KP Imon

Words Crafted

কোয়াড কোড


নতুন খুলেছে শপিং মলটা।
দোতলা একটা বিল্ডিং। তার মাঝেই অল ইন ওয়ান করার একটা প্রচেষ্টা।
আমি আর মিনহাজ একে অপরের দিকে একটিবার মাত্র দৃষ্টি বিনিময় করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
নীচতলার প্রথমভাগ ফ্যাশন অ্যাকসেসরিজে ভরপুর। ভেতরে ঘুর ঘুর করতে থাকা মানুষগুলোর বেশিরভাগই তরুণী। কয়েকজন যুবককেও ছন্নছাড়ার মত ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এদের চোখ মাঝে মাঝেই চলে যাচ্ছে তরুণীদের ওপর। অবিবাহিতের অভিশাপ!
হাল্কা পায়ে র‍্যাকগুলোর চারপাশে ঘুরছি আমরা। এটা একটা ছুতো মাত্র। ভালোমত দেখে নিচ্ছি চারপাশটা।
কাছে ঘেঁষে এল মিনহাজ, ‘শিওর হচ্ছিস কি করে? হতে পারে রাবেকের আরেকটা চাল এটা।’
মিনহাজকে এখনও কিছু জানাইনি। হাল্কা একটা হিন্টস দিয়ে চলে এসেছি ভেতরে।
কে জানে সময় কতক্ষণ পাওয়া যায়!
একটা বডি স্প্রে ধরে ঘুরিয়ে আবার নামিয়ে রাখি আমি, ‘শিওর হওয়ার উপায় তো একটাই। তাই না?’
আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল মিনহাজ। এমন আর কিছু স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেছে। তারপরই আবার গম্ভীর ভাবটা ফিরে এল ছেলেটার মুখে।
‘ঈশিতা ফোন দিয়েছিল?’
মাথা নাড়ি আমি, ‘না। তবে আননোন কলারের ওপর ভরসা রাখতে হচ্ছে।’
আমার নির্বুদ্ধিতাতে বেশ বিরক্ত হয় মিনহাজ, ‘কিভাবে ভরসা রাখছিস?’
‘আমার যতদিকে নেটওয়ার্ক ছিল সবাইকে লাগিয়েছি তো। কেউ না কেউ জানাতেও পারে। বুঝতে পারছি না ট্রাস্ট করার মত কি না। তবে একবার ঢুঁ মেরে যেতে তো সমস্যা নেই।’
মাথা দোলায় মিনহাজ।
আর মুখে যত যাই বলি না কেন – আননোন ফোনকলের ওপর ভরসা রেখে এখানে আসিনি।
এটা যে একটা ডেথট্র্যাপ হতে পারে সে ব্যাপারে আমি পূর্ণ সচেতন।
‘মিনহাজ?’ ডাকি আমি।
‘ইয়েপ।’ একটু পিছিয়ে গেছিল – চট করে সামনে এসে জানতে চায় ও।
‘গেট রেডি। আমাদের ঘিরে ফেলা হয়েছে।’
চারপাশে একবার আড়চোখে তাকায় মিনহাজ। পরিবেশ সম্পূর্ণ শান্ত। সাধারণ কাস্টোমাররা ছাড়া আর কেউ নেই।
এক কথায় – মোটেও ঘিরে ফেলার মত নয় সিচুয়েশনটা।
‘সেভেন ও’ক্লক। কাঁধে ব্যাকপ্যাক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ। অ্যাট ইয়োর থ্রি, লালচুলো মেয়েটা। গেটের কাছে থাকা গার্ড। স্টাফ ছেলেটা। কোকড়া চুল।’
অবাক হয় এবার মিনহাজ, ‘বেশি ভাবছিস! কিভাবে জানিস?’
‘চোখ ধাঁধানো সুন্দরী নই আমরা।’
‘তো?’
ব্যস্ত হয়ে সামনের দিকে আগাচ্ছি আমরা এখন। যথেষ্ট লম্বা শপিং মলটা, আগা থেকে গোড়া পার হতে বেশ সময় লাগবে। আরও ভেতরের দিকে ইচ্ছে করেই ঢুকছি। শেষ মাথায় ম্যানেজারের একটা রুম আছে। ওটাই আমার টার্গেট।
‘পুরোটা সময় আমাদের দিকে লক্ষ্য রেখেছিল ওরা। অ্যাকনলেজড। অ্যাট ফাইভ – ফোর – থ্রি -’
বাকিটুকু কাউন্ট করি না। মিনহাজকে এক ধাক্কা দিয়ে একর‍্যাকের আড়ালে ঠেলে দিয়ে আরেক র‍্যাকের কাভার নেই আমি।
হাতে ভোজবাজির মত বেরিয়ে এসেছে বিশ্বস্ত গ্লক-২৩ টা। আর আমাদের হঠাৎ নড়াচড়া দেখে একসাথে সামনে বাড়তে দেখলাম আগে থেকে সন্দেহ জেগে ওঠা মানুষগুলোকে।
একই সাথে পার্স হাতড়াচ্ছে লালচে চুলের মেয়েটা।
ব্যাকপ্যাক পড়া তরুণও কোমরের দিকে হাত বাড়িয়েছে।
স্টাফ ছেলেটাকে দেখা যায় র‍্যাকের দিকে ঝুঁকে পড়তে। কিছু একটা তুলে নিচ্ছে।
আর কাভার নেয়া র‍্যাকটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াই আমি। আমার দেখা দেখি মিনহাজও।
আর এরই মাঝে পেরিয়ে গেছে দুটো সেকেন্ড।
বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দটা কানে তালা ধরিয়ে দেয়। একগাদা বডি স্প্রের মাঝে টাইমার সহ একটা বিস্ফোরক রেখে আসার ভয়াবহতা টের পাই এতক্ষণে।
র‍্যাকটাতে আগুন ধরে গেছে।
আমাদের গায়েও শক ওয়েভের ধাক্কা লেগেছে – তবে কাভার হিসেবে একটা র‍্যাক পাওয়ার জন্য ধাক্কাটা সেভাবে লাগেনি অবশ্যই।
ঝট করে বেড়িয়ে আসি এবার আমি।
এত বড় বিস্ফোরণটাকে দিব্যি সামলে কোমর থেকে বের করা পিস্তলটা সরাসরি আমার দিকে তাক করছে ব্যাকপ্যাক পিঠে যুবক – দুই বার গুলি করে মাটিছাড়া করি তাকে। পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে সিকিউরিটি গার্ডকে, সশব্দে এগুচ্ছে সে এখন শব্দটা আসছে তার হাতে মুহুর্মুহু ঝলসে ওঠা উজি থেকে।
কোনমতে আবার গড়িয়ে চলে এলাম র‍্যাকের আড়ালে।
ব্যাটা সিকিউরিটি গার্ড না ছাই! স্রেফ অ্যামবুশ করার জন্য এসে ছদ্মবেশে বসে ছিল!
র‍্যাকের অন্যপাশ দিয়ে বের হতে চাইছিলাম, তখন চকচকে চোখের তরুণীকে চোখে পড়ল। একটু আগে বেড়িয়ে যাওয়া মিনহাজের দিকে গুলি ছুঁড়ছে মেয়েটা।
মিনহাজ একটু সামনে। আমার ডানদিকে। একটা ফ্রিজারের আড়ালে কোনমতে মাথা গুঁজে আছে।
একবার গুলি ছুঁড়ে পিস্তলটাই উড়িয়ে দেই মেয়ের। পরক্ষণেই বুকের কাছে লাল হয়ে যায় মেয়েটার ।
ছিটকে পড়ে মাটিতে।
পেছনে থাকা স্টাফকে চোখে পড়ে এতক্ষণে – চোখের সামনে থেকে বাঁধা দূর করেই আমার দিকে অস্ত্রটা নিমেষে তুলে ফেলেছে মানুষটা! একটা কোল্ট অটোমেটিক।
ঝাঁপিয়ে ডানদিকে সরে যেতে চাইলাম, কিন্তু তার আগেই গর্জে ওঠে অস্ত্র।
এত তাড়াহুড়োতে ঝাঁপাঝাঁপি করতে গিয়ে পাশ থেকে বেড়িয়ে থাকা একটা ট্রলিতে লেগে হাত থেকে পিস্তলটা ছুটে গেল।
শরীরের সম্পূর্ণ ভর নিয়ে বামদিকে আছড়ে পড়লাম, বেশ অসহায় বোধ করছি। মাত্র তিনফিট দূরে পড়ে থাকা পিস্তলটা দেখতে পাচ্ছি আরেকটা র‍্যাকের কাভার থেকে, কিন্তু তুলে নেওয়ার উপায় নেই। মাথা বের করলেই স্রেফ খুলি উড়িয়ে দেবে স্টাফের ড্রেস পরে থাকা বাইরের ওই পিস্তলধারি।
মিনহাজের কাছ থেকে সাহায্যের জন্য একটু আশা করতে যাব – ঠিক তখনই একটা উজি গর্জে উঠতে শুনলাম। সিকিউরিটির ভেক ধরে থাকা লোকটা জ্বালালো দেখছি! পাল্টা জবাব দিল মিনহাজের অস্ত্রও। ওদিকে কোল্টের চিল্লাফাল্লাও শুরু হয়ে গেছে!
মিনহাজের জন্য শঙ্কিত হলাম। একা দুইজনকে সামলাতে পারবে না ছেলেটা। আর আমার পিনডাউনড অবস্থায় করার কিছু দেখছি না।
চারপাশে তাকাই অসহায়ের মত। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।
পিঠের প্রবল ধাক্কাতে কাভার নিয়ে থাকা র‍্যাকটাকে আস্তে করে কাত করে ফেললাম। শুরুতে নড়ছিলই না, তারপর গতি জড়তার কারণে একা একাই পড়তে থাকল ভারী র‍্যাকটা। সেই সাথে খসে পড়ছে তার ওপর থাকা রাজ্যের জিনিস!
সরাসরি গায়ে পড়তে যাচ্ছে ছাত পর্যন্ত থাকা র‍্যাক – দেখে প্রাণপণে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল কোল্টধারী – এই সুযোগে এক ডিগবাজি খেয়ে গ্লকটা তুলে নিলাম। সিকিউরিটি গার্ড আমার দিকে ঘুরে যাচ্ছে, উজির চকচকে নলটা সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে – দৃশ্যটা ভীতিকর। স্রেফ রিফ্লেক্সের বশে দুটো গুলি বেড়িয়ে যায় আমার হাতের নীচে জ্যান্ত হয়ে ওঠা বিশ্বস্ত অস্ত্রটা থেকে।
গার্ডের মাথা গায়েব হয়ে গেছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে ওখান থেকে – তবে এতকিছু না দেখে আরেকবার গুলি করি আমি। উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল কোল্ট ধারী – এবার আবারও হুড়মুড় করে পড়ে গেল।
বাইরে এসে থেমেছে একটা গাড়ি। যে বেগে এসে যেভাবে শব্দ করে থামে – ওতে করে কারা আসতে পারে সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ থাকে না।
ডন রাবেক দেখি একেবারে আর্মি পাঠাচ্ছে!
‘কাভার দে, মিনহাজ।’ একবার চিৎকার ছুঁড়ে ম্যানেজারের রুমের দিকে ছুটে যাই আমি।
ব্লিপটা এখান থেকেই আসছে। ঢোকার আগেই মোবাইলে দেখে ধারণা পেয়েছি।
দরজাটা বাইরে থেকে লাগানো। নব সিস্টেমটা বেশ আধুনিক। দুই লাথিতেও ছুটল না।
যা আছে কপালে – পর পর দুই বার গুলি করি আবারও।
দরজার হাতল উড়ে গেছে। হিসেব সেই শুরু থেকেই মিলছিল না আমার। এখনও মিলছে না।
এই শপিং মলে ঈশিতা কি করছে?
দরজাটা খুলে ফেলতেই একটা ধাক্কা খেলাম।
এটা মানসিক।
রুমটা মোটেও ম্যানেজারের সাজানো গুছানো ঘর নয়।
অত্যাধিক নোংরা এই ঘরের সর্বত্র ধুলো জমে আছে।
সেই ময়লা পরিবেশে হাত পা বেঁধে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে একটা মেয়েকে।
সুন্দর চুলগুলো ধুলোয় নোংরা হয়ে আছে। অবিন্যস্ত চুলে ঢাকা পড়েছে ডান চোখ।
মুখ বেঁধে রাখা হয়েছে মেয়েটির – শব্দ করে কাস্টোমারদের দৃষ্টি আকর্ষণের উপায় রাখা হয় নি তার।
বাম চোখটা সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে।
না – ঈশিতা নয়।
হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে যায় আমার।
ছুটে যাই আমি ফারিহার দিকে।


‘ঠিক আছ তুমি?’ ফারিহার দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানতে চাই আমি ব্যস্ত গলায়।
কিছু না বলে চুপচাপ বসে থাকল মেয়েটা।
কিছু বুঝতে পারলাম না আমি।
ঈশিতার জুতোয় যে ট্রান্সমিটারটা লাগিয়েছিলাম তা কিভাবে ফারিহার কাছে আসল? এমনকী ঈশিতারও জানার কথা নয় এ বিষয়ে। রাবেক টের পেয়ে গেছে?
হবে হয়ত!
‘সব শেষ, রবিন।’ ভাঙ্গা গলাতে বলে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যায় ফারিহা।
ওকে ধরে উঠতে সাহায্য করছি আমি, তার মাঝেই জানতে চাই আবার, ‘কি হয়েছে?’
‘বাবা …’ – বলতে গিয়ে একবার থমকায় ফারিহা, ‘বাবা বেঁচে নেই। মেরে ফেলেছে ওরা। সব শেষ।’
ওকে শক্ত করে ধরে থাকি আমি। চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে আমার।
খবরটা এতটাই আচমকা পেলাম – সামলে উঠতে এমনকি আমারও কয়েক সেকেন্ড লেগে যায়!
ফারিহার বাবা শিল্পপতি রিজভী আকন্দ ছিলেন আমার শ্রদ্ধা কেড়ে নেওয়া একজন মানুষ। নিজে রাবেকের একজন হেডফাইভ হয়েও কথা দিয়ে কথা রেখেছেন। আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন – ঈশিতাকে আগলে রেখেছিলেন আমার অনুপস্থিতিতে! শুধু আমাকে দেওয়া কথা রাখার জন্য! অথচ তখন রাবেক তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল।
সেই মহৎপ্রাণ মানুষটি আর নেই? রাবেকের বাহিনীর কবল থেকে রক্ষা পেল না রিজভী আকন্দের মত একজন মানুষও?
খটকা লাগল তখনই।
বাইরে একটা গাড়ি এসে থেমেছিল। এতক্ষণে ওদের ভেতরে চলে আসার কথা। মিনহাজকে বলেছিলাম ব্যাকআপ দিতে।
কিন্তু কই?
একটা গুলির শব্দও শুনতে পাইনি তখন থেকে।
দ্রুত মুখ খুলি আমি, ‘এখান থেকে বের হতে হবে আগে, ফারিহা। আগে বেরিয়ে নেই। আংকেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী একজনকেও ছাড়ব না আমি।’
আমার চোখ থেকে আগুনের হল্কার মত দৃষ্টি বেরুচ্ছিল, কিন্তু ফারিহার মুখের ভাবের কোন পরিবর্তন দেখলাম না। মেয়েটা মুষড়ে পড়েছে অনেক। এই অপরাধ জগত, এই খুনোখুনি, এই শঙ্কা, প্রিয়জন হারিয়ে ফেলা – এসবের জন্য ওর জন্ম হয়নি। ভাগ্য তাকে টেনে এনেছে এখানে।
ওর কাঁধে একহাত রেখে ছোট দরজাটার দিকে আগাই। দোরগোড়ায় পড়ে আছে আমার গ্লক। ফারিহার বাঁধন খোলার জন্য নামিয়েছিলাম।
কিন্তু ওটার কাছাকাছি পৌছাতে পারলাম না, আগেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল একজন মানুষ।
এক হাতে উদ্যত পিস্তল দেখে বুঝতে বাকি থাকে না পার্ক হওয়া গাড়িটা থেকে কারা নেমেছিল!
একটা হাল্কা ধাক্কা দিয়ে ফারিহাকে একদিকে সরিয়ে দিলাম, লোকটার হাত ধরে মুচড়ে আনলাম নিজের দিকে। তার ভেতর ট্রিগার টেনে ধরেছে নতুন ঝামেলা।
বদ্ধ ঘরের দেওয়ালে কয়েকবার বাড়ি খেয়ে স্রেফ কাকতালীয়ভাবেই পিস্তলধারীর বাম হাতেই গাঁথলো বুলেটটা।
ব্যাটার গলাতে একটা মাপমত কোপ দিয়ে বুক বরাবর প্রাণের সুখ মিটিয়ে লাথি হাঁকালাম। খোলা দরজার ঠিক পাশের দেওয়ালে বাড়ি খেয়ে জ্ঞানহীন দেহটা আস্তে করে বসে পড়ে।
বড় একটা ফাঁড়া কেটেছে – বুলেটটা আমাদের কারও গায়ে লাগতে পারত।
ফারিহাকে এখানে এনে রাখার অর্থ এখন কিছুটা পরিষ্কার আমার কাছে। ঈশিতার খোঁজে ট্রাকিং ডিভাইস ফলো করেও আসতে পারতাম, তবে আমি ঐ লোকেশন নিয়মিত ট্র্যাক করি কি না তা রাবেকের জানার কথা নয়। কাজেই একটা আননোন ফোনকল দিয়ে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে। আর ঈশিতাকে উদ্ধার করা এক ব্যাপার, ফারিহাকে উদ্ধারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন আমাকে আক্রমণাত্মক কৌশল এড়িয়ে চলতে হবে মেয়েটার নিরাপত্তার কথা ভেবে। সেই সুবিধের পুরোটা নেবে রাবেক বাহিনী।
একা থাকলে ইরফান স্রেফ ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে – কিন্তু দুইজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সেটা করাটা অনেকটা কঠিন। কাজেই রাবেককে গুরু মেনে নিলাম।
‘এখানেই থাকো।’ ফারিহাকে বলে চট করে পিস্তলটা তুলে নিতে না নিতেই দ্বিতীয় মানুষটা ঢুকে যায় ছোট ঘরটাতে।
এর মোটামাথায় বিনা নোটিসে গুলি করলাম। দড়াম করে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে মানুষটার হাত থেকে একটা ছোটখাট সাবমেশিনগান ছিটকে পড়ল।
CZW 9 টা দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তেত্রিশ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের সাবমেশিনগানটা ক্ষুদ্র হলেও কাজের।
ছিটকে বের হয়ে এলাম ম্যানেজারের রুম থেকে। পায়ের ধাক্কায় দরজাটা ভেজিয়ে দিতে ভুলিনি। খোলা দরজা দিয়ে বুলেট কিংবা গ্রেনেড ঢুকে ফারিহার দফারফা করে দেক – চাই না।
ঝড়ের বেগে দৌড়াচ্ছি এক র‍্যাক থেকে আরেক র‍্যাকের আড়ালে– সেই সাথে পেরিয়ে যাচ্ছি শপিং মলের ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তিনটি অস্ত্র থেকে বেরিয়ে আসা বুলেটগুলো। তিনজনেরই চোখে সানগ্লাস।
পাশাপাশি দুটো র‍্যাকের মাঝে দিয়ে আমার শরীর বের হয়ে অন্য র‍্যাকের আড়ালে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়টুকুতে সাবমেশিনগান থেকে বার্স্ট শটে ফায়ার করছি।
কাবা শরীফ তওয়াফের মত করে পুরো মার্কেটটা আড়াইবার চক্কর মারতে না মারতেই এলাকা নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
নিথর দেহগুলো দেখে আমার মুখে হাসি ফুটে ওঠার কথা।
কিন্তু তেমন কিছু হল না। একটা মৃতদেহের সামনে এসে থমকে গেছি।
শুয়ে আছে মিনহাজ।
কপালের ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা বুলেট চলে গেছে ওর – সম্ভবত টু-ভার্সেস-ওয়ান ফায়ারফাইটের সময়ই।
পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি।
খুট করে খুলে যায় ছোট ঘরটার দরজা। গোলাগুলির শব্দ থেমে যাওয়ায় বেরিয়ে এসেছে ফারিহা।
আমাকে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে এল সে। এবার তার হতাশ মুখটায় আমি কান্নার অভিব্যক্তি দেখতে পাই।
এগিয়ে গেলাম তবে ওকে স্বান্তনা দিতে নয়, নির্দয়ের মত ওর এক হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকি শপিং মলের বাইরে। কোমরে লুকিয়ে ফেলেছি গ্লক, ফেলে দিয়েছি CZW-9।
একটা র‍্যাক থেকে দুটো সানগ্লাস তুলে একটা ধরিয়ে দিলাম ফারিহার হাতে। চেহারা যতদূর সম্ভব ঢেকে রাখা দরকার। ভাবাবেগকে দেওয়ার মত সময় আমাদের নেই।
যেকোন মুহূর্তে আরেকটা ফোর্স পাঠাবে রাবেক বাহিনী। কোনঠাসা আমাকে ফারিহার সাথে আটকে ফেলার কারণে হয়ত অল্প কয়েকজনকে পাঠানো হয়েছে। তবে সামনের বার এই ভুলটা করার কথা না ওদের।
মন থেকে সরাতে পারছি না একটি চিত্র। মিনহাজ আমার সবচেয়ে পুরোনো বন্ধু ছিল। চোখের কোণে কেমন যেন জ্বালা করে উঠলো।
বাইরে ঝলমলে রোদ। চোখে সানগ্লাস গলিয়ে একবার অবস্থা দেখলাম।
এই মুহূর্তে সামনের পথে আততায়ী নেই কোন। খালি গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। এলাকাবাসী ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। গুলির শব্দ সবার কানে গেছে।
দূরের কোথাও পুলিশের সাইরেন শোনা যায়। তবে সেটা ছাপিয়ে আরেকটি শব্দ আমার মনোযোগ কেড়ে নিল।
এক সেকেন্ড পরই দেখতে পেলাম ওদের। মোড় ঘুরে তিনটি গাড়ি তীব্র বেগে ছুটে আসছে এদিকে। উপস্থিত প্রতিক্রিয়ার ওপর ভরসা করতে বাধ্য হলাম। ফারিহার হাতে হাত রেখে ছুটলাম শত্রুর ফেলে রাখা গাড়িটার দিকে। প্যাসেঞ্জার সিটে ওকে তুলে দিয়ে অন্যদিক থেকে নিজেও উঠে বসি।
পুরোনো আমলের গাড়ি যেহেতু, ভরসা আছে। এখনকার জিনিস হলে আর দেখতে হত না। সিকিউরিটির দিক থেকে অনেক এগিয়ে গেছে অটোমোবাইলস ইন্ডাস্ট্রি।
ব্যস্ত হাতে ইগনিশন কাভার খুললাম। একগাদা তার এখন সামনে। জবড়জঙ অবস্থা। সামনের তিনজোড়া তারের মাঝেই অপেক্ষা করছে আমাদের মুক্তির টিকেট! সাবধানে তারগুলো দেখলাম। ব্যাটারী আর স্টার্টিং ওয়্যার কোনটা হতে পারে? যেকোন তার ধরে টেনেহিঁচড়ে হেডলাইট জ্বালিয়ে আমাদের কোন উপকার হবে না।
গাড়ি চুরি করতে হয়েছে আমাকে এককালে। তবে বহু আগের কথা সেসব। তখনকার গাড়ি চুরি করা সহজও ছিল। বহুদিনের পুরোনো অভ্যাসের ওপর ভিত্তি করে লাল আর বাদামী তারজোড়া টেনে নেই। তারপর ছুরিটা পা থেকে খুলে সিলিন্ডার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেই মাঝ বরাবর কেটে।
কাছে চলে এসেছে গাড়িগুলো। পেছনে গুলির শব্দ শুনি দুইবার।
ফারিহাকে কিছু বলতে হয় না – ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেলেছে ও।
সাবধানে স্টার্টার ওয়্যার আর পাওয়ার ওয়্যার দুটোকে জোড়া লাগাতেই স্পার্ক করে ওঠে – এবং ইঞ্জিন স্টার্ট নেওয়ার শব্দটা যেন সুধাবর্ষণ করে আমার কানে।
ফারিহার ওড়না ধরে এক কোণা ছিঁড়ে ফেললাম এবং আড়াল করলাম মাত্র কানেকশন দেওয়া অংশটাকে। মাঝরাস্তায় একটা ভেজাল লাগলে গুলি খেয়ে মরতে হবে।
ঝট করে সোজা হয়ে বসলাম, পেছনের জানালা দিয়ে চারবার এলোপাথারী গুলি ছুঁড়লাম। দ্বিগুণ তেজে পাল্টা ফায়ার করে ওরা।
সেই সাথে আগে বাড়ি আমরা, তীরবেগে ছুটিয়ে দিয়েছি গাড়ি – রাস্তা পার হতে থাকা বোকা এক মহিলাকে বহু কষ্টে এড়িয়ে ছুটে যায় আমাদের গাড়ি।
পেছনের আঠার মত লেগে আছে ওরা – পর পর তিনটা বাঁক নিয়ে সোজা মেইনরাস্তায় উঠে আসি আবারও। সামনের ট্রাফিক সিগন্যালের লাল সিগন্যালটা চোখে পড়ে একেবারে আচমকাই।
আমাদের রেড সিগন্যাল – ওদের গ্রীন। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে লাফ দিয়ে গোলচক্করে উঠে আসি গাড়ি নিয়ে। বাম দিক থেকে তীব্র বেগে আসতে থাকা পাবলিক বাসটাকে এড়াতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না পুরোপুরি। পেছনের বাম্পার ছুটে রাস্তায় ছিটকে পড়লো, কান ফাটানো ধাক্কা খেয়েছি। গাড়ির নাক বাম দিকে ঘুরে যাচ্ছিল – কোনমতে সোজা করে অন্যপাশ থেকে আসা মাইক্রোবাসটিকে এড়িয়ে গোলচক্করটা পেড়িয়ে গেলাম।
ফারিহা শক্ত করে ড্যাসবোর্ড আকড়ে ধরে বসে আছে। বিস্ফোরিত চোখে রাস্তায়!
অন্যপাশের রাস্তা সম্পূর্ণ খালি। পেছনে রেড সিগন্যাল পড়লে খালি থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
পেছনে কান ফাটানো বিদঘুটে শব্দের সাথে সাথে ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম আমাদের ফলোয়ার দুটো গাড়িকে একসাথে লাগিয়ে দিয়েছে শতাব্দী পরিবহণ।
একটার সামনের দিকে, অপরটার পেছনে।
রেড সিগন্যাল অমান্য করার কুফল।
নিষ্ঠুর একটা হাসি মুখে ফুটিয়ে সামনের দিকে ছুটে যাই আমি।


‘আসবেই ওরা।’ স্ক্রিনের দিকে ব্যস্তভাবে চোখ বুলাই আমি।
‘কি করে শিওর হচ্ছ তুমি?’ বিছানাতে হেলান দিয়ে বসে আছে ফারিহা। ওখান থেকে জানতে চাইল।
‘এর আগে এখানে কয়েকবার আশ্রয় নিয়েছি। রাবেকের অজানা থাকার কথা নয়। কোন না কোন লোক এখানে পাঠাবে।’
‘তারমানে – সরাসরি আমাদের ওপর হামলা চালানোর কথা আমাদের।’
‘উঁহু। ফায়ার এস্কেপ দিয়ে উঠেছি আমরা দোতলা থেকে। ফলো করে নি কেউ।’ মাথা নাড়ি আমি।
একই হোটেলে বসে আছি আমরা।
একই ফ্লোরে।
যেখানে এসে উঠেছিলাম আমি ফারিহার সাথে পরিচয়ের সময়কার ঝামেলাতে। এখানে ঈশিতাকেও কয়েকদিন রেখেছিলাম। রুমটার ঠিক অপোজিট রুম নিয়েছি এবার আমি। ফারিহা জানে না – তবে গত এক সপ্তাহ ধরে আগের ঘরটিরও ভাড়া দিয়ে চলেছি।
রবিনের নামে। নইলে যে কোন হোটেলরুমে যে কোন সময় আপনি আসবেন আর তা খালি পাবেন – এমনটি হবার কথা নয়।
ওই এক রুমে এতবার উঠেছি আমরা – আমার বিশ্বাস রাবেকের চোখ সেখানে পড়তে বাধ্য। এখানে নজর রাখবে সে। সম্ভবত হোটেলে কাওকে এরই মধ্যে এনে রেখেছে। আমরা ঢোকার পর চেহারা দেখানো মাত্র খবর চলে যাওয়ার কথা জায়গামত।
সেজন্যই দোতলাতে উঠে এসে সাবধানে সরে গেছি আমরা ফায়ার এস্কেপের দিকে। সেদিকের সিঁড়ি ব্যবহার করে উঠে এসেছি এই ফ্লোরে। ফ্রন্ট ডেস্কে গিয়ে কেউ খোঁজ নিলে আমার নামে থাকা অন্য ঘরটিকে দেখতে পাবে। হানা দিলে ওখানে দেবে।
আগে থেকেই ল্যাপটপ আর চার্জার কানেকশন দিয়ে ওয়েব ক্যাম চালু করে দিয়ে এসেছি সেই রুমটিতে। হুড় মুড় করে কেউ ঘরে ঢুকে পড়লে আমিও তার পিছু পিছু ঢুকে পড়ব। এবারের আক্রমণকারীদের কাওকে জ্যান্ত ধরতে হবে।
রাবেকের লোকেশন জানার জন্য কিছু ক্লু দরকার আমার।
ফিরে তাকালাম ফারিহার দিকে। নোংরা পোশাক পাল্টে গোসল করে এসেছে ও।
একেবারে রাজকন্যার মত লাগছে দেখতে এখন।
পোশাক কিনে আনতে হয় নি – অর্ডার দিয়েছি। এনে দিয়েছে রুম সার্ভিস।
লোকটা আমার বিশ্বস্ত। কাজেই রাষ্ট্র হবার ভয় নেই।
গোলচক্কর কেলেঙ্কারির পর একবার গাড়ি থামিয়ে ফারিহার জুতো থেকে ঈশিতার সাথে আমারই পাঠানো ট্রান্সমিটারটা বের করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে এসেছি। এটার সিগন্যালই আমাকে ধোঁকা দিয়েছিল আজ সকালে।
এখানে আমরা মোটামুটি নিরাপদ।
আপাতত।
ওর পাশে গিয়ে বসলাম আমি, কোমল গলাতে বলি, ‘রিজভী আংকেলের ব্যাপারটা খুলে বল আমাকে। সব শুনলে হয়ত রাবেকের প্ল্যানিংটা বুঝতে পারব।’
ফারিহার দুই চোখে তীব্র বেদনা নেমে এল। মনে পড়ে গেছে সব আবারও।
চুপচাপ বসে রইলাম। ওকে সময় দিচ্ছি।
‘বিকেল তখন। বাসায় মাত্র ফিরে এসেছি। সবকিছু স্তব্ধ মনে হচ্ছিল। একটু বেশিই চুপচাপ যেন। মনে কুডাক ডাকল, দ্রুত ভেতরে ঢুকেই দেখি –‘
থেমে যায় ফারিহা। সুন্দর ঠোঁটজোড়া তির তির করে কাঁপছে।
‘-পড়ে আছে বাবা। রক্ত চারপাশে।’ বলতে কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারলাম, ‘ওপরের তলায় অপেক্ষা করছিল ওরা। আমার চিৎকার শুনে চোখের পলকে নেমে এসে মাথায় পিস্তল দিয়ে বাড়ি মারল কেউ। তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম ছোট একটা অন্ধকার ঘরে আটকে আছি।’
‘হুম।’ মাথা নামিয়ে ফেলি আমি। রিজভী আকন্দ মানুষটি বেআইনি পথে থাকলেও সম্মান পাওয়ার যোগ্য ছিলেন, ‘আমি দুঃখিত, ফারিহা।’
কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যাই দুইজনেই। সারাজীবন মানুষের ক্ষতি কম করিনি। কাজেই সান্ত্বনা কিভাবে দিতে হয় সেটা জানি না আমি।
আমার দিকে বড় বড় চোখদুটো মেলে দেয় ফারিহা, ‘একটা ব্যাপার – আমার ভুলও হতে পারে।’
‘কোন ব্যাপারে?’ আড়চোখে একবার ল্যাপটপের স্ক্রিণে তাকিয়ে জানতে চাই আমি।
‘বাবার শরীরের পাশে নিজের রক্ত দিয়ে কিছু একটা মেঝেতে লেখে গিয়েছেন বলে মনে হয়েছে আমার।’
আগ্রহী হলাম এবার, সোজা হয়ে বসি আমি, ‘কি লেখা ছিল?’
একটু ভাবার চেষ্টা করে ফারিহা, ‘ঠিক মনে তো পড়ে না। কি সিচুয়েশন তখন আমার তো বোঝই। কোয়াডার টাইপ কিছু।’
‘ইংরেজী না বাংলা?’ ওর দিকে ঝুঁকে আসি আমি।
‘ইংরেজী। QUADR টাইপ কিছু।’
‘কাদের লেখতে চান নি তো? কারও নাম? আততায়ী হয়ত পরিচিত ছিল উনার?’ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাই আমি।
‘সেরকম তো মনে হয়নি। QUADR ই দেখেছি আমি।’
চুপ হয়ে একটু ভাবি আমি।
আমার সেলফোনটা বেজে উঠে মনোযোগ সরিয়ে দেয় একটু পরেই ।
একমুহূর্ত ওটার দিকে তাকিয়ে থাকি। তারপর রিসিভ করলাম।
‘হ্যালো?’
‘মাই ডিয়ার সান!’ ওপাশ থেকে খুশিতে বলে ওঠে রাবেক।
‘শাট আপ।’ রাগে নিয়ন্ত্রণ হারাই আমি, ‘কিলিং মি. রিজভী অ্যান্ড মিনহাজ ওয়াজ ইয়োর বিগেস্ট মিস্টেইক, রাবেক! আ’ম টেকিং ইট পার্সোনালি।’
ওপাশ থেকে খন খন করে হাসে রাবেক।
‘তোমার নিয়তিও ওই একই। তবে একটা সুযোগ দেওয়ার ইচ্ছে আছে তোমাকে। মেনে চলতে হবে আমার একটি মাত্র অনুরোধ।’
‘সেটি সম্ভব নয়।’ ফোনের এপাশেই মাথা নাড়ি আমি।
‘আহ! মেনে নাও ইরফান। হেরে গেছ তুমি। ঈশিতা আমার এখানে ভালোই আছে। পড়াশোনা করছে আর পাশাপাশি বিজনেসের কাজ শিখে নিচ্ছে। মাঝখান থেকে তুমি বেঘোরে প্রাণ হারাতে চাও কেন? সহযোগিতা কর, তোমাকে আর ফারিহাকে নিরাপদ একটা জীবন উপহার দেব। নিজের জন্য না করলে- যা পাছাভরা ইগো তোমার! তবে ফারিহার কথা ভাবো? কথা দিয়ে কথা রাখি আমি।’
‘একেবারে মরিয়া হয়ে আছেন দেখছি!’ ব্যঙ্গ ঝড়লো আমার গলা থেকে, ‘হঠাৎ আমাকে নিয়ে মেতে উঠলেন কেন?’
ওপাশটা কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায় এবার।
‘উঠতে হল। আমার একটা জিনিস তোমার কাছে আছে, ইরফান। জাস্ট গিভ মি ব্যাক হোয়াট ইজ রাইটফুলি মাইন।’
বয়স্ক হেডফাইভ ইয়াসিরের কথা মনে পড়ে যায় আমার। ডুবন্ত অ্যাম্বুলেন্সে শেষবারের মত দেখেছিলাম রাবেকের হেডফাইভ ইয়াসিরের মৃতদেহ।
সেদিনের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে মনে হয় রাবেক?
জানল কিভাবে ওটা আমার কাছে?
‘আমি জানি তুমি কোথায় আছ।’ আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছে রাবেক, ‘চাইলেই ফুটো করে নিয়ে যেতে পারি। তবুও ঈশিতার ভাই বলেই হয়ত একটা সুযোগ দিচ্ছি তোমাকে।
সৎ ছেলের জন্য রাতারাতি এত দরদ জন্মিয়েছে এ কথাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে আজ?
তাছাড়া লোকেশন জানার ব্যাপারটা সত্য হলেও এখানে একটা ফাঁক আছে। রাবেকের তা জানার কথা নয়। হোটেলে ঢুকলে আমার পাশের রুমেই দৌড়াবে ওরা। একেবারে আমার ফাঁদে পা দেবে।
ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘মুরোদ থাকলে এসে নিয়ে যান।’
কেটে দিলাম লাইন।
ফিরে তাকাতে গিয়ে ফারিহার নাকে নাক ঠেকে যায় আমার। উঠে এসেছে মেয়েটা। চোখে আতঙ্ক।
‘রাবেক ছিল ওটা – তাই না? এতক্ষণ রাবেকের সাথে কথা বলেছ তুমি?’
‘হুঁ।’
‘কিছু একটা চেয়েছে তোমার কাছে, রাইট?’ ওর গরম নিঃশ্বাস টের পাচ্ছি।
‘যা চেয়েছে সেটা দেওয়া সম্ভব নয়, ফারিহা। ওর উইকপয়েন্ট এটা। ছেড়ে দিলেই আমাদের হাতে আর কিছু থাকছে না।’
‘রবিন -’ ইতস্তত করে ফারিহা, ‘-সব ছেড়ে দিয়ে লো প্রোফাইলে থাকলে তোমাকে খুঁজে পাবে ওরা?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলি আমি, ‘আমার মায়ের হত্যাকারী – তোমার বাবার হত্যাকারীকে ছেড়ে দিচ্ছি না আমি। মিনহাজের কথাও ভুলে যেও না। সরি, ফারিহা। রাবেকের শেষ না দেখে নিজে লুকিয়ে থাকতে পারব না আমি।’
আমার চোখে চোখ রাখে মেয়েটা – বড় বড় চোখ দুটোতে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে আমার।
আস্তে করে আমার হাত ধরল ও, ‘তোমাকেও হারাতে চাই না।’
হাতটা ধরে হাল্কা একটা চাপ দিলাম। অভয় দেয়ার সুরে বললাম, ‘হারাবে না। কথা দিলাম।’
একটা মুহূর্ত একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা। তারপরই আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফারিহা।
পাগলের মত চুমু খায় আমার ঠোঁটে। পাল্টা সাড়া দেই আমিও।
একটা মেয়ের ঠোঁট এত নরম হয় কি করে?
ওকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে ওর নরম রেশমি চুলে হাত ডুবে যায় আমার – আর আমার সারা মুখে চুমুর ঝড় বইয়ে দেয় মেয়েটা।
ধাক্কা দিয়ে আমাকে বিছানাতে ফেলে দিয়েছে– আমার শার্টের কলার ধরে হিংস্র গলাতে বলে, ‘আই লাভ ইউ, রবিন। আই নীড ইউ রাইট নাউ।’
ওর পিঠে হাত রেখে টেনে নিয়ে আসি আমার অনেক কাছে। চকচকে চোখদুটোতে আমার ওপর আস্থা আর নির্ভরতা।
তারপরই ওকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখে একবার গড়িয়ে পড়ে গেলাম বিছানা থেকে, এক হাত লম্বা করে বালিশের ভেতর থেকে বের করে নিয়েছি গ্লক২৩, একই সাথে বিস্ফোরণের সাথে উড়ে গেল আমাদের রুমের দরজা।
ভেতরে ঢুকে পড়া শটগানধারীর গলায় প্রথম গুলিটা করতেই রক্তের স্প্রে ছিটে পড়ে সুন্দর মেঝেটা নষ্ট হয়ে গেল।
ঝাঁপিয়ে ভেতরে ঢুকল পরের দুইজন। কোমরে প্রস্তুত একটা করে এমপিফাইভ। শুয়ে থাকা আমাদের চোখে পড়তে ওদের দেরী হয়ে গেল, ফলস্বরূপ ছিটকে পড়ল ওরাও।
উঠে দাঁড়ালাম ফারিহাকে নিয়ে। জরুরী একটি বিষয় ভুলিনি। টুক করে একটা ছোট্ট চুমু খাই ওকে, ‘আই লাভ ইউ টু।’
সামনের খোলা দরজার ওপাশে আরও মানুষ আছে জানি আমি। সন্তর্পনে অস্ত্রটা কানের কাছে তুলে রেখেছি।
এক হাত ধরে টানি ফারিহার, ‘লেটস লীভ দিস গডড্যাম প্লেস।’


ফারিহাকে আরেকটি বারান্দা পার হতে সাহায্য করলাম।
সাবধানে রুমের সাথে থাকা বারান্দায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই আরেকজন বীরপুরুষকে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে দেখা গেছিল। গুলিটা লাগেনি ওকে – তবে ভয় পেয়েছে সন্দেহ নেই। ঘর থেকে এক্সট্রা ম্যাগ ছাড়া আর কিছু নেইনি আমরা।
হোটেলটার রুমগুলো পাশাপাশি এক সারিতে এগিয়ে গেছে আর সব হোটেলের মতই। তবে এদের বারান্দাগুলো বিশাল। আর বিশাল বলেই একটা রুমের বারান্দা থেকে আরেকটা রুমের বারান্দার দূরত্ব কম।
যে কারণে এই হোটেলে এসকেপ রুটের অভাব নেই। আর এপাশে কোন স্নাইপিং পজিশনও নেই। বারান্দায় বের হওয়াটা নিরাপদ। একমাত্র কারণ, এই হোটেলটা এতবার সেফ হাউজ হিসেবে ব্যবহার করেছি।
একটার পর একটা রুমের বারান্দায় লাফিয়ে লাফিয়ে পার হচ্ছি আমরা। ফারিহাকে নিয়েই ভয়। মাঝপথে খসে না পড়ে!
একেবারে চল্লিশ ফুট নীচে মাটি। পড়লে আর দেখতে হবে না।
প্রায় পঞ্চাশ ফিট সরে এসেছি আমরা, এসময় আমাদের রুমের বারান্দায় বের হতে দেখা গেল রাবেক বাহিনীর কাওকে। আমাদের দেখে হই হই করে উঠল। সোল্লাসে আমাদের দিকে গুলি ছোঁড়ার পাঁয়তারা করছে বুঝতে একটুও কষ্ট হল না। আন্দাজে দুইবার গুলি করতেই আবার ব্যাঙের মত লাফিয়ে ভেতরের দিকে চলে যায় বেয়াদবটা।
আর যে বারান্দায় এসে নেমেছি তার রুমের দরজায় একটা বিকট লাথি মেরে নব ছুটিয়ে ফেললাম। আর কানামাছি খেলে কাজ নেই।
ভেতরে হতভম্ভের মত বসে আছে একজন সদ্য তরুণী। গুলির শব্দে বিভ্রান্ত তো ছিলই। তার ওপর পিস্তল হাতে আমাদের ঢুকতে দেখে তার চোখ কপালে উঠে যায়।
একটা ছোট লাগেজ। তা থেকে লাল রঙের কাপড় উঁকি দিচ্ছে। সেই সাথে মেয়েটার চোখের নীচে কালি।
দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেললাম। ঘরটা থেকে বের হতে হতে ফ্রেন্ডলি অ্যাডভাইস দিতে ভুলি না, ‘বিয়ে ফেলে পালিয়ে না এসে বিয়ে ঠিক করার আগেই ফ্যামিলির সাথে খোলামেলা কথা বলে বিয়েটা ঠেকাতে পারতে।’
আমার দিকে শাসানির দৃষ্টি দিচ্ছে ফারিহা। তাই আর সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে এলাম কড়িডোরে।
একটু আগে আমাদের বাইরে দেখে ফেলেছে ওদের একজন। কাজেই সবাই যে গায়ে এসে পড়বে সে ব্যাপারে সন্দেহ ছিল না। আর ঠিক তাই দেখা যায়।
হা হা করতে করতে দৌড়ে আসছিল ছয়জন। ধাঁই ধাঁই করে সে বরাবর কয়েকটা গুলি পাঠালাম, সেই সাথে ছুটছি। করিডোরের দৈর্ঘ্যের মাত্র ছয় ফিট দূরত্ব অতিক্রম করে আরেক লাথিতে ফায়ার এসকেপের দরজা খুলে ফেলতে বেগ পেলাম না। এক ধাক্কায় ফারিহাকে ঢুকিয়ে দিলাম, সেই সঙ্গে এখনও দাঁড়িয়ে থাকা দুইজনের দিকে ম্যাগাজিন খালি করে দেই।
বিয়ে পালানি মেয়ের রুমের দরজা থেকে ফায়ার এসকেপের দরজা দিয়ে ঢুকে যাওয়ার জন্য ব্যয় হয়েছে মাত্র দেড় সেকেন্ড।
এত অল্প সময়ে হুড়মুড় করে বেড়িয়ে এসে আবার গায়েব হয়ে যাওয়ায় সারপ্রাইজড রাবেক বাহিনীর কেউই ঠিক মত গুলি ছুঁড়তে পারেনি।
এক ছুটে নীচতলাতে নেমে এসেছি আমরা, তবে মেইন গেটের দিকে গেলাম না। ওদিকে আরেকটা দল অপেক্ষা করছে সন্দেহ নেই।
নীচতলার রেস্টুরেন্টের পাশে মেইনটেন্যান্সের জন্য রাখা ঘরটিতে চট করে ঢুকে পড়ি ফারিহাকে নিয়ে।
হোটেলে আমার বিশ্বস্ত একজন আছে। তাকে দিয়ে আগেই আনিয়ে রাখা পোশাক দুটো পড়ে ফেলি আমরা দ্রুত।
এসকেপ প্ল্যান আগে থেকে প্রস্তুত রাখার স্বভাবটাকে মনে মনে আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে একটা ট্রলি নিয়ে বের হয়ে আসি আমরা।
হোটেলের দুই কর্মচারী এখন বাইরে গারবেজ ফেলতে যাচ্ছে।
*
রুমটা অন্ধকার।
শান্ত পায়ে তার ভেতর এসে দাঁড়াই।
একটা লাইট জ্বালিয়ে দেই। কিন্তু তাতে অন্ধকার যায় না। ঘোলাটে আলো বলা যেতে পারে এই অবস্থাকে।
চেয়ারের সাথে পা বাঁধা ঘরের একমাত্র মানুষটার। আর হাত দুটো স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা আছে টেবিলের সাথে।
মাথা ঝুলে পড়েছে বুকের কাছে। দূর থেকে দেখেই বুঝতে পারি মানসিক শক্তি ধরে রাখার শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছেন ডিফেন্স অ্যাডভাইজার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ।
দ্য ফিফথ হেডফাইভ।
রাবেকের সাথে একদম প্রথম থেকে আছে যে মানুষগুলো এ তাদের মাঝে একজন।
এতগুলো বছর ধরে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আর্মির এত ওপরের পদে আসীন হয়েছেন– রাবেকের সাম্রাজ্য কতদূর বিস্তৃত এ থেকে যথেষ্ট টের পাওয়া যায়!
তবে গত কয়েক মাস আগে আমাকে দুনিয়ার বুক থেকে কৌশলে সরানোর চেষ্টা গিয়ে নিজেই পড়ে গেছেন ফাঁদে। এই হেডফাইভকে আমি গত তিনমাস ধরে লুকিয়ে রেখেছি। বন্দী। তাকে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলার জন্য বেশ কিছু পদ্ধতির প্রয়োগ করেছি। কিন্তু যেটা করিনি – একটা প্রশ্ন পর্যন্ত করি নি তাঁকে।
মানসিক চাপ আরও বাড়ানোর জন্য এই পদ্ধতিটা বেশ কার্যকরী।
ধীরে ধীরে মাথা তুললেন মাহমুদ। তার চেয়েও ধীর পদক্ষেপে তাঁর দিকে এগিয়ে যাই আমি।
হাত থেকে চকচকে সার্জিক্যাল নাইফটা নামিয়ে রাখলাম সামনের টেবিলে।
একটি চেয়ার বন্দীর মুখোমুখি রাখা আছে। কিন্তু এখানে কোনদিনই বসিনি আমি। আজও বসলাম না।
চেয়ারটি মানসিক চাপ বাড়ানোর জন্যই রাখা। নিত্যদিনের একাকীত্ব থেকে একটা সময় ডিফেন্স অ্যাডভাইজার আশা করতে থাকবে কেউ এই চেয়ারে বসুক। তার সাথে দুটো কথা বলুক। সেই মানুষটা তার নির্যাতনকারী হলেও আপত্তি থাকবে না তার। কিন্তু – তিনমাসে তার সাথে একটি কথাও বলি নি আমি।
অথবা আর কেউ!
কথা বলতে শুরু করার যে কয়টি কারণ দরকার হতে পারে – তার সবগুলোই দেওয়া হয়েছে ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে।
তারপরও যদি আজ চুপ করে থাকতে পারে – এই লোকের প্রশংসা করাই উচিত!
‘মি. মাহমুদ? আপনার সন্তান আছে?’ চমৎকার একটা হাসি দিয়ে জানতে চাই আমি।
মাথা তুলে তাকিয়ে থাকেন মাহমুদ। জবাব দেন না কোন। তবে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেন।
ক্ষুধা আর তৃষ্ণার সাথেও কম যুদ্ধ করতে হয় নি তাঁকে একয়দিনে। কাজেই কথা এত সহজে বেরুবার কথা নয়।
টেনেটুনে শুধু বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে মানুষটাকে।
‘বিয়ে করেছেন তাহলে।’ বেশ স্বস্তির খবর শুনেছি এভাবে বলি আমি, মুখ থেকে হাসিটি মলিন হয় নি এতটুকুও, ‘জানেন তো – প্রচলিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস আছে – মানুষের বাম হাতের কড়ে আঙ্গুলের পাশের আঙুল থেকে একটি শিরা সরাসরি হার্টের সাথে সম্পর্কযুক্ত?’
‘ভুল।’ বিড় বিড় করে বলেন মাহমুদ।
‘ঠিক বলেছেন।’ মাথা ঝাঁকাই আমি, ‘আর্মিতে ছিলেন। হিউম্যান অ্যানাটমি সম্পর্কে আপনারা জানবেন না তো কে জানবে? আসলে – আমাদের দুই হাতেই প্রতিটি আঙুল থেকে পাঁচটি করে শিরা একত্রিত হয়ে এগিয়ে যায় হার্টের দিকে। এর মাঝে আরও অনেক জায়গাতে তারা বিভিন্ন শাখা মিলে এক হয়। সুপিরিয়র আর ইনফেরিয়র ভেনাক্যাভা হয়ে হার্টে ঢোকে অ্যাজ আ রেজাল্ট্যান্ট। সুতরাং ‘রিং ফিংগার’ হল ‘সিম্বল অফ লাভ’ কারণ হার্টের সাথে ভেইন সংযুক্ত আছে – এসব শুধুই ভ্রান্ত ধারণা। ’ স্ক্যালপেলটা হাতে নিয়ে একটু ঝুঁকে দাঁড়াই আমি, ‘তবে – হার্টের সাথে যুক্ত না থাকলেও আঙ্গুলগুলোতে শিরা কিছু আছে, মি. মাহমুদ।’
‘মি. ইরফান।’ দুর্বল মানুষটার গলাতেও বেশ কৌতুক ফুটে ওঠে, ‘বায়োলজী ক্লাস নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। যা জানতে চান জানাতে রাজি আছি। তারপর আশা করি দয়া করে একটি বুলেট খরচ করবেন আমার ওপর। আ’ম ফেড আপ উইদ দিস লাইফ।’
একমুহূর্ত লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
তারপর প্রথমবারের মত সামনের খালি চেয়ারটিতে বসে পড়ি আমি।


