায় চলে এসো।”
“ঢাকায়, স্যার?”
“ইয়েস, ঢাকায়। আমাদের প্রকাশনীতে স্টেনো টাইপিস্ট রাখার চিন্তাভাবনা চলছে। তোমার ওপর ডিপেন্ড করছে সবকিছু।”
“আমার ওপর, স্যার?” ঠিক বুঝলাম না উনার কথা।
“কাম অন! স্টেনোগ্রাফার রাখার সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র তোমার জন্য নেওয়া হয়েছে।” কোমল গলাতে বললেন তিনি, “তুমি মুখে বলবে, সে টাইপ করবে। তোমার উপন্যাস চাই আমরা।”
এখনও বুঝলাম না উনার কথা, “আমার জন্য?”
মৃদু হাসলেন তিনি, “অবাক হচ্ছ কেন? ইউ আর ফ্যামিলি।”
জানি না কেন, চোখে পানি চলে আসল আমার।

৫.
ফ্যান ঘুরছে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। ফ্যানরা যখন ঘোরা শুরু করে, তখন বোঝা যায় তারা ক্লকওয়াইজ ঘুরছে না অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ। তবে খানিকক্ষণ পরে এটা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। শুরুতে অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ মুভমেন্ট পরিষ্কার বোঝা যায়। পরে … খুব একটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
আধঘণ্টা ধরে একটানা তাকিয়ে থেকে এই সিদ্ধান্তে মাত্র পৌঁছেছি, দরজাটা খুলে গেল। গন্ধ শুনেই বুঝলাম এষা এসেছে। ওর শরীরের গন্ধ আমি যে কোন পারফিউমের চেয়ে ভাল চিনি। যেমনটা চেনে ও আমার শরীরের গন্ধ।
“…আমি দেখছি, আন্টি।” মুখ ঘুরিয়ে আম্মুকে বলল সে।
উঠে বসতে হল। বিপদের আশঙ্কা করাটা খুব একটা অমূলক তো নয়। এর আগে একটা আলোচনা সে চালাচ্ছিল সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। আম্মু অবশেষে এষাকে লেলিয়ে দিল? এই দৃশ্য দেখার জন্যই বেঁচে ছিলাম আমি!
“না না, তোমাকে আর উঠে বসতে হবে না।” ঝাঁঝালো গলাতে বলল এষা, “তুমি শুয়ে শুয়ে ফ্যান দেখো!”
দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে সে, আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। শুকনো গলায় জানতে চাইলাম, “দরজা লাগাচ্ছ কেন?”
“রেপ করব না। ভয় পাওয়ার কিছু নাই তোর।” সাফ সাফ জানিয়ে দিল সে।
বেশিদিন নয়, বাইরের এক দেশে তিনজন যুবতী ধরে নিয়ে গিয়ে এক যুবককে রেপ করে রাস্তাতে নামিয়ে দিয়েছে। কাজেই ভয় পাওয়ার কিছু তো আছেই। তার ওপর আমি লুলা মানুষ। অবশ্য মুখ ফুটে কথাটা বললাম না তাকে। এর মধ্যেই তুই করে বলা শুরু করেছে। এর অর্থ রেগে বোম হয়ে আছে সে।
“কি? প্রতিবার এসেই তোর নামে একশ’ একটা অভিযোগ শোনা লাগে ক্যান?” বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়তে পড়তে বলল এষা।
“আমি আবার কি করলাম?” বিড়বিড় করে নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করলাম।
“আবার কি করলাম!” ভেংচে দিল এষা, “শালা, অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে নিজের হাত দুইটা খুইয়ে আসছিস ওইটাই কি যথেষ্ট ছিল না? হারামজাদা! এখন বাকি সবাইকে জ্বালিয়ে মারার আগ পর্যন্ত তোর শান্তি হবে না, নাকি?”
“কই, কাওকে জ্বালাই না তো।” আনমনে বললাম। ফ্যান দেখছি।
চেয়ার থেকে উঠে সুইচ বন্ধ করে দিল এষা। ফ্যানটা আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছে।
“এবার পরিষ্কার বোঝা গেল ব্যাপারটা।” হাসিমুখে ওকে আমার আবিষ্কারের ব্যাপারে জানালাম।
“কি?” ভ্রু কুঁচকে আছে ওর।
“ফ্যানগুলো অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ ঘুরে। একটু আগে ঘুরতে থাকা অবস্থাতে ক্লকওয়াইজ লাগছিল।”
হাতের কাছে একটা চোথা (ক্লাস লেকচার) পাওয়া গেল। দুই সেমিস্টার আগের মনে হয়। ওটাই গোল করে পাকিয়ে আমার মাথাতে মারল এষা, “চুপ করে বসে থাক, শয়তান কোথাকার!”
কপালের কাছটা চুলকাচ্ছে। কাগজ দিয়ে বাড়ি মারলে ব্যথা লাগে না। চুলকায়। আমার এখন কারণে-অকারণে চুলকায়। মারলে আরও চুলকায়। একটা কাটা হাত ওপরে তুলে কনুইয়ের কাছে কপাল ঘষে চুলকানোর চেষ্টা করলাম। এষা দেখল, কিন্তু সাহায্য করতে এল না। একপাশে ফেলে দিল চোথা।
“কাল সকাল থেকে কিছুই খাসনি, আন্টি বলল।” অবশেষে আসল কথাতে এল সে।
“আরে বাল, খিদা নাই।” বিরক্ত হলাম এবার। খাবারের কথা কেউ বললেই বিরক্ত লাগে।
“আমার সামনে বাল-বাল করবি না। একদম করবি না বাল-বাল!” আবারও মুখ ঝামটে বলল ও।
“চার এক্কে চার।”
“কিছু বললি?”
“আরে না।” তাড়াতাড়ি বললাম, “দ্যাখ, খাওয়া নিয়ে জ্বালাস না তো। আর কিছু নিয়ে কথা বললে বল।”
“আমি জ্বালাচ্ছি?” অবাক হয়ে গেল এষা, “ও, আমি জ্বালাচ্ছি এখন? তুই আন্টিকে জ্বালিয়ে শেষ করে দিচ্ছিস বুঝলি? তোর পেছন পেছন কি সারাদিন ঘুরবে আন্টি? খাইয়ে দিতে আসলে খেয়ে নিবি। এত জ্বালাস ক্যান?”
এই প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। কথাটা ঠিক। আম্মুকে এখন খাইয়ে দেওয়া লাগে। মাঝে মাঝে আমি নিজেই খাওয়ার চেষ্টা করি। কাজ হয় না। দুই হাত সমানভাবে কাটলে হয়ত সম্ভব হত। এক হাত ছোট এক হাত বড় তো, আবার তালুও নাই। তাই খেতে পারি না নিজে নিজে। গতকাল থেকে খাবারের ঝামেলা করার কথা মনে হলেই বমি লাগছে। লাইফ হল এটা একটা? মাসের পর মাস লোকজনের ঘাড়ে চেপে বসে আছি!
“কি হল, কিছু তো বলবা?” নরম হয়ে এসেছে এষার কণ্ঠ।
“নিজ হাতে খেতে ইচ্ছে করছে রে খুব।” শোনা যায় না এমনভাবে বললাম।
চেয়ার থেকে উঠে এসে বিছানাতে বসল ও। আমার হাত দুটো ধরল কাঁপা হাতে। ওর হাত কাঁপার কারণ আছে। এই হাত দুটো দিয়ে কতবার ধরেছি ওকে। জড়িয়েছি ওর হাত, নেড়ে দিয়েছি ওর চুল, ছুঁয়ে দিয়েছি ওর ঠোঁট। এই দুই হাত দিয়েই ওকে কতবার তুলে নিয়েছি শুন্যে। ভয় পেত ও প্রথমে। আমি হয়ত ওকে ফেলে দেব। আস্তে আস্তে বিশ্বাস করল আমাকে, আমি কোনদিনও ফেলে দেব না ওকে।
সেই আমি এখন হাতবিহীন এক অথর্ব। ওকে আর কোনদিনও দুই হাতে শুন্যে তুলে ফেলা হবে না। ওকে ফেলে দিয়েছি আমি। ফেলে দিয়েছি পুরো পরিবারটিকেই।
কোনরকম আগাম সংকেত না দিয়েই আমাকে জড়িয়ে ধরল এষা। কাটা হাত দুটো ওর পিঠে আড়াআড়ি রাখলাম। কাঁপছে মেয়েটা। কাঁদছে কি? কাঁধের ওপর মাথা থাকার কারণে ঠিক বোঝা গেল না।
“একটা সময় বলেছিলাম না, আমার সবকিছু তোমার?” নিচু কণ্ঠে বলল ও।
“হুঁ।” বললাম, আমার গলাও ভারী হয়ে আসছে।
“আমার হাতদুটোও তোমার তাহলে, তাই না?”
কিছু বললাম না। মেয়েটা এত পাগল কেন?
“আমি খাইয়ে দিলে খাবা?”
কাটা হাত দিয়েই ওর চুল ছুঁয়ে দিলাম গভীর ভালবাসায়।
“খাবো।”

৬.
“কুত্তা নাকি তুই?” সবগুলো দাঁত বের করে বলল মাসুদ।
হাসলাম, এখনও আগের মতই আছে ছেলেটা। স্কুলজীবনের বেস্ট ফ্রেন্ড মাসুদ এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি। ইয়ার ফাইনাল শেষ হতে এই গালিটা দেওয়ার জন্যই রাজশাহী পর্যন্ত বয়ে এসেছে।
“যাব্ব্যাটা।” বললাম, “খবর কি তোর?”
“আমার খবর? আরে শালা তোমার খবর কও আগে। বিবিসি-সিএনএন বন্ধ কইরা দৌড়ায় আসলাম এইটা শুনতে।”
“তা তো কইবাই। শুনলাম নতুন পিরিতি করতেছ?”
হেহে করে সলজ্জ হাসি দিল মাসুদ। পুরুষের আবার বিনয়!
“ওই আরকি।” কম্বলের দিকে তাকাল, “বাইর কর।”
চমকে উঠলাম, “অ্যা?”
বিরক্ত হল মাসুদ, “তোমার নধর শরীরখানা বের করতে বলি নাই। শালা, হাত বাইর কর। দেখব কি অবস্থা।”
কায়দা কসরত করে বের করে আনলাম দুইটাই, “ট্যামা হইয়া গেছে। আর কি দেখবি?”
“আরে জোস, ফাটাফাটি!” উৎফুল্ল হয়ে বলল মাসুদ, চোখে অবশ্য বিষাদের ছায়া, “শালা তোমার তো আর ফিন লাগবে না পানিতে নামলে। এই দুটা নাড়ায়াই মাছের মত সাঁতার দিবা।”
“কুত্তা তুই।” মুখ ভেংচে দিতে দিতে আবারও কম্বলের তলে হাত নিয়ে যেতে থাকলাম।
দরজা খুলে গেছে খেয়াল করিনি। আম্মু ঢুকল একটা ট্রে নিয়ে। দুই কাপ চা আর নাস্তা তাতে। হাত গেছে তবে চায়ের নেশা আমার যায়নি। মাসুদের একটা ভ্রু উঁচু হয়ে গেছে। এতসব আম্মু অবশ্য খেয়াল করল না।
“ছেলেটার মুখের ভাষার যে কি অবস্থা!” আমার দিকে একটা তির্যক দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল আম্মু।
“সুন্দর করে দরজাটা লাগিয়ে দাও তো যাওয়ার সময়।” কাচুমাচু মুখে বললাম, “তাহলেই তো শোনা লাগে না এসব।”
দরজা লাগিয়ে দিয়েই গেল আম্মু। তবে মাসুদের ভ্রু তখনও সোজা হয়নি।
“তুই এখন চা খাস কি করে?” প্রশ্নটা করেই ফেলল সে।
কাপটা আমার সামনে নামিয়ে দিল, দেখার জন্যই হয়ত।
“ড্রয়ার খুলে দেখ, একটা স্ট্র-র প্যাকেট আছে। আমাকে একটা দে।” দাঁত বের করে বললাম, “হাত না থাকলে চা খাওয়া যায় না এটা কোন ধরণের যুক্তি হল রে? তাহলে কাকেরা চা খায় কি করে?”
“কাকেরা চা খায় না।” সোজাসুজি বলে দিল মাসুদ। হাত বাড়িয়ে আমার কাপে ডুবিয়েছে স্ট্র।
“তুই বেশি জানিস? সেইবার ফার্মগেটে …”
কথা বার্তা হঠাৎই থেমে গেল আমাদের। ফার্মগেটে এক দোকানের চায়ের আধোয়া কাপের ওপর কাক বসেছিল। চা খাচ্ছিল। তবে সেজন্য আমাদের কথা বন্ধ হয়ে যায়নি। ফার্মগেটে আমরা যেতাম একটা উদ্দেশ্যেই। অ্যাডমিশন কোচিং করতে। ওমেকা।
আচমকা বিষণ্নতার বন্যা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের ওপর। একই কথা ভাবছি দুইজনই।
“প্রতিদিন সকালে দৌড়ে গিয়ে নিউ ভিশন ধরতাম আমরা। আটটার ক্লাস ধরার জন্য।” তিক্ত একটা হাসি এখন আমার মুখে।
“হুঁ। আমার বাসা আরেকটু সামনে ছিল। সনি থেকে উঠতাম আমি।”
“হুঁ।”
পুরোনো দিনগুলোতে হারিয়ে যাইনি শুধু। সে সময় বলা কিছু কথা আমার কানে বাজছে। মাসুদেরও খুব সম্ভবতঃ।
“সেই সময় আমার হাতদুটোর যত্ন নিতাম খুব। মনে আছে তোর?” প্রসঙ্গটা তুললাম।
“তা নিতি। হাত আর মাথা …”
“হাত আর মাথা, রাইট। বলতাম এই দুইটা ঠিক থাকলেই চলবে আমার। দুনিয়ার আর কিছুর দরকার নাই। বাসের জানালা থেকে অনেক দূরে রাখতাম হাত।”
মাথা দোলাল মাসুদ, “ভুল করে হাত দিয়ে ফেলতি মাঝে মাঝে। জানালায় কনুই রাখা তো তোর পুরাতন অভ্যাস।”
“উঁহু, সাথে সাথেই ভেতরে টেনে নিতাম আবারও। পেছন থেকে কোন বাস এসে আমার হাত ভেঙ্গে দিয়ে যাবে এই ভয়ে থাকতাম সব সময়। বুয়েটের অ্যাডমিশন টেস্ট ডেট ছিল দেড় মাস পরে তো…”
“মনে আছে আমার। প্যারানয়েড ছিলি হাত নিয়ে। আমি আর তানভীর তোকে সেই লেভেলের পচানিও দিসিলাম একদিন।”
হাতের যত্ন নিয়েছি আমি সব সময়। মনে পড়ে যাচ্ছে যতবার হাতের যত্ন নিয়ে যতজনকে যত কথা বলেছিলাম সব। এক বছর আগে ঢাকাতে কলেজ বেস্ট ফ্রেন্ড সৈকতকে বলেছিলাম, হাত দুটো আস্ত থাকলেই আমাকে আর রুটি-রুজি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। পা ভাঙ্গলে সমস্যা নেই। সৃষ্টিকর্তা মনে হয় সেই কথাটাকেই ধরেছিলেন। আজকে আমার হাত বাদে আর সব কিছুই ঠিক আছে। শতভাগ ফাংশনাল।
স্ট্র দিয়ে চায়ের কাপ থেকে ‘সুড়ুৎ’ দিলাম।
প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার সুযোগ পেতে ছাড়ল না মাসুদ, “স্ট্র দিয়ে চা খেলে মুখ পুড়ে না?”
“হাতওয়ালাদের পুড়ে। হাত-ছাড়ারা শিখে নেয় মুখ না পুড়িয়ে খাওয়া।”
শুকনা হাসল মাসুদ, “পাগলামি -ছাগলামি করিস না কিন্তু। আন্টি বলল শুরুর দিকে নাকি সুইসাইডের চিন্তা-ভাবনা করতি।”
দ্যাট’স মাসুদ। ভাল লাগল যে কথাটা তোলার মত সাহস ওর আছে। পুরাতন বন্ধুদের ব্যাপারটাই আলাদা। বাকিরা ভয়ে তুলেইনি প্রসঙ্গটা। পাগলকে নৌকা ডুবাতে বলবে কে? আমি অবশ্য মাসুদের কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিলাম।
“কাম অন, ম্যান! আমি বর্ন ফাইটার। সুইসাইড করব আমি?”
চায়ের কাপে চুমুক দিল, “তাহলে শোন, এক লোক ছিল আমাদের ওদিকে। এক হাত কেটে গেছিল ট্রেনে।”
“লাকি বাস্টার্ড!” প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। হারামজাদার একটা হাত ছিল তো তাও!
“তোর অবস্থার প্রেক্ষিতে সেটা বলাই যায়।” মুচকি হাসল সে। “প্রথম প্রথম উনার মন সেই লেভেলের খারাপ থাকত। দিন রাত সুইসাইডের কথা চিন্তা করতেন। বউ-বাচ্চা আছে, তাদের মুখের দিকে তাকিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না।”
“বউ-বাচ্চা প্লাস একটা হাত।” মন্তব্য করলাম।
“প্রতিদিন বারান্দাতে বসে চিন্তা করেন তিনি। মাথাতে শুধু ঘুরে সুইসাইড। প্রক্রিয়াটাও ঠিক হয়ে গেল একদিন। ছাদ থেকে লাফ দিয়ে জীবনটা শেষ করে দেবেন তিনি। তারপরই সামনের বাড়ির ছাদে মানুষটাকে দেখলেন তিনি।”
“কোন মানুষটাকে?”
“আরেকজন পঙ্গু। ছাদে উঠেছেন। ইনার দুই হাতই কাটা।”
“ওহ শিট!” বলতেই হল আমাকে, “উনার চোখের সামনে লাফ দিলেন ওই দুই হাত কাটা ভদ্রলোক?”
“আরে ধ্যাত! দুই হাত কাটা ভদ্রলোক খুশিতে লাফাচ্ছিলেন। ছাদের খোলা অংশটাতে অনেক বাতাস। তার মাঝে লুঙি কাঁপানো নাচ দিলেন তিনি। তারপর নেমে গেলেন আবারও।”
“হোয়াট দ্য-”
“আরে শোন। পরেরদিন এক হাত কাটা আংকেল বারান্দাতে আবারও বসেছেন। বিকালে ছাদে আবারও উঠলেন দুই হাত কাটা ভদ্রলোক। কি হাসি তাঁর। আর কি আনন্দ, খুশিতে লাফাচ্ছেন রীতিমত!”
“শালা পাগল শিওর!” বললাম আমি, “দুই হাত কাটার পর হাসে যে বাইনসূদ, তার ব্যাপারে আমার আর কোন মন্তব্য নাই।”
“পাগল তিনি ছিলেন না।” থমথমে মুখে জানাল মাসুদ।
“কিভাবে শিওর হচ্ছিস?”
“কারণ, ওই আংকেল তিন দিনের মাথায় গিয়ে উনাদের ছাদে অপেক্ষা করছিলেন। দুই হাত কাটা ভদ্রলোক উঠে আসতেই তাকে ধরলেন তিনি। বললেন, ‘ভাই, আমার এক হাত ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে কেটে গেছে। তারপর থেকে আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে একেবারেই নেই। আত্মহত্যার কথা ভাবছি দিন রাত। থেরাপিস্ট দেখিয়েছি, কাজ হয়নি। আর আপনাকে দেখলাম সুখী জীবন কাটাচ্ছেন। দুই হাত না থাকার পরও আপনি খুশিতে লাফান। ট্রিকসটা কি জানানো যাবে, স্যার? নিজের জীবনে অ্যাপ্লাই করতাম। আমি বড়ই হতাশ।’ দুই হাত কাটা ভদ্রলোক তো ক্ষেপে উঠলেন রীতিমত।”
“কেন কেন?”
“উনি বললেন, ‘আরে রাখেন আপনার সুখী জীবন! বউটা মরে যাওয়ার পর থেকে পিঠ চুলকায়ে দেওয়ারও কেউ নাই। যখন খুব চুলকানি উঠে, তখন সহ্য করতে না পেরে ছাদে এসে কিছুক্ষণ লাফাই। আর আপনি বায়নোকুলারস মেরে দেখতেছেন! হোয়াট দ্য হ্যান্ড!’ ”
একটু হাসলাম, “হোয়াট দ্য হ্যান্ড। না, দুশ্চিন্তার কিছু নাই তোর। জীবন যখন যেমন। থেমে যাওয়ার ইচ্ছা নাই আমার।”
লম্বা করে আরেকটা চুমুক দিলাম কাপে। তারপর ষড়যন্ত্রকারীদের মত তাকালাম মাসুদের দিকে।
“ও কী! ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন?”
“শালা কুত্তা, তুমি দুই হাত কাটাদের নিয়া জোকস ছাড়ো?” হুঙ্কার ছাড়লাম, “এখন আসো, আমার পিঠ চুলকায়া দাও!”
দরজার ওপাশ থেকে আম্মুর শাসনের গলা শোনা গেল, “ইমন!”

৭.
রোদ ঝলমল করছে চারপাশে। এমন একটা পরিস্থিতে জীবনটাকে সত্যিই ভালবাসতে ইচ্ছে করে। শহীদ মিনারের পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমরা কয়েকজন। এষা, আমি, জাহিদ, রাহাত। জাহিদ ছেলেটা প্রথম দুইমাস নিজেকে অপরাধী মনে করত খুব। তার সাইকেলেই বেঁধেছিলাম আমি। তবে এখানে আসলে কারও কোন ভূমিকা নেই। নিয়তি! এই সহজ কথাটা বোঝাতে যথেষ্ট সময় লেগেছে আমার।
“তোর বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে গেছিলাম আমি।” রাহাত বলল, আমাদের সেকশনের সিআর সে।
“ডিএসডব্লিয়ের কাছে?” দুরুদুরু বুকে জানতে চাইলাম। এই আলোচনার কোন সুখকর সমাপ্তি নেই তা আমার জানা আছে।
“হ্যাঁ।” অন্যদিকে তাকিয়ে বলল রাহাত।
“কি বললেন তিনি?”
“তেমন কিছু না…” জাহিদ বলতে যাচ্ছিল, ওকে থামিয়ে দিলাম হাত তুলে।
রাহাত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল, “ইয়ে, বললেন যে কোন একটা ওয়ে খুঁজে বের করতে। কিভাবে তুই পরীক্ষা দিবি, বা কিভাবে তুই কোর্সগুলোর পাঠ্য অংশগুলো পারিস সেটা প্রুভ করবি এইটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার।”
“দুই হাত না থাকলে বাংলাদেশের সরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে যে অন্তত পরীক্ষা দেওয়ার উপায় নেই, তা তো জানেনই তিনি।” বিরক্ত হয়ে বললাম, “কিভাবে দেব? ভাইভা? নেভার উইল বি এনাফ। ম্যথমেটিকস আর ক্যালকুলেশন মুখে মুখে করা যায় না। আর শুধু ব্যাসিক পার্ট জানলে কোর্সে গ্রেড দেওয়ার মত বা পাশ করানোর মত এনাফ জানা হয় না। উপায় কোথায়?”
“ভাইভার ব্যাপারটা উনাকে বলেছি অলরেডি।” রাহাত বলল, “উনি বললেন এক্সেপশনাল কেস তো, ভাইভা নিয়ে তোকে একটা সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হয়েছিল। তাছাড়া তোর রেজাল্ট তো ভাল…”
“ভাই, আমার হাত নাই। রেজাল্ট ধুয়ে পানি খাওয়ার উপায় নাই এইটাও উনি ভাল করে জানেন। সোজা বাংলাতে সারমর্মটা বল।”
“উনি বললেন সব স্যারদের নিয়ে একটা মিটিং করে দেখবেন। তোকে একটা সার্টিফিকেট দেওয়া যায় কি না। তবে ভাইভা মেথডে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারটা উনারা কিভাবে দেখবেন তিনি জানেন না।”
“মিটিং না একটা হইছিলো গতকাল?” মেজাজ খারাপ হতে শুরু করল আমার, “আবার কেন?”
“ইয়ে…”
“বল আমাকে, রাহাত।”
“ওই মিটিংয়ে স্যাররা বলেছেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসির সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়ার জন্য একটা ভাইভা এনাফ না। তাছাড়া অ্যাকসিডেন্টটা ক্যাম্পাসের বাইরে ঘটেছে। তাদের রেসপনসিবিলিটি ছিল না, নেইও। তোকে উনারা কোন সার্টিফিকেট দিতে পারবেন না এই ডিসিশন নিয়েছে সেজন্য। ডিএসডব্লিউ স্যার আরেকটা মিটিং অ্যারেঞ্জ করানোর চেষ্টা করবেন বললেন আরকি।”
নাক কুঁচকালাম, “দরকার নাই। ইউনিভার্সিটি ফ্যামিলি থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছে আরকি আনঅফিসিয়ালি। সোজা হিসাব।”
মাথা নাড়ল জাহিদ, “ঠিক ওরকম না…”
“ঠিক ওরকমই।” শক্ত মুখে বললাম আমি। “আমার কোন দায়ভার এই বিশ্ববিদ্যালয় নেবে না। কারণ অ্যাকসিডেন্টটা ক্যাম্পাসের বাইরে ঘটেছে। চমৎকার যুক্তি। সার্টিফিকেট না দেওয়ার পেছনে অবশ্য ভাল যুক্তি আছে। ওই সার্টিফিকেট নিয়ে ঘরের দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে বলে মনে হয় না।”
এষা এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি, ওর দিকে তাকালাম, “দেখলি তো, কেন ক্লাস করতে আসিনি আমি এখানে? হাত নাই, আমি ব্যানিশড। আই অ্যাম নো মোর ফ্যামিলি।”
শুকনা হাসি হাসলাম। ব্যথাভরা চোখে তাকাল এষা। কিছু বলল না। আমার কনুইয়ের নিচের দিকটা ধরে চাপ দিল একবার।
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে আমার। ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার শেষ এখানেই।
তবে এর পেছনে কারো দোষ থাকলে তা আমারই। আমিই কেয়ারলেস ছিলাম। অ্যাকসিডেন্টটা আমি করেছি। বাস্তবতা মেনে নিতে শুরু করেছি এখন।
আমি পরাজিত।
হেরে গেছি, হেরে যাচ্ছি, হেরে যাব।
কিছুই করার নেই আমার।
শারীরিক অক্ষমতা কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা মানুষকে দেওয়া হয়নি।
বাস্তবতা মেনে নিতে শুরু করলাম।
হাতদুটো হারানোর আট মাস পর!

_ পরিশিষ্ট _
রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি। পাথরের মধ্যে ভেজা ভেজা ভাব। গতকাল বৃষ্টি হয়েছিল মনে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন আসার কথা আছে এদিকে। লাইনের ধার ঘেঁষে দাঁড়ালাম।
একবার ট্রেনে কাটা এক ছেলের লাশ দেখেছিলাম ইন্টারনেটে। একদম দুইভাগ করে দিয়েছিল তাকে ট্রেন। ভারতের কোথাকার ঘটনা যেন। কিছু মানুষ এসে তার মাথার দিকের অংশটা ধরে খাটিয়াতে তুলেছিল প্রথমে। তারপর আবারও গিয়ে পায়ের দিকের অংশটা তুলে এনেছিল খাটিয়াতে। দুটো টুকরো একসাথে করে পেঁচিয়ে দিয়েছিল চাদর। যাতে আলাদা হয়ে না পড়ে।
আমি কাটা পড়লে এলাকাবাসীর প্রতিক্রিয়া কি হবে?
নিশ্চয় হাতের বাকি অংশগুলো ছিটকে কই গেল তা খুঁজে বের করার জন্য পাগল হয়ে যাবে তারা? ওরা তো আর জানবে না, ইনফেকশন থেকে বাঁচানোর জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তাররা আমার হাত দুটো আগেই কেটে আলাদা করে ফেলেছেন।
ওরা তো আর জানে না, আমার হাত দুটোকে আমি নিজে গিয়ে গ্রামের বাড়িতে কবর দিয়ে এসেছি। আমি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত একা একা থাকবে আমার হাত। অন্ধকার কবরের মধ্যে হাতদুটো পড়ে আছে। হাসি ঠাট্টার মধ্যে সময় পার করি আমি, বন্ধুরাও চেষ্টা করে সব সময় আমাকে হাল্কা একটা পরিবেশে রাখার জন্য। তবে বাস্তবতা এতে করে ভুলে থাকা চলে না। প্রতিদিন ওদের জন্য কি অদম্য টানই না অনুভব করি আমি! বন্ধুদের জন্য নয়, হাত দুটোর জন্য। আমার হাতদুটো একা একা পড়ে আছে।
আমার শরীরের অংশ!
ঝক ঝক শব্দ হচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম।
ট্রেন আসছে।
“কেপি!” পেছন থেকে পরিচিত কন্ঠটা শুনে ঘুরে দাঁড়ালাম।
এষা।
মেয়েটা এখান পর্যন্ত এসে গেছে।
“কাজটা ঠিক করছিস না তুই।” গলার স্বর কঠিন নয়, তবে তুমি করেও বলছে না। কিসের সঙ্কেত বোঝার চেষ্টা করলাম।
“কোন কাজটা?” কাঁধ ঝাঁকিয়ে ব্যাগটা পিঠের মাঝে আনার চেষ্টা করলাম।
“যাচ্ছিস কোথায়?” আরও কাছে এসেছে মেয়েটা।
“ঢাকায়। যেই ফ্যামিলি আমাকে এখনও ত্যাগ করেনি তাদের কাছে।”
“সেটা আমাকে কাল রাতে ফোনেও বলেছিস। আমি জানতে চাইছি, এখানে একা একা পড়ে থাকব আমি, এটা একবারও ভাবলি না তুই? স্টেনোগ্রাফার এখানে রেখেও কাজ করতে পারতি-”
দুইপাশে মাথা নাড়লাম আমি, “পারতাম না। কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়। তোকে একটা দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি। ঠিকমত পড়াশোনা কর। আমি যেটা শেষ করতে পারিনি, সেটা শেষ কর। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে আয় রুয়েট থেকে।”
“আর তুই?” মেঘ জমেছে এষার কণ্ঠে।
“আমি সময়টাকে অন্য কোন কাজে লাগাতে যাচ্ছি।” হাসলাম একটু।
“স্টেনোগ্রাফারের সাথে ফ্লার্টিং?”
মুচকি হাসলাম ওর মুখে ঈর্ষার ছাপ দেখে, “আরে এই পোড়া দেশে ক’টা মেয়ে আর দ্রুত টাইপ করতে পারে? স্টেনোগ্রাফার কোন এক ছেলেই হবে। ফ্যাচ ফ্যাচ না করে হাসিমুখে বিদায় দাও। আবার কবে দেখা হবে কে জানে।”
আমাকে শক্ত আলিঙ্গনে আটকালো মেয়েটা। সঙ্কেতটা কিসের ছিল বুঝতে পারলাম তখন। বিদায় সঙ্কেত।
“যা চাও, তাই হবে।” ভাঙ্গা গলাতে বলল ও, “তুমি যা চাও তাই হবে।”
প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছে ঢাকাগামী আন্তনগর ট্রেন।
ভেতরে নতুন কোন শক্তির প্রবাহ অনুভব করতে শুরু করলাম।
লড়াকু সত্তাটার ঘুম ভাঙ্গতে শুরু করেছে মাত্র।
এষার কানে কানে বললাম, “আমি আবার তোমার আঙুল ধরতে চাই।”
— ০ —

আর কিছু বলবে?

‘আর কিছু বলবে?’ হাতঘড়ি দেখে জানতে চায় ইভা।
মাথা নাড়লাম আমি। মেয়েটার একটা ডায়েরী আমার কাছে ছিল। ওটা দিতে এসেছি। আর কিছু বলার থাকে কিভাবে?
ভাষা জিনিসটাকেই কেউ কেড়ে দিয়েছে আমার। কই? ইভা তো আজ আমার চোখ দেখেই সব বুঝে ফেলল না!
কয়েক বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়।

ভর্তি পরীক্ষার সময় আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল একবার। ছোট ছোট পা ফেলে প্রথম দিন হাঁটছিলাম সারাদিন। মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিলাম।
অভিমান!
বাসার ওপর অভিমান, ভর্তি পরীক্ষাতে কোথাও চান্স না পেলেই বের করে দেবে কেন? সীট কয় হাজার আর পরীক্ষার্থি কয় লক্ষ সে খেয়াল খবর তো রাখে না তারা কিছু। দোষ কি আমার, না আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার?
জীবনের ওপর অভিমান, কেন এরকম একটা অসম প্রতিযোগীতার মুখোমুখি আমাকে সে দাঁড় করাবে?
আপন বড় ভাইয়ের ওপর অভিমান, বুয়েটে প্রথম একশ’ জনের মধ্যে চান্স পেয়ে যে আমার জন্য অলিখিত একটা পথ-ব্যবস্থাতে যে পরিণত হয়েছিল আম্মুর চোখে।
কোচিং সেন্টারের ওপর অভিমান, যারা মেরিট লিস্টে তিনটি মাস ধরে আমাকে রেখে এতটা আশা দিয়েছিল!
সব ছাড়িয়ে যায় কারও কাছে শোনা একটা ছোট্ট বাক্য মনে পড়তে, ‘ভর্তি পরীক্ষা ৯৯% যোগ্যতার খেলা। আর বাকি ১% হল লাক।’
লাকের কথা দূরে থাকুক – এখন আমাকে ভাবতে হবে লাখের কথা।
প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তির ব্যাপার তো সহজ কিছু নয়। লাখ লাখ টাকা দরকার হবেই।
অবশ্য মেধার বিবেচনাতে এটা খুবই সহজ, অন্তত আমার জন্য, ঐ যে – কোচিং সেন্টারে বাংলাদেশ জুড়ে দেওয়া মেরিট লিস্ট কাঁপিয়ে এসেছিলাম। সেই তুলনাতে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা আমার জন্য কোন ব্যাপার নয়। টাকাটাই যত ঝক্কি!
রাতেও রাস্তায় থাকলাম। আমাদের এলাকাতেই ফিরে এসেছিলাম। অচেনা এলাকাতে রাস্তাতে রাতে থেকে পুলিশের ধাওয়া খাওয়ার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। এখানে অন্তত কিছু জায়গা আমি চিনি, যেখানে ঘুমিয়ে না কেবল, মরে পড়ে থাকলেও কেউ মাইন্ড করবে না।
চমৎকার একটি ঘুম হল সেরাতে।
সকালে জ্ঞান হতে দেখলাম আমার পেটের ওপর মাথা রেখে কে জানি ঘুমাচ্ছে। ছেলেটা আমার থেকে এক বছরের জুনিয়রই হবে। মুখ থেকে গাঁজার গন্ধ ভক ভক করে বের হচ্ছে। ওর মাথাটা একটা থান ইটের ওপর রেখে আবার হাঁটা ধরলাম।
প্যান্টের পায়ের গোড়ালির কাছে, ভেতরের দিকে থাকা গুপ্ত পকেট থেকে মোবাইল আর মানিব্যাগটা বের করলাম। প্রতিটি প্যান্ট আমাকে বানিয়ে নেওয়া লাগে। উচ্চতা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি আমার – সেজন্যই এই ফ্যাকরাটা বাঁধে। তবে কিছু পার্শ্ব-সুবিধেও আছে। যেমন এই পকেট। প্রতি প্যান্টেই এরকম সিক্রেট পকেট আছে। আমার নির্দেশে বানিয়ে দিয়েছে টেইলার্স। মানিব্যাগ আর মোবাইল যে এখনও গাঁজাখোরের পকেটে না গিয়ে আমার কাছেই আছে – তার কারণও ওই একটা।
মোবাইল অন করে রাখলাম। মনের ভেতরে বাসায় ফিরে যাওয়ার সুপ্ত একটা ইচ্ছে কোথাও থেকে থাকবে হয়ত।
মানিব্যাগ খুলে উল্টে ধরতেই দুটো দশ টাকার নোট বের হল। দুটো কাজ এ দিয়ে করা যায় –
১। তিনটি পরোটা আর এক বাটি ভাজি কিনে চমৎকার নাস্তা সেড়ে ফেলা যায় ধারে কাছের কোন দোকানে। দেড়দিন ধরে না খেয়ে আছি।
২। ৫+৫ করে দশ টাকার বাস ভাড়া খরচ করে ইভাদের বাসার কাছে চলে যাওয়া যায় – তারপর বাকি দশ টাকা মোবাইলে রিচার্জ করে ইভাকে একটা ফোন দেওয়া যায়। ফিরে আসতে হবে অবশ্য হেঁটে। ওতে মন খারাপের কিছু দেখলাম না। একবার ইভাকে দেখলে আমার বিশ টাকার বাসভাড়া পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার এনার্জি চলে আসে। মানে, একবার ওখান থেকে নিজের বাসাতে ফিরে এসে আবারও ওর বাসা পর্যন্ত যাওয়ার।
দ্বিতীয়টা বেছে নেওয়ারই সিদ্ধান্ত নেই।
ইভাদের বাসাতে পৌঁছাতে পারলাম না। তার আগেই মোবাইলে ফোন আসতে শুরু করল।
প্রথমটা আম্মু। দ্বিতীয় ফোন ভাইয়ার।
ধরলাম না। থাকো এখন!
নিজের ছেলেকে তো খুব বের করে দেওয়া যায়! পরে মায়াকান্না করার মানেও তো দেখি না।
তৃতীয় ফোনটা আসতেই ধরতেই হয়, ইভা।
‘ফোন অফ কেন? আবার অন করে বিজি। কোন সমস্যা হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন গলাটা শুষ্ক গলাতে বলার চেষ্টা করে।
এই ছিল আমার ইভা।
অন্য কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের মত সন্দেহবাতিক সে ছিল না। সব সময়ই ছিল বাস্তববাদী। এখন আর কেউ হলে মহা ঝগড়া বাঁধিয়ে দিত। ইভাকে সবকিছু জানালাম না। শুধু বললাম, ‘তোমার বাসার কাছে আমি। নামতে পারবে?’
অন্যবারের মতই ও বলেছিল, ‘দশ মিনিট।’
যেখানে আমি সবসময় থাকি – সেই দেওয়ালের ওপর পা দুলিয়েই বসে ছিলাম। ইভা এসে আমাকে দেখল। তারপর একনজর দেখেই বলে দিল, ‘বাসার বাইরে ছিলা, তাই না? দেড় দিন খাওনি কিছু মনে হচ্ছে। চলো, খাবে।’
কি অদ্ভুত না?
একবার দেখেই সব বুঝে ফেলত ও কিভাবে?
যখন নাস্তা করছিলাম সেদিন সকালে, ওকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আমাকে এত ভালো বোঝ কিভাবে তুমি?’
লাজুক হেসে উত্তর দিয়েছিল, ‘তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে।’

এখন ও আমার চোখের দিকে সম্ভবতঃ তাকায় না আর। তাই বোঝেও না কিছু।
ডায়েরীটা সুন্দর করে হাতব্যাগে ঢোকায় মেয়েটা। অন্যদিনের মত ওর চকচকে চোখের প্রবল মায়া আমাকে স্পর্শ করে না। কোমল ঠোঁটদুটো ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য ভেতরে কোথাও ব্যকুলতা অনুভব করি না। আজকে ও আমার ইভা নয়।
শুধু ইভা।
কোন এক ডাক্তারের সাথে জানি গভীর প্রেম চলছে ওর এখন। কাজেই অন্যের সম্পত্তি।
‘যাই তাহলে। ডায়েরীর জন্য থ্যাংকস।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় ও।
ওই ডায়েরী কোথায় যাবে আমি জানি। চুলোতে।
আমাকে নিয়ে তার নিজের হাতে লুতুপুতু সব লেখা ছিল ওতেই। এখন যেটা বিভীষিকা ওর জন্য।
আমি বসেই থাকলাম। দুই পা গিয়েও ফিরে তাকালো ইভা, চুল সরায় একহাতে। আমি মাছের মত স্থির চোখে ওই অপরূপ দৃশ্যটা একবার দেখলাম। এই মেয়েটার সিগনেচার মুভ হল ওই চুল সরানোটা।
একবার দেখলে যেকোন আঁতেল-যুবকও প্রেমে পড়ে যাবে ওর। তবে এই মুহূর্তে আঁতেল-বাতেলের ব্যাপারটাই সরে গেল আমার মাথা থেকে।
‘শুকিয়ে গেছ দেখছি।’ ধীরে ধীরে বলে মেয়েটা, ‘অবশ্য শুকানোরই কথা। তবে, চেষ্টা করবে নিজের যত্ন নেওয়ার।’
আমার কাছ থেকে কোন শব্দ আশা না করেই ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল মেয়েটা একটু একটু করে, দূরে থেকে দূরে। ওকে আর দেখতে পাবো না।
মাছের মত নিষ্প্রাণ এখন আর নেই আমার চোখ। হাল্কা একটা উপহাসের চিহ্ন সেখানে ফুটে ওঠেনি?
শুকিয়ে যাওয়ার তো কথাই আমার! তাই তো!
কি সহজেই না বলে দিল মেয়েটা! আবার বলেও গেল যত্ন করতে নিজের।
মীরাক্কেলে গেলেও পারতো।
উঠে দাঁড়িয়ে বাসার দিকে যাচ্ছি যখন, তখন একটা প্রশ্ন মনের মাঝে অযথাই খোঁচাতে থাকে।
আমার চোখে কি ওটা উপহাস ছিল? না বেদনা?

ল্যাবে আজকের মত কাজ শেষ। আমারই সবচেয়ে দেরী হল। ইন্সট্রুমেন্টগুলো জমা দিয়ে যখন বের হলাম ঠিক বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি আইরিনকে।
ঝলমলে পোশাকে ঘন কালো চুলের মেয়েটাকে এখন দেবীর মত লাগছে। একটু ইতস্তত করে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।
ইউনিভার্সিটিতে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে এই মেয়েটিই আমাকে এখনও একটু আধটু পাত্তা দেয়। ক্লাসরুমেও আমার আশেপাশে কোন ছেলেকেও খুঁজে পাওয়া এখন ভার। ল্যাবে আজ দেরী হওয়ার কারণও ওটা। আমার ল্যাবমেট হতে চায়নি কেউ। আইরিন এক সেকশনের হলেও অন্য গ্রুপে। তাই ওকে ল্যাবে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। শুধু ল্যাবে না, ক্লাসের মাঝেও হাল্কা কাশি দিলেও সবাই আমার দিকে এমন ভাবে তাকায় যেন ভীষণ মাত্রার কোন পাপ করে ফেলেছি!
পাপ অবশ্য আমি করেছি। তবে সেটা ভিন্নমাত্রার।
আইরিনের দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলাম, ‘এই যে। সামনের সপ্তাহে তোদের গ্রুপকে এটাই করাবে। দেখে রাখ ভাইভায় কি কি ধরতে পারে – লিখে দিয়েছি নিচে।’
ল্যাব নিয়ে আমার বলা কথাগুলো আইরিন খুব গুরুত্ব দিয়ে শোনে তা না।
‘আমার সাথে নদীর ধারে যাবি?’ জানতে চায় ও।
নদী আর পাবে কোথায় – লম্বা লেকটাকেই আমরা আদর করে নদী বলে ডাকি।
ওখানে কত আড্ডা দিয়েছি একসাথে আমি, আইরিন, রিতিশা, ইউসুফ, মিনহাজ আর তুরাশ মিলে!
ইউসুফ-রিতিশাকে সবাই ইউসুফ-জোলেখা বলেই খেপাতাম আমরা। মিনহাজটা ছিল গাধা প্রকৃতির। সার্কেলের ভেতরে থাকলেও ওর কথা কেউ মনোযোগ দিয়ে শুনত বলে মনে হয় না। আমার সন্দেহ হত এখানে ইউসুফকে। সার্কেলে মিনহাজকে সে-ই ঢুকিয়েছিল।
ব্যাপারটা ব্যক্তিগত হতে পারে। মিনহাজ রিতিশাকে প্রাণপণে ভালোবাসে। আমরা না, পুরো ক্যাম্পাসই জানে কথাটা। গাধা মিনহাজটা ভাবে সেটা কেউ জানে না। এদিকে রিতিশার সাথে ইউসুফের ‘আন্ডারকাভার রিলেশন’ শুরু হয় তাদের ফ্রেন্ডশীপের তিনমাস যখন। প্রায় একই সময় মিনহাজকে সার্কেলে টেনে এনেছিল ইউসুফ। আমার মনে হয়েছিল ব্যাপারটা শুধুই এক অন্ধ প্রতিশোধের।
তুরাশের ধ্যানধারণা সব ছিল গান নিয়ে। গিটার সাথে করে ঘুরত। কবে বড় শিল্পী হবে সে – এই স্বপ্নে সবসময় বিভোর। সুমন ভাইয়ের সাথে ওর এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা – ওর গিটার বাজানোর সখ আছে শুনে বেজবাবা বলেছিলেন, ‘দারুণ সখ! ক্যারি অন, কখনও ছেড়ে দেবে না।’
এতেই তুরাশের কি খুশি! আমাদের একটা করে কোল্ড ড্রিংকস খাইয়েছিল ওই আনন্দে।
আইরিনের দিকে তাকালাম, ‘যেতে পারব না রে অতদূর। শক্তি পাই না। শহীদ মিনারের সামনে বসবি একটু?’
অবসাদ যেন চেপে ধরছে আমাকে চারপাশ থেকে। শহীদ মিনারকেও অনেক দূরের পথ বলে মনে হতে থাকে!
বন্ধুদের আড্ডা দেওয়ার জন্য চমৎকার জায়গা এই শহীদ মিনারের সামনের জায়গাটুকু। আমাদের ব্যাচেরই কতজনকে দেখলাম ওখানে। তাকালাম না ভালো মত। আমি তাকালেও ওরা কুঁচকে উঠতে পারে। অনেক বিষাক্ত প্রাণি এখন আমি – অন্তত ওদের দৃষ্টিতে।
ছোট্ট শফিকুল কোথা থেকে দৌড়ে আসে এদিকে। এই ছেলে আইরিনের চেয়ে চার ইঞ্চি ছোট সাইজে। কিন্তু এই মেয়েটাকেই সে ভালোবাসে। কেন বাসে – তা কে বলবে?
আমাদের পুরো সার্কেলটাকেই ঘৃণা করত ও। কারণটা সহজ, সার্কেলটা আইরিনের, আমাদের সাথে আইরিন সবচেয়ে সহজভাবে মেশে। এর ওপর সার্কেলের প্রায় সবাই আইরিনের প্রেমে ডুবে আছে। এখন ওর আশেপাশে শুধু আমাকে দেখে সাহস পেয়েছে হয়ত। আইরিনকে হয়তো কিছু বলবে, আমি একটু দূরে সরে গেলাম।
শফিকুল আইরিনকে পার করে আমার দিকে এগিয়ে আসে, ‘কি রে – সরে যাচ্ছিস কোথায়?’
অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে, অপ্রতিভ হয়ে বলি, ‘আরে না। সরছি না। বল।’
আমার হাতে একটা চাপড় দেয় শফিকুল, ‘শরীর কেমন তোর? কিছু মেডিকেশনস না নিচ্ছিলি? ইম্প্রুভমেন্ট?’
মাথা নাড়লাম। আর তাই দেখে কালো হয়ে গেল শফিকুলের মুখটা।
খুব ভালো করে দেখলাম ওকে, অভিনয় না তো? নাহ, খাঁটি দুঃখের ছাপ ওই চেহারাতে এখন।
‘শোন, ‘ কেমন জানি বসে যাওয়া গলা নিয়ে আমাকে বলে ও, ‘তুই লিখছিস তো? নাকি ওটাও থামিয়ে দিয়েছিস?’
অভয়ের হাসি দেই আমি, ‘না, তা কেন? লিখি তো। আগের মত জোর পাই না অবশ্য। ক্লান্তি লাগে অল্পেই।’
‘এভাবে লিখি তো – বলবি না – শেষ করে আমাকে পড়তে দিস। এক কপি দিলে কোন ভয় নেই তোর। আমি আর কাওকে দেব না। ভাবিস না – বই বের হলে ওটাও কিনবো।’
হেসে ফেললাম, ‘শেষ করতে পারলে ওটাই হবে আমার ম্যাগনাম ওপাস।’
আমার মুখে হাসি দেখে শফিকুলের মুখেও হাসি ফোটে, আমার হাতে আরেকটা চাপড় দিয়ে বলে, ‘জানি। সেজন্যই পাগল হয়ে আছি ওটা পড়ার জন্য। কোনদিকে না তাকিয়ে লিখে যা, কেপি। তোর দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা অনেকেই।’
শফিকুল আজ আইরিনের দিকে একবারও না তাকিয়ে চলে গেল।
আমি আর আইরিন আবার একটা খালি জায়গার দিকে বসার জন্য এগিয়ে যাই। মনে মনে হাসছি।
আমাকে আজীবন ঘৃণা করতে থাকা শফিকুল আজ আমাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগাচ্ছে। আমার একটা লেখাও ইউনিভার্সিটির কেউ পড়ে না। অনেকটা ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’ – এর মত। তবুও বলে গেল “তোর দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা অনেকেই “ – কি হাস্যকর। আমাকে কি ও একটা শিশু ভাবে? যে কিছুই বোঝেনা?
লেখালেখিতে মনোযোগ সরিয়ে রাখতে পারলে আমার জন্য ভালো হবে এটা অনেকেই বলেছে – কিন্তু পরিণতি জেনে তো আর লেখালেখি চলে না!
আইরিন ব্যাগ থেকে দুটো চকলেটের প্যাকেট বের করে। এখনও ঠান্ডা হয়ে আছে। আমাকে একটা ধরিয়ে দেয় ও।
‘ঠাণ্ডা রাখলি কিভাবে এতক্ষণ?’ অবাক হই আমি।
কিছু না বলে মৃদু হাসে আইরিন। আমিও দুই কামড়ে একেবারে অর্ধেক করে দেই ওটাকে।
একটু পর জানতে চাইলাম, ‘ইউসুফরা সবাই কেমন আছে রে?’
‘এই তো। আছে আর কি। কেন তোর সাথে কথা হয় না?’ বিস্ময় প্রকাশের ভঙ্গী করে আইরিন।
মনে মনে হাসলাম আবারও, আমাকে আঘাত পেতে দিতে চায় না মেয়েটা। তাই না জানার ভান করছে।
মুখে বললাম, ‘ফোন দিলে তো ধরে না। ব্যস্ত মনে হয় খুব ইদানিং?’
মাথা জোড়ে জোরে দোলায় আইরিন, ‘তা ঠিক। তুরাশ তো ডাক পেয়েছে একটা ইন্টার-ডিভিশন কম্পিটিশনের জন্য। সারাদিন প্যাডে পড়ে থাকে ও। তাই পাবি না ওকে। ইউসুফ আর রিতিশা কি জানি একটা রোবটিক প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে। তাই দেখা যায় না মনে হয় – মিনহাজও ওদের সাহায্য করে।’
রোবট নিয়ে প্রজেক্ট হলে সবার আগে আমাকেই ডাকার কথা ওদের। কথাটা আইরিন ঠিকমত বানিয়েও বলতে পারেনি। ওকে কিছু বললাম না। আসল কারণ তো আমি জানি। অন্তত অনুমান করতে পারি।
তবুও সামান্য একটা কথা আমার জানা দরকার, কানের কাছে মুখ নিয়ে যাই আইরিনের, ‘আমাকে একটা নাম দে শুধু। সবার ব্যাপারে আমি বিশ্বাস করি না।’
গাঢ় দুটো চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে আইরিন নিষ্পলক। কি গভীর বেদনা সেখানে! আমার বুকটা হাহাকার করে ওঠে। বেদনাটুকু আমার জন্য – সেটা জেনেই যেন আরও বেশি হাহাকার করে ওটা!
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে আরও আস্তে করে বলি, ‘কেউ জানবে না। শুধু আমার জানাটা দরকার। জানার জন্য খুব সময় আমার নেই রে। বলে ফেল।’
‘রিতিশা – রিতিশার বিশ্বাস –’ বলার সিদ্ধান্ত নিয়েও আবার দ্বিধায় ভুগে ও, ‘ওর বিশ্বাস – কোন খারাপ মেয়ের কাছ থেকে পেয়েছিস তুই এটা।’
‘ভালো। এরা শিক্ষিত সমাজ আমাদের।’ মন্তব্য করলাম।
অন্যদিকে তাকায় আইরিন, ‘রিতিশার যুক্তি – এজন্যই ইভা ব্রেকআপ করেছে তোর সাথে।’
‘বাহ।’ নিজের বান্ধবীর বিচারবুদ্ধিতে চমৎকৃত না হয়ে আমিও পারলাম না, ‘আর বাকি তিনটা? তারা লাইন দিয়ে বিশ্বাস করে নিল সেটাই? আর করে সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলল – এরকম দুশ্চরিত্র লোককে আমাদের সার্কেলে রাখা সম্ভব না!’
হাত দুটো আটকায় আইরিন, ‘ঠিক তা না – তবে রিতিশার জন্য ইউসুফ তোর সাথে কন্ট্যাক্ট করতে পারে না। আর মিনহাজ তো – কি বলব, মেরুদণ্ড আছে নাকি ওটার? তুরাশও বাতাসের সাথে সাথে গেছে ওদিকে। তা নাহলে সার্কেল থেকে তাকে বের করে দেওয়ার কথা ভাবছিল ওরা। জানিস তো তুরাশ ছেলেটা সবার সাথে মিশতে পারে না। রাগ করিস না ওদের ওপর।’
আমার দিকে অনুনয় ভরা চোখ নিয়ে তাকায় ও। আমি একটু হাসলাম।
কি বোকা আমার এই বান্ধবীটা! আমি কি আমার একমাত্র আপনজনদের ওপর রাগ করে থাকতে পারি? তারা নাহয় ভুল বুঝলই আমাকে!
ক্যাম্পাসের মাঝে বসে আছি আমরা – আশেপাশে সিনিয়র ভাইয়া, স্যাররা আসা-যাওয়া করেন এদিক দিয়ে। শহীদ মিনারটা একেবারে সামনের দিকে।
তারমাঝেই আলতো করে আমার হাতে হাত রাখে আইরিন।

বাসাতে ফেরার তেমন তাগিদ নেই। দুইজন বন্ধুর সাথে উঠেছিলাম ছোট্ট দুইরুমের বাসাটাতে।
আব্বু-আম্মুরা তো চট্টগ্রামে চলে গেছে। ট্রান্সফার।
এখন অবশ্য গোটা ফ্ল্যাটটা আমার। রিদওয়ান আর ফরিদ – এই তো দুই সপ্তাহ হল ছেড়ে দিয়েছে তাদের রুম। ওরা ইলেক্ট্রিক্যালের তো। তাই একজন মেকানিক্যাল স্টুডেন্টের সাথে না থেকে আরও কিছু ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রদের কাছে থাকাটা তাদের পড়াশোনার জন্য সুবিধের হবে।
আমি মুচকি হেসে মেনে নিয়েছি।
সারা মাস জ্বর হয়ে থাকে এমন একজনের সাথে থাকতে চাবে কেন তারা? তাছাড়া তখন নিঃশ্বাসের সাথে অদ্ভুত একধরণের গন্ধ নাকি পায় ফরিদ। সেদিন মুখের ওপরই বলে দিল ছেলেটা।
রিদওয়ানের মেডিকেল থিওরি আছে। তার থিওরিতে ওটা হল আমার ভেতরে থাকা ভাইরাস। ভাইরাসের গন্ধ পায় ফরিদ।
আসল ঘটনা ওরা জানে না অবশ্য। জানাইনি। আমার মুখের ওপর ঘায়ের মতো কিছু দাগ, অথবা আমার নিঃশ্বাসের গন্ধ, দীর্ঘদিন ধরে প্রচণ্ড ব্যথা – যা মাঝে মাঝে তুলে ফেলে জ্বর, কিংবা খানিক হাঁটলেই হাঁপিয়ে যাওয়া, এসব ভাইরাসের কারণে নয়। কেএসের কারণে। কাপোশি’স সারকোমা। ১৮৭২ সালে হাঙ্গেরিয়ান ডারমাটোলজিস্ট মরিজ কাপোশি প্রথম এ বস্তু আবিষ্কার করেছিলেন, তাই। কিন্তু ওদের আমার এত কথা বলতে ইচ্ছে করেনি।
কাজেই যখন ‘পড়াশোনার ক্ষতি’ ঠেকাতে ওরা চলে যেতে চাইল কাছের ‘রাইয়ান টাওয়ার’-এ, মানা করিনি তো।
ওদের শুধু বলেছি, ‘ভালো থাকিস।’
এই মুহূর্তে যে বিল্ডিংটার সামনে ক্লান্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছি – এটা আমাদের ইউনিভার্সিটির শরীরচর্চার জন্যই প্রতিষ্ঠিত। বোর্ড ভাইভার দিনে এখানে ভূত এফএমের নোংরা একটা অডিও ওদের শুনিয়েছিলাম। বরিশালে বাড়ি এমন একজন বন্ধুই আমাকে দিয়েছিল রেকর্ডিংটা। বরিশাল থেকে আগত একজন মানুষ ভূত এফএমে এসেছেন – সাথে আছেন আরজে রাসেল এবং সুমন ভাই। এটা ছিল ওই রেকর্ডিংয়ের প্রতিপাদ্য বিষয়।
সিঁড়ির ওপর বসেছিলাম আমরা। নিজের খাতা থেকে ছিঁড়ে দিয়েছিলাম পৃষ্ঠা যাতে ওদের গায়ে ধুলো না লাগে। ওই তো – ওখানেই হেসেছিল তুরাশ সেদিন। ইউসুফ হাসির দমকে উঠে গেছিল ওই গাছটা পর্যন্ত। আইরিন-রিতিশা এখানে ছিল না। মেয়েদের সামনে শোনানোয় আমার সংস্কার ছিল না, আলাদা করে ওদের আমি নিজেই শুনিয়েছি অডিওটা। তবে আমার মত ‘অশ্লীল’ না সবাই। ভদ্রতা মেইনটেন করতে ছেলেদের সবাই খুবই সচেতন থাকত।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। স্মৃতিগুলোও আর থাকবে না কোন একদিন।
সম্ভবতঃ দিনটি বেশি দূরে নয়।
বাসার দরজার সামনে এসে লক্ষ্য করলাম হাত কাঁপছে তালা খুলতে গিয়ে। নিজের ওপর প্রচন্ড বিরক্তি ধরে যায় এবার।
আবারও জ্বর এসেছে বুঝতে পারছি। সবগুলো হাড় পেটানোর মতো ব্যথা ছিল সারাদিন, তার ভেতর এতদূর হাঁটা উচিত হয়নি। এদিকে আগামীকাল অ্যাসাইনমেন্ট আছে এত্তগুলো। শেষ করতে হবে সব একে একে।
দাঁতে দাঁত চেপে জীবনের প্রতি একটা হুঙ্কার ছাড়লাম মনে মনে, ‘আয় শালা – শেষবারের মত ফাইট দিয়ে যা আমার সাথে!’
ক্লিক করে দরজাটা খুলে গেল। ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দিয়ে ডেস্কটপটা অন করি। মাস্টারক্যামে একটা রাফ মডেলিং করতে হবে। পুরোটা আঁকা সম্ভব নয়। একজায়গাতে ভালোই আটকেছি। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো উচিত ছিল আমাদের। তাহলেই আর সাত ফিট রেডিয়াসের পাইপে পনের ফিট ডায়ামিটারের রিংটা ঢোকার চেষ্টা করত না। জিনিসটা হবে ইন্টারনাল। হিসেবে তো ভুল আছেই কিছু – কাল দেখা যাবে ’খন।
যেরকম উৎসাহ নিয়ে নেমেছিলাম সেই উৎসাহ ধরে রাখা গেল না। কখন চেয়ার থেকে উল্টে খাটে শুয়ে পড়েছি – নিজেও জানি না।
চারপাশে তীব্র ঠান্ডা। শীতকাল নাকি এখন? কি অদ্ভুত রকম ঠান্ডা পড়েছে আজ!
বিড় বিড় করতে করতে বলি কয়েকবার, ‘ম্যাগনাম ওপাস … ম্যাগনাম ওপাস …’

দরজায় প্রচন্ড শব্দ। কে এল এই রাতের বেলায়? কোন রকমে চোখ মেলে উঠে এলাম কাশতে কাশতে।
বাইরে দিনের আলো ফুটে আছে স্পষ্টভাবে। দেখে ধন্ধে পড়ে যাই – আসলেই কি দিন নাকি?
দরজা খুলতেই চমকে উঠলাম। আইরিন!
শুধু আইরিন নয় – তার সাথে একটা বড় আকারের ট্রাংক আছে। আর একটা লাগেজ।
এতসব নিয়ে তিনতলাতে উঠল কিভাবে এতটুকু মেয়েটা?
কিছু না বলে আবার ভেতরে ঢুকে গেলাম। কখনও কখনও কথা সমাধান হতে পারে না। তখন নীরবতা ভালো কাজে দেয়। ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে নিজের সম্পত্তি নিয়ে ঢুকে পড়ে আইরিন ওই ফাঁকে।
‘হল ছেড়ে দিয়েছি। তোর সাথে থাকব।’ চমৎকার একটা হাসি দেয় মেয়েটা।
একফোঁটা শক্তি নেই শরীরে, খাটে শুয়ে পড়লাম, ‘তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে যা তো তুই-’
বললাম না ঠিক – দাঁড়ি কমা ছাড়া উচ্চারণ করলাম শুধু।
‘রিদওয়ান আর ফরিদ যে চলে গেছে আমাকে তো জানাস নাই।’ ধমক দেয় আইরিন উল্টো।
‘থাকবে কেন? জানের মায়া তো আছে সবারই। তাই না? তুই এসেছিস কেন?’ কপাল টিপে ধরে বলি আমি।
থমকে জায়গায় দাঁড়ালো আইরিন। তারপর কটমট করে তাকালো আমার দিকে।
‘জানিস, গত দশ দিন তুই ক্যাম্পাসে নাই? জানিস এই দশদিন তোকে ফোন দিয়েছি কতবার? জানিস তুই যে মাত্র দুইবার ধরেছিস কল? আর ফোন ধরেই কি বলেছিস সেটা জানিস?’
জেগে ওঠার চেষ্টা করতে করতে তাকালাম ওর দিকে। রাগে লাল হয়ে আছে মেয়েটা।
‘কি বলেছিলাম?’ কপাল আর চোখ থেকে চুল সরাতে সরাতে জানতে চাইলাম।
‘ম্যাগনাম ওপাস। বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধু এটাই বলে গেছিস। আমার কি ভয় লাগে না? আমি তোর সাথে থাকব এখন থেকে। ভাবিস না, ভাড়ার অর্ধেক শেয়ার করব। রাজি?’
‘কেউ থাকলে লিখতে পারব না-’ ঘরের এক কোণে থাকা ডেস্কটপটার দিকে তাকালাম, টলতে টলতে উঠি আমি।
‘কই যাস? আমি তোকে জ্বালাবো না। তোর ঘরেই আসব না। তুই লেখিস ইচ্ছেমত?’
‘ম্যাগনাম ওপাস। আমার উপন্যাসটা লেখে শেষ করতে হবে।’
চেয়ারে বসে পড়েছিলাম। পেছন থেকে আমার কপালে হাত রেখেই আঁতকে ওঠে আইরিন।
‘জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আর লেখা!’ টেনে হিচড়ে আমাকে আবার বিছানাতে শুইয়ে দেয় মেয়েটা, ‘সকালে খেয়েছিস কী?’
আমাকে চুপ থাকতে দেখে বুঝে ফেলে ও, ‘খাবি কেন? খেয়ে কি উদ্ধার হবে? তোর তো ম্যাগনাম ওপাস শেষ করতে হবে। হারামজাদা, মরার আগে একজনের ম্যাগনাম ওপাস বলা যায় না কিছুকেই – জানিস না? মরার ব্যাপারে খুব নিশ্চিত হয়েছিস, না?’
তবুও চুপচাপ থাকি। আসলে, খুবই ক্লান্তি লাগছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
‘চাবি দে।’ একটু পর আমার কাছে এসে বলে আইরিন, পোশাক পাল্টালো কখন? কমলা রঙের জামাতে তো ওকে একেবারে পরীদের মত লাগে দেখছি। আগে খেয়াল করি নি তো!
আঙুল দিয়ে ইশারা করে টেবিলটা দেখিয়ে দেই আমি।
‘বাজারে গেলাম। ঘরে কিছুই তো নাই। সামান্য কিছু রান্না করার জন্য একটা পাতিলও দেখলাম না কোথাও। লঙ্গরখানা নাকি?’
ওকে বলার চেষ্টা করলাম, ‘আমরা ছেলে। আমাদের ছোট বড় পাত্র নিয়ে মাথাব্যথা তেমন নেই।’
কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। ঘুমের রাজ্যে চলে গেছি আমি।

‘তোর অবস্থা উন্নতি হচ্ছে ধীরে ধীরে।’
কি সুন্দর করেই না হাসে আইরিন – আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি।
‘সারাদিন শুয়ে বসে খেলে অবস্থার উন্নতি হবেই।’ একটু হেসে জানালাম, ‘তুই এত কেন করছিস বল তো? গাঙ্গের মরাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিস যে! শোধ করতে পারব আমি? না সে সময় আমার আছে?’
আমার ঠোঁটে আঙুল রাখে আইরিন, ‘চুপ।’
কপালে হাত রেখে আরেকটু হাসে, ‘আজ তোর সারাদিন জ্বর নাই।’
দূরের আয়নাতে চোখ পড়তে ভয়ের সাথে তাকিয়ে থাকি। ওটা আমি? ওই কঙ্কালের মত দেখতে ছেলেটা?
যে ছেলেটা রিভার্স সুইপ করে ছক্কা মারতে পারত সে এরকম শুকিয়ে গেছে কবে?
পরের প্রশ্নটা আমাকে আরও জোরে আঘাত করে, ‘আমি কত দিন আয়না দেখি না?’
পাশে বসে আছে আইরিন, আমার পাটকাঠির চেহারা পাওয়া চুলগুলোতে হাত ডুবিয়ে দেয় ও।
‘কেপি?’
আলতো করে ডাকল না? সাড়া দেই আমি, ‘হুঁ।’
‘এইচআইভি ভাইরাস তোর শরীরে কিভাবে আসল জানাবি?’
প্রশ্নটা অবাক করে না আমাকে, অবাক করে এতদিন পরে প্রশ্নটা আসাতে, ‘কোনদিনও তো আগে জানতে চাসনি।’
‘আজ চাচ্ছি।’
‘কলেজ লাইফের শেষ দিকের কথা এসব। তখনও তোর সাথে পরিচয় নেই। ভার্সিটিতে ঢুকিনি। ইভেন কোথাও চান্সই পাইনি। তীব্র মানসিক হতাশাতে ভুগছিলাম।’
‘তারপর?’
‘ক্যাটামিনের নাম শুনেছিস?’ আইরিনকে প্রশ্ন করি।
‘না।’
‘হিংস্র পশুকে বশ করে এই মেডিসিন দিয়ে। ডার্ট গানের সাথে ক্যাটামিন মিশিয়ে দেওয়া হয়। অথবা সিরিঞ্জে। রক্তের সংস্পর্শে আসলে পৃথিবী ঘোলা হয়ে আসে। পশু ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের রাজ্যে কোন কষ্ট নেই। তীব্র হতাশ আমি আত্মহত্যা করতে পারলাম না। ক্যাটামিন নিলাম নিয়মিত। ঘুমিয়ে থাকলাম। ঘোর লাগা জগতের ঘুম। স্বাভাবিক ঘুম ওটা না।’
‘সিরিঞ্জ দিয়ে নিতি ওটা?’
‘হুঁ। বিশ্বাস কর – কোন ধরণের খারাপ মেয়ের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না।’
আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে আস্তে করে আমার ঠোঁটে চুমু খায় আইরিন, ‘জানি। কথা বলিস না, রেস্ট নে। হাগ দিলে নিবি?’
মায়া ভরে তাকাই ওর দিকে, ‘দে।’
চুপচাপ আমাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে আইরিন। সে-ও ভালো। এরপর যদি এইচআইভি ভাইরাসের সাথে কাপোশি’স সারকোমার সম্পর্ক জানতে চাইতো তো এই ঘরে মেডিকেল স্কুলের ক্লাস শুরু করতে হতো আমাকে।
নিচু গলায় বললাম, ‘কেন এমন করছিস, আইরিন? আমার সাথে তো থাকতে পারবি না। তুই নিজেও জানিস। ইভাও জানতো।’
‘পারব। চুপ।’ চোখ মুছে বলে মেয়েটা।
‘পারবি না। আমি বেঁচে থাকলাম মনে কর – তবুও তো আমার-তোর বিয়ে সম্ভব না। এইচআইভি পজিটিভকে বিয়ে করার মত বোকামি করার মত গাধা তুই?’
‘আমি বিয়ে করবো তোকে।’ আমার কপালে কপাল ঠেকায় আইরিন।
‘জানিস, কোন বাবু তুই পাবি না – তাও? তোর না ছোট্ট একটা মেয়ে বাবুর কত সখ ছিল?’
শক্ত করে আমাকে ধরে রাখে আইরিন, ‘লাগবে না আমার বাবু। চুপ করে থাক তো। বেশি বলিস তুই!’
ওর কথা মত চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ। ঠাণ্ডা ঘরটা। আমার নাক ডুবে আছে আইরিনের সুন্দর চুলগুলোর মাঝে। মেয়েটার শরীর কাঁপছে টের পাই।
কাঁদছে ও। কিন্তু কেন? পৃথিবী থেকে একদিন সবাইকেই কি চলে যেতে হবে না?
ওকে স্বান্তনাসূচক কিছু বলতে গেলাম – কিন্তু কথা বের হয় না আমার মুখ থেকে।
হড় হড় করে আইরিনের শরীরেই বমি করে দিলাম। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকি সেদিকে।
টকটকে লাল রক্ত বের হয়ে এসেছে বমির সাথে!