‘QUADR?’ জানতে চাইলেন মি. মাহমুদ আবার।
‘হুম।’ বলি আমি।
‘আমাদের ডীলের কথা মনে আছে তো?’ ভ্রু কুঁচকে জানতে চান মানুষটি।
‘কোন ডীল?’ একটু অবাক হয়ে তাকাই আমি।
‘জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দয়া করে একটি বুলেট-’
হাত তুলে থামাই তাকে, ‘ইফ ইউ ইনসিস্ট – আই’ল হ্যাভ নো প্রবলেম উইথ দ্যাট। আগে আমার তথ্য দরকার।’
মরার সুসংবাদ পেয়ে খুশি হয়ে গেলেন মি. মাহমুদ।
‘আমাকে আগে জানান কোথা থেকে পেয়েছেন এই শব্দ।’ এলোমেলো চুলের ফাঁক দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন মাহমুদ।
সংক্ষেপে রিজভী আকন্দের মৃত্যুর বর্ণনা দেই আমি।
‘QUADRUPLE এর অংশ এটা।’ অবশেষে জানালেন মি. মাহমুদ।
‘কোয়াডরুপল!’ বিড় বিড় করে বলি আমি, ‘চারগুণ।’
‘কোয়াডরুপলের আরেকটি অর্থ আছে মি. ইরফান।’ মাথা নেড়ে বলেন মাহমুদ, ‘কনসিস্টিং অফ ফোর পার্টস অর মেম্বারস।’
স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি আমি, ‘অথচ আপনারা ছিলেন পাঁচজনের একটা গ্রুপ। হেডফাইভস।’
একটু হাসলেন মি. মাহমুদ, ‘অবশ্যই। তবে খটকা লাগে নি আপনাদের? পঞ্চম হেডফাইভকে খুঁজে পেতে কি পরিমাণ ঝামেলা করতে হয়েছে আপনাকে?’
‘মানে -’ একটু ভেবে বলি আমি, ‘হেডফাইভদের মাঝেও র‍্যাংকিং আছে?’
মাথা দোলান মাহমুদ, ‘চারজন কোয়াডরুপল। একজন কোয়াডরুপল কো-অর্ডিনেটর।’
ঠোঁটজোড়া চেপে বসে একে অন্যের সাথে। ভাবছি।
‘ওয়েল, আপনি কোয়াডরুপল কোঅর্ডিনেটর। বাকিরা কোয়াডরুপল। কিন্তু এর তাৎপর্যটা কি? মৃত্যুর সময় কেন সেটা লেখে রাখার চেষ্টা করতে যাবেন মি. রিজভী আকন্দ?’
‘কারণ -’ ফিস ফিস করে বলেন মাহমুদ, ‘কো-অর্ডিনেটর না থাকায় জীবিত কোয়াডরুপলদের হাতে চলে গেছে শহরের বিভিন্ন সেক্টরের সর্বময় ক্ষমতা। ’
‘ব্যাখ্যা করুন।’ চাপ দেই আমি।
হেলান দিয়ে আরাম করে বসার চেষ্টা করেন মি. মাহমুদ।
‘হেডফাইভসদের মাঝে চারজনকে মেরে ফেলার আদেশ একটা সময় ডন রাবেক দিয়েছিলেন। জানেন সেটা আপনি। আপনাকে ঘিরেই সেই আদেশ দেওয়া হয়েছিল। রাবেক বাহিনীর কোন সদস্যরা সেই কাজে এগিয়ে গেছিল বলুন তো?’
‘আপনার।’ হাত উল্টে বলি।
‘হুম। এবার আপনাকে আমাদের অর্গানাইজেশনের কিছুটা ধারণা দেই। আমাদের কোয়াডরুপলদের হাতে সারা শহরের চারটি অংশ আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। তারা এই অংশগুলোর সর্বময় ক্ষমতা রাখে। এমনকি সেসব এলাকাতে আমাদের যেসব মাঠপর্যায়ের ‘সোলজার’ আছে – তাদের কন্ট্রোলও থাকে তাদের হাতে।’
একটু ভাবেন তিনি কী যেন। নিজের সোনালী(!) অতীতে ফিরে গেছেন কি?
‘কোয়াডরুপলরা আমার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিল। কিন্তু কেউ জানত না কে ছিল পঞ্চম হেডফাইভ। কোয়াডরুপলদের কেউ কেউ ধরেই নিয়েছিল রাবেক স্বয়ং পঞ্চম হেডফাইভ। কোয়াডরুপল কো-অর্ডিনেটর।’
‘আসল কথাতে আসুন।’ তাগাদা দেই আমি।
আমার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকান মাহমুদ। বহু দিন পর কথা বলতে পেরেও স্বাধীনতা না পেয়ে বিরক্ত!
‘কোয়াডরুপলরা তাদের অধীনস্ত রিজিওনাল হেডকে আদেশ দেয়। এই রিজিওনাল হেডরা আবার জানে না কারা রিজিওনাল কোঅর্ডিনেটর। নিখুঁত ব্যবস্থা। আপনি একজনকে ধরে চেইন বেয়ে বেয়ে উঠে ডনের কাছে যেতে পারবেন না কোনদিনও।’
চমৎকার একটি হাসি উপহার দেন এবার স্বয়ং মাহমুদ। স্বীকার করতেই হয় আমাকে – আসলেই নিখুঁত পদ্ধতি।
তবে প্রশ্নটা করেই ফেলি, ‘তাহলে কিভাবে কন্ট্যাক্ট করেন এই কোয়াডরুপলরা? রিজিওনাল হেডদের সাথে?’
‘কোয়াড দিয়ে। সেইফ কোড এটা। আমাদের আবিষ্কার।’ দাঁত দেখা যায় ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের মুখে, ‘আমার আর রাবেকের আবিষ্কার।’
ছোট একটা ডিভাইস বের করে টেবিলে রাখি আমি এবার।
‘এটাকে কি বলেন আপনারা?’
অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন মাহমুদ।
‘কোয়াড-রেডিও!’ বিস্ময় কন্ঠে নিয়ে বলেন তিনি, ‘পেলেন কোথায়? ইয়াসিরের মিসিং কোয়াড-রেডিও এটা?’
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি আমার দিকে।
মনে পড়ে যায় আমার সেই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা ডুবন্ত অ্যাম্বুলেন্সে আটকে পড়ার অভিজ্ঞতা।
মেরিটাইম স্প্রিং কাপের কল্যানে আন্ডারওয়াটার শূটিং করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পানিতে ভেসে উঠতে দেখেছিলাম ডিভাইসটাকে। পকেটে পুড়ে পাঁচ সেকেন্ডের মাঝে অ্যাম্বুলেন্স থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম পেছনের দরজা খুলে।
‘যেখানেই পাই – এটাই তাহলে আপনাদের কোয়াড ট্রান্সমিটার অ্যান্ড রিসিভার?’
‘একজন কোয়াডরুপলের কাছে একটাই থাকে।‘ গম্ভীর মুখে বলেন মাহমুদ, ‘যার কাছ থেকে বাগিয়েছেন এটা –এই মুহূর্তে আপনার হাতে তার এলাকার প্রতিটি সোলজার আছে, মি. ইরফান। প্রতিটি ব্যবসা আপনার নিয়ন্ত্রণে। যদি আপনি কোয়াড জানেন।’
‘হুম।’
এবার বুঝে ফেলি আমি তাৎপর্যটা, রিজিওনাল হেডকে আমি যে আদেশ দেই সেটাই মানবে সে চোখ বন্ধ করে। কারণ আদেশ এভাবে পেয়েই অভ্যস্ত সে। এমনকী – রাবেকের আর্মি নিয়েই রাবেককে হামলা করতে পারি আমি এখন চাইলে।
শুধু জানা লাগবে একটি কোড।
কোয়াড!
‘আপনারা জানেন তিনজন হেডফাইভ মারা গেছে। অথচ জানেন না – প্রতিটি মৃতদেহের কাছে ছিল এই জিনিস। আমরা উদ্ধার করেছি সেগুলো। আমার লোকদের নির্দেশ দেওয়াই থাকত – হেডফাইভকে গুলি করে কোয়াড-রেডিও নিয়ে ফিরে আসার। তারা এর তাৎপর্য জানত না – এটা একটা স্বস্তি।’
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কোয়াডরুপল কো-অর্ডিনেটর।
‘তাহলে – হেডফাইভ মিলন থেকে আপনারা হত্যার সাথে সাথেই কোয়াড রেডিও নিয়ে নিয়েছিলেন। ইয়াসিরের ব্যাপারে -’
‘অ্যাম্বুলেন্স পানি থেকে তুলে খুঁজেছি আমরা। ডুবুরী নামিয়ে খুঁজেছি নদীর নীচে। পাইনি। ধরে নিয়েছিলাম, নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। তাও স্বস্তি। হেডফাইভ আখতারকে সমাহিত করেছিলেন আপনারা রাষ্ট্রীয় মর্যাদাতে। তার আগেই আখতারের বিলংগিংস যেখানে যত্ন করে রাখা হয়েছিল সেটা লুট করে তার কোয়াড-রেডিও উদ্ধার করি আমি। ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া হাউ ইম্পর্ট্যান্ট থিংস দোজ আর – দোজ কোয়াড রেডিওস।’
রিজভী আকন্দকে মেরে ফেলার জন্য ব্যাগ্রতা বুঝতে পারলাম আমি এতক্ষণে।
কোয়াড-রেডিও সহই বিদ্রোহ করেছিলেন তিনি রাবেকের বিরুদ্ধে। কাজেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাম্রাজ্যের জন্য খুবই বড় এক হুমকি। আমার জন্যও মরিয়া হয়ে ওঠার পেছনে কারণ এখন এটাই।
ঈশিতাকে পেয়ে গেছেন নিজের সাইডে। তারপরও আমার পেছনে কাঁঠালের আঠার মত লেগে থাকার কোন কারণ ছিল না। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে আমার কাছেই যে ইয়াসিরের শেষ কোয়াড রেডিওটি আছে – সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়ার কথা নয়। ফারিহা এখানে শুধুই আমার উইকপয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত।
সব কিছু খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে।
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ি এবার আমি। হেলান দিলাম চেয়ারে।
বেজমেন্টের সিঁড়িতে তখনই অনেকগুলো পায়ের শব্দ শোনা যায়। চকিতে সোজা হলাম আমি। গ্লকটা ওপরে রেখে এসেছি। ফারিহার কাছে।
কোন ধরণের ফায়ার আর্মস ছাড়া নিজেকে সম্পূর্ণ নগ্ন লাগে আমার।
নেমে আসছে কারা?
পুরো বাসায় আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ ছিলাম না।
বিকট এক ধাক্কায় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়া ছয়জন মানুষের হাতের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললাম।
সবার হাতে একটা করে CZW 9। চেক অস্ত্রের প্রতি রাবেক বাহিনীর এত পিরিতি কেন কে জানে!
সার্জিক্যাল নাইফটা ফেলে দিয়েছি।
চুপচাপ দুই হাত মাথার ওপর তুলে দাঁড়াই আমি।


পাশাপাশি বসে আছি আমি আর ফারিহা।
দুইজনেরই হাতে একটা করে হ্যান্ডকাফ। লাগানো আছে সামনের টেবিলের সাথে আটকানো রডের সাথে।
টেবিলটা আবার মেঝের সাথে বোল্ট দিয়ে আটকে রাখা। কাজেই, ছুটে কিংবা টেবিল উলটে বের হয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই আমাদের।
ডন রাবেক বসে আছে আমাদের সামনে। ধীরস্থির অভিব্যক্তি। টেবিলের অন্যপাশে। তার মুখে সুন্নতি হাসি।
‘একটা সময় প্রশ্ন করেছিলাম – কিভাবে বার বার ঈশিতাকে খুঁজে বের করে ফেল তুমি? মনে আছে?’
‘আত্মার টান – সম্ভবতঃ।’ বিড় বিড় করে বলি আমি।
‘ওর জুতোগুলোতে একটা করে জিপিএস ট্রান্সমিটার প্ল্যান্ট করে রেখেছিলে তুমি – ইরফান। শুধু হাঁটার সময় কাজ করে ওগুলো। অথবা পরে থাকলে – কারণ সোলজোড়ায় নির্দিষ্ট পরিমাণ ভর না থাকলে সুইচড অফ হয়ে থাকে তারা। ক্লেভার – ভেরি ক্লেভার! ইন্টারফেরেন্স চেক করার যন্ত্রপাতি দিয়ে বিষয়টা ধরে ফেলা এজন্য অনেক কঠিন। আমার চোখেও প্রথমে পড়েনি।’
আমার প্রশংসা করার কোন ইচ্ছেই যে তার মাঝে নেই – সেটা চেহারা দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে। এটা স্রেফ রাবেকের নাটুকে স্বভাবের বহিঃপ্রকাশ। লোকটা যাত্রাপালায় ভালো করতো।
তার যাত্রা কেয়ার করি না আমি। আমার দুই চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা মাত্র সুযোগের অপেক্ষাতে। বাম হাতটা মুক্ত আছে – শুধু দরকার একটা সুযোগ!
ডন রাবেকের আত্মবিশ্বাস এতটাই বেশি – আমাদের বেশি কড়াকড়িতে আটকে রাখেনি। চাইলে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখতে পারত, তাকে ঠেকাত কে? অথচ ঘরের ভেতরও কেউ নেই। বাইরে যদিও গিজ গিজ করছে রাবেক বাহিনী।
একরকম হেডকোয়ার্টার বলা চলে এই বাসাটিকে। রাবেক হাউজ।
ঈশিতা কি এখানেই কোথাও আছে? হয়ত!
‘প্রশ্নটা হচ্ছে, মি. রাবেক -’ মুখ খুলি আমি, সৎ বাবাকে নাম ধরেই ডাকি আমি, ‘আমাকে খুঁজে বের করে ফেললেন কি করে? হোটেলে একবার বের করেছেন। যদিও আপনাদের ঢোকার কথা ছিল পাশের রুমে। কিভাবে বুঝলেন আমাদের লোকেশন? একেবারে পিনপয়েন্ট? তারপর আবারও আমার সেইফ হাউজে – একেবারে জায়গা মত চলে আসল কি করে আপনার লোকেরা?’
উত্তরটা আমি জানি না তা নয় – বরং রাবেকের সময় কিছুটা নষ্ট করাই উদ্দেশ্য। আয়ু বাড়বে এতে।
আর যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আঁশ।
মুচকি হাসে রাবেক অবশ্য। আমার নির্বুদ্ধিতায় হতাশ!
‘সেইম ট্রিক। আমার ট্রান্সমিটারটি ছিল ফারিহার শরীরে।’
‘ক্লেভার। ভেরি ক্লেভার!’ অনিচ্ছাসত্বেও বলি আমি।
দৌড়াদৌড়ির মাঝে ফারিহার জুতো থেকে ঈশিতার ট্রান্সমিটারটা উদ্ধার করি আমি ঠিকই। কিন্তু আরও ট্রান্সমিটার থাকতে পারে – সেটা আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল।
‘কিন্তু জুতোতে ছিল না ওটা। রেখেছিলেন কোথায়? এর মধ্যে আমরা ড্রেস চেঞ্জ করেছি।’
মাথা নাড়ে রাবেক, ‘ফারিহার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে নাকি এই ছেলে! মেয়েটা যে হাতে একটা রিং পরে তা খেয়াল করনি কখনও?’
বুঝতে পারলাম এবার। বোকামি হয়ে গেছে।
কিন্তু এখন আর সেসব ভেবে লাভ নেই।
‘আমাদের তুলে এনে জামাই আদর করছেন কেন জানতে পারি?’ প্রশ্নটা না করে পারলাম না।
‘সমস্যা?’ একটা ভ্রু উঁচু করে জানতে চায় রাবেক।
‘কি যে বলেন! সমস্যা কোথায়? আপনার মেহমান হওয়ার অনেকদিনের ইচ্ছে আমার।’ হেহে করে বলি আমি, ‘তবে আমার সেইফহাউজে আমাকে ফুটো করে দেওয়ার মাঝে একটা আয়রনিক ব্যাপার হত। আপনার যে নাটুকে ব্যাকগ্রাউন্ড, তা করবেন এমনটাই প্রত্যাশা। তাছাড়া, মিসিং কোয়াড-রেডিওটা উদ্ধার করে ফেলেছিলেন। আমার জীবনে আর কোন মূল্য আছে বলে তো মনে হয় না।’
‘আমি আনি নি এখানে তোমাকে – ইরফান। তুমি নিজেই নিজেকে এনেছ।’ মাথা নাড়ে রাবেক।
‘আমি?’ অবাক হই।
ফারিহা সেই তখন থেকে একদম চুপ। ঘোরের মাঝে আছে যেন।
বাবার মৃত্যুর পর থেকে অনেক বেশি ঘটনাপ্রবাহ এসেছে মেয়েটার জীবনে।
‘অ্যানাদার ডে – বলেছিলে তুমি, ইরফান। বলেছিলে – উই’ল সীল দ্য ডীল অ্যানাদার ডে।’ মুচকি হাসে রাবেক, ‘টুডে ইজ দ্য ডে।’
রাবেকের সাথে প্রথম সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা মনে পড়ে যায় আমার এবার। এই লোক দেখি কিছুই ভোলে না!
এই সময় বাইরে ব্যস্ত পদচারণার শব্দ শোনা যায়। দরজা খুলে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে একজন মানুষ।
এরা সবাই রাবেক বাহিনীর বিশ্বস্ত সদস্য। গোটা বাড়িতে এমন এক ডজন আছে।
এই এক ডজন মানুষই সামনাসামনি চেনে ডন রাবেককে।
‘স্যার, ক্রাইসিস। ইউ নীড টু সী দিস।’ রিপোর্ট করার ভঙ্গীতে বলে সৈনিকটি।
‘আমি ব্যস্ত।’ ইঙ্গিতে আমাদের দেখিয়ে বলে রাবেক।
‘দিস কান্ট ওয়েইট।’ নিঃশ্বাসের ফাঁকে ফাঁকে বলে মানুষটা।
বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়াল রাবেক।
আমাদের দিকে ফিরে তাকাল একবার, ‘এক্সকিউজ মি। আ’ল বি ব্যাক।’
তা আর বলতে – মনে মনে ভাবি আমি। তার ভদ্রতা আর বিনয় এখন দেখার মত।
দরজা দিয়ে উধাও হয়ে গেল রাবেক। শোনা যায় বাইরের গার্ড দুইজনকে বলছে, ‘ভেতরে চলে যাও। চোখের আড়াল হতে দেবে না।’
একই সাথে অবাক বিস্ময়ে দেখি ক্লিক জাতীয় একটা শব্দের সাথে খুলে গেল ফারিহার হাতের হ্যান্ডকাফ। আমার বাম হাতে দ্রুত সেফটি পিনটা গুঁজে দিল ও।
প্রথমবার রাবেকের ওপর সরাসরি হামলা করে আহত অবস্থাতে ফারিহাদের বাসাতে সাতদিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলাম। তখন ওকে শিখিয়েছি এই ট্রিকটা। আরও কিছু শিখিয়েছি। পিক-লক। টাইং নটস।
মেয়েটার হাত চালু – ছাত্রীর পারফর্ম্যান্স দেখে গর্বে আমার বুক ফুলে গেল।
পেছনে ঢুকে পড়েছে দুই গার্ড। তবে আমাদের পিঠ তাদের দিকে ফেরানো বলে ফারিহার মুক্ত হাত অথবা আমার হাতের মৃদু নড়াচড়া ওদের চোখে পড়ে না।
দুইজন অসহায় বন্দী স্থির হয়ে বসে আছে। এ ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে তাদের?
ঝাড়া পয়তাল্লিশটা সেকেন্ড লেগে গেল সঠিক মাপে সেফটিপিনটা বাঁকাতে।
তারপর একটা মৃদু ক্লিক শব্দ – যেটা গার্ডদের কান এড়ানোর কোনই উপায় নেই ছোট এই বদ্ধ ঘরে!
দুই লাফে সামনে বাড়ল গার্ড দুইজনই। এবং প্রথম ভুলটা করে বসল।
একজনকে সব সময় নাগালের বাইরে থেকে কাভার দিতে হয়।
কাজেই গর্ধভ দুটোর মাঝে বাম দিকের জনকে বেছে নিলাম।
চট করে লোকটার মাথা সজোরে ঠুকে দিলাম সামনের টেবিলে। একই সাথে অন্যজনের দিকে এক লাথিতে পাঠিয়ে দিয়েছি ফারিহা উঠে পড়ায় এই মাত্র খালি হয়ে যাওয়া চেয়ারটা!
হাঁটুর নিচে বাড়ি খেয়ে স্রেফ উড়ে যায় লোকটা। পরক্ষণেই টেবিল থেকে মাথা তোলার চেষ্টা করতে থাকা গার্ডের ঘাড় ধরে সজোরে মুচড়ে দিলাম। ঘাড় ভাঙ্গার বিশ্রী শব্দটার সাথে চোখের আলো নিভে গেল শত্রুর।
বাম হাতে CZW 9 টা তুলে নিয়েছি, আর ডান হাতে উঠালাম আমার চেয়ার। ভূমিশয্যায় শায়িত মানুষটার হাত একটু আগের আঘাতে পড়ে যাওয়া সাবমেশিনগানটার দিকে এগুচ্ছে।
চেয়ারটা ওপরে তুলে সজোরে তার মাথায় নামিয়ে আনতেই থেমে যায় ওই খাহেশ।
জ্ঞান হারিয়েছে না মারা গেছে – চেক করার প্রয়োজন মনে করি না। আপাতত এর থেকে জরুরী কাজ বাকি আছে। পড়ে থাকা দেহটা থেকে স্পেয়ার ম্যাগাজিন খুলে নিয়ে নিজের কোমরে আটকালাম। ফারিহার হাতে দ্বিতীয় গার্ডের CZW 9 টি তুলে দিয়ে দ্রুত একটা ব্রিফ দিলাম, যে কোন মুহূর্তে একটা বাড়তি অস্ত্র কাজে লাগতে পারে।
এখন পর্যন্ত সব কাজ নিঃশব্দে করা গেছে। এবার এখান থেকে বের হতে হবে।
‘আমার পেছনে থাকবে।’ আস্তে করে বলি ফারিহাকে।
তবে এগুতে পারি না। আমার হাত ধরে আটকে ফেলে মেয়েটা। দুই চোখে বিরাজ করছে নিখাদ আতংক।
আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ফারিহা – কাঁধে ওর থুতনি অনুভব করছি।
‘এভরিথিং উইল বি অলরাইট।’ বার দুই আউড়ালাম সেই বাক্য যেটা মানুষ অনিশ্চিতভাবেই আউড়ায়।
নিজের প্রাণের মায়াতে মেয়েটা আবেগাপ্লুত হচ্ছে না জানি।
ফারিহার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে রাবেক। আমাকে হারানোর ভয়টা ওর মাঝে এখন কাজ করছে সবচেয়ে বেশি।
‘এখান থেকে ভালোভাবে বের হব আমরা, বোকা মেয়ে।’ ওর কাঁধ ধরে সোজা করে হাসিমুখে বলি আমি, ‘আজ রাতে ডিনার করব জিং ওয়াং-এ। বিল আমার।’
আমার নির্মল হাসির দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস খুঁজে নিতে পারে অবশেষে ও। চোখ মুছে শুধু বলে, ‘লেটস গো।’
সাবধানে মাথা বের করি। বাড়িটা চমৎকার।
ডুপ্লেক্স এটাও।
রাবেকের কয়টা ডুপ্লেক্স আছে কে জানে! সিঁড়ি ঘরের নিচের একটা ঘরে আমাদের রাখা হয়েছিল।
দরজা দিয়ে বের হলেও আর আগাই না আমরা , সিঁড়ির আড়ালে থাকায় বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাইরে কয়জন আছে বোঝার উপায় নেই।
দূরে রাবেকের আতংকিত চিৎকার শোনা যাচ্ছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি আমি।
বেঁচে থাকাটা এখন জরুরী নয় আমার জন্য। প্ল্যান অনুযায়ী ধ্বংস হয়ে গেছে রাবেক। তবে যেতে যদি হয়ই সাথে করে রাবেককে নিয়ে যেতে হবে।
নাহলে একটা সাম্রাজ্য ভেঙ্গে ঠেকানো যাবে না এই লোককে। আরেকটা গড়ে নেবে। এদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। ফিনিক্স পাখির মতো জীয়নক্ষমতা!
আমাদের দিকে হা হয়ে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল এই মাত্র টহল ডিউটিতে থাকা চলে আসা লোকটা। তারপরই হাত বাড়ায় পিস্তলের দিকে।
কড় কড় করে গর্জে উঠল আমার সাবমেশিনগান। নাভি থেকে বুক পর্যন্ত সেলাই হয়ে গেছে লোকটার। গুলির শব্দে পুরো বাসাটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায়!
দীর্ঘশ্বাস ফেলি একটা। আর কোন উপায় ছিল না।
ফারিহাকে ইশারা করলাম ওখানেই থাকতে। তারপর আস্তে করে উঁকি দিলাম সিঁড়ির কোণা থেকে। দূরে মাত্র পজিশন নেয়া মানুষ তিনজন একই সাথে গুলি ছোঁড়ে – তবে এগিয়ে আছি আমি।
একপশলা গুলিতে একজনকে শুইয়ে দিয়েই আড়ালে সরে গেছি।
ম্যাগাজিন পাল্টাচ্ছি দ্রুত হাতে – অন্যপাশ থেকে নতুন দুই ঝামেলাকে দেখা গেল দরজা খুলে বের হচ্ছে। হাঁটু গেড়ে বসে মনের সুখে বুলেটবৃষ্টি চালালাম ওদের ওপর।
সাথে সাথে উদয় হয় তৃতীয়জন।
এর হাতে একটা গ্রেনেড।
মেশিনগানের শেষ বুলেটগুলো একেও কেঁচে ফেলে – তারপর ঠং করে একটা শব্দ বোঝায় ফাকা চেম্বারে আছড়ে পড়েছে হ্যামার। কিন্তু গ্রেনেডটা তখন বাতাসে উড়ন্ত – গতিপথ – সোজাসুজি আমাদের দিকে।
আর একই সাথে ফারিহার হাত ধরে এক ছুটে রাবেকের ইন্টোরেগেশন চেম্বারে ফিরে আসি আমরা।
দরজা থেকে সরে বসে পড়লাম মেঝেতে।
ঠিক বাইরে বিকট শব্দে ফাটে গ্রেনেডটা – পুরো বাড়ি কেঁপে উঠলো এ বিস্ফোরণে। একটা সেকেন্ড অপেক্ষা করে আবারও বেরিয়ে আসি আমি। গ্রেনেডে উড়ছে ধুলো আর সেটিকেই স্মোক স্ক্রীণ হিসেবে কাজে লাগিয়ে এগুলাম। আচমকা গুলি করে পজিশন নিয়ে থাকা অন্য দুইজনকে শুইয়ে দিয়ে আরও সামনে চলে এলাম আমরা।
শটগানের বিকট শব্দ কানে তালা ধরিয়ে দেয়। ছুটতে ছুটতেই দোতলাতে দাঁড়ানো মসবার্গ শটগান ধরে থাকা লোকটাকে চোখে পড়ে আমার। সেই সাথে দ্বিতীয়বার গর্জে ওঠে প্রতিপক্ষের হাতের শটগান এবং একই সাথে কোমরের কাছ থেকেই গুলি করি আমিও।
শটগানধারীকে পেছনে পড়ে যেতে দেখলাম – লক্ষ্য করলাম লেগেছে আমারও। বাম কাঁধ থেকে একটা লাল ধারা বুক বেয়ে নেমে যাচ্ছে।
শটগান শেলকে পাত্তা না দিয়ে দোতলায় এই মাত্র উদয় হওয়া পিচ্চি সাবমেশিনগানধারীর দিকে তিনবার ট্রিগার টানলাম। সিঙ্গেল শট মোডে নিয়েছি হাতের CZW9।
সর্বশেষ ম্যাগাজিনটা ভরে ফেলে নতুন আপদের জন্য চোখ ফেরাতেই থমকে গেলাম।
ওপরের আরেকটি দরজা খুলে যাচ্ছে।
তারপরই চোখে পড়ল ঈশিতার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে লম্বা পায়ে বেড়িয়ে আসা মানুষটাকে।
রাবেক।
নীচ থেকে ছুটে আসছে ফারিহা।
ওকে একবার চিৎকার করে মানা করলাম, আড়াল থেকে যেন কোনভাবেই বের না হয়।
ঘরটা ভরে গেল ড্রামা-কিং রাবেকের গমগমে গলাতে, ‘ কনগ্রাচুলেশনস! ইউ ওন দিস গেইম ইরফান। নাউ, লেটস সীল দ্য ডীল।’
এক ধাক্কায় শরীরের বাম অংশ পিছিয়ে গেল আমার। রাবেকের পিস্তলটা আমার দিকে তাক করা।
নলের চারপাশে হাল্কা ধোঁয়া উঠছে।
সেই ধোঁয়া ভেদ করে ছুটলো আমার ছোঁড়া বুলেট। ধার করা সাবমেশিনগানের পুরো ম্যাগাজিনটা খালি করে দিলাম। রাবেকের বুক থেকে গলা সেলাই হয়ে গেল স্রেফ।
‘ফর মাই মাদার -’ নিজের গলা নিজেই চিনতে পারি না আমি!
পরমুহুর্তেই হুড়মুড় করে পড়ে যাই মাটিতে। মেঝেতে হাত পড়তেই বুঝতে পারলাম পিচ্ছিল রক্তে ভরে গেছে জায়গাটুকু।
ফারিহা চলে এসেছে আমার খুব কাছে। দুই চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে মেয়েটার। তার মাঝেই কি সুন্দরই না লাগছে ওকে!
ঈশিতাকে দেখতে পেলাম সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে।
বুকের মাঝখানে তীব্র একটা ব্যথা। এবার সেদিকে আস্তে করে চোখ ফেরালাম।
কল কল করে রক্ত বের হচ্ছে বুকের বাম দিক থেকে। সেই রক্তে ভিজে যাচ্ছে মেঝে।
ঝুঁকে পড়ে আমার হাত তুলে নেয় ফারিহা নিজের হাতে। কি গরম ওর হাত!
ঈশিতা আমার মাথা তুলে নিয়েছে নিজের কোলে।
কিছু একটা বলছে – আমি আর শুনতে পাই না।
ফারিহা পরম মমতায় আমার ঠোঁটে মুখ রাখে – নিজের ভেতর থেকে বাতাস দিয়ে দেয় আমাকে –
আমি কিছুই অনুভব করি না।
অন্ধকার – গাঢ় একটা অন্ধকার টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে কোন পাতালে।
আর – পড়ে যাচ্ছি আমি।

পরিশিষ্ট
‘মর্চুয়ারী থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি আমরা ওকে?’ ঈশিতার গলার সুরটা বুঝতে পারে ফারিহা।
মেয়েটা ইরফানকে এখনও জীবিত বিবেচনা করেই কথা বলছে।
ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য অপেক্ষা করছে ওরা শুধু। একজন ডাক্তারের সিগনেচার। তারপরই রিলিজ দেওয়া হবে দেহ।
‘জানি না, ঈশিতা। ওর কোন ইচ্ছে কি ছিল?’ স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও এক ফোঁটা পানি অনুভব করে ফারিহা নিজের গালে।
‘মায়ের যেখানে মৃত্যু হয় সেখানেই শুতে চেয়েছিল ও।’ এবার আর পারে না – দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ঈশিতা, ‘আমার সব শেষ হতে গেল, আপু।’
ওকে জড়িয়ে ধরে ফারিহা। গভীর মমতার আলিঙ্গনে একই সাথে সমবেদনা আর হতাশা।
ঈশিতাকে স্বান্তনা দিচ্ছে ও – কিন্তু ওকে স্বান্তনা দেবে কে?
‘ভাইয়া আমাকে যেদিন রাবেকের কাছে চলে যেতে বলল, সেদিনই বলেছিল আর হয়ত দেখা হবে না। ওহ আমি কি বোকা! কি বোকা আমি! তবুও মেনে চলেছিলাম ভাইয়ার প্ল্যান!’
‘সবার জন্য-’ নিজেকে একটু সামলে শুধু বলে ফারিহা, ‘-সবার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইরফান। রাবেকের মাফিয়া সাম্রাজ্য একেবারে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে।’
রাবেকের ডিজিটাল কোডিং সিস্টেমকে ব্যাক ফায়ার করার সিদ্ধান্ত ইরফান নিয়েছিল বহু আগে। যেদিন অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর পাওয়া ডিভাইসটার মর্ম ও উদ্ধার করেছিল, তখন। এরপর ঈশিতাকে পাঠিয়ে দেয় রাবেকের কাছে। আর নিজে ব্যস্ত থাকে পঞ্চম হেডফাইভের সন্ধানে। অভিনয় চালিয়ে যায় সবার সাথে, যেন এসবই ঘটছে তার পরিকল্পনার বাইরে!
প্ল্যানের একটা অংশ ছিল যেদিন রাবেক ইরফানকে সশরীরে ধরে ফেলতে পারবে – সেদিনই হিট নেবে ওরা। ঈশিতা কন্ট্রোল রুমের ব্যাপারে যথেষ্ট জেনেছে এ কয়দিনে। মেয়েটাকে কোয়াড কোডিংয়ে সর্বাত্মক সাহায্য কম করেননি রিজভী আকন্দ। তবে ঈশিতা পরবর্তীতে ইরফানের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। ওরা একসাথে কাজ করছে এমন কোন প্রমাণ থাকলে রাবেক সবটাই গড়বড় করে দিত। কোয়াডকোডিংয়ের কল্যাণে ইন্টারনালি রিজভী আকন্দই যোগাযোগ রাখতেন মেয়েটার সাথে। ইরফান একটি ভূতুড়ে কোয়াড-রিসিভার রাডারে আনলে সবটা কেঁচে যেত।
ইরফানের প্ল্যানটি ছিল সহজ – চারটি গ্রুপকে নিজেদের মাঝে তুমুল লড়াইয়ে নামিয়ে দেওয়া।
রিজিওনাল হেড চোখ বন্ধ করে কোড মেনে চলবে। তার জানার কথা নয় কোয়াডরুপল কারা! নিরাপত্তা এতে যেমন ছিল নিখুঁত, তেমনই এ ছিল তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
শুধু খোঁজ পাওয়া যায়নি একজন মানুষের। স্রেফ উধাও হয়ে গেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ।
একা একজন গডফাদারকে ঠেকিয়ে দিয়েছিল ছেলেটা, ঘায়েল করেছিল তাদের নিজস্ব অস্ত্র দিয়ে! ইরফানের জন্য অনেকখানি গর্ব অনুভব করে ফারিহা। আর বেদনা।
সাদা অ্যাপ্রন পরা ডাক্তারকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। নিজেই চলে এসেছেন দুই তরুণীর কাছে। মিনহাজের সাথে অনেকদিন কাজ করেছেন তিনি। চেনেন সবাইকে। জানেন তাৎপর্য।
হাতের ফাইলে একটি ডেথ সার্টিফিকেট।
চোখভরা বেদনা নিয়ে কঠিনতম সত্যটির দিকে তাকিয়ে থাকে মেয়ে দুটো।

— ০ —

দ্য ফিফথ হেডফাইভ


ব্যাংকের ভেতর থেকে বের হতেই কোলাহল কানে বাজল।
এতটা নীরব ছিল ভেতরে, বাইরের এইটুকুকেই মনে হল রীতিমতো চেঁচামেচি যেন! আদতে এমন শব্দ প্রতিনিয়তই শুনতে হয় সবাইকে।
শান্ত পায়ে হাঁটছি আমি। ঈশিতাকে টাকাটা পৌঁছে দিয়ে আরেকবার বের হতে হবে আজ। মিনহাজের জরুরী তলব আছে।
চকচকে কালো রঙের গাড়িটাকে পাশ কাটালাম। কড়া রোদ উঠেছে আজ।
দূরে দুইজনকে ঝগড়া করতে শোনা যাচ্ছে। এদের পেশা – ভিক্ষাবৃত্তি।
ঝগড়ার কারণটা চমৎকার! একটু আগে যাওয়া লোকটা পঞ্চাশ টাকার নোটটাকে ভাগাভাগি করে নিতে বলেছে – সেটা আরেকজন মেনে নিচ্ছে না।
হাসতে পারলাম না অবশ্য – চোখের কোণে একটা মৃদু নড়াচড়া ধরা পড়েছে।
সাইড রোড থেকে একেবারেই হঠাৎ বেরিয়ে এল একটি গাড়ি। চট করে বামদিকের রোডে নেমে পড়লাম। এরকম চকচকে কালো রঙের গাড়িকে একটু আগেই পাশ কাটিয়েছি। একই মডেল, একই মেক। মনে হচ্ছিল যেন একই গাড়ি। কাকতালীয় ঘটনা?
না বোধহয়। আমার মত জীবন যাদের তাদের জন্য কোন কাকতালীয় ঘটনা নেই। কোন দুর্ঘটনা নেই।
যা হয় তার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে বাধ্য।
গলিটার ভেতরে জোর কদমে অর্ধেকটা ঢুকে গেছি – এই সময় গলির মুখে কালো পোশাক পড়া দুইজনকে ঢুকে পড়তে দেখা গেল।
ফোনটা বের করে মিরর অ্যাপ চালিয়ে চট করে দেখে নেই – ফলোয়ার চিনতে এই অ্যাপের জুড়ি নেই।
হুম – কোটের ভেতর কি অমূল্য সম্পদ রেখেছে জানার উপায় নেই। তবে একটু করে ফুলে আছে দুইজনই।
ভারমুক্ত করা লাগবে দেখছি!
এত দ্রুত সরকারি এজেন্সী আমাকে পেয়ে গেল কি করে?
বেশি ভাবতে হয় না অবশ্য – ব্যাংকের প্রায় সবগুলো সিকিউরিটি ক্যামেরা এড়িয়ে গেলেও অন্তত একটা আমাকে ক্যাপচার করেছে নিঃসন্দেহে! দক্ষিণ কোণেরটা। আমার চেহারা আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে চলে যাওয়ার পর থেকে এমন তাড়া মাঝে মাঝেই খেতে হয় এখন আমাকে।
শালার রাবেক! – মনে মনে প্রাণখুলে গালি দেই ব্যাটাকে।
তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না অবশ্য! পেছনের দুইজন আঠার মত লেগে আছে!
সাথে গ্লকটা নেই। নয়তো ওজন কমিয়ে দিতে পারতাম দুটোরই! পেছনে ছোঁক ছোঁক করতে থাকা লোকজনকে অসহ্য লাগে আমার।
ব্যাংকে অস্ত্র নিয়ে ঢোকার কথা চিন্তাও করা যায় না! এসব জায়গা এজন্যই আমি এড়িয়ে চলি। অথচ আজ না এসে উপায় ছিল না।
তিনটি অ্যাকাউন্টের ব্যালান্সই ফাঁকা হয়ে গেছে। কিডন্যাপিং-এর পেশা ছেড়ে দেওয়ার পর ছোট একটা চাকরী ধরেছিলাম।
সার্টিফিকেট অনুযায়ী অন্তত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা হয়ে যাওয়া উচিত আমার কোন কোম্পানিতে – কিন্তু অন্ধকার জগতে এত কামিয়েছি, কোথাও চাকরি নেওয়ার চেষ্টাও করিনি।
যে চাকরিটি শুরু করেছিলাম – সেটা ছেড়ে দিতে হয়েছিল কাভার ওড়ার পর।
দিন অনেকই পার হয়ে গেছে। তিনটি ব্যাংকে জমানো টাকা রাখা ছিল সিকিউরিটি হিসেবে। ম্যানুয়ালি ছাড়া নেওয়া অসম্ভব। এদের থেকে কার্ড নেইনি কখনো। সেটি নিতেও আমাকে সশরীরে যেতে হতো। সিস্টেমের বাইরে বহুদিন থাকার কুফল হচ্ছে, চট করে কোন ‘ওয়ার্ক-অ্যারাউন্ড’ পাওয়া সহজ নয়।
কাজেই খালি হাতে বের হতে হয়েছে আজ আমাকে। এখন পেছনের দুই সমস্যাকে ছুটানোটা একটু সমস্যা হয়ে গেল!
সামনের দিকে তাকালাম। গলিটি শেষ হয়ে আসছে। যেকোন সময় ওপাশ থেকে বেড়িয়ে আসবে একটি গাড়ি, বেশ বুঝতে পারছি। এভাবেই কাজ করে ওরা। দুইজনকে ওই দিক দিয়ে ঢুকিয়ে গাড়ি নিয়ে এসে অন্যপাশ থেকে ঢুকে গেলেই আমার জাড়িজুড়ি খতম একেবারে!
চোখদুটো দ্রুত নড়াচড়া করছে আমার।
রাস্তার দুইধারের একটা বাড়িতেও কি বহিরাগতদের ঢোকার উপায় নেই নাকি? সবগুলোর বাইরের গেটে তালা বসানো।
মানে, বাসিন্দাদের কাছে ওগুলোর চাবি থাকলেও আমার পকেট তো ফাঁকা!
ভালোই বুঝতে পারলাম – কঠিনতম চিপাতে পড়েছি! এস্কেপ প্ল্যান এখান থেকে করাটা প্রায় অসম্ভব।
কোন কিছুই নিজের অনুকূলে রাখার সুযোগ পাইনি। এই গলিতে না ঢুকে আরও বিশ ফিট এগিয়ে যেতে পারলে তিনদিকে কেটে পড়ার একটা পথ ছিল। কিন্তু খুব দ্রুত কাজ করেছে সরকারি এজেন্সী।
এই সময় দেখতে পেলাম আর মাত্র পনের ফিট দূরে লাল রঙের গেইট থেকে বের হল একটা মেয়ে।
মেয়েটাকে স্রেফ স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরী বলে মনে হল আমার! মাথায় একসাথে কয়েকটা এস্কেপ প্ল্যান খুলে দিচ্ছে!
কিন্তু পরক্ষণেই নিরাশ হয়ে যাই! ক্লিক করে তালাটা লাগিয়ে দিল মেয়ে আবার – আমি তখনও দশ ফিট দূরে!
পেছনের ওরা কাছে চলে এসেছে আগের চেয়ে। অ্যানিটাইম সামনে থেকেও গাড়ি বের হয়ে আসবে বুঝতে পারলাম। কাজেই প্ল্যান বিতে চলে যেতে হল আমাকে বাধ্য হয়েই!
মেয়েটা পাশ দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিল – কেউ কিছু বোঝার আগেই একপাশ থেকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসি আমি ওকে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মাঝেই ওর এক হাত মুচড়ে থ্রি সিক্সটি ডিগ্রী অ্যাংগেল ঘুরে যাই – আমার সামনে নিজের অজান্তেই মানব-বর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা। কেউ গুলি ছুঁড়লে আমার আগে ওকে ফুঁড়বে – এটা বোঝে দুই কালো পোশাকও। তবুও নিমেষেই বের করে ফেলে পিস্তল।
আমার হাতেও বেড়িয়ে এসেছে কলমটা। ব্যাংকে এটা দিয়েই সাইন করেছিলাম। সুইচ টিপতেই তিন ইঞ্চির চিকন কিন্তু স্পাতদৃঢ় ফলাটা বের হয়ে এল ডগা থেকে, অগ্রভাগটা স্পর্শ করলাম মেয়েটার গলায়।
‘মেয়েটাকে ছেড়ে দাও, ইরফান।’ ঠান্ডা গলায় বলে ফলোয়ারদের একজন।
‘নিশ্চয়!’ পূর্ণ সমর্থন জানাই আমি তাকে। ‘দুইজনই অস্ত্র মাটিতে রেখে পা দিয়ে ঠেলে আমার দিকে পাঠিয়ে দাও। ছেড়ে দিচ্ছি ওকে।’
আমার হাতের নিচে ফুঁপিয়ে ওঠে মেয়েটা। এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে নিশ্চয় ভাবেনি?
‘মাথা খাটাও, গর্দভ!’ হিস হিস করে বলে দ্বিতীয় মানুষটা। ‘তোমাকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। যে কোন সময় আমাদের পোশাকে ভরে যাবে এলাকা।’
ওদের দিকে একটু লক্ষ্য করি। বাংলাদেশে আবার সিক্রেট সার্ভিস এল কবে থেকে? নাকি স্নিফার্স এরা?
স্নিফার্সই হবে! এই এজেন্সীটা সরকারি এবং বিনা বিচারে ক্লিনিংয়ে ওরা দক্ষ। ২০১২য় গঠিত।
তবে ওরাই কি না – নিশ্চিত হবার উপায় নেই। দূরত্ব মাপলাম আমি। অস্ত্র নামায় নি দুইজনের কেউই – তারওপর এগিয়ে আসছে। দূরত্ব কমছে আমাদের।
একেবারেই হঠাৎ অ্যাংগেলটা আবিষ্কার করলাম। একটু আগে পরে সামনে বাড়ার ফল! মেয়েটাকে দ্বিতীয় স্নিফার্সের দিকে ছুঁড়ে ফেলেই মাটিতে একটা ডিগবাজি দিলাম। হাত থেকে ফেলে দিয়েছি কলম। ওটার আর দরকার নেই। তবে এতক্ষণ অপেক্ষা করার মত মানুষ না প্রথম স্নিফার্স – সামনে থেকে হোস্টেজ সরে যেতেই প্রথম গুলিটি করে বসল লোকটা।
নিস্তব্ধ গলিটাতে প্রতিটি বিল্ডিংয়ের সাথে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনীত হল গানশটের শব্দ!
ডিগবাজি খেয়ে সামনে এগিয়ে গেছি, কাজেই আমাকে ছোঁয় নি বুলেটটা। দেখলাম, দ্বিতীয় স্নিফার্সের বুকে আছড়ে পড়ছে হোস্টেজ মেয়েটা এবং দ্বিতীয় গুলি করার জন্য ট্রিগারে বসে যাচ্ছে প্রথম স্নিফার্সের আঙুল।
গুলিটা বেরিয়ে যায়, তবে তার আগেই ওর হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লাইন অফ ফায়ার সরিয়ে আকাশের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছি। হাত সমান করে নাকে একটা মারলাম সম্মানীস্বরূপ।
আধ ইঞ্চি দেবে গেল কি এর নাক?
দেখার সময় কোথায়? লোকটার ডান হাতের নার্ভ সেন্টারে একবার আঘাত করে সক্রিয় হাতটাকে অচল করে দিলাম এবার। দুই চোখে তীব্র মৃত্যুভয় ফুটে উঠেছে এবার। একই সময়ে ওর হাতের পিস্তলটা কব্জা করে নিয়েছি কি না!
দ্বিতীয় স্নিফার্সকে দেখা যায় মেয়েটাকে সামনে থেকে সরিয়ে অস্ত্র বাগাচ্ছে – সেই সাথে গলির অন্য পাশ থেকে তীব্র বেগে ছুটে আসছে একটা চকচকে কালো রঙের গাড়ি!
দিনের প্রথম গুলিটা ছুঁড়ে দ্বিতীয় স্নিফার্সের বাম কাঁধ গুড়িয়ে দেই – বাম কাঁধ পিছিয়ে যাওয়ার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াতেই ডান কাঁধ সামনে এগিয়ে আসে। আমার থেকে বেশ ডান দিয়ে বেড়িয়ে যায় বুলেটটা।
দ্বিতীয় গুলিতে ফেঁসে যায় কালো গাড়ির একটা টায়ার। সামনে পড়ে যাওয়া হোস্টেজ মেয়েটাকে এড়াতে বেশ কসরত করতে হল ড্রাইভার ভদ্রলোককে।
এতটুকু দেখেই আর থামলাম না আমি। একটু সামনে পাওয়া প্রথম টিনশেড বাসাটার দরজার তালা এক গুলিতে উড়িয়ে দড়াম করে লাথি বসালাম কবাটে। বিনা প্রতিবাদে এবার দরজাটা খুলে গেল আর আমিও হামলে পড়লাম ভেতরে।
সামনে একটা করিডোর। মাথার ওপর খোলা আকাশ।
কড়িডোরের শেষ মাথায় দেওয়াল। তার নিচে জমিয়ে রাখা ইটের স্তুপ রাখায় বাড়ির মালিককে ধন্যবাদ জানাই অন্তরের অন্তস্থল থেকে! তারপর ছুটন্ত গতি সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়ে এক চাপে নিজেকে ওপরের দিকে তুলে ফেলি। দেওয়ালটা টপকাতে পারলেই অন্য পাশের রোডে গিয়ে পড়া সম্ভব।
পেছন থেকে কে জানি গুলি করল – আমায় লাগলো না যেহেতু, আমলে নিলাম না। সময় নেই।
এক ঝাঁপে দেওয়ালের অন্য পাশে ল্যান্ড করে থমকে গেলাম। আর দৌড়ঝাঁপের মানে হয় না।
অন্তত পঁচিশ জন স্নিফার্স অপেক্ষা করছে এই রোডে।
আমাকে দেখেই অস্ত্র তুললো প্রত্যেকে।
আস্তে করে নিজের হাত থেকে সিগ-সাওয়ারটা ফেলে দিলাম। স্নিফার্সের প্রতি মেম্বারের হ্যান্ডগানের জন্য বাংলাদেশ সরকার সাড়ে ছয়শ ডলার খরচ করে কিভাবে?
পুরোই অপচয়!
ছ’টাকে ধোঁকা দিয়ে আরেকটু হলে বেরিয়েই গিয়েছিলাম আমি।
আমার হাতে চটপট হাতকড়া পড়িয়ে দেওয়া হল। ওদিকে এই ফোর্সের লিড যে দিচ্ছে – তাকে দেখলাম ওয়াকিটকিতে কথা বলছে।
ফ্যান্টম ইরফান প্রথমবারের মত ধরা পড়েছে – বাহিনীর সবাই নিশ্চয় সাফল্যে উদ্বেলিত হয়ে ট্যাংগো ডান্স দিচ্ছে?
আরেকটা গাড়ি এসে থামল এই রোডে।
দরজা খুলে যিনি বের হলেন তাকে লক্ষ্য করলাম। একনজর দেখে বুঝতে পারলাম, ইনি কোন চুনোপুঁটি নন। আমাকে হাতকড়া পড়ানো স্নিফার্স আমার কানের পাশে মৃদু কন্ঠে জানিয়ে দেয়, ‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ। ডিফেন্স অ্যাডভাইজার। কথাবার্তা ঠিকমত বলবে।’
সহবত শেখাচ্ছে?
সেটা নিয়ে ভাবি না অবশ্য, বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেছি! ডিফেন্স অ্যাডভাইজার আমার কাছে কেন?
সামনে এসে আদেশের সুরে বলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ, ‘আনকাফ হিম।’
তারপর আমার দিকে ঘুরে তাকান, ‘উই নিড ইয়োর হেল্প, মি. ইরফান।’


ডিফেন্স অ্যাডভাইজারের পাশে বসে আছি গাড়িতে।
মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরছে – তবে মুখ ফুটে কিছুই বললাম না। সময় হলেই বলা হবে আমাকে – সেটা জানি।
দেরী করেন না অবশ্য তিনি, মুখ খোলেন, ‘আমাদের হাতে সময় নেই বেশি, মি. ইরফান। কাজেই রাস্তাতেই আপনাকে ব্রিফ দেব। আমাদের সাথে ছোট একটা কাজ করতে হবে আপনাকে।’
কাজ?
আমার মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? না বলে পারলাম না, ‘আমি যদি ইন্টারেস্টেড না থাকি?’
একটু হাসেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, ‘আপনি আমাদের কাজে ইন্টারেস্টেড না থাকলেও আপনার ব্যাপারে অনেকেই ইন্টারেস্টেড। পুলিশ, অ্যান্টিটেররিজম এজেন্সী, স্নিফার্স – সবারই যথেষ্ট আগ্রহ আছে আপনার ব্যাপারে। বুঝতেই পারছেন!’
বুঝতে পারলাম।
চৌদ্দ শিকের মাঝে চলে যাওয়া তো সময়ের ব্যাপার। তারপরে মাথা থাকবে না উড়ে যাবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই আমার। কতগুলো সত্য মামলা, আর অনেকগুলো মিথ্যে মামলা, থ্যাংকস টু রাবেক। ওদের সাথে তাল না মিলিয়ে উপায় নেই!
‘তাহলে, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আপনারা কোন গভীরতার গর্তে পড়েছেন সে ব্যাপারে আলোকপাত করুন।’ বলি আমি।
‘ইয়ে -’ বোঝাই যাচ্ছে নিজেদের অক্ষমতা সরাসরি প্রকাশে বাঁধছে মানুষটার, ‘এভরিথিং ইজ আন্ডার কন্ট্রোল। শুধু আপনার কিছু মতামত জানা দরকার – ড্রিংক চলবে?’ মিনি ক্যাবিনেট থেকে একটা চ্যাপ্টা বোতল বের করে জানতে চান তিনি।
‘এতই আন্ডার কন্ট্রোলড থাকলে আমাকে ড্রিংক অফার করার দরকার হত বলে মনে হয় না।’ চাঁচাছোলা গলাতে বলে দেই আমি – মাহমুদের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল একথায়।
‘গতকাল সন্ধ্যায় হোম-মিনিস্টারের মেয়েকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।’ প্রতিটা শব্দ থেমে থেমে উচ্চারণ করেন তিনি, ‘কিডন্যাপিং-এ আপনার সমকক্ষ স্কিলের কাওকে বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন।’ একটু কেশে বললেন, ‘যদিও রিটায়ার্ড, তবে আপনার মতো এক্সপার্ট কারো সাথে কনসাল্ট করতে চাইছি আমরা। কাজটা করে দিন, এবারের মত ভুলে যাব ইরফান নামে কাওকে অ্যারেস্ট করতে হবে।’
মাথা দোলালাম। স্নিফার্সরা সরাসরি হোম মিনিস্টারের আন্ডারে চলে। এত আয়োজন করে আমাকে শুধু মাত্র ধরে আনার মানে এখন বেশ বুঝতে পারছি।
সবকিছু এখন পানির মতই পরিষ্কার!
*
স্নিফার্সের হেডকোয়ার্টারে বসে আছি।
হোমমিনিস্টারের সবচেয়ে ভরসা এই বাহিনীর ওপর। বাংলাদেশের আইন যা-ই বলুক, মন্ত্রী-মিনিস্টার সব সময় পুলিশকে নিজের লেঠেলের মতো ব্যবহার করেছে। কাজেই হোম-মিনিস্টার যে স্নিফার্সকে ব্যবহার করবে ব্যক্তিগত তৈজসপত্রের মতো তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যস্মিনদেশে যদাচার।
উদ্ধার করতে হবে সতের বছরের একটা মেয়েকে।
স্নিফার্সের ড্রেস পড়ার জন্য আমাকে বলা হয়েছিল। এককথায় প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছি।
কনুই পর্যন্ত হাতা গোটানো ফুলহাতা শার্টের সাথে কালো জিন্সেই যথেষ্ট স্বস্তি অনুভব করছি।
স্নিফার্সের ডিরেক্টর সালাউদ্দীন চৌধুরী ব্রিফ দিচ্ছেন এখন। প্রজেক্টরের সাহায্যে পর্দায় এক ফুটফুটে কিশোরীকে দেখা যাচ্ছে।
‘আনিকা তাবাসসুম রহমান। বাবা রায়হান রহমানের ব্যাপারে পরিচয় দেওয়ার নতুন কিছু নেই। মেয়েটির বয়েস সতের। বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রী, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। গতকাল সন্ধ্যার সময় কলেজ ছুটির পরে মেয়েটিকে কলেজে পায়নি ড্রাইভার। ধারণা করা হচ্ছে আনুমানিক বিকেল চারটা থেকে ছয়টার মাঝে কিডন্যাপ করা হয়েছে ওকে।’
আমার মাথায় চলে আসে বেশ কয়েক মাস আগের কিছু স্মৃতি, তখন কলেজ পড়ুয়া একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করতে মাঠে নেমেছিলাম আমি নিজেই।
‘কিডন্যাপাররা মেয়েটির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছে গতকাল রাত বারোটায়।’ বলে চলেছেন সালাউদ্দীন চৌধুরী, ‘মুক্তিপণের পরিমাণটা জানিয়ে দেয় তারা। একশ কোটি টাকা। সময় তিনদিন। যার মাঝে মূল্যবান অর্ধদিন নষ্ট করে ফেলেছি আমরা। এগুতে পারিনি মোটেও।’
আড়চোখে একবার দেখলাম, চোখ গোল গোল হয়ে গেছে টীমের সবার।
মাত্র পাঁচজনকে নিয়ে গঠিত স্পেশাল এই টীমটার একজন সদস্য হিসেবে আমাকেও গোণায় ধরা হচ্ছে। বাকিদের মাঝে ড্যাম কেয়ার ভাব নিতে থাকা মৃধা, শান্ত মুখভঙ্গীর জন্য বিখ্যাত শুভ, সবসময়ই ছটফট করতে থাকা রিয়াদ আর খুনীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার অভ্যাস যে ছেলেটার সেই রেজা – প্রত্যেকেরই চেহারা দেখার মত হয়েছে টাকার অংক শুনে।
মনে মনে ভাবি আমি, বেশ করেছে। টাকা তো যেখান থেকে পেরেছেন পকেটে ঢুকিয়েছেন – এখন সময় হয়েছে কিছু বের করার!
তবে সেটা নয়, মেয়েটার জীবনের নিরাপত্তা দেখছি না আমি। এটাই ভয়ের ব্যাপার।
উঠে দাঁড়াই আমি, ‘আমাদের সমস্যা এখানে টাকাটা না, গাইজ। সমস্যা হল, আজকের কিডন্যাপাররা টাকা পেয়ে যাওয়ার পর আর ফিরিয়ে দেয় না কিডন্যাপড পার্সনকে।’ আরও কত কি করে তরুণী মেয়েদের হাতে পেলে –মাথায় তেমন ঘটনা ফ্ল্যাশ দিয়ে যায় আমার। বন্যার কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবে সেসব বললাম না এদের সামনে। এমনিতেই কাতল মাছের মত মুখ করে রেখেছে, শুধু শুধু চাপ বাড়িয়ে লাভ নেই। ‘কাজেই টাকা দিয়েও মেয়েটাকে উদ্ধার করা সম্ভব নয় আমাদের। এই তিনদিনের, মানে আড়াইদিনের মাঝে মেয়েটার লোকেশন বের করতে পারাই আমাদের একমাত্র সমাধান। এব্যাপারে কতটুকু তথ্য দিতে পারবেন?’
গতকাল রাত থেকে কাজ করতে থাকা স্নিফার্সের ইনফরমেশনের আশায় তাকালাম। হাজার হলেও, আগে থেকে কাজ করছে এরা। প্রজেক্টর থেকে জানতে পারলাম, সহপাঠিদের সাথে আলাদা করে কথা বলে এরা জানতে পেরেছে মেয়েটি কলেজে ঢুকেছিল এটি নিশ্চিত। এরপর কেউ ঠিক করে কিছু বলতে পারেনি। বিজ্ঞানবিভাগের ছাত্রীদের ব্রেকের পর আরও তিনটি ক্লাস করতে হয়। ব্যবসাবিভাগের দুটো। এখানে নানা মত পাওয়া যাচ্ছে।
‘ধরলাম, বিকাল পাঁচটায় কমার্সের স্টুডেন্টদের সাথে বেরিয়ে এসেছে মেয়েটা। কলেজ লাইফে বাংক মারার ঘটনা তো আর কম ঘটে না। আর তখনই তাকে নিয়ে যায় ওরা।’ ধারণার কথা জানালেন সালাউদ্দীন চৌধুরী।
‘বয়ফ্রেন্ড?’ জানতে চাই আমি।
‘তাহের। ডেড। গুলি করা হয়েছে ওকে বিকাল পাঁচটার দিকে। যে কারণেই ওই সময়ের দিকে মনোযোগ চলে গেছে আমাদের।’ জানালেন সালাউদ্দীনই।
‘লোকেশন?’
ম্যাপ বের করে দেখান তিনি। পার্কটা চিনি আমি।
বিশেষত যেই পার্ক থেকে ফারিহাকে তুলে এনেছিলাম একেবারেই সেই পার্কটিতেই পাওয়া গেছে বয়ফ্রেন্ড তাহেরের ডেডবডি?
অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। কলেজ পড়ুয়া জুটিদের জন্য নিরাপদ ডেটিং প্লেস ওটা। কাজেই যেতেই পারে যে কেউ। গোটা ঢাকা থেকেই কলেজপড়ূয়া ছাত্রছাত্রী ওই পার্কে গিয়ে প্রেম করে।
আর এই যুগল সেখানে গিয়েই ফেঁসেছে!
গাল চুলকালাম একবার। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে নতুন কিছু শোনার আশায়। ওদের নিরাশ করতে পারলাম না।
‘মেয়েটার কলেজ শুরু হয় কখন?’ জানতে চাই আমি।
‘দুপুর বারোটা।’ বলেন সালাউদ্দীন।
‘আনিকা তাবাসসুম কিডন্যাপড হয়েছে বারোটার এদিক ওদিকে। আরও ঠিক করে বলতে গেলে একটার দিকে। বয়ফ্রেন্ড সহই তুলে নিয়ে যায় ওরা – তারপর পাঁচটার দিকে শুধু বয়ফ্রেন্ডটাকে নিয়ে ফিরে আসে। ঠান্ডা মাথায় ওকে গুলি করে একই পার্কে। আর আপনাদের চোখ সরে যায় পাঁচটার দিকে।’
খবরটা হজম করার চেষ্টা করে প্রত্যেকে।
তবে সালাউদ্দীনকে প্রভাবিত হতে দেখা যায় না। জানতে চান, ‘নিশ্চিত হচ্ছেন কিভাবে?’
একটু হাসি আমি, ‘হোমমিনিস্টারের মেয়েকে কিডন্যাপ করতে গেলে এমন কিছুই প্ল্যান করতাম আমি।’
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সবাই আমার দিকে।
বাইরে এসমন একটা হট্টগোল শোনা গেল। কেউ একজন কাউকে থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারলো না।
দরজাটা ডাবল ডোর, প্রবল ধাক্কায় তা হা করে খুলে ফেললো সেই লোক। অনুমতি ছাড়াই ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো মানুষটা। এর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে।
অপারেটর মিথিলা।
‘স্যার – দ্বিতীয়বার ফোন করেছে ওরা। কথা বলছে এখন। টেক-রুমে আসুন।’
উঠে দাঁড়াই প্রত্যেকে। তবে সালাউদ্দীন শুধু আমাকে নিয়ে বাকিদের ইশারা দেন বসে পড়ার জন্য।
টেক রুমটা বেশ বড়। এই মুহূর্তে হোম মিনিস্টারের ব্যক্তিগত নাম্বারের সাথে সংযুক্ত আছে স্নিফার্স। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারী গলা শোনা গেল স্পিকারে।
‘ডীল কিন্তু এটা ছিল না, মিস্টার। আমার আরও আড়াই দিন পাওয়ার কথা। একশ কোটি টাকা মুখের কথা নয়।’
মনে মনে ভদ্রলোকের নার্ভের প্রশংসা না করে পারলাম না। যথেষ্ট কর্তৃত্ব নিয়ে কথা বলছেন এখনও।
‘আপনার পছন্দ হোক বা না হোক – সময় কমানো হয়েছে চব্বিশ ঘন্টা। আগামীকালের মাঝেই ডেলিভারি দেবেন। অথবা পাবেন। তবে প্রতিটা ডেলিভারিই নির্জীব বস্তুর – মনে রাখবেন।’
এক মুহূর্ত নিজের সাথে যুদ্ধ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রায়হান রহমান, তারপর অগত্যা আত্মসমর্পণ করলেন, ‘অ্যাকাউন্ট নাম্বারটি দিন। ট্রান্সফার করে দেব।’
ওপাশের শুষ্ক কন্ঠে একটা অদ্ভুত হাসি শোনা যায়। ‘একহাজার টাকার নোটে নগদ দিতে হবে টাকাটা। বড় আকারের কাভার্ড ভ্যানে। ভ্যানটা হবে নীল রঙের। জায়গার নাম পরে জানিয়ে দেওয়া হবে। প্রস্তুত করতে থাকুন।’
‘একদিনে এই পরিমাণের টাকা কিভাবে আমি নগদ জোগাড় করব?’ হতাশায় চিৎকার দেন রায়হান রহমান।
‘সেজন্যই বললাম, সময় নষ্ট না করে কাজে নেমে পড়ুন। বেস্ট অফ লাক!’ লাইন কেটে দেওয়ার উপক্রম করল কিডন্যাপার।
‘ওয়েইট! ওয়েইট! ডেলিভারিটা আমি নিজে করতে চাই। মেয়েকে দেখবো, তবেই টাকা দেব। আপত্তি?’ দ্রুত জানতে চান হোমমিনিস্টার।
‘আপনি না। আপনার স্নিফার্স থেকে কাওকে পাঠাবেন। খুব তো পুষেছেন! আর ডেলিভারি ট্রাকের ওপর নজর রাখার চেষ্টা করবেন না। অন্যথায় ডীলটি আর থাকছে না।’ কচ করে লাইন কেটে গেল ওপাশ থেকে।
ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান সালাউদ্দীন।
লম্বা করে একটা নিঃশ্বাস নেই আমি। টাকাটা নিয়ে আমাকেই যাওয়া লাগবে মনে হচ্ছে।
মোবাইলটা একবার বের করে দেখি – মিনহাজের এত দেরী হচ্ছে কেন কে জানে!