বুকে মাথা ঠুকে কে? এই মানুষ তো শার্ট আজ ভিজাবে দেখছি।
ধীরে ধীরে চোখ মেললাম। অনেক ওপরে একটা ফ্যান।
হাসপাতাল তো!
আমার নতুন ঠিকানা এখন এটাই। রোজ এ দেখেই ঘুম ভাঙ্গে। কিন্তু বুকে এটা আবার কোন আপদ?
‘ওই ছাগল!’ মিন মিন করে বললাম। আমার গলা থেকে এখন আর বাঁজখাই শব্দ বের হয় না। ওই দিন ফুরিয়েছে অনেক আগেই।
ছাগলটা মুখ তুলে তাকিয়েছে। কেঁদে-কেটে চোখের জল-নাকের জল এক করেছে গাধাটা।
‘ছেলে মানুষের এত কাঁদলে চলে? কাঁদিস কেন?’ সরাসরি প্রশ্ন করলাম মিনহাজকে।
কান্নার বদলে ধমক দেয় এবার ছেলেটা, ‘তোর এমন দশা হইছে তুই জানিস? আয়না দেখছিস? এইটা তুই না তোর কঙ্কাল?’
‘যাহ শালা। এতটাও না। বাড়ায় বলিস।’
মুখে বললেও জানি ওর কথাগুলো কি নির্মম সত্য!
‘ইউসুফরা এসেছিল। তুই ঘুমাচ্ছিলি তখন। ইউসুফ-রিতিশার ব্রেকআপ হইয়া গেছে।’ আনন্দে ঝিকমিক করতে করতে বলে মিনহাজ।
ওর পথের কাঁটা দূর হয়েছে তাই – নাকি যে মানুষটার বিশ্বাসঘাতকতায় আমাদের সবার বন্ধুত্বে চিড় ধরেছিল সে সরে যাওয়ায় সেটা ঠিক বুঝলাম না।
‘দোয়া করি রে তোদের জন্য।’ বললাম ঠিকই – আমার কান পর্যন্তও গেল না।
মনে হচ্ছে একটা মাইক কিনতে হবে। মাইকের বিভিন্ন ব্র্যান্ড নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে থাকা উচিত আমার।
বাম হাতের তালুতে আলতো চাপ অনুভব করতে অনেক কষ্টে মাথাটা ঘুরিয়ে তাকাই আইরিনের দিকে।
চোখ দুটো গালে বসে গেছে মেয়েটার। গত কয়েক মাস আমার পিছে জীবনটা দিয়ে দিয়েছে ও। ওকে আমি কি করে কৃতজ্ঞতা জানাই এখন?
‘আংকেল আন্টি আসছেন। রাত হয়ে যাবে পৌঁছাতে। আজই দেখতে পাবি ওদের।’ ফিস ফিস করে বলে মেয়েটা।
বাসাতে এতদিন আমিই জানাতে দেইনি। গত তিনদিন অজ্ঞান হয়ে ছিলাম – এই ফাঁকে আইরিন কাজটা করে ফেলেছে মনে হচ্ছে।
ওকে আর বকলাম না আজ। আম্মু-আব্বু আসুক। আমার এই চেহারা দেখে খুব কষ্ট পাবে তো ওরা – এটাই খারাপ লাগে।
ভেবেছিলাম একটু সুস্থ হয়ে জানাবো ওদের আমার এইডসের কথা। কাপোশি’স সারকোমা লেট স্টেজের কথা। ডাক্তারের বেঁধে দেয়া চার থেকে ছয় মাসের কথা। তা আর হল কই? শরীরের অবস্থা আগের মত ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নেই এখন।
‘রাত হবে বললি না?’ মিন মিন করে জানতে চাইলাম।
‘হ্যাঁ। আর কয়েক ঘন্টা।’ আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে মেয়েটা।
গালে এক ফোঁটা গরম পানি অনুভব করলাম। কি দ্রুতই না ঠাণ্ডা হয়ে গেল পানির ফোঁটাটা!
বাম হাতে যতটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে আইরিনের হাতটা ধরলাম, ‘তাহলে ওদের সাথে দেখা হল না রে আর। দ্যাখ – ম্যাগনাম ওপাস যেই উপন্যাসটাকে বানাতে চেয়েছিলাম সেটাও শেষ করতে পারলাম না।’
অধৈর্য্য হয়ে আমাকে ঝাঁকুনি দেয় আইরিন, ‘চুপ। ভাববি না। মাথাটাকে বিশ্রাম নিতে দে। অনেক খাটিয়েছিস।’
আমি চুপ হয়ে যাই।
অনেকদিন আগে ইভা আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আর কিছু বলবে?’
ফ্যানটা ঝাপসা হয়ে আসছে চোখের সামনে ধীরে ধীরে। আজ ইভাকে আমি উত্তর দিতে পারি।
না, ইভা। আর কিছু বলব না আমি।
— ০ —

আর না দেখার দিন

দুটো ইঁদুর আমার চোখ খেয়ে ফেলছে।
ইঁদুরগুলো নোংরা দেখতে। গোঁফগুলো কত মাস যে পানির চেহারা দেখেনি কে জানে! শুকিয়ে কাঠির মত খাড়া হয়ে আছে ওদের মুখের কাছে। তবে সময়ের সাথে ওরা হচ্ছে আর্দ্র।
আমার অ্যাকুয়াস হিউমার ইঁদুরগুলোর গোঁফ ভেজাচ্ছে।
খুশিতে ডানদিকের ইঁদুরটা আমার চোখে সদ্য করা গর্তটা থেকে মুখ তুললো। ডাকলোও একবার।
চিঁ চিঁ শব্দ শুনে আরও কয়েকটা ইঁদুর চলে আসে। কামড়ে খাবে ওরা।
ওরা আমার চোখ কামড়ে খাবে।
ছটফট করছি – অন্তর থেকে চেষ্টা করছি হাত দিয়ে ওদের সরাতে।
কিন্তু হাত নড়াতে পারছি কই?
প্রচণ্ড আতংকের সাথে লক্ষ্য করলাম আমার হাত দুটো নেই। কেটে কাঁধের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে তাদের। বাতাসে খামচানোর চেষ্টা করতে থাকি আমি প্রাণপণে। আমার মস্তিষ্ক অনুভূতিটা চেনে। এই কমান্ড দিলে আমার হাত নড়ার কথা।
কিন্তু প্রোগ্রাম ঠিক থাকলেও ‘মিসিং ডিভাইসে’র জন্য শরীরে কোন কাজ হচ্ছে না।
আমি চিৎকার করতে চাই। লাফিয়ে উঠতে চাই।
কিন্তু কিছুই করতে পারি না। দর দর করে ঘামছি শুধু। বার বার নিজেকে বলে যাই, স্বপ্ন, এ নিশ্চয় স্বপ্ন!
তবুও কি বাস্তব অনুভূতিগুলো –শব্দহীন চিৎকার করতে করতে গলা ভেঙ্গে ফেললাম। কাঁদতে চাইছি – কিন্তু চোখ কোথায়?
ইঁদুরের সংখ্যা এখন দুই নয়। আরও কতগুলো এসেছে। কোথা থেকে এই পাল-টা আসল আমি জানি না।
কিন্তু এদের কারও মধ্যেই ধৈর্যের লেশমাত্র নেই – যে যার মত আমার চোখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। একজন আরেকজনকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে। আমার মুখের ওপর ওদের উদ্দাম নৃত্য শুরু হয়েছে স্পষ্ট অনুভব করতে পারি।
ওরা নখ কাটে না – আঁচরে আঁচরে মুখটা ক্ষত বিক্ষত করে দিলো। আমি অশ্রুবিহীন এক কান্না কাঁদলাম। কেউ আমাকে কি এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি দেবে না?
চিৎকার দিয়ে উঠে বসলাম। জোরে জোরে হাঁফাচ্ছি।
দুই হাত নাড়ালাম মনের মত করে। ঠিক আছে!
হাত ঠিক আছে!
মুখে হাত রেখে চমকে উঠি – শুকনো রক্ত আর খসখসে সেই ভাব ওখানে। আঁচরে মুখের চামড়া আসলেই উঠিয়ে নিয়েছিলো কেউ!
তবে সেটা আমাকে বিচলিত করে না। আরও বড় অসুবিধেটা অনুভব করতে পেরেছি একেবারে আচমকা।
ধাক্কাটা ছিলো যথেষ্ট জোরালো – আমার চিৎকার বন্ধ হয়ে যায়।
কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আমি। চোখে খুলে রেখেও কিছুই দেখতে পাচ্ছি না!
চোখের পাতা কয়েকবার জোরে জোরে নাড়ালাম – পৃথিবীটাকে আরেকবার দেখবো!
কিন্তু নেই – অসীম কালো এখন আমার চোখে।
কিছুক্ষণ পর সবকিছু মনে পড়ে যায়।
তাই তো! কিছু দেখতে পাওয়ার তো কথা না আমার!
আমি অন্ধ হয়ে গেছি।
দুই দিন হল।

১.
হাত বাড়িয়ে হাঁটছি।
ঘরগুলো আমার পরিচিত। মাঝখানের বেডরুমটা আমার।
বের হলে সরাসরি ডাইনিংয়ে পড়া যাবে। ওটা হাতের ডানদিকে রেখে সামনে এগিয়ে সামান্য বামদিকে গেলে আরেকটা বেডরুম। আর হাতের বামে রেখে এগিয়ে গেলে তিন নম্বর গেস্ট-বেডরুমটা পড়বে।
তবে কোনদিকেই গেলাম না।
ডাইনিংটা পার হলাম। এখানে একটা পাল্লাবিহীন দরজা আছে।
এটাই কিচেন। সাবধানে ঢুকি। র‍্যাক বা মীটসেফে বাড়ি খাওয়া চলবে না।
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কান পাতলাম। এখন রাত?
নাকি খুব সকাল?
আমার কাছে সব সময়ই রাত। আলো নেই তো!
কিন্তু কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বুঝতে পারলাম, এখন রাত।
পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে না। শুনশান নীরবতাতে টপ টপ করে সিংকে পড়া ফোঁটা ফোঁটা পানির শব্দ শুধু।
সিংক কোথায় সেটা বুঝতে পারছি। এটা একদিক দিয়ে ভালো। পা টিপে টিপে আবারও এগিয়ে যাই।
বিশ বাই পনের স্কয়ার ফিট একটা রান্নাঘর আমাদের। অনায়াসে ইনডোর ক্রিকেট খেলা যাবে। কাজেই দূরত্ব নিয়ে ভুল একটা ধারণা থাকা অসম্ভব কিছু নয়। অবাক হয়ে ভাবি, এই বাসাতে সবচেয়ে কম সময় আমি কাটিয়েছি এই রান্নাঘরে।
অন্য কোন ঘর হলে শব্দ না করেই চলা ফেরা করতে পারবো। আসবাবপত্রগুলো সরিয়ে ফেলা না হলে। কিন্তু রান্নাঘরের জন্য ব্যাপারটা আলাদা।
সিংক পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য বেশি কষ্ট করতে হল না। এবার বাম দিকের র‍্যাকটা কোথায়?
ছোট একটা র‍্যাক ছিল। ওয়ালের সাথে ঝুলতো। আমার স্পষ্ট মনে আছে। হাতড়ে ওটা ওখানে পাচ্ছি না কেন?
চোখ নষ্ট হয়ে গেছে ঠিকই – স্মৃতিশক্তিতে কোন রকম ধাক্কা তো লাগে নি।
নিষ্ফল হয়ে আরও কয়েকবার হাতড়ে মরলাম – কিন্তু ওটাকে তবুও পেলাম না।
কি সর্বনাশ!
ওই র‍্যাকে সবসময় তিন চারটা ছুরি থাকতোই। আমার যে খুব দরকার ছিলো একটা!
ছুরি না পেয়ে প্রচণ্ড রাগে আমার মাথার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। কে করল এই অকাজটা?
ছুরি সরালো কে ওখান থেকে?
শুধু ছুরি না – পুরো র‍্যাকটা সরিয়ে ফেলেছে। কাঁটাচামচটা পর্যন্ত পাচ্ছি না এখন।
কিচেনের পেছনের দিকে বড় একটা শোকেস আছে। ওদিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই। হাত সামনে বাড়িয়ে রেখেছি।
রিজার্ভ কাঁটাচামচ আর ছুরি এখানেই থাকে। কাঁচ সরানোর চেষ্টা করলাম। খুলতে হবে পাল্লাটা।
কিন্তু এক চুল নড়ে না পাল্লা। মুসীবত!
আঙ্গুল বাঁধিয়ে বাঁধিয়ে দেখলাম – একটা নতুন লক দেওয়া হয়েছে ওখানে। আগে তো ছিলো না!
বাসার সবাই বুঝে ফেলল নাকি?
‘ধারালো কিছুই খুঁজে পাবি না তুই এখানে।’, গমগমে কণ্ঠটা ভেসে আসে কাছ থেকেই, ‘চল, নিজের ঘরে ফিরে যাবি।’
ভাইয়া!
কাজটা তাহলে সেই করেছে? ছুরি সরিয়েছে আমার নাগাল থেকে?
প্রচণ্ড ক্রোধে ঘুষি মারলাম শোকেসের গ্লাসে। কাচ ভেঙ্গে হাত ভেতরে ঢুকে গেল। নিজের ডান হাতের জ্বলুনি টের পাচ্ছি ভালোই – সেসব এড়িয়ে আঁতিপাঁতি করে হাতড়াতে থাকি কাচের একটা বড় টুকরোর জন্য।
ধরে দ্রুত বাম হাতের শিরা কেটে ফেলতে হবে।
একটা পেয়েও গেলাম। একেবারে আমার মনের মত।
যত তাড়াতাড়ি বের করে করা সম্ভব বের করে ফেলেছি – বাম হাতে জায়গামত একটা পোঁচ মেরে দিতে পারলেই মুক্তি আর কেউ ঠেকাতে পারবে না!
খপ করে কেউ আমার হাতটা ধরে ফেলল।
জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম – পারলাম না। ভাইয়ার শরীরে আমার থেকে বেশি জোর। তাছাড়া ঠিক দেখতেও পাচ্ছি না কোথায় আছে ও।
ধ্বস্তাধস্তি না করে হাল ছেড়ে দিলাম – একাধিক জোড়া পায়ের ছুটে আসার শব্দ পাই রান্নাঘরের দিকে।
পরমুহূর্তেই আম্মুর কাঁপা গলাটা শুনতে পেলাম, ‘কি হয়েছে? ওমা! হাত কাটলো কি করে ও? ইমন!’
আমি কিছু বললাম না।
ভাইয়া চুপ করে থাকে না অবশ্য, ক্ষেপাটে গলাতে বলে, ‘ঠিক যেরকমটা বলেছিলাম – তোমার ছেলে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে জ্ঞান ঠিকমত ফিরে পেতেই।’, আমার হাত ধরে একটা ঝাঁকুনি দেয় ও, ‘শোন ইমন, আরেকবার যদি দেখি তুই এই কাজ করার চেষ্টা করেছিস – লেখার ব্যাপারে কোন হেল্প আমি করব না। বুঝতে পেরেছিস তুই?’
আমি এবারও কিছু বললাম না।
কেন জানি মনে হল, আম্মু কাঁদছে। আব্বুর গলাটা শুনতে পেলাম, ‘নাটক না করে ওর হাতে ব্যান্ডেজ তো বাঁধবে। এদিকে নিয়ে আসো।’
ওরা আমাকে ভালোবাসে – অনুভূতিটা প্রথমবারের মত বেশ তিক্ত একটা রেশ ফেলল আমার মনে।
কেন বাসে?
বুঝতে পারছে না কেন ওরা – আমি এখন বের হয়ে গেছি। এই জগতের মাঝে আমি নেই – আমার মাঝে আমি নেই!
হেরে গেছি আমি। একেবারেই হেরে গেছি!

২.
ভাইয়া আমেরিকা থেকে চলে এসেছে।
ব্যাপারটা আমি জেনে একটু অবাকই হলাম।
মাত্র তিন মাস আগেই মিনেসোটা স্টেটে পাড়ি জমিয়েছিলো ভাইয়া। পিএইচডি হল লক্ষ্য। এক বছরের আগে তো আসার কথা নয়।
আমার দুর্ঘটনার কথা শুনে দৌড়ে আসার তো কারণ দেখলাম না। এখানে ভাইয়া থাকলেই কি আর আমি দেখতে পাবো?
কথাটা ভাইয়াকে বলেও ফেলেছিলাম, হাল্কা হাসির শব্দ শুনে বুঝলাম, ঠোঁটের কোণে পরিচিত সেই হাসিটা ও ঝুলিয়ে রেখেছে। আমাকে শুধু বলল, ‘আমি না থাকলে এতক্ষণে নিজের পেটে ছুরি মেরে পড়ে থাকতি। ভাগ্যিস আমার আসতে যে সময় লেগেছে – তার মাঝে জ্ঞান ফেরেনি তোর!’
তর্ক করলাম না। আর কেউ এ বিষয়ে কিছু বলে নি। ডক্টরও না।
ভাইয়া নিজে থেকেই কিভাবে জানি বুঝে নিয়েছিলো আমার চিন্তা একটু পরিষ্কার হলেই আত্মহত্যার চেষ্টা করব আমি। ঠোঁট বাঁকিয়েই মনে হয় বলেছিল, ‘আমার এখানে আসাটা তোর সার্ভাইভালের জন্য প্রথম শর্ত – এইটা আমি নিশ্চিত।’
আমি সারাদিন বিছানাতে শুয়ে থাকি।
ছোটভাইটা আমার চারপাশে সব সময় পোষা বিড়ালের মত ঘুর ঘুর করে। একটু সাহায্যে লাগতে পারলে খুব খুশি হয়।
আমি বুঝতে পারি – প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছে ও আমার এই হাল দেখে। যতক্ষণ ও থাকে – বেদনাতুর দৃষ্টিটা আমি সব সময় অনুভব করতে পারি আমার শরীরের ওপর।
স্কুলে যখন ও চলে যায় তখনই কেন জানি স্বস্তি লাগে একটু।
নিজেকে মানুষের সাইকোলজি দিয়ে বুঝিয়েছি – ‘এটা সিমপ্যাথি স্টেজ’। এটা পার হলে ওরা আর এমন করবে না।
এই স্টেজ পার করার জন্য একটু বেশিই ব্যস্ত আমি। মানুষ সবসময় যদি মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে থাকে – কেমন লাগে?
এখন শুয়ে শুয়ে লিংকন পার্ক শুনছি। মাহীটা হয়েছে আমার ডিজে। যখন যেই গান দিতে বলছি সেটা প্লে করে দিচ্ছে।
মাঝে মাঝে আমার অগোছালো এবং সম্পূর্ণ ভর্তি এক টেরাবাইটের হার্ডডিস্কে কাঙ্ক্ষিত ফাইলটা খুঁজে পাচ্ছে না। তখন আমি তাকে বলে দিচ্ছি কিভাবে কিভাবে যেতে হবে।
আমাকে সব সময় ওয়াচে রাখার ব্যবস্থা করেছে ভাইয়া।
চিরকাল ও এখানে থাকবে না। আমেরিকাতে ফিরে যেতে হবে ওকে। ইতস্তত করছিলো ও – তবে আমিই জোর করছি। ভাইটার স্বপ্নপূরণের মাত্র একটা ধাপ বাকি। নিজের জন্য ওটা আটকে দেবো নাকি?
কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে সম্পুর্ণ নিরাপদ দেখে যেতে চায় ও। আর অবশ্যই চোখের ব্যাপারে আরও আশাব্যঞ্জক কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে ও পাগলের মত।
কিন্তু আমার কেসটা হতাশাজনক।
এই চোখ দুটো আর ভালো হওয়ার নয়।
ডক্টর বলেছে, মাথার ভেতরে যে ইনফেকশন হয়নি এটা একটা বিস্ময়। আরও বড় বিস্ময় আমার বেঁচে থাকাটা। একে তো এই পর্যায়ের এক ব্লান্ট ট্রমা তার ওপর পেনিট্রেটিং ইনজুরি। বেড়ালের জান কি না কে জানে – তবে আমার জন্য অন্তত এই বেঁচে থাকাটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। যেটা আমি পারছি না।
মানুষ তো – আশা আকাঙ্ক্ষা একটু বেশিই।
ভাইয়ার কাশি শুনলাম।
নিজের উপস্থিতি বোঝাতে ইদানিং নতুন ঢং শুরু করেছে। কাশে।
বিরক্তমুখে জানিয়ে দেই, ‘যক্ষ্মা রোগীর মত কাশবি না। দরকার হলে গলা ফাটিয়ে বলবি, এসেছিস।’
ভাইয়া আমার কথার জবাব না দিয়ে জানতে চাইলো, ‘কেমন বোধ করছিস?’
হেসে ফেললাম। অদ্ভুত রকমের এই বাক্যটা মানুষ কথা বলার সময় সাধারণতঃ ব্যবহার করে না।
কিন্তু ভাইয়া করে।
আমাকে অসুস্থ দেখলে আগেও জানতে চেয়েছে কতবার – ‘কেমন বোধ করছিস?’
সে জ্বর, সর্দি, কাশি বা বাসের দুলুনিতে হাল্কা অসুস্থ বোধ করাই হোক।
আমি বললাম, ‘আগের চেয়ে ভালো। গানটা বন্ধ কর তো।’
আর কিছু না বলে ভাইয়া গান পজ করে দেয়। স্পেস বাটন চাপার শব্দটা খাট থেকে স্পষ্ট পেলাম।
তারপর কোমল গলাতে বলে, ‘এখন তোর টাইপিস্ট হতে আমার কোন আপত্তি নেই।’
আমি উত্তেজনাতে লাফিয়ে উঠি একেবারে। বসে পড়ে হাতড়ে হাতড়ে একটা বালিশ নিয়ে এসে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসলাম।
‘মাইক্রোসফট ওয়ার্ড বের কর।’
ভাইয়া তিন সেকেন্ড পরই জানালো, ‘করেছি।’
‘তুই রেডি?’, অস্বস্তিতে জানতে চাই আমি।
ভাইয়া জানালো, ‘হুঁ।’
আটকে গেলাম হঠাৎ!
আজ আমার মাথাতে গল্পের কোন প্লট নেই! আছে আছে – মনে হচ্ছে। কিন্তু ধরা দিচ্ছে না তারা।
দুই হাতে মাথা খামচে ধরি আমি অল্প সময়ের মাঝেই। অক্ষমতাটা কোথায় বুঝতে পারছি!
গল্প আমি তাৎক্ষণিকভাবে টাইপ করে লিখতে পারি। কিন্তু বলতে তো পারি না। অভাবে আমার লেখালেখির অভ্যাস তো আর গড়ে ওঠেনি।
এষার রাত তিনটার সময় করা আবদারগুলোর কথা মনে পড়ে গেল।
পরিবারের পর যদি কেউ আপন হয়ে থাকে – তবে সেটা এই মেয়ে। রোজ রাতে ওর সাথে কথা হত আমার। ভোরের কাছাকাছি সময়ে মেয়েটার উঠতো গল্প শোনার সখ। আমাকে বলত, ‘অ্যাই, আমায় একটা গল্প শোনা।’
প্রতিবারই আমি উৎসাহের সাথে শুরু করতাম। কিন্তু তারপর দেখতাম প্লটগুলো আমি কী-বোর্ডের সামনে এসে বসলে যেভাবে ডালপালা মেলে দেয় – এখান তা হচ্ছে না।
আমি গল্প লিখতে পারি – বলতে পারি না!
জানি আমার চোখের দৃষ্টি যথেষ্ট শূন্য এখন – তার পরও মস্তিষ্ক জানালো এই মুহূর্তে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমি। অঙ্গটা নেই দেখে সেটা হয়তো তেমন দেখাচ্ছে না!
ভাইয়ার গলাটা শুনতে পেলাম, ‘থাক, নিজেকে ফোর্স করিস না। আরেকদিন হবে।’
আমি বিড় বিড় করে শুধু বললাম, ‘আমি আর কোনদিনও লিখতে পারবো না!’

৩.
নতুন একটা সানগ্লাস কিনে দিয়েছে আব্বু আমাকে।
ওটা পড়ে থাকি না বাসাতে। দরজা লাগিয়ে বসে থাকি। প্রায় সারাদিনই।
বুকপকেটে রাখি সানগ্লাস। যখন দরকার হবে যাতে পাওয়া যায়।
সানগ্লাস কিনে দেওয়ার পরই হাল্কা পাতলা বুঝতে পেরেছি চেহারাটা আমার কেমন হয়েছে। ভয়ানক নিশ্চয়। চোখের জায়গায় অমন ক্ষত কে সহ্য করতে পারে! এরপরে তো আর ওদের সামনে বের হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
বাইরে একবার বের হয়েছিলাম হাসপাতাল থেকে বের হয়ে। মাত্র একবার।
বাসার সামনের মাঠটাতে আমার ছোটভাই আমাকে হাঁটতে নিয়ে গেছিল। সমস্যা হল, চোখ নষ্ট হওয়ার পর থেকে আমার কান আগের তুলনায় বেশি কাজ করছে। বলা চলে কান আর নাকের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছি আমি। পঞ্চইন্দ্রীয় আস্তে করে হয়ে গেছে ‘চৌঠা-ইন্দ্রীয়’। দিন দিন সাপ হচ্ছি। শব্দ শুনেই যা বোঝার বুঝতে হয়।
মাঠে হাঁটতে নেমে সেরকম একটা শব্দই শুনলাম।
একটা কণ্ঠ, মেয়ে কণ্ঠ। গলার শব্দ শুনে মেয়েদের বয়স বোঝা কঠিন। তবে অনুমান করলাম চৌদ্দ হবে। তাছাড়া এটা একটা হাউজিং ব্যবস্থা। এখানে যারা থাকে সবাই স্কুল অথবা কলেজের ছাত্র। ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়ে যারা আছে তাদের বেশিরভাগই থাকে নিজ নিজ ইউনিভার্সিটির কাছে। কাজেই মেয়েটার বয়েস চৌদ্দ হতেই পারে।
ও বলেছিল, ‘দ্যাখ, এত ভয়ঙ্কর দেখতেও হয় মানুষ!’
কাকে বলেছিলো আমি জানি না। জানতে চাই নি।
সোজা বাসায় চলে এসেছি।
ইদানিং আরেকটা অনুভূতি খুব ভোগাচ্ছে। অন্ধ হওয়ার পর থেকে দেখলাম পৃথিবীতে আর কোন কাজ নেই আমার – যেটা আমি পারি! আগে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হত। দিনে দু-তিন ঘণ্টা ঘুমাতে পারলে খুশি হয়ে যেতাম।
কারণ, ওটুকুই জুটতো না কোন কোন দিন।
আর এখন বলতে গেলে সারাদিন ঘুমাই। মানে, জেগে থাকা আর ঘুমানোর মাঝে তেমন পার্থক্য তো দেখি না।
অবসর কাটানোর প্রিয় উপায় যে ছেলের বই পড়া – তার চোখ নষ্ট হয়ে গেলে আর কিভাবে সময় কাটাতে পারে সে?
ভাইয়া আমাকে বই পড়িয়ে শোনাবার চেষ্টা করেছিল। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছিল। প্রতি পনেরো সেকেন্ডে একটা পৃষ্ঠা পড়ি আমি, সেখানে ধীরে ধীরে দুই মিনিট ধরে ওইটুকু পড়ে শোনাবে আমাকে ভাইয়া?
মজা কোথায় তাহলে বইয়ের? মেশিনগানের মত মাথার মাঝে শব্দগুলো যখন নাই খেলল?
ঝোঁকের মাথাতে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম। ভাইয়াকে একবার ডাক দিতেই বাসার অন্যপাশ থেকে সাড়া দিলো।
তারপর কয়েক সেকেন্ডের মাঝে আমার ঘরে এসে জানতে চায়, ‘বলে ফেল।’
বললাম, ‘মোবাইলটা অন কর।’
অ্যাকসিডেন্টের পর থেকে মোবাইল অন করি নি। শত মানুষের সিমপ্যাথির শোনার কোন ইচ্ছে আমার ছিলো না।
আজকে মনে হচ্ছে, একটা অন্তত ফোনকল কেউ পায় আমার কাছ থেকে।
ভাইয়া জানালো, মোবাইল অন হয়েছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
‘টু স্কয়ার ইজ ইকুয়াল টু থ্রি স্কয়ার নামে একটা নাম্বার আছে। বের কর।’
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে ভাইয়া, ‘কি?’
আরও থেমে থেমে উচ্চারণ করি আমি, ‘থ্রি লেখে সার্চ দিলেই পাবি।’
দ্রুত বলে ও, ‘পেয়েছি।’
হাত বাড়িয়ে দিলাম, ‘কল কর। তারপর আমাকে মোবাইল দিয়ে বেড়িয়ে যা এই ঘর থেকে।’
হাতের ওপর মোবাইলটা ফেলে শুকনো হেসে ভাইয়া চলে যায়।
টাচ স্ক্রিন ফোনের প্রথম সমস্যা টের পাই আমিও। চোখ না থাকলে ব্যবহার প্রায় অসম্ভব। ভয়েস কমান্ড আমার ফোনে নেই। বাটন হলে মুখস্থ চেপে ফোন চালাতে পারতাম। কানে ফোনটা ঠেকাতে শুনতে পাই – ওপাশে রিং হচ্ছে।
দম বন্ধ করে আমি অপেক্ষা করতে থাকি মিষ্টি একটা গলা শুনতে।
একদম শিশুদের মত কণ্ঠটা শোনার অপেক্ষাতে আমার বুকের ভেতরটা ধ্বক ধ্বক করতে থাকে!

৪.
‘কেমন আছিস?’, প্রশ্নটা করে ফেললাম আগুপিছু না ভেবেই।
এষার গলাটা শুনতে পেলাম না ওপাশে। একেবারে চুপ চাপ।
ফোন ধরার আগেই কেটে যায় নি তো? কেটে গেলে তো একটা ব্লিপ দিতো। নাকি দিয়ে ফেলেছে, আমি শুনতে পাই নি?
দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে আরেকবার বললাম, ‘হ্যালো?’
ওপাশে হাল্কা নাক টানার শব্দ শুনলাম মনে হয়, এষার কাঁপা কণ্ঠটা শুনতে পাই তারপরই, ‘বল। শুনছি।’
বিব্রত বোধ করি হঠাৎই, ‘কাঁদছিস কেন?’
‘খুব পর হয়ে গেছি আমি? খুব বেশি পর?’
মেয়েটা আচমকা ঝাঁঝিয়ে ওঠে। আমি এবার চুপ হয়ে যাই।
‘সেদিনের পর আজ কত দিন পার হয়েছে জানিস?’
আমতা আমতা করি এবার, ‘ইয়ে, দিনতারিখের হিসেব তেমন রাখি না। ক্যালেন্ডার দেখি না তো।’
‘তেইশ দিন! তেইশটা দিন পার হয়েছে – তোর নাম্বারে কত বার ফোন করেছি আমি সেটা কি একবারও বুঝতে পেরেছিস? কম করে হলেও দশ হাজার বার ফোন করেছি আমি তোকে!’
‘তেইশ দিন, না?’, উদাস হয়ে যাই আমি, ‘তাহলে আজ অক্টোবরের তের? পরশু রুয়েট খুলে যাবে।’
এষা কিছু না বলে আরেকবার নাক টানলো।
‘আমার ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার এখানেই শেষ!’ কথাটা মনে মনেই বললাম। মুখে বলে এষাকে আর কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। এমনিতেই খুব রেগে আছে। মোবাইল একেবারে বন্ধ করে রাখার আগে আমার ওর সাথে কথা বলে উচিত ছিলো – সেটাই তার ধারণা।
তখন তো ছিলাম সুইসাইড স্কোয়াডে। ফোন-টোনের চিন্তা মাথায়ই ছিলো না। এ কথা তো আর এষাকে বলা চলে না।
‘কেন ফোন দিয়েছিস এখন, হুঁ?’, বলে এষা, ‘এখন তো আর আমাকে চিনিস না। ডায়লগ ছাড়? কই, ছাড়বি না?’
‘কোন ডায়লগ?’, অবাক হলাম।
‘বল – তোর মত অন্ধ একটা ছেলের সাথে আমার থাকা উচিত হবে না। আমার জন্য আরও ভালো ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। আমার উচিত তোকে ভুলে যাওয়া – বল এসব?’
মেয়েটা একেবারে গ্রেনেড হয়ে আছে, প্রমাদ গুনি আমি, ‘যুক্তি তো তাই বলে। আমি তো বলিনি আমার সাথে থাকতে তোকে। এই পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব না – সেটা আমি জানি। তাছাড়া আমি নিজেই তোকে আর আমার জীবনে দেখতে চাই না।’
‘তা চাবি কেন? আমি তো এখন পর।’ হাল্কা ধরে যায় এষার গলাটা।
‘তা না। কিন্তু বন্ধুত্বের বেশি কিছু আর থাকা উচিত না এখন। অথর্বের ঘাড়ে ঝোলাতে তোর আপত্তি না থাকতে পারে – তোর ওরকম একটা ভবিষ্যৎ দেখতে আমার আপত্তি আছে।’
ওপাশে এষার দীর্ঘশ্বাসটা শুনতে পেলাম স্পষ্ট, ‘শুরু হয়ে গেলো। সেজন্যই তো বলেছিলাম, ডায়লগ দে! আরও বেশি করে দে!’
‘এর পরে চোখ নষ্ট হলে সবার আগে তোকে ফোন দেব। প্রমিজ।’ রাগ করে বললাম।
এষা নিজেকে সামলে নেয়। বুঝতে পারছে এখন ঠিক ঝাড়ি খাওয়ার মুডে আমি নেই।
‘আমি চট্টগ্রামে আসবো। তোর ঠিকানা দে।’
আমি মাথা নাড়লাম, ‘আম্মু বাসাতে আমার নারীসঙ্গ অ্যালাউ করবে না।’
‘আমাকে দূরে রাখার চেষ্টা করবি না, খবরদার! হোটেলে উঠবো আমি, ঠিক আছে? ঠিকানা দে!’
পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘তুই কি ঢাকায়? নাকি রাজশাহী চলে গেছিস?’
এষার গলার পর্দা আরেকটু উঠল, ‘তা জেনে তোমার দরকার কি?’
খুব রেগে গেলে অথবা আমার জন্য খুব মায়া হলে ও আমাকে ‘তুমি’ করে বলে। এখন মায়ার কিছু দেখলাম না। তারমানে রেগে আছে।
আস্তে করে বললাম, ‘ঠিকানা ল্যাখ। আমাকে জানাইস কয়টায় বাস। ভাইয়াকে পাঠিয়ে দেব তোকে নিয়ে আসতে। আমিই যেতাম – কিন্তু -’
এষার গলা নরম হয়ে আসে, ‘তোমাকে আসতে হবে না। ভালো ছেলের মত শুয়ে থাকো। আসছি আমি।’
আমি কিছু বলতে চাইছিলাম, এষাই বাঁধা দেয়, ‘এখন আটটা বাজে। তুই ফোন রাখ তো। দেখি আজ রাতের বাস পাওয়া যায় কি না।’
‘এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন?’, তাড়াতাড়ি বললাম, ‘ধীরে সুস্থে আয় তো।’
‘ফোন রাখ তুই। বাসে উঠে আমি জানাবো। আর যদি আবার ফোন বন্ধ পেয়েছি – খুন করে ফেলবো একেবারে!’
‘খুন করার সখ থাকলে চাকু-টাকু নিয়ে আসিস। এ বাসাতে কিছুই পাবি না।’
গর গর করে উঠল ও, ‘তোকে খুন করতে আমার চাকু লাগে না। ফোন রাখ হারামি।’
আমি বাধ্য ‘হারামি’র মত ফোন রাখলাম। মেয়েটা এরকমই, খুবই শান্ত।
আবার খুবই হিংস্র।
হিংস্র ভাবটা কৃত্রিম। কাছের মানুষগুলোর সাথেই এই রূপটা দেখায় ও। আর এজন্যই আমার ওকে এত ভালো লাগে।
মিষ্টি মিষ্টি গলাতে কিছু স্বান্তনার বাণী শোনানোর মত মানুষ ও না। একসাথে থেকে সমস্যা সমাধানে আগ্রহী।
এত বড় ঝামেলাতে পড়ে গেলাম, অথচ সে গুণটাই বের হয়ে আসছে তার মাঝ থেকে।
ভাইয়ার হাসি হাসি গলাটা শুনতে পেলাম, ‘মেয়েটার নাম কি?’
খারাপ লোক!
সব কথা শুনে নিয়েছে!
কেন জানি আজ একটুও রাগ করতে পারলাম না ওর ওপর। হেসে ফেললাম।
বললাম, ‘এষা।’