‘বলতে চাইছিস ফিরোজ গ্রুপ উধাও?’ ভ্রু কুঁচকে মিনহাজকে ছুঁড়ে দেই প্রশ্নটা।
মাথা ঝাঁকায় মিনহাজ, ‘কমপ্লিটলি। একেবারে রাডারের নিচে আছে ওরা। গত ছয় মাস ধরে।’
‘হুম। হোম মিনিস্টারের মেয়েকে কিডন্যাপের প্ল্যান করার জন্য এতটুকু সময় লাগাটা স্বাভাবিক।’ একমত হলাম আমি।
মিনহাজ আর আমি খুব সাধারণ একটা চায়ের দোকানে বসে আছি। মিরপুরে চলে এসেছি ওর সাথে দেখা করতে।
স্নিফার্সের হেডকোয়ার্টারে ঢুকে মুঠোবার্তায় ওকে সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা দিয়েছিলাম, তিনটি কিডন্যাপার গ্রুপের খোঁজ নেওয়ার জন্য।
যেহেতু আমাদের হাতে কোন লিংক নেই, আর একটা মেয়ে নিয়ে কেউ লুকিয়ে পড়লে বাংলাদেশ ঢুঁড়ে খুঁজে বের করা একেবারেই অসম্ভব একটা কাজ; কাজেই অন্য দিক থেকে আগাতে চাইছিলাম আমি। এব্যাপারে অবশ্য ভূমিকা রেখেছে আমার অন্ধকার জীবন এবং তৎকালীন অভিজ্ঞতা কিংবা জানাশোনা।
হোমমিনিস্টারের মেয়েকে সুচারুভাবে কিডন্যাপ করতে পারবে – এমন গ্রুপ ঢাকায় বেশি নেই। যেনতেন কাজ নয় এটা। গোটা দেশে হোমমিনিস্টারের ক্ষমতা সব সময় প্রধানমন্ত্রীর ঠিক পর পর, আছে সব আইনশৃংখলা বাহিনীর পূর্ণ সহযোগীতা। সেই সাথে আমাদের এই মন্ত্রীমহোদয় স্নিফার্সের গোড়াপত্তন করেছে, কিডন্যাপাররা যেমন বললো, পেলে পুষে বড় করেছেন, অর্থাৎ নিজস্ব বাহিনী তার আছে। এখানে নাক ঢুকাতে ভয় পাবে বাঘা বাঘা কিডন্যাপাররাও।
নোমান গ্রুপ, জিহান গ্রুপ আর ফিরোজ গ্রুপের ছেলেমেয়েরা স্কিলড। উচ্চাকাঙ্খাও আছে। কাজটা করলে হয়তো এদের তিনগ্রুপের কেউ করে থাকতে পারে,। তাদের মধ্যে ফিরোজ গ্রুপটাকে মিসিং দেখা যাচ্ছে!
‘এদের লোকেশন জানার কোন উপায় নেই দোস্ত।’ মন খারাপ করে বলল মিনহাজ।
‘ফিরোজকে আমি পার্সোনালি চিনি।’ জানালাম মিনহাজকে। একই লাইনে কাজ করলে একটু আধটু চেনা লাগে সবাইকে।
‘তাতে লাভ?’ আশার আলো দেখে না মিনহাজ।
‘ফিরোজের বাসায় একবার গিয়েছিলাম। কয়েক বছর হল। কিডন্যাপিংয়ে নামেনি তখনও ছেলেটা। এই ছোটখাট মাস্তানীতে সীমাবদ্ধ ছিল ওর কাজ। চাঁদাবাজিটা ভালো করত।’
কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলো আমি কী বলতে চাইছি – ফিরোজের বাসা চিনলে কী লাভ? এ ধরনের মানুষের অনেক হাইডআউট থাকে। নিজের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকবে এমন নয়।
তারপরই জ্বলে উঠল মিনহাজের চোখ, বুঝতে পেরেছে!
‘দোস্ত, ইউ আর ব্রিলিয়ান্ট!’
*
মিতুকে দেখে শিস দিয়ে উঠল কলেজ পড়ুয়া ছেলেটা। অন্যদিকে তাকায় কিশোরী। গত বছর থেকে এসব শুরু হয়েছে। কারো নারীত্বের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে আর বাঙালি পুরুষ তাকে সুস্থ পরিবেশে বড় হতে দেবে এমন সুদিন দেশে আসেনি এখনো।
মিতুর কানজোড়া লাল। রাগ। অপমান। তবে লজ্জা নয় এটা সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা চারজন। এদের পাশ কাটিয়েই যেতে হবে ওকে। স্কুল থেকে বাসার দিকে যেতে এ রাস্তা ধরা লাগে। আর কোন পথ নেই।
শরীর সিঁটিয়ে আসতে চায় – ঘেন্নায়, সেভাবেই হেঁটে ওদের পাশ কাটানোর চেষ্টা করল মিতু।
শিস দেওয়া ছেলেটা মুখ খোলে এবার, ‘যৌবন তোমার লাল টমেটো -’
অপমানে – ক্রোধে আরও লাল হয়ে যায় মেয়েটা। কিন্তু করার কিছুই নেই।
ভাইয়া থাকলে কেউ ওর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহসও পায়নি। ভাইয়াটা যে কোথায় গেল হঠাৎ!
এলাকায় অনেকে বলাবলি করছে ভাইয়াকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। মিতুর এত খারাপ লাগে বলার মত না!
ভাইয়া থাকলে এই বেয়াদবগুলোকে একেবারে সাইজ করে ফেলত না? আর এইসব বদমাশও টের পেয়েছে। মিতুকে রক্ষা করার কেউ নেই জানে বলেই এরা এখন এমনটা করছে।
সানক্যাপ পরা ছেলেটাকে তখনই প্রথম চোখে পড়ে মিতুর। ছেলেটা লম্বা – সেই সাথে মানানসই স্বাস্থ্য। বয়েসে মিতুর চেয়ে বেশ বড়ই হবে।
হাতে একটা কী-বোর্ডের প্যাকেট। পাশের কম্পিউটার অ্যাকসেসরিজের দোকানটায় কী-বোর্ড কিনতে এসে এই টিজিংয়ের ঘটনা চোখে পড়ে গেছে যুবকের?
কোন রকম ভূমিকার মাঝে না গিয়ে টিজার ছেলেটার বুকে একটা ধাক্কা দিল মানুষটা।
আচমকা এই ধাক্কার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না বখাটে ছেলেটা – ঘুরে পড়ে যেতে যেতে সামলে নেয় নিজেকে।
বাকি তিনজন নিমেষেই চটে ওঠে এবার, অপেক্ষাকৃত পেশীবহুল ছেলেটা তো হুংকারই ছাড়ে ‘শালা তোর এতবড় সাহস আমার ফ্রেন্ডের গায়ে হাত তুলস…’
অবাক হয়ে মিতু খেয়াল করল চেঁচাতে থাকা ছেলেটার গলায় নির্বিচারে ডানহাতে একটা কোপ বসিয়ে দিয়েছে এইমাত্র আসা যুবক। বাতাসের অভাবে হাঁসফাঁস করতে করতে মাটিতে বসে পড়ল ছেলেটা। টিজার-বখাটে সামলে নিয়েছে নিজে এর মাঝে অনেকটাই – ঝাঁপিয়ে পড়ল এবার যুবকের ওপর।
এক পা পিছিয়ে একটু জায়গা করে নেয় যুবক। তারপর একটা সলিড ঘুষি বসিয়ে দেয় ছেলেটার মুখে – যেই বেগে সামনে এসেছিল সে বেগ বজায় রেখে পেছন দিকে ছিটকে পড়ল মাস্তান। দাঁত নিশ্চয় নড়ে গেছে দু-চারটে!
এসবই যুবক করছে এক হাতে কী-বোর্ডের প্যাকেট ধরে! অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থেই একহাতে ওদের দু’জনকে সামলে নিয়েছে রহস্যময় যুবক।
বাকি দুই মাস্তান যুবকের এমন মারমুখী ভঙ্গী দেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না – আগাবে নাকি পেছাবে!
অবশেষে রণে ভঙ্গ দেওয়ার সিদ্ধান্তই নেয় তারা বুদ্ধিমানের মত। যাওয়ার সময় সাথে করে বাকি দুইজনকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে ভোলে না।
মিতু এবার স্লিভগোটানো শার্ট পরে থাকা ছেলেটার দিকে এক পা এগিয়ে যায়।
‘ভাইয়া, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ রিনরিনে কন্ঠে বলে ও।
একটু হাসে ছেলেটা। দেবদূতের মত চেহারার সাথে চমৎকার মানালো হাসিটা, ‘ও কিছু না, আপু। আমারও বোন আছে একজন।’
এক সাথে হাঁটে ওরা।
‘নাম কি আপনার বোনের?’ জানতে চায় মিতু।
‘ঈশিতা।’ উত্তর দেয় যুবক।
‘এই যাহ। আপনার নামটাই জানা হল না।’ হেসে ছেলেটার দিকে তাকাল মিতু। ও কি এই অদ্ভুত ছেলেটার সাথে ফ্লার্ট করছে? জানে না, তবে মিতুর খারাপ লাগছিল না এর পাশে হাঁটতে।
‘ইরফান।’ শীতল কন্ঠে উত্তর দিল এবার ছেলেটা।
পাশে দাঁড়ানো টয়োটার একটা সাধারণ চেহারার গাড়ির দিকে দেখাই এবার মিতুকে, ‘এতে করেই এসেছি আমি।’
‘যাচ্ছেন আবার কোথাও?’ জানতে চায় মেয়েটা।
‘হুম। তোমাকে সাথে নিয়ে।’ বরফ শীতল কন্ঠে বললাম ওকে। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার।
আমার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে ভাবটা আরও বাড়ল, কীবোর্ডের প্যাকেটটা মডিফাইড, একটু খুলে ওকে দেখিয়ে দেই গ্লক২৩ এর চমৎকার চেহারাটি।
‘গেট ইন দ্য কার, মিতু।’


স্নিফার্সের অফিসে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদের সাথে।
বসে বসে স্টিক নাড়াচ্ছেন ইনি।
ইনার বাল্যবন্ধুর ছোটভাই বর্তমানে বাংলাদেশের হোমমিনিস্টার। তার মেয়েকে উদ্ধারের জন্য এমন মরিয়া প্রচেষ্টা আমি শুরুতে বুঝিনি। এসব ইতিহাস অফিসের এ ও আমাকে টুকটাক বলেছে। এখন সবকিছু স্পষ্ট।
আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন চটপট, ‘ইরফান! তোমার জন্য সারাদিন অপেক্ষা করতে হবে নাকি আমাকে? কোথায় ছিলে? ডেলিভারি ডেডলাইনের মাত্র দুই ঘন্টা আছে!’
চোখে চোখে রেখেছিল আমাকে স্নিফার্স। মিনহাজের সাথে দেখা করার জন্য স্নিফার্সের হেডকোয়ার্টার থেকে ভাগাটা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ ছিল। টয়লেটে পাঁচ মিনিটের জন্য ঢুকে পঞ্চাশ মিনিটেও বের হইনি যখন– কাহিনী বুঝে ফেলেছিল ওরা নিশ্চয়?
পুরো একটা দিন পর এসে হাজির হয়েছি আমি আবার।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের দিকে তাকিয়ে একটা বিদ্রুপের হাসি হাসলাম। এমন একটা হাসি সব সময় আমার মুখে লেগেই থাকে। আশেপাশে নিম্নবুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন লোকজন থাকলে এছাড়া করার আর কিছুই থাকে না। তাছাড়া জীবনটাই তো বড় একটা বিদ্রুপ!
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন স্নিফার্স ডিরেক্টর সালাউদ্দীনও।
‘থ্যাংকস গড! ইরফান ইজ ব্যাক! ডেলিভারি দেয়ার কথা ওর, অথচ দায়িত্বজ্ঞানের অবস্থা দ্যাখো! নতুন কাউকে পাঠানোই ভালো হবে বোঢহয়।’ খুব বিরক্ত হয়েছেন বোঝা যাচ্ছে।
‘টাকা রেডি?’ জানতে চাই আমি।
সটান দাঁড়িয়ে পড়লেন এবার ডিফেন্স অ্যাডভাইজার মাহমুদ, ‘একশ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাবে এই ছেলে। আমি লিখে দিতে পারি!’
গতকাল যেভাবে পালিয়েছি, এরপর এদের থেকে এর বেশি কিছু আশা করছিলামও না।
‘ঘাবড়াবেন না।’ তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন সালাউদ্দীন, ‘সাথে আমার বেস্ট এজেন্ট রেজাকে পাঠাচ্ছি। ভেগে যেতে দেখলে একটা বুলেট পাঠিয়ে দেবে জায়গা মত।’
মাথা দোলাই আমি। জানতাম এমন কিছু একটাই হবে। তাছাড়া স্নিফার্সের এদিকে রেকর্ড দুর্দান্ত। অপরাধীদের কাস্টডিতে না নিয়ে মাথায় বুলেট ঢোকাতেই স্নিফার্সের জন্ম। ইন্সট্যান্ট ডিসিশন নেওয়া লাগলে আমার মুখের দিকে তাকাবে এটা সত্য, তবে সেই দৃষ্টির নিচে হাতে ধরে থাকবে একটা সাড়ে ছয়শ ডলারের জিনিসও । সিগ সাওয়ার!
‘ভাববেন না। মেয়েটার নিরাপত্তার ব্যাপারে আমার নিজস্ব উদ্বেগ আছে। কাজ শেষ না করে পালানোর ইচ্ছে আমার নেই, খুঁজলে দেখবেন, রেকর্ডও নেই। চাইলে অবশ্য আটকাতে পারতেন না।’ শান্ত কন্ঠে চ্যালেঞ্জটা ছুঁড়ে দেই আমি।
‘হুঁ হুঁ। শুনেছি তোমার কথা আগেও। নীতিবান ক্রিমিনাল, তাই তো!’ শ্লেষমিশ্রিত গলায় বললেন মাহমুদ।
ঘাড় ফুটালাম আমি শুধু। যা বলে বলুক।
আমার মাথাব্যথা মেয়েটাকে নিয়ে। এই দুই বুড়ো ভামের জন্য এখানে কাজ করছি না আমি।
‘সবাই কমফারেন্স রুমে চলে আসো। ডেলিভারির ব্যাপারে ফাইনাল ব্রিফ দেব।’ এগিয়ে যান সালাউদ্দীন কনফারেন্স রুমের দিকে।
*
ট্রাকটা ড্রাইভ করার দায়িত্ব আমার ঘাড়েই বর্তেছে।
চুপচাপ ড্রাইভ করছি। সাথে একটা অস্ত্র রাখার অনুমতিও দেওয়া হয়নি আমাকে।
কিডন্যাপাররা আমাদের কপালে কী রেখেছে তা জানার উপায় নেই। সবসময় খুনের দৃষ্টি চোখে নিয়ে চলেফিরে বেড়ানো এজেন্ট রেজাকে দেখে মনে হল না সে বিন্দুমাত্র বিচলিত।
তার হাতে শোভা পাচ্ছে সিগসাওয়ার। একমুহূর্তের জন্যও আমার দিক থেকে সরাচ্ছে না সেটা।
‘রাস্তার যে অবস্থা – হাতের ওটা একটু সরিয়ে রাখ হে!’ না বলে পারলাম না এবার, ‘কাঁপুনীতেই ছ্যাদা করে দেবে দেখছি।’
‘বাজে কথা রাখ! জাস্ট ড্রাইভ।’ ঘেউ ঘেউ করে উঠল রেজা।
আমার কি? ফুটো হয়ে গেলে ট্রাকের সাথে চ্যাপ্টা হবে ওই ব্যাটাও। চুপচাপ ড্রাইভ করে যাই।
সামনে একটা চৌরাস্তার মোড় – এর পর রাস্তা অনেকটাই সোজা এগিয়ে গেছে। আর কোন বাঁধা নেই ডেস্টিনেশনের।
‘শেষ বিচারের দিন তোমার আর আমার অবস্থান এতটা কাছাকাছি না থাকলেই খুশি আমি।’ একটু হেসে বেয়াদবটাকে বললাম।
আড়চোখে দেখি বাম দিকের রাস্তা থেকে তীরবেগে ছুটে আসতে থাকা মটরসাইকেলটাকে।
অসঙ্গতিটা ধরা পড়ল রেজার চোখেও – মাথা একটু এগিয়ে মটরসাইকেলটার দিকে দেখল। চোখজোড়া কুঁচকে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে হিস হিস করে উঠল তারপর, ‘ইউ স্নেইক!’
আমাকে এড়িয়ে দুটো গুলি পাঠিয়ে দিল মটরসাইকেল আরোহীর দিকে।
এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে আরোহী – মুখে মুখোশ। তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে আমাদের সমান্তরালে চলে এল, তবে ইচ্ছে করেই পিছিয়ে আছে। রেজাকে মনমত ফায়ারিং অ্যাংগেল দিতে চায় না!
এদিকে জানালা দিয়ে শরীর একটু বের করল রেজা, জুতমত একটা শট খুঁজছে।
সুযোগটা নেই আমি, ওপাশের দরজাটা ড্রাইভারস সিট থেকে আনলক করলাম, তারপর চমৎকার এক লাথিতে ট্রাকের দরজাটাসহই রেজার পাছায় মাঝারি মানের এক গুঁতো দিতে চল্লিশ কিলোমিটার বেগে ছুটতে থাকা ট্রাক থেকে বেকায়দাভাবে রাস্তায় পড়ে গেল স্নিফার্সের গর্বিত সদস্য।
আমার পাশে চলে এসেছে মটরসাইকেল। দারুণভাবে একটা থাম্বস আপ সাইন দেখিয়ে পরের গলিতে ঢুকে যায় মিনহাজ। ডাইভার্সনটা চমৎকার ভাবেই দিয়েছে।
সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম বেশ দূরে অপেক্ষমান তিনটি গাড়ি। কোর্স ধরে রাখলে একেবারে ওদের গায়েই গিয়ে পড়ার কথা আমাদের।
অ্যামবুশ!
আমিও ট্রাক ঢোকালাম মিনহাজের পিছু পিছু। অ্যামবুশ করে বসে থাকা মানুষগুলোকে হতাশ করতে পেরে আমার একটুও খারাপ লাগল না।
দ্রুত ইঞ্জিন স্টার্ট দিচ্ছে হয়ত ওরা। কিন্তু আমাকে ধরতে পারবে না– তার আগেই গায়েব হয়ে যেতে হবে আমাকে। হেডলাইট আর টেইললাইট নিভিয়ে ফেললাম। এদিক থেকে ঘুরে আরেক বড় রাস্তায় উঠব।
তারপর সোজা সেইফ হাউজ। পিঠে একশ কোটি টাকা নিয়ে ঘুরতে পারলে আর কিসের সমস্যা?
চল্লিশ মিনিট পর ট্রাকটাকে জায়গা মত রেখে মিনহাজের বাইকে চেপে বসলাম।
এবার হাইডআউট বরাবর একটা শর্ট রাইড!
*
আমাদের হাসাহাসি করে ঢুকতে দেখে খুব বিরক্ত মুখে তাকাল মেয়েটি। অ্যানিমেশন মুভি দেখার মাঝে এমন বাঁধা ওর অপছন্দ। ওকে জ্বালাতন না করে পাশের রুমে গিয়ে ঢুকলাম আমরা।
‘পায়ের কি অবস্থা, দোস্ত?’ জানতে চায় মিনহাজ।
‘ঠিক আছি।’ আশ্বস্ত করি ওকে।
আনরেজিস্টার্ড সিমটা ঢুকিয়ে মোবাইলটা অন করি।
একবার মাত্র রিং হতেই খপ করে ধরে ফেললেন ডিফেন্স অ্যাডভাইজার মাহমুদ, ‘হ্যালো?’
‘আমি ইরফান বলছি।’ ঠান্ডা গলায় বলি আমি।
‘ইউ বাস্টার্ড! একশ কোটি টাকা মেরে দিলি, শুয়োরের বাচ্চা? মেয়েটাকে এবার ওরা মেরে ফেলবে সন্দেহ নেই! তোকে আমি ছাড়ব না – পৃথিবীর যেইপ্রান্তে থাকিস না কেন খুঁজে বের করব!’
‘বাংলা ব্যকরণ পড়ানোর জন্য আপনাকে ফোন দেইনি। রাখলাম তাহলে।’ বিরক্ত হয়ে বলি আমি।
হাহাকার করে ওঠেন মাহমুদ এবার, ‘নো নীড। ফোন তো দিয়েছ কিছু বলতেই – সেটা কি?’
‘এখন না। আপনি স্নিফার্সের গর্ত থেকে বের হন আগে। তারপর বাইরের নাম্বার থেকে ফোন দিন। স্নিফার্সকে আমি বিশ্বাস করি না। ট্রেস করার পর্যাপ্ত সময় আমি দেব না। কাজেই দ্রুত কথা শেষ করবেন ওই ফোনকলে।’
জানি আমাদের প্রতিটা কথা কান পেতে শুনছে স্নিফার্স হেডকোয়ার্টারে থাকা প্রতিটা মানুষ।
আমার কথার তাৎপর্য স্পষ্ট বুঝতে পারলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ।
‘ওকে। বের হচ্ছি।’
লাইনটা কেটে দিলাম আমি।
মাহমুদের দিকে এগিয়ে দিলাম একটা ছোট পিনের মত জিনিস।
একটা মাইক্রোফোন। এটা কলারে গুঁজেই সকালে ঢুকেছিলাম স্নিফার্সের হেডকোয়ার্টারে। স্নিফার্সের প্ল্যান আর কিডন্যাপারদের ডেলিভারি লোকেশন জানতে পেরে বাকি প্ল্যানটা করা মিনহাজের জন্য ছিল ছেলে খেলা।
মাহমুদ ফোন দেবেন যে কোন সময়। কাজেই ফোনে আবার সিম বদল করলাম। আমার সিম ঢুকিয়ে ফোন অন করামাত্র একটা নতুন ইনবক্স। একটি ইনকামিং মেসেজ।
ঈশিতার মেসেজটা পড়ে ভ্রু কুঁচকে ওঠে আমার। চেহারার পরিবর্তনটা খেয়াল করল মিনহাজ।
আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে পড়ে ওর চেহারার অবস্থাও একই রকম হয়ে যায়।
‘ঈশিতা রাবেকের কাছে ফিরে যাচ্ছে। কিভাবে সম্ভব, ম্যান?’ কাকে প্রশ্নটা করে মিনহাজ – সম্ভবত সে নিজেও জানে না।
‘সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ও।’ মাথা নীচু করে বলি আমি।
‘রাবেকের মেয়ে তো আফটার অল।’ মন খারাপ করে বলল মিনহাজ।
প্রতিবাদ করতে গিয়েও করি না। ঈশিতা হয়ত রাবেকের আপন মেয়ে – কিন্তু স্বভাবচরিত্র মোটেও বাবার মত পায়নি মেয়েটা। একেবারে নিজ হাতে গড়েছি মেয়েটাকে – জানি কেমন মেয়ে ও। তবুও বাবার কাছে ফিরে যেতে চাওয়ার কারণ আমি বুঝে উঠতে পারি না। চাই না হয়ত! রাবেকের কাছে যাওয়ার অধিকার তার আছে। আমিও এমন কোন আহামরি বড়ভাই ছিলাম না গত দশ বছর ধরে। একা একাই বড় হতে হয়েছে তাকে। ওর পরিবারের কেউ-ই ওর পাশে ছিল না সব সময়। এমন সম্পর্কই যদি ওর কাছে স্বাভাবিক পরিবারের সংজ্ঞা হয়, তবে বাবা হিসেবে রাবেকই বা এমন কী অন্যায় করেছে?
তবে আমার দুশ্চিন্তা হল, মেয়েটা নিরাপদে থাকবে তো?
ইনকামিং কলের টোন শুনে চিন্তা থেকে বেরিয়ে এলাম। আননোন নাম্বার।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ।


মিতু হাঁটুতে মুখ আটকে বসে আছে। একটু আগে ধরে এনে সেফহাউজে ভরেছি মেয়েটাকে। বিছানার সাথে হাত আটকে রেখেছি একটা হ্যান্ডকাফের সাহায্যে। আমার শিকার প্রতিটা মানুষকেই এই স্টেজ পার হতে হয়। আপনজনেরা যতদিনে টাকা দিতে রাজি না হয় আরকি।
গ্লকটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুন্যে ভাসিয়ে ক্যাচ ধরছি মাঝে মাঝে। সেদিকে তাকিয়ে থাকা মেয়েটার দুই চোখের তারায় ফুটে ওঠে স্পষ্ট ভীতি। আমলেই নেই না আমি। মিতুর মায়ের নাম্বারে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি। জানি ওতেই কাজ হবে।
মেয়েটার ভবিষ্যৎ তুলে দিয়েছি তার ভাইয়ের হাতে। হয় লুফে নাও – নাহলে মারা খাও।
ছেলেটা অলস, নয় অন্য কিছু নিয়ে চরম ব্যস্ত ছিল। রাত দুইটায় ফোন দিল গাধাটা।
অলস ভঙ্গীমাতে ফোন ধরেছিলাম আমি, ‘হ্যালো।’
ওপাশ থেকে একটা রাগত কন্ঠ শোনা গেল, ‘হালার ভাই – আমার নাম হুনসস? দুই দিনের চুটকা পোলা হয়ে আমার বইনের দিকে হাত বাড়াস ক্যমনে!’
একটু হেসে উত্তর দেই আমি, ‘আপনার নাম শুনেছি, ফিরোজ ভাই। এখন আপনি আমার নাম শুনবেন। মিতুর সাথে কথা বলতে চান?’
ওপাশ থেকে ফিরোজ শুধু একটা শব্দ দিয়েই বাক্য সম্পূর্ণ করল, ‘… [লেখার অযোগ্য] ’
‘আহা! কথা বলার ইচ্ছে না থাকলে এতক্ষণ কেন বাঁচিয়ে রাখলাম ছুঁড়িকে?’ আফসোস করে বলি আমি।
নরম হয়ে এল এবার ফিরোজ, ‘ওর কোন ক্ষতি করলে পুইতা লামু তোরে হারামজাদা! কি চাস বল।’
‘রঞ্জন মিত্রের ফাইলটা। যেটা পাঁচ বছর ধরে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিস।’ আপনি থেকে ধাম করে তুইয়ে ডিমোশন দিয়ে দিলাম ফিরোজকে।
থমকে গেল ফিরোজ। এই ব্যাপারে জানলাম কি করে ভাবছে হয়ত!
রঞ্জন মিত্র নামে এক লোকের বাসাতে ডাকাতি করেছিল ফিরোজ। শুধু সোনাদানা নয়, লোকটা গুরুত্বপূর্ণ এমন এক কথা চাউর ছিল এলাকায়। কাজেই বুদ্ধিমান ফিরোজ তার ফাইল কেবিনেটের সব ফাইলও সাথে করে নিয়ে আসে। পরে অবশ্য অধিকাংশই চুলোয় ফেলে দিয়েছে। শুধু একটা ফাইলের ভেতর অদ্ভুত সব স্কেচ ছিল, যেন খুব গোপনীয় নথি! ওটা সে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল মূল্যবান কোন তথ্য ভেবে। আজ পর্যন্ত ওটার কোন মূল্য আছে বলে আমার জানা হয়নি। বিশেষত্ব হচ্ছে, আমি ফিরোজের একান্ত আড্ডায় এই ফাইল আর তার ব্যাপারে অবসেশনের কথা জানি। এবং এটাও জানি, ওটা দিতে হলে হারামজাদাকে গর্ত থেকে বের হতে হবে। আনিকা তাবাসসুম কোথায় আছে তা আমরা জানি না। তবে ওখানে ফিরোজ অবশ্যই আছে।
শালাকে গর্ত থেকে বের করাটাই এখন প্রথম কাজ!
‘ওটার দাম আছে তাইলে আসলেই!’ বিস্ময়ে ভরা কন্ঠে বলল ফিরোজ।
‘না! মাগনা তো! তাই তো তোর বোনকে উঠিয়ে আনা লাগে আমার!’ বিরক্তির স্বরে বলি আমি।
‘ভাই ওটা লইয়া যান। মাগার বোনটারে ছাইড়া দ্যান!’ অনুনয় করে ফিরোজ।
‘ঠিক কাল সকাল দশটায় আসবি তাইলে যেখানে বলব। তুই আসবি। একা। আর কেউ না।’ সোজা সাপ্টা বলে দেই আমি।
‘ভাই, আটটায় আসলে হয় না?’ ফিরোজ একেবারে গলে গলে পড়ছে এখন।
একটু হাসি আমি মনে মনে। এই ব্যাটার হেফাজতেই আছে আনিকা রহমান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মেয়ে। সেজন্যই এত টেনশন সকাল দশটায় আসতে বলায় এর এত দুশ্চিন্তা।
দুপুর একটায় টাকা ডেলিভারি দেওয়ার কথা – দশটায় এদিকে ছুটতে গিয়ে দেরী হয়ে যাওয়ার ভয়ে আছে!
‘না, দশটায় বলেছি। দশটাতেই। বোনকে আবার দেখতে চাস জীবনে?’ শীতল কন্ঠে বলি আমি।
‘আচ্ছা ভাই। কোনদিকে আসব বলেন।’ ফিরোজ আবার নরম হয়। মানে হতেই হয় তাকে।
যাত্রাবাড়ির একটা ঠিকানা বলতেই আবার হাউ মাউ করে ওঠে মানুষটা।
‘ভাই ওদিকে না। সবই তো মানলাম। ঢাকার অন্য সাইডে আইতে বলেন। আইয়া পড়ুম।’
পিতলা ঘুঘু, অ্যাঁ? আনিকা মেয়েটাকে ওপাশে রাখে নি তাহলে এরা।
‘মোহাম্মদপুর?’ জানতে চাই।
একটু গাঁইগুঁই করে এবার রাজি হল বেয়াদবটা।
‘মিতুর সাথে কথা বলায়ে দেবেন না?’ আবেদন জানায় এবার ও।
ফোনয়া মিতুর খোলা হাতের দিকে এগিয়ে দেই আমি।
কাজ অর্ধেক শেষ।
বাকিটা শেষ করতে পারলে কাল সাড়ে বারোটার মাঝে আনিকা রহমানকে উদ্ধার করে ফেলা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে!
*
সিগারেট টানছে ছোকড়া। তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। এর সাথে সাথেই ঢুকে পড়তে হবে দোতলা বাড়িটায়। একটু আগে ফিরোজকে ফলো করে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। ব্যাটা কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা ঢুকে গেছে ওখানে। তারপরই বের হয়ে এসেছে এই অল্পবয়েসী ছোকড়া।
মিনহাজকে পাঠিয়েছিলাম ফাইলটা নিতে।
একটু ছদ্মবেশ ধরতে হয়েছে – পাঁচ বছর আগে আমাদের দেখা হয়েছে। ফিরোজ দূর থেকে দেখেই আমাকে চিনে ফেলতে পারে, তাই সে ঝুঁকিতে যাইনি।
সিগারেট শেষ হয়েছে ছেলেটার। আবার দোতলা বাসাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ও।
তির্যক একটা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করি আমিও। একই সাথে ফ্রন্ট গেটে পৌঁছলাম দুইজনে। ছেলেটা আমাকে এতটা কাছে আসতে দেখে একটু বিস্মিত হতে যাচ্ছিল কিন্তু ওকে শতভাগ বিস্মিত করে কোমরে ঠেকালাম গ্লকের শক্ত নলটা।
চোখ কপালে উঠে যায় ছোকড়ার।
‘কোনরকম শব্দ নয়। ভেতরে নিয়ে চলো আমাকে। নাহলে একাধিক গর্ত করে দেব তোমার শরীরে। বোঝা গেল?’
কি বুঝল কে জানে। কিন্তু আমাকে ভেতরে এনে ফ্রন্ট গেটটা লাগিয়ে দেয় ঠিকমত।
গার্ডরুমটা খালি। এখানে গার্ড রেখে সাক্ষীর সংখ্যা বাড়াতে চাইবে না অবশ্যই ওরা।
ত্রিশফিট দূরে দাঁড়িয়ে দোতলা বাড়িটা। ঢাকায় এমন বাড়ির সংখ্যা খুবই কম। সবাই একেবারে রোডের সাথে গা লাগিয়ে ধপাধপ বাড়ি তুলে ফেলতে চায়। সামনে লন রাখবে এমন রুচি অধিকাংশের নেই।
হেলেদুলে এগিয়ে গেলাম বাড়িটার দিকে। ভেতরে চমৎকার একটা ডুপ্লেক্স প্ল্যানিং আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। দারুণ এক ডিজাইনের ডুপ্লেক্সে রাখা হয়েছে দেখা যায় হোমমিনিস্টারের মেয়েকে! মানীর মান রাখার ব্যাপার আছে হয়তো।
তবে ভালোমত দেখার সুযোগ পাওয়া গেল না।
বিশাল ড্রইং রুমটাতে আরাম করে চুরুট টানতে থাকা এক তরুণের চোখে পড়ে যাই আমরা। চৌকস অপরাধী। বিন্দুমাত্র সময়ক্ষেপণ না করে হাত বাড়াল সামনের টী-টেবিলে রাখা পিস্তলটার দিকে!
জিনিসটা একনজর দেখার সুযোগ পেলাম। হাহাকার উঠল আমার বুকের ভেতর। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যাওয়ার মত অস্ত্র একটা। গ্র্যান্ডপাওয়ার কে১১০।
প্রেমে না পড়ে বরং ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমার জিম্মি ছোকড়ার পেছনে একটা লাথি কষে সামনে থেকে সরিয়ে ফেলার পর পর ঝাঁপিয়ে পড়লাম সবচেয়ে কাছে থাকা পিলারটার আড়ালে।
মুহুর্মূহু গর্জে উঠল তরুণের হাতের অস্ত্র।
চোখ বন্ধ করলাম আমি।
গুণছি।


গুণে গুণে এক ডজন গুলি করল তরুণ কিডন্যাপার।
ওদিকে ছাড়া পাওয়া মাত্র সামনের দিকে ছুটেছে আমার হোস্টেজ। সন্দেহ নেই – কয়েক মুহূর্ত পরই আরেকটা অস্ত্র বাগিয়ে আমার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করবে অকৃতজ্ঞটা!
গ্র্যান্ডপাওয়ারধারীকে খেলাতে হবে। তাকে বেশিক্ষণ সময় দিলে নিজের মাথা উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই ষোলআনা।
হাত বাড়িয়ে বাম দিকে দেওয়াল থেকে পেইন্টিংটা নামিয়ে ফেললাম, অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ছুঁড়ে দিলাম ওই ব্যাটার অবস্থান বরাবর।
ডাবল রো ম্যাগাজিন লাগিয়ে বুলেটের ব্যবসায়ীদের পকেট ভর্তি করছ বটে। এবার দেখা যাবে কিভাবে সামলাও!
উড়ন্ত পেইন্টিংটার দিকে দ্রুম দ্রুম করে তিনটি বুলেট খরচ করল ছোকড়া – সন্তুষ্ট হলাম।
ডাবল রো ম্যাগাজিন থাকলে গ্র্যান্ডপাওয়ার কে১১০ –তে সতের রাউন্ড করে বুলেট রাখা সম্ভব। আর মাত্র দুটো বুলেট থাকার কথা এখন প্রতিপক্ষের চেম্বারে।
এক ডিগবাজি খেয়ে বেরিয়ে এলাম এবার, স্বভাবতই আচমকা উদয় হওয়া চলন্ত টার্গেটের দিকে প্রথম বুলেটটা মিস করল তরুণ। পরবর্তী ডিগবাজি খেয়ে আরও ডানে সরে যাচ্ছি – অন্য পিলারটার দিকে।
তাড়াহুড়োয় এই শটটাও মিস করল ছেলেটা।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এক গুলিতে উড়িয়ে দিলাম ব্যাটাকে। ঠিক তখুনি দেখা গেল দোতলা থেকে সাব মেশিনগান নিয়ে হাজির হয়ে গেছে আরেকজন। তার পিছেই আছে একটু আগের হোস্টেজ ছোকড়া।
আমার ধারণা ভুল নয়। একটা পিস্তল বাগিয়েছে কোত্থেকে জানি!
বৃষ্টিতে ভেজা আমার প্রিয় একটা কাজ। তবে বুলেটবৃষ্টি হলে আলাদা কথা!
চট করে পিলারের আড়ালে সরে এলাম আবারও।
গুলিতে বিরাম নেই – পিলার উড়িয়ে দিতে চায় যেন ওরা!
তবে সাবমেশিনগানের শব্দ থেমে যেতে বেশি সময় লাগল না। রিলোড করতে হবে এখন তাকে। কাভারে নিশ্চয় হোস্টেজ ছোকড়া?
একজনকে সামলাতে পারার আত্মবিশ্বাস বুকে নিয়ে পিলার থেকে সোফার দিকে ডাইভ দেই আমি – বাতাসে উড়ন্ত অবস্থায় হোস্টেজ ছেলেটার বুকের মাঝে গুলিটা পাঠিয়ে দিতে পেরে আত্মতৃপ্তি অনুভব করলাম।
একই সাথে বুঝে ফেলি – ভুল করে ফেলেছি!
ওপরে দুই নয় – তিনজন।
স্বয়ং ফিরোজ উপস্থিত হয়েছে সেখানে। মসবার্গ শটগানটা থেকে একবার মাত্র ফায়ার করে ফিরোজ। সকালের বোনকে ছাড়িয়ে আনার পর থেকে মেজাজ নিশ্চয় খিঁচড়ে আছে ওর!
পায়ের কাছে টান অনুভব করলাম।
দূরত্বটা যথেষ্টরও বেশি – তাও শেলগুলোর কোন একটা অংশ আমার শরীরে লেগেছে। দড়াম করে পড়ে গেলাম সোফার আড়ালে।
ওখান থেকেই একটু শরীর বের করে সাবমেশিনগানধারীর খুলি উড়িয়ে দেই আরেক গুলির সাহায্যে। গর্দভটা এতই মনোযোগ দিয়ে রিলোড করেছিল আমার অবস্থান পাল্টে যাওয়াটা খেয়ালই করেনি। পিলারের দিকে তাকিয়ে ছিল সরাসরি।
পুরো বিল্ডিংয়ে বোধহয় শুধু আমি আর ফিরোজ।
চারপাশে শুনশান নীরবতা।
মাটির কাছে মাথা পেতে এই মৃত্যুফাঁদ থেকে বের হওয়ার চিন্তায় ডুবে গেলাম। শরীর বের করলে শটগান দিয়ে ছ্যাঁদা করে দেবে নির্ঘাৎ! মিনিট দুই পর নিস্তব্ধতা ভাঙ্গে ফিরোজ।
‘মেয়েটার ক্ষতি না চাইলে ভালোমানুষের মত বাইর হইয়া আহেন।’ গম গম করে বলে ও।
এরপরে আর কি করার থাকে?
আস্তে করে মাথা বের করে উঠে দাঁড়াই আমি।
ফিরোজের ডানহাতে একটা হ্যান্ডগান। বাম হাতে শক্ত করে ধরা আনিকার হাত।
ছবিতে দেখা মেয়েটার সাথে অনেক ফারাক এখন দেখা মেয়ের।
ভয়ে শুকিয়ে গেছে মুখ – সুন্দর চোখ দুটোর নিচে কালো ছোপ। কান্নাতে কাজল ধুয়ে যাওয়ার ছাপ।
আমার দিকে নিস্কম্প হাতে ধরে থাকে ফিরোজ অস্ত্রটা। রাগে ওর হাত তির তির করে কাঁপছে।
সহকর্মী তিনজনকে যমের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি – কাজেই রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে তার মাঝেও স্বাভাবিক সতর্কতা ভোলে না ফিরোজ।
‘হাতের পিস্তলটা ফালান। তারপর লাথি মাইরা দূরে সরান।’
কথা মত কাজ করা ছাড়া উপায় নেই। কাজেই অক্ষরে অক্ষরে পালন করলাম। এই পর্যায়ে এসে নিজের বা আনিকার মাথা উড়ে যাক – চাই না।
‘যা জিগামু জবাব দিবি।’ এ-ও সরাসরি আপনি থেকে তুইয়ে ডিমোশন দেয় আমাকে, ‘নাইলে হাঁটুতে গুলি কইরা উড়ায় দিমু বাটি।’
‘বাটি ওড়ানোর সখ আমার নেই। প্রশ্ন করতে পারো।’ কিছুটা সময় আদায় করা ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না। সুযোগ আসতেও পারে!
‘কয়জন আছে তোর লগে?’ রক্তচক্ষু মেলে জানতে চায় ফিরোজ।
‘পাঁচজন।’ বিন্দুমাত্র দেরী না করে উত্তর দেই আমি।
‘মিথ্যা কইলি। হেতেরা কই তাইলে? একাই আইছস তুই।’ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায় ফিরোজ।
‘উঁহু।’ একটু হাসি আমি। অস্ত্রের মুখে হাসার চেয়ে কষ্টের কাজ আছে কি? ‘স্নিফার্সের নাম শুনেছ? ওদের আরও চারজনকে লোকেশন জানানোর পরই ঢুকেছি। এনিটাইম পুরো ফোর্সটাই চলে আসবে এখানে।’
বলতে গিয়ে মনে পড়ে স্নিফার্সের টয়লেট থেকে পালানোর অভিজ্ঞতা। ব্যাটারা পেলে আমাকে কাঁচাই খেয়ে ফেলবে। তবে সেটা তো আর ফিরোজের জানার কথা নয়।
‘তাইলে হাতে সময় নাই একদম-’ কথাটা শেষ করেই গুলি করতে চেয়েছিল ফিরোজ। গলার সুরেই বুঝি আমি এবং ঝাঁপ দেই ডানদিক বরাবর। একই সাথে অবাক হয়ে লক্ষ্য করি ফিরোজকে কামড়ে দিয়েছে আনিকা! হাত কামড়ে একরকম ঝুলে আছে মেয়েটা।
বুলেটটা টার্গেটকে পায় না – ছাতের কোথাও লেগে পিছলে নেমে এসে আমার কানের পাশ দিয়ে বেড়িয়ে যায় ওটা।
আবারও বামদিকে ঝাঁপিয়ে নিজের পিস্তলটা তুলে নিয়ে চিন্তাভাবনা ছাড়াই ফিরোজের বাম হাঁটুতে গুলি করি। পর পর দুইবার।
অবিশ্বাসের দৃষ্টি চোখে নিয়ে বসে পড়ছে ফিরোজ – হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় – ভারসাম্য হারিয়ে দড়াম করে পড়ে যায় মাটিতে। কে কার বাটি ওড়ালো তা তো দেখাই গেল!
ওপর থেকে মেয়েটা দৌড়ে নেমে আসছে। আমার কাছে এসে শুধু দুর্বল গলাতে জানতে চায়, ‘বাবা পাঠিয়েছে আপনাকে?’
মৃদু হাসি আমি, ‘না। থাকুক সেসব কথা। তোমার দরকার এখন ফ্রেশ একটা অ্যানিমেশন মুভি। ‘ফ্রোজেন’ দেখেছ?’
*
মাথা নিচে পা ওপরে দিয়ে ঝুলে আছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ।
মানে, তাকে ওভাবে ঝোলানো হয়েছে আর কি।
চকচকে একটা হাসি উপহার দেই উনাকে, ‘কেমন বোধ করছেন?’
‘বিট্রে করলে, ইরফান। এর ফল ভালো হবে না।’ হিস হিস করে বলেন বন্দী হিরো!
‘কোথায়? ফোনে বললাম অর্ধেক শেয়ার আপনি পাবেন আর লাফাতে লাফাতে চলে এলেন? বিনিময় করার মত কি আছে আপনার?’
‘স্নিফার্সকে তোমার টেইল থেকে সরিয়ে দিতাম। এটাই ডীল ছিল।’ ঝুলতে ঝুলতেই বলেন তিনি।
হেহ – জাতীয় একটা শব্দ করলাম আমি।
‘স্নিফার্স আমার জন্য মাথাব্যাথা নয় মি. মাহমুদ। আর বিট্রের কথা বলবেন না। হোমমিনিস্টারকে নিশ্চয় ভুলে যান নি?’
দরদর করে ঘামা শুরু করলেন মাহমুদ এবার।
‘আনিকার ব্যাপারে তথ্য এনে দিয়ে কিডন্যাপারদের কাজটা সহজ করে দিয়েছিলেন। তারওপর প্রশাসনের ভেতরের তথ্য দিয়েছেন তাদের, কিডন্যাপিং তো নয়, হলো কিছু জলবত তরলং ক্লকওয়ার্ক। আর ফিরোজের মতো একটা লোক মুফতে পঞ্চাশ কোটি পাওয়ার একটা সুযোগ পেলে নেবে না সেটা? আপনার পঞ্চাশ কোটি তো ফাউ। উদ্দেশ্য তো আর টাকা ছিল না আপনার।’
‘কোথা থেকে এসব ভিত্তিহীন কথা বলছ -’ দুর্বল কন্ঠে প্রতিবাদের চেষ্টা করেন মাহমুদ।
হাত নাড়ালাম কাঁকড়া তাড়াবার মত করে, ‘প্রাণে বেঁচে থাকবেন না তো আপনি আর বেশিক্ষণ। কাজেই স্বীকার করা বা না করায় যায় আসে না কিছু।’
‘রায়হান রহমানের মেয়ে কিডন্যাপড হলে আমাকে খোঁজা হবে – খুঁজবে হোমমিনিস্টারের স্নিফার্স। এটা আপনি জানতেন। কিছু ঘটানোর আগ পর্যন্ত আমার ব্যাপারে নিজে থেকে নাড়াচাড়া করে পরিচয় ফাঁস করে দিতে চান নি, তাই একটা উপলক্ষ্য বের করলেন। কিডন্যাপ করলেন হোমমিনিস্টারের মেয়েকে!’ বলেই যাচ্ছি আমি, ‘এরপর আমাকে খুঁজে বের করল স্নিফার্স, সরকারের পূর্ণ রিসোর্স কাজে লাগানোর সুযোগ পেলেন আপনি। এদিকে হোম-মিনিস্টারের সাথে পুরোনো বন্ধুত্ব, সহানুভূতি দেখিয়ে অফিশিয়ালি, আনঅফিশিয়ালি এই কিডন্যাপ কেসে একেবারে জড়িয়ে রাখলেন নিজেকে । স্নিফার্সের মাঝে নাক ডুবিয়ে এক সাথে কাজ করার নাম করে আমাকে কাছাকাছি দেখে যাচ্ছিলেন। আমার প্রতি এত প্রেম কবে থেকে জন্মালো আপনার, বলুন তো?’
নির্বাক ঝোলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।
‘পরিকল্পিত ভাবে কিডন্যাপারদের হাতে আমাকে মেরে ফেলে পথের কাঁটা দূর করে ফেলতে চেয়েছিলেন। ডেলিভারির শর্ত এমনভাবে জুড়েছেন যাতে আমাকেই নিতে হয় টাকাটা। আর – ওটা তো ইস্যু না। মাঝপথে অ্যামবুশ পেতে রেখেছিলেন আমার খুনটা নিশ্চিত করতে। অথচ দেখুন, যত যা-ই হোক, আপনার নাম জড়াচ্ছে না। অজ্ঞাতনামা কিডন্যাপারদের কাজ। কি চমৎকার প্ল্যান আপনার। ধরেন মাছ – না ছোঁন পানি!’
এবার হুংকার দেন মাহমুদ, ‘বেশি বাজে বকছ ছোকড়া! তোমাকে মেরে ফেলে আমার দুই পয়সার লাভ থাকার কথা না। এটুকু বোঝা তো উচিত, এত বোঝ যখন। কেন করব আমি এত ঝামেলা – শুধু তোমার মত একজন প্রাক্তন কিডন্যাপারের জন্য?’
হেসে ফেলি আমি এবার আসলেই, ‘নির্বোধ পেয়েছেন আমাকে, স্যার? কিডন্যাপিং প্লেস – ফারিহার কিডন্যাপিং প্লেস। মুক্তিপণের টাকা চেয়েছেন– বন্যার মুক্তিপণের মত। ফিরোজ গ্রুপকে পুষছেন ঠিক ছয়মাস আগ থেকে ঠিক যখন শেষ হয়েছিল হেডফাইভস নিয়ে আমাদের ঝামেলা। ক্লুটা আপনি ঠিকই দিতে চেয়েছিলেন – যাতে বুঝতে পারি আমি শেষ মুহূর্তে – কে আমার জীবন ধ্বংস করল। কিন্তু নিজেই ধরা খেয়ে যাবেন – সেটা ভাবেননি।’
একটু দম নেই আমি, ‘কেন করবেন আপনি এত ঝামেলা? কারণ মি. মাহমুদ। ইউ আর দ্য ফিফথ হেডফাইভ।’