৫.
ঘরে আমি আর এষা।
আর কেউ নেই।
আমি সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারতাম না। এষা নিশ্চিত করেছে। জানি মন খারাপ করে এখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কাল রাতে ছোটভাই মাহীকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আমাকে দেখতে কুকুরের মত লাগছে এখন। তাই না?’
ও অপরাধী অপরাধী একটা কণ্ঠে বলেছিল, ‘আরে নাহ। একদম আগের মত লাগছে তোমাকে। শুধু চোখে সানগ্লাস।’
আমি জানি, কথাটা মিথ্যা। নিজের গালে হাত দিয়েই বুঝতে পেরেছি – রোজ কয়েকবার রোলার চালালেও ওই চেহারা আর মসৃণ হবে না আমার। কিন্তু কিছু বলি নি।
মিথ্যা সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় তো ওর ছিলো না।
ও তো আর বলতে পারে না, ‘তোমাকে স্রেফ যোম্বিদের মত লাগছে ভাইয়া! পার্থক্য হল যোম্বিদের একটা চোখ ফাটা থাকে – আর তোমার দুই চোখই ফাটা!’
‘সানগ্লাস খোল তো। আমার সামনে ঢং করতে হবে না।’, ক্যাটক্যাট করে ওঠে মেয়েটা, ‘তুই যেভাবে আছিস তোকে সেভাবে দেখতে চাই আমি।’
‘কিন্তু-’, কিছু বলার আগেই চট করে সরিয়ে নিলো ও সানগ্লাসটা। বাতাসে খামচি দিয়েও আটকাতে পারলাম না।
‘চোখ অপারেশন করে পাল্টে দেওয়া যায় না রে?’ দুঃখী গলাতে জানতে চায় এষা। এর মাঝে বাসার সবার সাথে পরিচয়পর্ব ওর শেষ হয়েছে। বাসা থেকে একরকম যুদ্ধ করেই একা এসেছে ও। ওর আম্মু আসতে চেয়েছিলো সাথে, নেয়নি।
আমি মাথা নাড়ি, ‘টিস্যু ফেঁড়ে ফুঁড়ে গেছে। কার সাথে কানেক্ট করবে নতুন চোখ?’
‘উন্নত মানের অনেক চিকিৎসা-’
‘টিস্যু বানাতে হবে আমার জন্য নতুন করে। তাও আমার কনফিগারেশনে। তারপরে সেখানে আবার চোখ লাগাতে হবে। আমেরিকাতে মিলিটারিদের কাছে এ প্রযুক্তি আছে হয়ত। আমার জন্য না সেটা।’
এষা বুঝতে পারে। এবার প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে তাড়াতাড়ি।
‘তোর টাইমলাইন ভেঙ্গে ফেলছে পাবলিক। ভাইয়াকে দিয়ে শেষ স্ট্যাটাস দিয়েছিলি – এর পর তো আর কিছু জানাস নি। সবাই অস্থির হয়ে আছে তোর খবর জানার জন্য।’
ভাইয়াকে দিয়ে নিজের টাইমলাইনে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম বর্তমান অবস্থার কথা বলে। সেই কবেকার কথা!
এষাকে ইঙ্গিতে কম্পিউটারটা দেখালাম। নিজের ঘরের সবকিছু কোথায় আছে তা জানা আছে আমার। চোখ না থাকলেও স্পর্শ করতে সমস্যা হয় না।
‘তুই আমার আইডিতে ঢোক। পাসওয়ার্ড মনে আছে?’, আগে ওকে পাসওয়ার্ড একবার দিয়েছিলাম। কাজেই জানতে চাই।
‘আছে। ঢুকছি।’, ঘাড় কাত করেছে ও নিশ্চয়? দেখতেই পাচ্ছি না ছাই কিছু!
কতদিন এষার মিষ্টি মুখটা দেখি না? ভাইয়ার মুখ? ছোটভাই বা আম্মু-আব্বুর মুখ?
কত কাছে ওরা! অথচ কত দূরে!
‘মনে আছে – একদিন তোকে বলেছিলাম, তোর প্রতি মেন্টালি তো বটেই – ফিজিকালি অ্যাট্রাক্টেড আমি?’
নিশ্চয় লাল হয়ে গেছে মেয়েটা, গোঁ গোঁ করে বলল, ‘স্বভাব তোর এখনও ঠিক হল না!’
‘তুই জানতে চেয়েছিলি আমি তোর দিকে তাকিয়ে থাকি কি না।’ আমি ওর কথা না শোনার ভান করে বলে যাই, ‘আমি বলেছিলাম, মাঝে মাঝে তাকাই। তুই বলেছিলি, “চোখ উপরে ফেলবো তোর ”।’
‘আমি সত্যি মীন করে বলি নি রে।’ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে ও।
‘আমি তোকে দোষ দেই নি, পাগলি। শুধু বলছি, দেখ – ব্যাপারটা আয়রনিক। তাই না?’
এষা আমার কথার জবাব দিলো না। বলল, ‘ঢুকেছি। কি স্ট্যাটাস দিবো?’
‘লেখ-’, ওকে বলি, ‘চোখ হারিয়েছি। লেখালেখি আমার এখানেই শেষ। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। যাঁরা পাশে ছিলেন আর যাঁরা ছুরি মেরেছিলেন – সবাইকেই। জীবনের প্রাপ্তিগুলোর মাঝে আপনাদের ভালোবাসা আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটা প্রাপ্তি । দুঃখিত, ইরফান সিরিজ শেষ করে যেতে পারলাম না। আর “মিথস্ক্রিয়া” উপন্যাসটা ছেড়ে দিলাম প্রকাশকের ইচ্ছের ওপর। ১৭২ টা গল্প রেখে গেলাম, তাই আইডি ডিঅ্যাক্টিভ করবো না। লেরকের কাজ শেষ করে যেতে পারলাম না। এজন্য আমি দুঃখিত। আমি সত্যিই দুঃখিত।’
কিছুক্ষণ পর জানতে চায় ও, ‘আর কিছু?’
‘নাহ। পোস্ট করে দে।’ ভাবলাম, এখন লম্বা সাহিত্য লেখার সময় না। আর কি বলার থাকে একজন অন্ধ লেখকের?
একটু পর বিছানা শব্দ করে ওঠে। বুঝলাম, খাটে উঠে বসেছে ও। তারপর আমার হাত টেনে নেয় নিজের কাছে।
‘আবার লিখতে পারবি – দেখিস। একটা কাজ কর। কী বোর্ডে এসে বস। এতদিন ধরে লেখছিস – না দেখে টাইপ করতে পারবি না?’
অবসন্নের মত মাথা নাড়লাম, ‘জানি না রে। না দেখে টাইপ করা সমস্যা নয়, তবে একবার কার্সর অন্য কোথাও চলে গেলে এরপরের এক-দুই ঘণ্টা যা লিখবো সবই উল্টোপাল্টা জায়গায় টাইপ হবে।’
আমি নড়ছি না দেখে ও আবার বলে, ‘আমাকে নিয়ে আরেকটা গল্প ল্যাখ। আমি একা – সিরিজের আরেকটা গল্প?’
‘আমি একা – ০৯!’, ফিস ফিস করে বললাম।
আমার ক্ষত বিক্ষত গাল ছুঁয়ে দেয় মেয়েটা, ‘চাইলে আমি দোকা – ০২ ও লেখতে পারিস। আমার কোন আপত্তি নাই।’
হাতড়ে হাতড়ে উঠে পড়লাম। চেয়ারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি – অনুভব করি এষা আমাকে ধরে পথ দেখাচ্ছে। চেয়ারে বসার পর হাতড়ে কী-বোর্ডটার অবস্থান বের করলাম।
পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এষা, ফিস ফিস করে বলে, ‘কীবোর্ড তোর শরীরের একটা অংশ। এমনই না বলেছিলি আমাকে? ফীল কর ওটাকে। ওটা তোর শরীরের একটা অংশ।’
অনুভব করি আমি প্রতিটা কী-কে। আলতো করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেই সবগুলোকে। ওই ছোট ছোট চারকোণা কী-গুলো আমার কত আপন!
আমি ভালোবাসি ওদের। ছোঁয়ার সাথে সাথে আঙুল চালানোর জন্য আমার হাত নিশপিশ করতে থাকে।
এষাকে বললাম, ‘মাইক্রোসফট ওয়ার্ড খুলে দে।’
আমিও চেষ্টা করতে পারতাম, তবে কী হবে যদি কোন এক পপ-আপ খুলে থাকে আর আমি মনে করি ওটা বোধহয় এডিটরে চলে এসেছে? পণ্ডশ্রম হবে এরপর যা লিখবো সব-ই।
আমার কাঁধের ওপর দিয়ে মাউসটা ধরল ও, একবার ক্লিকের শব্দ শুনলাম। টাস্কবারের সাথে লাগানো আছে ওটা। চার সেকেন্ড পর এষা বলল, ‘রেডি। ট্রাই কর।’
আলতো করে হাত নাড়াই আমি। F12 তে একবার চাপ দিতেই ‘বাংলা’ হয়ে গেল অভ্র। নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছি। ঘাড়ের কাছে এষার নিশ্বাস এখন রীতিমত বিরক্তিকর লাগছে। ওকে একটু রুক্ষ গলাতেই বললাম, ‘যা, আম্মু আব্বুর সাথে গল্প কর। কেউ থাকলে লিখতে পারি না।’
‘যাই। তুমি চেষ্টা কর।’ বলেই গালে টুক করে একটা চুমু খায় ও।
আমি ঠাণ্ডা হয়ে বসে থাকি – কেউ দেখে ফেললে কি হবে!
ঘাড়ের পেছন থেকে মেয়েটা দূর হতেই মনে মনে কী-বোর্ডকে একবার বললাম, ‘জান, বিট্রে কইরো না আমাকে এই সময়। প্লিজ।’
আমার পৃথিবী এখনও অন্ধকার। কালো– নিকশ কালো আমার সামনে। ডেস্কটপের মনিটরের উজ্জ্বল প্যানেল দেখতে পাচ্ছি না। দেখতে পাচ্ছি না আলোর ছোট কোন বিন্দু।
আলোকিত ঘরে চোখ বুজলে তো তাও একটা আভা দেখা যায়। আমি তাও দেখি না আজ কতদিন!
শিউরে উঠলাম বাকি জীবন এভাবে থাকতে হবে ভেবেই। কুয়োর অন্ধকার চারপাশে – কেন এমন হল আমার সাথেই?
আজকে আমি ‘আমি একা -০৯’ লেখব। পার্থক্য এটুকুই হবে – এটা বিভ্রক থাকছে না।
এষাকে মনে পড়তে আমার রক্তগুলো আলোড়িত হয়। মেয়েটা না থাকলে ওই ১৭২ গল্প আমাকে লেখতে হত না। তুচ্ছ ব্যাপারে ঝগড়া করে আমরা আলাদা হয়ে না গেলেও পারতাম চার সপ্তাহ আগে!
একসাথে বাসে করে ঢাকা আসার কথা ছিলো আমাদের। তারপর সেখান থেকে আমি চলে যেতাম চট্টগ্রাম।
হল কোথায়? ঝগড়া করে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ওর সাথে যাবো না। মেয়েটা কত করে বলেছিলো আমাকে – টিকেট কেটে ফেলেছিলো দু’জনের।
তবুও আমি যাই নি।
খুব বড় গলায় ওকে শুনিয়ে দিয়েছিলাম, ‘কেপিকে লোকজন এমনি এমনি সাইকো ডাকে না। দেখতে চাও তুমি, কেন বলে? তোমার সাথে আর জীবনে যাচ্ছি না আমি কোথাও। আর ফোন-টোনও দিও না প্লিজ। একবার যা বলি, আমি তা করি।’
তারপর নিজের জন্য আলাদা করে চট্টগ্রামের জন্য বাসের টিকেট কেটে নেই আমি। সেদিন রাতে এই শক্ত মেয়েটা কেঁদেছিল। আমি পাত্তাই দেই নি। আরেকটা গল্প লেখার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলাম।
ফালতু আবেগে কাজ কি?
ঠিকমত ঢাকাতে পৌঁছায় এষা। কিন্তু আমার বাসটা কুমিল্লা পার হয়েই অ্যাকসিডেন্ট করল।
আমার শুধু মনে আছে জানালার ঠিক পাশে বসেছিলাম। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। এটা স্বাভাবিক। আমি চট্টগ্রামে গেছি আর বৃষ্টি পড়েনি এমনটা কখনও হয়নি। ঠাট্টা করে নিজেকে কতবার ডেকেছি ‘ওয়েদারম্যান’ বলে!
আমাদের বাসটা পিচ্ছিল রাস্তাতে ছুটছিলো বেপরোয়া ভাবে।
অন্ধকার আমাদের চেপে ধরেছিলো ভারী একটা চাদরের মত।
পুরো বাসটা কেঁপে উঠেছিলো তারমাঝেই। আমার পাশের জানালার কাচটা ভেঙ্গে কুচি কুচি হয়ে যাচ্ছে – এমন একটা দৃশ্যই আমার দেখা শেষ কিছু।
এর পরেই চোখে খুব জোরে কিছু ঢুকে গেল। দুইবার লাফিয়ে ওঠে আমার চোখের ভেতরটা। তারপর ভেতরে অদ্ভুত রকম গরম একটা অনুভূতি। এর একসেকেন্ড পরেই আসলো ওটা।
অমানবিক একটা যন্ত্রণা!
চোখের যন্ত্রণাতে পাগল হয়ে গেছিলাম। কতক্ষণ অসহ্য যন্ত্রণাতে চিল্লিয়েছি মনে নেই। অথচ এই আমিই কি না ভাবতাম – যত যন্ত্রণাই হোক – মুখ বুজে সহ্য করতে পারি আমি! গাল বেয়ে না – কপাল বেয়ে চোখের গলিত তরলগুলো পড়ছিলো আমার। কারণ বাসটা ততক্ষণে উল্টে গেছে!
সম্ভবতঃ এর পরেই জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমি।
“নিজেকে গুরুত্ব দেওয়ার মত মানুষ আমি মনে করি না।
কারণ, আমি একা।”
লাইন দুটো লেখে হাঁক ছাড়লাম, ‘এষা?’
হুড়মুড় শব্দ শুনে বুঝলাম বাসার সবাই চলে এসেছে এবার। বদ মেয়েটা নিশ্চয় বলেছে ওদের আমি আবার লিখছি?
ভাইয়ার খনখনে হাসির সাথে উপহাসের ছায়াও খুঁজে পেলাম না। ওতে স্বস্তি-ই আছে শুধু।
‘প্রতি দুই শব্দে একটা করে বানান ভুল। কিন্তু, লেখেছিস তাহলে!’
আমি সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসলাম। অতো খারাপ করিনি নিশ্চয়, ইচ্ছে করে পচাচ্ছে।
আম্মু বলতে শুনি, ‘কি আশ্চর্য – না দেখেই লিখে ফেলেছে! বানান আমরা ঠিক করে দেবো। অসুবিধের কি আছে? তুমি দেখবা পড়াশোনাও করতে পারবা। ব্রেইলী রিডিং শিখতে হবে তোমাকে শুধু। পারবা তো।’
আমি ওদের মাঝে নতুন করে আশা জন্মাতে দেখেও শান্তি পাই না। আমার মাঝে কি আর কিছু বাকি আছে পৃথিবীকে দেওয়ার মত? আমার মনে হয় না।
অনুপম রায়ের গলাটা আমার কানে বেজে ওঠে যেন –
হিসেবের ভীরে আমি চাই না ছুঁতে
যত শুকনো পেঁয়াজগুলি ফ্রিজের শীতে
আমি ওবেলার ডালভাত ফুরিয়ে গেছি …

৬.
সারাদিন ঘরেই বসে থাকি। জোর করে এষা আমাকে একবার বাইরে নিয়ে গেছিল।
আধঘণ্টা পর ফিরে চলে এসেছি। দেখতে পাই না কিছু – বের হয়ে আমার কাজ কি?
মেয়েটাও হয়েছে একগাদা পচা। ওদিকে রুয়েটে পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ও যাবে না।
যতই গালি দেই আর ঝাড়ি দেই, একেবারে সুপারগ্লু হয়ে আছে।
‘দুই সেমিস্টার ক্লাস করবো না। তোর কোন সমস্যা?’, সোজাসাপ্টা আমাকে প্রশ্ন করে মেয়েটা। আমি অবাক হয়ে যাই।
‘এরকম করিস না। এমনিতেই আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন লাগে – তারমাঝে তোর আর ভাইয়ার ক্ষতি করছি ভাবলেই মরে যেতে ইচ্ছা করে।’
আমাকে ধরে ধরে টিলাতে তুলেছে ও, এবার আমাকে বসায় ধীরে ধীরে, ‘যেখানে অর্ধেক মানুষ আমাকে দুই চোখে দেখতে পারে না সেখানে যাওয়ার জন্য আমি মরে যাচ্ছি না।’
এষার বেপরোয়া চলাফেরার কারণে রুয়েট ক্যাম্পাস, যাকে আমরা আদর করে মাদ্রাসা ভার্সন অফ ইউনিভার্সিটি বলে ডাকি, তাকে খুব একটা সমাদর করেনি।
‘আমিও তোকে দুই চোখে দেখতে পাচ্ছি না।’ মুচকি হেসে বললাম।
‘বেশি কথা বলতে হবে না। শোন তোকে আমি লাইভ কমেন্ট্রি দেই। তুই আমার চোখ দিয়ে দেখ চারপাশটা।’
কোনরকম আহ্লাদ ছাড়া বলে গেল ও কথাগুলো। তবুও আমার কানে বাজতে থাকে ‘তুই আমার চোখ দিয়ে দেখ চারপাশটা। তুই আমার চোখ দিয়ে দেখ চারপাশটা!’
হাতড়ে হাতড়ে ওর হাত খুঁজে নিলাম।
আঙুলের ফাঁকে আঙুল আটকাই, ঠিক যেভাবে প্রথমদিক ওর হাত ধরেছিলাম।
দুটো মাত্র চোখ নিয়ে নীরব বসে থাকি আমরা দুইজন মানব-মানবী।
*
ভেবেছিলাম আম্মু-আব্বু কি মনে করে – এষা বাসায় এসে উঠেছে আজকে নিয়ে দশদিন হয়ে গেলো।
ভাইয়া আমাকে চুপিসারে জানিয়ে গেলো, তারা মেয়েটার প্রতি অনেক বেশি কৃতজ্ঞ এজন্য। কারণটা আমি স্পষ্ট বুঝি।
এষা আমাকে লিখতে শিখিয়েছে আবারও। দুটো ছোটগল্প লিখেছি আমি এই দশদিনে।
বানানে হাজারো ভুল থাকে। এষা বা ভাইয়া ঠিক করে দেয় ওগুলো। তারপর আমাকে পড়ে শোনায়।
আমি অবশ্য বুঝে গেছি এই সখ করে দুই এক পাতাই লেখা লাগবে আমাকে। প্রফেশনাল রাইটার আর হতে হচ্ছে না। সেই যখন আমার বয়েস ছয় কি সাত – তখন থেকে আমার স্বপ্ন, বড় হয়ে প্রফেশনাল রাইটার হওয়া – সব এক মাস আগেই শেষ।
এর মাঝে আমি ব্রেইল পদ্ধতির পেছনেও পড়েছিলাম । তবে তেমন উৎসাহ পেলাম না। এসব স্পর্শের অনুভূতি দিয়ে পড়ার মাঝে কোন প্যাশন কাজ করে না।
বাঁচার প্রেরণা এষা আমাকে দিয়েছে – এমনিটাই ভাবছে ওরা। আমি আর কিছু বলিনি।
ভাইয়াকে প্রশ্ন করেছি, ‘তুই মিনেসোটা ফিরছিস কবে?’
ও হাসি হাসি গলাতে বলল, ‘এই তো। যাবো আর কি। ওদিকে কাজ তেমন নাই। কিছু ক্লাস মিস হলে আসবে যাবে না। এটা তো আর বুয়েট না। প্রফেসরদের ইমেইল করে ঘটনা বলা আছে। অনলাইনে হোমওয়ার্ক, টিএ-র কাজ সাবমিট করে যাচ্ছি, এখানে থাকলে আপাতত সমস্যা নেই।’
সত্য বলল না মিথ্যে – ঠিক বুঝলাম না।
আগে আগে শুতে যাই। চেষ্টা করি বেলা গড়িয়ে গেলেও ঘুম থেকে না ওঠার।
ঘুমাতে আমার খুব ভালো লাগে।
স্বপ্ন দেখি তো!
কত কিছু দেখি আমি ওখানে! এষাকে রোজ দেখি। মেয়েটা আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে দেখলাম।
ঢাকাতে থাকা একগাদা বন্ধুদের দেখি স্বপ্নে। রাজশাহীর বন্ধুদের দেখি। মুখগুলো দিন দিন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে – এটা আমাকে কষ্ট দেয়।
কয়েকদিন পর হয়ত ওদের নিয়েই স্বপ্ন দেখবো – বুঝতে পারবো কোনটা কে। কিন্তু ওদের চেহারা আর দেখতে পাবো না।
স্বপ্ন ছাড়া আমার আছেই কি এখন! ওটা চলে গেলে কি করব আমি জানি না।
লাইট বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম ঘরে। আমার জন্য অবশ্য সবই সমান।
এখন আমাকে সারারাত পাহারা দিয়ে রাখে না ওরা। জানে, আত্মহত্যার ভূত মাথা থেকে একেবারেই বের হয়ে গেছে।
সিগারেট খেতে খুব ইচ্ছে করছে এখন। রাত কয়টা বাজে কে জানে?
হাতড়ে হাতড়ে অ্যানালগ ক্লকটা নিলাম। আমার জন্য এটা কেনা হয়েছে। তারপর সেফটি গ্লাসও ভাঙ্গা হয়েছে।
স্পর্শ করে আমি কাঁটাগুলোর অবস্থান বুঝি। সময় জানতে পারি।
ছুঁয়ে দেখলাম – রাত দুইটা। সবার ঘুমিয়ে পড়ার কথা।
এক মাস ধরে সিগারেট না খেয়ে আছি। এষাকে দিয়ে তাই গতকাল একটা প্যাকেট কিনিয়েছি। বাসাতে জানে না আমার স্মোকিংয়ের কথা। ওদের জানিয়ে কষ্ট দিতে চাই নি আগেও। এখনও ইচ্ছে করে না। এমনিতে আমার অবস্থা নিয়ে তাদের চিন্তার সীমা নেই।
মেয়েটাকে বলেছিলাম আমার খাটের নিচে কম্পিউটার টেবিলের গা ঘেঁষে রেখে যেতে। রেখেছে কি না কে জানে!
নড়তে যাবো – খস খস একটা শব্দ হল ঘরের মাঝে।
ভাইয়া না তো? স্পাইং হচ্ছে? এখনও ভাবে পাগলামি করব?
সিগারেট নিয়ে ওর হাতে ধরা খেতে চাইলাম না। কাঠ হয়ে শুয়ে থাকি চাদরের নিচে।
মশারী তুলছে কেউ –টের পেলাম।
চোখ বলে তো কিছু নেই – তবে চোখ টিপে বন্ধ রাখার জন্য যেরকম কমান্ড আগে মস্তিষ্ককে দিতাম – আবারও দেওয়ার চেষ্টা করি।
আমাকে চমকে দিয়ে গরম একটা শরীর আমার চাদরের ভেতরে আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ে। তুলোর মত নরম শরীরটার স্পর্শ পেয়ে আমার বুঝতে বাকি থাকে না এটা কে।
‘এষা! তুই উঠে এসেছিস কেন!’ ফিস ফিস করে ঝামটা দেই ওকে।
‘চুপ করে শুয়ে থাক। তোর সাথে ঘুমাবো।’ ফিস ফিস করেই উত্তর দেয় মেয়েটা।
‘ধরা পড়ে যাবি তো!’ আমার জগত অন্ধকার। তাও ওকে হাতড়ে হাতড়ে ধরলাম।
‘যাবো না। সাড়ে চারটাতে ভাইব্রেশন অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি। উঠে চলে যাবো।’
অ্যাকুয়াস হিউমার আর জন্মায় না আমার। তাই চোখ এখন শুকনো খটখটে। অবাক হই আরও একবার – এই মেয়েটা আমাকে এত ভালোবাসে কেন?
‘শক্ত হয়ে থাকবি না। আমাকে জড়াবি?’
মিষ্টি কণ্ঠটা আমাকে ভুলিয়ে দেয় মেয়েটার সাথে আমার থাকা উচিত না। আমার সাথে ওর কোন ভালো ভবিষ্যৎ নেই।
মিষ্টি কণ্ঠটা আমাকে ভুলিয়ে দেয় আমি আর কোনদিনও মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবো না। আমি কোনদিনও হতে পারবো না বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ থ্রিলার রাইটার।
মিষ্টি কণ্ঠটা আমাকে ভুলিয়ে দেয় সব কিছু।
আমি আলতো করে করে ছুঁয়ে দেখলাম ওর মুখ, গাল, কপাল, চোখের পাপড়ি, কানগুলো আর ছোট্ট নাকটা।
তারপর বুকে চেপে ধরি ওকে, ফিস ফিস করে শুধু বললাম, ‘জড়াবো।’

৭.
‘আমি ওকে বিয়ে করবো। নিষেধ করে লাভ নাই। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।’ আমার পাশেই কথাগুলো বলে ফেলে এষা।
আমার নিঃশ্বাস আটকে যায় আজ।
আন্টিকে এসব কি বলছে মেয়েটা? কি ভয়ানক!
আমি তো গেছিই – একেবারে অথর্ব হয়ে গেছি। শুধু শুধু আমার জন্য নিজের দুর্গতি ডেকে আনছে মেয়েটা। হাতড়ে হাতড়ে ওকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কখন সরে গেছে ও আগের অবস্থান থেকে।
বাসার সাথে ফোনে কথা বলছে আর হাঁটছে মেয়েটা।
বিকেলে ভাইয়া আমাকে আরও স্পষ্ট করে দেয় সবকিছু, ‘এষা তোকে বিয়ে করতে চায়। তোর কি মতামত?’
আমি টেংরা মাছের মত হা হয়ে গেলাম, ‘আব্বু আম্মু? এষার ফ্যামিলি? আমার মত খোঁড়া কুত্তার কাছে তো এই প্রশ্ন করার মানে নাই। ফুটা পয়সা পরিমাণ দাম নাই আমার।’
‘ওসব দিক দেখাটা আমার দায়িত্ব। আমি জানি মেয়েটাকে তুই ভালোবাসিস।’ অস্থির শোনায় ভাইয়ার কথাটা।
‘সেজন্যই তো স্বার্থপরের মত সিদ্ধান্ত নিতে আমি পারি না, ভাইয়া।’ না বলে পারলাম না।
‘স্বার্থপরের মত মানে? এষা তোকে করুণা করছে না। মেয়েটা সত্যি তোকে ভালোবাসে। আমি শুধু বলব, তুই সারা জীবন বালময় কাজ করে এসেছিস বটে, তবে এই একটা জায়গাতে খুবই লাকি। এষার মত পরিচ্ছন্ন মনের মেয়ে আজকে আরেকটা খুঁজে আনতে পারলে বলিস।’
আমি মাথা নাড়লাম, অনুমান করে ভাইয়া যেদিকে থাকার কথা সেদিকে তাকিয়ে আছি।
‘তুই আমাকে বুঝতেই পারছিস না। এষাকে বিয়ে করাটা আমার পক্ষে সম্ভব না। মেয়েটার লাইফ আমি হেল করে দেব রে!’
বাধা দেয় ভাইয়া, ‘দিবি না। ও সব জানে। না জেনে তুই ওকে ঠকাচ্ছিস না।’
‘গুড গড! বুঝতে পারছিস না কেন? আমি এখন লিখতে পারি না!’ ভাইয়া চুপ করে আছে দেখে বলেই ফেললাম, ‘আর আমি লিখতে না পারলে, কাজকর্ম কিচ্ছুটা করতে না পারলে, আমার প্রতি ওর ভালোবাসা থাকবে কয় দিন?’
থাপ্পড়টা খেয়ে মাথা ঝিম ধরে গেল।
বহুদিন কেউ এত জোরে মারেনি আমাকে। কিছু দেখতে পাচ্ছি না তো – তাই বুঝলাম না ঠিক কোনদিক দিয়ে আসলো।
মাথা চক্কর দিচ্ছে। চোখে কিছু দেখতে না পেলে মাথা চক্কর দেওয়াটা খুবই অস্বস্তিকর।
‘শোন, তুই লেখালেখি শুরু করার আগ থেকে এই মেয়েটার সাথে তোর পরিচয়। লেখালেখি শুরু করার আগ থেকে তোরা একজন আরেকজনকে পছন্দ করিস। কথা দুইটা কতটা সত্য তুই খুব ভালো করে জানিস। বিয়ে এড়াতে এষার ভালোবাসাকে ছোট করে আর একটা কথাও বলবি না।’
ভাইয়াকে এষা পুরোদস্তুর ঘটক বানিয়ে ফেলেছে দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই।
বুঝলাম আপত্তি করে লাভ নেই। বিয়েটা ওরা দেবেই।
এষা ছাড়া কেউ আমাকে কন্ট্রোল করতে পারবে না এখন – এটাও আমি জানি। কিন্তু নিজের সুবিধে দেখতে গিয়ে তো আর মেয়েটার বারোটা বাজাতে পারি না। অন্ধ স্বামী নিয়ে ঝোঁকের মাথাতে পাঁচ দশ বছর সংসার করল নাহয়। তারপর কি ওর মনে হবে না – সিদ্ধান্তটা নিয়ে পস্তাচ্ছে?
ভাইয়া আমাকে ঠাণ্ডা গলাতে বলল, ‘এখন ড্রইং রুমে একটা মিটিং ডাকছি। এষা থাকবে ওখানে। আব্বু আম্মুকে আমি লাইনে আনবো। তুই যদি এখান থেকে নড়েছিস – কেটে ফেলবো একেবারে। তোর লাইফ চুলোয় যাবে – সেটা দেখতে আমি আমেরিকা থেকে উড়ে আসিনি। আর এষাকে ছাড়া – বরাবর ওখানেই যাবে ওটা।’
মার খেয়ে চুপচাপ বসে থাকি।
ড্রইং রুমে নিচু গলাতে কথা বার্তা হচ্ছে। বুঝলাম ওখানে এখন মাথা ঢুকিয়ে ‘আমি বিয়ে করে এই মেয়ের লাইফ চুলোয় দিতে পারবো না’ বলে চেঁচিয়ে উঠতে পারবো না। চেঁচালে ভাইয়া আমাকে আমার এতদিনের থ্রিলারের কোন এক মেথডে স্রেফ খুন করে ফেলবে।
ঝিম মেরে বেশিক্ষণ বসে না থেকে চোরের মত উঠে দাঁড়াই। ওরা মিটিং করছে করুক। আমার আরেকটা কাজ বাকি থেকে গেছে। পা টিপে টিপে ডাইনিং রুমে বের হয়ে আসলাম। বাইরে যাওয়ার জন্য এদিকে একটা দরজা আছে।
সাবধানে নবটা ঘুরিয়ে বের হলাম। সিঁড়ির দিকে এগুচ্ছি, পাশেই চাপা গলাতে সবধরনের সম্ভাবনা নিয়ে ভাইয়া কথা বলছে আব্বু আম্মুর সাথে। সোজা বাংলাতে ‘পটাচ্ছে’।
আমার জীবনটা ওদের সবাইকে একটা ঝামেলাতেই ফেলে দিয়েছে।
ভাইয়া তার মাস্টার্স – পিএইচডি ফেলে আমার নার্সিংয়ে লেগে গেছে। বুঝতেই পারছি স্কলারশিপটা চুলোতে দিয়ে আমার লাইফ চুলো থেকে বের করতে সে এখানে এসেছে।
এষা রুয়েটের সেকেন্ড ইয়ারে এসে রুয়েট-লাইফ প্রত্যাখ্যান করেছে। এটাও স্পষ্ট – নিজের বিএসসি ক্যারিয়ারকে পানিতে ফেলে এই মেয়ে আমার জীবনটাকে পানি থেকে তুলে নিয়ে যেতে এসেছে।
ওদের ভালোবাসা আমি হৃদয়ের গভীরে অনুভব করতে পারলাম অনায়াসে।
সেই সাথে অনিবার্য প্রশ্নটা চলে আসল আমার মনে, ‘এত স্যাক্রিফাইস তারা কার জন্য করছে?’
উত্তরটা পেতে আমার দেরী হয় না এবার।
এত স্যাক্রিফাইস তারা করছে গুড ফর নাথিং একটা অথর্বের জন্য।
চোখ থাকা অবস্থাতে আমার দাম হয়ত ছিলো কিছু। এখন একটা ফুটো পয়সাও না সেটা।
অন্যের কাছে আমার কতটুকু দাম – সেদিক থেকে নিজের চিন্তা ঘুরিয়ে নেই দ্রুত।
আমার কাছে আমার দাম কতটুকু?
যেই আমি ঘণ্টায় ২,০০০ শব্দ করে লিখতে পারতাম – সেই আমি লিখছি দশদিনে দুটো গল্প?
মেকানিক্যালের ল্যাবগুলোতে ঈগল দৃষ্টি দিয়ে কাজ শিখে নিতাম যে আমি – সে আমি ব্রেইল রিডিংয়ের একেবারে প্রাথমিক ধাপে আছি! আর শিখতে পারলেই বা কি?
অন্ধ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কার কি কাজে আসতো?
খোলা ছাদে উঠে এসে নিজেকেই বলি, ‘কারও কাজে আসতো না।’
বাতাস সব উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মনে হয়। আমার চুলগুলো উড়ছে আগের মতই। শুধু অন্ধকার এই দিনের বেলাতেও।
রেইলিংয়ের ধারে গিয়ে হাসলাম, সারাজীবনই নিজের জীবনটাকে একটা যুদ্ধক্ষেত্র ভেবে এসেছি আমি।
মনে হচ্ছে, আমার জন্য যুদ্ধটা শেষ।
অন্ধ সৈনিকের কানাকড়িও দাম নেই যুদ্ধক্ষেত্রে।
তাই বলে সামান্য একটা ইচ্ছে পালন করার অধিকার তার থাকতেই পারে। আমার অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিলো প্যারাসুট দিয়ে গ্লাইড করে ওপর থেকে নামার।
বিশেষ কোন কারণে না, পাখিদের মত আকাশে ভাসতে আমার খুব সখ। সেই ছোটবেলা থেকেই।
বড় করে একবার নিঃশ্বাস নেই।
রেইলিং টপকে গিয়ে আজ আমি পাখি হলাম।