পরিশিষ্ট
কয়েকটা ইঞ্জেকশন পুশ করে তব্দা খাইয়ে রেখে এসেছি শেষ হেডফাইভকে।
আর্মি পার্সোনেল – তারওপর বেশ উঁচু তাঁর পদ। এ কারণেই ডন রাবেকের পঞ্চম হেডফাইভের নাম আমরা হাজার ঘেঁটেও বের করতে পারিনি এতদিন। আমরা ধরে নিয়েছিলাম পঞ্চম হেডফাইভ রাবেক স্বয়ং।
শেষ হেডফাইভকে হাতের মুঠোয় জীবিত পেয়ে রাবেকের সাথে শত্রুতার ইতি টানার একটা উপায় দেখতে পাচ্ছি প্রথমবারের মত। যেমন বলে থাকে, টানেলের শেষপ্রান্তে আলোর ছটা!
বারবারের ব্যর্থতা আমাদের হতাশ করেছিল, গুঁড়িয়ে দিয়েছিল মনোবল। আংশিক বিজয়ের পরও তিক্ত ভাবটা যাচ্ছে না অবশ্য, ঈশিতা ডন রাবেকের সাথে থেকে কাজ করছে, মনে পড়তেই অসহ্য লাগে সব কিছু।
মেয়েটা কেমন আছে কে জানে! মনে হচ্ছে একযুগ ধরে দেখা হয় না আমাদের! অথচ ঈশিতার সেই মেসেজের পর পার হয়েছে মাত্র সাতদিন। মেয়েটার বিপদাশঙ্কা বার বার ছেয়ে ফেলছে আমার মন। জানি, আন্ডারওয়ার্ল্ড কেমন অনিশ্চিত একটি জগত। ও জগতে আমি ছিলাম একসময়। আর একমাত্র ফ্যামিলি বলতে এই বোনটাই ছিল আমার কাছে, নিজেকে বড় অসহায় মনে হয় আমার।
দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে বুক চিড়ে।
আকাশের দিকে তাকাই আমি, ‘নিরাপদে থেক, ঈশিতা।’

হেডহান্টারস


স্বাধীন পাখিগুলো নীড়ে ফিরছে।
সন্ধ্যার আবহটা আমার কাছে সব সময় চমৎকার লাগে। এটাই একমাত্র পরিবেশ যেটা আমাকে মনে করিয়ে দেয় পৃথিবীতে একাকীত্বের মাঝে একটা আলাদা সুখ আছে। একাকীত্ব উপভোগের মত সময় অবশ্য এটা নয়। সামনের গলির দুইপাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলো দেখছি আমি।
এর মধ্যে লাল গেইটের বিল্ডিংটাই আমার টার্গেট।
ঢাকার বাসাগুলো হঠাৎ করেই বেড়ে ওঠে একসাথে – এটা একটা মজার ব্যাপার।
শহরের ধারে থাকা জনবহুল এলাকাগুলোতে এই কাজটা হয়। হয়ত একসাথে তিনটি চারতলা বিল্ডিং ছিল – একবছর পরেই দেখা যাবে একই সাথে বিল্ডিংগুলো ছয়তলা হয়ে গেছে!
বাড়িওয়ালারা কি নিজেদের সাথে কম্পিটিশন করে এই কাজ করে নাকি একই সাথে তাদের বাজেট বেড়ে যায়, সে এক রহস্য।
তবে সেসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কাজ শুরু করতে হবে।
বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে গেলাম।
আস্তে করে কোটের ভেতরের দিকে হাত দিয়ে নিশ্চিত হলাম হোলস্টারে চুপচাপ বসে আছে আমার বিশ্বস্ত গ্লক টুয়েন্টি-থ্রি।
আজ ওর কাজ আছে। লাল গেইটের দিকে পা বাড়ালাম আমি। ধীরস্থির একটা ভঙ্গী ধরে রাখলাম চলার মাঝে, যেন এখানে প্রতিদিনই আসি।
ভেতরে ঢুকতেই চেয়ারে ঝিমাতে থাকা সিকিউরিটি গার্ডের শুভদৃষ্টি আমার ওপর এসে পড়ল। ঝটপট ঝিমানোর ভাবটা চলে যায় ইনার মুখ থেকে। উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গল লোকটা।
‘কোন ফ্ল্যাটে যাইবেন?’
‘টপ ফ্লোরে।’ শান্ত কন্ঠে উত্তর দেই।
‘ওহ, আসাদ স্যারের বাসায়?’ দেওয়ালে ঝোলানো রিসিভারটার দিকে এগিয়ে যায় সিকিউরিটি গার্ড, ‘কি নাম বলব?’
লোকটার পিছু নিয়ে এগিয়ে গেছি আমিও।
ঘাড়ের ওপর একটা মাপমত আঘাত করতেই টু শব্দটা না করে মাটিতে লম্বা হয়ে গেল গার্ড।
‘টপফ্লোর মিনস… রুফটপ।’ অজ্ঞানটাকে উত্তর দিলাম।
ওটাকে তুলে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। বেকায়দা ভঙ্গীতে চোখ বন্ধ করে ঘাড় এলিয়ে পড়ে থাকে মানুষটা।
তা থাকুক।
সবমিলিয়ে আমার দরকার মাত্র আধাঘন্টা। তবে শুধুমাত্র এই বিল্ডিংয়ে আমার অতটুকু সময়ও প্রয়োজন নেই। মিনিট দেড়েক হলেই চলবে। সিঁড়ি ভাঙ্গার ঝামেলায় গেলাম না। লিফটটাকে ডেকে নামিয়ে চট করে উঠে গেলাম।
যন্ত্রকক্ষটা চূড়োয় থামলে শান্ত পায়েই বের হলাম। কোন তাড়াহুড়োর ছাপ নেই আমার আচরণে। বাইরে অপেক্ষমাণ এক যুগলকে দেখা গেল। একে অন্যের হাত জড়িয়ে লিফটের অপেক্ষা করছিল।
নিউলি ম্যারিডম খুব সম্ভব! ওদের উদ্দেশ্যে একটা ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে লিফট থেকে বের হয়ে যাই।
ওপরের দিকে আরেকতলা সিঁড়িতে করে পার হতেই ছাদে বের হওয়ার দরজাটা চোখে পড়ল।
যথারীতি তালাবদ্ধ একটা দরজা। ঢাকার বাড়িওয়ালাদের ছাদ দখলের চিরন্তন মানসিকতা।
পকেট থেকে একটা বোতল বের করলাম। ভেতরের তরলটা আস্তে করে তালার গর্তে ঢুকিয়ে দিতেই বেচারার দফারফা হয়ে যায়।
ছাদের মুক্ত বাতাসে পা রেখে স্বস্তি অনুভব করি।
পাশের বিল্ডিংটা এর থেকে আটফিট দূরে।
একেবারে কম নয় দূরত্বটা। চোখ দিয়ে একবার মেপে নিয়ে দৌড় শুরু করি।
প্রথমে আস্তে আস্তে এবং ধীরে ধীরে বেগ বাড়তে বাড়তে এখন বুলেটের মত ছুটছি ছাদের রেলিংয়ের দিকে – সামনে তিন ফিট রেইলিংটা পড়তেই ছোট একটা লাফের সাহায্যে ওটার ওপরের অংশে পা রেখে মাটির সাথে সমান্তরাল ভাবে নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম।
আশি ফিট নিচে একটা ভাঙ্গা সাইকেল দেখা যায়। কে এনে রেখেছে – সেটা কে বলতে পারে?
তবে ওইপাশে পৌঁছতে না পারলে আমার অবস্থা সাইকেলের চেয়েও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ঠিকমত ল্যান্ড করে আবারও শান্ত পায়ে হাঁটলাম এই ছাদের রেলিংয়ের দিকে।
কোটটা খুলে একপাশে সরিয়ে রাখলাম। তারটার একপ্রান্ত বাঁধতে হবে ছাদের মাঝেই কোথাও।
কোটের ভেতর কাঁধের সাথে ছিল তারের রীলটা।
একপ্রান্ত অ্যান্টেনার লোহার রডটার সাথে বেঁধে তারটা আলগোছে ঝুলিয়ে দিলাম নিচে। এই পথেই ভাগতে হবে। চারতলা নেমে যুদ্ধ করে পালানোর চেয়ে তিনতলা ওপরে এসে ছাদ থেকে কেটে পড়া ঢের সহজ।
আবার এগুতে থাকি দরজার দিকে।
এই ছাদে আমি বাইরে থেকে দরজাটা দেখতে পাচ্ছি – কাজেই তালাটা ভেতরের দিকে।
লাথিয়ে ভাঙ্গতে হবে। এই দরজা খোলার আর কোন প্ল্যান নেই।
তারপরও সারপ্রাইজিং এলিমেন্ট কিছু থাকছে। এই বিল্ডিংয়ের নিচ থেকে উঠতে গেলে সেটা পাওয়া যেত না।
আখতারকে ধরার সুযোগ বার বার আসবে না। এই একবারেই কাজ সারতে হবে।
গডফাদার রাবেকের ‘হেডফাইভস’-এর একজন এই আখতার। আজকের জন্য ওর অবস্থান জানতে পারাটাই একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। এরপর এরকম সুযোগ আর নাও আসতে পারে।
হেডফাইভস!
পাঁচজন মানুষ।
এরাই দাঁড় করিয়ে রেখেছে রাবেকের সব কার্যক্রম। রাবেকের সাথে কেবল এই পাঁচটি মানুষেরই সরাসরি যোগাযোগ হয়। কাজেই একজন জীবিত হেডফাইভকে পেলে রাবেককেও পাওয়া যাবে – সমীকরণটা সহজ।
প্রকান্ড লাথিটা দরজাতে ফেলেই থমকে গেলাম। শব্দটা আরেকটা শব্দ ঢেকে দিয়েছে!
নীচ থেকে একই সাথে হওয়া শব্দটা আমার অভিজ্ঞ কান চিনে নিল নিমেষেই!
মসবার্গ শটগানের শব্দ ওটা!
দড়াম দড়াম করে ছয় লাথিতে ছুটিয়ে ফেললাম দরজা। নীচে এরই মাঝে যুদ্ধ বেঁধে গেছে!
আক্রমণকারীরা নীচতলা থেকে ওপরের দিকে উঠে আসছে। আখতারের লোকেরা প্রাণপনে চেষ্টা করছে বাঁধা দেওয়ার – তবুও টিকতে পারছে না ওদের সামনে।
স্তব্ধ হয়ে সিঁড়ি ঘরের ছাদের কাছে দাঁড়িয়ে আছি আমি।
রাবেকের হেডফাইভের একজনকে হামলা করতে আসতে পারে কে?
প্রশ্নোত্তরের সময় নেই – প্রবল বিক্রমে ছাদের দিকে উঠে আসছে হানাদারদের দুইজন।
গ্লক থেকে দুটো গুলি ছুঁড়তেই ওদের নড়াচড়া থেমে গেল।
চারতলায় আখতার ছিল।
এই মুহূর্তে সেই ফ্লোর থেকে তিনতলা ওপরে দাঁড়িয়ে আমি। কানের সমান্তরালে পিস্তলটা ধরে রেখে ধীরে ধীরে নামতে থাকি সিঁড়ি বেয়ে।
একটু আগে গুলি করা দুইজনের মাথা ভেঙ্গে রক্ত গড়িয়ে নামছে – ওটা এড়িয়ে চলতে হচ্ছে।
এতে পা পিছলালে দেখার মত দৃশ্য পাবে হেডফাইভ আখতার আর তাকে আক্রমণকারীরা।
সাবধানে পাঁচতলাতে নেমে আসতে আসতে নিচের গোলাগুলির শব্দ একেবারেই থেমে গেল। কোন একপক্ষ একেবারে নিঃশেষিত নিশ্চয়?
দেখতে হচ্ছে।
একমাত্র জীবিত মানুষ আখতার হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। রাবেকের মত একটা ঘোস্টের পিছু নিয়ে লাভ হবে না। কিন্তু হেডফাইভের কাওকে জীবিত ধরতে পারলে চিরশত্রুকে নিঃশেষ করে দেওয়া সম্ভব।
ধীরে ধীরে মাথা বের করলাম চারতলা এবং পাঁচতলার সংযোগস্থলে।
পরমুহূর্তে একটা তীব্র বিস্ফোরণ।
উড়ে গেল চারতলার অ্যাপার্টমেন্টের দরজা – পেছনে আগুনের শিখা।
সরে যাওয়ার চেষ্টা করেও খুব একটা কাজ হল না। দরজার অংশবিশেষ আঘাত হানল বুকে। শকওয়েভের তীব্রতায় একই সাথে ছিটকে সিঁড়িঘরের অন্যপাশের ল্যান্ডিংয়ের সাথে সেঁটে গেছি।
হাঁফাচ্ছি চোখ বন্ধ করে। কান বেয়ে একফোঁটা রক্ত পড়তে শংকা অনুভব করি। ইন্টারনাল ব্লিডিং না এক্সটার্নাল?
বাইরে একটা গাড়ির ইঞ্জিন গর্জে উঠল। কিছুই আমার পরিকল্পনা অনুসারে হচ্ছে না!
পালাচ্ছে আখতার? নাকি তার আক্রমণকারী কেউ?
পিছু নিতে হবে ওর! তাগাদা অনুভব করি প্রবলভাবে।
পায়ে জোর নেই শকওয়েভের ধাক্কায় – তবুও ছুটে বের হতে চাই সর্বশক্তি একত্র করে – ফলস্বরূপ সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চারতলার ধ্বংসস্তুপে এসে থামে আমার দেহ।
গরম ধ্বংসস্তুপে পড়ে হতাশায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে আমার।
রাবেকের আরেকটা ট্রেইল হারিয়েছি আমি এইমাত্র।


‘আরেকজন হেডফাইভ দরকার আমার।’ এলোমেলো চুলে বলি আমি।
‘একটা দিন পরে আবার কাজে নামতে পারিস।’ মিনহাজ বলে।
হতাশা নিয়ে সারা শরীরের ব্যান্ডেজগুলোর দিকে তাকালাম।
গডফাদার রাবেক ঈশিতাকে খুঁজছে ওর সাম্রাজ্যে বসানোর জন্য। একই সাথে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে পথ থেকে একমাত্র বাঁধাটা দূর করে দিতে। আমার হাতে একদিন সময় নেই।
হাসপাতালে বসে আছি আমি। বাল্যবন্ধু মিনহাজ এবারের কাজটায় আমাকে গোড়া থেকেই সাহায্য করছে।
এই দফা অন্তত রাবেকের থেকে এগিয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মাঝখানে অনাহূত থার্ড পার্টি এসে পড়ায় ঝামেলা হয়ে গেল।
‘আখতারের প্রতিটা মানুষকে মেরে ফেলা হয় ওখানে।’ বিড় বিড় করে মিনহাজকে জানালাম, ‘কিন্তু মারল কারা? অন্তত এই জিনিসটা খোঁজ নিয়ে দেখ – ঢাকার কোন গ্যাং কারও ওপর আজ হিট নিয়েছে কি না। হেডফাইভ খুঁজে পাওয়ার থেকে এটাই বেশি সহজ হবে।’
‘তুই নিশ্চিত সামলে নিতে পারবি?’ আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চায় মিনহাজ।
‘আরে ধ্যাত!’ ধমকে উঠি আমি মৃদুস্বরে, ‘গুলি তো আর খাইনি। এটা এমন কিছু না। একটু পরেই বের হয়ে যাব আমি।’
তাও সন্দেহের চোখে তাকায় মিনহাজ। তবে জানে একবার যখন বলেছি আমি এখান থেকে একটু পরে বেরিয়ে যাচ্ছি – আমাকে হাসপাতালে আটকে রাখার সামর্থ্য কারও নেই।
মিনহাজ বেরিয়ে যেতে পুরো ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করলাম।
ডন রাবেকের সাথে আমার শত্রুতা আজকের নয়। আমার মায়ের হত্যাকারী মানুষটা। শেষবার যখন আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম, ঈশিতা ছিল সাথে।
খুব জঘন্য একটা দিন ছিল সেটি।
ওর অনুরোধে রাবেকের মাথাতে একটা বুলেট না ঢুকিয়েই বেরিয়ে এসেছিলাম ঠিকই – কিন্তু ভবিষ্যতে সেই ছাড় তাকে আর দেওয়া হবে না।
নার্স এসেছে।
‘শুয়ে পড়ুন। ইঞ্জেকশন দেয়ার সময় হয়েছে।’ খুব ছটফট করে বললো সে। নার্স মেয়েগুলো কি শান্ত গলায় কথা বলতে পারে না?
‘বসে থাকলে হবে না?’ পাল্টা প্রশ্ন করতে মন চাইলেও করলাম না। একটু পর কেটে পড়ছি এখান থেকে।
শুয়ে পড়তেই আমার হাতের দিকে এগিয়ে আসে নার্স।
পরক্ষণেই ‘ক্লিক’ জাতীয় শব্দটা সবকিছু স্পষ্ট করে দেয়।
নার্সও কি রাবেকের লোক?
নাকি অ্যান্টি-রাবেক এ?
আমার বাম হাতটা হসপিটাল বেডের সাথে আটকে দেওয়া হয়েছে একটা হ্যান্ডকাফের সাহায্যে।
আলতো করে দুইবার টান দিয়ে দেখলাম। অযৌক্তিক।
চাবি ছাড়া মুক্তির উপায় নেই।
সুন্দরী নার্সের মুখে আলাদা রকম একটা হাসি ফুটেছে।
আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে বুকের কাছ থেকে গ্লকটা সরিয়ে নেয় ও। তারপর বেডের পেছন দিকটা ধরে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকে।
আস্তে করে বলল শুধু, ‘চোখ বন্ধ করে থাকুন।’
আর উপায় কি?
কাজেই শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে থাকি আমি। নার্স ঠেলে নিয়ে যেতে থাকে ঝড়ের বেগে।
বাইরে আমার জন্য কোন ট্রান্সপোর্টেশন অপেক্ষা করছে – গায়ে অ্যাম্বুলেন্সের ছাপ মারা – এটা বুঝতে জোতিষ্যি হওয়া লাগে না।
কিছুক্ষণের মাঝেই যখন লিফটের টুং-টাং শুনলাম তখনই স্পষ্ট হয়ে গেল আমার ধারণার সত্যতা।
চোখ বন্ধ করেই তারপর আবারও চাকার গড়গড়ানি শুনতে থাকি।
আশে পাশে শুধু হাসপাতালের একটা অদ্ভুত গন্ধ।
অবশেষে প্রায় একযুগ পর একটি পুরুষকন্ঠ শোনা যায়, ‘মেরে ফেলেছ নাকি?’
‘নাহ। একটু শাসানী দিয়েছি। এখন বাধ্য ছেলের মত চুপ করে আছে।’ আনন্দের সাথে জানায় মেয়েটা।
‘উই হ্যাভ হিম, বস!’ এবার পুরুষকন্ঠ রিপোর্ট করে।
‘ড্রাইভ কর। পেছনে বসছি আমি।’
আস্তে করে তাকালাম। আস্ত বেড সহ আমাকে অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।
ভেতরে দুইজন মানুষমাত্র।
নার্সরূপী মেয়েটি নার্সের পোশাক খুলে ফেলেছে। ওগুলোর আর দরকার নেই।
চোখে খুনীর দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে এ।
অপরজন পুরুষ। বয়েস কম না – পঞ্চাশের ঘরে পা রেখেছে এটুকু নিশ্চিত।
অনেক প্রশ্ন মনে জমা হয়ে আছে – তবে চুপ করে থাকলাম। যা বলার ওদেরই বলার কথা। মেরে ফেলতে চাইলে মেয়েটা হাসপাতালের ভেতর একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে চলে আসতে পারত।
‘উঠে বসতে পার হে!’ গলায় কৌতুক ফুটিয়ে বলে লোকটা, ‘যদি ততটা দুর্বল না বোধ কর।’
এরপর আর শুয়ে থাকা চলে না। উঠে বসে লোকটার মুখোমুখী হলাম। হাত এখনও হ্যান্ডকাফের সাথেই আটকানো।
‘কে আমি – কেনই বা তোমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছি – এসব জানতে চাইবে না?’ আবারও বলে মানুষটা।
একমুহূর্ত চিন্তা করে উত্তর দিলাম, ‘ডন রাবেকের একজন হেডফাইভ আপনি। ইয়াসির মির্জা সম্ভবতঃ – কারণ হেডফাইভদের মাঝে সবচেয়ে সিনিয়র এই বেজন্মাই।’
একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা। বন্দী যে তার এমন পরিচয় দিতে পারে – সেটা বোধহয় কল্পনা করতে পারে নি ইয়াসির।
অবশেষে প্রফেশনালি নিজের রাগটা দমন করল হেডফাইভ ইয়াসির। তার মুখের কোণে একটা বিদ্রুপের হাসি।
‘চমৎকার ধরেছ। তারমানে আসলেই যা শুনেছিলাম সত্যি। হেডফাইভদের একে একে খুন করে ফেলার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে একা এক যোদ্ধা।’ অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে ফার্স্ট এইড কিট বের করে ইয়াসির।
‘হেডফাইভদের খুন করার ইচ্ছে আমার কখনই ছিল না। তার থেকে একজন জীবিত হেডফাইভই আমার জন্য বেশি উপকারী হবে। আ’ম কাউন্টিং অন ইউ ফর দ্যাট, ইয়াসির।’ ঠান্ডা গলাতেই জবাব দেই আমি।
ইয়াসির ফার্স্ট এইড কিট খুলে একটা চমৎকার চকচকে স্ক্যালপেল বের করেছে। আলতো আঁচড়ে মাংস কেটে অনেক গভীরে ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব এটা দিয়ে। সার্জারীর সময় স্ক্যালপেল ব্যাবহারের কারণেই সবচেয়ে কম সংখ্যক কোষের ক্ষতি করে সবচেয়ে গভীরতম ক্ষতগুলো করা যায়। আমরা দুইজনই সম্মোহিতের মত স্ক্যালপেলটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
নার্স মেয়েটার কোন বিকার নেই – ও জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছে!
হেডফাইভের একটা হাত উঠে যায় – সেই সাথে স্ক্যালপেলটাও। ইয়াসিরের হাতটা নড়ল কি নড়ল না – বাম গালটা বেশ বাজে ভাবে চিড়ে গেল আমার।
রক্তের একটা স্রোত চিবুক বেয়ে গলার দিকে নামছে স্পষ্ট অনুভব করলেও কোন শব্দ করলাম না। চোখ খুঁজছে ডানদিকে কাজে লাগানোর মত কিছু একটা। একটা হাত এখনও খোলা আমার।
‘হেডফাইভ আখতারের হাইডআউটে গতকাল সন্ধ্যাতেই হামলা চালানো হয়েছে। একেবারে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে ওকে। কাজটা যে তোমার আর তোমার লোকেদের সেটা বুঝে নিতে বেশি ভাবতে হয় না। এখন আমাদের দাবী সাধারণ, হেড ফাইভের বিরুদ্ধে তোমার যে কয়জন লোক আছে – প্রত্যেকের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে যাও।’
‘চমৎকার।’ হাসিমুখে বলার চেষ্টা করি কিন্তু গালের ক্ষতটার জন্য হাসি ঠিক জমল না! ‘বিনিময়ে আমাকে কি অফার করছেন?’
‘শান্তিপূর্ণ একটা মৃত্যু।’ হাতের স্ক্যালপেল দুলিয়ে বললো হেডফাইভ।
একে বলে লাভ নেই যে ওখানে একটা থার্ড পার্টি ছিল।
একে বলে লাভ নেই আমি একা কাজ করি।
সে যখন ধরে নিয়েছে কাজটা আমারই, এখান থেকে তাকে আর টলানো সম্ভব হবে না।
কিন্তু ছেদো কথায় কিছুটা সময় নষ্ট করা গেলে আশা করা যায় বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও বাড়তে থাকবে।
‘অসাধারণ আপনার অফার। আগে পেমেন্টটা অ্যাডভান্স করে দিন, তারপর জানাচ্ছি আপনাদের তথ্য।’ গলায় খুশি খুশি ভাবটা ধরে রেখে বললাম।
হঠাৎই হাতের সার্জিক্যাল নাইফটা আমার বাম কাঁধের নিচে ঢুকিয়ে দেয় ইয়াসির, হিস হিস করে বলে ওঠে, ‘সব কাজ ফেলে আমি নিজে ছুটে এসেছি এই হাসপাতালে। আমাকে খুন করতে চাওয়া মানুষটার সাথে নিজে ডীল করতে। বাস্তবতা মেনে নাও ছোকড়া – এখন অথবা পরে – গান তোমাকে গাইতেই হবে!’
বাম কাঁধে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। বেশিদিন নয় ওদিকেই একটা গুলি খেয়েছিলাম আমি।
এই হারামজাদা দেখছি বেশ জ্বালালো! একই জায়গাতে বার বার খোঁচাখুঁচি কেন? তবে একটা সুবিধেও আছে – সার্জিক্যাল নাইফটা এখনও আমার বাম কাঁধে গাঁথানো। হেডফাইভ ইয়াসির আমার একটু বেশি-ই কাছে।
আর আমার ডানহাতটা মুক্ত!
নার্স মেয়েটাও বাইরের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছে।
বাইরেটা একটু আমিও দেখে নেই। সামনেই একটা ব্রীজ আছে।
মনটা খুশি হয়ে ওঠে। চট পট বুড়োটাকে কাবু করে ফেলে নার্সটার কাছ থেকে হ্যান্ডকাফের চাবি ছিনিয়ে নিতে হবে।
তারপর বুড়োকে নিয়ে সটকে পড়তে হবে। রাবেকের আরেকটা ট্রেইল ধরিয়ে দিতে পারে এই হেডফাইভ।
বিদ্যুতবেগে নড়ে উঠছি, তবে কিছুই করতে পারলাম না।
চেঁচিয়ে ওঠে নার্স, ‘অ্যামবুশ!’
পরমুহূর্তে যেন নরক ভেঙ্গে পড়ে আমাদের চারপাশে!


বুলেটবৃষ্টি চলছে।
তারমাঝে কোনমতে মাথাটা নামিয়ে রেখেছি।
ছোট একটা পিস্তল বের করে ধাই ধাঁই গুলি ছুঁড়ছে মেয়েটাও। হেডফাইভ চট করে শুয়ে পড়েছে – অ্যাম্বুলেন্সের মেঝে হাতড়াচ্ছে। ওখানে কি গুপ্তধন রেখেছে কে জানে!
ব্রীজের মাঝখানে আছে অ্যামবুশ করে থাকা ওই ওরা। আর আমাদের গাড়িটা আরেকটু পর ওদের অতিক্রম করে গেলেই আর কোন ভয় নেই। তবে তারপর কপালে হেডফাইভ ইয়াসিরের জেরা তো আছেই।
অর্থাৎ আমার জন্য লাল-নীল দুটোই সমান।
এই সময় স্প্রের মত রক্ত এসে লাগল আমার চোখে মুখে।
চোখ কুঁচকে ফেললাম। রক্তের সাথে হাড়ের কুঁচিও এসে লাগছে। চোখে পড়লে চুলকাবে অনেক।
খুলির একাংশ উধাও হয়ে আছে – এই অবস্থায় হেডফাইভ ইয়াসিরের শরীরে ঢলে পড়ে মেয়েটা।
এই সময় সাঁই করে বাতাস কেটে ওদের ছাড়িয়ে যায় আমাদের অ্যাম্বুলেন্স। তবে পেছন থেকে গুলিবৃষ্টি এখনও চলছে!
একই সাথে ড্রাইভিং সীট থেকে একটা আর্তচিৎকার শুনতে পাই আমরা। ঘটনার তাৎপর্য বুঝেছে ইয়াসির; শরীরের ওপর থেকে কোনমতে মেয়েটাকে সরিয়ে ড্রাইভিং সীটের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরতে চায় স্টিয়ারিং।
আরেকপশলা গুলি ডান দিকের চেসিস ভেদ করে ঢুকে পড়ে ভেতরে।
ড্রাইভারের ঘাড়ে লাগে তাদের একটা।
ইয়াসির কিছু করার আগেই মৃত্যুকালীন রিফ্লেক্সে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ফেলেছে ড্রাইভার।
রেইলিং ভেঙ্গে নদীর বুকে আছড়ে পড়ে আমাদের মাইক্রো-অ্যাম্বুলেন্স।
এক সেকেন্ড ভেসে থাকে চুপচাপ – তারপরই ডুবতে শুরু করে।
বাঁহাতে হাতকড়া আর হাতকড়ার অন্যপ্রান্তে হাসপাতালের একটা ভারী লোহার বেড নিয়ে নদীর বুকে ডুবতে থাকার অনুভূতি তলপেটে খামচি দিয়ে ধরে আমার। দিনের প্রথমবারের মতো টের পেলাম ও জিনিস!
নিখাদ এক আতঙ্ক!
কিন্তু ফিরে আসছে না কেন হেডফাইভ ইয়াসির?
যেই অ্যাঙ্গেলে বসে আছি সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও বুঝতে পারলাম মাথায় একটা বুলেট এরও লেগেছিল তখনই।
রাবেকের ট্রেইল বের করার আরেকটা সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে অবশ্য এখন আক্ষেপ করার সময় নেই। মৃত্যুফাঁদে আটকে আছি আমি। বের হতে হবে এখান থেকে।
*
অ্যাম্বুলেন্সে পানি বাড়ছে।
ভেতরে হুড় হুড় করে পানি ঢোকা শুরু করবে। ড্রাইভিং সীটের পাশের জানালা পর্যন্ত ওয়াটার লেভেল পৌঁছানোর যা দেরি। হা করে খুলে রেখেছিল ওটা ড্রাইভার।
এখনও নিচের বিভিন্ন ফাঁকফোকড় দিয়ে পানি ঢুকছে – তবে তুলনামূলক ধীরগতিতে।
মরা নার্সের দিকে হাত বা পা বাড়ানোর চেষ্টা করে লাভ হল না – একেবারে ড্রাইভিং সীটের পেছন দিকে গিয়ে পড়েছে ও ইয়াসিরের ধাক্কার সময়। এদিকে প্রাণপনে চেষ্টা করেও বেডটাকে একচুল নড়াতে পারছি না। হাতও হ্যান্ডকাফে আটকে আছে।
নড়াতে পারার কথাও অবশ্য না – অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর আস্ত বেড ঢোকাতে গিয়ে একেবারে টাই টাই করে ঢোকাতে হয়েছে। অতিরিক্ত একটা ইঞ্চি জায়গাও নেই। কাজেই বেড নড়িয়ে মৃত মেয়েটার কাছে গিয়ে চাবী উদ্ধারের চেষ্টা করে লাভ নেই।
বেশ গ্যাড়াকলেই পড়া গেছে!
ভবিষ্যত চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি – পানিতে সব কিছুর ওজন কমে যেতে পারে – কিন্তু লোহার এই খাটটা যেভাবে অ্যাম্বুলেন্সের সাথে এঁটে আছে – আমার কোন উপকার তাতে হবে না।
অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরটা ভালো করে দেখলাম। কিন্তু কিছুই নজরে আসছে না যা কাজে দেবে।
অক্সিজেনের সিলিন্ডার একটা আছে বটে – তবে ওটা থেকে মেয়েটার লাশই কাছে!
মুক্তির জন্য ঝড়ের বেগে ভাবনা চলে মাথায়। কিন্তু বাস্তবতা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না।
এরই মধ্যে উইন্ডো লেভেলে পানি চলে এসেছে – ড্রাইভারের খোলা জানালা দিয়ে খুব দ্রুত পানি ঢোকা শুরু করল।
সেই সাথে ঝট করে কাত হয়ে যায় অ্যাম্বুলেন্স। আড়চোখে একবার দেখি।
মেয়েটার লাশ আমার দিকে একটু এগিয়ে এসেছে – কিন্তু এখনও নাগালের বাইরেই।
আর শুরু হয়েছে বুকের জ্বলুনী। হেডফাইভ ইয়াসির সার্জিক্যাল নাইফ যেখানে গাঁথিয়ে দিয়েছিল তার চারপাশে মনে হয় নরকের সব প্রেতাত্মারা নাচছে। আমার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষার সময় নেই হয়ত ওদের।
বুক ভরে বাতাস নিতে থাকি আমি।
আরেকটু পর একেবারেই ডুবে যাবে অ্যাম্বুলেন্সটা। স্পষ্ট বুঝতে পারি এই শেষবারের মত বাতাস টেনে নিচ্ছি বুক ভরে, তারপর আর পাবো না। কেন জানি তবুও শান্তি লাগে না একটুও – কোন স্বাদ পাই না সেই বাতাসে।
ঝুপ করে ডুবে গেলাম।
ডুবে যাওয়ার সাথে সাথেই সামনের দিকটা উঁচু হয়ে যায় একটু। পানির নিচেই তাকিয়ে তামাশা দেখছি।
সামনের দিকটা উঠে গেল কেন? অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো ওপরের দিকে চাপ দিচ্ছে নাকি? আমার ভাবনা শুনলে যেকোন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক গাট্টা লাগাতেন সন্দেহ নেই – কিন্তু ব্যাখ্যার দিকে যাই না আমি আর।
অ্যাম্বুলেন্সের বক্রতায় নার্সের লাশটা সরে এসেছে এদিকে। সেই সাথে আমার নাক মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় বেশ কিছু বুদবুদ। ফুসফুসের রিজার্ভ প্রায় ‘এম্পটি’।
ডান হাতে মেয়েটার লাশ ধরে আরও কাছে টেনে এনে পাগলের মত চাবিটা খুঁজি।
কোথায় রেখেছে?
মেয়েটার কোমরে হাত পড়তেই থমকে যাই।
আমার গ্লকটা।
.40 ক্যালিবারের অস্ত্র দিয়ে পানির নিচে গুলি করা যায় না – বিস্ফোরিত হবে পিস্তলের ব্যারেল!
সাথে করে নিয়ে যাবে আমাকেও!
ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেই – আমার গ্লকে মেরিটাইম স্প্রিং কাপ বসিয়েছিলাম গত বছর।
কাজেই নিখুঁতভাবে পানির নিচেও গুলি করা সম্ভব।
পাঁচ সেকেন্ড পরই অ্যাম্বুলেন্সের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসি আমি।
ওপরের দিকে উঠতে থাকি সাঁতরে।
বাতাসের অভাবে ফুসফুসটা ফেটে যাচ্ছে!


কোনমতে নিজের হাইডআউটে ফিরে এসেছি।
ডন রাবেকের মত ভয়ানক একজন মানুষের সেরা পাঁচজন অপারেটরকে কেউ সরিয়ে নিতে চাইছে। রহস্যটা আমার কাছে মোটেও স্পষ্ট নয়। মজার ব্যাপার হল – ডন রাবেক বা হেডফাইভের ধারণা কাজগুলো আমার।
এই তৃতীয়পক্ষটা কোথা থেকে আসল?
ঝট করে মাথায় একটা সম্ভাবনা দেখতে পাই – ঈশিতার আগমনকে কি ডন রাবেকের উচ্চপর্যায়ের লোকেরা মেনে নিয়েছে সহজভাবে? দলের জন্য কাজ করতে থাকা অনেকেই হয়ত রাবেকের পরে ডন হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল । অথচ বুড়ো বয়সে রাবেকের ভীমরতি ধরলো। নিজের টিন-এজ মেয়েকে সে এখন গ্রুম করে সিংহাসনে বসাবার পরিকল্পনা কষেছে। দলের ক’জন একে ভালো চোখে দেখছে?
হামলাগুলো করছে কে?
আরেকজন হেডফাইভ?
সম্ভাবনাটি উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
মিনহাজকে খুঁজে বের করা দরকার। আর কোন আপডেট কি বের করতে পেরেছে কি না কে জানে!
সেকেন্ডারী ফোনটা হাতে তুলে নিলাম।
বাইরে থাকলে মাঝে মাঝেই মোবাইল ফোন হারানোর মত ঘটনা ঘটতে পারে – একটু আগে যেমনটা ঘটেছে! এখন অন্তত দুটো নাম্বার আমার নাগালে থাকে। একটা হারালে যেন আরেকটা দ্রুত ব্যবহার করতে পারি। এসব আমার বন্ধুদেরও জানা আছে।
বেয়াল্লিশটা মিসকল!
ফারিহা!
দ্রুত কলব্যাক করলাম।
‘হ্যালো, ফারিহা।’
‘রবিন!’ ফারিহার গলা একেবারে শান্ত। একেবারেই স্বাভাবিক।
‘কি হয়েছে?’ ভয়ের একটা অনুভূতি চারপাশ থেকে চেপে ধরে আমাকে। ও এত চুপচাপ কেন বেয়াল্লিশবার ফোন দিয়ে? ‘অ্যাই ফারিহা?’
‘এক ঘন্টা আগে আমাদের বাসার সামনে তিনটা গাড়ি এসেছিল।’ চুপচাপ শোনে ইরফান, ‘বাবাকে গুলি করেছে ওরা। ঈশিতাকে নিয়ে গেছে সাথে করে যাওয়ার সময়।’
ফোনের ওপাশের কথা শুনতে শুনতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে একহাতে গ্লকটা আবার তুলে নিয়েছি আমি – হোলস্টারে ভরে হাঁটা শুরু করেছি দরজার দিকে। রাবেক এরই মধ্যে ঈশিতাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছি তা খুঁজে বের করে ফেলল?
‘রিজভী আংকেলের কি অবস্থা?’ ঝটপট জানতে চাই আমি। ফারিহার বাবা উনি। এঁর কাছেই রেখে গিয়েছিলাম ঈশিতাকে। আমার কারণে পরিবারটির ওপর আরও একবার একটা ঘূর্ণিঝড় নেমে এল!
‘জানি না। বাবার কিছু লোক বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।’ হঠাৎই কেঁদে ফেলে ফারিহা। শক কাটিয়ে উঠেছে যেন। ‘তুমি কোথায়, রবিন? আসো প্লিজ। তোমাকে খুব দরকার যে আমার!’
মিনহাজকে ফারিহার ঠিকানা দিয়ে মোটরসাইকেলটা ছুটাই পূর্ণগতিতে।
মাথা ভারী হয়ে আছে একগাদা দুশ্চিন্তায়। রিজভী আংকেলের মত চমৎকার একজন মানুষের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকাটা নিয়ে একধরণের কষ্ট আর নিজের একমাত্র জীবিত আত্মীয় ঈশিতাকে আরেকবার হারানোর ভয়ে মাথার ভেতর সব কিছু জট পাকিয়ে যায় আমার।
*
সেই পরিচিত বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আবারও।
ফারিহাকে কিডন্যাপ করার রাতে ওকে এখানেই ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম। এরপরে আরেকবার আসা হয়েছে ঈশিতাকে রাবেকের খপ্পর থেকে প্রথমবার মুক্ত করে। সেবারে এখানে সাতদিন ছিলাম। আহত অবস্থায়।
ফারিহা সেসময় সেবা করেছে প্রাণপণে! রাতে ঘুমায় নি – দিনে নিজেকে সময় দেয় নি বিশ্রামের। যেন এক মুহূর্ত আমাকে চোখের আড়ালে রাখলেই কেউ একজন এসে আমায় শেষ করে দেবে!
অথচ মেয়েটার সাথে বন্ধুত্বের বাইরে কিছুই নেই আমার। অজান্তেই বিভিন্ন দিক থেকে এই পরিবারটার সাথে বাঁধা পড়ে গেছি আমি আর ঈশিতা।
ফারিহা বাইরেই অপেক্ষা করছিল।
আমাকে দেখে এগিয়ে এল ক্লান্ত পায়ে। প্রায় একমাস দেখা হয় না আমাদের।
ফারিহার সুন্দর মুখটায় ক্লান্তির ছাপ – আর অনেকখানি বেদনা। বাবা ছাড়া ওরও কেউ নেই এই পৃথিবীতে – আমাকে আর ঈশিতাকে গোণার বাইরে রাখলে।
এক মুহূর্ত একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা। তারপর আমার বুকে মাথা রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা।
মুক্তোর মত কয়েক ফোঁটা পানি গড়ায় ওর গাল বেয়ে – ওপর থেকে দেখি আমি।
শক্ত একটা আলিঙ্গনে বাঁধি ওকেও – যেন বোঝাতে চাই আমার কাছে ও সম্পূর্ণ নিরাপদ।
সেই সাথে খোঁচাতে থাকে একটা অক্ষম ক্রোধ।
ফারিহা আমাকে তার সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় পায়নি কাছে।
আস্তে করে ওকে ছেড়ে দিলাম কয়েক মিনিট পর।
‘আমাকে জানাও কি হয়েছিল ঠিক। একেবারে যেভাবে দেখেছ সব ঘটতে।’
ধীরে ধীরে বলতে থাকে ফারিহা।
ওর কথা থেকে জানা যায় – দুপুরে রিজভী আকন্দ হঠাৎ ফিরে আসেন বাইরে থেকে। ফারিহা আর ঈশিতা গল্প করছিল ভেতরে। বাবাকে অসময়ে দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে ওঠে ফারিহা। জানতে চায় দুপুরে খাবে নাকি বাড়িতে, কিন্তু মি. রিজভী জানান সামান্য একটা কাজে এসেছেন। একটা ফাইল নিয়েই বেরিয়ে যাবেন। তারপর যখন বাইরের দিকে রওনা দিয়েছেন, এসময় বাইরে থেকে তিনটা গাড়ি এসে থামে। এবং নেমেই কোন রকম জানান না দিয়ে ফায়ারিং শুরু করে ওরা।
বাইরের সিকিউরিটি গার্ডরা পাল্টা আক্রমণ করেছিল – কিন্তু এরই মাঝে রিজভী আকন্দের পিঠে একটা বুলেট গেঁথে যায়
বাবাকে ‘বাই’ বলে দোতলায় উঠে গেছিল ফারিহা – ওখান থেকেই দেখতে পায় বাবাকে পড়ে যেতে। অবাক বিস্ময়ে ও লক্ষ্য করে একজন মানুষ ছুটে গেছে বাবার পাশে।
ঈশিতা।
ঈশিতাকে দেখেই অ্যাটাকিং প্ল্যান পাল্টে ফেলল আক্রমণকারীরা। সিকিউরিটি গার্ডদের দিকে কাভারিং ফায়ার ছোঁড়ে কয়েকজন – দুইজন এইফাঁকে এসে ঈশিতাকে ধরে সরিয়ে নেয় গাড়ির দিকে। দ্বিগুণ উৎসাহে গুলি ছোঁড়ে সিকিউরিটি গার্ডেরা – তবে ঠেকাতে পারে নি ওদের তবুও।
গাড়িগুলো চলে যেতে রিজভী আকন্দকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায় ওরা।
‘তিনটা গাড়ির সাথে ফাইট করল কি করে তোমাদের সিকিউরিটি গার্ডেরা?’ একটু অবাকই হই আমি।
‘বলেছিলে তো ঈশিতার জীবন নিরাপদ না – সেজন্যই কড়াকড়ি বাড়িয়েছিল বাবা।’ চোখ মোছে ঈশিতা, ‘তবে আমার একটা ব্যাপার খটকা লেগেছে।’
‘কি ব্যাপার?’
‘বাবা কেবলমাত্র একটা ফাইল নিতে বাসায় ফিরবেন কেন? এতটুকু করে দেয়ার জন্য লোকের অভাব নেই।’
‘হুম।’ বলি শুধু।
আরেকটা মটরসাইকেলের শব্দে আমাদের দুইজোড়া চোখ ঘুরে যায় শব্দের উৎসের দিকে।
মিনহাজ।
*
ফারিহার দায়িত্ব মিনহাজকে দিয়ে এসেছি। কাজের কাজ করে এসেছে ছেলেটা।
আরেকজন হেডফাইভের নাম দিতে পেরেছে আমাকে।
প্রথম দুইজন হেডফাইভের মৃত্যুর পর এত অল্প সময়ে আরেকজন হেডফাইভকে পাওয়া যাবে বলে ভাবিনি।
ছুটে যাচ্ছি শ্যাওড়াপাড়ার দিকে।
সাদা রঙের একটা বাড়ি। মিনহাজ জানিয়েছে সিকিউরিটি থাকতে পারে কিছু।
সাবধানে বিল্ডিংটাতে ঢুকতে গিয়ে কারও সাথে ধাক্কা খেলাম।
ক্যাপ বাঁকা হয়ে গেল ছেলেটার।
‘সরি।’ জানালাম ছেলেটাকে। বয়সে আমার চেয়ে ছোটই হবে দুই একবছর। চেনা চেনা চেহারা।
‘ইটস ওকে ব্রাদার। ফিফটি পারসেন্ট ফল্ট ওয়াজ মাইন।’ একটু হেসে বলে বেড়িয়ে যায় ছেলেটা।
ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করি। হেডফাইভ মিলনকে পাওয়া যাবে তিনতলায়।
সিঁড়ি বেয়ে তিনতলাতে পৌঁছতেই ঘাড়ের পেছনের চুল দাঁড়িয়ে যেতে থাকে আমার। তিনতলার দরজার নিচ থেকে রক্ত গুড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে বাইরে।
চট করে গ্লকটা বের করে ধাক্কা দেই দরজাটায় – আস্তে করে খুলে যায় পুরোটা।
ভেতরের দৃশ্য গা গুলানোর মতই – ঝাঁঝরা হয়ে গেছে অপরপাশের দেওয়াল। তারমাঝেই ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সাতটা লাশ। তাদের মাঝে কালো সানগ্লাসের পাশে পড়ে থাকা মানুষটাই হেডফাইভ মিলন।
সানগ্লাস ছাড়া কোথাও যায় না মিলন। দরজার ঠিক সামনের লাশটা থেকে রক্ত গড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে পড়ছে এখন।
গ্লকের গ্রিপে শক্ত করে আঙ্গুল চেপে বসে আমার। রাবেকের পেছনে কোন ট্রেইলই পাওয়া যাচ্ছে না!
তৃতীয় হেডফাইভকেও মৃত দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে!
বুঝতে পারছি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে গুলি চালিয়েছে কেউ সাবমেশিনগান দিয়ে।
না – ধারণাটা পাল্টাতে বাধ্য হলাম। দুইহাতে দুটো অটোমেটিক পিস্তল দিয়ে গুলি করেছে আততায়ী এক্ষেত্রে। দেওয়ালের ক্ষতগুলো সেটাই বলছে।
একটু আগে ধাক্কা খাওয়া ছেলেটাকে কোথায় দেখেছি চট করে মনে পড়ে যায় আমার হঠাৎ। পিস্তল উদ্যত রেখেই চট করে ঘুরি যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে।
সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা।
একই সাথে একে অন্যের দিকে অস্ত্র তাক করি আমরা।
সময় যেন থমকে যায় আমাদের ঘিরে।


‘রাবেকের হেডফাইভদের মেরে ফেলছ তুমি। কেন?’ পিস্তল একচুল না সরিয়ে জানতে চাই আমি।
‘বাহ! তোমার তাই ধারণা?’ তিক্ত কন্ঠে বলে ছেলেটা।
‘ধারণা না করার কোন কারণ আছে কি? হেডফাইভ আখতার যেখানে মারা যায় তার পাশের বিল্ডিংয়ে সেই সময়েই দেখি আমি। লিফটে ঢুকে যাচ্ছিলে একটা মেয়ের সাথে। আসলে বোমা ডিটোনেট করার জন্য পাশের বিল্ডিংয়েই আশ্রয় নিয়েছিলে, তাই না? রেঞ্জের বাইরে যেতে চাওনি।’
‘একই কথা আমি তোমার ব্যাপারেও বলতে পারি, হুয়েভার ইউ আর! সেদিন একই বিল্ডিংয়ে দেখার পর আজ হেডফাইভ মিলনের মৃত্যুর পরও একই বিল্ডিংয়ে তোমার সাথে আমার দেখা হবে কেন?’
একমুহূর্ত চুপ হয়ে যাই দুইজনেই।
হঠাৎ ব্যাপারটা চোখে পড়ে আমার। বিস্ময়ের একটা ধাক্কা খাই ভেতরে ভেতরে।
‘তুমি হেডফাইভ আখতার। হেডফাইভদের তুমি মেরে বেড়াচ্ছ না।’ হাত নামাই আমি। আখতারের দিকে অস্ত্র তাক করে রাখার কোন মানে হয় না।
‘হেডফাইভদের ওপর হিটগুলো তোমার নেওয়া নয় – যদিও এখন বুঝতে পারছি তুমি কে হতে পার। দ্যা ফ্যান্টম বয়। ইরফান। অন্য সময় হলে তোমাকে এইমুহূর্তে গুলি করতাম। তবে এখন পরিস্থিতি আলাদা।’ একই সাথে সিদ্ধান্তে পৌঁছে আখতার। হাতের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনের নাইন মিলিমিটারটা নামায় সেও। আবার নিস্তব্ধতা নেমে আসে সিঁড়িঘরে।
‘আমাদের কথা বলা দরকার।’ নিস্তব্ধতা ভাঙ্গি আমি নিজেই।
‘নিরাপদ একটা জায়গা প্রয়োজন।’ গাল চুলকাতে চুলকাতে পিস্তলটা হোলস্টারে রাখল আখতার।
‘জিয়া উদ্যান। এতটা নিরাপত্তা আশেপাশে আর কোথাও পাবে না। পিস্তলটা বেশ ভালো করে লুকিয়ে রাখো হে – এলাকা পুলিশে গিজ গিজ করে। ধরা পড়লে জবাব নেই। লেটস গো।’
নামতে থাকি আবার আমরা।
*
‘অবস্থা এমন হয়েছে – নিজেদের কাহিনী বলে ফেলাটাই মনে হচ্ছে একমাত্র চয়েজ।’ মুখ খুললাম পানির পাশে বসে। সতর্ক চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। রাবেককে কোন বিশ্বাস নেই।
ধীরে ধীরে গত কয়েকদিনের কথা খুলে বলি আমি রাবেকের একজন ‘মৃত’ হেডফাইভকে। চুপচাপ সব শোনে আখতার।
‘অনেকগুলো ব্যাপার স্পষ্ট হল।’ এতটুকুই বলে শুধু।
তারপর সিগারেট ধরায় একটা।
অযথাই কাশি দেয় দুইবার।
বুঝতে পারি, সারাজীবন গোপনীয়তার মধ্যে থেকে অভ্যস্ত ‘রাবেকীয়’ মাফিয়ার কনিষ্ঠতম হেডফাইভ জীবনের প্রথমবার গোপনীয়তার খোলস ভেঙ্গে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। একটু অপ্রস্তুত হবে এমনটিই স্বাভাবিক। তাকে আমি সময় নিতে দিলাম।
কয়েক মিনিট উশখুশ করে শুরু করলো সে, ‘আমাদের হেডফাইভদের লোকেশন কম্প্রোমাইজড হয়ে গেছে – এই খবরটা আমার ওপর হিট নেয়ার আগেরদিন জানানো হয় আমাকে। খবরটা দিলো তিন্নি, বহুদিন ধরে একসাথে কাজ করছি আমরা। অন্য কেউ হলে খুব একটা পাত্তা দিতাম না।’ অযথাই জোরসে সিগারেটে কয়েকবার টান দিল আখতার, ‘ওর কথাতে বিশ্বাস করতে পারিনি। তবে একেবারে উড়িয়ে দিতেও পারিনি। ডন রাবেক নিরাপদে থাকেন কারণ ওকে আমরা নিরাপদে রাখি। আর এই একটা কথার গুরুত্ব বুঝতে পারছ তো?’ আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চায় আখতার।
‘হুম। তোমাদের নিরাপত্তার কথাই রাবেক সবার আগে ভাববে। যেহেতু তোমাদের কাওকে চিনে ফেললে অ্যানিহাউ ব্রেক করে ছাড়বে শত্রুপক্ষ।’
মাথা দোলায় আখতার, ‘রাইট। কিন্তু আমাদের লোকেশন কিভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে তাহলে? মধ্যরাত পর্যন্ত তবুও দলের অনেকের সাথে কথা বললাম। দেখার চেষ্টা করলাম কোন লীক আছে কি না। তেমন মনে হলো না। ইনফর্মার মেয়েটার কথা ভুল ধরেই নিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন মনে হল কাছ থেকে ব্যাপারটা টেস্ট করে দেখা যেতে পারে। একই সাথে দুটো বিল্ডিং নিলাম। অফিসকে জানালাম একটি বাসার ঠিকানা। আমাদের ব্যাপারগুলো সরাসরি ডন রাবেকই হ্যান্ডেল করেন। যাই হোক – পাশের বিল্ডিংয়ে অপেক্ষা করতে করতে অর্গানাইজেশনের কিছু কাজ সেরে ফেললাম আমি আর তিন্নি। তারপর সেখান থেকে বের হতে গিয়ে দেখলাম লিফট থেকে তোমাকে বের হতে – যদিও তখন সন্দেহ করিনি কিছু।’
একটু হাসল দুইজনই। আবার বলতে শুরু করে আখতার, ‘আধঘন্টার মাঝে গাড়িগুলো এসে একেবারে সাফ করে ফেলল আমার লোকেদের! বোমাটা আগেই পেতে রেখেছিলাম – এরকম সিচুয়েশন দেখা দিলে নিজের মৃত্যুটা সাজানোর জন্য। সময় হতেই ফাটিয়ে দিলাম পাশের বাসার গ্যারাজে দাঁড়িয়ে।’
‘আরেকটু হলে আমাকে সহই ফাটিয়ে দিয়েছিলে!’ গোঁ গোঁ করে বলি আমি।
‘সরি।’ আখতারের হাসির মাঝে অবশ্য দুঃখের কোন লক্ষণ দেখা যায় না – একঝিলিক কৌতুক উঁকি দেয় শুধু। ‘যাই হোক – এরপরদিনই শুনলাম হেডফাইভ ইয়াসিরের মৃত্যু। অ্যামবুশ। গানফাইট। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলালাম তখনই। তিন্নি যখন সাবধান করেছিল, তখন ভেবেছিলাম তোমার ব্যাপারে। রাবেকের সাথে তোমার চুলকানির কারণটা হেডফাইভেরা জানে। কিন্তু ঘটনা দুটোর পর বুঝলাম কাজটা তোমার না। একা চল তুমি। তিন বহর গাড়ি নিয়ে হামলা দেয়াটা ঠিক তোমার সাথে যায় না।’
‘আর আজকের ব্যাপারটা?’ আবার প্রসঙ্গে ফিরে আসি আমি।
‘যাদের সাথে এখনো ভালো সম্পর্ক আছে এমন মানুষজনের সাথে দেখা করলাম। হেডফাইভ মিলনের ঠিকানাটা জোগাড় করে এসেছিলাম তার সাথে দেখা করতে। এসে দেখলাম কাজ হয়ে গেছে।’
মাথা নামায় আখতার। আবার তুলল মিনিট দুই পর। সিগারেটটা সামনের পানিতে ফেলে দেয় ছুঁড়ে।
‘কিভাবে বুঝলে?’ বিশেষ কিছুর প্রতি ইঙ্গিত না করলেও কিসের কথা জানতে চাইছে বুঝতে পারি আমি।
‘ভেতরের তান্ডবটা মেশিন পিস্তল দিয়ে ঘটানো হয়েছে। তোমার হাতে ছিল একটা এস অ্যান্ড ডব্লিউ। তাহলে – খুনগুলোর সাথে তুমি জড়িত না। অথচ, আখতারের বাসার পাশে তোমাকেই দেখেছি। যার অর্থ একটাই হতে পারে – আখতার তুমি নিজেই।’
একটু হাসল আখতার।
‘থার্ড পার্টির ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।’ মাথা নাড়ে আখতার। ‘কে জানবে আমাদের ব্যাপারে?’
‘ডন রাবেক।’ জানিয়ে দিলাম ওকে আমার ধারণা।
‘নেভার।’ তীব্র আপত্তি জানায় আখতার, ‘ডন রাবেকের নিরাপত্তা আমরাই নিশ্চিত করি। আমাদের ছাড়া অর্গানাইজেশন চলবে কি করে?’
‘হয়ত তোমাদের অজান্তেই আরও পাঁচজনকে প্রস্তুত করে ফেলেছে ও। যারা রাবেকের লোকেশনও জানবে না। রাবেক ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব না একে একে সব হেডফাইভের ব্যাপারে জানার। বাই দ্যা ওয়ে – তুমি কি রাবেকের লোকেশন জানো?’
আইডিয়াটা কিছুটা হলেও ধরল আখতারকে এবার।
‘না। শেষ বার আমি আপডেট দেয়ার পর রাবেক নিজের লোকেশন নিয়ে কিছু বলেনি। হেডফাইভকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়াটা রাবেকের প্ল্যান হলেও হতে পারে। কিন্তু সেখানে উদ্দেশ্যটা কি?’
‘খুবই সাধারণ। হেডফাইভের সাথে ডন রাবেকের একটামাত্র প্রশ্নেই অবিশ্বাস। ডন রাবেক এখন কিংবা আগে এই পদ্ধতিতে অর্গানাইজেশন চালিয়ে নিরাপদ থাকতে পারে – কিন্তু আমার স্কিলের ব্যাপারে রাবেকের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আর আমি হয়তো খুঁজে বের করে ফেলতে পারি হেডফাইভদের – এবং সেখান থেকে রাবেককে। কাজেই তার একমাত্র উইকপয়েন্ট ছিলে তোমরা। হেডফাইভস। নতুন কোন পদ্ধতি অর্গানাইজেশন চালানোর কথা হয়ত রাবেক ভেবেছিল – কিন্তু সেটা তোমাদের সরিয়ে দেয়ার পরই বাস্তবায়ন করা হত হয়ত।’
আমার কথাতে আখতার কিছুটা প্রভাবিত হল বলেই মনে হয়।
‘যাই হোক – আমাদের তিনজন হেডফাইভের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে। আর দুজনের সাথে দেখা করাটা জরুরী।’ উঠে দাঁড়ায় আখতার।
ওকে স্তব্ধ করে দেই আমি একটামাত্র বাক্য উচ্চারণ করে, ‘তিন নয়, আখতার। চারজন।’
আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আখতার।
‘আমার সাথে আসতে পারো। একজন পুরোনো সহকর্মীর সাথে দেখা করবে।’