— ০ —

রচনাকাল – সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৪

ক্যাথি

‘আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো যা বেহায়া আর বেশরম হয়েছে না! বেতিয়ে সবার পাছা লাল করে দেওয়া উচিত।’
রাফিদ সাহেবের কথা শুনে ইকরাম সাহেব একটু গাল চুলকালেন। বেতানোর টপিকটাই ভয়ংকর। তার সাথে বিশেষ অঙ্গ লাল করার কথা থাকলে তো কথাই নেই! ইকরাম সাহেব নির্বিরোধী মানুষ। বেত-প্রসঙ্গে ইনি নেই। ওপরেও না। নীচেও না।
যদিও একই রুমে অফিসওয়র্ক করতে হয় বলে রাফিদ সাহেবের হুঙ্কার না শুনে আর কোন উপায় ইকরাম সাহেবের থাকে না। ইকরাম সাহেবের চুপচাপ থাকায় অবশ্য রাফিদ সাহেবের রাগ পড়ে গেল এমন নয়। টকটকে লাল চোখ মেলে সোজা হয়ে বসলেন তিনি।
‘আর বলবেন না। আমার মেয়েটার কথা বলছি। সারা রাত জেগে জেগে তার ফুসুর ফাসুর।’
‘ছেলেটা কি করে?’ গলা খাকারি দিয়ে সাহস করে জানতে চেয়েই ফেললেন ইকরাম সাহেব।
‘আমার ছেলে?’ দ্বিগুণ তেজে জানতে চাইলেন মানুষটি।
‘না। যার সাথে ফুসুর ফাসুর।’ ক্লু ধরিয়ে দেন ইকরাম সাহেব।
‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ইলেক্ট্রিক্যাল। ছোহ!’
রাফিদ সাহেবের চোখ মুখ কুঁচকে গেছে। কারণটা অবশ্য ভালোই বুঝতে পেরেছেন ইকরাম সাহেবের। ইনার মেয়ে ফারজানার সাথে তাঁর পরিচয় আছে।
চমৎকার দেখতে মেয়েটি। গানের গলা ভালো। সেই সাথে পড়ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজে।
প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী।
সেখানে ‘প্রাইভেট’ ভার্সিটি শুনেই রাফিদ সাহেবের নাক কুঁচকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক না। নিজের ছোট ছেলে যে প্রাইভেট ভার্সিটিতেও কোর্স কমপ্লিট করতে পারেনি – মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছে – সে ব্যাপারে বলবে কে? বললেই রাফিদ সাহেব প্রাইভেট ভার্সিটি ছেড়ে দিয়ে জার্মানি চলে যাওয়ার উপকারিতা নিয়ে ছোটখাট লেকচার দিয়ে দেবেন না?
‘ভাবতে পারেন?’ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি, ’ওই ব্যাটা আমার গুনবতী মেয়েটাকে কিভাবে পটিয়ে, ফুসলিয়ে, সরিয়ে, ম্যানেজ করে নিয়েছে?’
‘এতসব জানলেন কখন?’ আস্তে করে জানতে চান ইকরাম সাহেব।
‘গতকাল হাতেনাতে ধরে ফেলেছি না? তখন জানতে চাইলাম। আর মিথ্যা বলে পার পাবে আমার সাথে? সব বের করে নিয়েছি!’
বেচারি বাচ্চা মেয়েটা – একেবারে আত্মা বের করে নিয়েছেন রাফিদ সাহেব নিঃসন্দেহে – ভেবে মনটাই খারাপ হয়ে যায় ইকরাম সাহেবের। নড়েচড়ে বসেন তিনি।
‘ইলেক্ট্রিক্যাল খারাপ কি? দেশে ইলেক্ট্রিক্যালের তো জব স্ফেয়ার আছে অনেক বেশি। মেনে নিলেই তো পারেন। মানে ছেলের ব্যাপারে একটু খোঁজ নিয়ে দেখেন – চরিত্র ভালো হলে আর সমস্যা কি?’
‘অসম্ভব!’ ছোট অফিস রুমটা কাঁপিয়ে দিয়ে হুংকার ছেড়ে বলেন রাফিদ সাহেব, ’ছেলের চরিত্র ভালো না খারাপ সেটা দিয়ে আমি কি করব? বিয়ের আগে সব ছেলেই একটু লাগাম ছাড়া থাকেই। পরে সবাই লাইনে চলে আসে।’
দুর্ধর্ষ লোকটির দিকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকেন ইকরাম সাহেব দুই মুহূর্ত, তারপর মৃদু হাসেন, ’তাহলে তো দেখাদেখিরও কিছু নেই। বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন। নাহলেও এংগেজমেন্টটা করাতে পারেন আপাতত। মেয়ে পড়া শেষ করুক। কি বলেন?’
‘ওহ! আপনি কি খুব সহজেই সবকিছু ভুলে যান নাকি? কিভাবে আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করতে পারি আমি একজন প্রাইভেট ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলের সাথে?’
‘তাহলে কার সাথে ঠিক করতে চাচ্ছেন?’ ইকরাম সাহেবের প্রশ্ন থামে না।
‘বুয়েট! এমআইএসটি! আইইউটি…’
আরও কি কি জানি বলে যাচ্ছিলেন মানুষটি, ইকরাম সাহেব হতাশ হয়ে চেয়ারে হেলান দেন, বিড় বিড় করে বলেন, ‘হুম, বিল গেটসের ছেলে – টম ক্রুজ, জেরেমি রেনার -’
ভাগ্যিস নিজের উচ্চকন্ঠের ধাক্কায় কথাগুলো কানে যায় না রাফিদ সাহেবের। নাহলে এখানেই একটা কেলেঙ্কারী হয়ে যেত!
*
ফারজানা হাতের মুঠোতে একটা পিঁপড়া নিয়ে বসে আছে।
পিঁপড়াটি ওর না। রাশেদের। রাশেদ একটা করে পিঁপড়া পোষে। পিপড়ার লাইফটাইম পর্যন্ত সেটার যত্ন নেয় প্রাণপনে।
ওটা মরে গেলে আরেকটা পিঁপড়া পোষে তখন।
ছোট্ট একটা কাচের জারে রাখে ও পিঁপড়াটাকে। সেটায় থাকে অনেক ছোট ছোট ফুটো।
তিনটা কম্পার্টমেন্ট। একটা খুলে খাবার দেয় ও। তখন ওটার বাকি দরজা থাকে বন্ধ। তারপর বাইরে থেকেই কম্পার্টমেন্টের দরজা লাগিয়ে দেয়। তখন পিঁপড়াটা খেতে পারে।
রাশেদ কোনদিনও পিঁপড়াটাকে বের করে না। তবে মাঝে মাঝে ফারজানার আগ্রহে ওকে রাখতে দেয় পিঁপড়াটাকে।
তখন এটাকে আর কাচের জারে আটকে রাখে না মেয়েটা। হাতে নিয়ে বসে থাকে।
পিঁপড়াটাও কি অদ্ভুত! মোটেও পালানোর চেষ্টা করেনা!
ফারজানার টলটলে চোখের দিকে তাকিয়ে আছে ছোট্ট পিঁপড়াটা। বাবা একটু আগেই ডেকেছিলেন।
সুখবর দিতে।
প্রবাসী বন্ধু ফারুক এখন দেশে। বন্ধুটির ছেলে সিনেমার হিরোদের মত দেখতে। মাথার ভেতর মগজের জায়গাতে সম্ভবতঃ কপোট্রন বসানো। ম্যাসাচুয়েটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়াশোনা করছে। এরই মাঝে তিনটা পেটেন্ট আছে তার কাজের। দেশে এসেছে স্বদেশের মাটিতে পা রাখতে, স্বদেশকে হাল্কা চিনে যেতে।
আর রাফিদ সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে ফোনের অন্যপাশ থেকে টেলিফোন কাঁপানো হাসি দেন ফারুক চৌধুরী, ‘ছেলে জানে না – তবে এবার আমি নিজের আগ্রহেই ওকে দেশে টেনে আনছি কেন সেটা তোমাকে বলা যায়।’
ফোনের এপাশে চোখ টিপ দেন রাফিদ সাহেব, ’নির্ঘাত লাল টুকটুকে একটা বাঙালি বউ চাই তোমার?’ ওপাশে কাশির শব্দ শুনতেই দ্রুত কারেকশন দেন তিনি আবার, ’ছেলের জন্য আর কি!’
ফারুকের গলা থেকে আবারও টেলিফোন কাঁপানো হাসির শব্দ বের হয়, ’হাহাহাহা – একেবারে ঠিক ধরেছ। নাহলে দেখা যাবে বেলে মাছের মত চামড়ার কোন খ্রিস্টান মেয়ের সাথে ঝুলে গেছে। এই সমস্যা শুরু হওয়ার আগেই ঝেড়ে ফেলতে হবে। কি বল?’
‘তা তো অবশ্যই। আমার মেয়েটাও যা হচ্ছে, আর কয়েকদিন পর মেডিকেল থেকে বের হয়ে যাবে – এখনও বিয়ের কথা বললেই নাক কোঁচকায়!’
‘ওরই কি বা দোষ বল?’ মাথা নাড়ান ফারুক, ’এই দেশে ওর মত লক্ষী মেয়ের উপযোগী জামাই আসবেই বা কোথা থেকে? তোমার মেয়ে, বুঝলে রাফিদ, ওয়ান ইন আ মিলিয়ন!’
তখনই বাতাসে গন্ধ পেয়ে আনন্দে হৃৎপিন্ডটা লাফিয়ে ওঠে রাফিদ সাহেবের। কিসের বুয়েট! এই ছেলে একেবারে এমআইটির পাবলিক! সেটাকে উস্কে দেন ছেলের বাবা ফারুক সাহেব নিজেই, ’আমার ছেলে কিরণকে তো দেখেছই তুমি। মানে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে। ই-মেইল পাঠিয়েছিলাম – দেখেছ না?’
রাফিদ সাহেবকে স্বীকার করতেই হয় – তিনি দেখেছেন কিরণকে।
‘তোমার মেয়ের পাশে ওকে কেমন মানাবে বল দেখি?’
ফারুক সাহেবের গলা থেকে এতটুকু বের হওয়াই যথেষ্ট ছিল। তার আধ ঘন্টা পরই ফারজানার ডাক পড়ল বাবার ঘরে। বাবার সুখবর ফারজানার মাথাতে মিসাইলের মত আঘাত হানে। কোলে রাশেদের পিঁপড়া নিয়ে বসে আছে এজন্যই ও।
রাশেদকে পরের দিন ডেকে যে দেখা করবে – সে উপায় রাখছে বলেও মনে হয় না। আগামিকালই নাকি চলে আসবে ছেলেপক্ষ!
এই বাবা আর বাবার বন্ধু একেবারে আঁটঘাট বেঁধে নেমেছে। লোকটা ঘাঘু আছে। যেদিন বাসায় আসবে তার আগের রাতে ফোন দিয়েছে। প্ল্যান করার সময় তারা দেবে না ফারজানাকে। বাবার ওপর ফারজানার যা বিরক্তি লাগে বলার মত না। মানুষটা মাত্র কয়েকদিন আগে শুনল রাশেদের ব্যাপারে- আর এখন আবার নতুন বিয়ের কথা বলছে। মানে ডাক্তারি পড়েও নিজের সিদ্ধান্তে বিয়ে করার উপায়টুকু নেই ওর।
মা বেঁচে থাকলে হয়ত একটা চেষ্টা করা যেত তাকে দিয়ে বাবাকে প্রভাবিত করার। মা-টাও মরে ভূত হয়ে আছে সাত বছর ধরে!
মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে। রাশেদের ফোন।
মেসেজে তাকে জানিয়েছিল ফারজানা – যে আগামীকাল দেখতে আসবে ওকে। এখন টনক নড়েছে তার।
এখন লাফিয়ে লাভ আছে?
বাবার সামনে ফারজানার সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে যায়। নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়া বা পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানো তখন তাকে দিয়ে সম্ভব না।
আর ফারুক আংকেলকে দেখা যাচ্ছে একেবারে ডিটারমাইন্ড – এসে আংটি না পড়িয়ে যাবেন না। সুদূর আমেরিকা থেকে আজাইরা প্যাচাল পাড়তে তো আর আসেননি। বাংলাদেশে এখনও শিক্ষিত মেয়েদের পর্যন্ত সিদ্ধান্তের দাম দেওয়া হয় না কোথাও কোথাও!
এখানে কড়া কিছু না বললে কোনদিনও বিয়েটা থামানো সম্ভব হবে না – বাবার সামনে যেটা ফারজানাকে দিয়ে হবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলটা রিসিভ করে ফারজানা।
রাশেদের চিন্তিত গলা শোনা যাচ্ছে। হাজারটা সমাধান দিয়ে যায় ও ফারজানাকে।
কিন্তু সব ক্ষেত্রেই একটা জায়গায় আটকে যায় মেয়েটা – বাবার সামনে ও যে ভীষণ ভয় পায় কিছু বলতে!
সারা রাত কথা বলেও কোন সমাধান পাওয়া গেল না।
*
‘ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট তুমি?’ অসম্ভব সুদর্শন ছেলেটা ফারজানাকে এই প্রশ্নটা করলে ওর দম আটকে আসে।
নিজেকে পন্য পন্য মনে হতে থাকলে দম থাকার কথা না। এখানে তার বাবা আর এই কিরণের বাবার প্যাঁচে পড়ে বিক্রি হয়ে যেতে হচ্ছে। খাড়া নাক আর হাল্কা খয়েরী চোখের এই ছেলেটাকেও তার রীতিমত ষড়যন্ত্রকারী বলে মনে হচ্ছে। দেবে নাকি নাকের ওপর একটা খামচি?
‘জ্বি। ফোর্থ ইয়ারে এবার।’ আস্তে করে বলে ফারজানা।
হাল্কা হাসে কিরণ, ’হেই, আমি তোমার প্রফেসর না। এত ফর্মাল কথা বলছ কেন?’
সোজাসুজি ছেলেটার দিকে তাকায় ফারজানা, ’ইনফর্মাল কথা বলার মত সম্পর্ক আমার-আপনার না। ভুলেও ভাববেন না সেরকম কিছু হতে চলেছে।’
বাবা আর ফারুক আংকেল বের হয়ে গেছে, সুযোগটা পূর্ণ কাজে লাগাচ্ছে ফারজানা। যেটা জানা দরকার এই ছেলের সেটা জানিয়ে দিয়েছে। কিরণের মুখটা ছাই বর্ণ হয়ে যায়।
‘তোমার কি মনে আছে আমরা ছেলেবেলায় একসাথে খেলতাম?’ ব্যথিত গলাতে জানতে চায় ও।
‘আছে! তাই বলে কি করতে হবে?’ বেশ রুক্ষ ভাবেই জানতে চায় ফারজানা।
‘সবচেয়ে পুরোনো বান্ধবীর কাছে আরেকটু সফট ব্যবহার আশা করেছিলাম – এই আর কি। আর কিছু করতে হবে না।’
‘সবচেয়ে পুরোনো বন্ধুর সাথে আরেকটু সফট বিহ্যাভ করার ইচ্ছে আমারও ছিল, মি. কিরণ। কিন্তু আমাদের বাবাদের খামখেয়ালীপনার জন্যই এরকম আচরণ করতে বাধ্য হচ্ছি আমি।’
এবার একটু বিভ্রান্ত দেখায় কিরণকে, ’বাবাদের খামখেয়ালীপনা?’
‘ইয়েপ! ন্যাকামি করবেন না। নাকি বলতে চান কিছুই জানেন না?’
‘কি ব্যাপারে?’ বাম হাতের কব্জি ডান হাত দিয়ে ঘষে জানতে চায় ছেলেটা।
‘আমাদের বিয়ের ব্যাপারে – অফকোর্স!’ গর গর করে জানায় ফারজানা।
‘এখানে বিয়ের টপিক আসল কি করে?’ হা হয়ে যায় কিরণ এক প্রকার।
‘এই যে আমাকে আপনাকে একা কথা বলতে দিয়ে চলে গেছে ওরা এর অর্থ কি বোঝেন?’
এবার আক্ষরিক অর্থেই অপ্রতিভ দেখায় কিরণকে। একবার মাথা চুলকেও নেয়, ’আসলে, বাংলাদেশী সমাজ নিয়ে খুব একটা জানি না আমি। পুরোনো দুই বন্ধু দেখা করতে এসে নিজেরা নিজেরা কথা বলতে বলতে চলে গেলে তাদের ছেলেমেয়ে যদি প্রাইভেসী পায় স্মৃতিচারণ করার জন্য – তাহলেই যে বিয়ের জন্য কথা চলছে বুঝতে হবে – সেটা ঠিক জানতাম না। আমি দুঃখিত। সত্যিই দুঃখিত।’
‘ফর হোয়াট!’ ঝামটে ওঠে ফারজানা।
‘আমি জানতাম না। বাবা আমাকে কিছুই বলেনি। বললে অবশ্যই এই ভুল বোঝাবুঝি থেকে রক্ষা পেতাম সবাই।’
‘সেক্ষেত্রে – বোঝাই যাচ্ছে এই বিয়ের ব্যাপারে কিছুই না জেনে মাঝে ঢুকে পড়েছ তুমি?’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জানতে চায় ফারজানা।
দ্রুত মাথা ঝাঁকায় কিরণ, ’অবশ্যই। ছেলেবেলার বান্ধবীর সাথে দেখা করা ছাড়া আর কোন দুরভিসন্ধি ছিল না। বিশ্বাস করো!’
ছেলেটার ব্যস্ততা দেখে মুচকি হাসে ফারজানা, ’করেছি। নাহলে আগের সম্বোধনে ফিরে যেতাম না।’
‘আমিও তো বেঁচে গেলাম তুমি আগেভাগে জানালে তাই।’ ঝলমলে একটা হাসি দেয় কিরণ, ’নাহলে ক্যাথির ব্যাপারটা পরে ঝামেলার হয়ে যেত।’
‘ক্যাথি?’ হা হয়ে গেল এবার ফারজানা।
‘ইয়েপ। ক্যাথেরিন ডেমিয়েন। আমাদের ক্যাম্পাসের মেয়ে।’
‘গার্লফ্রেন্ড?’
‘অ্যাকচুয়ালি উই আর লিভিং টুগেদার।’
এবার মাথা চুলকায় ফারজানা, ’তোমার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দাওনি?’
হাল্কা হাসে কিরণ, ’তোমার মাথা খারাপ? বাবা সেকেলে চিন্তাভাবনায় বিশ্বাসী। অযথাই ক্যাথির সাথে খারাপ ব্যবহার করে মনটা খারাপ করে দেবে মেয়েটার। বুঝতেই পারছ – মেয়েটা ক্রিশ্চিয়ান।’
‘তাও ঠিক।’ মাথা ঝাঁকায় ফারজানা।
‘তোমার ব্যাপারটা?’ আস্তে করে জানতে চায় কিরণ।
‘রাশেদ ওর নাম। ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে বিএসসি করছে। আর দুই মাস পর বের হয়ে যাবে।’
‘বাহ – ভালোই তো।’ খুশি হয়ে ওঠে কিরণ, ’তবে এটাও ঠিক – তোমাকে চিন্তায় থাকতে হবে না। আমার নিজস্ব প্ল্যান আছে ক্যাথির ব্যাপারে। আর তোমার ব্যাপারটাও এখানে মিটে যাবে। বাবাকে আমি সামলাবো। বুঝতেই পারছ – তোমার বিয়ে নিয়ে কথা উঠলে এখানে দ্বি-পক্ষীয় ক্ষতি।’ চোখ টিপ দেয় কিরণ, ‘আমরা একই দলে।’
দুই বাবা এসে দেখতে পেলেন তাঁদের ছেলে-মেয়ে বেশ খোশ মেজাজেই আছে। হাসাহাসি করছে। একে অন্যকে খোঁচাও মারছে।
দুইজনই পরিতৃপ্তির হাসি দিলেন।
জানেন না – মাত্র দুই ঘন্টার মাঝে ওই হাসি উড়ে যাবে কোথায়!
*
‘কিছু কিছু পুরোনো বন্ধু আছে, বুঝলেন! ভাবের ঠেলায় চলে। মানুষকে ছোট করতে সুযোগ পেলে ছাড়ে না কখনও।’
রাফিদ সাহেবের বিরক্তিতে কুঁচকে থাকা মুখটা দেখে বেশ ভালো লাগে ইকরাম সাহেবের। নিজেও মনে মনে কিছুটা বিরক্ত।
আরে ব্যাটা অফিসে এসেছিস – কাজ কর। এখানে গুষ্ঠির প্যাঁচাল কেন পাড়বে?
‘আসলে বড় বড় প্রতিষ্ঠান মানুষের অহঙ্কার বাড়িয়ে দেয়। আরে – যে কথা দিয়ে কথাই রাখতে পারবি না সেটা দিতে আসবি কেন?’ গর গর করেন রাফিদ সাহেব।
‘কি হয়েছে, রাফিদ ভাই?’ এবার ইকরাম সাহেব আর না বলে থাকতে পারেন না।
লাই পেয়ে গলে গেলেন রাফিদ সাহেবও, ’আর বলবেন না – পুরোনো আমলের বন্ধু আমার – বলে কি না তার এমআইটি-তে পড়া ছেলের সাথে আমার মেয়ের সম্পর্ক করাতে চায়। ছেলে দেখতে শুনতে দারুণ। আর এমআইটি মানে তো বোঝেনই -’
আয়েশ করে হেলান দিয়ে আধ ঘন্টা ধরে মানুষটার বক্তব্য শুনলেন ইকরাম সাহেব। কিভাবে সব কথা বার্তা বলে দেখতে এসেও পরের দিনই তড়িঘড়ি করে দেশ থেকে চলে গেছে বাবা-ছেলে সেটা শুনে দুঃখের বদলে কৌতুক অনুভব করেন ইকরাম। তারপর আস্তে করে একটা চোখ খুললেন, ’সিদ্ধান্ত কি নিচ্ছেন তাহলে? মেয়েকে তো পড়া শেষ করতে দেবেন আগে, নাকি? আগে থেকেই বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগলে একটু ঝামেলা হতেই পারে। কি বলেন?’
‘একেবারে খাঁটি বলেছেন। আগেই আপনার কথা শোনা উচিত ছিল। মেয়ের যদি দুই বছর পরও ওই ছেলেকে পছন্দ থাকে – আমি ওকে ওর সাথেই বিয়ে দেব। লাগবে না আমার বুয়েট- এমআইটি! মানুষ ভালো হলেই হল।’
মোবাইল দেখেন ইকরাম সাহেব।
‘আমাকে একটু বের হয়ে যেতে হচ্ছে, রাফিদ ভাই। মেডিকেল রিপোর্টটা নিয়ে আসি। ছেলে এসে দাঁড়িয়ে আছে নিচে। সামলাতে পারবেন তো? একেবারে চারটার দিকে ফিরব।’
ঘাড় নেড়ে সায় দেন রাফিদ সাহেব।
আর অফিস থেকে বের হয়ে যান ইকরাম। বিল্ডিংটা থেকে বের হতেই এয়ার কন্ডিশনড সিস্টেম থেকে সরাসরি রোদের গরমে চলে আসার যন্ত্রণাটা অনুভব করেন সবার আগে।
তারপরই দেখতে পান কালো গাড়িটা। দরজার সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর ছেলে।
বাবাকে দেখে দরজা খুলে দেয় সসম্মানে।
*
দুই ধরণের যানবাহনে ছুটে চলা দুই বাংলাদেশী যুবকের মনে এক রকম ঝড় উঠেছে।
বাবাকে নিয়ে ড্রাইভ করছে রাশেদ। বাবা বেরিয়েছেন তাঁর অফিস থেকে। কিন্তু ছেলের মনটা পড়ে আছে ওর সেখানেই। বাবার অফিসে।
ফারজানার বাবা ভেতরে বসে আছেন ভেতরে। সিদ্ধান্ত এতক্ষণে হয়ত পাল্টে ফেলেছেন।
মেয়েটির ব্যাপারে যতবারই ভাবছে রাশেদ – পরাজয়ের একটা তিক্ত গ্লানি গলাতে এসে ঠেকছে ওর।
গতকাল রাতে ফেসবুকে সার্চ দিয়ে কিরণকে বের করে মেসেজ দিয়েছিল ও। ফারজানা তার বাবার সামনে একটুও আপত্তি করতে পারবে না, তা ওর থেকে ভালো আর কে জানে। বিয়ের ঘটনাতে ‘সেকেন্ড বেস্ট ইফেক্টিভ’ মানুষটার সহায়তা দরকার ছিল ওর।
আর মানুষটা অবশ্যই কিরণ।
ছেলেটা চমৎকার।
বোঝাতেই বুঝেছে। এবং রাশেদকে কোন ধরণের দুশ্চিন্তা করতে মানা করে দিয়েছে।
কথা রাখতে জানে ছেলেটা। ফারজানা দেখাদেখির পর ওকে সুখবরই দিয়েছিল।
সব দিক থেকে সব কিছু ঠিক আছে। ফারজানা-কিরণের পরিচয় ছিল ওদের বয়েস যখন তিন। ছয় মাসের মত পাশাপাশি ফ্ল্যাটে ছিল তারা। কাজেই কিরণের ভালো মত মনেও নেই মেয়েটাকে। এমনিতেও হয়ত বিয়েটা হত না– তবুও সাবধানের মার রাখেনি রাশেদ।
কিন্তু আরেকটি ছেলের কাছে সাহায্য নিতে ইগোতে বাঁধছিল ওর। নিজের গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে ঠেকানোর জন্য তার হবু স্বামীর সাহায্য নিতে হলে সেটা একটা ছেলের জন্য কতটা আত্ম-অপমানজনক সেটা কেবল এই পরিস্থিতিতে আটকে পড়া একটা ছেলেই জানে।
আবার অন্যদিক বিবেচনা করলে, ফারজানাকে হারাতে পারে না রাশেদ কোন মূল্যেই – তাই আত্মসম্মানের হিসাব বাদ দিয়ে এগিয়ে গেছিল কথা বলতে। যে কারণে এখন প্রতিটা সেকেন্ড নিজের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ওর।
পাশ ফিরে তাকালেন ইকরাম সাহেব, ’কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে তোমাকে?’
‘ওহ – তেমন কিছু না বাবা।’ হাল্কা হাসি দিয়ে বলে রাশেদ।

প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে কিরণ। পাশে বাবাও আছে। ওরা চলে যাচ্ছে বাংলাদেশ ছেড়ে।
একদিনের নোটিশে আমেরিকার টিকেট পাওয়া কঠিন হত নিঃসন্দেহে। তবে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাথে কিরণের বাবার সম্পর্ক চতুর্মাত্রিক। ‘না’ করতে পারার মত না সেটা।
কিরণ আর একটা দিনও বাংলাদেশে থাকবে না। কাজেই ফারুক সাহেবও থাকার জন্য কোন লজিক দেখতে পারেননি।
‘সমস্যা কি? মেয়েটাকে একবার দেখার জন্য পাগল হয়ে ছিলি। এখন মনে হচ্ছে এই দেশ থেকে বের হয়ে যেতে পারলে বাঁচবি। কি এমন কথাবার্তা হল? মেয়েটা খারাপ কিছু বলেছে নাকি?’
মাথা নিচু করে কিরণ, ’মেয়েটা আমার জীবনের প্রথম মেয়ে বন্ধু ছিল বাবা। তাই আগ্রহ দেখিয়েছিলাম তার সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু তুমি যে বিয়ের দিকে নিয়ে গেছ জিনিসটা আমি কিভাবে বুঝব? খুবই লজ্জার ব্যাপার। দ্যাট ওয়াজ টোটালি আনঅ্যাকসেপ্টেবল, ড্যাড!’
থম মেরে বসে থাকেন ফারুক সাহেব। রাগে কান জ্বলে যাচ্ছে তাঁর। ছেলেটাও ঠিকই বিজাতীয় ধারাতে চলে গেছে। আরে বাবা মা বিয়ে ঠিক করে দেবে – তোরা বিয়ে করবি – এত কথার কি আছে রে ব্যাটা?
তবে বোঝাই যাচ্ছে বাংলাদেশী সংস্কৃতির ওপর থেকে মন উঠে গেছে ছেলের। অবশ্য ফারজানা মেয়েটাকে দেখতে যে রকম খাঁচায় আটকে পড়া পাখির মত লাগছিল – তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারটা স্পষ্ট ফুটে ওঠার কথা কিরণের সামনে। আর ছেলেকে চেনেন তিনি। একটু বেশি পরিমাণে মানবতাবাদী।
‘তোর কি পছন্দের কেউ আছে?’ গুরুগম্ভীর গলাতে জানতে চান ফারুক সাহেব।
বাবার দিকে সরাসরি তাকায় কিরণ, ’হুঁ। মেয়েটার নাম ক্যাথি।’
‘ক্রিশ্চিয়ান?’ চেয়ার কাঁপিয়ে জানতে চান ফারুক সাহেব।
‘ক্যাথলিক।’
‘আস্তাগফিরুল্লাহ।’
‘ড্যাড’ আর কিছু বলেন না। কিরণও ঘাঁটায় না। বাবাকে আঘাত করতে চায় নি ও। কিন্তু আর কিছু করার ছিলও না। ছেলেদের এসব একটু আধটু আত্মত্যাগ করতেই হয়। এত বিচলিত হওয়ার মতও না ব্যাপারটা।
আস্তে করে নিজের সীটে হেলান দেয় কিরণ।

পরিশিষ্ট
ফারজানার মনটা আজকে একটু বেশিই খারাপ।
মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী।
বাবাকে লুকিয়ে একটা ডায়েরী পড়তে দেখে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে ও। মায়ের ডায়েরী।
যতই পড়ছে – বার বার চোখ ভিজে যায় ফারজানার। প্রায় পুরোটা জুড়েই ওর ব্যাপারে লেখা। জায়গায় জায়গায় আবার সাদাকালো ক্যামেরা দিয়ে তোলা ছবি। নিচে ক্যাপশন।
সেসব ছবির প্রায় সবই ফারজানার।
ক্যাপশনগুলো মজার।

বাবুটার আজ দুটো দাঁত উঠেছে।
আরও দুটো দাঁত।
জ’!!
ফারজানা এখন দাঁড়াতে পারে–
ফারজানা আজ প্রথম হাঁটল।

চোখ থেকে পানি মুছতে মুছতে একবার হাল্কা হাসে মেয়েটা। মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা ফুটে উঠেছে হাসিটিতে।
ধীরে ধীরে সেটা মুছে যায় পরক্ষণে।
আরেকটি ছবির ক্যাপশনের দিকে তাকিয়ে আছে ফারজানা। নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছে।
একটি দেবশিশুর মত সুন্দর ছেলেশিশুর সাথে তিন বছরের ফারজানা।
মায়ের নিজ হাতে লেখা ক্যাপশন : কিরণ ও ক্যাথি। (কিরণ নামের পিচ্চি এই ছেলেটা আমার বাবুটাকে কেন ক্যাথি বলে ডাকে কে জানে!)

 

রিপুচক্র

১.

সাদাতের ডানহাতের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো পলাশ। চোখের পাতা না নড়িয়ে এভাবে তাকিয়ে থাকা পলাশের জন্য বিরল। কখনোই সে নিজের দৃষ্টি একদিকে বেশিক্ষণের জন্য ধরে রাখতে পারে না। দীর্ঘদিন নিয়মিত ইয়াবা সেবনের ফলে তার দৃষ্টি সব সময় থাকে চঞ্চল। আড়ালে আবডালে পলাশকে এজন্য “ছুপা পলাশ” নামেও ডাকা হয়।

ছুপা পলাশের দৃষ্টি আজ থেমে গেছে। কয়েক সেকেন্ড তার উত্তরের আশায় তাকিয়ে থাকল সাদাতও। তবে নীরবতা ভাঙ্গে পলাশই, “কিভাবে হলো?”

রুমাল দিয়ে রক্তপাত বন্ধের বৃথা চেষ্টা করতে করতে উদাসী কণ্ঠে উত্তর দিলো সাদাত, “লামিয়া কামড়ে দিয়েছে।”

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো পলাশ, “টিটেনাস শেষ কবে নিয়েছিলি?”

“দুই বছর আগে। কেন?” অবাকই হলো সাদাত।

“ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে কিন্তু।” জবাব দিলো পলাশ।

এবার নিঃশ্বাস ফেললো সাদাত, “লামিয়া কুকুর না।”

হাত নেড়ে ওর কথা উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলো পলাশ, “কামড়ালো কেন?”

গুম হয়ে বসে থাকলো সাদাত। উত্তর দিলো না।

“লামিয়া যাকে তাকে কামড়ানোর মেয়ে না।” আবারও বললো পলাশ।

“তাই তো দেখলাম।” হতাশ ভঙ্গিতে বললো সাদাত, “আর কাওকে না কামড়ালেও আমাকে ঠিক ঠিক কামড়ে দিয়েছে।”

“করেছিলি কি?”

এবারও পলাশের প্রশ্ন না শোনার ভান করে এড়িয়ে গেল সাদাত। লামিয়া পলাশেরই খালাতো বোন। প্রশ্ন শোনার প্রশ্নও আসে না। তবে বিনা ব্যাখ্যায় পলাশকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার চেয়ে টাইটানিকের আইসবার্গ এড়ানোর প্রচেষ্টা বেশি সফল ছিলো। এক সুদীর্ঘ হাই তুলে প্রশ্নটাকে দমিয়ে দেওয়ার এক শেষ চেষ্টা করতে সাদাতকে অবশ্য দেখা যায়।

“কুকুরের মতো হা করে না থেকে ঘটনা খুলে বল্!” সাদাতকে উৎসাহ দিতে বললো পলাশ।

“আরে ওই যে!” এতটুকু থেকেই যেন সবটা বুঝে ফেলবে পলাশ।

“কোন যে?”

“প্রেমে পড়ার চেয়ে ঝামেলার কিছু নাই।”

ধীরে ধীরে মাথা দোলালো পলাশ। ঘটনা সে যেমনটা ভেবেছিলো, তেমনই ঘটতে যাচ্ছে। সাদাত-লামিয়ার প্রেমকাহিনী এলাকাতে বিখ্যাত। বিখ্যাত ঘটনাবলীর কিছু সাইড ইফেক্ট আছে। সাইড ইফেক্টের আবর্তনে পড়ে গেছে সাদাত। লামিয়া তাকে কামড়ে দিয়েছে।

“বুঝতে পেরেছি। আবারও মারামারি করে এসেছিস।” পলাশও একমত হল, “তবে এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হল না। কি এমন করেছিলি যে মারামারি বাঁধলো? এটা ছিলো আমার প্রশ্ন।”

“ওই যে।”

“প্রেমের ঝামেলা?”

“হুঁ।”

“আগেও একবার বলেছিস। ঘটনা পরিষ্কার হয়নি। প্রেম করলে ঝগড়া কিছু হবেই। অযথা ভূমিকা দীর্ঘায়িত করছিস।”

“ভূমিকার কি হলো?” বিষণ্ন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললো সাদাত, “প্রেমে পড়েছি। তাই লামিয়া রেগে গেছে।”

“প্রেমে পড়লে লামিয়া রাগবে কেন? ও কি তোকে ভালবাসে না?”

পলাশের চোখ এখন আগ্রহের আতিশয্যে জ্বল জ্বল করছে। যেন লামিয়া সাদাতকে ভাল না বাসলেই সে খুশি হয়! সন্দেহের দৃষ্টিতে পলাশের দিকে তাকালো সাদাত। বছর তিনেক আগে লামিয়ার সঙ্গে প্রেমের সূত্রপাত তার। তখন পলাশকে নিয়ে বাজারে গুজব ছিলো। বাজার মানে এলাকার একমাত্র ক্ষুদে বাজার। হাশেম চাচার চায়ের দোকানে রোজ বিকেলে আসর বসতো। সেখানে সবচেয়ে প্রচলিত গল্পটা ছিলো পলাশ-লামিয়ার। পলাশ নাকি তের বছর বয়সে লামিয়াকে বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলো। একবস্ত্রে ইলোপ। গন্তব্য ঢাকা শহর। নতুন সংসার, সুখ, ইত্যাদি। দিন দিন লামিয়া সুন্দর হচ্ছিলো দেখেই ওই গল্পের ঘন ঘন অবতারণা। চায়ের সাথে সিগারেটের ধোঁয়া মিশে একাকার, সেই সাথে একাকার হতো কৌতুক আর ঈর্ষা। 

কথাটা অবশ্য মিথ্যা না। পলাশও কোনদিন অস্বীকার করেনি। এ নিয়ে একবার পলাশের উপস্থিতিতে কথা হচ্ছিলো। ও শুধু বলেছিলো, “আরে ব্যাটা, রাজ্জাক-শাবানার ছায়াছবি দেখে আমার মাথা আউলা হয়ে গেছিলো। মাথা আউলা বুঝিস?”

সাদাত মাথা আউলা বুঝে। এই মুহূর্তে পলাশের মাথা ঠিক আছে। তারপরও তার চোখ জ্বল জ্বল করে উঠবে কেন? মুখে এসব কথা অবশ্য বলা গেল না। ছুপা পলাশের সাথে ইয়ার্কি চলে কম। ইয়ার-দোস্তদের জন্যও এ কথা প্রযোজ্য।

সুতরাং উদাস ভঙ্গিতে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে সত্য কথাটাই বলে দিলো সাদাত, “প্রেমে তো পড়েছি ব্যাটা আরেক মাইয়ার।”

২.

তানিশা মেয়েটা এলাকাতে নতুন এসেছে। শহরের শেষ মাথার হলদে দোতলা বাড়িতে এসে উঠেছে তারা। বাবা রিটায়ার্ড কর্ণেল। সুতরাং নো ধানাই-পানাই। বাজারে নতুন গুজব এসেছে। কর্ণেল সাহেব নাকি বাড়ির লকারে বন্দুক রাখেন। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে এসে পরিবারের শহর পরিবর্তনের ঘটনার সঙ্গে লকারের বন্দুকের যোগাযোগ আছে। আগের শহরের জনৈক ছুপা সালমানের চোখ পড়েছিলো মেয়ের ওপর। কর্ণেল সাহেব গুড়ুম করে দিয়েছেন। আইনী ঝামেলা সামলাতে শহর পরিবর্তন।

গুড়ুম তত্ত্বে বিশ্বাস করতে পারেনি সাদাত। তার ধারণা এই ঘটনাটা ছড়িয়েছে লুচ্চা শফিক। লুচ্চা শফিকের নামের পেছনে লুচ্চা টাইটল এমনি লাগেনি। যথেষ্ট আস্থা আর দক্ষতা ধরে রেখে চারটি বছর ধরে টানা করে যাওয়া লুচ্চামির ফসল হিসেবে নামের পেছনে চিরস্থায়ী এক পদ বাগিয়েছে সে। গত তিন বছর ধরে আটকে আছে এইচএসসির ফাঁদে। একবার দিয়ে ফেল মেরেছে। এবার আবার দিবে। 

লুচ্চা শফিকের নজর থেকে তার ছোটবোন কেয়াও বেঁচেছে বলে নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। শফিকের জনপ্রিয়তার পেছনে কারণটা সহজ। ছেলেটা ক্ষতিকর নয়। নজর দিয়েই ক্ষান্ত দেবে সে। কোনদিনও কাওকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে বলে শোনা যায়নি। রূপসী কাওকে রাস্তাতে দেখলে সেকেন্ড দশেক তাকিয়ে থাকবে। তারপর বলবে, “পাছাটা জোস!”

শফিককে সন্দেহ করার পেছনে সাদাতের কারণটা যৌক্তিক। ছুপা পলাশ একবার তাকে পিটিয়েছিলো। পাছা থিওরি তখন সে কাজে লাগিয়েছিলো লামিয়া সম্পর্কে। পলাশের কানে উঠে গেছিলো অচিরেই। বাজারের সেই ইলোপ কাহিনী এর পেছনে ভূমিকা রেখে থাকবে। তবে লামিয়ার যে অঙ্গ নিয়ে তার মহামূল্যবান মন্তব্য রেখেছিলো শফিক, একই অঙ্গে হকিস্টিক দিয়ে গোটা ছয়েক ঘা বসিয়ে দেওয়ার নজির পলাশ রেখেছিলো। কাজেই, আচমকা শহরের নতুন সুন্দরীর পুরোনো ইতিহাসের চরিত্র সালমানের পেছনে পরিচিত এক “ছুপা” টাইটল দেখা গেলে শফিককে সন্দেহ না করে উপায় থাকে না।

লুচ্চা শফিক গত সপ্তাহের প্রতিটি দিন নতুন মেয়েটিকে নিয়ে বয়ান ছাড়ছে শিডিউল ধরে। এসব বয়ান সব হাশেম চাচার দোকানে হচ্ছে না। বিভিন্ন জনপ্রিয় ভেন্যু ধরে ধরে বয়ানের শিডিউল ঠিক করছে সে। তার কোন এক ফাঁকেই ছুপা পলাশের ডুপ্লিকেট ক্যারেকটার ছুপা সালমানের কাহিনী পয়দা করে ফেলেছে সে।

তানিশাকে প্রথমবার সাদাত দেখেছিলো শহরের একমাত্র শপিং মলের সামনে। ফ্যাকাসে নীল জিন্সের সাথে গোলাপী ফতুয়া। গোলাপী রঙ দেখলেই ঘৃণায় মুখ বাঁকিয়ে যায় সাদাতের। গোলাপী আবার একট রঙ হলো নাকি? সেদিন অবশ্য তার মুখ বাঁকিয়ে যায়নি, হয়ে গেছিলো হা। মেয়েটার চুল তাকে পাগল করেছিলো, রেশমী আর কোকড়ার মাঝামাঝি কিছু। সাদাতের মনে হয়েছিলো এই ত্রিশ মিটার দূরে দাঁড়িয়েও ওই চুলের ঘ্রাণ পাচ্ছে সে। পোড় খাওয়া চেহারার এক প্রৌঢ় তাকে নিয়ে বের হয়ে আসছিলো। শপিং মলের সামনে রাখা সবুজ রঙের এক পাজেরোতে উঠে গেছিলো তারা।

নাকের সামনে দিয়ে পাজেরো চলে যাওয়ার পর সম্বিত ফিরে পেয়েছিলো ও। ততক্ষণে কাজ যা হওয়ার হয়ে গেছে। দুই লাফে হাশেম চাচার দোকানে এসে একটা সিগারেট কিনে নিয়েছিলো সাদাত। সিগারেটটা ধরেছে নতুন। নতুন সিগারেট ধরা তরুণের জীবনের প্রায় সব কিছুতেই সিগারেট ভাল ভূমিকা রাখে।

পরীক্ষায় বাঁশ খাওয়া থেকে শুরু করে কাজিনের বিয়েতে হাঁস খাওয়া, সবকিছুর পরই তাদের একটা সিগারেট ধরাতে হয়। এই আইনের বাইরে যেতে পারেনি সাদাতও। নিয়মিত টানছে। দিনে দুইবার করে লামিয়ার সঙ্গে লাগছেও তার।

সেদিন প্রথমবারের মতো সিগারেটে টান দিয়েছে, কোথা থেকে হেলেদুলে এসে উপস্থিত হলো লুচ্চা শফিক। লুচ্চা শফিক সাদাতের মত নতুন “খোড়” না। স্টিমারের মতো ধোঁয়া ছাড়ার জন্য এলাকাতে তার একটা আলাদা সম্মান আছে। একই বৈশিষ্ট্যের কারণে তাকে দেখেই সাদাতের মনটা খারাপ হয়ে গেল। শফিক জীবনেও একটা সিগারেট কিনে খেয়েছে বলে শোনা যায়নি।

“আরে ছোটভাই!” অবাক হয়ে যাওয়ার ভান করতে করতে বললো লুচ্চা শফিক, “ভর দুপুরে বিড়ি ধরাইলা কি মনে করে? সর্বনাশ কইরা দিলা তো মিয়া।”

সর্বনাশের বৃত্তান্ত জানতে চাওয়ার ইচ্ছে শফিকের ছিলো না। এসব ঢঙের মানে তার জানা আছে। ধীরে ধীরে সিগারেট দখলের একটা প্রক্রিয়া শুরু করবে শফিক, এটা তারই সূচনা।

“বদর বদর কইরেন না তো, শফিক ভাই।” বিরক্ত মুখে বলে দিলো সাদাত, “স্কুল ছুটির সময় হয়ে গেছে। গিয়ে মেয়েদের পাছা দেখেন গা। এইখানে বদর বদর কইরেন না।”

লুচ্চা শফিকের চোয়াল ফাঁক হয়ে গেছে। সাদাতের মত জুনিয়র একটা ছেলে তার সাথে এমন ভাষাতে কথা বলবে এটা সে ভাবতেও পারেনি। অন্য কোন সময় হলে এখানেই একটা কেলেঙ্কারী হয়ে যেত। তবে সাদাতের সঙ্গে ছুপা পলাশের আত্মীয়তার সম্পর্ক তার জানা আছে। কষ্ট করে হলেও নিজের জ্বিহ্বা সংযত রাখলো সে।

“বউয়ের লগে ঝগড়া করে আসছো নাকি, মিয়া? মেজাজ এতো উঁচুতে ক্যান?” সরু চোখে জানতে চাইলো শফিক, “অবশ্য যে মাইয়ার সাথে সম্পর্ক করতে গেছো, ঝগড়াঝাঁটি তো কিছু লাগবোই। মাথা গরম ফ্যামিলি।”

পিচিক করে চায়ের দোকানের মাটিতে থুতু ফেললো লুচ্চা শফিক। আড়চোখে দূরে হেঁটে যাওয়ার একটা মেয়ের পেছনে তাকিয়ে নিলো। হাশেম চাচা অবশ্য ব্যাপারটা সমর্থন করতে পারলেন না। বললেন, “কতবার বলছি মিয়া, দোকানের ভিতরে থুতু ফেলবা না! আজকালকার পোলাপাইনরে এক কথা দশবার বললেও মনে রাখে না।”

হাশেম চাচার দিকে গরম চোখে তাকালো শফিক। হাশেম চাচাই বা কম যাবেন কেন? পাল্টা তাকিয়ে রইলেন তিনিও। চোখে  সাদাতের কাজ অবশ্য সাদাত করে যাচ্ছে। লুচ্চা শফিকের হাত বাঁচিয়ে যতটা সম্ভব সিগারেট টেনে নিচ্ছে সে। শেষ রক্ষা অবশ্য হল না। ধপ করে সাদাতের পাশে বসে পড়লো লুচ্চা শফিক, তারপর হাতটা আনমনে বাড়িয়ে দিলো, “দাও, বিড়িটা দাও। মন মেজাজ ভাল নাই।”

বিড়ি দেওয়ার ইচ্ছা সাদাতের ছিলো না। কাজেই আবারও জানতে চাইলো, “কি হইছে ভাই?”