টর্পেডোর মত ফ্রন্ট বাম্পারের ধাক্কায় গেইট উড়িয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে গাড়িটা – তবে থামে না।
স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে কালো সানগ্লাসে চমৎকার লাগছে আখতারকে।
চলন্ত অবস্থাতেই একহাত স্টিয়ারিংয়ে রেখে অন্যহাতে ধরে থাকা ক্যালিকো এম-নাইনসিক্সটিটা থেকে ফুলঝুরির মত গুলি বর্ষণ শুরু করে ও।
বিশাল বাগান বাড়িটা স্থানে স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সিকিউরিটি গার্ডেরা অতর্কিত হামলায় চমকে উঠলেও খুব দ্রুতই সামলে নিতে থাকে। অর্ধেক গার্ড এতক্ষণে শুয়ে পড়েছে অবশ্য প্রাণহীন দেহে। কিন্তু বাকিরা দ্রুত কাভার নেয়ার চেষ্টা করল।
বিশাল একটা চক্কর দিয়ে আবার ফিরে আসতে থাকে আখতার গাড়ি নিয়ে – এর মধ্যে রিলোড করে ফেলেছে।
বাড়িটার ছাদের একটা মূর্তিকে দেখা যায় – হাতে বাজুকা নিয়ে আখতারকে টার্গেট করার চেষ্টা করছে। কারবাইনটাকে সিঙ্গেল শটে নিয়ে একটা মাত্র গুলি খরচ করলাম ওদিকে।
প্রাচীরে গা ঢাকা দিয়ে এতক্ষণ অবস্থা যাচাই করছিলাম।
আখতার দারুণ দেখাচ্ছে। আরেকটু কমে আসলেই ভেতরে ঢুকে যাব আমরা।
বেড়ার ওপর থেকেই একের পর এক গুলি চালিয়ে রাবেকের সৈন্যদের বেড়া পার করতে থাকি আমরা।
‘ডান। চল ঢোকা যাক।’ আখতারের কন্ঠ স্পষ্ট শুনতে পাই রেডিওতে। ওপর থেকে নেমে আসলাম।
ক্লোজ রেঞ্জে আমার কারবাইন কোন কাজে আসবে না। আখতারের গাড়িতে অস্ত্রটা রেখে গ্লকটাই বের করলাম।
নাঈমকে ধন্যবাদ; এত অল্প সময়ের নোটিশে আমাদের চাওয়া প্রতিটি অস্ত্র ম্যানেজ করে দিয়েছে। অবশ্য চোরাকারবারীর অস্ত্র ব্যবসায় নাঈমের সমকক্ষ কেউ নেই বাংলাদেশে।
সিংহদরজাটার দুই কবাটে ধাক্কা দিই আমরা দুইজন। তবে ধাক্কা দিয়েই ঢুকে পড়লাম না, বরং সরে গেলাম দুইপাশে।
এখন ভেতর থেকে প্রাণের সুখ মিটিয়ে গুলি চালাচ্ছে রাবেক বাহিনীর অবশিষ্টাংশ।
কান পেতে কিছুক্ষণ গুলির ধরণ আর প্রকৃতি বুঝার চেষ্টা করি। তারপর দরজার এপাশের প্রান্ত থেকে আখতারকে ইঙ্গিতে দেখাই, ‘তিন’।
মাথা ঝাঁকাল আখতার।
ভেতরের শব্দ থেমে গেছে। প্রথমে দরজা খোলার সাথে সাথেই ইন্সট্যান্ট রিঅ্যাকশন দেখিয়ে ফেলেছিল, এরপর বুঝে শুনে গুলি চালাবে ওরা। কয়েকটা মুহূর্ত ভাবলাম, একটা গেম-প্ল্যান প্রয়োজন। একসাথে তো আর তিনজনকে সামলানো সম্ভব নয়!
বুঝতে পারলাম কী করতে হবে। গুলির শব্দ কোন দিক থেকে এসেছিল তা মনে করলাম আরেকবার, আশা করি আমার ধারণা সঠিক। বিশাল দরজাটার তিনদিকে তিনজন বসে আছে। মানে অ্যাংগেল বানিয়ে নিলে একবারে একজন করে পাওয়া সম্ভব। সামান্য সরালাম আমার চোখ। আস্তে আস্তে শূন্য ডিগ্রী অ্যাংগেল থেকে এক দুই তিন – চার ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে যেতেই একজন মানুষের অংশবিশেষ দেখতে পেলাম। বাম হাতে গ্লকটা তুলে শুধু হাত লম্বা করে ওদিকে দুটো গুলি পাঠিয়ে দিতেই ভেতর থেকে কাতর আর্তনাদ ভেসে আসল।
আমার পদ্ধতি ফলো করে আরেকজনকে ফেলে দিয়েছে আখতার ক্যালিকোর বর্ষণে।
এবার আখতারকে সংকেত দিয়ে দুইজনই গড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে একযোগে গুলি চালাই তৃতীয় ডিফেন্ডারের ওপর, গুলির ধাক্কায় মাটি ছেড়ে উঠে গেল মানুষটার পা। এই শরীরটা আছড়ে পড়তেই চারপাশটা চুপচাপ হয়ে যায়।
তারপরই তালির শব্দ।
দোতলায় উঠে গেছে ডুপ্লেক্স বাড়িটার সিঁড়িটা। দুই হাতে হাত তালি দিতে দিতে সেখানে দাঁড়ায় একজন মানুষ।
রাফসান বেগ কবীর ওরফে রাবেক!
ডন রাবেক।
*
আখতার আর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম হাসপাতালে। জিয়া উদ্যান থেকে চলে এসেছি সরাসরি এখানে।
ফারিহা আমাকে একবার জড়িয়ে ধরল শুধু।
ওর কাছে রিজভী আকন্দের শরীরের অবস্থা জেনে নেই। জ্ঞান ফিরেছিল উনার। এখন আবার ঘুমাচ্ছেন।
তবে ডাক্তার বলেছে প্রাণের ভয় আর নেই। তবে তাঁকে নড়াবারও জো নেই। দুর্বল শরীর, রক্তক্ষরণ কম হয়নি। বয়েসটাও তো দেখতে হবে! এখনও নাকি আরেকব্যাগ রক্ত দিতে হবে অন্তত। আর এখানে দুই সপ্তাহ চেক-আপের মধ্যে থেকে বাড়ি ফিরেও যেতে পারবেন।
‘ফারিহা?’ ইতস্তত করে বলেই ফেললাম, ‘একটু বাইরে অপেক্ষা করবে?’
ফারিহা কোন প্রশ্ন না করেই বাইরে চলে গেল। মেয়েটার এই গুণটা আমাকে আকৃষ্ট করে। অহেতুক প্রশ্নের মধ্যে সে নেই। ঘটনার গভীরতা এবং তাৎপর্য বোঝে।
ফারিহা বের হতেই চোখ মেললেন ‘মৃত-প্রায়’ এবং ‘ঘুমন্ত’ মি. রিজভী, ‘থ্যাংকস আ লট, রবিন। মেয়ের সামনে জীবনে মুখ দেখাতে পারতাম না আমি। বাবা হিসেবে আমাকে অনেক উঁচুতে স্থান দেয় মেয়েটা।’
‘একজন হেডফাইভ হতে পারেন কিন্তু মানুষ হিসেবে আপনি আসলেই অসাধারণ , স্যার।’
না বলে পারলাম না আমি, মানুষটা কথা রাখতে জানেন। ‘রাবেকীয়’ মাফিয়ার একেবারে উচ্চপর্যায়ের মানুষ হয়েও ঈশিতাকে সত্যিকার অর্থেই প্রটেকশন দিয়েছিলেন তিনি এতদিন। আমার ব্যাপারে জানার পরও আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মেয়ের প্রতি অপার স্নেহও এর একটা কারণ হতে পারে!
‘আপনারা দুইজনই শেষ হেডফাইভস।’ আবার বলি আমি, ‘রাবেকের প্ল্যান ছিল আপনাদের সরিয়ে ফেলার। ঠিক যেমন আমার প্ল্যান ছিল আপনাদের কাওকে ব্রেক করে রাবেকের লোকেশন জানার। লোকটার মাথা ভয়ানক চালু। আমার প্ল্যান গেস করে আগেই অ্যান্টি-প্ল্যন করে ফেলেছে!’
রাবেকের প্রশংসা বাধ্য হয়েই করতে হল আমাকে এখানে।
‘আখতার বেঁচে গেলে কিভাবে? সবাই তোমার মৃত্যুর খবর জেনেছি। একদিন শোকও পালন করা হয়েছে তোমার জন্য।’ বিস্ময় চেপে শুধু জানতে চান মি. রিজভী।
‘বিশাল ইতিহাস, মি. রিজভী।’ এড়িয়ে যায় আখতার প্রশ্নটা, ‘ডন রাবেক আমাদের সরিয়ে দিতে চাইছে। এবার আমাদের প্ল্যান কি হওয়া উচিত?’
‘কাজটা রাবেকের সেটা আমার ওপর অ্যাটাক হওয়ার পরই বুঝতে পেরেছিলাম।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন রিজভী, ‘আর পঞ্চম হেডফাইভের কি হল?’
‘আমাদের ধারণা পঞ্চম হেডফাইভ রাবেক নিজেই।’ জানালাম আমি, ‘কারণ আপনারা চারজন একে অন্যকে চিনলেও পঞ্চম হেডফাইভকে কেউ চেনেন না। রাবেক না হয়ে যায় না সেটা। এখন রাবেকের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিতে চান বলুন।’
আমরা দুইজনই তাকিয়ে থাকলাম দূরদর্শী মানুষটার দিকে।
‘অ্যাটাক অ্যান্ড ডেস্ট্রয় হিম। এরকম একটা ঘটনার পর একটা ফ্যামিলিতে আর বিশ্বাসের জায়গা থাকতে পারে না।’
‘আমারও একই মত, মি. রিজভী।’ বলল আখতার।
বাইরে বেরিয়ে ফারিহার কাছ থেকে বিদায় নিলাম আমি, ‘ঈশিতাকে নিয়েই ফিরব আমি।’
কথা দিলাম ওকে।
চলে আসার সময় ওর বড় বড় চোখদুটোতে কিছু একটা দেখতে পাই আমি। ভালোবাসা?
*
হাত তালি থেমে গেল রাবেকের।
লোকটার সাহস দেখে অবাক হলাম আমি। কোন ভয় নেই এর জীবনের।
মাত্র পঞ্চাশ ফিট দূরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি – তাও কী সাবলীলভাবেই না কথা বলা শুরু করে রাবেক!
‘কংগ্র্যাচুলেশন্স! এই পর্যন্ত আসতে পেরেছ। তোমাদের মনে থাকবে আমার। যেটুকু জানার জন্য এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছি – আমাকে বার বার খুঁজে পাচ্ছ কিভাবে , রবিন? হাজার ভেবেও ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি।’
‘মায়ের রক্ত লেগে আছে আপনার হাতে। খুঁজে না পেয়ে উপায় আছে? একটা অস্ত্র তুলে নিন হাতে, রাবেক।’ হুংকার ছাড়ি আমি।
রাবেককে খুন করে ফেলার জন্য সামান্য একটা ছুতোই দরকার আমার।
‘সেই আশা পূর্ণ হবে না তোমার, রবিন। আমাদের মাঝে কেউ মারা গেলে সেটা তুমিই হতে যাচ্ছ। ঈশিতাকে বের করে ফেল কিভাবে বার বার – এই কৌতূহল মেটাবার সম্ভাবনা নেই সেটা জানা ছিল আমার। তবুও দেখা করার জন্য একটু থামলাম। দেখাসাক্ষাৎ আমাদের সম্প্রীতি বাড়িয়ে তোলে, রবিন। আফটার অল, আমি তোমার বাবা। দেখা হল – কাজেই …’
দুই আঙ্গুলে টাটা দেখিয়ে সিঁড়ির মাথা থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় রাবেক।
একই সাথে বাড়িটা হাল্কা কেঁপে – বাইরের শব্দটাও অতি পরিচিত আখতার বা আমার।
দৌড়ে ওপরে উঠতে থাকি আমরা।
ছাদের দরজাটা খোলা। সেদিক দিয়ে ঢুকতেই মাত্রই উঠে যেতে দেখা গেল কুটিল গডফাদারকে।
অপেক্ষমাণ হেলিকপ্টারটা তার রোটর ঘোরাচ্ছে পূর্ণগতিতে। সেটা নয় – ভেতরে বসে থাকা ঈশিতাকে দেখে হৃৎপিন্ডটা গলার কাছে উঠে আসতে চায় আমার।
একই সাথে আমাকে দেখলো ঈশিতা – ওর বিষন্ন মুখে একটা হাসির রেখা এতদূর থেকেও দেখতে পাই আমি।
একপাশে বসে থাকা মেশিনগানার তার মেশিনগানের নল আমাদের দিকে ঘোরাতে শুরু করেছে ততক্ষণে।
হেলিকপ্টারটা ছাদের সারফেস থেকে উঠতে শুরু করে – একবুক আশা নিয়ে দেখলাম মেয়েটা আচমকা লাফ দিয়েছে! ছাদের ওপর পড়লো ঈশিতা, উচ্চতা একেবারে কম ছিল না, উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার পড়ে গেল। একঝটকায় গ্লকটা বের করে ম্যাগাজিনের তেরটা গুলির প্রতিটি পাঠালাম কপ্টারের দিকে। রাবেককে থামাতে হবে।
আখতারের হাতের ক্যালিকো সাবমেশিনগানটাও গর্জে ওঠে আরেকবার – একই সাথে ফুলকি দেখা যায় কপ্টারের মেশিনগানের নলের সামনে।
ডাইভ দিয়ে ভেতরে চলে আসি আমি।
ঈশিতার কাছে ছুটে যাওয়ার জন্য ভেতরটা আকুলিবিকুলি করছিল, তবুও মাথাটা নামিয়ে রাখতে হলো। বাইরের তান্ডবের শব্দ থামার বিরাম নেই।
অবশেষে থামলো গুলির শব্দ। রোটরের শব্দ দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। ছুটে বের হয়ে এলাম ছাদে।
শুয়ে আছে আখতার। নিষ্প্রাণ দুই চোখে শূন্যতা।
প্রয়োজন ছিল না – তবুও পালস চেক করলাম। নেই।
দূরে ছাদের মাঝে বসে আছে ঈশিতা। চারপাশে পড়ে আছে মেশিনগান শেল।
ওকে গিয়ে ধরি আমি, ‘ঠিক আছিস?’
কিছু না বলে আমার কাঁধে মুখ লুকোয় ঈশিতা। একদিনে যথেষ্ট হয়েছে ওর জন্য।

পরিশিষ্ট
‘রবিন?’
পেছন থেকে রিজভী আকন্দের গলা শুনে ফিরে তাকালাম।
ধীরে ধীরে হাঁটতে পারেন এখন তিনি। এগিয়ে গিয়ে তাঁকে সাহায্য করলাম রেলিংয়ের কাছে আসতে।
ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। চাঁদ দেখছিলাম একাকী। আবারও ফিরে এসেছি রিজভী সাহেবের বাড়িতে।
‘আমি সত্যিই দুঃখিত। কিন্তু আমারও কালো অতীত আছে একটা। জানোই তো – সবারই থাকে।’ ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বলেন রিজভী আকন্দ।
‘আপনার নীতিতে আপনি ঠিক ছিলেন – এটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট, স্যার।’ আর কথা বাড়াতে দেই না উনাকে।
‘ফারিহা আর ঈশিতা ঘুমাচ্ছে।’ জানালেন তিনি।
‘এখান থেকে আগামীকালই সরিয়ে নেব ওদের। আপনাকেও, স্যার। রাবেকের কাছ থেকে এখন কেউ নিরাপদ না।’
একয়দিন আমি এখান থেকে নড়িনি। অন্য কারও ওপর ওদের নিরাপত্তার ভার দিয়ে আর নিশ্চিত হতে পারছি না।
দুইজনই কিছুক্ষণ চুপ করে রাতের কালো আকাশ দেখি।
‘ইয়াসির তোমাকে পেয়েও মেরে ফেলার অর্ডার কেন পেল না রাবেকের কাছ থেকে – ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।’ হঠাৎ বলেন মি. রিজভী।
‘রাবেক চেয়েছিল একঢিলে দুই পাখি মারতে, স্যার। ইয়াসির আর আমি এক গাড়িতে ছিলাম তা জানা ছিল ওর।’
‘কিভাবে বুঝলে আমিও একজন হেডফাইভ?’ জানতে চাইলেন অবশেষে প্রশ্নটা।
‘ফারিহার বর্ণনা স্যার। তখনও অ্যাটাকটাকে থার্ড পার্টির বলে মনে করছিলাম। কিন্তু আপনাকে দেখা মাত্র শূট করা আর ঈশিতাকে দেখে আক্রমণের ধরণ পাল্টে ওকে সাথে করে নিয়ে যাওয়ায় বিষয়টা খটকা লাগে আমার। নিশ্চিত হই ওটা রাবেকের কাজ।’
‘কিন্তু তোমার তো ভাবার কথা ছিল ঈশিতার জন্যই এসেছে রাবেকের লোকেরা। আমাকে হেডফাইভ কেন ভাবলে?’
‘আপনার রুটিন পাল্টে যাওয়াতে। নিজেই ফাইল নিতে চলে এসেছেন দেখে অবাক হয় ফারিহা। তখনই সন্দেহটা হল। নিশ্চয় রাবেক নিজেই বলেছিল আপনাকে ওটা আনতে? এমন কিছু যা আনতে হলে আপনাকেই বেরুতে হবে। কর্মচারী দিয়ে আনা যাবে না। খুব গোপনীয় কিছু, যা থাকতে পারে একজন হেডফাইভের বেডরুমের লকারে। যাতে আপনার লোকেশনটা জানাতে পারে ও তার কিলারদের?’
‘হুঁ। চীপ বাস্টার্ড।’ রেইলিংয়ে থাবা দেন রিজভী আকন্দ।
তারার আলোতে দাঁড়িয়ে থাকি দুইজন মানুষ – মতাদর্শের পার্থক্য থাকলেও নীতিগত দিক থেকে যাদের চিন্তা ভাবনা একরকম।
জীবনটাকে হঠাৎই বড় অদ্ভুত বলে মনে হতে থাকে আমার!

আমি ইরফান


অফিস থেকে বের হতেই অসংগতিটা ধরা পড়ল।
ঢোকার সময় চারপাশে নজর বুলিয়ে ঢোকা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আমার।
মোড়ের একমাত্র চায়ের দোকানটায় একটা মুখ দ্বিতীয়বার দেখলাম। যখন ঢুকি তখনও ভর্তি ছিল দোকানটা। সবগুলো মুখের দিকে একবার নজর দিয়ে ভেতরে চলে গিয়েছিলাম। এখন বের হয়েও তখনকার একজন মানুষকে দেখলাম বসে থাকতে। টাকমাথা – পেটানো স্বাস্থ্যের সাথে অভিব্যক্তহীন মুখ। ধরণটা অনেকটা পেশাদার খুনীদের মত।
আমার ওপর নজর রাখছে?
অর জাস্ট হ্যাপেনড টু বি দেয়ার?
নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। তবে সতর্কতার মাত্রা বাড়ালাম।
ধীরে ধীরে মেইন রোডের দিকে এগুচ্ছি। বাম হাতে অবিচলভাবে ধরে রাখা স্যুটকেসটা হাঁটার তালে অল্প অল্প দুলছে। ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি কাছেই। আমি আর ঈশিতা – দুইজন মানুষ।
ভালোই চলে যায়।
বাসে উঠে পড়লে পাঁচ মিনিটে পৌঁছে যাব।
চাকরীটাও ছোট্ট। তবে বেআইনী কিছু নয়। ওই পথ থেকে সরে এসেছি প্রায় একবছর হয়ে গেল।
ফারিহার সাথে তখন থেকেই পরিচয়। ওকে কিডন্যাপ করার কথা ছিল আমার। ওই কেসে প্রাণবিপন্ন হয় ঈশিতার। শেষ মুহূর্তে কোনভাবে ঈশিতাকে ওখান থেকে উদ্ধার করার পরই সিদ্ধান্ত নেই – এই পথে আর না। আমার এই জীবন যে কেবল আমার নয়, ঈশিতার জীবনকেও দুর্বিপাকে ফেলতে পারে তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
তবে আজকের এই অসঙ্গতিটা চোখে আটকে চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার অতীত থেকে ফিরে আসা কেউ কি এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে? মেইন রোডে উঠতে উঠতে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করলাম। মিরর অ্যাপটা চালিয়ে দুইসেকেন্ডের জন্য পেছনটা দেখে নেই।
পেছনে লেগে আছে টাকু।
কোন কিছু খেয়াল করিনি এভাবেই রাস্তায় দাঁড়ালাম। যেন বাস আসলেই উঠে যাব।
পেছনের টাকমাথা কিছুটা দ্বিধায় ভুগছে, এখন দাঁড়ালে আমার সন্দেহ জাগবে। আর আমাকে পার করে হেঁটে গেলে আমি বাসে উঠে ভ্যানিস হয়ে যাব।
ওর দোটানা বুঝে মনে মনে হাসলাম।
বাস এল।
উঠে পড়তেই আস্তে করে ছেড়ে দেয় বাস।
চলন্ত বাসটার সাথে পাল্লা দিয়ে দৌঁড়ে কোনমতে বাস ধরে টাকমাথাও।
‘কাঁঠালের আঠা’টাকে খসানোর প্ল্যান আমারও আপাতত নেই। একে ঠেসে ধরতে হবে সুবিধেজনক কোন স্থানে।
আমার বাসা যেখানে সেখানে নামলাম না আমি। অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায় টাকুর চেহারায়, পাকা খবর নিয়েই এসেছে তাহলে। বাসের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
আরও পাঁচমিনিট পর টাকুকে পাশ কাটিয়ে নেমে পড়লাম।
টাকমাথা নামে না।
ধীরে সুস্থে উলটো দিকে হাঁটছি।
যেদিকে আমার বাসা।
মিরর দিয়ে আরেকবার বাসটাকে দেখলাম।
আবারও থেমে গেছে ওটা আমার চল্লিশ ফিট পেছনে। হন্তদন্ত হয়ে লাফিয়ে পড়ে টাকু আবারও।
আবার আমার দিকে ধীরে ধীরে এগোয়।
প্রেম এরকমই হওয়া উচিত- মনে মনে না ভেবে পারলাম না।
যত যাই হোক ছুটানো যাবে না একে। পুরোদস্তুর সুপার-গ্লু!
স্যুটকেসটা হাতবদল করে নিয়ে গলিতে ঢুকে পড়লাম এবার আমি।
বামদিকের টিনশেড বাসাটার বাইরের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। এরকম বাসাগুলোতে বেশ কয়েকটা পরিবার থাকে। বাইরের দরজা এজন্য সবসময়ই থাকে খোলা। দরজার একচিলতে ফাঁক দিয়ে পরিস্থিতি দেখি আমি। দুই মিনিট পরই কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া গেল।
বড় বড় দম ফেলতে ফেলতে টাকমাথা বুলেটের মত ঢুকে পড়ল গলিতে।
জোর পা চালাচ্ছে গলি ধরে সামনের দিকে। গলিতে আমাকে না পেয়ে শেষমাথায় গিয়ে দেখতে চায় নিশ্চয়!
দরজা খুলে আস্তে করে বেরিয়ে আসি আবার।
তবে এবার আমিই ওর পেছনে!
ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস নিতে থাকা আমার ‘অন্ধভক্তের’ টাকমাথায় স্যুটকেসটা সবেগে নামিয়ে আনতেই গুঙ্গিয়ে উঠে ফিরে তাকায় লোকটা। অনায়াসে বাম হাতের এক আপার কাটে নাকের ব্রীজ ভেঙ্গে দিলাম।
বহুদিন এসব কাজে নামা হয় না বলে খুব যুতসই হল না আঘাত।
আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখ বরাবর মুষ্ঠিবদ্ধ হাতটা চালায় টেকো।
দ্রুতমাথা নামিয়ে আঘাতটা এড়িয়েই টেকোর অরক্ষিত বুকটায় দ্রুতবেগে কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দেই।
বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়েছে যেন! দু’পা পিছিয়ে যায় পিছু নেওয়া মানুষটা।
বিপুল উদ্দমে আবারও ছুটে এল। তার উৎসাহ দেখবার মত! বাতাস কেটে শরীর ঘুরিয়ে নেই আমি, সেই সাথে বিশেষভঙ্গীতে কনুই ভাঁজ করে ফেলেছি।
উড়ে এসে কনুইয়ের ওপর পড়ল টেকোর বুক। পূর্ণগতি নিয়ে কনুইয়ের সুক্ষ কোণায় এসে পড়ায় চাপটা মূলত পড়ল একটা বিন্দুতে।
পাঁজরের হাড় ভাঙ্গার বিচ্ছিরি শব্দটা মনে হয় গলির শেষ মাথা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
সেই সাথে গতি জড়তা কাজে আসতে না পারায় দুই পা শুন্যে উঠে গেছে ফলোয়ারের – এক মুহূর্ত পরেই দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল।
দেরী করে কাজ নেই।
ম্যাটাডোর কলমটা ঝটপট বের করে মানুষটার হাতের তালুতে গেঁথে দিতেই আকাশ ফাঁটিয়ে চেঁচিয়ে উঠে টাকু।
‘কার নির্দেশে আমার পিছনে লেগেছ?’ ওর বুকের ওপর হাঁটু তুলে দিয়ে কলমটা মুচড়ে দিতে দিতে বলি আমি।
গুঙ্গিয়েই যায় লোকটা। একে মুখ খোলানোর জন্য বেশি সময় পাওয়া যাবে না। উঠতি বয়েসের কিছু ছেলে আড্ডা ভেঙ্গে এদিকে এগিয়ে আসছে গলির ওইপাশ থেকে। দ্রুত আরেকহাতের তালুতেও কলম গেঁথে দেই আমি।
‘হু সেন্ট ইউ?’ মুখে ঘুষি মারি একটা, ‘অ্যানসার মি!’
চোখমুখ উলটে ফেলে হা করে লোকটা।
কিন্তু ওখান থেকে কোন শব্দ পাওয়া যায় না।
হঠাৎ-ই জিহবা দিয়ে একটা দাঁত খুলে গিলে ফেলে টেকো।
পরক্ষণেই স্তব্ধ হয়ে যায় শরীরটা।
‘শিট!’ ওকে ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াই।
ছেলেগুলো প্রায় চলে এসেছে।
বিপরীত প্রান্তের দিকে হাঁটা দেই দ্রুত।
জানি ওরাও শেষ মাথায় এসে মোড় ঘুরবে আমাকে ধরার জন্য।
কিন্তু আমাকে আর দেখতে পাবে না কোথাও।
*
চিন্তায় মাথাটা ভারী হয়ে আছে।
যতদ্রুত সম্ভব বাসার দিকে আগাচ্ছি।
এ ফ্ল্যাটে আমি বা ঈশিতা কেউই নিরাপদ নই। অতীত ঝেড়ে ফেলা দেখছি ততটা সহজ নয়।
নকল নাম নিয়ে অন্ধকার জগতে প্রবেশ করি আমি – কাজেই আসল নাম নিয়ে সুস্থ জগতে ফিরে আসতে পেরে বেশ স্বস্তিবোধ করছিলাম। তারপরও আমাকে খুঁজে বের করে ফেলেছে!
দ্রুত বাসা থেকে ঈশিতাকে বের করে নিয়ে সরে পড়তে হবে এখান থেকে।
স্কুল ছুটি হয় বারোটায়। মর্নিং শিফট। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত বাসায় একাই থাকতে হয় বেচারিকে। এই পৃথিবীতে বোনটা ছাড়া কেউ নেই আমার, তাকেও সময় দিতে পারলাম আর কোথায়!
তিনতলাতে উঠে শরীরটা শক্ত হয়ে গেল আমার। দরজাটা আধখোলা!
নব ভেঙ্গে ছুটিয়ে ফেলা হয়েছে!
নিজের হৃৎপিন্ডের ধুকধুকানী ছাড়া আর কিছু শুনতে পাই না।
প্রতিটা পেশী সতর্ক হয়ে গেছে আমার, আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে দরজাটা পুরো খুলে ফেললাম। দেয়াল হাতড়ে লাইট অন করতেই সন্ধ্যার আবছা আঁধার কেটে যায়।
ঘরের সবকিছু ওলট পালট হয়ে আছে।
ভেতরে ছুটে ঢুকে পড়লাম।
প্রতি মুহূর্তে ভয় কাজ করছে, এই মুহূর্তে হয়ত ঈশিতাকে দেখতে পাব।
কি অবস্থায় দেখতে পাব – সেটা কল্পনা করতেই ভয়ে রক্ত হিম হয়ে আসছে।
সেই সাথে দায়ী ব্যক্তির প্রতি রাগের একটা হল্কা অনুভব করছি।
প্রতিটা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজি আমি।
কোথাও ঈশিতা নেই।


বাইরে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হতেই সচকিত হয়ে উঠি আমি।
ছুটে সিঁড়িঘরে বেড়িয়ে আসি। এই সময় বাসার সামনে থেমে যায় গাড়িটা।
আমাকে নিয়ে কি চায় ওরা – জানি না।
জানার জন্য কোনরকম বাড়তি কৌতুহল না দেখিয়ে ছাদ বরাবর উঠতে শুরু করলাম।
ছয়তলা বিল্ডিং। ছাদ আরও তিনতলা ওপরে।
ততক্ষণে সিঁড়িঘরে চলে এসেছে দুইজন।
নিচতলা থেকে আমাকে দেখে হৈ হৈ করে ওঠে ওরা।
হর্ষধ্বনি না শিকারকে হাতে পাওয়ার আনন্দে উৎফুল্ল – তা নিয়ে মাথা ঘামাই না, উঠতে থাকি।
ছাদে পা রেখেই আগে থেকে দেখে রাখা এস্কেপরুটটা মনে করি। আলতো করে গলায় ঝোলানো চাবিটা ছুঁলাম। জায়গামতই আছে।
কখনও এভাবে পালানোর চেষ্টা করে দেখিনি অবশ্য। আমার নতুন জীবনে এত দৌড়ঝাঁপ ছিল না।
নির্দিষ্ট দিকের রেইলিং-এ গিয়ে ঝাঁপ দিলাম ছাদ থেকে।
পেছনের ওই ওরা বেরিয়ে আসে সেই মুহূর্তে ছাদে।
শূন্যে ভেসে ছয়ফিট দূরের পাঁচ তলা বিল্ডিংটার ছাদে গড়িয়ে পড়তেই পেছন থেকে ভোঁতা শব্দ শুনতে পাই।
ঠাস করে ফেটে পড়ে ছাদের সখের বাগান হিসেবে রাখা ফুলগাছের টবটা।
ওদিকে তাকানোর সময় নেই। ছুটে গিয়ে ছাদের আরেক কিনারে লাফ দেই। পরের বিল্ডিংটার ছাদ আরও একতলা নিচুতে।
গড়িয়ে সোজা হয়ে গায়ের জোরে লাথি হাঁকাই ছাদের দরজাটায়।
ভেতর থেকে তালা দেওয়া!
আবারও প্রকান্ড একটা লাথি মারি ওতে। নিশ্চুপ চারপাশে কামানের গোলার মত শব্দ হয়।
অবশ্য মাইন্ড করার কিছু নেই এতে।
পাশের বিল্ডিং-এর ছাদের ধুপধাপ শব্দ শোনা যায়।
আমার দোস্তরা নেমে আসছে– বুঝলাম। ওই বিল্ডিংটার ছাদের রেইলিং-এর কাছে দুটো ছায়ামূর্তি দেখা যায় আমার অনুমান নির্ভুল প্রমাণিত করে।
এদের একজন আবারও কোমর থেকে কিছু একটা খুলে আমার দিকে তাক করতে থাকে।
সেই সাথে তৃতীয় লাথিতে দরজার কব্জা ছুটিয়ে দেই আমি। লাফিয়ে ভেতরের অন্ধকারে ঢুকে পড়তেই বাইরে ঠং জাতীয় শব্দ ওঠে।
সেদিকে কান না দিয়ে সিঁড়িঘর কাঁপিয়ে নামতে থাকি আমি।
কিডন্যাপিং-এর পেশা থেকে সরে আসার পর থেকে সাথে আগ্নেয়াস্ত্র রাখি না। এই প্রথমবার সেটা নিয়ে আক্ষেপ হল।
জানটা হাতের মুঠোয় নিয়ে ছুটতে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই এই মুহূর্তে।
ঈশিতার এখন আমাকে দরকার। এখানে গুলি খেয়ে পড়ে থাকাটা কোন কাজের কথা নয়।
চারতলা বিল্ডিংটার গ্যারাজে পা রেখেই মনে শান্তি আসল আমার মটরসাইকেলটাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে।
এই বিল্ডিং-এর গ্যারাজে মটরসাইকেলটা রাখার জন্য ভাড়া দিয়ে এসেছি গত আটটা মাস।
ছোট গেইটটার লক খুলে ফেলি গলায় লকেটের মত ঝোলানো চাবিটা দিয়ে।
ওদিকে মুখখিস্তি করতে করতে নেমে আসছে ওপরের ওরা।
ওরা দোতলায় প্রায় – আমি স্টার্ট দেই ইঞ্জিন।
নিস্ফল দুই মূর্তিকে পেছনে রেখে বাতাসের গতিতে বেড়িয়ে যাই হতচ্ছাড়া গ্যারাজটা থেকে।
তবে এতেই বিপদ কেটে গেছে – এমনটা না।
আমার বিল্ডিং-এর সামনের জীপটা স্টার্ট নেয় পরিস্থিতি বুঝে। বিপরীত দিকটা বেছে নিই আমি।
ঝড়ের বেগে বাইক ছুটিয়েও পেছনে ফেলা যায় না ওদের।
মোড়ের পর মোড় বাঁক নিচ্ছি – পেছনে রূপকথার দৈত্যের মত লেগে আছে জীপটা।
মনে হচ্ছে আমার মৃত্যুর সাথে সাথে জাতীয় ছুটি ঘোষনা দেওয়া হবে। যেরকম ঘটা করে এগিয়ে আসছে ওরা!
গন্তব্য পাল্টালাম।
আর তিনটে বাঁক নিয়েই হঠাৎই ঢুকে পড়ি দুই বিল্ডিং-এর ফাঁক দিয়ে।
দুপাশে মাত্র চারফিট জায়গা। জীপ ঢোকার কোনই উপায় নেই এখানে।
অর্ধেকে পৌঁছে গেছি – এসময় জীপটাও গ্যাপটায় এসে থামে।
আর মাত্র কয়েকফিট বাকি – তাড়া খাওয়ার পর এই প্রথম প্রার্থনা করলাম যাতে বেড়িয়ে যেতে পারি।
পেছন থেকে সাইলেন্সারের বালাই না করে কড় কড় শব্দে গর্জে ওঠে একটা সাব-মেশিনগান।
প্রথমে মটরসাইকেলের বাম দিকের আয়নাটা চুরমার হয়ে যায়।
পরের সেকেন্ডেই গ্যাপটা থেকে বেরিয়ে আসে বাইক – সেই সাথে বাম কাঁধের নিচে ধাক্কা অনুভব করতেই কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছিলাম ।
শেষ মুহূর্তে সামলে নিয়ে ছুটে যাই রাতের আঁধারে।
*
মিরপুরের এক ফার্মেসীতে এসে থামলাম একঘন্টা পর।
বাইক থেকে পা মাটিতে নামিয়েছি, ভারসাম্য হারালাম। দাঁড়ানোর মত অবস্থা নেই।
অত্যাধিক রক্তক্ষরণ কাবু করে ফেলেছে।
আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে বিনা বাক্যব্যায়ে ভেতরের চেম্বারে ঢুকিয়ে ফেলল মিনহাজ।
বর্তমান পৃথিবীতে কেবলমাত্র এই ছেলেটাই আমাকে বাল্যকাল থেকে চেনে।
নিজেও মাঝে ঢুকে গেছিল ড্রাগসের ব্যাবসায়। এখন মোটামুটি ছেড়ে দিয়েছে সব।
‘দোস্ত ওরা -’ বলতে যাচ্ছিলাম। ইশারায় আমাকে থামিয়ে দেয় ও।
শার্ট খুলে ক্ষতটা পরীক্ষা করে চিমটা নিয়ে কাজে নেমে পড়ে।
পাশের ট্রে-তে ঠং করে একটা বুলেট ফেলে ব্যান্ডেজ বাঁধা শুরু করল মিনহাজ। খানিকবাদে টের পেলাম, বুকের চারপাশ দিয়ে ঘুরিয়ে ব্যান্ডেজটা যেন আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।
‘তুই লাকি।’ অবশেষে মুখ খোলে স্বল্পভাষী মানুষটা। ‘বুলেট সরাসরি হাড়ে লাগেনি, পেশীর বারোটা বাজালেও ভাঙা হাড় সামলাতে হয়তো হবে না। এক্স-রে করা দরকার, তবে মনে হয় আপাতত সে চিন্তা না করাই ভালো হবে। কী বলিস?’
‘আমাকে যেতে হবে।’ উঠে পড়ি। পকেট থেকে এই প্রথম বের করার সুযোগ পেলাম জিপিএস রিসিভারটা।
‘আগামী সাতদিন নড়াচড়া করবি না।’ ভ্রু কুঁচকে বলে মিনহাজ, ‘কতগুলো রক্ত গেছে সে ব্যাপারে ধারণা আমার থেকে তোর বেশি থাকার কথা।’
রিসিভারের স্ক্রীণে কোন ব্লিপ নেই।
থাবা দেই যন্ত্রটাকে। ‘কাম অন!’
‘কি হয়েছে?’ মিনহাজ কৌতুহলী হলেও মুখে ছাপ পড়ে না।
‘ঈশিতাকে নিয়ে গেছে ওরা।’ কোন ব্লিপ দেখি না এবারও। ‘ড্যাম ইট!’
হতাশ হয়ে একপাশে নামিয়ে রাখি রিসিভারটা।
মিনহাজের মুখে বরাবরের মতই কোন ভাব পড়ে না। তবে আমি ওকে চিনি। জানি, ভেতরে ভেতরে এখন ও প্রস্তুত আমার যেকোন সাহায্যে নেমে পড়ার জন্য।
‘ঈশিতার গতবারের দুর্ঘটনার পর থেকে সতর্ক হয়ে গেছি আমি।’ ব্যাখ্যা দিলাম ওকে, ‘ওর সবগুলো জুতোয় জিপিএস ট্রান্সমিটার থাকে। রেঞ্জ নয় কিলোমিটার।’
যে ধরনের স্পাই ট্র্যাকের কথা বলছি তাদের ইন্টারনেটে সংযোগ দেয়ার ব্যবস্থা থাকে না। তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করতেই এ ব্যবস্থা।
‘এতটুকু সাইজে? হেভী কোয়ালিটি।’ মাথা দোলায় মিনহাজ। ‘কিন্তু কোন সিগন্যাল পাচ্ছিস না?’
‘নট আ সিঙ্গেল ব্লিপ।’
‘তুই তোদের বাড়িতে চলে যা। আমাকে দেখতে দে।’ হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা চায় মিনহাজ। ‘জুতোয় ট্রান্সমিটার বসিয়েছিস যে – ঈশিতা জানত?’
‘না। ঢাকার বাইরে নিয়ে গেছে ওকে ওরা।’ বিহ্বল দৃষ্টি মেলে দেই আমি।
‘সেটা আমি দেখছি।’ একরকম জোর করেই রিসিভারটা নিয়ে নেয় মিনহাজ, ‘গোটা ঢাকায় একটা চক্কর দিয়ে দেখব কোথাও সিগনাল পায় কি না। তুই এই ফাঁকে বিশ্রাম নে একটু।’
টলতে টলতে বেরিয়ে আসি আমি মিনহাজের সাথে।
ফার্মেসী বন্ধ করে নিজের বাইকটা স্টার্ট দিয়ে মোড়ের শেষপ্রান্তে অদৃশ্য হয়ে যায়।
আমিও বাইকে উঠি।
*
আস্তে করে চাবিটা ঘুরাতেই ঠং করে খুলে ওঠে মরচে পড়া তালাটা।
গত চৌদ্দ বছরে দ্বিতীয়বারের মত পৈতৃক বাড়িটায় পা রাখলাম ।
যেখানে কেটেছে আমার শৈশবের শুরুটা।


হতচ্ছাড়া একটা টিনশেড বাসা।
সামনে লম্বা একটা উঠান।
বিষন্ন চোখে তাকিয়ে থাকি সেদিকে।
বাইকটা পাশেই পার্ক করে রেখেছি।
বাবাকে আবছা মনে পড়ে। তবে মানুষটার ব্যাপারে কেন জানি স্মৃতি হাতড়ে তেমন কিছু পাই না। আবছা এক স্মৃতি। বাবাটা ছিলেন নিষ্ঠুর প্রকৃতির। এতটুকু ঠিকই মনে পড়ে।
পূর্বদিকের ঘরটায় চোখ পড়তে এতবছর পরেও মেরুদন্ডের কাছটা শিরশির করে ওঠে আমার।
চৌদ্দ বছর আগে দশ বছরের আমি ঘুমাচ্ছিলাম পাঁচ বছরের ঈশিতাকে পাশে নিয়ে।
সেইদিনই জীবনে প্রথম গুলির শব্দ শুনি আমি।
মায়ের ছোট্ট একটা আর্তচিৎকার।
আড়াল থেকে উঁকি দিয়েছিলাম। চারজন লোকের মাকে ঘিরে থাকা আর তাদের হাতের আগ্নেয়াস্ত্রের বার বার গর্জন – আমার মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়।
শরীরের প্রতিটি রক্তকণা চাইছিল ছুটে গিয়ে মাকে ধরতে।
কিন্তু তা না করে ঈশিতাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলি আমি। জানালা খুলে জীবন বাজি ধরে বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়ি ওর হাত ধরে।
আমার মায়ের মৃত্যুটা রহস্যই থেকে যায়।
*
নিজের বাড়িতে ফেরা হয় না আর ছেলেটার। ভীতি দূরে সরিয়ে রাখে ওকে।
একমাত্র বন্ধু ছিল মিনহাজ। তবে ছোট্টোটি তখন সে-ও। মাঝে মাঝে গিয়ে খবর নেয়া ছাড়া আর কোন উপকারে আসেনি।
সেই ভয়ঙ্কর সময়ে টানা দু’দিন শিশুদুটো রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে। খেয়েছে চেয়েচিন্তে। অবশেষে ছেলেটা মিনহাজের সাথে লুকিয়ে দেখা করে। জানতে চায় বাসার খবর।
‘তোর মায়ের চেহারা চেনা যায় নাই। গুলি মাইরা একেবারে ছাতু কইরা দিছে।’ মিনহাজের কথায় গোটা দুনিয়ার ওপর ক্রোধের একটা আগুন অনুভব করে দশ বছরের ছেলেটা। সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে পারলে হয়তো একটু শান্তি পাওয়া যেত!
‘তোর বাবারেও খুঁজে পাওয়া যায় নাই কোথাও। বাবা বলছে পুলিশেও তব্দা খাইছে। এমুন ঘটনা এই শহরে আগে কোনদিন হয় নাই। কী থেইকা কী হইয়া গ্যালো কেউ কইবার পারে না।’
মাথা নাড়তে নাড়তে সরে এসেছিল সেদিন ছেলেটা। প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল পৃথিবীর ওপর এর প্রতিশোধ তুলে নেবে।
পরের তিনটি বছর কঠিন সংগ্রামে জীবন যায় শিশুদুটোর।
সমাজের অন্ধকার দিকগুলো ঘোরা হয়ে গেছে ততদিনে ছেলেটার। অপরাধের জগতে পা রাখার পর এই প্রথম খেয়েপরে কিছু টাকা জমাতেও পারছে। বোনটাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয় ছেলেটা। তীব্র অভাবে দিন পার হলেও – বোনকে অনেক বড় বানাবে – এই স্বপ্ন সবসময় দেখেছিল।
বস্তিতে থাকত ওরা। নিজের আস্ত একটা বাড়ি পড়ে আছে মিরপুরে – তবে সেদিকে আর পা বাড়ায়নি ভাইটা। ওখানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।
‘ওস্তাদের’ সাথে ছিঁচকে ডাকাতিতেই বেশি উপার্জন হত ওদের।
পিচ্চি ছেলেটা ওই বয়েসেই একটা বাসায় খুঁত বের করতে পারত নিখুঁতভাবে। যে কোন বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে সদর দরজা খুলে দেয়া তার জন্য হয়ে উঠলো হাতের মোয়া। এদিক বিবেচনায় ছেলেটা ছিল ভূতের মত। নিজেকে লুকিয়ে ফেলার একটার পর একটা অসামান্য কৌশল আবিষ্কার করতে থাকে সেই তের বছর বয়েসে। যেকোন বাসার নিরাপত্তা ব্যাবস্থার খুঁত ধরে ভেতরে চলে যাওয়ার দক্ষতা ছিল যে কারও চেয়ে বেশি। কারও অধীনে থেকে নয়, নিজের ব্যাবসার ক্ষেত্র নিজেই বানিয়ে ফেলতে চায় ছেলেটা।
নিজের শৈশব পার করা এলাকায় কেবল মিনহাজের সাথে যোগাযোগ থাকে ওর।
সেই সাথে নিজেও এক অখ্যাত স্কুলে ভর্তি হয়। এক বছর পানিতে ভেসে গেলেও অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়।
এগার বছর তখন ঈশিতার। দিন দিন আরও সুন্দর হচ্ছে ও। এই প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো মেয়েটা। সেই সাথে কথাবার্তায় বড়লোকের মেয়েদের মতো চৌকস ও বাগ্মী। কে বলবে একটা বস্তিতে বড় হয়েছে সে?
ছেলেটা খেয়াল করে বোনের দিকে ওস্তাদের দৃষ্টিটা আগের মতো নেই, দিন দিন পালটে যাচ্ছে।
একদিন ওস্তাদকে বোনের শরীরে হাত দিতে দেখে ফেলে ও।
মাত্রই রান্না বান্না সেরে ঘরের দিকে যাচ্ছিল ‘রাজুর মা’। বস্তি বাসা – সবাই একসাথে এভাবেই থাকে। বিদ্যুৎবেগে নড়ে উঠেছিল কিশোর। তার হাত থেকে বটিটা কেড়ে নিয়ে ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দিয়েছিল দীক্ষাগুরুর।
ওস্তাদের কোমর থেকে পিস্তলটা খুলে নিয়ে আবারও বোনের হাত ধরে ছুটে পালানো।
এর মাঝেও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার এক অবিশ্বাস্য কাহিনী। ছেলেটা ‘রাজাদের মাঝে গরীব’ অথবা ‘গরীবদের মাঝে রাজা’ হতে চায় না।
ও চায় ‘রাজাদের রাজা’ হতে।
সতের বছর বয়েসে লাভজনক ছিঁচকে ব্যবসাগুলোর দিকে চোখ না দিয়ে নিজের স্কিলগুলোর দিকে লক্ষ্য করে ও। নিজের দক্ষতা যে পেশায় কাজ দেবে সেদিকে গেলেই ওকে ঠেকাতে পারবে না কেউ – বোঝে ও ভালো মতই। এতদিনের অর্জিত স্কিলগুলো সবগুলো যথার্থভাবে ফিট করে একটা পেশায় – কিডন্যাপিং।
পাঁচ বছরের একটা ছেলেকে ধানমন্ডি থেকে উধাও করে দিয়ে আগেরদিন চুরি করা মোবাইলটা কানে ঠেকিয়ে ফোন দেয় ছেলেটার বাবাকে, ‘হ্যালো মি. গোলাম মোস্তফা। আমি ইরফান বলছি।’
‘ইরফান’ নামটা ও প্রতি কিডন্যাপিংয়েই ছড়িয়ে দেয় যতটা পারে।
ডিমান্ড বেড়ে যেতে থাকে ওর। বিভিন্ন স্তরের ক্লায়েন্ট খুঁজে বেড়ায় ‘ইরফান’কে।
ঢাকার সবচেয়ে দক্ষ কিডন্যাপার বলা হয় ওকে।
বোনকে আস্তে করে নিজের কালো জীবন থেকে সরিয়ে দেয় ইরফান। টাকার সমস্যা ওদের আর ছিল না। বোর্ডিং স্কুলে তাকে পড়ানোর সঙ্গতি তার হয়েছে।
এদিকে নিজের আসল নাম জনমন থেকে বিস্মৃত হয়েছে আগেই। বিশেষ দক্ষতার কারণে লোকে ওকে ডাকতে শুরু করে ‘ফ্যান্টম ইরফান’।
টাকার অভাব হয়নি ওদের আর।
ভুলেও ফেরেনি ইরফান তার বাবার বাড়িতে। এতগুলো বছর গেলেও রহস্যময় খুনটাকে কেন্দ্র করে পোড়োবাড়ি আখ্যায়িত হয়ে যাওয়ায় এই বাড়িটাও কেউ দখল নিতে চেষ্টা করেনি।
আটমাস আগে এর ব্যত্যয় ঘটে।
প্রথমবারের মত নিজের বাসায় ফিরে আসে ইরফান।
*
মা-বাবার ঘর ছিল এটা।
ইটের টুকরোগুলো সরিয়ে বিশাল বাক্সটার ঢাকনাটা বের করলাম।
আটমাস আগে অপরাধের পথ ছেড়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে সব ইকুয়েপমেন্ট এনে রাতের আঁধারে এখানেই লুকিয়ে রেখেছিলাম আমি। এর থেকে সঠিক জায়গা আছে বলে আমার মনে হয়নি।
প্রয়োজনীয় ইকুয়েপমেন্টগুলো বের করে সদ্য বাক্স থেকে বের করা স্পেশাল ব্যাকপ্যাকে ভরে রাখি।
সবশেষে গ্লক২৩ টা একহাতে নিয়ে আরেকহাতে গান ক্লিনিং কিটটা সহ উঠানটায় এসে বসি।
অস্ত্রটাকে আবারও ব্যাবহার উপযোগী করে তুলতে হবে। যেকোন সময় মিনহাজের ফোন আশা করছি।
বিশাল উঠোনটায় বসে পিস্তলটার প্রতিটা পার্ট খুলতে থাকি আমি। গান অয়েলে চুবানি দিতে হবে এগুলোকে।
আর দশটা পরিবারের মত আমাদের জীবনটা হলে এখানে চৌদ্দ বছরে হয়ত বহুতল ভবন উঠতে পারত – ভাবি আমি!


ফোনটা বেজে উঠতেই খামচে ধরি ওটা।
‘হ্যালো!’
‘দোস্ত, সিগন্যাল পেয়েছি।’ মিনহাজের গলাটা অতটা আশাবাদী বলে মনে হয় না।
‘লোকেশনটা জানা।’ ব্যাস্ত গলায় বলে উঠি আমি।
‘তুই নাঈমের স্পটে চলে আয়।’ ফোন কেটে দেয় মিনহাজ।
অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
নাঈমের ওখান থেকেই অস্ত্রের সাপ্লাই পেতাম আমি। জায়গাটা এখান থেকে খুব একটা দূরেও না।
মিনহাজ কি বলতে চাইছে ওই জায়গার আশেপাশেই ও সিগন্যাল পেয়েছে?
ডান কাঁধে ব্যাকপ্যাকটা চাপাই।
বাম কাঁধ আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে কিছুই করার নেই। পেইনকিলারের বালতি তুলে এনেছি মিনহাজের দোকান থেকে, নয়তো স্রেফ আড়ষ্ট নয়, প্রতিটা পেশীর নড়ে ওঠার সাথে আমার অবর্ণনীয় যন্ত্রণা অনুভব করার কথা। গুলি খাওয়া কোন সুখের ব্যাপার নয়।
বিশমিনিটের মাঝেই পৌঁছে গেলাম নাঈমের ওখানে।
আমাকে নিয়ে নাঈমের বাসায় ঢুকে পড়লো মিনহাজ। ঢাকায় সবচেয়ে বড় প্রাইভেট অস্ত্র ব্যবসায়ী আমাদের নাঈম। ডুপ্লেক্স বাড়িটার নিচে বেজমেন্টে ঢুকলে ওর অস্ত্রের কালেকশন দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে।
‘এখানে কেন দোস্ত?’ ফিস ফিস করি আমি।
বেজমেন্টে নেমে প্রাইভেসী দিতে দূরে সরে গেছে নাঈম।
‘তুই যেখানে ঢুকতে চাস – একটা হ্যান্ডগান নিয়ে ঢোকার কথা তুই ভাববি না।’
‘ঈশিতা কোথায়?’ গলা কিছুটা কাঁপে এবার আমার।
‘রাবেকের নাম শুনেছিস?’
মিনহাজের কথায় স্থির হয়ে যাই আমি।
রাবেক। দ্য ওয়ান অ্যান্ড ওয়ানলি গডফাদার অফ ঢাকা।
একটা মিথ। একজন লিজেন্ড।
তবে মজার ব্যাপার হল কেউ জানে না আসলেই রাবেক বলে কেউ আছে কি না।
‘ঢাকায় মাফিয়া নেই।’ মাথা নাড়াই আমি। ‘শুধুই গালগল্প। যা ছিল আগেই সেনাবাহিনীর সাথে লড়তে গিয়ে সব বেঘোরে মারা পড়েছে।’
‘তুই কতটুকু জানিস?’ ভ্রু কুঁচকে বলে মিনহাজ। ‘শোনা কথা সবই মিথ্যা হয় না। শপিং কমপ্লেক্সের প্রতিটা মালিক জানে এই ঢাকাতেও তাদের লাভের নির্দিষ্ট একটা শতাংশ জমা দিতে হবে। খোঁজ নিলেই জানতে পারবি। কয়েকদিন আগে মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের মালিক অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে নিহত হল। কেন?’
জবাব দিতে পারি না আমি। আজকাল মাফিয়া মানেই সরকারী লোকের চাঁদা তোলা, ওসব থেকেই ধুম-ফটাক হওয়া এক জিনিস আর সত্যিকারের মাফিয়া আরেক জিনিস। এদিকে আমার নীরবতার সুযোগে বলে চলে মিনহাজ।
‘যে লোকেশনটা আজ আমি রিসিভারে পেয়েছি – ওদিকেই কোথাও রাবেকের হেডকোয়ার্টার বলে আন্ডারওয়ার্ল্ডে গুজব ছিল। তাছাড়া তোর ওপর যেভাবে হামলা হয়েছে; তোকে যেভাবে খুঁজে পেয়েছে সব ট্রেস লুকিয়ে তুই ডুব দেওয়ার পরও – যে কেউ নয়, তুই! রাবেকের কাজ হতেই পারে।’
‘রাবেক একটা গুজব। এর বেশি কিছু না।’ তবুও মাথা নাড়াই আমি।
‘তাহলে ব্যাখ্যা দে, তুই তোর সমস্ত ট্রেস মুছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছিলি। এরপরেও আজকে শুধু তোকে খুঁজে বের করেছে তাই না, তোর বাসা পর্যন্ত খুঁজে বের করেছে। তুই তো আর যে কেউ নোস। আন্ডারওয়ার্ল্ড যখন ছিল তখন তোকে তারা ফ্যান্টম নাম দিয়েছিল। ঢাকায় তোর মতো লুকাতে পারে আর কে আমি জানি না। কিভাবে সম্ভব যে তোকে এভাবে টেক্কা দিল? ব্যক্তিগত শত্রু? না, তাহলে আমার কানে আসতো। মাফিয়া-নেটওয়ার্ক থাকলেই কেবল সম্ভব। কেন তোকে ফলো করা মানুষটা সুইসাইড করল? কার ভয়ে? এরকম ভীতির প্রকাশ মাফিয়া ছাড়া হয় না। এলাকার কোন মাস্তানের জন্য লোকে এমন করবে? কোন মন্ত্রীর জন্য? একটা নাম দেখা?’
‘মানে,’ ওর যুক্তি ঠিক ধরে নিয়ে বলি আমি, ‘তুই বলতে চাইছিস – রাবেক দ্যা গডফাদার আমাকে দিয়ে কিছু একটা করাতে চাচ্ছে? সেজন্যই একমাত্র জীবিত আত্মীয়কে ধরে নিয়ে গেছে?’
‘সারাদিনের ঘটনাপ্রবাহের একমাত্র লজিক্যাল এক্সপ্লেনেইশন।’
‘আমার দিকে গুলি ছুঁড়েছিল ওরা।’ মানলাম না ওর কথা।
‘এমন কোন ক্ষতি করেনি যাতে তোকে হাসপাতালে ঢুকে যেতে হবে। ইচ্ছে করেই মিস করতে পারে।’ পালটা যুক্তি দেয় মিনহাজ।
একমুহূর্ত ওর দিকে তাকালাম।
তারপর হাত বাড়ালাম সাবমেশিনগানগুলোর দিকে। ওপেন বোল্ট সেমি-অটো ইন্টারডায়নামিক কেজি-নাইনটাই পছন্দ হল।
‘নাঈম!’ হাঁক ছাড়ি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অস্ত্র ব্যাবসায়ীর দিকে। ‘আমার গ্লক২৩ এর ম্যাগ লাগবে কয়েকটা। পয়েন্ট ফর্ট স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন।’
*
বাসাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
কালো পোশাকে আমি আর মিনহাজ শুয়ে আছি আধমাইল দূরের কন্সট্রাকশন সাইটের ক্রেনের ওপর।
আমার হাতে বাইনোকুলারস।
‘হোয়াটস দ্য প্ল্যান? কি করতে যাচ্ছিস?’ পাশ থেকে জানতে চায় মিনহাজ। ওকে অনেক চেষ্টা করেও খসাতে পারিনি। আসলই আমার সাথে।
‘ওয়ান থিং আ’ম বেস্ট অ্যাট।’ বিড় বিড় করে বলি আমি। ‘কিডন্যাপ।’
বিল্ডিংটা চারতলা। চারপাশে আর কোন বিল্ডিং নেই। একেবারে শহরের শেষ প্রান্ত। এখনও এদিকে দোকানপাট থেকে শুরু করে কোন নাগরিক সুবিধেই তেমন আসেনি। কাজেই অন্যান্য জমির মালিকেরা এখানে বাড়ি বানানোর চিন্তা করেনি এখনও।
‘এটা কিডন্যাপিং সিচুয়েশন না। রেসকিউং সিচুয়েশন।’ অবাক মিনহাজ বলে।
‘কখনও কখনও দুটো একই জিনিস।’ বলি আমি। জনমানুষ একেবারেই নেই তা না। ছাতে একজনকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে হেডকোয়ার্টার পাহড়া দিচ্ছে। রাবেকের অস্তিত্বে কিছুটা বিশ্বাস করতেই হল।
‘এত ভণিতা না করে খুলে বল!’ অধৈর্য্য হয়ে বলে মিনহাজ।
‘কাজের ধারা তো একই। ভেতর থেকে আমার কিডন্যাপ করতে হবে ঈশিতাকে। সে অনুযায়ী প্ল্যান দরকার।’
‘সেটাই এতক্ষণ বলছিলাম। প্ল্যান ঠিক কর একটা। তারপর অ্যাকশন।’
‘ঠিক করে ফেলেছি।’ নামার প্রস্তুতি নেই আমি।
ধীরে ধীরে মাটিতে নামি আমি। ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নেই।
‘ওরা আমার আসার অপেক্ষায় আছে।’ মুখ খুলি এবার আমি। ‘আমার প্রোফাইল জানা আছে ওদের। কাজেই ওরা একদম প্রস্তুত। কাজেই হামলা চালানোটা কিছুটা ঝামেলার হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ওদের সুবিধেটাকেই ওদের উইকনেস বানিয়ে কাজ করতে চাইছি আমি।’
‘আমি কি করব?’ মিনহাজ আস্তে করে কোমর থেকে ওর ম্যাকারভ পিএমফাইভটা বের করে। ছেলেটা এত থাকতে রাশিয়ান জিনিসের দিকে ঝোঁকে কেন সেটাই ভেবে পাই না আমি।
‘সোজা বাড়ি ফিরে যা।’ ওর পিঠে চাপড় দিলাম। ‘এটা তোর লড়াই নয়।’
‘সেই ন্যাদা ছিলি তখন থেকে তোদের চিনি।’ মুখ ঝামটা মারে মিনহাজ, ‘ঈশিতা আমারও বোন না – এরকম কিছু একটা বলেই দ্যাখ!’
মুখটা দেখলাম। সংকল্প ঝিকমিক করছে। তাকে ফেরানোর সাধ্য আজ রাতে আমার হবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম একটা।
‘তাহলে ঠিক যেভাবে বলব সেভাবেই কাজ করবি – ওকে?’ প্ল্যানটা আরেকটু উন্নত করে সাজাই আমি। ‘ফিরে আসার কথা ভাববি না।’
*
মিনিট দশেক পর – বাসাটার সামনে দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে যায় ওয়াল্টনের একটা ঝরঝরে মটরসাইকেল।
পার হওয়ার সময় ধাঁই ধাঁই করে গুলি ছোঁড়ে বিভিন্ন তলার জানালার কাঁচে।
সাথে সাথে নির্ঘুম বাড়িটা যেন জেগে ওঠে। সামনের প্রতিটা জানালা থেকে নিদেনপক্ষে একজন মানুষ রাইফেল এবং সাবমেশিনগান নিয়ে প্রতিউত্তর দেয়। মুচকি হাসলাম, মিনহাজের মাফিয়া তত্ত্ব বিশ্বাস করতে শুরু করেছি অবশেষে। অস্ত্রের যে ঝনঝনানি দেখা গেল, খুব সম্ভব!
সবার মনোযোগ সামনে সরে গেছে – এই ফাঁকে পেছনের পাইপ বেয়ে উঠতে শুরু করি আমি।
ব্যাকপ্যাক নিয়ে উঠতে গিয়ে জান বের হয়ে যাচ্ছে বাম হাতের কাঁধের নীচের ক্ষতে। পেইনকিলার তো আর আজীবন ব্যথা ভুলিয়ে রাখবে না। ওখানে আবারও রক্তপাত শুরু হয়ে গেছে – নিঃসন্দেহে।
ছাদ থেকে ভেতরে ঢোকা যাবে।
গোলাগুলির শব্দ একেবারে চুপচাপ এখন।
নিরাপদে মিনহাজ বেরিয়ে গেছে – এটা একটা স্বস্তি।
বেড়ালের মত নিঃশব্দে হাতের তালুতে ভর দিয়ে রেইলিং টপকালাম।
পরমুহূর্তেই হাতে উঠে এসেছে বিশ্বস্ত গ্লক২৩। সাইলেন্সারের সুবিধে নিয়ে যতদূর পারি যেতে হবে।
আমার আসার কথা বুঝে ফেললে ঈশিতার ক্ষতি করার হুমকি দিতে পারে, তখন নিষ্ক্রিয় হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না আমার। সেক্ষেত্রে দু’জনই মরবো।
ছাদে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা ভাগ্যিস ওদিকেই তাকিয়ে ছিল – যেপথে এই মাত্র মিনহাজ গায়েব হয়ে গেছে।
নিষ্কম্প হাতে লোকটার পেছন থেকে গুলি করলাম। কপাল ভেদ করে মগজের সাথে সাথে প্রাণবায়ুও বেরিয়ে গেছে ছোকড়ার। এখন ‘ফেয়ার অ্যান্ড স্কয়ার’ – টাইপ ফ্রেইস মুখস্থ করার সময় না। সর্বাগ্রে পরিবার।
খটাস করে রাইফেলটা সহ পড়ে যেতেই মরাটার হাত থেকে গর্জে উঠল রাইফেল। অনবরত হাতুড়ির বাড়ি মারার মত শব্দটা ম্যাগাজিন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত হতে থাকে!
নির্ঘাত গাধাটা ট্রিগারে আঙ্গুল দিয়ে রেখেছিল! মিনহাজের তাণ্ডবের কারণে সেফটি অফ ছিল নির্ঘাত! ট্রিগারে আঙুলের চাপ পড়তেই কাজ হয়ে গেছে!
ছাদে গোলাগুলির শব্দ শুরু হওয়ামাত্র নিচের ওদের আর নতুন নির্দেশ দেওয়া লাগলো না। ক্রুদ্ধ হুংকারের সাথে অনেকজন মানুষের ওপরে উঠে আসার শন্দ শুনতে পেলাম। ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে!
দ্রুত সিঁড়িঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিলাম বাইরে থেকে। গেল আমার ‘সারপ্রাইজিং এলিমেন্ট’!
যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন এভাবেই আগাতে হবে।
আমি সুপারহিরো না। কাজেই একসাথে এতজনের মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না।
ছাদের দরজায় লাথির পর লাথি পড়ছে। উনিশশ’ কটকটি সালের দরজা বেশিক্ষণ টিকবে না বুঝলাম।
ব্যাকপ্যাক থেকে লম্বা দড়িটা বের করতে হল। দ্রুত অ্যান্টেনার জন্য রাখা রডটায় বেঁধে কোমরে আটকে রাখা গ্রেনেড তিনটার একটা ছুঁড়ে মারলাম ছাদের দরজার দিকে। একই সাথে দড়ির আরেকমাথা ধরে পড়ে যাচ্ছি ছাদ থেকে বিশেষ একটা ভঙ্গিমায়।
এক সেকেন্ড পর একই সাথে অনেক কিছু ঘটে যায়।
রাবেকের বীরপুরুষদের লাথিতে ছুটে যায় দরজা। প্রায় সাথে সাথেই ফেটে যায় গ্রেনেডটা – প্রায় একই সাথে চারতলার জানালার গ্লাস ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়ি আমি।
এই ঘরে কাওকে দেখলাম না। সব বীরপুঙ্গব নিঃসন্দেহে ছাদের দিকে দৌড়েছে!
ছুটে ঘরটা থেকে বের হতেই যন্ত্রণাকাতর শব্দে সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ল রাবেকের একজন সৈনিক। এর বুকের কাছে এক খাবলা গোস্ত বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। এই অবস্থাতেও পিস্তলটা আমার দিকে তাক করার প্রচেষ্টায় আছে।
এক গুলিতে ওর খায়েশটা মিটিয়ে দিলাম। ছাদের কাছে এসে পড়ে থাকা দেহগুলোর ওপর কেজি-9 দিয়ে একপশলা গুলি ছুঁড়তেই সবার নড়া চড়া থেমে গেল।
ম্যাগাজিন পালটে আবার নামা শুরু করি আমি। একছুটে চারতলার প্রতিটা ঘর পরীক্ষা করে আসি – কোথাও নেই ঈশিতা।
নিচে নামতে হবে আমাকে।


চারতলা পরীক্ষা করে সিঁড়িঘরে ফিরে আসতেই অতিউৎসাহী তিনজনকে দেখা গেল সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে।
‘ওপরটা-এত-চুপচাপ-কেন’ টাইপ একটা অভিব্যাক্তি সবার চোখে মুখে।
ওদের অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করি আমি।
কেজি-নাইনের সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলাম আরেকপশলা গুলির মাধ্যমে।
পিছলে নিচে নেমে যায় লাশ তিনটে।
সিঁড়ি বেয়ে নামতেই লম্বা করিডোরে পড়লাম। ওপাশে সাতজন এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। একসাথে গর্জে ওঠে ওদের হাতের অস্ত্রগুলো।
সিঁড়ি থেকে পা সরিয়েই নেহায়েত রিফ্লেক্সের বশে গেছি ছোট পিলারটার আড়ালে, নইলে আর দেখতে হত না।
প্রাণের সুখ মিটিয়ে গুলি করে পিলার ওড়ায় ওই ওরা। এই সুযোগে আস্তে করে তাদের দিকে ঠেলে দেই একটা বিদায় উপহার।
বাম কাঁধ তখন জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে যেন আমার! এদেরই কারো সন্ধ্যাবেলার উপহার!
চোখের সামনে পিছলে আসা গ্রেনেডটাকে দেখে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ছোটাছোটি শুরু করল ওরা।
এতটুকু শুনেই কানে আঙ্গুল চাপা দিলাম।
বদ্ধ জায়গায় প্রচুত শব্দ করে ফাটল গ্রেনেডটা।
এক ঝটকায় বেড়িয়ে এলাম এবার, তবে কোন গুলি ছুঁড়তে হলো না।
নিথর দেহগুলোকে দেখে মুখে হাসি ফোটে আমার। তিনতলার প্রতিটি ঘর খুঁজে দেখতে বেরিয়ে যায় আরও কয়েকটি মুহূর্ত। এখানেও নেই ঈশিতা।
দোতলায় আরেক দফা বাঁধার সম্মুখীন হব ভেবেছিলাম। কিন্তু কাওকে দেখি না আমি। প্রতিটা ঘর পরীক্ষা করার সময় জানতাম নেই ঈশিতা এখানেও।
ছুটে নেমে আসি নীচতলায়। জিপিএস রিসিভারে দেখেছি এখনও আমি ব্লিপের ওপরেই আছি।
নীচতলার ঘরগুলো খুঁজেও কাওকে দেখলাম না।
তাজ্জব ব্যাপার! যেন সবাই বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে!
অথচ আমার রিসিভার বলছে এই বিল্ডিংয়েই ঈশিতা আছে।
এর মানে একটাই – মাটির নিচে ঘর আছে আরও। কিন্তু নামার উপায় দেখলাম না। তন্নতন্ন করে খুঁজে অবশেষে রান্নাঘরে পাওয়া গেল ওটা।
আস্তে করে ট্র্যাপডোরটা কয়েক ইঞ্চি তুলেছি, নীচ থেকে ছিটকে আসল একটা গ্রেনেড।
ডোরটা ফেলে প্রাণপনে দরজার দিকে ছুট লাগালাম।
তিন সেকেন্ডের টাইমার শেষ হওয়ার আগে কোন মতে কাভার নিতে পারলাম, ওদিকে রান্নাঘরের বাসনপত্র পুরো ঘর জুড়ে ছোটাছোটি করছে তখন বদ্ধ জায়গায় ফাটা গ্রেনেড বিস্ফোরণের তীব্রতায়।
ট্র্যাপডোরটাও ধ্বসে গেছে। ভেতরের কথাবার্তা এখানে চলে আসছে খোলা ফোকড় বেয়ে। নীচের আলোচনা শুনে মনে হল ওপরে গিয়ে দেখার জন্য একজন আরেকজনকে ঠেলাঠেলি করছে, কিন্তু কেউই আসতে চাইছে না। কান পেতে শুনি আমি। চোখ ট্র্যাপডোরের দিকে।
গ্লক থেকে ম্যাগাজিনটা বের করে আস্তে করে নতুন একটা ঢুকালাম শান্তভঙ্গিতে।
নীচে কেউ একজন তীব্র গলায় প্রতিবাদ জানালো, ‘এত সাহস থাকলে আপনি গিয়ে দেখে আসেন!’
আচমকা নীচে একটা গুলির শব্দ।
একটা দেহের পতন। আপত্তি করছিল যে সৈনিক তাকে উপযুক্ত শিক্ষাই দেয়া হল।
ভরাট একটা বয়স্ক কন্ঠ স্পষ্টস্বরে বলে, ‘আর কেউ আছে নাকি?’
রাবেক!
কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ চারপাশ।
তারপর কেউ একজন উঠতে শুরু করে ওপরে।
কপালটা দেখা যেতেই জায়গামত গুলি পাঠিয়ে দেই।
হুড়মুড় করে নিচে পরে মৃতদেহটা।
‘বোমবাস্টিং’ খেলায় এবার আমার টার্ন।
কোমর থেকে গ্রেনেডটা খুলে ট্র্যাপডোরের ফোকড় দিয়ে নীচে ভরে দিলাম।
বিকট শব্দে ভেতরে ফাটে গ্রেনেডটা – ওটা ফাটার শব্দ মিলিয়ে যেতে না যেতেই ঝাঁপিয়ে পড়ি গর্ত বরাবর!
ভেতরে বেশি বড় না জায়গাটা – ছোট্ট একটা করিডোরমত। সেখানে পড়ে আছে চারজনের মৃতদেহ।
বয়েসে প্রত্যেকে তরুণ।
এদের মাঝে রাবেক নেই।
করিডোরের শেষ মাথায় একটি মাত্র দরজা।
আস্তে করে দরজার নব খুলে উদ্যত পিস্তল হাতে ঢুকে পড়ি আমি।
উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে ঈশিতা। আমাকে দেখে খুশির বদলে রীতিমত চমকে ওঠে ও।
তার সামনে শটগান হাতে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে তার মুখ বরাবর পিস্তল ধরেছি আমি, অথচ হাতটা থরথর করে কেঁপে উঠল আমার। এই কাঁপন শারীরিক কারণে নয়!
‘ইম্প্রেসিভ, রবিন!’ বলে ওঠে রাবেক।
‘বাবা?’ অস্ফূট কন্ঠে বলে উঠি আমি।
সামনে মানুষটা আর কেউ নয়।
আমার বাবা রাফসান বেগ কবীর।


বিস্ময়ের ধাক্কাটা কাটানোর আগেই ঈশিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবার ওপর। এতখানি ডিসট্র্যাকশনই আমার দরকার ছিল।
‘ইউ লায়ার!’ বাজপাখির মতো চিৎকার করে উঠলো ঈশিতা।
তার ধাক্কায় নড়ে যায় শটগানের নলের মুখ। এক লাথিতে সেটাকে ওর হাত থেকে ছুটিয়ে দিয়ে কপালে পিস্তলের নল চেপে ধরলাম আমি।
‘বসে পড়ুন লক্ষী ছেলের মত।’ কড়া গলায় বললাম। ‘বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই আমি।’
বসে পড়ে বৃদ্ধ মানুষটা। আমার পিস্তল ধরা হাত একচুলও নড়ে না।
‘তুমি বলেছিলে -’ ঈশিতার প্রতিক্রিয়া এখনও শেষ হয় নি, ‘আমার জীবন হুমকির মুখে! তুমি বলেছিলে রবিন ভাইয়ার ওপর প্রতিশোধ নিতে আমার ওপর হামলা চালানো হতে পারে! আসলে আমাকে টোপ হিসেবে ব্যাবহার করেছ শুধু!’
‘আমি তোমার বাবা – ঈশিতা!’ আহত কন্ঠে বলে রাবেক।
‘তুমি আমার বাবার দায়িত্ব যতটুকু আর পালন করেছ! জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না! আজ দুপুরের আগে আমি জানতামও না তুমি আদৌ বেঁচে আছো কি না!’ অসহ্য ক্রোধে থর থর করে কাঁপে ঈশিতা, ‘আমার ভাইয়াই ছিল আমার বাবা, আমার ফ্যামিলি। ওই দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে কোথায় ছিলে তুমি? এই মুহূর্তেই বা কেন এসেছ?’
‘বেশ বেশ!’ মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে আমার। ‘চৌদ্দ বছর পর মেয়ের জন্য বেশ দায়িত্ব কর্তব্য ফুটে উঠেছে দেখছি! এখন আমি পুরো ঘটনা বিশ্লেষন করতে যাচ্ছি। আপনি শুনুন। ’
দম নিই আমি, পিস্তল সরাই না রাবেক দ্য গডফাদারের কপাল থেকে, ‘আপনার লোকজন নিয়ে আমার বাসায় আজ ঢুকে পড়ে নিজের পরিচয় দিয়ে ঈশিতাকে একরকম তুলে নিয়ে এসেছেন আপনি। বেশ কিছুক্ষণ ব্রেইনওয়াশও করেছেন মেয়েটার। কাজ হত না হয়ত এসব ছেঁদো কথাতে। তবে যখন গোলাগুলি শুরু হল – তখন ঈশিতা বিশ্বাস করে বিপদ আসলেই একটা ছিল ওর। মজার ব্যাপার হল – দুইপক্ষের কেউই ঈশিতার ক্ষতি করার চিন্তাও করেনি। তাই না? নিজের মেয়ের কখনই ক্ষতি করার চিন্তা করতে পারতেন না আপনি।
রাবেক চুপ করে থাকে তবুও, কাজেই বলতে থাকি আমি, ‘যতদূর মনে হচ্ছে – বয়েস হয়েছে আপনার – গডফাদারের প্লেসটা নিজের রক্তের সম্পর্কের কাওকে দিয়ে যেতে চান বলেই এত নাটক। আমি ঈশিতাকে উদ্ধার করতে গিয়ে মারা পড়লাম – আমার লাশটা লুকিয়ে ঈশিতাকে উল্টোসিধে বুঝিয়ে দিলেন – আপনিই হয়ে উঠতেন ওর একমাত্র অভিভাবক। সবই ঠিক আছে – যেটা মাথায় আসছে না – ছেলে হিসেবে আমাকেই আগে আপনার বেছে নেয়ার কথা। ঈশিতাকে কেন? ’
‘ইউ আর নট মাই ব্লাড।’ এই প্রথম মুখ খুলে রাবেক।
হাত কেঁপে ওঠে আমার।
‘ঠিকই শুনেছ, রবিন! নাকি তোমাকে এখন ইরফান বলে ডাকব? তুমি আমার ছেলে নও – কখনই ছিলে না।’ ঠাট্টার সুরে বলে মানুষটা। ‘তোমার বাবা আমার সাথে কাজ করত। তখনও মাফিয়া জিনিসটা শুরু হয়নি। তবে আমার মাথায় এরকম কিছু একটা আইডিয়ার বীজ যেটা, তা তখনই গজিয়েছিল। ছয়জন মিলে তখন এলাকার ঝামেলা সামলাতাম, কারও ঝামেলা হলে তাদের প্রটেকশন দিতাম নির্দিষ্ট অংকের বিনিময়ে আর অন্যান্য এলাকার সাথে লিংক তৈরীর কাজ শুরু করেছিলাম মাত্র। বিরোধী পক্ষ যে ছিল না ঠিক তা নয়। তাদের কারও হাতেই মারা গেল মাজেদ। তোমার বাবা। অন্ধকার গলি দিয়ে আসছিল। ওত পেতে ছিল ওরা। জবাই হয়ে যাওয়া তোমার বাবার লাশটা যখন তোমাদের বাসায় পৌঁছে দেই, স্বামীর শোকে ভেঙ্গে পড়া মেয়েটার প্রেমে তখনই পড়ে গেলাম। তোমার বয়স মাত্র তিন বছর তখন। ’
শুনতে থাকি আমি মূর্তির মত দাঁড়িয়ে।
‘তোমার মা অমত করেনি। যখন প্রস্তাবটা আমি পাঠাই, তার চারপাশে তখন শ্বাপদরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা নিরাপত্তা তার দরকার ছিল। নিজের জন্য যতখানি, তোমার জন্য আরও বেশি।’ বলে চলে গডফাদার, ‘এরপর জন্ম হল ঈশিতার। নেটওয়ার্ক মাত্র স্টাবলিশ করা শুরু করেছি আমি। ঈশিতার মা তখনই প্রথম ভুলটা করে ফেলে। ভুল মানুষের হাতে তুলে দেয় ড্রাগসের একটা চালান।’
কথা কোনদিকে এগুচ্ছে বুঝতে পেরে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল!
‘মাত্র একসপ্তাহ আগে আমি নতুন নিয়ম জারি করেছি। যেকোন ভুলের পরিণতি মৃত্যুদন্ড।’ মাথা নীচু করে রাবেক। ‘ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের হাতে মৃত্যুদন্ড দিতে হয় আমার। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সেদিন সেই সিদ্ধান্তটা না নিলে আজকের এই সাম্রাজ্য গড়ে উঠত না। ওভাবে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করাটাই ভীতি ছড়িয়ে দেয় প্রত্যেক সদস্যের মনে। আর জানোই তো ভীতি হল সকল ক্ষমতার উৎস।’ অমায়িক হাস রাবেক।
আর শোনার প্রয়োজন মনে করি না আমি। পিস্তলের বাট নামিয়ে আনলাম পাষণ্ডটার মাথায়।
হাত থরথর করে কাঁপে আমার।
‘ইউ বাস্টার্ড! ’ আরেকবার পিস্তলের বাট দিয়ে আঘাত করি ওর মুখে। ‘সারাটা জীবন আমি আমার মায়ের মার্ডারারকে খুঁজে বেড়িয়েছি। তাকে সামনে পেলে কি করব ভেবেছি!’ ছাদের দিকে মুখ তুলে উন্মাদের মত হাসি আমি। ‘ফাইনালি! আমার প্রার্থনা কবুল হয়েছে।’ গ্লকটা বুড়োর মাথায় ঠেকাই।
একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে আমার হাতটা চেপে ধরে ঈশিতা।
‘ভাইয়া, প্লিজ।’ ফিস ফিস করে বলল ও।
‘আর ইউ ব্লাইন্ড! হি কিল্ড মাই মাদার!’ ওর হাত সরিয়ে দেই আমি।
‘প্লিজ ভাইয়া!’ এবার একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে ঈশিতার চোখ থেকে, ‘যাই হোক আমি বাবার মৃত্যু দেখতে চাই না তোমার হাতে।’
সরাসরি তাকাই আমি রাবেকের চোখে।
কি আশ্চর্য।
অপলক চেয়ে আছে লোকটাও আমার চোখে।
সে চোখে মৃত্যুভীতি নেই!
কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই তাকিয়ে থাকি আমরা।
আমার হাত ধরে কাঁদতে থাকে ঈশিতা।
দীর্ঘ একযুগ পর যেন নড়ে উঠি আমি।
কপালের ঘাম তখন থুতনীতে এসে ঠেকেছে।
‘অ্যানাদার ডে, রাবেক!’ পিস্তলটা বড় একটা শ্বাস নিয়ে সরিয়ে ফেলি আমি। ‘উই’ল সীল দ্যা ডীল অ্যানাদার ডে।’
ঈশিতাকে এক হাতে ধরে ঘরটা থেকে বের হয়ে আসি আমি।
পেছনে বসে থাকে রাবেক দ্যা গডফাদার – এক চুল নড়ে না তার পেশী।

পরিশিষ্ট
বাইক থেকে শ্রান্ত পায়ে নেমে এলাম।
টলে উঠতেই আমাকে ধরে ফেলল ফারিহা।
‘তোমার কি হয়েছে?’ আমাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে ও।
‘ঈশিতাকে লুকিয়ে রাখতে হবে, ফারিহা।’
আর কিছু বলতে পারলাম না আমি।
আমার পৃথিবী দুলছে চারপাশে।
এতক্ষণ চুপ থাকা রিজভী আকন্দ মুখ খোলেন এবার, ‘ছেলেটার সাথে কথা বলতে চেয়েছি কতদিন। ওর তো শুধু পালাই পালাই। আজ যখন এসেই পড়েছ – এত সহজে যেতে দিচ্ছি না আর। ’
‘রাবেকের চোখের আড়াল করে রাখতে হবে ঈশিতাকে কয়েকদিনের জন্য, স্যার!’ সাবধানে নিজের পায়ে দাঁড়াই আমি। তবুও আমার হাত ছাড়ে না ফারিহা।
‘রাবেক তাহলে মিথ নয়?’ আমার টলোমলো অবস্থা আর শার্টের বাম দিক ভিজে থাকার দৃশ্য দেখেই পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করেন তিনি। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য যে সঠিক সময় এই মুহূর্তটি নয়, তা সফল ব্যবসায়ী বুঝতে পারলেন। কেবল বললেন, ‘ইউ আর আ ব্রেভ ইয়ং ম্যান, রবিন। আর মনে হচ্ছে চাইলেও এক সপ্তাহের মাঝে কোথাও নড়ার অবস্থা নেই তোমার। এই সময়টা আমার তত্ত্বাবধায়নে তোমরা থাকলে রাবেকের দৃষ্টিসীমা থেকে দূরে থাকতে পারবে অনায়াসে। আমিও শুনতে পারব তোমাদের অ্যাডভেঞ্চারের গল্পটা। ’ পরিবেশ হাল্কা করতে আলতো করে হাসেন তিনি।
আপত্তি করে লাভ নেই।
ফারিহা অলরেডী দুই হাতে আমাদের দুইজনকে ধরে হাঁটা শুরু করেছে।
‘সত্যি কি বাবা আমাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে?’ ফারিহার বাম দিক থেকে জানতে চায় ঈশিতা। তার কণ্ঠে ভীতি।
‘অবশ্যই।’ বলি আমি। ‘আমাদের দুইজনকেই তার দরকার। তোর নেতৃত্ব আর আমার সাথে পুরাতন হিসেব নিকেশ।’
‘এসব কথা সাতটা দিন পরে বললে হয় না?’ মৃদু ধমক লাগায় ফারিহা।
পারিবারিক চিকিৎসককে ফোন দিয়ে মাত্র মোবাইলটা পকেটে রাখলেন রিজভী আকন্দ।
পেছন থেকে ওদের তিনজনকে গলাগলি করে যেতে মুচকি হাসেন তিনি।

দ্য বিগেস্ট ডিল


পার্কের দূরবর্তী কোণে বসে ছিল জাহিদ আর ফারিহা।
জাহিদ ছেলেটার মাঝে কি যেন আছে। ওর আশেপাশে থাকলে নিজেকে অনেক নিরাপদ লাগে ফারিহার।
এই মুহূর্তে জাহিদের হাতে হাত তুলে দিয়ে ওর বুকে মাথা রেখে চুপচাপ বসে আছে ফারিহা। কিছু কিছু সময় কথা বলার প্রয়োজন হয় না। কথার চেয়ে নিস্তব্ধতাকেই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয়।
আড়াল থেকে ওদের দেখছিলাম।
এবার বুক ভরে একটা শ্বাস নিলাম। এ লাইনে আমার এটাই সবচেয়ে বড় কাজ।
আস্তে করে বেল্টের পেছনে আটকে রাখা গ্লক২৩ টা স্পর্শ করলাম।
জিনিসটার দাম আছে, তবে আমার স্পন্সরও মালদার পার্টি।
আড়াল থেকে বের হয়ে ওদের দিকে হেঁটে যাই আমি।
আমাকে দেখে মেয়েটা সরে যায় ছেলেটার বুক থেকে। দুইজনই সরু চোখে তাকিয়ে আছে। মনোযোগ পুরোপুরি আমার দিকে। আমার দৃষ্টি সরাসরি ফারিহার ওপর নিবদ্ধ – সেটাও একটা কারণ হতে পারে।
মেয়েটা পাঁচ ফিট ছয়। বড় বড় চোখদুটো সাথে কপালে এসে পড়া চুলগুলোতে একেবারে রাজকন্যার মত লাগছে।
‘টাকা আর আভিজাত্যের সাথে সৌন্দর্যের সম্পর্ক কোথায় কে জানে’- মনে মনে ভাবলাম।
দার্শনিকতার সময় কিংবা সুযোগ অবশ্য ছিল না। ইটস শো টাইম।
‘ফারিহা!’ গলায় যুগপৎ বিস্ময় ঢেলে বললাম। ‘তুমি এখানে কি করছ?’
একটা দীর্ঘ মুহূর্ত পরও আমাকে চেনার কোন লক্ষণ দেখা যায় না ফারিহার মুখে।
‘রিজভী আংকেল আমার বাবার বন্ধু। আমাদের দেখা হয়েছে আগে। ভুলে গেছ নাকি? আমি ইরফান।’
সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। তবে ছেলেটা ত্রস্ত্র পায়ে উঠে দাঁড়ায়। বয়েসে আমার জুনিয়র। লুকিয়ে প্রেম করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে এমন ভাব ওর চোখে মুখে।
‘ইরফান ভাই।’ হাত বাড়িয়ে দেয়। ‘আমি জাহিদ। ফারিহা আর আমি – ইয়ে আরকি।’
সব বুঝে ফেলেছি এভাবে একটা হাসি দিয়ে হাত মেলালাম ছেলেটার সাথে।
‘হু দ্য হেল আর ইউ?’ উঠে দাঁড়ায় ফারিহাও। ‘আমি কোন ইরফানকে চিনি না।’
অবাক হয়ে ওর দিকে ঘুরে তাকাল জাহিদ।
ঘাড়ের পেছনে মাঝারি আকারের একটা রদ্দা মারতেই চোখ উলটে যায় ছেলেটার। কাটা কলাগাছের মত পড়ে গেল মাটিতে।
চিৎকারটা চলে এসেছিল ফারিহার মুখে – ঝটপট পিস্তলটা ওর মুখ বরাবর ধরতেই ওটা গিলে ফেললো সে। প্রেমিকযুগলকে ধন্যবাদ – নির্জন একটা জায়গা বেছে নিয়েছিল ওরা। দেখার কেউ নেই।
‘আমার সাথে হাঁটো। যদি প্রাণের মায়া থাকে।’ কড়া গলায় ওকে বললাম।
আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফারিহা।
‘আর শোন মেয়ে – তোমাকে জীবন্ত ধরে নিয়ে যাওয়াটা আমার জন্য খুব জরুরী এমনটা ভাবলে ভুল করবে। তোমাকে মেরে ফেলার জন্যই যথেষ্ট টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য টাকার অংকটা ডাবল হয়ে যাচ্ছে বলেই এত কথা। নাহলে চোখের মাঝ দিয়ে বুলেট ঢুকিয়ে একটা ছবি তুলে চলে যেতাম। সুতরাং – কোন ধানাই পানাই নয়। বুঝেছ?’
একটা কথাও বলল না মেয়েটা। গা থেকে জ্যাকেটটা খুলি আমি। হাতের ওপর ফেলে এমনভাবে ফেলে রাখলাম যেন পিস্তলটা ঢাকা পড়ে যায়। ডানহাতে আড়াআড়ি ভাবে ওটা ধরে ফারিহাকে আবার বললাম, ‘আমার হাত ধরে হাঁটবে এখন।’
নড়ল না মেয়েটা একচুল। ‘নাউ!’ চাপা ধমক দেই। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
এই অজ্ঞান দেহের আশে পাশে বেশিক্ষণ দাঁড়ালেই সমস্যা। অবশ্য মেয়েটির ইতস্তত করার পেছনের কারণও ওটাই। বয়ফ্রেন্ডকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে তার বাঁধছে।
ফারিহা আমার বাম হাত জড়িয়ে ধরল, জ্যাকেটের নিচে আড়াআড়ি ডান হাতে ধরা পিস্তলটা একেবারে ওর বুক বরাবর থাকে। এটা বুঝতে অবশ্য ওরও কোন সমস্যা হচ্ছে না। কাজেই ভদ্র মেয়ের মতই হেঁটে যায় ও আমার সাথে। মেইন রোডে উঠতেই বাতাস কেটে ছুটে আসে গাড়িটা।
আস্তে করে ব্রেক কষে আমাদের সামনে।
পেছনের সীটের দরজা খুলে ফারিহাকে ঢুকিয়ে দেই।
তারপর নিজেও উঠে বসি আমি।
ড্রাইভিং সীট থেকে রাসেল হাস্যোজ্জ্বল মুখে একটা সিগারেট ধরায়।
‘ইজি মানি, হাহ?’ আমার উদ্দেশ্যে বলে ও।
‘আনন্দে ডিগবাজি না খেয়ে ঠিকমত ড্রাইভ করো, গর্দভ।’ নিশ্চিত হতে পারি না আমি। ‘সেফ হাউজে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত আমরা কেউই নিরাপদ না।’
তবে আমার ধমকে হাসি মোছে না রাসেলের মুখ থেকে।
মেয়েটার দিকে চোখ রাখি আমি। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে ও। এই মেয়ের নার্ভ আছে- মনে মনে স্বীকার না করে পারলাম না। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে হাউ-কাউ লাগিয়ে দিত।
অবশেষে এক যুগ পরে আমাদের গাড়ি সেফ হাউজে এসে পৌঁছুলো। আমার অন্তত তাই মনে হল। জ্যাকেট হাতে ফেলে আবারও সেভাবে হেঁটে উঠে যাই আমরা।
বাসাটা আর সব বাসার মতই। ফারিহাকে কিডন্যাপ করার জন্য তিনতলাটা গত চারমাস ধরে ভাড়া নেয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, দোতলা আর চারতলাও ভাড়া নেয়া আছে গত চারমাস থেকে – মালদার পার্টির কাজ – যথেষ্ট প্রোফেশনাল এরা। কাজেই কারও সন্দেহ না তুলে ওকে সহজে রাখা যাবে এখানে।
রাসেলটাকে গাড়ি সহ ভাগিয়ে দিয়েছি।
বিশাল বেডরুমটায় এসে ঢুকি আমি আর ফারিহা। ওর কাঁধ থেকে ব্যাগটা সরিয়ে টেবিলে ছুঁড়ে মারি। একাকী অচেনা একজন কিডন্যাপারের সাথে এক রুমে ঢুকে ফারিহার মুখে ভীতির ছাপ পড়ল কি না খেয়াল করার চেষ্টা করলাম।
উঁহু – ভীতি নয়; অসহায়ত্বের ছাপ পড়েছে। এই মেয়ে কঠিন ধাতুতে গড়া।
বিশাল বিছানাটার এক প্রান্তে একটা হ্যান্ডকাফ লাগানো। এক প্রান্ত আটকে আছে বিছানার সাথে। আরেকপ্রান্ত খোলা।
ইশারা করে ওটা দেখালাম। ‘বাম হাতে পড়ে ফেল।’
চুপচাপ তাই করল ফারিহা। অবশ্য হাতে পড়ার আগে এক মুহূর্ত ইতস্তত করেছে। তারপর আমার ডান হাতের অকম্পিত পিস্তলটার দিকে তাকিয়ে ওর মুখের অসহায়ত্ব আরেকটু বেড়েছিল। কিছু না বলে বাম হাতে আটকে ফেলে ও হ্যান্ড কাফটা।
টেবিলে খোলা ল্যাপটপটা অন করি আমি এবার। স্কাইপ থেকে একটা নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে ভিডিও কল দিলাম। ওপাশের ক্যামেরা অবশ্য বন্ধ করা। অর্থাৎ দেখা যাবে না কাকে কল করলাম – যদিও ওপাশ থেকে আমাদের দেখতে পাচ্ছে স্পষ্ট!
‘কাজ শেষ?’ ওপাশ থেকে ভরাট গলা ভেসে আসে।
‘হুম।’
‘মেয়েটাকে দেখাও।’
ওয়েব ক্যাম ঘুরিয়ে বিছানায় বন্দী ফারিহাকে দেখালাম।
‘গুড। ই-মেইল চেক করে দেখ।’
অফলাইনে চলে গেল ওপাশের আগন্তুক। কম কথার মানুষ। ই-মেইল চেক করে দেখলাম বিস্তারিত নির্দেশ দেয়া হয়ে গেছে।
ফোনকলটা দিতে হবে রাত বারোটায়। কলেজ ফাঁকি দিয়ে প্রেম করার হ্যাপা বুঝুক মেয়ে! এত বড়লোকের মেয়ে হয়ে আদাড়ে-বাঁদাড়ে প্রেম করছিল এক চালচুলোহীন ফকিরের সাথে। উচিত শিক্ষা হয়েছে!
পাঁচটার সময় কলেজ ছুটি, ছয়টার মাঝে তার বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা যোগাযোগ করব আরও ছয় ঘন্টা পর। এটা কিডন্যাপিং-এর একেবারে ব্যাসিক – যাকে বলে অ আ ক খ।
কিডন্যাপিংটা হয়ে যাওয়ার পর পরিবারকে দুশ্চিন্তায় ডুবে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দাও। তারপর যোগাযোগ কর। ওই মুহূর্তে যা চাওয়া হবে দিয়ে দেয়ার জন্য একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকে পরিবার।
‘খিদে পেয়েছে?’ জানতে চাইলাম ফারিহার কাছে।
মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলে ও।
সেই তখন থেকে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি মেয়েটা।
‘খিদে পেলে বলবে।’ আর কি বলব বুঝতে পারলাম না।
‘আপনার বোনটা কোন ক্লাসে পড়ে?’ হঠাৎ – একেবারে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল ফারিহা।
এতটাই চমকে যাই আমি – আমার হাত কেঁপে ওঠে।
এক সেকেন্ড পরেই নিজেকে সামলে নেই অবশ্য। তবে পরিবর্তনটা চোখে পড়ে গেছে ফারিহার।
নিজের ওপর রাগ হতে থাকে আমার। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আমার নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা ছিল।
‘শাট আপ!’ দ্রুত এগিয়ে পিস্তলটা ওর মাথায় চেপে ধরি। ‘এরপর থেকে আমি প্রশ্ন করব যদি দরকার হয়। একটা প্রশ্ন না – বোঝা গেছে?’
বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে মেয়েটা।
সে দৃষ্টিতে ভীতি নেই – আহত একটা দৃষ্টি।
চোখ সরিয়ে নিলাম।
আমি কিডন্যাপার মানুষ – এত অনুভূতির কোন দাম নেই আমার কাছে।
চোখ সরালেও পিস্তল সরালাম না।
‘মোবাইল কোথায়?’
‘ব্যাগে।’ আর্দ্র গলায় বলে মেয়েটা।
কান্নাকাটি শুরু করলে বিপদ। মেয়েমানুষের ট্যা-ফোঁ একেবারেই অসহ্য আমার কাছে।
পিস্তলটা কোমরে গুঁজে টেবিল থেকে মোবাইলটা বের করলাম।
সুইচড অফ রাখতে হবে। তার আগে একটা ছোট্ট অ্যাপ ইনস্টল করে দেয়া আমার দায়িত্ব। বাকিটা মালদার পার্টি দেখবে। এই ফোনের ক্লোন এরপর গাজীপুরে রওনা হবে। পুলিশ কখনোই ডিভাইস ট্র্যাক করে এই বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারবে না। কাঁচা কাজের লোক ওরা নয়।
অথচ ফোনটার লক স্ক্রিন খোলার সাথে সাথে আমার ভ্রু কুঁচকে যায়।
মোবাইলের ডিসপ্লের ওপরে একটা ব্লিপ।
দ্রুত ফিরে যাই মেয়েটার কাছে। ‘এটা কি?’
‘আমি কি জানি?’
কষে একটা থাপ্পড় দিলাম মেয়েটার গালে।
ফরসা গাল সাথে সাথে টকটকে লাল হয়ে গেল।
‘হোয়াট – ইজ – দিস?’ দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করলাম।
‘যা ইচ্ছে কর তোমরা …’ এই প্রথম চোখ থেকে একফোঁটা পানি পড়ে ফারিহার, ‘আমার জাহিদ আমাকে খুঁজে বের করবেই।’
সাথে সাথেই ঘন ঘন কলিং বেল পড়ে বাসায়।
ঝট করে পিস্তলটা বের করে ফেলি আমি।
জিপিএস ট্র্যাকার দিয়ে ট্র্যাক করে কি পুরো পুলিশ ফোর্সটাই চলে এসেছে আমাদের পেছনে?


দেয়ালের আড়াল নিয়ে ধীরে ধীরে মেইন গেটের দিকে যাই আমি।
কান বরাবর তুলে রেখেছি পিস্তলটা।
কলিংবেল আবারও বেজে ওঠে – বেশ অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে বেল দাবানো লোকটার আচরণে।
আলতো করে ছিটকিনিটা সরিয়ে দরজার হাতলে টোকা দিয়ে খুলে ফেলি দরজা।
আমি এখনো দেয়ালের আড়ালেই আছি। মেপে মেপে নিঃশ্বাস ফেলছি।
হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল দুইজন মানুষ।
হার্টটা লাফিয়ে এসেছিল গলার কাছে। আরেকটু হলেই গুলি বেড়িয়ে যেত!
রাসেল আর আরেকটা ছেলে।
রাসেল দ্রুত দরজাটা লাগিয়ে দেয়। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলি আমি।
অন্য ছেলেটাকে আমি চিনি।
জাহিদ।
*
‘আর কইস না!’ কপাল থেকে ঘাম মোছে রাসেল। ‘আমি বিল্ডিংয়ে ঢুকতছি– এই পোলারে দেখলাম মোবাইলে চোখ রাইখা আমার লগে লগে ঢুকতেছে। সন্দ হইল। কানে বয়রা দিয়ে মোবাইলটা লইলাম, বাকিটা বাইর হইয়া গেল আরকি দুই থাবড়ে।’
‘দারুণ কাজ দেখিয়েছিস।’ পিঠ চাপড়ে দেই ওর। তাকালাম জাহিদের দিকে। ‘তারপর? কি খবর লিটল হিরো? চলো – কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়া লাগে যে!’
ভয়ে ছোটখাট হয়ে গেছে বেচারার মুখ।
ওই মুখে একটা মাঝারি মাপের ঘুষি বসালাম। এটা অ্যাডভান্স।
তাড়াতাড়ি মুখ খুলতে সাহায্য করবে ওকে।
বেডরুমে জাহিদের কলার ধরে ঢুকতেই ফারিহা ওর রক্তাক্ত মুখ দেখে আৎকে উঠলো।
‘পুলিশ আসছে।’ জাহিদ ফারিহাকে অভয় দিয়ে বলল। ‘ওদের খবর দিয়েই ঢুকেছি।’
চট করে ফারিহার দিকে তাকালাম।
মেয়েটার মুখে আশার কোন লক্ষণ দেখলাম না।
জাহিদকে ঘুরিয়ে আরেকটা ঘুষি মারলাম ওর মুখে। ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল ছেলেটা।
‘প্লিজ!’ অনুনয় ঝরে পড়ে মেয়েটার চোখমুখে। ‘প্লিজ ওকে মারবেন না।’
‘শাট আপ!’ রুম কাঁপিয়ে ধমক দেই আমি। ‘রাসেল, প্লায়ার্স গরম কর। এই শালা মিথ্যা বলছে। পুলিশকে খবর দিয়ে ঢোকেনি। তবুও সাবধানের মার নেই।’
‘প্লায়ার্স দিয়ে কি করবেন?’ ফারিহার চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে ভয়ে।
‘হারামজাদার আঙ্গুলের নখ তুলব একটা একটা করে। তখন মুখ দিয়ে সত্য কথা হড়হড় করে বের হবে।’
‘প্লিজ – এই কাজ করবেন না।’ কেঁদে ফেলে এবার মেয়েটা। ‘ও মিথ্যা বলেছে। ও মিথ্যা বললে আমি বুঝি। পুলিশে খবর দেয় নি ও। প্লিজ ওকে আর কষ্ট দেবেন না।’
মেঝেতে পড়ে থাকা জাহিদ মুখ তুলে ফারিহাকে ধমক দেয়, ‘তুমি চুপ কর ফারিহা।’ ওখান থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমাকে যতখুশি টর্চার করুন – তাতে এখন আর পুলিশ আসা ঠেকাতে পারবেন না।’
দুইহাতে ওর কলার জাপ্টে ধরে দাঁড় করালাম ওকে। পেটে মাঝারি আকারের একটা ঘুষি বসাতেই বাঁকা হয়ে গেল জাহিদ।
‘আর কোন কথা না। শুধু আমি যা বলব তাই উত্তর দেবে। বোঝা গেছে?’
এই সময় রুমে ঢুকে রাসেল। ‘প্লায়ার্স গরম হচ্ছে।’ জানায় ও।
একেবারে আচমকাই নড়ে উঠে জাহিদ।
আমার পেটে দুবার হাত চালিয়ে মাথায় একটা জোরদার ঘুষি মারল ছোকরা।
এতটুকু ছেলের গায়ে এত জোর থাকে কি করে? মাটিতে ছিটকে পড়তে পড়তে ভাবলাম।
এই সময় সশব্দে ভেঙ্গে পড়ল ঘরের দূরবর্তী কোণার ফুলদানীটা।
রাসেল, জাহিদ এমনকী ফারিহাও অবাক হয়ে তাকায় ওদিকে।
হঠাৎ ব্যাপারটা বুঝে ফেলি আমি – আতঙ্কে শীতল হয়ে এল রক্ত।
‘গেট ডাউন!’ চেঁচিয়ে উঠি রাসেল আর জাহিদের উদ্দেশ্যে।
সেই সাথে গড়িয়ে এসেছি একপাশের দেওয়ালের দিকে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পুরো খাটটাকে পায়ের ধাক্কায় কাত করে দিচ্ছি – আর্তচিৎকার দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে ফারিহা।
রাসেল আর জাহিদ আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে – মরিয়া হয়ে আবার চেঁচালাম, ‘গেট ডাউন ড্যাম ইট!’
হঠাৎ – একেবারেই হঠাৎ রাসেলের মুখমন্ডলের অর্ধেকটা গায়েব হয়ে যায়। রক্ত আর মগজ ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়ল চারদিকে।
জাহিদ ততক্ষণে পরিস্থিতি বুঝে ফেলেছে। ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় ও মেঝের দিকে, জানালার গোবরাটের আড়াল নেবার ইচ্ছে। পরের বুলেটটা ওর মাথা মিস করলেও ঘাড়কে পেয়ে গেল। ঘাড় আর গলা অর্ধেক দ্বিখন্ডিত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে যায় জাহিদ। জবাই করা গোরুর মত তড়পাচ্ছে।
পায়ের ধাক্কায় খাটটাকে ততক্ষণে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। ফারিহার হ্যান্ডকাফ পড়ানো হাতটা চাপা পড়ে গেছে এর নিচে। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলেও থেমে গেছে ও এখন।
মাত্র ছয়ফিট দূরে রক্তাক্ত বয়ফ্রেন্ডকে দেখতে পাচ্ছে ও।
ঘরটায় এখন শুনশান নীরবতা।
‘ইরফান ভাই।’ ঘড়ঘড়ে গলায় বলে ওঠে জাহিদ, ‘পুলিশ ডাকতে পারিনি আমি। একাই এসেছিলাম …’
গলা থেমে যায় প্রায় ওর। কল কল করে রক্ত পড়ছে ক্ষত থেকে।
‘ফারিহাকে…’ বলার চেষ্টা করে ও কিছু একটা।
ক্রল করে গিয়ে ওর হাত ধরলাম। ‘আ’ম সরি ফর এভরিথিং, জাহিদ। আ’ম রিয়েলি …’
‘ফারিহাকে দেখে রাখবেন…’ কোনমতে বলে জাহিদ।
চোখদুটোর মাঝে প্রাণের আলো নিভে যায় ওর।
বুকে হেঁটেই খাটের ওপাশে ফারিহার দিকে চলে যাই। এখানে তাও খাটটা কাভার হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে।
হ্যান্ডকাফের চাবি বের করে আস্তে করে ফারিহাকে বলি, ‘তোমার হাত খুলে দিচ্ছি এখন। পাশের বিল্ডিং-এ একটা স্নাইপার আছে। পুলিশের লোক নয় ওরা। কাজেই, হাত খুলে দিলেই দৌড় দেবে না। বুকে হেঁটে বেরিয়ে যাব আমরা। বুঝতে পেরেছ?’
ফ্যাকাসে মুখে চেয়ে থাকে মেয়েটা। চেঁচাচ্ছে না। ভয় পাচ্ছে এমনও নয়। একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে।
আফটার শক ট্রমা।
যা আছে কপালে – ওর হাত খুলে দিতে থাকি আমি।
নিজের এবং মেয়েটার জীবিত থাকাটাই এখন আমাদের ট্রাম্প কার্ড।
এখান থেকে যতদ্রুত সম্ভব বেড়িয়ে পড়তে হবে। তারপর ছাড়াতে হবে ঘটনার প্যাঁচ।
যা ঘটছে চারপাশে – তার সাথে বড় কোন কিছুর সম্পর্ক না থেকেই যায় না।
বড় কিছুটা কি সেটাই বের করতে হবে আমাকে।
মেয়েটার হাত ধরে ধীরে ধীরে ক্রল করে মেইন গেটের দিকে এগিয়ে যাই আমি।
গ্যারাজের মটরসাইকেলটার কাছে জ্যান্ত পৌঁছতে পারলে হয়…