“কেয়া প্রেম করতেছে।” উদাস হয়ে বললো শফিক।

“ফাটাফাটি খবর।” হাসিমুখে বললো সাদাত, সিগারেট টেনে নিলো আরেকবার, “আপনার বোনটা দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে গেল।”

নিজের বোন সম্পর্কে এমন মন্তব্য কোন বড় ভাইয়ের সামনে করাটা নিরাপত্তাজনিত প্রশ্নের দাবিদার। তবে লুচ্চা শফিকের ব্যাপারটাই আলাদা। ক্লাস থ্রিতে থাকতে সে কেয়ার সঙ্গে যা করেছিলো, তা জনগণের সামনে প্রকাশ করার মতো ঘটনা না। হাশেম চাচার দোকানে বসেই সে ঘটনা অবশ্য সে গর্বের সঙ্গে সবাইকে শুনিয়েছিলো।

কেয়ার বড় হয়ে যাওয়ার খবর দিয়ে লুচ্চা শফিককে বেশিক্ষণ প্রভাবিত করে রাখা গেল না। হাত বাড়িয়ে আবারও নড়াতে থাকলো সে, যেন অস্কার দোলানো হচ্ছে সামনে। বললো, “বিড়িটা জোস।”

চোখ কুঁচকে যায় সাদাতের। ঘটনা মনে হচ্ছে সিরিয়াস। লুচ্চা শফিক তার উক্তির প্যারোডি বানানোর মতো মানূষ না। এখন সেটাই ঘটছে। অর্থাৎ, প্রথমবারের মতো সে উদাসী হয়ে এসেছে। সাদাতকে জানতে চাইতেই হলো, “ঘটনা কি ভাই?”

সিগারেটটা একরকম কেড়েই নিলো শফিক, তারপর বললো, “কেয়ার বয়ফ্রেন্ডকে তুমিও চিনবা। হানিফ। বর্ষার ছোটভাই হানিফ। পাছাটা জোস।”

লুচ্চা শফিকের এই আরেক বিরল বৈশিষ্ট্য। যে কোন মানুষের পরিচয় তার কাছে এভাবেই জমানো থাকে। অনেকটা মোবাইলের সেভড কন্ট্যাক্টের মতো।

হানিফ, বর্ষার ছোটভাই। পাছাটা জোস।

তারেক, কৃষ্ণার বড়ভাই। পাছাটা জোস।

জামশেদ, কুলসুমের কাজিন। পাছাটা জোস।

ইত্যাদি ইত্যাদি।

সাদাত অবশ্য অন্য একটা কারণে থমকে গেছে। হানিফকে সে চেনে। টিঙটিঙে এক ছেলে। কেয়ার মতো দামাল মেয়েকে সে কিভাবে সামলাবে তা একটা প্রশ্ন হতে পারে। এ তো আর ক্লাস সেভেনের ইংলিশ প্রাইভেট টিউটরের বাড়িতে গিয়ে সহপাঠিনীর সঙ্গে প্রেম নয়। কলেজ ফার্স্ট ইয়ারের উদ্দাম প্রেম। হানিফ ছিবড়ে যাবে একেবারে!

“বলেন কী ভাই!” সিগারেট হারানোর দুঃখেই হোক আর খবরের প্রচণ্ডতায়, সাদাতের মুখ থেকে এটুকুই বের হলো।

“তুমি চিঙড়ির মতো দাঁপাচ্ছো কেন?” প্রচণ্ড বিরক্ত হলো লুচ্চা শফিক, “আসল খবরটাই তো বলিনি তোমাকে!”

“কোন হাসপাতালে?” দ্রুত উপসংহারে চলে এলো সাদাত।

“কোন হাসপাতালে মানে!”

“না কিছু না।” দ্রুত কথা গিলে ফেললো ও, “বলেন ভাই।”

“হানিফ কি বলেছে জানো?” গরগর করে উঠলো শফিক।

“কি ভাই?”

“আমি নাকি সুযোগ পেলেই কেয়ার পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকি! ভাবা যায়?”

মাথা চুলকালো সাদাত। ঘটনা পুরোপুরি অবিশ্বাসের উপায় কী? লুচ্চা শফিকের রেপুটেশন তল্লাটের সবারই জানা আছে। সেদিন মেথরপট্টির মর্জিনাকে দেখেছিলো শফিকের সামনে পড়ে যেতে। দ্রুততার সাথে কোমর তোয়ালে দিয়ে ঢেকে নিয়েছিলো সেদিন মর্জিনা। আর কেয়ার মতো আকর্ষণীয়া মেয়ে লুচ্চা শফিকের নাগাল থেকে ফস্কে যাবে?

মুখে অবশ্য বললো, “শালার সাহস তো কম না!”

“বোঝ একবার!” লাই পেয়ে মাথায় উঠে গেল শফিক, “শালা আমার বোনের সাথে প্রেম করে, আর সামান্য কিছু ব্যাপার চেপে যেতে পারে না!”

হাশেম চাচার কাছে আরেকটা সিগারেট চাইবে কি না তা মনস্থির করার চেষ্টা করছে তখন সাদাত। লুচ্চা শফিকের সঙ্গে বেশিক্ষণ বসার আগেই কান ঝাঁ ঝাঁ করতে শুরু করে ওর।

“ঠিক করছিলাম আজ বিকালে শালাকে ক্যাচকা ধোলাই লাগাবো। তোমারেও ডাকতাম।”

লুচ্চা শফিকের কথা শুনে প্রমাদ গুণলো সাদাত। এর মধ্য আবার ওকে টানা কেন? কিন্তু তখনও শফিকের কথা শেষ হয়নি। বলে ফেললো, “শপিং মলে গিয়া মাথাটা কিছু ঠাণ্ডা হইলো। তানিশারে দেখলাম বাপের লগে ঘুরতাছে। টাইট জিন্স পড়ছে, মামা! চোখ ফেরানোর মতো না শালী! পাছাটা জোস!”

পিচিক করে চায়ের দোকানের মাটিতে থুতু ফেললো সাদাত।

৩.

তানিশার সঙ্গে প্রথমবার কথা বলার সুযোগ পাওয়া গেল কেমিস্ট্রি ল্যাবের বাইরে। মেয়েটা মিশুক আছে। প্রথম তিন দিনের ক্লাস শেষে জুটিয়ে ফেলেছে একগাদা বান্ধবী। আর মেয়েগুলোও বেহায়ার মতো মিশছে ওর সাথে। যেন মেলায় হারিয়ে যাওয়া বোনকে খুঁজে পাওয়া গেছে।

ব্যতিক্রম লামিয়া। ক্লাসের কোণে গুম হয়ে বসে ছিলো সে। সাদাত এখনও তানিশার ব্যাপারে কিছু বলেনি তাকে। তবে আড়চোখে প্রেমিকের দৃষ্টি ফেলা কোন ছেলেকে ধরে ফেলা কঠিন কিছু নয়। আজকে সাদাতের চোখের প্রেম লামিয়ার জন্য নয়।

“শালার মাল একটা। পুরাই মাল।” নিঃসঙ্কোচে ঘোষণা দিলো পলাশ। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে সে এখন।

“সরাসরি তাকাসনে। ধরা পড়ে যাবি।” সাবধান করে দিয়েছিলো সাদাত।

“ধরা পড়লেই বা! ওটাই তো ভাল হবে আরও। মাইয়া জানতে পারবে আমার চোখে সে আগেই পড়সিলো।”

“একই কারণে তোরে ছ্যাচড়া এক পোলা ছাড়া আর কোন কিছু ভাববে না সে।”

“আমাকে প্রেম শেখাতে আসবি না।” লাল চোখে বললো ছুপা পলাশ।

পলাশকে সেদিন প্রেম শেখাতে যায়নি সাদাত। তবে কেমিস্ট্রি ল্যাবের পর কলেজ গেটের দিকে এগুতে গিয়ে বাঁধাগ্রস্থ হয়েছিলো সে। দেখতে পাচ্ছিলো লুচ্চা শফিক দূরে একটা কিছু করছে। কাছাকাছি তানিশাকেও দেখা যায়। মসুরের ডাল তো কিছু কাল হয়েছেই। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যেতে হলো সাদাতকে।

কাছে পৌঁছতে লুচ্চা শফিকের গলা পরিষ্কারভাবে কানে এলো ওর। নিজের নাম্বার অত্যন্ত উৎসাহের সাথে দিচ্ছে সে। ততোধিক উৎসাহের সাথে চেয়ে বসেছে মেয়েটির নাম্বার। সেই সাথে কলেজে তার প্রভাব প্রতপত্তি কেমন তা খুব ভাল করে বুঝিয়ে বর্ণনা দিয়ে ছাড়ছে সে। কয়েক সপ্তাহ আগে প্রতিপক্ষের বড় ভাইকেও হাসপাতালে পাঠায়নি কী সে? নিজে যে তিন বছরের সিনিয়র হয়েও একই ক্লাসে পড়ছে আজ, সে খবরটা তানিশার কাছে বেমালুম চেপে গেল মানুষটা। মনে মনে বেদম হাসলো সাদাত।

তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, “শফিক ভাই, টুর্নামেন্ট নিয়ে একটা কথা ছিলো।”

অচিরেই হতে যাচ্ছে আন্তঃকলেজ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। তাতে কোন দায়িত্বই লুচ্চা শফিককে দেওয়া হয়নি। সে দলের একজন ডানহাতি স্পিনার। আর কিছু নয়। অথচ এই মুহূর্তে তাকে দেখে সে কথা কে বলবে?

সবগুলো দাঁত বের করে তানিশার দিকে তাকালো সে, “আরে আমরা পরে কথা বলবো, ঠিক আছে? জরুরী একটা আলাপ সাইরা লই। বোঝই তো, আমাকে ছাড়া একদম চলতে পারে না পোলাপাইন, হেহে।”

ব্যস্ততার ভঙ্গিতে করে সাদাতের দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই তাকে একটু আড়ালে নিয়ে গেল সে। তারপর , বললো, “মাহতাব স্যার তো বললো আপনাকে ইমিডিয়েটলি ক্যাপ্টেনের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। স্পিনার নিয়ে কি একটা ঝামেলা যেন হয়েছে। স্কোয়াড চেঞ্জ হবে খুব সম্ভব।”

দলে স্পিনার রাখার সিদ্ধান্তই হয়েছে একজন। তার ওপর স্কোয়াড স্পিনারের জন্য চেঞ্জ হলে লুচ্চা শফিক দল থেকে বিতারিত হবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েই বলা চলে। নিমেষেই তার মাথা থেকে তানিশার কথা চলে গেল। হন্তদন্ত হয়ে বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সাদাত গেটের দিকে হাঁটা দিলো আনমনে।

রাস্তাতেই ওভারটেক করা হলো তানিশাকে, তবে ব্যাপারটা যে ইচ্ছাকৃত তা তো আর মেয়েটির জানার কথা নয়। লুচ্চা শফিক কানের যথেষ্ট দূরে চলে গেছে। নরোম গলায় ডাকলো তানিশা, “হ্যালো?”

ফিরে তাকালো সাদাত, “আমাকে কিছু বললে?”

“থ্যাংকস।” ছোট করে বললো সে।

“আরে ও কিছু না। ওইটা শফিক ভাই। ফাঁপড়ে বস। মেয়েদের সাথে উনার এই রেপুটেশন আছে…”

“রেপুটেশন?”

সাদাত আবিষ্কার করলো, চমকে গেলে এই মেয়েকে সুন্দর লাগে। বিস্ময়ে সামান্য হা হয়ে যাওয়া সাধারণ কিশোরীর সৌন্দর্য্য নয়, এখানে আরও কিছু আছে। অপার্থিব কিছু। তানিশার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন একসাথে চমকে উঠেছে। এমনকী চুলও। যেন পুকুরের ঠিক মাঝখানে আছড়ে পড়েছে উল্কাপিণ্ড। নারীর এমন রূপ সাদাত আগে কখনও দেখেনি। লামিয়ার কথা উল্কার বেগেই মাথা থেকে বেরিয়ে গেল তার।

চমকে ওঠার উপযুক্ত কারণও অবশ্য তানিশার ছিলো। রেপুটেশনের মানে সবাই জানে। জাহাঙ্গীরনগরের এক পরাক্রমশালী ছাত্রনেতার ১০০ মেয়ে ধর্ষণের পর কেক কাটার খবর সবাই পড়েছে।

সচকিত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অভয়ের হাসি হাসলো সাদাত, “যা ভাবছো তেমনটা না। তিনি কাণ্ড ঘটান না কোন।”

“তাহলে তো ভালই।” হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো তানিশা, “রেপুটেশনের প্রসঙ্গ এলো কেন তাহলে?”

“ওহ… ওটা…” বলবে কি না তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগলো সাদাত, তারপর বলেই ফেললো, “আসলে, উনি মেয়েদের পাছা দেখে বেড়ান।”

এবার তানিশা হা হয়ে গেছে। বিস্মাভূত তরুণীর অপরূপ রূপ। ঠিক যতটুকু রূপ ঠিকরে বের হলে এক গোবেচারা ছেলেও তার চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য হাত তুলতে পারে, ততটাই। সাদাত হাত তুলেও ফেলেছিলো, তানিশার পরের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে আবার নামিয়ে ফেলে অবশ্য।

“কী!”

“মানে, উনি মেয়েদের…”

“হয়েছে, থাক!” দ্রুত বললো তানিশা, “আমি বুঝেছি।”

“সরি।”

এখনও হাঁটছে ওরা, তার মধ্যেই কয়েকবার সাদাতের দিকে তাকালো তানিশা। তবে ঘুরে তাকায় না সাদাত, ক্ষমাপ্রার্থনা ব্যাখ্যার কোন ইচ্ছে তার মধ্যে আছে বলে মনে হচ্ছে না। দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে মনোযোগের সাথে হাঁটছে গেটের দিকে। বের হবে ওরা।

“সরি কেন?” অবশেষে মুখ ফুটে জানতে চাইলো ও।

“আরে, সব কথা শুনতে নেই।” মাথা নেড়ে বললো সাদাত। “বাদ দাও।”

সবুজ পাজেরো চলে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিলো সাদাত।

মেয়েটার মাথায় যথেষ্ট মশলা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। লুচ্চা শফিকের কপালে এবার খারাপী আছে।

৪.

তানিশার সঙ্গে বিকেলে বের হওয়ার ফন্দীটা কাজে লাগাতে সাদাতের অপেক্ষা করতে হলো দুই সপ্তাহ। ঝাড়া দুই সপ্তাহ অপেক্ষার ইচ্ছে ওর ছিলো না। তবে তানিশা মেয়েটা পিচ্ছিল আছে। প্রতিদিন বিকেলে বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্রিকেট খেলা দেখবে, ওপর থেকে হাতও নাড়াবে সাদাতের দিকে লক্ষ্য করে, কিন্তু নিচে নামবে না। ভেতরে ডাকার তো প্রশ্নই আসে না।

এমনটা ঘটবে তা অবশ্য আগেই অনুমেয় ছিলো। শেষ যে ছেলেটা তানিশাদের বাড়িতে ডুকেছিলো, তার নাম ছুপা সালমান। একদম গুড়ুম করে দেওয়া হয়েছে তাকে। খুপড়ি উড়ে গেছে। সাদাতের খুপড়ি সংখ্যা এক। এক খুপড়ি নিয়ে তানিশাদের বাড়িতে ঢোকা চলে না।

সাদাত সময়টা কাজে লাগিয়েছে বেশ। কয়েকবারই কথা হয়েছে তার সাথে তানিশার। প্রতিবারই বোমা ফাটিয়ে দিয়েছে। স্ট্রেটকাট কথা বলা ছাড়া মেয়ে পটানোর আর কোন অস্ত্র সাদাতের ছিলো না কখনও। লামিয়া ওর প্রেমেও পড়েছিলো স্ট্রেটকাট কথার ধাক্কায়। ও জানে, তানিশাও পড়বে। এই মুহূর্তে লামিয়া নিয়ে ভাবার মতো অবস্থা তার নেই। জগত জুড়ে আছে তানিশা। শেষ তিনদিন লামিয়ার সাথে ঘুরতেও যায়নি। ফোনে বাজে ব্যবহার করেছে। তারপর লামিয়ার কান্না শুনে শুধু বলেছে, “মেয়েমানুষের মত ফোঁত ফোঁত করবা না।”

তানিশা মাঝে মাঝে বিকেলে সাইকেল নিয়ে বের হয়। সপ্তাহে দুইদিনের বেশি না। ক্যাচ মিস করে সাদাত তানিশার পা দেখে। লুচ্চা শফিক বলে, “শালা গাণ্ডু! এমন ক্যাচ মিস করে কেউ?”

তবে ব্যাপারগুলো লুচ্চা শফিক বোঝে না তেমন নয়। নিতম্ব দর্শনের জন্য নতুন মেয়ে সে খুঁজে নিয়েছে। শুধু বোঝেনি ছুপা পলাশ। পলাশের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলার মতো সাহস সাদাতের ছিলো না। একে তো লামিয়ার ভাই, তার ওপর লামিয়া-তানিশা দুটোর ওপরেই ক্রাশ খেয়ে বসে থাকা আরেক মানুষ ওই পলাশ। তাকে সব খুলে বললে পানি যে কোথা থেকে কোথায় গড়াবে তা কে জানে?

কাজেই অগ্রগতি চালাতে হচ্ছে সাদাতকে, তবে পলাশ থাকছে অন্ধকারে। রাতের বেলায় ওরা মাঝে মাঝে টঙে এসে দেখা করে। টাকা পয়সার কমতি যাচ্ছে দুইজনেরই। একটা সিগারেট ভাগ করে খাওয়ার সময় পলাশ সাদাতকে প্রায় কিছুই দেয় না। ফোঁস ফাঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুই অবিবাহিত তরুণ।

তানিশার সঙ্গে প্রথম ব্রেকথ্রুটা ঘটে গেল এক সোমবারে। যথারীতি কলেজে এসেছে সাদাত। দূর থেকেই দেখা গেল লুচ্চা শফিক পেছনের বেঞ্চ থেকে তাকিয়ে আছে আড্ডারত তিন মেয়ের দিকে। ধ্যানের ভঙ্গিতে দুলছে মাথা। সাদাত পরিষ্কার বুঝতে পারলো, বন্যার নিতম্ব লক-ডাউনে এনেছে শফিক। সাদাতের দিকে তাকিয়ে একবার তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে গোল করে বোঝালো, “জোস!”

তেতো মুখ নিয়ে শফিকের দুই বেঞ্চ সামনে গিয়ে বসে পড়লো সাদাত। মোবাইল কিছুক্ষণ গুঁতোগুতি করলো। মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। সামনে থেকে লামিয়া বার বার রিপ্লাই দিচ্ছে। তাকে হুঁ-হাঁ করে পাশ কাটানো যাচ্ছে না। তোমার কি হয়েছে? তুমি আমাকে ইগনোর করছো কেন? ভালবাসো না আর আমাকে? ইত্যাদি ইত্যাদি রাজ্যের বালছাল। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে গেল সাদাতের।

পেছন থেকে কেউ মাথায় টোকা দিতেই দ্রুত ঘুরে তাকালো ও, মুখের আগায় চ-বর্গীয় এক গালি এসে গেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তবে গালিটা ঝাড়া গেল না।

পেছনে উজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছে তানিশা। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছে ক্লাসে। বললো, “প্রেম হচ্ছে? আজকে ক্লাসে পর থাকিস তো একটু।”

প্রেম যে হচ্ছে না, সেটা বোঝানোর জন্য বিস্তৃত এক হাসি উপহার দিলো সাদাত। সামনের বেঞ্চ থেকে কটমট করে তাকিয়ে আছে লামিয়া। তার দিকে তাকিয়ে পিত্তি জ্বালানো হাসি দিলো তানিশা। লামিয়া-সাদাতের প্রেমের কথা সে জানে। তবে থোরাই পরোয়া করে। সাদাতের সঙ্গে তার কোন বিশেষ সম্পর্ক নেই। পরোয়া করার মানে হয় না। লামিয়া অবশ্য ডালের রঙ যে কালো হয়েছে তা বুঝতে পেরে গেছে।

তানিশা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, রীতিমতো আঁতকে উঠলো লুচ্চা শফিক।

তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে জানতে চাইলো সাদাত, “কি হলো, ব্রাদার?”

শফিক এবার কিছু বললো না। কটমট করে সে-ও তাকালো সাদাতের দিকে।

একটা উলের জ্যাকেট উল্টো করে কোমরে বেঁধে রেখেছে তানিশা। দেখাচ্ছে একদম টম বয়ের মতো। লুচ্চা শফিক বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো। পাত্তাই দিলো না সাদাত।

নিজের মন্তব্য জানিয়ে শুধু বললো, “জ্যাকেটটা জোস!”

**

কলেজ ছুটির পর নিজে থেকেই এগিয়ে আসলো তানিশা। বিল্ডিং থেকে মেইনগেটের দূরত্বটুকু পার হতে হতেই কথা যা হওয়ার হয় ওদের মধ্যে। আজকে তানিশাকে স্বপ্রতিভ দেখাচ্ছে। সাদাতের ডানহাতের কনুইয়ের কাছে জড়িয়ে ধরে হাঁটছে সে। কলেজের ছেলেরা ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকাচ্ছে। মেয়েরা বিরক্তিতে কুঁচকাচ্ছে নাক। ভাগ্যিস আশেপাশে লামিয়া ছিলো না। শেষ ক্লাসটা না করেই মন খারাপ করে বের হয়ে গেছে সে। সাদাতের সাথে ছুটির পর ঘুরতে যেতে চেয়েছিলো। সাদাত বলেছিলো, “মেয়েমানুষের মতো খালি ‘ঘুরতে যাবো-ঘুরতে যাবো’ করবা না।”

গেটের কাছে এসে তানিশা ওর কনুই ছেড়ে দিলো। মেয়েটার মনে কি চলছে বোঝা দায়। এগিয়ে যাওয়ার কোন ইঙ্গিত সে দেয়নি। সম্ভবতঃ “ঝুলিয়ে রাখা” হয়েছে সাদাতকে। ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিট। সাদাত কিছু মনে করছে না। তানিশার কাছাকাছি থাকতে পারলেই সে খুশি। কোকড়া-রেশমি ওই চুলের পরশ মাঝে মাঝে গালে পেলেই তার চলে যাবে। লামিয়া নরকের অনন্ত আগুনে জ্বলে মরুক। কোন আক্কেলে যে ওই মেয়ের সাথে প্রেম করতে গেছিলো সে!

তানিশার সঙ্গে কথা বলার নমুনা মোটামুটি এরকম।

“দ্যাখ দ্যাখ, আম গাছে মুকূল ধরেছে।”

সাদাত জবাব দেবে, “আমের সিজনে আম ধরবে না তো কি লিচু ধরবে রে?”

“তাও ঠিক। এই আমগুলো কি কলেজ অথরিটি মেরে খেয়ে ফেলে?”

“সম্ভবতঃ। পেটুক শালারা।”

“ওই দ্যাখ, তরুর সাথে নতুন একটা ছেলে। খিক খিক খিক।”

“তাই তো দেখছি। শালী ভালোই ছেলে পটাচ্ছে।”

“আমাকে পটাবি তুই?”

“মানে কি?”

“কিছু না।”

সাদাত জানে এসবই তানিশার কাছে খেলা। সাদাতের ভেতরে তার জন্য দুর্বল কোন কোণ আছে, এটা সে জানে। সুবিধাটা পুরোদমে ব্যবহার করছে মেয়েটা। সাদাত জানে এই মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া চলবে না। সোজা খুপড়ি উড়ে যাবে। মেয়ে নিজেও ওড়াতে পারে সেটা।

সামনে তাকাতেই জমে যেতে হলো সাদাতকে।

সবুজ পাজেরোর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রিটায়ার্ড কর্ণেল। সরাসরি তাকিয়ে আছেন সাদাতের চোখের দিকে।

অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সাদাতের হাত ছেড়ে দিলো তানিশা। কর্ণেলের দৃষ্টি সেজন্য বিন্দুমাত্র নরোম হলো না।

মেঘগর্জনের সুরে বললেন, “ছেলে, গাড়িতে ওঠো!”

ছেলের হাঁটুতে তখন জোর নেই!

৫.

কখনও কখনও মনের গহীন থেকে সতর্কবার্তা শোনা যায়। “করো না, এই কাজ ভুলেও করো না!” তারপরও শুধুমাত্র এড়িয়ে যাওয়ার সৎসাহসের অভাবে ঠিক সে কাজটাই করা হয়ে যায়। যেমন এই মুহূর্তে কর্ণেলের ডাককে উপেক্ষা করতে সাদাত পারলো না। টুক করে গাড়ির ভেতরে বসে পড়লো। প্যাসেঞ্জারস সিটে। ড্রাইভ করছেন কর্ণেল স্বয়ং।

ভয়ে ভয়ে ভেতরটা একবার দেখে নিলো সাদাত। আগ্নেয়াস্ত্রের অনুপস্থিতি স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিলো তার মনে। খুপড়ি নিয়ে আপাতত চিন্তার কিছু নেই দেখা যাচ্ছে। তবে ভদ্রলোকের মেজাজ খুব একটা প্রসন্ন বলেও মনে হচ্ছে না। বিষয়টা চিন্তাতে ফেলার মতো। তানিশা বসেছে পেছনের সিটে। রিয়ার ভিউ মিররে তার চেহারা ঠিক অ্যাঙ্গেলে আসছে না। আবার কর্ণেলের সামনেই তার মেয়ের দিকে ঘাড় ঘুররিয়ে তাকানো ঠিক হবে কি না সাদাত বুঝতে পারলো না।

“তানিশার ক্লাসেই পড়ো তুমি?” মেঘগর্জন শোনা গেল আবার।

“জ্বি।”

“বাবা কি করে?”

“শিপ… মানে শিপিং বিজনেস।” গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো সাদাত।

তারপর আরও কিছুক্ষণ নীরবতা। গাড়ির ভেতরে কোন শব্দ নেই। সাদাতের আজ লুচ্চা শফিকের কথা বার বার মনে পড়ে। ও ব্যাটাকে তানিশার সাথে ঝুলিয়ে দেওয়া গেলেই বোধহয় ভাল হতো। এখন জাঁদরেল এক কর্ণেলের সঙ্গে বসে থাকতে হতো লুচ্চা শফিককে। তার জায়গাতে বসে আছে সাদাত। সব বিপদ কেন যেন ভাল মানুষগুলোর সঙ্গেই ঘটে থাকে। খারাপ লোকেরা বেঁচে যায় দিব্যি।

“তানিশাকে ভালবাসো?”

এবার সাদাত ঢোক গিললো। বুড়ো বলে কি এসব? ছুপা সালমানকে কোনদিনও দেখেনি সাদাত, তবে আজ বেচারার জন্য বড় মায়া হলো তার।

“একটা প্রশ্ন করেছি তোমাকে। উত্তর দাও।”

“অ্যাঁ?”

“বাসো তাহলে! তা আমি তোমার চোখ দেখেই বুঝেছিলাম। দেখা হি পেহলি বার, ছোকড়া তোর আখে উয়ো পেয়ার।”

“জ্বি, জ্বি।” বিনয়ের অবতার ঘোষণা করলো।

“তানিশা, ওকে কি এখনও সত্যটা জানিয়েছো?” গরগর করে উঠলেন রিটায়ার্ড কর্ণেল।

বুকটা ধ্বক করে উঠলো সাদাতের। সত্যটা! এহেন সত্য কোনদিনই ভাল কিছু হয় না।

কি সত্য?

তানিশার সঙ্গে কর্ণেলের সম্পর্ক কি ভুল জানানো হয়েছে সবখানে? কর্ণেল আর তানিশা স্বামী-স্ত্রী নয় তো? এমনটা কিন্তু ঘটেছিলো শার্লকের সাথে। ওরা জানতো “বাস্কারভিলের” মিস্টার স্টেপলটন আর মিস স্টেপলটন ভাই-বোন। এলাকার সবাই তাই জানতো। তারপর তলা দিয়ে বের হলো কি? তারা আসলে জামাই-বউ। ঠ্যালাটা বোঝ!

“না, বাবা।” পেছনের সিট থেকে বললো তানিশা।

গলায় আর্দ্রতা।

তাও ভাল, সম্পর্কটা এখনও বাবা-মেয়ের আছে! হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সাদাত।

“কি সত্য?” সাহস করে জানতে চাইলো ও।

“হ্যাঁ, তানিশা, বলো বলো!” আবারও উৎসাহ দিলেন কর্ণেল।

“কি বলো, বাবা! প্লিজ!” তানিশার গলা আরও ভারী হয়ে এসেছে এখন।

বিব্রত বোধ করলো সাদাত। বিড়বিড় করে বললো, “থাক নাহয়।”

“থাকবে কেন? আরে থাকবে কেন! তানিশা, তুমি বলবে না আমি বলবো?” রিয়ার ভিউ দিয়ে মেয়ের দিকে কড়া করে নজর দিলেন তিনি।

“প্লিজ…”

তানিশা এবার সত্যি কেঁদে ফেললো। দুই গাল রাঙা হয়েছে। লজ্জা আর অপমান।

“আমি শুনতে চাইছি না, আংকেল। থ্যাংকস।” বললো সাদাত।

“শুনবে না মানে? অবশ্যই শুনবে।” গরগর করে উঠলেন তিনি, “তানিশার প্রিম্যাচিউর মেনোপজ ঘটেছে। এর অর্থ তুমি জানো, ছেলে?”

“জ্-জ্বী!” মেয়ের সম্পর্কে এমন অবলীলায় কথাটা বলে ফেলতে দেখে অবাক হয়ে গেল সাদাত।

তানিশা কোনদিনও মা হতে পারবে না!

সবজান্তার ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন রিটায়ার্ড কর্ণেল, “ইঁচরে পাকা ছেলেপেলে সব। এরপর আর কোনদিন তানিশার আশেপাশে তোমাকে দেখলে পাছার চামড়া তুলে ফেলবো। বোঝা গেলো?”

“জ্বি?”

“এরপর আর কোনদিন তানিশার আশেপাশে তোমাকে দেখলে পা-”

“জ্বি জ্বি।” দ্রুত বললো সাদাত। কার? এটা জানতে চাওয়ার সাহস তার আর নেই এখন।

তানিশাদের বাড়ির সামনে এসে থেমেছে সবুজ পাজেরো। আশা নিয়ে কর্ণেলের দিকে তাকালো সাদাত।

ভদ্রলোক শুধু বললেন, “গেট লস্ট।”

 ৬.

বাড়ি ফেরার পথে বাগানের দিকে চোখ পড়লো সাদাতের। পার্কটা ছোট। তার মধ্যে আছে সিমেন্টের চেয়ার। তার একটায় বসে আছে মেয়েটা। হলুদ রঙের জামা পরেছে। এদিকে পিঠ ফিরিয়ে রাখলেও মেয়েটিকে চিনতে ভুল হয়নি সাদাতের।

বাড়ির দিকে না এগিয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল সে।

বড় বড় চোখ মেলে তার দিকে তাকায় সে, “তাই, না?”

“লামিয়া।” বিড়বিড় করে বললো সাদাত, আজকের দিনটায় কুফা লেগেছে, “এখানে কি করছো তুমি?”

জবাবটা এলো না। লামিয়ার চোখ ফুলে গেছে। মনে হচ্ছে কান্নাকাটি হয়েছে একটু আগে। এখন সেকেন্ড স্টেজ চলছে।

“তানিশার শরীর আমার চেয়ে ভাল।” মন্তব্য করার ভঙ্গিতে বললো লামিয়া।

প্রমাদ গুণলো সাদাত, “এসব কি হচ্ছে, লামিয়া?”

“চেহারাও।”

“আজব কথাবার্তা বলছো তুমি!”

“দুনিয়ার যে কেউ তোমাকে দেখলেই বলতে পারবে, শালীর প্রেমে পড়েছো তুমি। সেখানে আমি তোমাকে আর যে কারও থেকে ভাল চিনি।”

“এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে!” সাদাত নিজেই গলাতে জোর পেলো না।

“শাট আপ!”

লামিয়া কাঁদছে। লামিয়ার কান্না দেখতে সাদাতের বরাবরই সুন্দর লাগতো। ঠোঁট দুটো কিভাবে ফুলে যেত, তারপর পানি পড়তো চোখ থেকে মুক্তোর মতো। শুধু এই দৃশ্যটা দেখার জন্যই কতোবার মেয়েটিকে কাঁদিয়েছে সাদাত। তবে আজকে লামিয়ার কান্না দেখে তার কাছে সুন্দর কিছু মনে হলো না।

কুৎসিত!

অত্যন্ত কুৎসিত দেখায় মেয়েটি কাঁদলে।

অঝোরে কাঁদছে লামিয়া। এখনও। কাঁদতে কাঁদতেই কিছু একটা বললো সে। সাদাত ঠিক বুঝতে পারলো না।

“কী!”

“তুমি নাকি … তুমি নাকি প্রথমদিন ক্লাস শেষেই তানিশাকে বলেছো…”

“কি বলেছি?” অবাক হয়ে গেল সাদাত।

লামিয়ার কান্নার দমক বেড়ে গেল আরও, নিজের কথাটা শেষ করতে পারলো কোনমতে, “…ওর পাছাটা জোস!”

ধপ করে ওর পাশে বসে পড়লো সাদাত। তালগোল পাকিয়েছে সব। ভালোই পাকিয়েছে!

খবর রিলে করার মানুষটা কে হতে পারে? লুচ্চা শফিক ছাড়া আর কে হবে!