মেঝেতে পড়ে থাকা রাসেল আর জাহিদের রক্তে আমাদের জামার সামনের দিকটা ভিজে আছে। ফারিহার চুলের একপাশ রক্ত লেগে থকথক করছে।
ওই অবস্থাতেই আস্তে করে দরজা খুলে বের হলাম। সিঁড়িঘরটা অন্য অ্যাংগেলে থাকায় আশা করছি – স্নাইপারদের নাগালের বাইরে এটা। যত বড় বান্দাই হোক, আমাদের একটা ঘরকে কাভার করতে দুটো-তিনটে স্নাইপার রাখার কথা নয়।
‘উঠে পড়।’ ফারিহার হাত ধরে টেনে তোলা লাগল। এখনো মরা লাশের মতো তার আচরণ।
বের হয়ে সাবধানে তাকালাম সিঁড়িঘরের চারপাশে। কোন নড়াচড়া নেই।
‘জাহিদকে নিয়ে আসি?’ আমার দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের সাথে বলে ফারিহা।
মেয়েটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে আছে।
দোষ দিতে পারলাম না। এক দিনের জন্য যথেষ্ট হয়ে গেছে ওর জন্য।
কোন কথা না বলে নিষ্ঠুরের মত ওকে টেনে নিয়ে লিফটে উঠে পড়লাম। মেয়েটা একটা হাত অবুঝ শিশুর মতো পেছনে আসা পথের দিকে বাড়িয়ে রেখেছে। জাহিদকে নিয়ে আসতে চায়।
তার কার্যক্রম নিষ্ঠুরের মতো উপেক্ষা করলাম, পিস্তলটা বের করে ফেলেছি।
লিফটটা গ্রাউন্ড লেভেলে নামতেই প্রস্তুত হলাম। বাইরে আরও আততায়ী থাকতে পারে।
দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেলেও গ্যারেজে কাওকে দেখা গেল না।
আজ সকালে নিজের মটরসাইকেলটা গ্যারেজে ইমার্জেন্সী এস্কেপের জন্য এনে রাখায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হল।
‘ফারিহা, লিসেন!’ মেয়েটার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করি আমি, আমার দিকে বিহ্বলদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে ও। ‘তোমার বাবার শত্রু আছে। আমাকে ভাড়া করা হয়েছিল তোমাকে কিডন্যাপ করতে। কিন্তু এখন তারা সম্ভবতঃ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে ওরা।’
যদিও যতদূর বুঝতে পারছি – ফারিহার ক্ষতি করার ইচ্ছে এদের নেই। এরা সম্ভবতঃ তৃতীয় পক্ষ।
আমাদের কষ্টার্জিত জিনিসটা সহজে নিজেদের করে নিতে চায়।
মুক্তিপণের টাকাটা কম নয়। একমাত্র মেয়ে কি না!
দশ কোটি টাকা!
এর জন্য আরও অনেক পার্টি হন্যে হয়ে থাকতেই পারে!
‘আমার জাহিদকে কেন মারল ওরা।’
প্রশ্ন নয় ঠিক – কি বলছে সেটা মেয়েটা নিজেও জানে কি না সন্দেহ হল আমার।
জাহিদের প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা বোধ আমারও আছে। ঠিক সময়ে আমার মুখে ঘুষি মেরেছিল ছেলেটা। নইলে এতক্ষণে ঠান্ডা মাংস হয়ে পড়ে থাকতাম – সন্দেহ নেই। কিন্তু মেয়েটার এ বাড়ি থেকে সরাতে না পারলে আমরা কেউ-ই রাত পর্যন্ত বেঁচে থাকবো না।
‘পে অ্যাটেনশন!’ এবারে চেঁচিয়ে উঠি। কেঁপে ওঠে মেয়েটা। ‘এই বিল্ডিং-এ থাকা প্রতিটি সেকেন্ড আমাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে। এই মুহূর্তে কেটে না পড়লে তোমার লাশটাও পড়ে থাকবে এখানে। আমি এখন এই মটরসাইকেলে করে বেড়িয়ে যাব। তুমি আমার সাথে আছ?’
কিছুটা বাস্তবে ফিরে এল যেন মেয়েটা। চারপাশে তাকাচ্ছে।
ভাল লক্ষণ। এতক্ষণ একেবারে মোমের পুতুল হয়ে ছিল।
মটরসাইকেল স্টার্ট দিলাম।
নিজে থেকেই এগিয়ে এসে আমার পিছে বসে পড়ল ফারিহা।
ছোট গেইটটা খোলা গ্যারেজের।
আমি নিশ্চিত ওদিকে স্নাইপার তাক করে বসে আছে আততায়ী!
কিন্তু – ঝুঁকিটা নিতে হচ্ছে, গড়গড় করে উঠল ইঞ্জিন ।
বুলেটের মত বেড়িয়ে এলাম আমরা পিচ্চি গেইটটা দিয়ে।
ভালোমানুষের মত মুখ করে তিনজন কোটধারী এগিয়ে আসছিল বিল্ডিংটার দিকে। আমাদের ছিটকে বেড়িয়ে আসতে দেখে একযোগে কোটের ভেতরে হাত ভরে ফেলল তিনজনই। ভেতর থেকে কি অমূল্য সম্পদ বের করে আনতে যাচ্ছিল সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করলাম না।
ডান হাত হ্যান্ডেল থেকে সরিয়ে নিমেষে কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে কয়েকটা গুলি পাঠিয়ে দিলাম ওদের দিকে। এদিক ওদিক ঝাঁপিয়ে পড়ে কাভার খুঁজছে তিন ভদ্রলোক – এই ফাঁকে বাম দিকের গলি ধরে ঢুকে পড়লাম আমরা।
কাঁধের কাছে খামচি দিয়ে ধরে আছে ফারিহা।
আমার মনে হল, দশ কোটি টাকা কাঁধ খামচে ধরে আছে আমার।
রক্তে ভেজা জামা নিয়ে তীব্রগতিতে বাইক ছোটাটে থাকা যুবক আর একটু আগে শোনা গুলির শব্দ – এলাকাবাসী দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিতে বেশি সময় নিল না মোটেও। এদিক ওদিক সরে যেতে থাকে সবাই আমাদের বাইক থেকে। একছুটে হতশ্রী বাড়িটার সামনে থামলাম আধঘন্টা পর।
গত ছয়মাস ধরে এটাই আমার হাইডআউট ছিল। এখন অবশ্য আর নিরাপদ নয়। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়েই কেটে পড়তে হবে। বেশি সময় পাওয়া যাবে না। ওই সেইফ হাউজের ঠিকানা জানলে আততায়ীর দল আমার হাইডআউটের কথাও জানে – এটা নিশ্চিত।
রাস্তার মানুষজন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। তাদের একেবারেই পাত্তা না দিয়ে মোটরসাইকেল থেকে নেমে এলাম আমরা।
ফারিহাকে নিয়ে সোজা দোতলায় উঠে যাই।
অ্যাডভান্স তিনলাখ টাকার ব্রীফকেসটা খামচি দিয়ে তুলে নিলাম। তারপর বেডরুম থেকে আমার একটা টি-শার্ট এনে ছুঁড়ে দেই ফারিহার দিকে।
‘রক্তে ভেজা কাপড় পরে দৌড়াদৌড়ি করা যাবে না।’ ব্যাখ্যা দিলাম ওকে। ‘চেঞ্জ করে ফেলো।’
কোন কথা না বলে টি-শার্টটা নিয়ে বাথরুমে চলে গেল ফারিহা।
দ্রুত আমার শার্টটা খুলে আরেকটা শার্ট চাপাই গায়ে।
পিস্তলটা টেবিলের ওপর রেখে কিচেনে গিয়ে ঢুকলাম তারপর। একটা বিস্কুটের টিন থেকে বের করলাম নয়টা ম্যাগাজিন। ফায়ার পাওয়ার এতখানি-ই সম্বল।
‘আরও কয়েকটা রাখতে পারলে ভালো হত…’ মনে মনে ভাবি আমি।
রুমে ফিরে এসে ব্যাকপ্যাকে টাকাগুলো ভরে তার ওপর ম্যাগাজিন সাতটা রাখলাম। দুটো ভরলাম কোটের পকেটে।
কাজে লাগতে পারে।
পেছনে খুট করে একটা শব্দ হতেই ফিরে তাকালাম আমি। বেরিয়ে এসেছে ফারিহা।
টি-শার্টে চমৎকার দেখাচ্ছে তাকে। কিন্তু এইমাত্র টেবিল থেকে তুলে নেয়া গ্লকটার আমার বুক বরাবর তাকিয়ে থাকার দৃশ্যটা মোটেও চমৎকার লাগল না।
‘ইরফান-’ ঠান্ডা গলায় বলল মেয়েটা। ওর কণ্ঠে কিছু একটা ছিল, বরফ হয়ে যাই আমি। ‘এটা তোমার আসল নাম কি না আমি জানি না। তবে শোন – আমার মনে হয় না আর কোথাও যাওয়ার দরকার আছে। তোমাদের কিডন্যাপিং প্ল্যান ভেস্তে গেছে। এখন আমি যেদিকে ইচ্ছে সেদিকেই যেতে পারি। আর হ্যা – টিশার্টটার জন্য ধন্যবাদ।’
‘ফারিহা-’ খুব সাবধানে মুখ খুলি আমি, ‘বোঝার চেষ্টা কর। বাইরে তুমি নিরাপদ না।’
‘হাহ!’ খুব মজা পেয়েছে এভাবে বলে মেয়েটা। ‘তোমার সাথে আমি নিরাপদ?’ হঠাৎ খেপে ওঠে মেয়েটা – ‘ইউ বাস্টার্ড!’
নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেছি আমি। ‘শুধু মাত্র তোর জন্য খুন হয়ে গেছে আমার জাহিদ। তুই যদি আমাকে তুলে না আনতি এখনও নিঃশ্বাস নিত ও। আই শূড কিল ইউ টু! ইউ মাদারফা-’
গালিটা সম্পূর্ণ দেয়ার আগেই আমাদের চারপাশে নরক ভেঙ্গে পড়ে।
বাসার দরজার ঠিক বাইরে বিদঘুটে একটা ভোঁতা শব্দ – সেই সাথে অনেকগুলো ফুটো হয়ে গেল দরজাতে।
সাইলেন্সড সাব-মেশিনগান!
চমকে উঠে ওদিকে ঘুরে যায় ফারিহা। বদ্ধ জায়গাতে কানে তালা লেগে যায় আমার।
ফারিহার কাঁপা হাত থেকে গুলি বেরিয়ে গেছে! একটা দুটো নয়- চোখ বন্ধ করে ছাত তাক করে ম্যাগাজিন খালি করে ফেললো ফারিহা!
দ্বিগুণ উৎসাহে দরজাকে মোরব্বা বানায় বাইরের ওই ওরা।
এক থাবা দিয়ে ওর থেকে আমার হাতে নিয়ে নিলাম পিস্তলটা।
ম্যাগাজিন সড়াৎ করে বের করে আরেকটা ঢুকিয়ে ফেলতে না ফেলতেই হুড়মুড় করে দরজাটা ভেঙ্গে পড়ে কারও লাথিতে।
পোশাকে-আশাকে ভদ্রলোক টাইপ দুই ষন্ডার চেহারা দেখতে পেয়ে আর দেরী করলাম না। তরমুজের মত মাথা দুইটায় দুটো বুলেট ঢুকিয়ে দিতেই বিল্ডিং কাঁপিয়ে পড়ে গেল দু’জনে।
পেছনে আরও লোক আছে – জানি।
তবে এরা ঢোকার আগে তিনবার ভেবে ঢুকবে।
ঝটপট ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে তুলে, আরেকহাতে ফারিহাকে টেনে এনে শেষপ্রান্তের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম।
ওকে ধরে বারান্দায় নিয়ে আসলাম। গ্রিলের সাথে ছোট জানালাটা খুলে আগে থেকেই লাগিয়ে রাখা দড়িটা খুলে দিলাম তারপর, যে পেশায় আছি আমি, ‘এস্কেপ রুটে’র কথা একটা সবসময় ভেবেই রাখতে হয়।
এই বিছানায় ঘুমাই প্রতিদিন – তবে বারান্দার গ্রিলের দড়িটা পরীক্ষা করতে কোন রাতে ভুল হয় না আমার। আজ কাজে দিল।
ভয়ে ছিলাম ফারিহা নামতে পারবে কি না।
ভয়টা সত্য করে বারান্দায় দড়িটা ধরে ইতস্তত করতে থাকে মেয়েটা।
এই সময় বেডরুমের দরজাতেও ছিদ্র হওয়া শুরু করল। আমার শেষ না দেখে ফিরে যাবে না – এই প্রতিজ্ঞা করে এসেছে এরা। আর দশ কোটি টাকা তো আমার সাথেই।
প্রাণের মায়া বড় মায়া – আমার চেয়েও দ্রুত নেমে পড়ল ফারিহা। নিচে পড়ে ককিয়ে ওঠে ও।
ব্যাগটা নিচে ফেলে দিয়ে ওকে ধরে তুললাম, ‘আর ইউ ওকে?’
ব্যাথার চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করে মাথা দোলায় মেয়েটা। গোড়ালি মচকেছে ওর – বুঝলাম।
সময় নষ্ট করা যাবে না – ব্যাকপ্যাকটা তুলে ছুটলাম। বাসার পেছনে এই মাটিগুলো আসলে ড্রেনের কাভার।
মোটামুটি ছয়ফিট গ্যাপ রেখে পরের বিল্ডিংটা তোলা হয়েছে। অর্থাৎ দুটো বিল্ডিং-এরই পিছন দিকে এই ড্রেনের জন্য রাখা ছয়ফিট জায়গা। সামনের দিকে যেন প্রত্যেকেই রাস্তা পায় সে ব্যবস্থা।
ফারিহার হাত ধরে ছোট লোহার বেড়াটার দিকে ছুটে যেতে থাকি আমি।
আজ সকালেই এই মেয়েটাকে আমার বন্দী করে রাখার কথা ছিল – মুক্তিপণের টাকা না পেলে মাথায় একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেয়ার দায়িত্ব ছিল।
কে বলবে এখন আমাদের দেখে?


রাত আটটা।
হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে সাবধানে চারপাশে তাকাই।
আমার হাইডআউট থেকে বেরিয়ে এসে রাতের আঁধারে এই হোটেলে উঠেছি আমরা।
আসার পথে পেছনে ফেউ লেগে নেই নিশ্চিত করে খেয়ে নিয়েছি। সারাদিন আমার বা ফারিহার পেটে দানাপানি পড়েনি। এরপর মেয়েটা তার অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়েছে।
খাটে চাপা পড়ে হাত মচকে গেছিল এতক্ষণের উত্তেজনায় বোঝেনি সে। আর পায়ের ধাক্কা সামলাতে ওর আরও সপ্তাহ খানেক অন্তত লাগবে।
হোটেলে ওঠার আধ ঘন্টার মধ্যেই ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে যায় মেয়েটা। এরকম এক স্নায়ুবিধ্বংসী অভিজ্ঞতার পর কেউ যে ঘুমাতে পারে তা আমি ওকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
আস্তে করে বাইরে থেকে লক করে দিয়ে আসি ওকে। টেবিলে নোট রেখে গেছি – দেড় ঘন্টার মাঝেই ফিরে আসব আমি।
বাইরে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগে। যখন পেছন থেকে ছুটে আসা বুলেটের ভয় না থাকে।
একটা ল্যাপটপ কিনে বাংলালায়নের কাছে গিয়ে মডেম নিয়ে আসলাম। ব্যাকপ্যাকে সব সময় অল্টারনেটিভ কাগজপত্র থাকেই। বেশিরভাগই জাল অবশ্য। ফিরে আসার সময় ফারিহার জন্য কয়েকটা ড্রেস কিনে আনলাম। মেয়েদের সাথে মেলামেশার তেমন সুযোগ হয়নি। সাইজে এসব জামা ওর হবে কি না কে জানে!
*
মাত্র ঘুম থেকে উঠে বিছানায় উঠে বসেছে ফারিহা, আড়মোড়া ভাঙছিল, এই সময় রুমে ঢুকি আমি।
ঘুম ঘুম চোখেও মেয়েটাকে পরীর মত লাগছে।
‘ঘুম কেমন হল?’ টেবিলে হাতের ব্যাগগুলো নামিয়ে জানতে চাইলাম আমি।
‘ইরফান?’ কোমল গলায় ডাকে ফারিহা। ‘যদিও তোমার আসল নাম এটা না…’
‘কিছু বলবে?’
‘থ্যাংকস ফর সেভিং মাই লাইফ।’ হাতের দিকে তাকাল মেয়েটা। বাঁ হাতের কব্জির কাছে ফুলে আছে।
তাকিয়ে থাকলাম আমি। আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলে ও, ‘টুয়াইস।’
কিছু একটা বলতে গেছিলাম – কিন্তু সুযোগ না দিয়ে আবারও বলে, ‘অ্যান্ড আই হেইট ইউ ফর ব্রিংগিং মি ইন দিস মেস।’
হেসে ফেললাম।
‘তোমার জন্য কয়েকটা ড্রেস এনেছি। দেখো তো লাগে কি না।’ ওর দিকে প্যাকেটগুলো ছুঁড়ে দিলাম।
ওগুলো ধরে আস্তে করে উঠে যায় ফারিহা।
ল্যাপটপটা অন করে নেট কানেক্ট করলাম।
এবার আমার টার্ন।
স্কাইপে ঢুকতেই পাওয়া গেল কন্ট্যাক্টকে।
‘দিস ওয়াজ নেভার অ্যাবাউট দ্যা মানি, ওয়াজ ইট?’ ওই পক্ষ ভয়েস কল রিসিভ করতেই ঠান্ডা গলায় জানতে চাই আমি।
‘হাহ হাহ হা।’ ওপাশ থেকে বেশ হাসিখুশি গলাতেই বলে ওঠে অচেনা মানুষটা। ‘ইরফান – অথবা যাই হোক তোমার নাম – ঘটে বুদ্ধি আছে দেখছি।’
‘ছেঁদো কথা রাখুন। সেইফ হাউজের কথা আর কারও জানার কথা নয়। আগেভাগেই স্নাইপার নিয়ে অ্যামবুশ করে থাকাটা তো আরও অসম্ভব – এক যদি না আপনার কাছ থেকে ইনফরমেশন পায়।’
‘হুমম – কিন্তু ওসব কিছুই হওয়ার কথা ছিল না।’ গম্ভীর হয়ে যায় গলাটা। ‘দোষ সম্পূর্ণ তোমাদের। থার্ড পার্টি ঢুকিয়েছ তোমরাই। তোমার আর তোমার সহযোগী ছাড়া সেইফ হাউজের লোকেশন কেউ জানবে না – এটাই শর্ত ছিল।’
বুঝলাম – জাহিদের কথা বোঝাচ্ছে ক্লায়েন্ট।
‘ওটা একটা ঝামেলা ছিল।’ মাথায় ঝড়ের বেগে চিন্তা চলছে আমার। ‘তবে আমাদের দুইজনকে সরিয়ে দেয়ার প্ল্যানটা আপনার ছিলই। জাহিদ এর মাঝে না আসলেও তাই করতেন। সম্ভবত রাত বারোটায় কলটা দেয়ার পরই আমাদের পাট চুকে যেত। কেন? সাধারণ কিডন্যাপিং এটা নয় – আমাকে নির্বোধ ভাববেন না। গোটা ব্যাপারটা আমি জানতে চাই। মনে রাখবেন, মেয়েটা এখনও আমার কাছে।’
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পেছনে বিছানায় বসে থাকা ফারিহাকে দেখিয়ে দিলাম ক্যামেরা ঘুরিয়ে।
এক মুহূর্ত নীরব থাকে ওপাশে।
‘ঠিক আছে। তোমাকে জানানো ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই আমার অবশ্য।’ অবশেষে মুখ খুলে কুটিল ক্লায়েন্ট। ‘দিস ওয়ান ইজ নট অ্যাবাউট কিডন্যাপিং – নট অ্যাবাউট মানি। দিস ওয়ান ইজ অ্যাবাউট রেইপ অ্যান্ড মার্ডার।’
বিস্ময়ের আঘাতটা এতটাই জোরে আসল, ভাষা হারালাম আমি।
‘ইয়ংম্যান! ঠিকই শুনছ তুমি।’ ওপাশ থেকে নিশ্চিত করল ক্লায়েন্ট। ‘তোমাদের দায়িত্ব ছিল কেবল কিডন্যাপ করে ফোনে টাকাটা চাওয়া। শোনা যায় – কিডন্যাপিং-এ এই শহরে বেস্ট হল ফ্যান্টম ইরফান। ফ্যান্টম কেন বলা হয় সেটাও সবাই জানে। তুমি অদৃশ্য থাকতে জানো। তোমার কিডন্যাপিংগুলো হয় শতভাগ নিঁখুত। কিন্তু মার্ডার জিনিসটা তোমার রক্তে নেই – প্রোফাইলে যা পড়েছি এতে সহজেই বোঝা যায়। নেহায়েত আত্মরক্ষার প্রয়োজন না হলে কারও দিকে অস্ত্র তোলেনি ফ্যান্টম ইরফান। কিছু নৈতিক নিয়ম মেনে চল তুমি, যা একজন কিডন্যাপারের মাঝে থাকতে নেই। তোমাকে দিয়ে যে রেইপ হবে না সেটা বোঝার জন্য অবশ্যই ইরফান-বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না।’
‘ইউ আর ড্যাম রাইট মি. হুয়েভার ইউ আর!’ টেবিলে কিল বসাই আমি। ‘এই ডীল ক্যান্সেল করছি আমি। ফায়ারফাইটটুকু জাস্ট বিজনেস মেনে নিয়ে হয়ত এগিয়ে যেতাম আমি ডীল অনুযায়ী। কিন্তু যেটা আপনি চাচ্ছেন সেটা আমার তত্ত্বাবধায়নে হবে না। আমি কাউকে তুলে আনলে তাকে অক্ষত ফিরিয়ে দেই, দ্যাট’স মাই রেপুটেশন। আপনার বিকৃত মানসিকতার জন্য তো আর আমার রেপুটেশন নষ্ট করবো না। এরপরের বাচ্চাটাকে তুলে আনলে তখন পাগলা কুকুরের মতো আমাকে গুলি করে মারবে পুলিশ।’
‘তোমাদের দুইজনের পাওয়ার কথা ছিল দুই কোটি টাকা, ইরফান।’ ওপাশ থেকে একঘেয়ে গলায় বলে মানুষটা। ‘তুমি পেতে এককোটি। তোমার পার্টনার মারা গেছে। নতুন প্রস্তাব দিচ্ছি আমি – এই কাজের জন্য দুই নয়, সম্পূর্ণ দশ কোটি টাকা পাচ্ছ তুমি। কোন পার্টনারের সাথে শেয়ার করতে হবে না এক আধুলিও। সহজ কাজ ইরফান। ভিডিও অন রাখতে হবে পুরোটা সময়। তারপর কাজ শেষে কেবল একটা বুলেট। অথবা যে পদ্ধতিতে তুমি চাও মার্ডারটা করতে।’
‘কিপ ইয়োর মানি।’ চোয়াল শক্ত হয়ে যায় আমার।
‘তোমাকে আধ-ঘন্টা সময় দিলাম।’ ওপাশ থেকে বলে আবারও। ‘তারপর তোমার সিদ্ধান্ত জানাও।’
লাইন কেটে গেল।
পেছনে ঘুরে ফারিহাকে দেখতে পেলাম আমি।
পুরো কথাবার্তাই শুনেছে ও নিঃসন্দেহে। আমাকে তাকাতে দেখে এই প্রথমবারের মত ওর চাউনীতে ভয় উঁকি দিল। ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম।
দশ কোটি টাকা। এত টাকা আমি জীবনেও চোখে দেখিনি।
আবার ভেবে দেখতে থাকি পুরো বিষয়টা। এটাই হতে পারে আমার এই জীবনের শেষ কাজ। এরপর এই ঘৃণ্য এবং সেই সাথে ঝুঁকিপূর্ণ পথ থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।
দশ কোটি টাকা ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলে কিডন্যাপিং ছেড়ে দেয়াটা সহজ।
নিরাপদ একটা জীবন সব অপরাধীরই কাম্য – ভাগ্যগুনে সেই সুযোগ আমার হাতে চলে এসেছে।
কাজটা কঠিন না মোটেও।
পরীর মত সুন্দর একটা মেয়েকে ধর্ষণ করতে হবে।
সেটা ভালো মত ভিডিও করে রাখতে হবে যাতে মেয়েটার চেহারা দেখা যায়।
তারপর যেভাবে আমার মন চায় মেরে ফেলতে হবে মেয়েটাকে।
একেবারেই ছেলেখেলা। ভিডিও জমা দিয়ে দিলেই আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা পড়বে দশ কোটি টাকা।
মাথা নিচু করে রুমের মাঝে পায়চারী করছি।
হাতে পিস্তলটা নিয়েই।
ফারিহা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাড়া খাওয়া শিকারের মতো অভিব্যক্তি তার।
ওর দিকে ফিরলাম, ‘তোমার বাবার ব্যাপারে জানা লাগবে আমার, ফারিহা।’
‘কেন?’ ঠান্ডা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় মেয়েটা। ‘যতদূর বুঝলাম ব্যাপারটা আমাকে নিয়ে।’
ওর কাটা কাটা উত্তর গায়ে মাখলাম না।
‘বলে যাও। বাবার প্রফেশনাল লাইফ সম্পর্কে যা যা জানো বলে যাও, প্লিজ।’ ওকে তাড়া দেই আমি।
মুখ খোলে মেয়েটা।
বলে যায় যতদূর পর্যন্ত ও জানে।
শুনি আর নিরাশ হই আমি। আর দশটা শিল্পপতির মতই জীবনযাত্রা ছিল রিজভী আকন্দের।
আধঘন্টা প্রায় পেরিয়ে এসেছে। বিচ্ছিরি শব্দে স্কাইপের ইনকামিং কলের শব্দ ভেসে আসছে কম্পিউটার থেকে।
ভয়েস কলটা রিসিভ করলাম।
‘কি সিদ্ধান্ত নিলে?’
‘আ’ম নট ডুইং দিস।’ স্পষ্ট উত্তর দিলাম ক্লায়েন্টকে।
‘জানতাম আমি।’ খোশমেজাজেই বলে লোকটা।
‘গুড নাইট মিস্টার।’ কল কেটে দিতে চাই আমি।
‘গুডনাইট, ইরফান।’ স্বাভাবিকভাবেই বলে লোকটা। ‘জাস্ট আ ফ্রেন্ডলি অ্যাডভাইস – তোমার ই-মেইল আইডিতে একটা ভিডিও পাঠানো হয়েছে। ওটা চেক করে দেখো।’
বেহুদা বক বক করে লাভ নেই।
কলটা কেটে দিলাম আমি।
‘হাত থেকে ফেলে দিলে কেন দশ কোটি টাকা?’ বিছানা থেকে স্বস্তি আর বিস্ময়ের সাথে বলে ফারিহা।
‘আমার নিজস্ব কিছু নীতি আছে – যেগুলো আমি ভাঙ্গি না কখনও।’ ই-মেইলে ঢুকি কৌতুহল মেটাতে।
‘বাহ।’ উঠে দাঁড়িয়ে আমার পাশে দাঁড়ায় মেয়েটা। ওর শরীরের মিষ্টি গন্ধ আমার নাকে তীব্রভাবে লাগছে। ‘নীতিবান ক্রিমিনাল?’
আমার শরীর শক্ত হয়ে যায়।
ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ল্যাপটপের স্ক্রীনে তাকায় ফারিহা।
ছোট্ট একটা ভিডিও পাঠিয়েছে আমার ক্লায়েন্ট।
একটা মেয়েকে টান টান করে বেঁধে রাখা হয়েছে বিছানায়।
পাশেই টেবিলে কার্ড খেলছে চারজন ষন্ডা।
‘হু ইজ শী?’ ফিস ফিস করে বলে ফারিহা।
‘শী’জ মাই সিস্টার।’ কাঁপা গলাটা আমার – আমি নিজেই চিনতে পারি না।


‘মত পাল্টেছেন বলে মনে হচ্ছে?’ খ্যাক খ্যাক করে হাসে ওপাশের গলাটা।
‘ঈশিতাকে কোথায় পেয়েছ?’ গলা ঠান্ডা রাখইতে চাইলেও পারি না।
‘আজ দুপুরে যে গানফাইট তুমি দেখালে – আমি মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। একটু তলা খুঁড়ে ফ্যামিলি হিস্টোরি বের করতেই হল তোমার। ও তেমন কিছু না আমার জন্য। তোমার আসল নামও এখন আমি জানি, ইরফান।’
‘ডীলটা কি?’ গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করি আমি।
‘ইজি।’ খুবই আমোদের সাথে বলে ক্লায়েন্ট। ‘ফাক হার।’
চুপ করে থাকি এপাশে আমি।
‘ওহ কাম অন!’ অধৈর্য হয়ে বলে ওপাশের কন্ঠটা। ‘আর ইউ ইনকম্পিটেন্ট অর হোয়াট? এটাও ভেঙ্গে বলতে হবে না নিশ্চয় – হয় তুমি ফারিহার সাথে কাজটা করবে – নাহয় তোমার বোনের সাথে একই কাজ করা হবে। ফেয়ার, কি বল?’
ইচ্ছে করছিল মানুষটার গলা খালি হাতেই ছিঁড়ে ফেলতে।
‘ওকে।’ বড় করে শ্বাস টানি আমি। ‘ওকে! আমি করছি কাজটা।’
‘গুড বয়।’ স্বস্তির সাথে বলে ওপাশের মানুষটা। ‘তোমার জন্য সুখবর আছে ইরফান, এখন তুমি নিজেকে ভলান্টিয়ার করতে অতি উৎসাহী আমি জানি – তবুও কাজ শেষে তোমার অ্যাকাউন্টে দশ কোটি পৌঁছে যাবে। আর তোমাকে দুই ঘন্টা সময় দেয়া হল। এরমধ্যে রিপোর্ট এবং ভিডিও চাই আমি। নয়তো -’
‘ডীল।’
খটাস করে ল্যাপটপের ডালা নামাই আমি।
বিছানায় হাঁটুদুটো জোড়া লাগিয়ে ওখানে থুতনী ঠেকিয়ে বসে আছে ফারিহা।
আমার দিকে তাকিয়ে থাকা বড় বড় চোখ দুটোতে ভয়।
রুম জুড়ে পায়চারী করি আমি।
ঈশিতা ছাড়া এই পৃথিবীতে কেউ নেই আমার।
ওর কিছু হতে দেব না আমি।
কিন্তু বিনিময়ে যা করতে হবে – তা আমার নীতি বিরুদ্ধ। জানোয়ারটা আমার ব্যাপারে একটা কথা ঠিকই ধরেছিল, এ আমাকে দিয়ে সম্ভব না।
ফারিহার বাবারও একমাত্র জীবিত আত্মীয় ফারিহাই। ভাগ্য আজ আমাদের এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে – চাইছে একপক্ষের স্যাক্রিফাইস। পুরো ব্যাপারটা আবারও ভেবে দেখতে থাকি আমি।
ফারিহার বাবার প্রতি তীব্র আক্রোশ নিয়ে কেউ একজন চাইছে তার মেয়ের কিডন্যাপের টাকা পুরোটা তো নিতেই, এবং মেয়েটারও চূড়ান্ত ক্ষতি করতে।
এখানে টার্গেট মোটেও ফারিহা নয়। তাহলে তাকে মেরে ফেলা হত না।
ফারিহার বাবাকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করতে চায় কেউ।
আরেকটু ভাবতেই মজাটা বুঝে গেলাম আমি – পুরো ব্যাপারটার সাথে টাকার কোনই সম্পর্ক নেই।
দশ কোটি টাকা মুক্তিপণ হিসেবে আমাকে ধরতে বলা হয়নি। কারণ টাকা নেবার জন্য কিছু করার নির্দেশনা এবার আমার জন্য নেই। একটা ফোনকল পর্যন্ত না!
বরং ধর্ষণ এবং খুনের জঘন্য কাজটা শেষ করলেই আমাকে দশ কোটি টাকা নিজের পকেট থেকেই দিতে চাইছে এখন আমার ক্লায়েন্ট।
পুরো ব্যাপারটা শুধু ব্যাক্তিগত নয় – পুরো ব্যাপারটার একটাই মানে থাকতে পারে।
আমরা রিজভী আকন্দের সেই শত্রুকে খুঁজছি – যার মেয়েকে ধর্ষণ এবং খুন করা হয়েছে।
ছুটে এসে ল্যাপটপ খুললাম আবারও।
সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ দিলামঃ Rizvee Akanda Scandal
কোন রেজাল্ট পেলাম না।
‘শিট … কাম অন …’ বুঝতে চেষ্টা করি আমি। ‘দেয়ার মাস্ট বি সামথিং …’
আবারও সার্চ দেইঃ Bangladeshi industrialist’s daughter raped & killed…
বেশ কয়েকটা সার্চ রেজাল্ট পেয়ে যাই এবার।
দ্রুত পড়ে দেখি।
শিল্পপতি ফারুক সিদ্দীকির মেয়েকে মাত্র ছয় মাস আগে কিডন্যাপ করা হয়।
দশ কোটি টাকা মুক্তিপণ চাওয়ার পর দিয়ে দেন ফারুক সিদ্দীকি।
কিন্তু মেয়ে বন্যাকে ফিরে পান না এতে।
এক সপ্তাহ পর মেয়েকে পাওয়া যায়।
ধর্ষিত এবং মৃত।
মিলে গেছে সবকিছুই! শুধু আরেকটা ব্যাপার দেখা দরকার।
আবারও সার্চ দেইঃ Industrialist Faruque Siddiqie – video results
কিছু ভিডিওতে তার সাক্ষাৎকার পাওয়া যায়।
গলাটা আমার অতি পরিচিত।
আজ সারাদিন এর সাথেই ডীল করেছি আমি!
‘দ্যাটস আওয়ার গাই, ফারিহা।’ লাফিয়ে উঠি আমি। ‘তুমি থাকো। আমি বের হচ্ছি।’
ল্যাপটপে ভেসে থাকা ভিডিওটার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে মেয়েটা।
‘ফারুক আংকেল বাবার সবচেয়ে পুরোনো বন্ধু। আমিও আসছি তোমার সাথে।’
*
রেন্ট-আ-কার থেকে ভাড়া করা গাড়িটা নিয়ে ছুটে চলেছি আমরা ফারুক সিদ্দিকীর বাসার দিকে।
‘আই কান্ট বিলিভ দিস, ইরফান।’ পাশ থেকে মাথা নাড়ায় ফারিহা।
‘পুরো ব্যাপারটার সাথে তোমার সম্পর্ক কি?’ মাথা নাড়াই আমি। ‘বন্যাকে চিনতে কেমন তুমি?’
‘আমরা সেই ছোটবেলা থেকে বন্ধু ছিলাম। কিন্তু কয়েক মাস আগে এই অ্যাকসিডেন্ট – ’ মুখ ঢাকে ফারিহা।
‘তোমার বাবার জড়িত থাকার কোন সম্ভাবনা আছে এতে?’ সাবধানে জানতে চাই আমি। বাবার চরিত্রে কলংক দেওয়া হচ্ছে – ক্ষেপে যাওয়া স্বাভাবিক।
‘অ্যাবসার্ড!’ তীব্র গলায় বলে ফারিহা। ‘আমার বাবাই টাকার ব্যাপারটা দেখেন ওই সময়। ফারুক আংকেল তখন দেশের বাইরে। কিডন্যাপাররা টাকার যে ডেডলাইনটা বেঁধে দিয়েছিল তার মাঝে দেশে ফিরে আসা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ওরা টাকাটা চেয়েছিল ম্যানুয়ালি। নগদ টাকা – একজন মানুষ ড্রাইভ করে ভ্যানটাকে পার্ক করে সরে চলে আসবে। টাকা নিয়ে যাওয়ার পর সব ঠিক থাকলে একদিন পর বন্যাকে ছেড়ে দেয়ার কথা ছিল।’
‘কোন সম্ভাবনা, তোমার বাবা টাকাটা কম দিয়েছিলেন। দশ কোটির কম?’
‘কেন দেবেন?’ মাথা নাড়ায় ফারিহা। ‘টাকাটা ব্যাপার ছিল না তখন। বন্যাকে আমার মতই স্নেহ করতেন বাবা।’
‘কিন্তু ডেফিনিটলি তোমার বাবাকেই দায়ী মনে করেছেন ফারুক সিদ্দিকী। এতে কোন সন্দেহ নেই। মুক্তিপণের দশ কোটি টাকা – আর তোমার ব্যাপারে নির্দেশ – সবকিছু খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে এখন।’
চুপচাপ ড্রাইভ করি কিছুক্ষণ।
‘আচ্ছা – ফারুক সিদ্দিকীর সিকিউরিটি কেমন থাকে?’
‘সিকিউরিটি বাদ দাও। আমাকে দেখলে গেইটে আর কিছু বলবে না। দারোয়ানরা আমাকে চেনে। আন্টির সাথে আমি বন্যার ঘটনার পরও বেশ কয়েকবার দেখা করেছি, নিয়মিত যাওয়া হয়েছে তখন। বন্যার অভাব আন্টি আমাকে দেখে কিছুটা পূরণ করতেন… ’
‘এই রাত বারোটাতেও?’
‘গভীর রাতেও কয়েকবার গেছি। আন্টিই আমাকে ডেকে পাঠাতেন মাঝে মাঝে, অসময়ে। ঠিক যেদিন একমাস হয় বন্যার লাশ পাওয়ার আমাকে ফোন করে রাতে তাঁর সাথে থাকার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এমন বেশ কয়েকবার হয়েছে। গেটে সন্দেহ করবে না।’
‘ফারুক সিদ্দিকীর কানে না দিয়েই ওর বাসায় ঢোকা যাবে তাহলে বলছ?’
‘অনায়াসে। আর আংকেলের সাথে আমার দেখা হয়েছে খুব কম। উনি সবসময় বাইরের কাজেই ব্যস্ত থাকেন। কাজেই ঢোকার জন্য আমাদের ওকে জানাতে হবে – এরকম না। আমার মনে হয় না আমাদের দেখলে দারোয়ান বাড়ির ভেতর ফোন করবে।’
‘দারুণ।’ মনে পড়ায় বলি, ‘জানতে চেয়েছিলে। ঈশিতা ক্লাস নাইনে পড়ে।’
ফারিহার দিকে অন্যমনস্ক হয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেই। ‘দুপুরে আমার বোনের ব্যাপারে কিভাবে জানলে?
‘তোমার চোখ দেখে।’ হাসে একটু ফারিহা। ‘আমার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলে সে দৃষ্টি বোনের দিকেই দেয় মানুষ। আর অচেনা একজন ভিক্টিমের দিকে কেন এভাবে তাকাবে তুমি? নিঃসন্দেহে তোমারও একটা বোন আছে।’
‘প্রে ফর হার, ফারিহা।’ জীবনে প্রথমবারের মত কাওকে এই কথা বললাম আমি। ‘প্রে ফর হার।’


গৃহ পরিচারিকা তাহমিনা ঘুম ঘুম চোখে আমাদের ভেতরে নিয়ে চললেন।
রাত বারোটা বাজলেও পরিচিত সিকিউরিটি গার্ডরা ফারিহাকে দেখে আর সন্দেহ করেনি।
অবশ্য মিসেস সিদ্দিকীকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের আগমনী বার্তা।
এতটুকু করা হবে সেটা স্বাভাবিক।
আমি কেবল আশা করছি, মিসেস ফোনটা ধরার পর ‘মিস্টার’কে জানাবেন না।
ফারিহা আর তাহমিনা বক বক করে যাচ্ছে।
‘আন্টির শারীরিক অবস্থা’ নিয়ে রীতিমত উদ্বিগ্ন কি না ফারিহা!
‘আংকেল কোথায়?’ কথার ফাঁকে জানতে চাইল ফারিহা।
‘স্টাডিতে ঢুকে বসে আছেন। রাতের বেলায় ঘুমান নাকি উনি। সারাক্ষণ আছেন তো কাজ নিয়ে।’
এতটুকুই শোনার দরকার ছিল আমার।
‘সরি ফারিহা।’ বাড়িটায় পা রাখার পর এই প্রথম কিছু বললাম আমি।
তাহমিনার ঘাড়ের বিশেষ জায়গায় একটা মাপমত কোপ দিতেই তাহমিনা আন্টিরও চোখ উলটে গেল।
ধীরে সুস্থে ইনাকে শুইয়ে দিয়ে ফারিহাকে ধরলাম। ‘স্টাডিটা কোথায়?’
ডিরেকশন দেয় আমাকে ও।
‘তুমি আন্টিকে নিয়ে স্টাডিতে চলে আসো। কুইক।’ ওকে ঠেলা দেই আমি।
‘আমি কি বলে এদিকে আনব আন্টিকে?’ অবাক হয় ফারিহা।
‘যা পারো – যেভাবে পারো – আন্টিকে স্টাডিতে চাই আমার।’
আজ্ঞা পালন করতে চলে যায় ফারিহা ওপরের দিকে।
আমি ফারিহার নির্দেশনা অনুযায়ী স্টাডিরুমের দিকে আগাই।
মিনিট পাঁচেকের মাঝে পেয়েও গেলাম।
মোবাইলটা বের করে সময় দেখি – ডেডলাইনের আর মাত্র একত্রিশ মিনিট বাকি।
ভেবেছিলাম ভেতর থেকে লাগানো থাকবে।
কিন্তু নব ঘুরাতেই খোলা পাওয়া গেল।
বিশাল রুমটার শেষ মাথায় একটা টেবিলের সামনে একটা ঝকঝকে ডেস্কটপের সামনে বসে আছেন শিল্পপতি ফারুক সিদ্দিকী।
*
আস্তে করে ইনার মাথায় পিস্তলটা ঠেকালাম।
চেয়ারটা ঘুরিয়ে আমার দিকে ফিরলেন ধীরে সুস্থে। আমাকে দেখে চেহারায় প্রথমে ভীতি , তারপর একে একে বিস্ময়, আতংক এবং সবশেষে স্বস্তি ফুটে ওঠে।
‘ইম্প্রেসিভ।’ হাসিমুখে বলে উঠলেন তিনি। নিজেকে আবারও ফিরে পেয়েছেন। ‘ফ্যান্টম ইরফান কেন বলা হয় তোমাকে আজ আমার কাছে স্পষ্ট। সাবাশ, ছেলে।’
‘মি. সিদ্দিকী।’ বরফ শীতল গলায় বলি আমি। ‘ডীলটা আরও সহজ করে দিচ্ছি আমি আপনার জন্য।’
আগ্রহের সাথে তাকিয়ে থাকেন ফারুক সিদ্দিকী।
‘আপনার জীবনের বিনিময়ে আমার বোনের জীবন। সসম্মানে ঈশিতাকে এখানে আপনার বাড়িতে ফিরিয়ে আনার ব্যাবস্থা করবেন আপনি। আমরা কি একমত?’
‘হাহ হাহ হা।’ মাঝারি হাসি দিলেন শিল্পপতি। ‘আমাকে গুলি করে মেরে ফেলে কি লাভ? তোমাকে দেয়া দুই ঘন্টার আর…’ ঘড়ি দেখেন তিনি, ‘আটাশ মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ড অ্যান্ড কাউন্টিং … তারপর চারজনকে বলে দেয়াই আছে – এর মাঝে আমি তাদের ফোন না দিলে ওদের কর্তব্য কী।’
‘সেজন্যই আপনি ওদের এখন ফোন দিচ্ছেন।’ পিস্তলটা নাচাই আমি।
‘পিস্তল সরাও তো!’ বিরক্ত হয়ে বলেন আবার, ‘আমাকে মেরে ফেললেও রেজাল্ট পাল্টাচ্ছে না – জানো তুমি। এর চেয়ে আমার দোতলায় একটা ফাঁকা রুমে তুমি ফারিহাকে নিয়ে ঢুকে যাও। তোমার কাজ শেষ করার জন্য আটাশ মিনিট যথেষ্ট। লেটস গো ব্যাক টু দ্যা ফার্স্ট ডীল।’
স্টাডি রুমের ভেতর ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়েন এই সময় একজন মোটাসোটা প্রৌঢ়া।
পিছে ফারিহা।
ইনি নিঃসন্দেহে মিসেস সিদ্দিকী।
আমাকে স্বামীর মাথায় পিস্তল ধরে থাকতে দেখে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না তিনি।
‘ফারুক!’ বাজপাখির মত হুংকার দেন মহিলা, ‘আমি কিছু প্রশ্নের জবাব চাই।’
‘সত্য-বলা-ছাড়া-আর-কোন-ভাল-উপায়-পেলাম-না’ টাইপ একটা লুক দেয় আমাকে ফারিহা।
‘ইউ বেটার অ্যানসার হার, মি. ফারুক।’ পিস্তলের খোঁচা দেই আমি ইনার মাথায়।
‘ফারিহাকে কিডন্যাপ করানোর জন্য তুমি নাকি এই ছেলেকে ভাড়া করেছ?’ চেঁচান আবার মহিলা, ‘এটা কি সত্যি?’
‘অফ কোর্স এটা সত্যি!’ দাঁড়িয়ে যান ফারুক সিদ্দিকী রাগে আর উত্তেজনায়। ‘তুমি কি মনে কর আমার একমাত্র মেয়ের এই পরিণতির জন্য যেই লোকটা দায়ী তাকে আমি কিছুই বলব না?’
‘রিজভী তোমার ভালো চেয়েছে আজীবন, ফারুক। তোমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও। ওরা… ফারিহা, আমাদের মেয়ের মতো! কন্যাশোকে পাগলামী করছ তুমি।’ বোঝানোর চেষ্টা করেন মিসেস সিদ্দিকী। ‘বন্যার টাকাটা নিজে ডেলিভারী দিয়ে এসেছিল ও। তার মেয়েকে তুমি -।’
‘টাকা ডেলিভারী দিয়ে বেশ করেছে!’ ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে হুংকার দেন ফারুক সিদ্দিকী। ‘উইদ-আ–ট্রাকিং–ডিভাইস!’
থমকে যাই আমরা সবাই।
‘ডীলটা ছিল দশ কোটি টাকার বিনিময় আমার বন্যাকে আমি ফিরে পাব। কিডন্যাপাররা বার বার বলেছিল তাদের দিকে বিন্দু মাত্র অ্যাপ্রোচ নেয়া হলেই ডীলটা আর থাকবে না। আমি নিজে বার বার বলে দেই রিজভীকে। বাট – হি ট্রাইড টু বি আ হিরো! কিডন্যাপারদের ধরার জন্য একটা জীবন বাজি ধরেছিল ও – বন্যার জীবন! পুরা রিস্কটা কার ওপর ছিল? আমার বন্যার ওপর। পুরো ধাক্কাটা কার ওপর দিয়ে গেল? আমার ওপর! আমার নিষ্পাপ মেয়েটার ওপর! সো ডোন্ট ট্রাই টু টেল দ্যাট আই অ্যাম রং! ’
বলে যান ফারুক সিদ্দিকী। ‘আমি ওই লোকটাকে একেবারে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিতে চাই – দশ কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে মেয়েকে সুস্থ স্বাভাবিক দেখার আশা করার পর রেইপড অ্যান্ড মার্ডারড মেয়েকে ফিরে পেতে তার কেমন লাগে। ফেয়ার!! ইজনট ইট?’
আড়চোখে ঘড়ি দেখি আমি।
আর মাত্র ষোল মিনিট বাকি আছে।
প্রচন্ড জোরে আঘাত হানি ফারুক সিদ্দিকীর মাথায়।
কপাল কেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। আৎকে ওঠেন মিসেস সিদ্দিকী।
‘আপনাদের প্রতি আমার সিমপ্যাথি আছে মিসেস সিদ্দিকী।’ তাঁকে অভয় দেই। ‘কিন্তু আপনার সাইকোপ্যাথ স্বামী একটা ফোন কল না করলে আমার বোন ঈশিতার পরিণতি ঠিক বন্যার মতই হতে যাচ্ছে। আই অ্যাম সো সরি, মিসেস সিদ্দিকী।’
এগিয়ে এসে ভদ্রমহিলার মাথায় পিস্তলটা ঠেকাই।
‘আমি দশ গুণব। এর মাঝে আমার ফোনকলটা চাই। আপনার এই বাসায় ঈশিতাকে সসম্মানে জীবিতবস্থায় এনে দেওয়া হবে। নাহলে মিসেস সিদ্দিকীর মাথায় গুলি করে আপনাকেও ধ্বংস করে দেব মি. সিদ্দিকী । এটাই আমাদের ডীল।’ পকেট থেকে নতুন কেনা মোবাইলটা বের করে দেখাই। ‘ঢোকার আগেই রেকর্ডিংটা অন করে নিয়েছিলাম, স্যার। আপনার জবানবন্দী অনুযায়ী দুটি কিডন্যাপিং, দুইটি খুন এবং একটি অ্যাটেমপ্ট টু মার্ডারের আসামী আপনি। বাবার নিষ্ফল আক্রোশ অনুভব করেছেন, কিন্তু ভাইয়ের মরিয়া প্রচেষ্টা দেখেননি। ভুল মানুষের সাথে টক্কর লাগিয়েছেন আপনি মি. সিদ্দিকী। এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় … ’
ঝড়ের বেগে গুণে যাই আমি। সাইকোটা ভাবার জন্য বেশি সময় পাবে না এতে।
‘ডোন্ট শূট! ডোন্ট শূট।’
‘সাত … আট … নয় …’
ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোনটা তুলে নেন শিল্পপতি।
অক্ষরে অক্ষরে আমার দাবী পৌঁছে দেন ওপাশে।
পিস্তলটা সরিয়ে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি একটা আমি।
*
গাড়ি ছুটে চলেছে আমাদের।
বেরিয়ে পড়েছি আমরা ফারুক সিদ্দিকীর বিশাল বাড়িটার ত্রিসীমানা থেকে।
পেছনের সীটে ঈশিতা কাঁপছে থরথর করে – ওকে ধরে রেখেছে ফারিহা।

পরিশিষ্ট
গাড়ি থামালাম আস্তে করে। ঘুমিয়ে পড়েছে ঈশিতা।
নেমে এলাম আমি।
বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় ফারিহা। নেমে আসে ও-ও।
‘এটা আমাদের বাসা। চিনলে কিভাবে?’
‘ভুলে যাচ্ছ।’ হাসি আমি। ‘তোমাকে কিডন্যাপ করতেই আজ সকালে বের হয়েছিলাম আমি।’
‘চৌদ্দ ঘন্টার মাঝে কতকিছু তাই না?’ বিষন্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় ফারিহা।
অপরূপ ওই বড় বড় চোখদুটোতে ডুবে মরতে ইচ্ছা করল আমার।
‘জাহিদের খুনীকে ছেড়ে দিলাম আমরা। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা কিছু হতে পারে না।’ বিষন্ন মুখটা আরও বিষন্ন হয়ে যায় ওর।
‘উহু। আমরা ছেড়ে দেইনি।’ বলি আমি, ‘শুধু একটা জবানবন্দী তার কাছে হস্তান্তর করেছি। আরও ট্রেইল থাকতে বাধ্য। আজকের সব ঘটনা মি. রিজভী যখন জানবেন – আশা করি সেসব ট্রেইল উনি বের করে আনবেন।’
‘ইরফান?’ কেমন করে জানি ডাকে আমাকে ফারিহা। আমার বুকে ঝড় ওঠে।
‘আমার আসল নাম ইরফান না, ফারিহা।’ আস্তে করে ওকে জানাই। ‘আমার নাম রবিন।’
মিষ্টি একটা হাসি ফুটে ফারিহার মুখে, ‘রবিন, তোমাকে সারাদিনের জন্য অসংখ্য থ্যাংকস।’
‘ধন্যবাদ তোমার পাওনা, ফারিহা। আমি ঈশিতাকে হারাতাম আজ তুমি না থাকলে।’
টুক করে আমার গালে চুমু খায় ফারিহা। ‘ধন্যবাদের বোঝা একে অন্যের ঘাড়ে থামানো বন্ধ করে ভেতরে এসো। বাবার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেই।’
মাথা নাড়ি আমি, ‘আরেকদিন, ফারিহা।’
হাত বাড়িয়ে দেয় ফারিহা, ‘মোবাইল নাম্বার লিখে দাও। মোবাইল তো তোমার সেইফ হাউজে ফেলে এসেছি।’
মোবাইল নম্বরটা ওর হাতে লিখে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসি আমি। স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে যাই হোটেলের দিকে।
পেছনে মিষ্টি একটা হাসি মুখে নিয়ে তাকিয়ে থাকে ফারিহা।
রুমটা ভাড়া আছে এখনও। আজ রাতটা ঈশিতাকে ওখানেই রাখার ইচ্ছে আমার।
কানে ভাসছে জাহিদের শেষ বাক্যটা, ‘ফারিহাকে দেখে রাখবেন…’
আকাশের দিকে তাকাই, ‘জাহিদ, কথা দিচ্ছি, মায়াবতী এই মেয়েটাকে দেখে রাখব আমি।’

খারাপ মেয়ে

মেয়েটার কাটা গলা থেকে এখনও দমকে দমকে রক্ত বের হচ্ছে।
ফর্সা গলাটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার পর ক্যানভাসে আঁকা অদ্ভুত এক ছবিটার মত মনে হতে থাকে দৃশ্যটাকে। একটু আগে বের হতে থাকা রক্তগুলো হাল্কা জমাট বেঁধে থকথকে একধরণের ঘন তরলে পরিণত হয়েছে, রঙ পাল্টে হয়ে গেছে কালচে লাল। নতুন রক্তগুলো টকটকে লাল রঙের তবে আগের মত জোর এখন আর নেই। হৃৎপিণ্ড আর পাম্প করছে না তরল জীবনীশক্তিগুলোকে।
মরার আগে দুর্বলভাবে বার কয়েক পা ছোঁড়ে মেয়েটা। গলা থেকে অদ্ভুত রকম একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
শেষ লাথিটা চেয়ারের ওপর পড়ল। আস্তে করে কাত হয়ে যায় ওটা প্রথমে। তারপর দড়াম করে মাটিতে পড়ে যায়।

সে শব্দ কানে ঢোকে না হতভাগা মেয়েটির। তার আগেই চোখ থেকে সরে গেছে প্রাণের সব লক্ষণ।

১.