লামিয়াকে দেখে হঠাৎ মায়া হলো সাদাতের। মেয়েটা ভুল তথ্য পেয়ে মন খারাপ করেছে।

হাত বাড়িয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিলো সাদাত।

মেয়েটার কান্না থেমে গেছে। দূরে কোথাও একটা কোকিল ডাকলো বলে মনে হলো সাদাতের।

ওর ডান হাতটা নিয়ে নিজের গাল ঠেকালো লামিয়া। নরোম একটা হাত।

পরমুহূর্তে বত্রিশটা দাঁত ঢুকে যাওয়ার তীক্ষ্ণ ব্যথা টের পেল সাদাত।

হাতের তালুতে খুব জোরে কামড়ে ধরেছে লামিয়া!

৭.

দুর্দিনেও সাদাতের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের হতে দেখে খুশিতে আজ ছুপা পলাশের মুখ উজ্জ্বল হলো না। ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো, “আরেক মেয়ের মানে?”

ফস করে আগুন জ্বালিয়ে সিগারেট ধরালো সাদাত, “তানিশা।”

চোখ কুঁচকে গেছে পলাশের, “ওই মাগির ঘরের মাগি?”

“হোয়াট? মুখ সামলে কথা বলবি, পলাশ!” ঝাঁ করে মাথাতে রক্ত উঠে গেল সাদাতের।

“তাতে করে কি ওর পরিচয়টা মিথ্যা হয়ে যাবে?” খুব অশ্লীলভাবে হাসলো পলাশ, “ওই ব্যাটা কর্ণেলের চরিত্র সুবিধার না।  তানিশার মাকে ফাটিয়ে দিয়েছিলো। মেয়েটা সিলেটের কোয়ার্টারে দুধ বিক্রি করতো। সু্যোগের সদ্ব্যবহার। তেজ তো দেখছিস লোকের। একদম ছিবড়ে বানিয়ে দিয়েছে ওই মাইয়াকে। এরপর দুধওয়ালী নাকি তিন মাস পা ফাঁক করে করে হেঁটেছে। নয় মাসের মাথায় বাচ্চা পয়দা সারা।”

সাদাতের পৃথিবীটা দুলে উঠলো হঠাৎ। পলাশ তার সাথে ট্রিকস খাটাচ্ছে? তানিশার দিকে তারও চোখে পড়েছে নাকি!

পলাশ কেন মিথ্যা বলতে যাবে!

“ছুপা সালমানের কাহিনী লুচ্চা শফিক বানায় কয় নাই।” বিষণ্ন কণ্ঠে বললো পলাশ, “সালমান নামে একজন ছিলো ঠিকই। তানিশাদের বাড়ি গিয়ে তার জন্ম পরিচয় সম্পর্কে যা-তা বলার পর কর্ণেল তার মাথায় গুলি করে।”

সাদাতের কান ভোঁ ভোঁ করছে। সিগারেটের ধোঁয়াগুলোকে আজ বড় বিষাক্ত মনে হচ্ছে তার।

“আমি ভাবছিলাম, সব লুচ্চা শফিকের বানোয়াট গল্প। সেজন্য সিলেটে খোঁজ লাগায়া দেখি কাহিনী সেই লেভেলের হিন্দী সিরিয়াল।”

“খুনের মামলায় ফাঁসলেন না যে কর্ণেল?” জানতে চাইলো সাদাত।

“হোম ডিফেন্স বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে ওটাকে। প্রোপার্টি তো কর্ণেলের। তাছাড়া সালমানের রেপুটেশন ভাল ছিলো না। অ্যাটেম্পট টু রেইপ বলতেই সব ঠাণ্ডা।”

“তানিশার মা…”

হাহা করে হাসলো আবারও পলাশ, “বললাম না, কর্ণেলের তেজ ছিলো। একদম ফাটিয়ে দিয়েছিলো মাগিকে। মেয়ে জন্মাইছিলো, সেই সাথে মারা গেছিলো মা। পিউর চোদন! জাউরা-চোদা…”

পলাশের হা হা করে হাসতে থাকা দেখে সাদাতের আজ যোগ দিতে ইচ্ছে হয় না তার সাথে। বরং ঘৃণায় তার শরীর রি রি করে ওঠে।

মুষ্ঠিবদ্ধ হাতটা পলাশের নাকে এসে আছড়ে পড়তেই হাড় ভাঙ্গার ভোঁতা শব্দটা শোনা যায়।

_ পরিশিষ্ট _

সবুজ পাজেরোর ড্রাইভিং সীটের দরজা সশব্দে লাগানো হলো। কর্ণেল আর তানিশা চলে যাচ্ছে।

কোথায়, তা কেউ জানে না। কর্ণেল জানাননি।

কর্ণেল চাননি তাঁদের গন্তব্য আর কেউ জানুক।

পেছনের সিটে বসে আছে তানিশা। তাকে দেখাচ্ছে ফুটফুটে এক পরীর মতো। মন-খারাপ-করা পরী।

সামান্য মাথা নিচু করে বসে আছে মেয়েটা। এখান থেকে পরিষ্কার দেখতে পায় সাদাত।

মেয়েটার মাথা ছুপা পলাশ নিচু করে দিয়েছে। এলাকার সবাই এখন জানে, তানিশার মা ছিলেন একজন দুধওয়ালী। যার সাথে কর্ণেলের অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক ছিলো। পথে, কলেজে, মার্কেটে, সবখানেই এখন তানিশার জন্মকাহিনী লেটেস্ট মুখরোচক ঘটনা। বিষয়টা মাটিতে পড়তে না দিয়ে সবাই এ নিয়ে আলাপে মগ্ন। তানিশাকে দেখলে এদের অনেকেই টিটকিরির হাসি হাসে।

তানিশার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু হয়ে গেছে সাদাতের। বিয়ে ছাড়াই মহিলার সঙ্গে কর্ণেলের প্রেমকে কেউ মেনে নিতে পারছে না দেখে সে বাকরুদ্ধ। সমাজের নিজস্ব নিয়ম এড়িয়ে গেলে সমাজ ভাল কিছুকেও প্রাপ্য সম্মান দেয় না। অমর্যাদার সঙ্গে ছুঁড়ে দেয় মাটিতে।

সমাজ মনে রাখেনি কর্ণেল ভদ্রলোকের নিষ্কলুস প্রেমকাহিনী। মনে রাখেনি প্রেমের টানে প্রেয়সীর মৃত্যুর পরও সন্তানের দায়িত্ব এড়িয়ে না যাওয়া একজন সংগ্রামী মানুষকে। সমাজ বিয়েহীন এক যৌনসংস্রবকে মনে রেখেছে শুধু।

জানালা দিয়ে বাইরে থুতু ফেললো সাদাত। ঘৃণার ঘ্রাণ লেগে আছে সে থুতুতে।

তানিশার জন্মটা হয়তো পাপের সমীকরণের একপ্রান্তে।

হয়তো, জন্মের পরও সমীকরণ মেলেনি মেয়েটির, সৃষ্টিকর্তা কেড়ে নিয়েছেন তার সন্তান জন্মদান ক্ষমতা।

হয়তো লামিয়া এখনও তাকে প্রচণ্ড ভালবাসে!

সেজন্য তানিশাকে জীবন থেকে হারিয়ে যেতে দিতে পারে না সাদাত।

লুচ্চা শফিকের গাড়িটা একদিনের জন্য ধার করে নিয়েছে ও।

আস্তে করে ইগনিশন কী ঘোরালো সাদাত। পিছু নিলো সবুজ পাজেরোর।

— ০ —-

** কিছু বাস্তব চরিত্র অবলম্বনে [শফিক, তানিশা, পলাশ, সাদাত। ছদ্মনাম।]

আলোগুলো দূরে সরে যায়

বুকের ভেতর তীব্র একটা ব্যাথা হচ্ছে। যন্ত্রণাটা শারীরিক নয়।

নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে ফেলতে হবে আমাকে। তিন টান দিতে না দিতেই হাতের সিগারেটটা অর্ধেক হয়ে গেছে।
ধোঁয়া কি আসলেই ভেতরের আগুন নেভাতে পারে? পারে না।
এই মুহূর্তে ধোঁয়াতে কাজ দেবে না। প্রয়োজন হারিয়ে যাওয়া।

মন খারাপ থাকাটা শুধুই একটি স্বাভাবিক মানসিক ব্যাপার হতে পারে – কিন্তু ফেলে দেওয়ার মত নয় তা।
রাস্তায় নেমে আসলাম।
হাত তুলতেই ওপাশ থেকে আসতে থাকা ব্যাটারিচালিত অটোটা থেমে গেল।

‘মামা, সিগারেটে সমস্যা হবে?’ অটোচালককে প্রশ্ন করি হাতের সিগারেটটা দেখিয়ে। কারও অসুবিধে আমার জন্য হবে সেটা চাই না।
‘না, মামা। সামনে বসেন।’ নিজের পাশের একচিলতে জায়গাটা দেখিয়ে দেয় অটোড্রাইভার।
কাজেই চট করে বসে পড়লাম।

এমনটা না যে কোথাও যাচ্ছি আমি। এটা শুধুই ছুটতে থাকা। অটো আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে – আমিও সেখানে যাব।
সিগারেটে আরেকটা টান দেই। ভাবছি, ফুসফুসের আয়তন কত হতে পারে আমার?
হিসেবটা একেবারে অ্যাকুরেটলি করা সহজ না। তবুও আয়তন বরাবর ধোঁয়া ভেতরে স্টোর করে রাখতে পারলে হত! বার বার টানাটানির ঝামেলাতেই আর যেতে হতো না তখন। চিরন্তন পিনিক।

‘মামা, এটা কি সিগারেট?’ অটোওয়ালা জানতে চেল কৌতুহলী গলায়।
‘ব্ল্যাক।’ নিরুত্তাপ গলায় জবাব দেই আমি। এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না।
‘শেষের দিকে একটু দিয়েন। টেস্ট করতাম।’ সামনের রাস্তায় নজর রেখে বলে অটোড্রাইভার।
‘আচ্ছা।’

রাজি তো হলাম – কিন্তু মনের যে অবস্থা – আমারই হবে না এই এক ব্ল্যাকে। আরও কয়েকটা ব্ল্যাক নিয়ে ওঠা দরকার ছিল।
অটোড্রাইভারের মুখে বিমল একটা হাসি দেখা যাচ্ছে। আবিষ্কারের আনন্দ তার চোখে। নতুন অনুভূতি আবিষ্কার করার সুযোগ পেলে মানুষের আনন্দ হয় – এই একটা কারণেই হয়ত পৃথিবীর বুকে এই প্রাণিটা এত উন্নত!

গতি কমে যেতে থাকে আমাদের। ধীরে ধীরে থেমেই গেল!
সামনের দিকে তাকিয়ে কারণটা বুঝতে পারলাম। একজন হুজুর হাত নাড়াচ্ছিলেন অটোটাকে থামার ইশারা দিয়ে।
অটো থামার সাথে সাথে হুজুর লাফিয়ে উঠে গেলেন ভেতরে।

হুজুরশ্রেণীর মানুষ দেখলেই আমার ভেতর একটা পবিত্র অনুভূতি কাজ করে। অন্য দিন হলে হয়ত সিগারেটটা ফেলেই দিতাম। কিন্তু আজকের কথা আলাদা।
আজ বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এখানে উপস্থিত হলেও আমি ধোঁয়া ছাড়ব।
গলগল করে।

আরেকটা টান দিয়ে অটোড্রাইভারের দিকে বাড়িয়ে দেই অবশিষ্টাংশ।
‘ধন্যবাদ ভাই।’ একটু হেসে আগ্রহের সাথে তুলে নেয় অটোওয়ালা সিগারেটটা।
একটান দিয়ে আমার দিকে আয়নার ভেতর দিয়ে একটা মৃদু হাসি দিল আমার উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ সিগারেটটা ভালো লেগেছে তার।

‘সিগারেটটা ফেলে দাও।’ পেছন থেকে গুরুগম্ভীর গলাতে হুজুর শরীফ বললেন।
‘দেই ভাই।’ আশাভঙ্গের বেদনা চোখে মুখে নিয়ে উত্তর দিল অটোওয়ালা।
দ্রুত আরেকটান দিয়ে সিগারেটটা বাইরের দিকে ফেলে দেয় মানুষটা। চোখমুখ কালো হয়ে আছে।

রাজশাহীর মানুষ এতটা ধূমপানের বিরুদ্ধে সচেতন হল কি করে?
পেছনে অতি মিষ্টি একটা গলা আস্তে করে এসময় বলে, ‘মামা, অটো থামান।’
বাতাসে বেলীফুলের তীব্রগন্ধ পাই আমি সেই সাথে।

অটো থামলো। মাতাল করা গন্ধ বাতাসে ছড়াতে ছড়াতে নেমে পড়লেন আন্টিও। হাত বাড়িয়ে ভাড়াটা এগিয়ে দেন অটোওয়ালার দিকে।
সবার কার্যকলাপই দেখি আমি।
কি সুন্দর জীবনের ব্যস্ততার আড়ালে নিজেদের সব অনুভূতি লুকিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে প্রত্যেকে!
আমার আর এগুতে ভালো লাগে না।

‘আরেকটু রাখেন। আমিও নামব।’ বলে অটো স্টার্ট দেওয়া থেকে বিরত রাখি মামাকে।
ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে কাছের সিগারেটের দোকানটা খুঁজে বের করলাম। খেতে দিল কই অটোতে?

ভদ্রার মোড়টা দূরে নয় বেশি।
সেদিকে এগিয়ে যেতে থাকি। আমার তো আজ আর ব্যস্ততা নেই কোন। শুধু হারিয়ে যাওয়া।
বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার পরিবর্তে সিগারেট স্টিক থেকে বুক ভরে ধোঁয়া নেওয়া।

অন্যপাশ থেকে আসতে থাকা রিকশাটার ভেতর চোখ পড়ে। ছেলেমেয়ে দুটো পাগলের মত একে অন্যকে চুমু খাচ্ছে।
পৃথিবীর আর কোন দিকে ওদের নজর নেই।
চোখ সরিয়ে নেই। এসব অনুভূতির আর কোন মূল্য নেই আমার কাছে।

ভদ্রার মোড়ের পরেই রেইলক্রসিং। বাতাসে ধোঁয়া শুধু আমি-ই ছাড়ি না।
ট্রেনেরা এই কাজটা করে। কম আর বেশি।
আস্তে করে লাইনের পাশে এসে দাঁড়ালাম। মোবাইল বের করে সময় দেখে মনটা খুশি হয়ে উঠল।
এরপরের ট্রেনটা বেশিক্ষণ পরে না। কয়েক মিনিট পর যাবে এদিক দিয়েই।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছি।
এই সময় মেয়েটাকে চোখে পড়ল। এদিকেই আসছে।
খুব সুন্দর করে সেজেছে। মাথা ভর্তি রেশমী চুলগুলো ঝিলিক দিচ্ছে সূর্যের আলোতে।

ফতুয়াটা এসে শেষ হয়ে গেছে কনুইয়ের দুই ইঞ্চি ওপরেই। জিন্সের প্যান্টের সাথে চমৎকার মানিয়েছে ওকে।
রাস্তার ওপাশে থেমে যায় মেয়েটা। আমার দিকে একবার একটু তাকায়।
আমি আরেকবার মোবাইলটা বের করে ঘড়ি দেখি। ট্রেনটা কেন দেরী করছে কে জানে!

এভাবে এর আগেও কয়েকবার এখানে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছি আমি। কিন্তু সেসব দিনগুলোতে ট্রেন দেরী করেনি। দেরী করেছি আমি। আজ একেবারে সময়মত করতে হবে সব কিছু।
ট্রেনটাকে দেখা যাচ্ছে। বড় করে দম নেই আমি।
ওপাশের মেয়েটার দিকে চোখ পড়তে অবাক হই। সেও বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে! সমস্যা কি এই মেয়ের?
উদ্দেশ্য একই নাকি?
মেয়েটার আঙ্গুলের দিকে তাকালাম। খালি!

এবার আমার দিকেও চোখ পড়ে মেয়েটার। বিস্মিত একটা দৃষ্টি ওর মুখেও ফুটে ওঠে।
ওদিকে চোখ না দিয়ে ট্রেনের দিকে তাকালাম। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড।
চোখের কোণে একটা নড়াচড়া দেখতে পেতেই সামনে তাকিয়ে অবাক হই – মেয়েটা ঝড়ের বেগে রেইললাইন পার হচ্ছে।
ট্রেনের ড্রাইভার পাগলের মত হুইসল বাজাতে শুরু করে। কিন্তু অনেক এগিয়ে আছে মেয়ে। লাইন পার হয়ে যায় নিরাপদেই।

আমার পাশে চলে আসতে আসতে ট্রেনটা এসে গেল। একেবারে নিঁখুত সময় টোকা মেরে সিগারেটটা চাকা বরাবর ছুঁড়ে দেই।
এতদিন না হলেও আজ কাজ হয়েছে। কোন এক চাকার মাঝে ঢুকে যেতেই আগুনের ফুলঝুড়ি চারপাশে ছিটকে যায় চারপাশে। মনে হতে থাকে ট্রেনের একপাশে আগুন ধরে গেছে!
অদ্ভুত সেই সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে আছি – ট্রেনটা ঝড়ের বেগে পাশ দিয়ে চলে যায়।
পেছন থেকে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। কি আশ্চর্য! আজ আমাকে সৌন্দর্যটা স্পর্শ করে না!

‘পেয়েছেনটা কি?’ মেয়েকন্ঠের চিৎকারে ঘুরে তাকাতে বাধ্য হই। সেই মেয়েটা।
‘কিছু হয়েছে কি?’ যথাসম্ভব বিনম্র কন্ঠস্বরে পালটা জানতে চাইলাম।
‘লাফ দিলেন না যে?’ দ্বিগুণ বিরক্তির সাথে বলল মেয়েটা।
হতভম্ভ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি শুধু। এই মেয়ে পাগল নাকি?

‘আপনাকে থামাতে নিজের প্ল্যান মাটি করে চলে এসেছি এদিকে আর আপনার … উফফ! এখন যে কি করি! আরও তিন ঘন্টা!’ ঘুরে দাঁড়ায় মেয়েটা।
কিছু কিছু তো বুঝলাম। আমি সিগারেট চাকায় ফেলব তেমনটা ভাবেনি মেয়েটা। ভেবেছিল আত্মহত্যা করতে চেয়েছি।
কিন্তু সেটা না করায় এত রেগে গেল কেন?

মেয়েটা একটু দূরে একটা গাছের নিচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
একটা কুকুর হা করে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। আর আমিও আমার শেষ ক্লুটা পেয়ে যাই।
আর তিন ঘন্টা পর আরেকটা ট্রেন আছে।

তাহলে এই ব্যাপার? চোরের মন পুলিশ পুলিশ?
নিজে ট্রেনের তলাতে ঝাঁপ দিতে এসেছে সেজন্য আমার ব্যাপারেও একই ধারণা?
ভালো তো।

ঘাড়ের কাছ থেকে আবার শুনতে পেলাম, ‘শুনুন?’
ফিরে তাকাই। মেয়েটা ফিরে এসেছে।
‘জ্বী, বলুন?’ শুধু এটুকুই বলি।
মাথা ঝোঁকায় মেয়েটা, ‘একটু আগের ব্যাবহারের জন্য আমি দুঃখিত। আসলে আমার মাথা ঠিক নেই।’

ধীরে সুস্থে আরেকটা সিগারেট ধরালাম আমি। আমার দিকে এবার কটমট করে তাকালো মেয়েটা।
নিশ্চয় সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না?
‘ট্রেনের নিচে লাফানোর জন্য ট্রেন ধরতে এসেও মিস করলে মাথা ঠিক না থাকারই কথা।’ অবশেষে বললাম, ‘ভাববেন না। তিন ঘন্টা পর আরেকটা ট্রেন তো আছে। ওটার নিচে লাফ দেবেন।’
মুখ ঝামটে ওঠে মেয়েটা, ‘এখন আর মরতে ইচ্ছে করছে না! সব আপনার দোষ!’
‘আমি আবার কি করলাম?’ অবাক হয়ে যাই আমি।
‘আত্মহত্যা না করেও সেরকম ভয় দেখালেন কেন? মাঝ থেকে আমার প্ল্যান গড়বড় করে দিলেন!’
‘আহ হা!’ দুঃখ এবং বিরক্তি – একই সাথে প্রকাশ করি আমি, ‘তিনটা ঘন্টার জন্য দাঁপাচ্ছেন কেন?’
‘মরার সাহসটা চলে গেছে।’ আবার মাথা নামায় মেয়েটা।

আমি মেয়েটার ওপর থেকে চোখ সরাতে পারি না। কে জানি বলেছিল, ইরানী মেয়েরা অনেক সুন্দর হয় দেখতে। শোনা কথাতে কান দিয়েছি। আমার অবশ্য এত ক্যাড়া ওঠে নি যে গুগলে সার্চ করে দেখতে হবে আসলেই ইরানী মেয়েদের চেহারা কেমন হয়!
তবে এই মেয়ে ইরানী মেয়েদের ছাড়িয়ে যাবে সন্দেহ নেই।

‘মরার সাহস চলে গেলে বেঁচে থাকুন। অযথা ভাবার তো কিছু নেই।’ স্বান্তনা দিলাম একটু।
‘কাকে নিয়ে বাঁচব?’ হতাশ কন্ঠে বলে মেয়েটা।

এর জরুরী ভিত্তিতে ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন। কাজেই বললাম, ‘চলুন, হাঁটি।’
মেয়েটা একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। আমাকেও একই পথের পথিক ধরে নিয়েছে। কাজেই হাঁটতে বাঁধা কোথায়?
‘আমি লিয়া।’ হাঁটতে হাঁটতেই বলল ও।
‘শোভন।’ পরিচয় দিলাম এতক্ষণে।

কিছুক্ষণ দুইজনই চুপচাপ।
রেইললাইন ধরে হাঁটছি আমরা। কিন্তু একটু আগে এখানেই কোথাও পড়ে থাকার কথা ছিল লিয়ার শরীরটা। দ্বিখন্ডিত অবস্থায়!

‘গার্লফ্রেন্ড ছেড়ে চলে গেছে?’ চট করে জানতে চায় মেয়েটা।

মেয়েদের স্পর্ধা দেখ! ছেলেরা কেবল যদি ‘কিসে পড়েন?’ জানতে চায় অপরিচিত মেয়েকে – তাহলেই নেমে আসে কেয়ামত। আর আমাকে সরাসরি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছে!
তবে কড়া করে কিছু বলাটা অভদ্রতা হয়ে যায়। একটু হাসলাম শুধু লিয়ার দিকে তাকিয়ে।

‘মেয়েটার কি বিয়ে হয়ে গেছে?’
চুপ করে থাকি আমি লিয়ার এ প্রশ্নে।
‘ও ব্যাপারে কথা বলতে চান না?’ আবার জানতে চায় মেয়েটা। ভারী অসভ্য তো!

‘আচ্ছা। বলতে না চাইলে নেই। আমিও ছ্যাঁকা খাই নি। তবে দিয়েছি।’ আগ বাড়িয়ে নিজের ব্যাপারে বলতে থাকে লিয়া।
‘তাই বুঝি ট্রেন খুঁজছিলেন?’ একটু হাসি এবার আমি।
‘না – আসলে – ছেলেটা ছিল একটা বাস্টার্ড! আমাকে ঠকাচ্ছিল। বুঝে ফেলায় ওকে তাড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু কি যে হয় আমার ওকে ছাড়া! উফফ!’

এই মেয়ের উফফ বলার মুদ্রাদোষ আমার কানটাকে রক্ষা দেবে না আর – পরিষ্কার বুঝতে পারলাম।
‘তাড়িয়ে বেশ করেছেন। এখন নিজেকে তাড়াতে চাইছেন কেন? নয়টা নাকি আপনার জীবন?’ একটু শ্লেষের সাথেই বললাম এবার।
‘একটাই তো!’ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায় লিয়া।
‘তাহলে সেটার কদর তো করতে শিখবেন। অন্তত নিজেকে বেড়াল ভাবতে যাবেন না।’
‘আমি নিজেকে বেড়াল ভাবি?’ কটমটে দৃষ্টিটা ফিরে আসে আবার লিয়ার চোখে। তার মাঝেই টুক করে আরেকটা টান দেই আমি সিগারেটে।
‘বেড়ালদের নয়টা জীবন থাকে।’ জানালাম বিশেষ-অজ্ঞ রাগত তরুণীকে।

মেয়েটার হাতের দিকে চোখ পড়তে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেই।
কারও হাত এখন আমার জন্য সবচেয়ে হীলিং থেরাপি হতে পারে। কারণ খুব একা এই মুহূর্তে আমি পৃথিবীতে। তাছাড়া মেয়েটার হাত বেশ আকর্ষণীয়। দেখলেই ধরতে ইচ্ছে করে।
আমার বদ নিয়ত ভাগ্যিস চোখে পড়েনি মেয়েটার। আপনমনে বকে যাচ্ছে ও।

‘আমি বাসা থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম ওর সাথে – জানেন? মা অনেক কষ্ট পেত – জানি। তবুও।’
এবার ওর দিকে তাকাই, ‘নিজের মার থেকে বয়ফ্রেন্ডকে ওপরে স্থান দিয়েছেন দেখছি!’
‘কষ্টই তো পেত মা একটু। মরে তো আর যেত না। কিন্তু ইমরানকে না পেলে আমি ঠিক মরে যাব।’

ইমরান! ইমরান কি? হাশমী নিশ্চয়?
তাহলে তো কাজ হয়েই গেছে। লিয়াকে ঠকাবে না তো কি? ছেলের যা চরিত্র!
এবারেও আমি একটু হাসলাম শুধু।

রেগে ওঠে লিয়া, ‘দাঁত যে কেলাচ্ছেন বড়? আমার কষ্টের কথা শুনতে খুব ভালো লাগছে – তাই না? নিজে তো আছেন মহাসুখে!’
‘বেশ মানুষ চিনতে শিখেছেন দেখছি!’ আনমনে বলে ম্যাচ বের করলাম। আরেকটা সিগারেট ধরাতে হবে।
‘আমার সামনে একের পর এক সিগারেট টেনে চলেছেন যে? একটা মেয়ের সামনে সিগারেট টানতে আপনার লজ্জা করে না?’ এবার আর কটমট করে তাকানো না – সরাসরি বলেই ফেলে মেয়েটা।
‘আমার সব বান্ধবীই সিগারেট খায়। সিগারেটের দিকে ছেলে-মেয়ে দেখি না আমরা।’ জানালাম লিয়াকে।
‘ছি ছি!’ নাক সিঁটকে বলে ও।
‘সিগারেটের সাথে চা খাব। আপনি আসছেন?’ পাশে হাঁটতে থাকা মেয়েটাকে কেন যে অফারটা দিতে গেলাম আমি নিজেও জানি না।

একমুহূর্ত দ্বিধায় ভোগে মেয়েটা। তারপর বেশ বিরক্তির সাথেই উত্তর দেয়।
‘আসছি। শুধু চা খেতে!’

সামনের টং দোকানটায় টুপ করে বসে পড়লাম আমরা। লিয়ার গেটআপের একটা মেয়েকে এভাবে বসতে দেখে অবাক হয়ে তাকায় অনেকেই।
গায়ে মাখি না আমরা। একটা মেয়ে এইমাত্র মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। এই সময় চারপাশটা অতশত দেখলে চলে না।

‘মামা, দুইটা দুধ চা।’ চা দোকানীকে বলি আমি।
‘আর দুইটা সিগারেট।’ ফট করে বলে বসে লিয়া। অবাক হয়ে পাগলাটে স্বভাবের মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি আমি। তবে এর মাঝেই দোকানদার মামা প্রশ্ন করতে ভোলে না।
‘কি সিগারেট?’
‘শোভন – কি সিগারেট খান?’ প্রশ্নটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দেয় লিয়া।
‘বেনসন সুইচ।’ চট করে জানালাম। দেখা যাক মেয়ের দৌড় কতদূর!
‘দুইটা বেনসন সুইচ তাহলে।’ দোকানদারের দিকে তাকিয়ে কনফার্ম করে লিয়া।

চা আর সুইচ এসে গেছে।
মেয়েটা আগুন ধরানোর চেষ্টা করছে সিগারেটে। কিন্তু পারছে না।
মুচকি হাসলাম, ‘না খেলে হয় না?’
‘আমার টাকা, আমার সিগারেট, আমার সিদ্ধান্ত। আপনি বলার কে?’ কড়া গলায় বলে লিয়া।

কথা সত্য!
টিপস দেই এবার আমি। ‘তাহলে বাতাস বুকে ভরে নিতে নিতে আগুন লাগান। জ্বলে যাবে।’
সিগারেটটাকে সার্থক করে দিয়ে আগুন জ্বলায় মেয়েটা।
তারপরই মুখ বিকৃত করে। কাশি আটকে বহুকষ্টে বলে, ‘এত বাজে কেন স্বাদ?’
মুখ থমথমে করে শুধু বলি, ‘কি আশা করেছিলেন?’

চুপচাপ সিগারেটে টান দিয়ে যাই আমরা।
চায়ের কাপেও মাঝে মাঝে চুমুক পড়ে।

‘আপনাকে চমৎকার লাগল। বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিতে পারি?’ জানতে চায় মেয়েটা।

তেমন কথা বলি নি। তাতেই চমৎকার লাগলে তো বিপদ!
আমাকে নিরুত্তর দেখে হাতের সিগারেটটা দেখিয়ে আবার বলে মেয়েটা, ‘বান্ধবী হওয়ার গুণ কিন্তু রপ্ত করেছি।’
‘বন্ধুত্বের প্রস্তাব গ্রহন করা হল।’ জানাই ওকে।
‘আপনার নম্বরটা দেওয়া যাবে? বন্ধু হারাতে চাই না।’ সরল মুখে বলে লিয়া।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে নম্বরটা বলি, সেই সাথে যোগ করি, ‘আমার ফোনফোবিয়া আছে। মেসেজ দিলে রিপ্লাই পাবেন। কল রিসিভ করার গ্যারান্টি দিতে পারব না।’
এক মুহূর্ত থমকে যায় লিয়া। বোঝার চেষ্টা করে কথাটা সত্য কি না।
তারপর একটু হেসে বলে, ‘নো প্রবলেম।’

উঠে দাঁড়াই আমি।
‘চললাম। কাজ আছে।’
দাঁড়ায় মেয়েটাও, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।’
‘কে আছে ওখানে?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করে লিয়া।
‘আছে না। ছিল। আম্মু মারা গেছে দুই ঘন্টা হল। চলি।’

হতভম্ভ ইরানী বালিকাকে পেছনে রেখে হেঁটে যাই আমি।
পৃথিবীটা বড় শূন্য।
বড়ই নিষ্ঠুর!

রচনাকাল – ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৪

নারী

“সরি ভাই।”

পা মাড়িয়ে দেওয়া আঠারো-উনিশ বছরের ছেলেটি শশব্যস্ত হয়ে বললো। ঢিলেঢালা শার্ট, কাঁধে একটা ঢাউস ব্যাগ। ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে তার খুব ঝামেলা হচ্ছে। পায়ের ব্যথাটা টের পেলাম কয়েক সেকেন্ড পর। অমায়িক হাসি দিয়ে ছেলেটাকে বললাম, “ইট’স ওকে।”

কাদামাখা জুতো পায়ে পড়লে এতো মধুর কন্ঠে আমি ইট’স ওকে বলি না। তবে আজকের কথা আলাদা। দুই ভদ্রলোক পরে বাদামি ফতুয়া পরা এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে বেশ, সিল্কি চুলে লালচে ভাব, দুধসাদা ত্বক। তালতলা থেকে উঠেছে, তখন থেকে তার দিক থেকে আর চোখ সরাতে পারছি না।

মেয়েদের দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকা আমার স্বভাবের বাইরে। এই মেয়ে আমাকে স্বভাবের বাইরে বের করে এনেছে। চারপাশে আড়চোখে তাকালাম, তবে সরাসরি তাকালেও সমস্যা হতো না। বাসের প্রতিটি পুরুষের দৃষ্টি এখন তার দিকে। মেয়েটির ভিউয়ারের সংখ্যা লক্ষ্য করলে সালমান মুক্তাদিরও ঈর্ষান্বিত হতেন। এদের মধ্যে একজনের মনোযোগ অন্যদিকে দেখা গেলো। কর্কশ ভাষায় কটুক্তি করে বসলেন বাঁদিকে বসে থাকা চল্লিশোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক।

“সরি আংকেল।” দ্বিগুণ শশব্যস্ত হয়ে বললো ঢাউস ব্যাগওয়ালা ছেলেটা।

“ব্যাগটা হাতে রাখতে পারো না!” কড়া গলায় বললেন যাত্রীটি, “মুগুরের বাড়িতেও তো কম ব্যথা লাগে। ভেতরে কি কামানের গোলা নিয়ে ঘুরছো নাকি?”

সদ্য তারুণ্যে পা রাখা ছেলেটির মুখ কাঁচুমাচু হয় গেলো। খুব সম্ভব ভর্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া কোনো যোদ্ধা। কোচিং থেকে ফিরে আসছে। বাইরে বিকেলের শেষ আলো।

হট্টগোলের শব্দ শুনে দুধসাদা মেয়েটি ফিরে তাকালো। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য তার চোখে আটকে গেলো আমার চোখ। হাল্কা বাদামি চোখ একেবারে ম্যাচ করে গেছে ফতুয়ার সাথে। দুম করে প্রেমে পড়ে গেলাম। মেয়েরা নাকি ছেলেদের চোখ দেখে সব বুঝে ফেলে। তাচ্ছিল্যের একটা ভঙ্গি করলো সে, পেছনে আমার প্যাকাটির মতো ফিগার আর বাদুড়ের মতো চেহারা দায়ী। তাও খানিকটা আশাভঙ্গের শিকার হলাম।

মেয়েটি আবারও সামনের দিকে মুখ ফেরাতেই ঘটে গেলো ঘটনাটা। তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা চট করে ডান হাত বাড়িয়ে পেলব নিতম্বে হাত বুলিয়ে দিয়েছে। দৃশ্যটা দেখে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো। মেয়েটি আবারও ফিরে তাকিয়েছে, তবে এবারের লক্ষ্য আমি নই, যার একটি লম্বা হাত আছে, সে। তার দিকে আমিও তাকালাম।

সুপারম্যানের টি-শার্ট পরা এক যুবক। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হবে। ভুরভুর করে পারফিউমের গন্ধ বের হচ্ছে, চুল স্পাইক করা। ‘স্মার্ট-অ্যাস’ ভঙ্গি চেহারায়। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। যেনো ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না।

দুধসাদা ত্বকের সুন্দরীও বিষয়টিকে দুর্ঘটনা হিসেবে ধরে নিলো। বাসের মধ্যে এখন মাছের বাজারের মতো ভিড়। তার মধ্যে উচ্চস্বরে হেল্পারের কন্ঠ শোনা যাচ্ছে, “বাড়াগুলা হাতে হাতে লন, ভাই। বাড়াগুলা হাতে হাতে লন!”

আমার নিঃশ্বাস এখনও বন্ধ হয়ে আছে। হেল্পার এখন মেয়েটির সামনে। গলা যতোদূর সম্ভব ভদ্র-লয়ে নামিয়ে এনে সে বললো, “আফা, ভাড়াটা দিয়েন।” আমি নিশ্চিত শাপলা চত্বর থেকে তার হুঙ্কার শোনা যাবে তাও।

হৃপিণ্ডটা গলার কাছে লাফিয়ে উঠে এলো। ত্রিশ-ছুঁই-ছুঁই করা যুবক আবারও হাত বাড়িয়েছে। এবার মেয়েটির নিতম্বে চেপে বসলো তার হাত। নরম মাংস ভেতরে দেবে যেতে দেখলাম পরিষ্কার। কানের নিচে আগুনের হল্কা বয়ে গেলো আমার। খানিক বাদে বুঝতে পারলাম, ওটা ক্রোধ ছিলো!

মেয়েটি এবার সরাসরি তাকালো না, ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরেছে। এখান থেকে দেখতে পেলাম, তার দুধসাদা ত্বক লালচে হয়ে উঠেছে অপমানে, লজ্জায়।

ঢাউস ব্যাগটা আমার বুকে দড়াম করে বাড়ি খেলো। হার্ড ব্রেক কষেছে বাস। ছেলেটা মুখ থেকে থুতু ছিটাতে ছিটাতে বললো, “সরি ভাইয়া!”

তার দিকে আমি তাকালাম পর্যন্ত না। আমার চোখের খুনে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ছেলেটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। এক সেকেন্ড পর বুঝতে পারলো, সে দৃষ্টি তার জন্য নয়। ফিরে তাকালো সে, এবং বিশ্বাস করুন, পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, ছেলেটির শরীর শক্ত হয়ে গেছে।

হার্ডব্রেকের সুযোগ নিয়ে মেয়েটির পেছনের লম্পট আরও কাছে ঘেঁষে গেছে। তার হাত এখন মেয়েটির কোমরে যেনো অধিকারবলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাত সরিয়ে নেওয়ার অভিনয় করতে করতে পেছন থেকে হাল্কা করে তার স্তনের একপাশ ছুঁয়ে দিলো দিব্যি।

আমার দু’হাত এখন মুষ্ঠিবদ্ধ। যে কোনো সময় নিয়ন্ত্রণ হারাবো, ঝাঁপিয়ে পড়বো লোকটার ঘাড়ে, ঘুষি মেরে ফাটিয়ে দেবো নাক, থেঁতলে দেবো ইতরটির চেহারা, গলা টিপে ধরবো যতোক্ষণ পর্যন্ত তার জিভ বেরিয়ে না আসে! অজান্তেই ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছি, রাগ আমাকে অন্ধ করে দিয়েছে।

সামনে থেকে বেআক্কেল রিকশাওয়ালা সরে যেতেই বাস আবারও ছুটতে শুরু করলো। লোকটি মেয়েটির শরীর থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে, তবে যথেষ্ট দূরে নয়। অতি লোভে তাঁতী নষ্ট, এই প্রবচন তার জানা। ধরা পড়তে সে চাইছে না।

যাত্রীদের দিকে তাকালাম। মুগ্ধ পুরুষগোষ্ঠির প্রায় সবারই চেহারা এখন টকটকে লাল। কোনো সন্দেহ নেই, বিষয়গুলো তারা লক্ষ্য করেছে। ঢাউস ব্যাগটা আরেকবার আংকেলের মাথায় গিয়ে লাগলো। বেমক্কা আঘাতে ভদ্রলোকের মগজ নড়ে গেলেও তিনি তরুণ ছেলেটিকে এবার আর কিছু বললেন না। তাঁর চোখ স্পাইক করা চুলের ভুরভুরে সুবাস ছড়িয়ে দেওয়া লম্পটের ওপর নিবদ্ধ।

ব্যাগ বহন করা ছেলেটিও লক্ষ্য করেনি তার ‘আংকেল’কে সে ফাটিয়ে দিয়েছে। তার নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শুনতে পেলাম, আমার মতোই ভারি আর গাঢ়, ফোঁস ফোঁসে। মেয়েটির চামড়া টকটকে লাল হয়ে গেছে এখন, ঘাড়ের কাছটা পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছি। তাকে আর দুধসাদা বলার উপায় নেই।

সামনের নিউ ভিশনটিকে ওভারটেক করার সময় সামান্য হেলে গেলো বাস, কোনোমতে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে যা দেখলাম তাতে করে মাথার ভেতর কিছু একটা ছিঁড়ে গেলো। ত্রিশের কাছাকাছি বয়সের যুবক পড়ে যাওয়ার অভিনয় করতে করতে মেয়েটির একপাশের স্তন খামচে ধরেছে। নিমেষের জন্য, তারপরই ছেড়ে দিলো।

আমার সামনের ঢাউস ব্যাগ নিয়ে থাকা ছেলেটির দুই হাত এখন মুষ্ঠিবদ্ধ। আমারই মতো। ব্যাপারটা সে আর সহ্য করতে পারছে না। আবার এগিয়েও যেতে পারছে না। এই ছেলে নেহায়েত পড়ুয়া একজন মানুষ, তার অভিব্যক্তিতে অনভিজ্ঞতা পরিষ্কার। মানুষ পেটানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা দু’জনেই জানি সামনে দাঁড়ানো লোকটা মানুষ নয়, পিশাচ। তবুও তার গায়ে হাত তোলা আমাদের অনভ্যস্ততার কারণে সম্ভব হচ্ছে না।

গাড়ি এখন আসাদগেটের একটু পেছনে। মেয়েটি হেল্পারকে উদ্দেশ্য করে বললো, “মামা, নামায় দিয়েন।”

তার গলায় ক্রোধ কিংবা লজ্জার ছোঁয়া নেই, একদম নিস্তেজ, পরাজিত এক কন্ঠস্বর!

ড্রাইভার গাড়ির গতি কমাচ্ছে। অপমানে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে আসছে। নিজেকে এখন আর পুরুষ মনে হচ্ছে না, কাপুরুষের রক্ত বইছে সারা শরীরে। সুপারম্যানের টি-শার্ট পরা লম্পটও তরুণীর পেছনে পেছনে রওনা দিলো। নধর শরীরের নেশা তার দেহে, বাস থেকে মেয়েটিকে একা একা নামতে দিতে সে চাইছে না।

বাসের গতি পুরোপুরি কমে যেতেই ঘটনাটা ঘটে গেলো। নিচে এক পা রাখা তরুণী আচমকা ঘুরে দাঁড়ালো, শেষ পা-দানিতে তখন স্পাইক করা বদমাশ। হাত ব্যাগ থেকে ছয় ইঞ্চি ফলার একটি ছুরি চোখের পলকে তার গলায় বিঁধিয়ে দিলো মেয়েটি। সামান্য সরে এসে সর-সর করে টেনে নিলো আবার।

ঘরঘর জাতীয় শব্দ উঠছে, লম্পটের রক্তে ভেসে গেলো রাস্তা। সামনে টলে উঠেই দড়াম করে পিচঢালা পথে আছড়ে পড়লো তার দেহ। মেয়েটি ছুরি হাতব্যাগে ভরে দ্রুত উঠে এলো বাসে। হেল্পারকে বললো, “আরেকটু সামনে নামবো।”

স্থবির বাস, তার মধ্যেই পেছনের সিট থেকে একজন চিৎকার করে উঠলো, “খুন! খুন!”

দুইপাশ থেকে দুইজন তরুণ তাকে মৃদু ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো।

পাল্টা কোনো প্রশ্ন হেল্পার বা ড্রাইভার করছে না, এক ফোঁটা রক্তও তাদের বাসে পড়েনি, লম্পটের রক্তে কলুষিত হয়নি যানবাহন, কৃতজ্ঞতার সাথে বাস ছাড়লো ড্রাইভার।

“আসাদগেটে নাইমেন না, চেকপোস্ট আছে। ওইহানে গাড়ি থামানো যাইবো না।” হেল্পার এখন আসলেই মৃদুস্বরে বলছে। এই লোক তাহলে গলা নামিয়ে কথা বলতেও পারে! “আপনারে আমরা ফার্মগেটে সাইড কইরা নামায়া দিমু।”

কোনো প্রশ্ন ভেসে আসলো না, কোনো আপত্তিও না। ঘটনা সবাই দেখেছে।

মেয়েটি একবার ঘুরে তাকালো বাসের ভেতরে, উদ্ধত তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি, গর্ব ঝিলিক দিচ্ছে চোখেমুখে, নারীর রূপ তো এমনই হওয়া চাই!

গালের ওপর রক্তের মৃদু ছোপটুকু বাদে, দুধসাদা ত্বক আবারও তার জৌলুস ফিরে পেয়েছে।

মানাচ্ছে বেশ। শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে এলো।

রচনাকাল – মে ০৮, ২০১৬

ইলিউশন সাইকিয়াট্রিস্ট 

মেয়েটা সুন্দরী, কিন্তু একা দাঁড়িয়ে আছে। পড়নের পোশাক আর অভিব্যক্তিতে আভিজাত্য ঠিকরে পড়ছে। সন্ধ্যাও নেমে আসছে চারপাশটা অন্ধকার করে দিতে দিতে।

এরকম একটা মালকে ছেড়ে দেওয়া যায় না।

চুপচাপ গিয়ে মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। একটু বিরক্ত হয় যেন ও। ভ্রু হাল্কা বাঁকিয়ে আরেকটু দূরে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দেয়। অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি। ক্লান্ত হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কারও জন্য অপেক্ষা করছে? তাই হবে হয়ত। মোবাইলটা বের করে ঝড়ের বেগে ডিসপ্লেতে টাচ করতে শুরু করল এই মাত্র। নিশ্চয় যার আসার কথা তার পিন্ডি চটকাচ্ছে?

এগিয়ে গিয়ে কোন কথা না বলে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলাম।

এতটাই হতচকিত হয়ে যায় মেয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া করতে পারে না। মেয়েটার নিশ্বাস আমার গলায় অনুভব করতে পারছি স্পষ্টভাবে। বেশ ভারী নিশ্বাস পড়ছে এখন আতঙ্ক? একমুহূর্ত পরেই সম্বিত ফিরে পায় অবশ্য কিন্তু তখনও প্রতিক্রিয়া করে না।

আমার বাম হাতে বেড়িয়ে আসা ছুরিটাই যে এর কারণ সেটা বুঝে উঠতে বেশী জ্ঞানের দরকার নেই। একেবারে পেটের সামান্য ওপরে ধরেছি মুখ দিয়ে কিছুই বলতে হয় না আমার হাতটা চলে যায় তরুণীর হাতব্যাগের দিকে।

‘প্লিজ ব্যাগটা নেবেন না।’ মিষ্টি অথচ ভয়ার্ত কন্ঠে প্রথমবারের মত মুখ খোলে মেয়েটা।

টান দিয়ে ব্যাগটা মেয়েটার হাত ছেড়ে ছাড়িয়ে নিতে হল। এমনিতে দেবে না যখন কি আর করা? গোলাপী ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরে সে হতাশায়। আস্তে করে ওর ওপর থেকে সরে আসি আমিও। চটপট আমার ব্যাকপ্যাকে গায়েব হয়ে যায় মেয়েটার হাতব্যাগ। একরাশ অপমান চোখে নিয়ে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

অতশত ভাবি না আমি। আমার ইয়াবার সাপ্লাই শেষ। অন্তত তিনহাজার টাকা পেলে তো দশটা কেনা যায়!

তিনদিনের জন্য একেবারে নিশ্চিত।

গলি ছেড়ে যখন বের হয়ে যাচ্ছি তখন একটু খটকা লাগে।

মেয়েটার দৃষ্টিতে কি আমি অপমান দেখে এসেছিলাম? নাকি ব্যর্থতা?

দুই

বাসে করে মিরপুর-১২ যাচ্ছি।

শফিক মামাকে পেলে হয়। আমার সাপ্লাই সেই কখন থেকে বন্ধ! ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে বেশ।

পাশের ঘাড়ে গর্দানে চেহারার লোকটা গল গল করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। সে যে একটা পাবলিক বাসে আছে কে বলবে এই লোককে দেখলে? ইচ্ছে করেই ভোটকাটার পা মাড়িয়ে দেই আমি। বাসের মাঝে বসে সিগারেট খাচ্ছে! আনন্দের তো সীমা থাকা উচিত একটা!

কড়া চোখে একবার তাকায় শুধু মোটকু। কিন্তু কিছু বলে না।

তারপর একেবারে হঠাৎ গলা নামিয়ে জানতে চায়, ’সঙ্কেত দেওয়া লাগবে না। রেশমা কোথায়?’

এবার আমার ভিড়মি খাওয়ার জোগাড়। রেশমা কে? যার ভ্যানিটিব্যাগ নিয়ে সটকে পড়েছি তার নাম নাকি? এই ভোটকার সাথে তার সম্পর্ক কি? জানলই বা কি করে আমার কাছে মেয়েটার ব্যাগ আছে? কিন্তু, কিছু তো বলা লাগে।

বাসভর্তি মানুষের গণপিটুনী খেতে চাই না।

ভেবেচিন্তে গলা নামালাম আমিও, ’রেশমা আটকে গেছে।’

চুক চুক করে দুঃখপ্রকাশের শব্দ করল লোকটা, তারপর আমার দিকে না তাকিয়েই আস্তে করে আবার জানতে চায়, ’প্যাকেজ কার কাছে তাহলে?’

কোনকিছু না ভেবেই বলে দিলাম, ’আমার সাথেই।’

লোকটাও একথায় আশ্বস্ত হয় বেশ। আমার দিকে একটু ঘুরে জানায়, ’সামনের স্টপেজে নেমে যাব আমরা। রিফাজের লোকেরা পিছু নিয়েছে। একেবারে গলা ফাঁক করে দেবে নাগালে পেলে।’

এ তো দেখছি রীতিমত ঝামেলায় ফেলে দিল আমাকে! গলা কাটাকাটি কেন বাবা এর মাঝে আবার? আমি নিরীহ মানুষ। নেহায়েত ইয়াবার টাকাটার জন্যই মেয়েটাকে লুট করতে হল।

মেয়েটা কে ছিল?

সুবিধের কেউ ছিল না সেটা নিশ্চিত অন্তত। আগেই সন্দেহ হয়েছিল। সন্ধ্যার অন্ধকারে কেন দাঁড়াবে ওভাবে? মেয়ের মাথায় কুচিন্তা না থেকেই যায় না!

মাফিয়াদের লোক?

পেছনে আবার জনৈক রিফাজের উপস্থিতি আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দেয় বৈকি!

‘কাম অন!’ বাস থেমে যেতেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় লোকটা।

দুইজনই সুড় সুড় করে নেমে পড়লাম। এই লোককেও খুব একটা সুবিধের লাগছে না। কিন্তু অন্তত এই মুহূর্তে এ আমার গলার প্রটেক্টর।

বাস থেকে নেমে পড়তেই গলা খাদে নামিয়ে বলে লোকটা, ’তাড়াতাড়ি আমার হাতে প্যাকেজটা দাও। রিফাজের ওরা তোমাকে দেখলেই হামলা করবে। প্যাকেজ যে বাগিয়েছো, পিঠে টার্গেট মার্ক পড়ে গেছে তোমার। কিন্তু আমার দিকে লক্ষ্য করবে না।’

সখটা একবার দেখ! আমার গলা কেটে ফেলবে রিফাজবাহিনী তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই উনার। আছেন প্যাকেজ নিয়ে! চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। এলাকা সুবিধার না। চারপাশে মেইনরাস্তা থেকে ঢুকে যাওয়া গলিগুলো বেশ চিপা চিপা।

তারওপর নেমে এসেছে রাত।

বাবাটা ইয়াবার কথা জেনে ফেলার পর থেকেই শুরু হয়েছে এই হ্যাপা! টাকার উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। কোন কোন স্যারের প্রাইভেট না পড়েও টাকা মারি জেনে ফেলেছে। নয়তো জীবনের প্রথম ছিনতাইটা করা লাগত না আজ আমার। আর ওরকম ঝামেলায় পড়তেও হত না।

বিমর্ষ মুখে লোকটার হাতে আমার ব্যাকপ্যাক তুলে দিতেই চটপট পড়ে ফেলল ওটা। ভালুকের মত শরীরের মানুষটার গায়ে আমার ব্যাকপ্যাক নেহায়েতই ক্ষুদ্র দেখাচ্ছে!

‘ফলো মি! ফাইলটা নিতে পারলেই রিফাজবাহিনী একেবারে থেমে যাবে!’ বলে একটা কানাগলিতে ঢুকে যায় অদ্ভুত মানুষটা।

প্যাকেজ নিরাপদে রাখতে যাচ্ছে নিশ্চয়? আর ফাইলটা নিতে?

ভালো কথা, ফাইলটা কিসের?

আধো-অন্ধকারে গলির মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে থাকা ষন্ডামার্কা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলতে গিলতে ভালুকটার পেছন পেছন গলিতে ঢুকে পড়লাম আমিও।

তিন

আমার ব্যাগটা কাঁধে নেওয়া মানুষটা একজন ষাঁড়।

তবে গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর প্রত্যেকে দেড়জন ষাঁড়। কিন্তু তৃতীয়জন, এঁদের দলনেতা লোকটি বেশ প্যাকাটি গড়নের। প্যাকাটিটা সামনে আসল।

‘চমৎকার আব্রাহাম! নিজেই চলে এসেছ দেখছি!’ চিকণ মানুষটার মুখ থেকে কামানের গোলার মত গর্জন বের হয়ে আসে।

‘কি আর করা! ফাইলের তো আর পা নেই। তাই আমারগুলোকে ধার চেয়েছে কিছুক্ষণের জন্য।’ বেশ হাসিমুখেই বলে আব্রাহাম পিঠে ঝোলানো আমার ব্যাগটার একটা স্ট্র্যাপ ধরল একহাতে।

‘কোন ফাইল?’ চোখ সরু সরু করে জানতে চায় চিকণা।

‘আহা! ন্যাকা আরকি!’ দাঁত খিঁচায় আব্রাহাম, ’তোমাদের বস ভেতরে আছে?’

এ কথায় পেছনের তিন দেড়জন করে সাড়ে চারজন ষাঁড় এগিয়ে আসে কিছুটা।

‘বস কারও সাথে দেখা করবেন না।’  চাছাছোলা গলায় জানিয়ে দেয় ভদ্র চেহারার একজন’বস’-এর বডিগার্ড।

চুপচাপ সেদিকে তাকিয়ে একবার ঘাড় মটকালো শুধু আব্রাহাম। আমি পিছিয়ে আসি দুইপা। ষাঁড়ে ষাঁড়ে লড়াই দূরে সরে দাঁড়াই।

এবার প্যাকাটি দলপতি নিজেই এগিয়ে আসে।

‘গেট লস্ট, আব্রাহাম। ভাইয়ের সাথে দেখা করার আসা ছেড়ে দাও। আর যা ক্ষতি হয়েছে মেনে নাও। সাথে করে বাচ্চা পোলাপান নিয়ে এসেছ আমাদের ঘাঁটিতে সরাসরি? তোমার সাহস আছে বলতেই হচ্ছে।’

বাচ্চা পোলাপাইন আমার ঘাড় হাত-পা সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। আমাকেও দেখছি ওরা গোণায় ধরেছে! তিন ষন্ডার গঠন দেখে হাঁটুতে জোর পাচ্ছি না আর।

আল্লাহর কাছে একবার প্রার্থনা করলাম এখান থেকে জ্যান্ত পালাতে পারলে ইয়াবার জগত ছেড়ে চলে আসব। এরই মাঝে দেখি আব্রাহাম প্যাকাটির পেট বরাবর ঘুষি বসিয়ে দিয়েছে!

প্যাকাটি-টাইপ মানুষটা উড়ে গিয়ে এক ষন্ডাকে সাথে নিয়েই মাটিতে পড়ে।

রইল বাকি দুই।

চমৎকার মুখভঙ্গী করে ছুটে আসছে ওই ষন্ডাদ্বয় আমার নিজেরই গেয়ে উঠতে ইচ্ছে হল, ’ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে!’

আব্রাহাম আমার ব্যাকপ্যাক এক ষন্ডার মুখের ওপর দড়াম করে ফেলে দিতেই’উহা’র গতিবেগ রহিত হয়ে গেল! অপর ষন্ডার মুখে আব্রাহাম আর ব্যাগ নয়   নিজের ছয়মনি হাতই ফেলে দিচ্ছে দেখতে পেলাম। একপাক ঘুরে এক ষন্ডার পতনের সাথে সাথেই আমার ব্যাগ একপাশে ফেলে দ্বিতীয় ষন্ডা একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আব্রাহামের ওপর।

আব্রাহাম একটু কায়দা করে সরে যেতেই টার্গেটকে মিস করে সোজা আমার দিকেই ধেয়ে আসে দ্বিতীয় ষন্ডা। তবে কৌতুকপূর্ণ মুখ নিয়ে পেছন থেকে পা বাঁধিয়ে দেয় আব্রাহাম।

আমিও আব্রাহামের কাছে এইমাত্র শেখা  কায়দাটা করে একটু সরে যেতেই ঝপাত করে একেবারে নর্দমার মাঝে আছড়ে পড়ল ষাঁড়টি।

তৃতীয় ষাঁড়ের দিকে নজর ফেরাতেই দেখতে পেলাম প্যাকাটি-দলপতিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে এখনও  ছেলে! আব্রাহাম সেদিকে নজর দিতেই দড়াম করে সামনের বাসাটার দরজাটা খুলে যায়। প্যাকাটি-দলনেতার’এল্ডার-ভার্সন’ বেড়িয়ে আসে ভেতর থেকে।

‘বাইরে এত হট্টোগোল কিসের, অ্যা?’ সরু গলা দিয়ে সিংহের মত গর্জন করে বলল লোকটা।

চার

এই মানুষটাই যে ওই প্যাকাটি ছোকড়ার ভাই এটা বোঝার জন্য আমার তৃতীয়শ্রেণীর ঘিলুই যথেষ্ট। এর কাছেই তাহলে আছে একটা টপ সিক্রেট ফাইল! যেটা দিয়ে ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে পুরো রাফিজ বাহিনীকে। তবে এই লোক আমাদের ঠেকানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করল না।

‘আরে আব্রাহাম যে! এতদিন পর হঠাৎ কি মনে করে?’

‘ফাইলটা লাগবে আমার। দিয়ে দাও। চলে যাই।’ ঝটপট দরখাস্ত করে ফেলে আব্রাহাম।

‘তুমি কি বলছ আমি বুঝতে পারছি না।’ গম্ভীর মুখে বলে দরজা লাগাতে শুরু করল প্যাকাটির বড় ভাই।

ঝট করে একটা পা বাড়িয়ে দরজার শেষ মাথা আটকে ফেলে আব্রাহাম, ’এত সহজে না, মাহমুদ। ভেতরে আসছি আমরা।’

মাহমুদের আপত্তি মোটেও কানে তোলা হল না।

বাইরের তৃতীয় ষন্ডা একেবারে থার্ড আম্পায়ারের মতই বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিতেই মাহমুদের কলার ধরে একটা ঝাঁকুনী দেয় আব্রাহাম।

‘সেনের ফাইলটা। কুইক!’

‘ওই ফাইল আমি পাবো কোথায়?’ অবাক হওয়ার ভান করতে করতে বলে মাহমুদ।

আমি শুধু নাটক দেখছি। আব্রাহামের মত বডি বিল্ড করতে পারলে হত। একাই দুটো ভোটকাকে শুইয়ে দিতে পারলে আমার ইয়াবার টাকার অভাব হত না আর।

পরক্ষণেই একটু আগে করা প্রার্থনার কথা মনে হতেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটলাম।

ফাঁড়া কেটেছে এই ঢের! এবার এখান থেকে বেরিয়েই বাবাকে বলে একটা রিহ্যাবে ঢুকে যাবো। রোজ রোজ মেয়েদের সম্পদ লুট করতে গিয়ে প্যাঁচে পড়ব নাকি?

‘আমি জানি না ওই ফাইল কোথায় গেছে। বহুদিন ধরেই মিসিং শুনেছি।’ বিড় বিড় করে বলে মাহমুদ।

‘তুমি ডিপার্টমেন্ট ছাড়ার পরদিন থেকেই মিসিং ওটা, মাহমুদ! বন্ধুত্বের খাতিরে তোমার দিকে নজর দেইনি এতদিন। কিন্তু এখন ফাইলটা আমার দরকার। আর একটা গান। নাহলে মারা পড়বে আরেকটা নিরপরাধ মেয়ে! মাস্টার তিরমিজির কথা মনে আছে নিশ্চয়? আর তাঁর ছোট মেয়ে ফাল্গুনীর কথা?’

ওদের কথা শুনে এবার আমার কান খাড়া হয়ে যায়। কাহিনীর প্যাঁচ ঘোরতর!

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহমুদ।

‘ফাইলটা নিতে পার। তবে মনে রেখ দিচ্ছি কেবল মাস্টার তিরমিজির কথা ভেবেই। আমার প্রাণরক্ষক তিনি।’

‘এখন তাঁর মেয়ের প্রাণভক্ষক হতে যেও না। রাফিজের চোখ কোনদিকে পড়েছে বুঝতে পারছ? ডাটা সব চলে যাবে একেবারে জায়গা মত। তুমি আমি অথবা মাস্টার তিরমিজি কেউই রক্ষা পারবে না সেটা হলে।’

ভেতরে ঢুকে পড়ি আমরা মাহমুদকে ফলো করে। রান্নাঘরে এনে একটা মাটির নিচে যাওয়ার রাস্তা বের করে ফেলে মাহমুদ মেঝের এক অংশ সরিয়ে।

তারপর নিচে অদৃশ্য হয়ে যায়।

একটু পর বের হতেই হাতের ঢাউস ফাইলটা চোখে পড়তে আমিও ভড়কে যাই।

‘পদ্মার বুকে মাস্টার তিরমিজি আমাকে বাঁচিয়েছিলেন সেই ম্যাসিভ গানফাইটের মাঝেও। সেই ঋণের কিছুটা শোধ দেয়ার প্রচেষ্টা শুধু, আব্রাহাম। তবে লড়াইটা তোমার। আমি আর ফোকাসে আসতে চাই না।’

কোমর থেকে খুলে একটা পিস্তলও বাড়িয়ে দেয় মাহমুদ আব্রাহামের দিকে।

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখি শুধু আমি।

পাঁচ

কোনমতে হেঁটে চলেছি আমি আব্রাহামের সাথে।

দুইজনেই চুপ একেবারে।

আমার মাথায় কিছুরই হিসেব মিলছে না। কোথা থেকে কি হয়ে গেল!

একটা মাত্র ভ্যানিটিব্যাগ চুরি করতে গিয়ে এত বড় ঝামেলায় পড়া লাগবে জানলে কি আর আগাই?

‘কিছু প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেওয়াই যায় তোমাকে।’ মুখ খোলে আব্রাহাম, ’ঘটনার সাথে একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে জড়িয়ে পড়েছ তুমি। আমি, মাহমুদ দুইজনই ছিলাম বাংলাদেশ অ্যান্টি-টেররিজম এজেন্সীর সাথে। কিন্তু আর সবার মতই আমাদেরও একটা কালো অধ্যায় আছে। আমাদের সুপিরিয়র ছিলেন মাস্টার তিরমিজি। উনার প্ল্যান অনুযায়ী আমরা কাজ করতাম যাকে বলে ইয়ে আইনে অবৈধ।’

তাকিয়ে থাকি আমি।

‘যেসব অপরাধীদের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব থাকত, যাদের জেলে ভরে রাখা সম্ভব নয় তাদের মাথাতে সোজা বুলেট ঢুকিয়ে দিতাম আমরা। অ্যারেস্ট করার ঝামেলায় যেতাম না।’

বলে কি! আমার তো রীতিমত গা গুলাচ্ছে। এই মানুষ এতবড় খুনী সেটাই বা কে জানত!

‘জেনে ফেলে শেষ শিকার অভিজিৎ সেন। পালটা আঘাত হানে সে তার লোকেদের নিয়ে। লোকটা ভূতের মত। ডিপার্টমেন্টের এজেন্টরা সিরিয়ালি মারা পড়ছিল মরিয়া হয়ে আমরাও ডাটা কালেক্ট করতে শুরু করি। কিন্তু তার আগেই কাজ হয়ে যায় মাস্টার তিরমিজির বাসায় হামলা চালিয়ে পার্সোনাল ড্রাইভ কেড়ে নেয় কেউ যেটায় আমার আর মাহমুদের সিক্রেট কিলিং মিশনের ডাটাগুলো সবই আছে।’

‘তারপর?’ গোগ্রাসে আব্রাহামের কাহিনী গিলছি আমি।

‘প্রাণপনে হামলা চালাই আমরা সেনের ঘাঁটিতে। সেনকে হত্যা করে উদ্ধার করে আনি হার্ডড্রাইভটা। কিন্তু ততদিনে ডিপার্টমেন্ট সন্দেহ শুরু করেছে। আমাদের তিনজনই চাকরিচ্যুত হতাম ফাঁসী-টাসীও হয়ে যাওয়াটা বিচিত্র ছিল না। কিন্তু উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে আমাদের খুনগুলোর বিচার ঠিকমত হল না। আমাদের ফিল্ড থেকে সরিয়ে ডেস্কজব দেওয়া হল। কিন্তু অফিস ছেড়ে চলে গেল মাহমুদ এরপর, রেজিগনেশন দিয়ে। সেই সাথে কারও চোখে না পড়লেও আমার চোখে পড়ে গায়েব হয়ে গেছে সেনের ফাইল।’

‘ওই ফাইলের সাথে আজকের ছোটাছুটির সম্পর্ক কি?’ না জানতে চেয়ে পারলাম না।

‘সেনের ডানহাত রাফিজ এখন ক্ষমতায়, বাঁধন।’ হাঁটতে হাঁটতেই আমার নাম জেনে নিয়েছে আব্রাহাম।’গতপরশুই মাস্টার তিরমিজির মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে ওরা। আজ জমা দেয়ার কথা ছিল হার্ডড্রাইভটা। তবেই জীবিত ফিরে পাওয়ার কথা ছিল ফাল্গুনীকে। শর্ত একটাই ফাল্গুনীর বোন অহনাকে নিয়ে যেতে হবে হার্ডড্রাইভ।’

‘কিডন্যাপাররা তাহলে মোবাইলে টেক্সটের মাধ্যমে যোগাযোগ করছিল?’ এবার বলি আমি। সবকিছু এখন স্পষ্ট।

যেই মেয়েকে ছিনতাই করেছি আমি, সে দেখা যাচ্ছে কিডন্যাপড ফাল্গুনীর বোন অহনা ছিল!

‘চালাক ছেলে। ঠিকই ধরে ফেলেছ।’

‘আপনাদের ডুবিয়ে দিয়ে কি লাভ রাফিজের?’

‘প্রতিশোধ! আমাদের কারণে ওদের অনেক সহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। রাফিজের বড় ভাই রিয়াদও মারা যায় মাহমুদের হাতে। যে করেই হোক আমাদের ডুবাবে ওরা। এর আগেই আমাদের ফাল্গুনীকে খুঁজে বের করতে হবে।’

‘আগাচ্ছেন কিভাবে?’ সন্দেহভরা কন্ঠে জানতে চাই আমি।

‘ফাইলের সব পৃষ্ঠার ছবি অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি। যথেষ্ট তথ্য আছে। মাহমুদ অহেতুক ভয় পেয়েছিল। সেনের ইতিহাস খুঁড়তে গিয়ে আমাদের কুকীর্তির কথা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য ফাইল সহই কেটে পড়েছিল ও। এখন দেখা যাক অফিস থেকে কোন লিড পাওয়া যায় কি না!’

‘ডেস্ক থেকে বেরিয়ে ছোটাছুটি করছেন কিভাবে?’ জানতে চেতেই হল।

‘স্পেশাল কোয়ালিফিকেশনের জন্য আমাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে এই মিশনে। আমাদেরই কো-ওয়ার্কারের মেয়ের কিডন্যাপিং দেখে ডিপার্টমেন্ট তেঁতে রয়েছে। অবশ্য কিডন্যাপিংয়ের পেছনে কি রহস্য সেটা ওরা জানে না।’

‘তারমানে মুক্তিপণ হার্ডড্রাইভটা দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল অহনা। ব্যাকআপ হিসেবে ছিলেন আপনি। তারমাঝেই হামলে পড়েছি গিয়ে আমি?’

‘হুঁ। শুধু তাই না আস্ত হার্ডড্রাইভ নিয়ে সটকে পড়েছ। কাজেই তোমাকে ফলো করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমার। আর বাসে একটু রহস্যের গন্ধ দিতেই একা একাই চলে আসলে সাথে। ধন্যবাদ তোমাকে।’

মোবাইল ফোন ভাইব্রেট করে ওঠে আব্রাহামের।

‘গট দ্যা লোকেশন। তোমার ব্যাকপ্যাকটা ধার নিতে পারি? শেষ অ্যাকশনে যাচ্ছি। আশা করি ফাল্গুনীকে নিয়ে বের হয়ে আসতে পারব।’

‘আমি যাচ্ছি না সাথে?’ আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে তাকালাম আমি।

‘তোমার এসবে ট্রেইনিং নেই, বাঁধন। মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট করেছ তুমি। এবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।’

রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকি আমি।

সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকা মানুষটা আমার জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে।

বুঝিয়ে দিয়ে গেছে একটা ব্যাপার হয়ত তাঁর নিজের অজান্তেই!

জীবন মোটেও হেলাফেলায় কাটানোর মত জিনিস না। জীবন একটাই।

নিজের জীবনকে ঘুরিয়ে ফেলব আমি।

আর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ অ্যান্টি-টেররিজম এজেন্সীতে গিয়ে ঢোকার একটা ভালো চেষ্টা দিতেই হবে!

ইয়াবার গুষ্টি আমি কিলাই। আজই বাবাকে বলে সোজা রিহ্যাব!

ছয়

ভ্রু কুঁচকে বসে আছেন লিয়াকত হোসেন।

কুঞ্চিত ভ্রুর পেছনে অষ্টম স্কেলের কারণ বিদ্যমান। একটু পর তিনি রেজাল্ট পাবেন।

লিয়াকত হোসেনের বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করছে। তবে তিনি কোন মেডিকেল চেক-আপের রেজাল্টের অপেক্ষাতে নেই। একমাত্র ছেলে শরীফ হোসেন বাঁধনের রেজাল্টের অপেক্ষায় আছেন। ছেলের বয়স কম মাত্র কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে  তবে এরই মাঝে ইয়াবা ধরে ফেলেছে!

ইলিউশন-সাইকিয়াট্রিস্ট ফারদিন আহমেদ চৌধুরী তাঁর বাল্যজীবনের বন্ধুর ছেলে। এই একটা কারণেই তাকে একটা সুযোগ দিয়েছেন। কারণ ইলিউশনিস্ট মনোরোগ বিজ্ঞান বলে কোন বিজ্ঞান এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। এটা ফারদিনের নিজের আবিষ্কার। আর তাতেই কি না নিজের ছেলেকে গিনিপিগ বানাতে সম্মত হয়েছেন লিয়াকত সাহেব!

বয়েসের সাথে কি তার বুদ্ধিশুদ্ধিরও লোপসাধন হচ্ছে?

‘নেশাগ্রস্থ ছেলেরা হতাশার আড়ালে লুকিয়ে আসলে অ্যাডভেঞ্চার খোঁজে।’ ফারদিন বলেছিল সেদিন, ’যদিও এই অ্যাডভেঞ্চারের ব্যাপারে তারা নিজেও জানে না। অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকে সেটা। অথচ অ্যাডিক্টের কোন আইডিয়াই নেই ঠিক কোন কারণে নেশার অতল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে সে। জানতে চাবেন আপনি ফট করে বলে দেবে, “আমার জীবন নিয়ে আমার অনেক হতাশা।” যতসব ফালতু কথা বার্তা। এই ছেলেকেই নিয়মিত হান্টিং রাইফেল দিয়ে শিকারে পাঠান ঝটপট কমে যাবে ড্রাগস নেওয়ার পরিমাণ।’

‘তুমি সাজেস্ট করছ বাঁধনকে আমি শিকারে পাঠাই?’ সামনে বসে থাকা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মনে রোগ আছে কি না সে ব্যাপারেই সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পরেন লিয়াকত সাহেব।

‘না, স্যার!’ হেসে ফেলে ফারদিন, ’এখানেই কাজ করব আমি। বাঁধনকে একটা চমৎকার ইলিউশন দেব। প্রকৃত অ্যাডভেঞ্চারের। এতে ও জীবনের বিস্তৃতিটা বুঝতে পারবে। আশা করি কাজ হয়ে যাবে। আমাদের ওপর ভরসা রাখতে পারেন।’

‘তোমাদের মানে?’ ভারী গলায় জানতে চান লিয়াকত হোসেন।

‘আমাদের টিম আছে একটা। এটা নিয়ে কাজ করছি আমরা। আমি ছাড়া আরও পাঁচজন আছি। ইলিউশন দিতে হলে লোক তো কিছু লাগেই। আপনি শুধু বাঁধন বের হবে যখন আমাকে একটা মেসেজ দেবেন। বাকিটা আমরা দেখব।’

ভরসা রেখে তো ভুল করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। সারাদিন বাঁধনের কোন পাত্তা নেই। যত্তসব অহেতুক তত্ত্ব!

উঠে দাঁড়ালেন লিয়াকত হোসেন। ছেলেটাকে রিহ্যাবে দেওয়াটা দরকার। কিন্তু নিজের ইচ্ছে না থাকলে দিয়ে কাজ হবে না। আবার বের হয়েই নেশাতে ডুবে যাবে!

খুট করে একটা শব্দ হয় পেছনে।

লিয়াকত হোসেন ঘুরে দেখতে পান তাঁর একমাত্র ছেলেকে। আজ ওর চোখে অন্যরকম একটা আভা বাঁধন জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছে!

*

পার্সটা উল্টে পালটে দেখছে ফারদিন। মেয়েটার নাম-ঠিকানা কিছু পাওয়া যায় কি না বের করা দরকার। সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁধন ছেলেটার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে আছে ও। তবুও হাতের কিছু কাজ শেষ করতে হল।

রাত অনেক হলেও আজকের এক্সপেরিমেন্টটার রিপোর্ট লিখে ফেলেছে ও। প্রথম পরীক্ষাতেই সাফল্য!

বাঁধনের বয়েসী ছেলেদের জন্য বেশ কাজের হবে প্রক্রিয়াটা। এখন শুধু ছিনতাই করা পার্সটার মালিককে খুঁজে বের করলেই ওর কাজ শেষ। ভেতরে হাত দিতেই একটা হার্ডড্রাইভ উঠে আসে ওর হাতে।

সরু চোখে সেদিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে থাকে ফারদিন। তারপরেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে ও একটা নামের জন্য।

ছোট একটা কাগজে নাম ঠিকানা আটকানো আছে ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতরের পিচ্চি পার্সটায়।

সেদিকে তাকিয়ে নিশ্বাস নিতে ভুলে যায় ফারদিন আহমেদ চৌধুরী।

‘অহনা তিরমিজি’ নামটা যেন জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে!

 

ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৪