‘কোন মতিনের কথা বলতেছ? গালকাটা মতিন?’ হতাশ একটা ভঙ্গীতে মাথা দোলাতে দোলাতে বলল রহমত মিয়া, ‘লোক খারাপ।’

চোরাই মালের কারবার যে লোক করে তার কাছ থেকে আরেকজনের ব্যাপারে ‘লোক খারাপ’ জাতীয় মন্তব্য শোনার পর সেটা হজম করতে সমস্যা হওয়ার কথা। তন্ময়েরও হজম হয় না। নাকের গোড়াটা হাল্কা কুঁচকে ওঠে বিরক্তিতে।
বিরক্তি প্রকাশ না করে হাল্কা মাথা দোলায় ও। চেহারা দুই সেকেন্ডের মাঝে স্বাভাবিক করে ফেলেছে।

‘মতিন ভাইকে পাওয়া যাবে কোথায় সেটা তাহলে বলতে পারছেন না, তাই তো?’ উঠে দাঁড়ায় তন্ময়, এই মানুষটাও লোক খারাপ। অযথা এখানে ঘুর ঘুর করার কোন মানে হতে পারে না।
পেছন থেকে রহমত মিয়ার কণ্ঠটা শুনে আবার থমকে দাঁড়াতে হয় ওকে, ‘চলে যাইতেছেন ভাই? সাবধানে থাইকেন।’
শুকনো গলাতে জানতে চায়, ‘কেন? সাবধানে কেন থাকতে হবে?’
‘নষ্টা মাইয়া নিয়ে মতিনের কারবার। হের লগে গ্যাঞ্জামে জড়াইয়েন না।’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে রহমত মিয়ার ডেরা থেকে বের হয়ে আসে ও।
মতিনের কারবার যে দৃষ্টিতেই দেখুক সমাজের মানুষ, তার সাথে গ্যাঞ্জামে জড়ানোর কোন ইচ্ছে তন্ময়ের নেই। বরং অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে ওই লোকই গ্যাঞ্জামে জড়িয়ে পড়েছে। অস্বাভাবিক কিছু তো নয়।
লোক খারাপ।

বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশী বৃষ্টি এটা না। পুরো মেঘে মনে হয় মোটে এক চামচ পানি ছিলো। ওটাই গুঁড়ি গুঁড়ি করে ফেলা হচ্ছে এখন। সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলেও কান পর্যন্ত ভিজবে না।
মোবাইল ফোন বের করে অযথাই আরেকবার মতিন ভাইকে খোঁজার চেষ্টা করে ও। নাম্বার সেই আগের মতই বন্ধ।
রাস্তার পানি হাল্কা ছিটাতে ছিটাতে আসতে থাকা কালো গাড়িটা দেখে গত আধঘণ্টার মাঝে দ্বিতীয়বারের মত কুঁচকে যায় ওর ভ্রু। এখানে এই গাড়ি কেন?
আস্তে করে ওর পাশে থেমে যাওয়ার পর সাইড উইন্ডো ধীরে ধীরে নেমে যেতে থাকে। ইলোরার দিকে তাকিয়ে বোকার মত একটা হাসি দেওয়া ছাড়া ওর আর কিছুই করার থাকে না।

‘গাড়িতে উঠে পড়।’ পাল্টা হাসে না মেয়েটা, ‘কুইক।’

ভেজা চুলে হাত বোলাতে বোলাতে গাড়িতে ওকে ওঠাই লাগে। ইলোরা অন্যপাশের জানালার দিকে পিছলে সরে যায়। এর মাঝেই একটা লিপসের প্যাকেট বের করে ফেলেছে। ফস করে আগুন ধরিয়ে ফেলে ও সিগারেটটাতে।
প্রত্যাশা নিয়ে তার দিকে তন্ময় তাকিয়ে থাকলেও টু শব্দ বেরুলো না মেয়েটার মুখ থেকে। মনোযোগ দিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। সামনের ড্রাইভিং সীটে বসে থাকা মারুফ ভাইকেও রীতিমত শান্ত মনে হচ্ছে।

‘কিছু তো বলবি? কিছু তো হয়েছে বটেই। গাড়ি নিয়ে চলে আসতি না কিছু না হলে।’ নীরবতা অসহ্যকর মাত্রাতে চলে যাওয়ার আগেই সেটা ভেঙ্গে ফেলে তন্ময়।
‘তোর লিংক ধরে কিছু খুঁজে পাই নি।’ সোজাসাপ্টা বলে দেয় ইলোরা।
‘বিন্দু নামের একটা মেয়েকে পাওয়ার কথা ছিলো তোর। ভদ্রমহিলা কি ছিলেন না ওখানে?’
কটমট করে তাকায় ইলোরা, ‘ভদ্রমহিলা? প্রস্টিটিউটদের এখন থেকে এভাবেই ডাকা হবে নাকি?’
শক্ত মুখে সামনের দিকে তাকায় ও, ‘মারুফ ভাই, গাড়ি থামান। নেমে যাবো।’
হতচকিত মারুফ ভাই পেছনের দিকে তাকান সাথে সাথেই, ‘ম্যাম?’

‘ম্যাম’ খপ করে তন্ময়ের হাত চেপে ধরেছে ততক্ষণে। টানাটানি না করে আস্তে করে বলে ও, ‘হাত ছেড়ে দে। সব জেনেও যেভাবে কথা বলছিস – তাতে তোর সাথে কাজ করার রুচি হচ্ছে না আমার। জয়িতাকে আমি একাই খুঁজে বের করতে পারবো।’
‘মাথা গরম করিস না। ঘটনা প্যাঁচ খেয়ে গেছে অলরেডি। তোর কি মনে হয় মনের সুখে তোর এদিকে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছি?’

মারুফ ভাই এখনও রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে পেছনের সীটের দিকে তাকিয়ে আছেন। থামবেন কি চালিয়ে যাবেন সেটা বুঝতে পারছেন না।
ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে তন্ময়। ইলোরার মুখের দিকে তাকায়, ‘কি ধরণের প্যাঁচ?’
‘তোর ঠিকানা অনুযায়ী ঠিকমতই গেছিলাম – হোটেলটায়– কিন্তু -’ কিছু একটা বলতে ইতস্ততঃ করে মেয়েটা।
অধৈর্যের মত চাপ দেয় ওকে তন্ময়, ‘রুম নম্বর ৩১৫। বিন্দুর একার থাকার কথা ছিল ওখানে। পাসনি তাকে?’
‘ইয়ে– মেয়েটা মারা গেছে রে।’

স্থির হয়ে যায় তন্ময় সাথে সাথে, ‘গতকালই ফোনে কথা বলেছি আমি ওর সাথে। দিব্যি সুস্থ স্বাভাবিক মনে হয়েছে -’
‘আজকে সকালে কেউ হোটেলের রুমেই জবাই করে ফেলে রেখে গেছে ওকে।’ ফিস ফিস করে বলে ইলোরা, ‘আমরা গিয়ে গলাকাটা লাশটা ছাড়া আর কিছুই পাই নি।’
‘হোয়াট?’
‘তুই মতিন ভাইকে খুঁজে পাচ্ছিস না গতকাল থেকে। আর আজকে জয়িতাকে চেনে এমন একমাত্র মানুষটা খুন হয়ে গেল, ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস?’

বাইরে বৃষ্টির বেগ আগের থেকে সামান্য বেড়েছে। সেদিকে তাকায় ছেলেটা।
চোখের শূন্য দৃষ্টি দেখতে দিতে চায় না ইলোরাকে।
ওভাবেই উত্তর দেয় মেয়েটার শেষ প্রশ্নের, ‘কেউ একজন চাচ্ছে না জয়িতাকে উদ্ধার করি আমি।’

জানালার কাঁচে জোরে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে বৃষ্টি – সাত মাসের আগের একটা দিনে ফিরে যায় তন্ময়।

২.
চারপাশে হাসির শব্দ। ছোট দোকানটাতে আজকে একটু বেশি মানুষই ভিড় জমিয়েছে।

বাইরে ঝুম ঝুম বৃষ্টি পড়তে থাকলে এমনটা হয়। নিঃসঙ্গ দোকানগুলোর ওপর চাপটা পরে বেশি। দরজা শক্ত করে লাগানো ছিলো, দড়াম করে ওটা খুলে যেতে নিজের সীট থেকে ঘুম ঘুম চোখে সেদিকে তাকায় তন্ময়।

ময়মনসিংহের এই পোড়া শহরে পড়ে আছে। একদিন ধরে নয়। আজকের দিনটা পার হয়ে গেলে আটদিন হয়ে যাবে।
সামান্য একটা কাজ করতে রাসেল ভাই পাঠিয়েছেন – সেটা করতে অতিরিক্ত সময় লাগিয়ে দিচ্ছে বলে মনে হয় ওর নিজের কাছেই। রাসেল ভাই সন্তুষ্ট হবেন না।

দরজা খুলে ঢুকেছে যে মানুষটা – তাকে দেখে আবার পেশীতে ঢিল দিচ্ছিলো ও, এক মুহূর্তের মাঝেই ঘুম ঘুম ভাবটা সম্পূর্ণ কেটে যায় ওর। ভিজে একেবারে দাঁড়কাক হয়ে আছে বটে, সেজন্য দলের ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি তারেক আদনানকে চিনতে মোটেও ভুল হয়নি এবার। বাম হাতে একটা মেয়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
শক্ত শরীরে কোমরের কাছে রাখা পিস্তলটার ওপর একবার আঙুল ছোঁয়ায় তন্ময়। মুখে ঘুম ঘুম ভাবটা ধরে রেখেছে এখনও। এখানে আটদিন পচা বৃষ্টির মাঝে অপেক্ষা করার ঝামেলাটা শেষ হতে যাচ্ছে।

নির্দিষ্ট একটা বয়েসের পর টাকা পয়সার জন্য বাবা-মার দিকে তাকিয়ে থাকা খুবই অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই বয়েসটা আঠারো থেকে তেইশের মাঝে থাকে। এর পর টাকার কথা পরিবারকে আর মুখ ফুটে বলা যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে বগুড়ার গ্রামে পড়ে থাকা বাবা-মার কাছে টাকা চাওয়াটা তন্ময়ের কাছেও অসহ্যকর একটা ব্যাপার বলে মনে হত। বন্ধুরা টিউশনি করে পরিবারের ওপর থেকে চাপ কমায়। দেখাদেখি তন্ময়ও ধরেছিলো একটা।

ক্লাস নাইনের যে মেয়েটাকে পড়াতে যেত ও, তার নাম ছিল সুস্মিতা।

গোড়া থেকেই মেয়েটির চরিত্র খুব একটা সুবিধের মনে হয়নি তন্ময়ের। ঘর থেকে তার মা বের হয়ে যাওয়ার পর থেকেই যতসব অদ্ভুত রকমের ইঙ্গিত দিয়ে যেত সে প্রতিদিন।
তবে মাসে সাত হাজার টাকার মায়া বড় মায়া, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আর দশটা ছাত্রের মত তন্ময়ের পক্ষেও এই পরিমাণ টাকা সামান্য ঝুঁকির ভয়ে ফেলে দিতে মন চায় নি। এক লোডশেডিংয়ের রাতের আগ পর্যন্ত সবকিছু এভাবেই চলছিলো বটে।

সুস্মিতার মত বোকা মেয়ে সে দেখেনি। ঘরভর্তি মানুষ লোডশেডিংয়ের সাথে সাথে প্রথমেই ছুটে যাবে যে ঘরে ছোট মেয়েকে তার টিউটর পড়াচ্ছে সেখানে – এই সহজ যুক্তিটির কথা সে চিন্তাই করে নি।
টর্চ জ্বালিয়ে সুস্মিতার বাবা যখন দেখলেন, মেঝেতে শুয়ে আছে তন্ময়, অন্ধকারে তাকে পাকড়ে ফেলতে মেয়েটির তেমন কষ্ট করতে হয়নি – এটা অবশ্য তাঁর বোঝার কথা নয়। আর গুণধর টিউটরের বুকের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে তাঁর নিষ্পাপ মেয়ে।
তন্ময়কে তুলে ধরে টর্চ দিয়েই একের পর এক আঘাত করেছিলেন তিনি। সব দোষ এখানে নন্দঘোষের ঘাড়ে পড়েছিল। তবে লোহার শক্ত টর্চের আঘাত তন্ময় চুপচাপ গ্রহণ করতে পারে নি। ভদ্রলোককে জোরে একটা ধাক্কা দেওয়ার সাথে সাথে কারেন্ট চলে আসে।

রক্তাক্ত ভদ্রলোকের নিথর দেহ প্রথমবারের মত চোখে পড়ে ওদের। ওয়ার্ডরোবের কিনারে মাথা লেগে একপাশ একেবারে গুঁড়িয়ে গেছে। সম্ভবতঃ বুড়ো হাড়ে এই আঘাত সহ্য হয়নি তার। বাড়ি খেয়েই একেবারে শুয়ে পড়েছেন। হাত বাড়িয়ে নাড়ি দেখে চমকে উঠেছিলো তন্ময় – নেই।

দরজা খুলে উদভ্রান্তের মত ছুটে বেড়িয়ে গেছিলো ও। পরের রাতটা ছিল লুকিয়ে; এরপর দিন জাতীয় দৈনিকের শেষ পৃষ্ঠাতে নিজের ব্যাপারে ছোট একটা খবর দেখে আতংক কয়েক গুণে বেড়ে যায় ওর।

“ঢাবির ছাত্র : টিউটর, ধর্ষক নাকি খুনী?”

তাকে খবরটিতে ‘জনৈক সুস্মিতা শারমিন(১৪)’-কে ধর্ষণের প্রচেষ্টা চালানো এক উদ্ধত যুবক হিসেবে দেখানো হয়েছে খবরে। স্পষ্ট করে লেখা হয়েছে টিউশনি করানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের ঘরে ডেকে আনাটা মোটেও নিরাপদ কিছু নয় বরং এরা গৃহকর্তাকে অনায়াসে খুন করে ফেলতে পারে কন্যা সন্তানটিকে ধর্ষণের সময় বাঁধা দিতে এলে।

তখনই বন্ধু রাফসানের মাধ্যমে রাসেল ভাইয়ের সাথে ওর পরিচয়, ভাই হেসে বলেছিলেন, ‘ক্যাম্পাসের ছোট ভাই তুমি। আমাকে আগে বলবা না? এসব কোন সমস্যা হইল?’

তন্ময় ধীরে ধীরে বোঝে এসব অভিযোগ সরিয়ে দেওয়া রাসেল ভাইয়ের কাছে কোন ব্যাপারই না। ক্ষমতায় আছে – এমন একটি রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর বেশ উঁচু অবস্থান তাঁর, দলের ভেতরে। শুধু তন্ময়কে ছোট একটা কাজ করতে হবে। একটা ফর্ম পূরণ করতে হবে।

রাসেল ভাই মুচকি হেসে বললেন, ‘আরে তোমাদের মত ভালো ছেলেরা রাজনীতিতে নাই, আমি জানি। এটা শুধু একটা লিস্ট দেখানো দলের ভেতরে। এতজন আমাদের সাপোর্টে আছে – হ্যান তেন। তোমাকে কিছুই করতে হবে না, বুঝলা না? ফর্মালিটি জাস্ট। যখন ওদের জানাবো – তোমাকে হেল্প করতেছি, তখন দলের তোমার এন্ট্রির ব্যাপারে বলা লাগবে তো। তোমার কাজ হওয়া নিয়ে কথা। কি কও?’

মাথা দুলিয়েছিল তন্ময়। তবে বুঝতে পেরেছিল, এমনি এমনি তার ওপর থেকে খুনের অভিযোগ সরানো হচ্ছে না। পরবর্তীতে তাকে কিছু একটা করে এর প্রতিদান দিতে হবে দলের কাছে।
দশ মিনিট চিন্তা করে হাতে থাকা দুটো অপশনের মাঝে এই রাজনৈতিক দলের পুতুলে পরিণত হওয়াটাকেই ভালো মনে হতে থাকে ওর। অন্য অপশনটা সহজ – জেলখানাতে সুড়ুৎ করে সেঁধিয়ে যাওয়া– বগুড়ার কোণে পড়ে থাকা মা-বাবার মুখটা ভেসে উঠেছিল ওর মানসপটে।

ঠিকমত এই ঝামেলা থেকে বের হতে পারলে বাবা-মার চাপ ও কমাবেই একদিন। সেজন্য এই রাজনৈতিক দলের পুতুল হওয়া অনেক ভালো। জেলখানায় আছে ছেলে – এই খবর সহ্য করতে পারবে হার্টের রোগী বাবা?

মাস চারেকের মাঝেই মাঝারি সাতটা অপারেশনে পাঠানো হয় ওকে। এর মাঝে ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলা হয়েছে ক্রিমিনাল রেকর্ড। পুলিশ সুস্মিতার বাবার মৃত্যুর কেসটা একেবারে দশমণি ফাইলের তলে চাপা দিয়ে রেখেছে। আগামী শতাব্দীতে ওটা আলোর মুখ দেখলেও দেখতে পারে। তবে সে সম্ভাবনা কম।

অষ্টম অপারেশনটা ছিলো রিজভী তরুণ নামে বিরোধীদলের এক পাতিনেতার কাছ থেকে তথ্য আদায় করা।
এতদিনে তন্ময়ের ভেতরের কোমল দিকগুলো সব সরে গেছে – ধাপে ধাপে নিষ্ঠুর কাজ করানো হয়েছে ওকে – সতর্কতার সাথে একটা অ্যাসেটে পরিণত করেছে ওকে দলটি। একবার খুনের অভিজ্ঞতা আছে – এমন কাওকে দিয়ে যে নোংরা কাজগুলো করিয়ে নেওয়া যায় – তা আর কাওকে দিয়ে করানো যায় না। বিবেকের দংশন তাদের এক ঘণ্টা দংশন করলে বাকি তেইশ ঘণ্টা করে রাখে বেপরোয়া। খুনের চেয়ে ছোট অপরাধগুলো তাকে আর স্পর্শ করে না। দলটি তন্ময়ের দিকে এজন্যই মনোযোগ দিয়েছিলো।
ব্যাপারটা অবশ্য ও টের পায় অনেক অনেক দেরিতে।

বিরোধীদলের পাতিনেতার শরীরের বারোটা হাড় ভাঙ্গার পরও যখন মুখ খোলানো যায় না – ছুরি দিয়ে গলা কেটে মানুষটার মাথা আলাদা করে ফেলেছিল তন্ময়।
অদ্ভুত ব্যাপার – এ ব্যাপারে বিবেকের দংশন সে আর অনুভব করেনি। নিজের দলের ক্ষতির কারণ হচ্ছে – এমন একজন শত্রুকে কমিয়ে দেওয়াতে অনুশোচনার কি আছে? দলের সক্রিয় কিলারে পরিণত হতে তার লেগেছে মাত্র চৌদ্দ মাস।

ভাবনাটাকে চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ও – দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে দোকানটা থেকে – শেষ মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ায়।
কোনরকম দ্বিধা না করেই ঘরভর্তি লোকের সামনে পিস্তলটা বের করে ফেলেছে। প্রতিক্রিয়া দেখানো সময় এসময় স্বাভাবিক মানুষেরা পায় না – বদ্ধ ঘর কাঁপিয়ে দিয়ে পর পর দুইবার গুলি করে ও।

তারেক আদনান বুকে আর গলাতে বুলেটের ক্ষত নিয়ে পড়ে যাচ্ছেন – তার মাঝেই দরজা পেরিয়ে গেছে তন্ময়। বাইরে থেকে হুড়কো তুলে ভেতরের প্রতিটা মানুষকে আটকে ফেলেছে ভেতরে।

৩.
মোটরসাইকেলটা যখন চতুর্থবারের চেষ্টাতেও স্টার্ট নিলো না – গলা শুকিয়ে এল তন্ময়ের।
দরজাটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারবে না ভেতরের ওদের। আর ক্ষিপ্ত জনতা বের হলে খবর আছে। হাড়মাংস আর থাকবে না একটাও জায়গায়।

মোটরসাইকেল থেকে দ্রুত নেমে এসে দৌড় দেয় ও রাস্তার অন্যপাশের গলিটা ধরে। বৃষ্টির জন্য মনের ভুল হতে পারে – তবে বেশ পেছনে কিছু একটা ভেঙ্গে পড়ার শব্দ শুনতে পেল কি ও? দরজাটা ভেঙ্গে ফেলেছে লোকজন?

তারেক আদনান তার নিজের দলের লোক, বিরোধি দলের নয়। ঢাকা মহানগরের সেক্রেটারি। মানুষটাকে খুন করা ছাড়া উপায় ছিলো না।
দলের স্বার্থে কাজটা করতে হল ওকে। সামান্য খারাপ যে লাগছে না তার – এমনটা না। কিন্তু এই ঘটনার পর সারা দেশ আঙুল তুলবে বিরোধী দলের দিকে। সামনের নির্বাচনে ভালো একটা প্রভাব ফেলবে ঘটনাটা।
তারেক আদনান নিজেও কিছু ভুল করে ফেলেছিল। বাল্যবন্ধুকে অতিমাত্রায় বিশ্বাস করে নির্বাচনী এজেন্ডার অনেককিছু শেয়ার সে করেছে। কাজটা ঠিক করেনি। জেনে শুনে শত্রুপক্ষকে তথ্য তুলে দেওয়ার কারণে বড় ধরণের পিছিয়ে গেছে দল।
তার মৃত্যুর মাঝ দিয়ে আবার আগের জায়গাতে ফিরিয়ে আনা হয়ত সম্ভব হতে পারে। তার কাজটা ঠিকমত করেছে তন্ময়।

বেশ পেছনে দুইজন পুলিশকে দেখতে পায় ও এই সময় আড়াল থেকে। অনুসরণ করছে কি না নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই।
পর পর তিনবার মোড় নেয় ও বোঝার জন্য। ঠাঁয় লেগে আছে পুলিশ।
রেস্টুরেন্টটা থেকে যদি এর মাঝে লোকজন বের হয়ে গিয়ে থাকে – তবে অর্ধেক শহর জেনে গেছে খুনের ব্যাপারটা। সেই সাথে পেয়েছে খুনির দৈহিক বর্ণনা। পুলিশ এই সময় পেছনে ঘুর ঘুর করার একটাই অর্থ হতে পারে। ঝুম ঝুমে বৃষ্টির মাঝে খুব বেশি মানুষ রাস্তাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে না – খুনের আসামী ধরার জন্য এর চেয়ে সহজ সিনারিও হতে পারে না। বৃষ্টি না থাকলে জনতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা করা যেত। এখন সেটি সম্ভব নয়।

মোটরসাইকেলটা ঠিক থাকলে শহরের অন্যপাশে থাকত ও এতক্ষণে। তার বদলে ধরা খাওয়া থেকে মাত্র দশ মিনিট দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাণ্ডা শরীরটা আরও ঠাণ্ডা হয়ে যেতে থাকে ওর। ঘামতে পারলে ভালো হত – মনে মনে ভাবে একবার। পিস্তলটা ডাম্প করার সময়ও পায়নি ও। ওটা কোমরে এখনও। পুলিশ শুধু সার্চ করে দেখতে চাইলেই কাজ হয়ে যাবে।

পেছনের পুলিশ দুইজন দূরত্ব কেন রাখছে সেটা ও বুঝতে পারে। গুলির ব্যাপারটা এতক্ষণে চাউর হয়ে যাওয়ার কথা। পুলিশগুলো এক্ষেত্রে গুড ফর নাথিং। খালি হাতে আছে। একটা করে ব্যাটন সম্বল এদের। এই অবস্থাতে সশস্ত্র লোকের সাথে লাগতে চাইছে না।

আর দুটো মোড় নেওয়ার পর একটা ল্যাম্পপোস্টের সামনে থেমে যায় ও। কানাগলি এটা। সামনে এগিয়ে আরেক গলিতে পড়বে সে উপায় নেই। না বুঝেই এখানে ঢুকে পড়াটা একেবারেই অনুচিত হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ায় ও। ভাবনা খানা – কারও জন্য অপেক্ষা করছে।
প্রতিটা পেশিকে সচকিত করে রেখেছে একটা ঝামেলা দেখার জন্য। বিদ্যুৎচমকের মত রিঅ্যাক্ট করতে হবে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওদের দুইজনকে দুটো বুলেট ঢুকিয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে যেতে হবে।
পুলিশদুটো ঘাঘু আছে। তারাও সম্ভবতঃ তন্ময়ের মনোভাব বুঝতে পারে স্পষ্ট। গলির মোড়ে এসে ইতস্তত করতে শুরু করেছে দুইজনেই। ঢুকছে না।

মিনিট তিনেক লাগে তাদের একটা মতৈক্যে পৌঁছতে – পুরো সময়টা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে তন্ময়। উদাস ভঙ্গীতে অন্যপাশের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে দুই আপদ এতক্ষণে এগিয়ে আসতে থাকে ওর দিকে।

‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’ কোন রকম ভূমিকা ছাড়াই জানতে চাইলো ওদের একজন।
কিছুক্ষণ স্মৃতি হাতড়ায় তন্ময় – কোনকালে কোন পুলিশকে কি হাই-হ্যালো দিয়ে শুরু করতে দেখেছে একটা কথোপকথন? বাংলাদেশে? না।
পাল্টা প্রশ্ন করে তন্ময়, ‘তা জেনে আপনার কি কাজ?’

সাথে সাথে পুলিশের মুখের চেহারাই পাল্টে যায়, রীতিমত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে লোকটা। এভাবে পাল্টা প্রশ্ন সাধারণ মানুষের কাছে শুনে অভ্যস্ত নয়।
‘এক থাবড়ে কানপট্টি ছুটায়া দিমু শালা – প্রশ্ন করছি – উত্তর দে!’
শক্ত শরীরে দাঁড়ায় তন্ময়, ‘ভদ্র ভাষাতে কথা বলেন। আপনি একজন ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছেন।’
‘ওরে আমার ভদ্রলোক রে!’ দ্বিতীয় পুলিশ খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দ করে, ‘কে ভাই আপনি? বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট?’
মাথা নাড়ে তন্ময়, ‘সাধারণ একজন ছাত্র।’
‘কোথায় পড়াশোনা করেন?’
‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি।’

পুলিশ দুইজন এ ওর মুখের দিকে তাকায়। ভার্সিটির নাম শুনে এমন করার কারণ কি? খুনী একজন মানুষ ঢাকা ভার্সিটিতে পড়তেই পারে না – এমন একটা ধারণা নিয়ে আছে? নাকি আগে থেকেই পুলিশকে কেউ সতর্ক করে দিয়েছিল – ঢাবি থেকে কেউ আসতে পারে এখানে?
সেক্ষেত্রে আর কোন আশা নেই। হাত নামাতে থাকে ও পিস্তলের দিকে ।

তবে আচমকা কোমল হয়ে যায় পুলিশ দুটোর গলা, ‘এখানে কেন এসেছেন?’
‘বাঁধা কোথায়? উইকএন্ড চলে।’
‘না, মানে -’
‘বড্ড প্রশ্ন করেন আপনারা।’ কাঁধ ঝাঁকায় তন্ময়, ‘আমার প্রেমিকা ময়মনসিংহে থাকে। সকালের বাসে এসেছি– বিকেলের বাসে ঢাকা চলে যেতে হবে। এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন – সেটা স্পষ্ট হয়েছে এবার?’

রিকশাটা ওদের খুব কাছে থেমে যায় তখনই। চোখ ধাঁধানো সুন্দরী মেয়েটি ফিরে তাকিয়েই বিস্ময়ে হা হয়ে যায়। পুলিশ দুইজনের চোখ এখন তার দিকে চলে গেছে।
এর মাঝেই তন্ময় ওকে একটা চমৎকার হাসি উপহার দেয়।

দ্রুত এগিয়ে আসে মেয়েটি, ‘তুমি কতক্ষণ হয়েছে এখানে? ইশ, ভিজে গেছ যে একেবারে!’
কাঁধ ঝাঁকায় তন্ময়, ‘ফোন তো ধর না। কি করব? বৃষ্টিতে মোবাইল এতবার বের করতেও পারছিলাম না -’

আর কিছু বলার আগেই মেয়েটা ওকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে, রাস্তার মাঝেই ওর ঠোঁটদুটো কামড়ে ধরে, তারপর মুখের ভেতর নিয়ে যায়। তন্ময়ের মনে হয় এই ভৌতিক চুম্বন কোনদিনও শেষ হবে না। মেয়েটির শরীর খুব কাছে চলে এসেছে ওর – মাতাল করা একটা বুনো গন্ধ পাচ্ছে ওখান থেকে। আস্তে করে মেয়েটাকে সরায় ও মিনিট তিনেক পর।

পুলিশ দুইজন হা করে তাকিয়ে আছে এখনও। মেয়েটি যেন এতক্ষণে সচকিত হয়, ‘ভাই, ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন কেন?’
তন্ময় অবশ্য অন্য কথা বলে, ‘ডিসট্যান্সড রিলেশন তো – দেড় মাস পর দেখা হল – সামলাতে পারিনি আমরা নিজেদের। কিছু মনে করবেন না। কি জানি জানতে চাইছিলেন?’

মাথা নাড়ে দুইজনই, ‘না না – ঠিক আছে। আপনারা যেতে পারেন।’

মেয়েটা একপাশ থেকে ওর হাত জড়িয়ে ধরেছে, পুলিশ দুটো ফিরে যেতে থাকে। একজনকে বলতে শোনে তন্ময়, ‘এই ছেলে দিয়ে রেস্টুরেন্ট ডাকাতি? হাহ!’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ও। মাত্র খুনটা হয়েছে – পুলিশ এখনও বুঝতেই পারেনি ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি মারা গেছে এই মাত্র। তারা ভেবেছে সাধারণ কোন ডাকাতির কেস এটা হবে। নিশ্চয় যথেষ্ট তথ্য কালেক্ট করার আগেই বোকার মত তারা পিছু নিয়েছে সন্দেহজনক তন্ময়ের?

‘কেন করলে এটা? আমাকে বাঁচালে কেন?’ এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে গোলাপফুলের মত ফুটফুটে চেহারার মেয়েটাকে প্রশ্ন করে ও, গলা নামিয়ে রেখেছে।
‘জানোয়ারটা একমাসের জন্য আমাকে ভাড়া নিয়েছিলো।’ বিড় বিড় করে বলে অদ্ভুত মেয়েটা।
চিনে ফেলে তন্ময়, ‘তারেক আদনানের সাথে ছিলে তুমি রেস্টুরেন্টে।’
‘ভাগ্য ভালো একেবারে আমার ফ্ল্যাটের সামনে এসে থেমেছিলে। অবশ্য – ফ্ল্যাটটা আমার না। জানোয়ার তারেকের। আমাকে নিয়ে নিরিবিলিতে থাকা দরকার ছিলো তার।’
‘ফিরে এলে কেন?’
‘আমার জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলতে হবে যত তাড়াতাড়ি পারি – পুলিশ এসব পেলে আমার পেছনেও লাগতে পারে।’

বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়ছে, দারোয়ান মুচকি একটা হাসি উপহার দেয় ওদের দিকে তাকিয়ে। মেয়েটা কয়েকদিন ধরে এখানে আছে। অজানা নয় এখন চেহারাটা।

‘তুমি আসছ কোথায়?’ ফিস ফিস করে প্রশ্ন করে তারেকের রক্ষিতা।
‘ঘরের ভেতর থেকে তোমার ট্রেস সরিয়ে ফেলতে আমাকে পাশে চাবে তুমি – বিশ্বাস কর। ওই কাজে আমার মত দক্ষ লোক এ তল্লাটে পাবে না।’
এক মুহূর্ত ভাবে মেয়েটা, তারপর রাজি হয়ে যায়, ‘এসো তবে।’ লিফটের সুইচে চাপ দিয়ে তাকার একবার ওর দিকে, ‘আমার নাম জয়িতা।’

‘ঠোঁটের মতই মিষ্টি একটা নাম।’ মুচকি হাসে তন্ময়, ‘আমি তন্ময়।’

৪.
রাতটা অন্য একটা হোটেলে কাটাতে হয় ওদের। আঁচরে তারেক আদনানের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সবকিছু বের করে এনেছিলো ওরা।
স্বয়ং তারেক আদনান মরা থেকে জ্যান্ত হয়ে যদি উঠে আসে – তবুও সে দাবী করতে পারবে না এখানে কোনদিন জয়িতা বলে কোন মেয়ে ছিলো। একটা চুলও ফেলে আসেনি ওরা ওখানে।

হোটেলের ছোট্ট ঘরটাতে টিভি চলছে – ক্লান্ত তন্ময়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে জয়িতা। অজান্তেই ওর কপালে হাত বুলিয়ে দেয় তন্ময়।
বড় বড় চোখ মেলে ওর দিকে তাকায় মেয়েটা, ‘তন্ময়?’
‘হুঁ।’
‘কাল চলে যাবে?’ মেয়েটার গলা এবার বিষণ্ণ শোনায়।
মাথা দোলায় ও, ‘যেতে হবে। ছোট একটা কাজ বাকি আছে। সেটা শেষ করেই চলে যাবো।’
গুটিসুটি মেরে তন্ময়ের আরও কাছে আসে জয়িতা, ‘কি কাজ?’
শক্ত হয়ে যায় তন্ময়ের মুখটা, ‘জানতে চেও না।’

ধমক খেয়ে হাসিখুশি ভাবটা মুখ যায় না জয়িতার, বরং উঠে বসে বিছানাতে। চেপে ধরে শুইয়ে দেয় তন্ময়কে। জোর করে নিজের কোলে তুলে নিয়েছে ওর মাথাটা।
‘আচ্ছা, জানতে চাইবো না। চুপচাপ শুয়ে থাকো তো – তোমার মাথায় বিলি কেটে দেই। ঘুমাও একটু।’

জয়িতাকে এই মুহূর্তে তন্ময়ের ঠিক ইলোরার মত লাগে।
এক ছাদের নিচে ওরা ছিলো তিন মাস। মেয়েটা এভাবে কোলে তুলে নিত ওর মাথাটা। তারপর এভাবেই বলত, ‘বিলি কেটে দেই, হুঁ?’
মেয়েটা হুট করে ওর জীবন থেকে সরে গেল কেন? ড্যাশিং একটা ছেলেই কি সব নাকি? বেটার চয়েজ দেখতে পেয়ে অপেক্ষা করার মত বোকা ইলোরা ছিলো না।
তন্ময়ের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।

কাচ ভাঙ্গার মত শব্দ করে হাসে জয়িতা, ‘এক্স গার্লফ্রেন্ডের কথা মনে করতে হবে না। ঘুমাও।’
চোখ খুলে যায় তন্ময়ের, চোখে বিস্ময়ের ছাপ। মেয়েটা জানে কিভাবে?
ওর বুকে হাত বোলায় জয়িতা, ‘আমার পেশাটাই এমন গো, পুরুষ চিনতে হয়। নিঃশ্বাসে পুরুষ চিনতে হয়, দীর্ঘশ্বাসেও চিনতে হয়। নইলে ধ্বংস হয়ে যেতাম।’
জয়িতার হাত সরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসে তন্ময় ওর পাশে, মেয়েটার জন্য হঠাৎই খুব মায়া হতে থাকে ওর।

‘কাল থেকে তো আর আমাদের দেখা হবে না, তাই না?’ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায় মেয়েটা। তন্ময় জোর করে চোখ সরিয়ে নেয়।
‘হবেই না – কে বলতে পারে?’ প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে তন্ময়, ‘বাদ দাও তো – তোমার ব্যাপারে বল। তারেকের সাথে জুটলে কিভাবে?’
মাথা নাড়ে জয়িতা, ‘শুনতে তো তোমার ভালো লাগবে না।’
মুচকি হাসে তন্ময়, ‘ঘুম আসছে না। আপত্তি না থাকলে বল।’
‘ময়মনসিংহের সবচেয়ে বড় ব্রথেল থেকে এসেছি আমি – শাইনিং।’ ধীরে ধীরে বলে মেয়েটা, ‘নাম শুনবে না। এসব কাজ প্রকাশ্যে চলে না। শাইনিংয়ের সাথে সারাটা জীবন ধরে আছি আমি। কারণ, ওখানেই আমার জন্ম। আমার মা ছিলেন এলাকার টপ খানকি।’

স্তব্ধ হয়ে শোনে তন্ময়, বলে যাচ্ছে দুঃখী মেয়েটা, ‘আমাকে সারাজীবন একজন বেশ্যা হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ছোট থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত – নিখুঁত একজন বেশ্যা বানানো হয়েছে আমাকে ধাপে ধাপে। শাইনিংয়ে কোন মেয়ে প্রেগনেন্ট হয়ে গেলে ছেলে সন্তান না মেয়ে সন্তান পেতে যাচ্ছে – সেটা নিশ্চিত হওয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করে ওরা। মেয়ে হলে আমার মতই শিখিয়ে পড়িয়ে উন্নত মানের বেশ্যা তারা বানিয়ে ফেলে। জীবনটা ওখানে এরকমটাই স্বাভাবিক।’
টপ করে এক ফোঁটা পানি পড়ে মেয়েটার হাতের ওপর, ‘আমার কুমারী জীবন ছিলো এগারো বছরের। যখন মা আমাকে বলল আজ রাতে আমি আরেকজনের সাথে ঘুমাবো – তখন আমার বয়েস ছিলো মাত্র এগারো। বয়েস চৌদ্দ পেরুনোর আগেই পুরোদস্তুর বেশ্যা হয়ে গেলাম। পড়াশোনা যথেষ্ট শেখায় তারা ওখানে। ভদ্রোচিত একটা উপস্থাপনা করতে পারলে অনেক বেড়ে যায় খানকিদের দাম।’

সান্ত্বনা দেয় না তন্ময়, তবে মেয়েটার কষ্ট ওকে স্পর্শ করে। এক হাত বাড়িয়ে ওকে ছোঁয় সে, ‘আর এখান থেকেই তোমাকে ভাড়া করে নিয়ে গেছিলো তারেক আদনান?’
‘সাতদিন আগে।’ চোখ মোছে জয়িতা, ‘নতুন কিছু তো আর না। এরকম স্পেশাল অর্ডার আমরা মাঝে মাঝেই পাই। টাকাটা একটু বেশিই আসে। তবে কাজকর্মের কোন পার্থক্য নেই। পুরুষ মাত্রই জানোয়ার।’
ইতস্তত করে প্রশ্নটা করেই ফেলে তন্ময়, ‘আমাকে সাহায্য করলে কেন? আমিও একজন পুরুষ।’

জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা। ঘরের ঠিক মধ্যখানে হেঁটে যায়। তারপর আস্তে করে জামার চেইন খুলে ফেলে।
কোমর পর্যন্ত খুলে গেছে মেয়েটার পোশাক। কালো রঙের বক্ষাবরণী ছাড়া ওপরে আর কিছুই নেই। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায় ও তন্ময়ের দিকে পিঠ ফিরিয়ে।
শিউরে ওঠে তন্ময়, এত সুন্দর মেয়েটার পিঠ ওটা? বীভৎস ভাবে কুঁচকে গেছে চামড়া। সম্ভবতঃ কাগজ কাটার ছুরির অবদান। ফালা ফালা করে ফেলা হয়েছে পিঠে মেরে মেরে। পরক্ষণেই কোমর পর্যন্ত চলে যাওয়া একটা সাপের মত দাগ দেখে ভুল ভাঙ্গে ওর।
কাগজ কাটার ছুরি নয়, পুরুষালী বেল্টের দাগ! রক্ত শুকিয়ে আছে ওখানে। বেশিদিনের পুরোনো ক্ষত নয়।

খাট থেকে উঠে দাঁড়ায় হতভম্ব তন্ময়, বিষণ্ণ গলাতে বলে যাচ্ছে জয়িতা, ‘এগুলো, তারেক আদনান নামক একজন পুরুষের অবদান। তাকে গুলি করার মুহূর্ত থেকে পুরুষ জাতির সেই শ্রেণি থেকে সরে গেছ তুমি।’
ওর ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ে তন্ময়, আলতো করে ছোঁয় ক্ষতগুলো। এই প্রথম তারেক আদনানকে গুলি করার জন্য মনের কোথাও কোন খারাপ লাগা অনুভূতি নেই ওর। বিবেক আগে থেকেই ওর হেডঅফিসের অনেক নিচু একটা পদে কাজ করে, এখন একেবারে চুপ হয়ে গেছে।

‘কিভাবে বুঝলে না মেয়েদের ক্ষেত্রে তারেক আদনানের সাথে আমার কোন পার্থক্য আছে কি নেই? ব্যবসায়িক কারণে মারা গেছে তারেক। তোমাকে নির্যাতন করার জন্য তাকে গুলি করিনি আমি।’

মুচকি হেসে ঘুরে দাঁড়ায় জয়িতা, সামান্য পোশাকে ওর সুন্দর মুখ আর সুগঠিত বুকের দিকে চোখ পড়তে তন্ময় নিজের অজান্তেই ঢোক গেলে। গলা শুকিয়ে আসছে ওর। মেয়েটা কি সুন্দর! অথচ, কি ভাগ্য নিয়েই না জন্মেছে!
‘ওই যে বলেছিলাম -’
গলা খাঁকারি দিয়ে কথাটা শেষ করে দেয় তন্ময়, ‘রাইট। রাইট – আমাদের নিঃশ্বাসে চিনে ফেল কে কেমন হতে পারে।’

আলতো করে মেয়েটার জামা আবার পরিয়ে দেয় তন্ময়, যত্ন করে চেইন লাগিয়ে দুই কাঁধ ধরে সামনে দাঁড় করায় ওকে, ‘এই জীবনে কেন আছো? আমার সাথে কাল তুমিও চলো ঢাকায়।’
অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে জয়িতা, ‘মানে?’
‘আমার অনেক কানেকশন, অনেক লিংক এখন। আজকের পর থেকে আরও স্ট্রং একটা পজিশনে চলে যাবো। তোমাকে ভালো একটা কাজ জুটিয়ে দেওয়াটা এখন আমার পক্ষে খুব একটা কঠিন কিছু না।’
‘কেন করবে সেটা জানতে পারি?’ আচমকা শক্ত হয়ে যায় জয়িতার কণ্ঠ।

অবাক হয়ে দুই সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে তার দিকে তন্ময়, তারপরই বুঝতে পারে তার ভয়। উচ্চস্বরে হেসে ওঠে ও, ‘বোকা মেয়ে, তোমাকে নিজের জন্য নিয়ে যাচ্ছি না। নিয়ে যেতে চাইছি বন্ধুত্বের দাবীতে। এখানে পচে মরার তো কোন কারণ দেখি না তোমার।’
কৃতজ্ঞ একটা দৃষ্টি ফোটে জয়িতার মুখে আর কয়েক সেকেন্ড পর, তন্ময়ের শিশুর মত মুখটাতে কোন রকম শঠতার চিহ্ন সে দেখে নি।
তবুও গলাটা বিষণ্ণ থাকে মেয়েটার, ‘আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব কিসের? আমার পরিচয় তোমার অজানা নয়। এমনও নয় যে আমাকে অনেকদিন ধরে চেন। কেবলই না পরিচয়!’
হাসিমুখটা ম্লান হয় না তন্ময়ের, থুতনি ধরে জয়িতাকে বাধ্য করে ওর দিকে তাকাতে, ‘তুমি না থাকলে এতক্ষণে আমি শক্ত রুটি খেতাম হাজতে বসে, সেটা অজানা না তোমার। আর বন্ধুত্বে কোন ছোট বড় নেই। বোঝা গেছে?’

জয়িতার চোখে আচমকা পানি চলে আসে। জীবনে তার দিকে একটা মানুষও তাকায়নি স্বাভাবিক কোন দৃষ্টিতে।
প্রত্যেকের চোখে শুধু ছিলো ভোগ, লালসা, কাম, ওকে দেখা হয়েছে স্রেফ একটা উপাদেয় খাবার হিসেবে। তন্ময় ছেলেটা একটু আগেই একটা মানুষকে ঠাণ্ডা মাথাতে দুই বার গুলি করেছে – কিন্তু ছেলেটার ওই একটা দিকই নেই।
অন্যদিকটার পরিচয় পেয়ে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে নি। চোখের পানিটা তাড়াতাড়ি মুখে ঘরের অন্য পাশে চলে যায় ও তাড়াতাড়ি।
তন্ময়কে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে করছিলো হঠাৎ করেই। কাজটা করা যাবে না। ছেলেটা মেয়েদের ব্যাপারে ঠিক যেভাবে ভাবে বলে ধারণা করে ছিল, সে ওরকমই। এদের ছুঁয়ে দিতে হয় না, একটু দূরত্ব রেখে দেখতে হয়।
হঠাৎ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েটি বলে মনে হয় ওর।

ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ – তন্ময়ের নিঃশ্বাস নিজের ঘাড়ে অনুভব করে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না ও। ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর বুকে। একে অন্যের ঠোঁট খেয়ে ফেলার যে অসম প্রতিযোগিতা তারা লাগিয়ে দেয় পরমুহূর্তে – দাঁতগুলো ছাড়া আর কেউ তার সাক্ষী থাকে না।
অথবা তারা ওটাই ভেবেছিলো।

কোন রকম আগাম সংকেত না দিয়েই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে হোটেল রুমের দরজাটা।
উজ্জ্বল টর্চের আলো ফেলে ঘরে ঢুকে পড়ল চার-পাঁচজন মানুষ। প্রতিটা আলো ফেলা হয় ওদের চেহারাতে।

‘মাগীর হুক দেখো!’ গর্জন করে ওঠে ওদের একজন, ‘কাস্টোমার ছুইটা গেছে – সেই ফাঁকে ফ্রিতে ক্ষ্যাপ মারতাছে।’

খপ করে জয়িতার হাত ধরে মেয়েটিকে সরিয়ে নেয় আরেকজন, ‘ফিইরা চল। যাইতে হবে আমাদের এখন।’

তন্ময়ের মাথাতে রক্ত উঠে যায় – এক পা এগিয়ে এসেছে বিদঘুটে লোকটার দিকে – একই সাথে নড়ে ওঠে দুই বিশালদেহী। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা শুধু অনুভব করার সময় পেল তন্ময়। তারপর পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে খেয়াল করলো হোটেলের পুরোনো জানালা তার ওজন নিতে পারেনি, ভেঙ্গে গেছে।

দুই তলা থেকে খসে পড়ছে ও নিচে!

৫.
বাইরের বৃষ্টি থেমে গেছে। কালো গাড়িটা থেকে হাল্কা পায়ে নেমে আসে তন্ময়। ইলোরার ফ্যাকাসে মুখটার দিকে তাকিয়ে হাল্কা হাসে।
‘ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন? যাবো আর আসবো।’
ড্রাইভিং সীট থেকে নেমে এসেছেন ইলোরার ড্রাইভার-কাম-বডিগার্ড মারুফ ভাই, ‘আমিও যাবো।’
কাঁধ ঝাঁকায় তন্ময়, ‘অযথা কষ্ট করছেন। মতিন ভাই আমাকে চেনেন। এখানে কোন ঝামেলাই হবে না।’
জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেয় ইলোরা, ‘অদ্ভুত কথা বলবি না তো। মতিন ভাই নিজেই ঝামেলায় আছে বলে আমার মনে হচ্ছে।’

চোখ মটকালেন মারুফ ভাই। এরপর আর আপত্তি করা যায় না।
ছোট কিন্তু ছিমছাম বাড়িটার ভেতর ঢুকে পড়ে ওরা। দোতলা একটা বাড়ি। সাদা রঙের দেওয়ালগুলো আর ওপরের খয়েরী রঙের চালমত ছাদ দেখে মনে হতে পারে এটাকে স্রেফ ছবি থেকে তুলে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এখানে।

এত টাকা মতিন ভাই কিভাবে পেয়েছেন তা এলাকাবাসী পর্যন্ত জানে। বেশ্যা-ব্যবসা থেকে।

ময়মনসিংহ থেকে পরদিনই ঢাকাতে চলে আসতে হয়েছিলো তন্ময়কে। একে তো এর পরের কয়েকদিন দেশ গরম রাখার মত একটা খুন করে এসেছে। আবার ‘শাইনিং’-এ এসে ঝামেলা করলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। ঢাকায় ফেরার পর ও জেনেছে জয়িতার সাথে সেদিন কী ঘটেছিল।

মেয়েটির কন্ট্যাক্ট যে গুলি খেয়ে মারা গেছে – সেটা ‘ব্রথেল শাইনিং’ জানতে পেরেছিল তিন ঘণ্টার ভেতরই। তখনই তাদের মাথাব্যথার শুরু, তাদের টপ খানকি কি এই সুযোগে পালিয়ে গেল? নাকি ফ্রি-তে ‘ক্ষ্যাপ মারতে’ বের হয়েছে সে?
দুটোই শাইনিংয়ের জন্য ক্ষতির কারণ, খোঁজ খবর নিয়ে তন্ময়দের হোটেলে থাকার ব্যাপারে জানতে তাদের তেমন কষ্ট হয় না। হোটেলগুলোর সাথে সব সময়ই মাগিপাড়ার দহরম মহরম। দুটো ফোন দিয়েই বের করে ফেলা গেছে।

তারপর হোটেলে ঢুকে ওদের যে অবস্থায় তারা পেয়েছিল, লোকগুলো ধরেই নেয় জয়িতা ‘শাইনিং’কে বাটোয়ারা না দিয়ে শুধু নিজের জন্য দুই এক রাত রোজগার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কাজেই তাকে ধরে আবার শাইনিংয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে রেগুলার কাস্টোমারদের কাছে তার ডিমান্ড আছে। এক রাত তার বাইরে থাকা মানে বড় অঙ্কের ক্ষতি।

তন্ময় শাইনিংয়ে ফিরে এসেছিলো ঠিক দেড় মাস পর।
তবে জয়িতাকে ওখানে পায় নি। বড় অংকের টাকার টোপ ফেলার পর ম্যানেজার শুধু জানায় ঢাকাতে চালান করে দেওয়া হয়েছে তাকে। প্রস্টিটিউট-ট্রেডিং হয়েছিলো ‘রজনী ব্রথেলে’র সাথে। জয়িতার ডিমান্ড ময়মনসিংহে পড়ে আসছিল, কাজেই তার সাথে ‘লিয়া’ নামক আরেকজনে অদলবদল করেছিল ব্রথেল দুটো। আরেক বেশ্যা বিন্দুকেও ট্রেড করা হয়েছে লতিকার সাথে।

রজনী ব্রথেলে জয়িতাকে খুঁজেছে তন্ময়, পায়নি সেখানে। কাস্টোমারের বেশে এসে অন্য কোন এক ব্রথেল খুব ভালো প্রস্তাব দিয়েছিলো রজনীর চারজনকে। এক রাতে চারজনই পালিয়ে গেছে। কোথায় গেছে সেটা রজনীর ম্যানেজার জানে না।

সবচেয়ে লম্বা হাত যে মতিন ভাইয়ের – সে গালকাটা মতিন ভাইও গত কয়েকদিন ধরে লুকিয়ে আছেন। শাইনিংয়ের বিন্দু অবশ্য রজনীতেই ছিলো। ফোনে আলাপ করেছিলো তন্ময় তার সাথে। তবে ওটা যথেষ্ট হয়নি, কাজেই পাঠিয়েছিলো ইলোরাকে। এখন ইলোরা বলছে, ওখানে গিয়ে বিন্দুকে মৃত পেয়েছে সে!

এই মুহূর্তে মারুফ ভাইয়ের সাথে হাঁটতে হাঁটতে পিঠের কাছে শির শির করে ওঠে ওর। কেউ একজন অদৃশ্য থেকে যেন চাইছে না ও জয়িতাকে খুঁজে পাক। মেয়েটার প্রতি অদ্ভুত ধরণের একটা টান অনুভব করেছে ও, সেই প্রথম চুমুর সময় থেকে। ইলোরা প্রথমে শুনে তো রীতিমত অপমান করেছিলো ওকে। এত থাকতে তন্ময়ের মত দারুণ একটা ছেলে কিভাবে একজন প্রস্টিটিউটের সাথে মাথা কুটে?

মেয়েটির সাথে আজকের বন্ধুত্ব নয় ওর। মাঝে লিভ টুগেদার করেছে বলে বন্ধুত্ব নষ্ট হয় নি, বরং আরও হয়েছে গাঢ়। তন্ময়ের জীবনে এই জয়িতা মেয়েটার গুরুত্ব আছে, সেটা বুঝতে অবশ্য ইলোরার বেশি সময় লাগেনি। এসব ব্যাপারে ওদের হয়তো ষষ্ঠইন্দ্রীয় প্রখর হয়।

এদিকে ইলোরা বেশ্যাবৃত্তি একেবারেই দেখতে পারে না। জয়িতাকে তন্ময়ের জন্য বিশেষ ছাড় দিলেও জগতের আর বেশ্যাদের নাম শুনতে সে নারাজ। বিন্দুর সাথে কথা বলতে রাজি হওয়ায় তন্ময় খুশি হয়েছিল – ইলোরাকে পাঠাবার কারণ, বেশ্যাপাড়ার মেয়েদের পুরুষের প্রতি ঘৃণা। ইলোরাকে বিন্দু যত সহজে তথ্য দেবে, তন্ময়কে দেবে না। পুরুষ ঘৃণা করার যথেষ্ট কারণ তাদের আছে।

‘কলিং বেল তো নষ্ট দেখি।’ বিরক্ত হয়ে বললেন মারুফ ভাই।
বার দুই বেল চেপে দেখে তন্ময়ও, ‘তাই তো। আরেকটা রাস্তা বের করতে হবে।’
চারপাশে তাকায় ও বাড়িটার। একেবারে রাস্তার সাথে বানিয়েছে। দরজা ভাঙ্গতে গেলে নির্ঘাত লোকজন জড় হয়ে যাবে। আর বাই অ্যানি চান্স, মতিন ভাইয়ের অবস্থা বিন্দুর মত হলে পরিস্থিতি ওদের হাতে আর থাকবে না।

‘পেছনের দিকটা দেখে আসি, চলো।’ প্রস্তাব রাখেন মারুফ ভাই।
না মেনে উপায় কি? দরজা তো “চিচিং ফাঁক” বললেই খুলে যাচ্ছে না। দুইজন ঘুরে পেছনের দিকে চলে আসে।
রান্নাঘরের পাশের ছোট দরজাটা চোখে পড়তেই একে অন্যের দিকে তাকায় ওরা। চোখে সন্দেহের দৃষ্টি।

‘পিস্তল এনেছ?’ জানতে চান মারুফ ভাই।
মাথা নাড়ে তন্ময়, ‘না। সকালে বের হয়েছি যখন, ভাবিনি দরকার পড়বে।’
‘আমার পেছনে থাকো। একটাতেই চলবে।’ কোমর থেকে একটা টানে অস্ত্রটা বের করেন মারুফ ভাই।

আস্তে করে একটা ঠেলা দিতেই দরজাটা হা করে খুলে যায়। কাওকে দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে।
জুতোর কোন শব্দ না করে সাবধানে আরও ভেতরে ঢুকে যায় ওরা। পুরো বাড়িটা একেবারে শান্ত হয়ে আছে। বাইরে থেকে কিছু পাখির ডাক শোনা যায় – এছাড়া আর কোন শব্দ নেই কোথাও।
দোতলায় ভূতের মত নিঃশব্দে উঠে আসে ওরা। একেবারে উত্তর দিকের ঘরটাতে চোখ পড়তেই পা থমকে যায় তন্ময়ের। টকটকে লাল রঙের বের হয়ে এসেছে ঘরটা থেকে। খুবই সামান্য পরিমাণে। ভেতরে কি চলছে বোঝার জন্য জ্যোতিষী হবার কোন প্রয়োজন নেই – এক হাত বাড়িয়ে পিতলের ভাস্কর্যটা তুলে নেয় তন্ময়। একেবারে খালি হাতে যাওয়ার থেকে এ বরং–

দরজাটা পেরিয়ে প্রথম চোখে পড়ল মতিন ভাইয়ের দিকে। লোকটার নাম কবে তেকে ‘গালকাটা মতিন’ হয়েছে তা ওর জানা নেই। তবে এই অবস্থাতে কেউ দেখলে তাকে ‘গলাকাটা মতিন’ নামে অনায়াসে ডাকা শুরু করতে পারে।

দ্বিতীয় শরীরটার দিকে নজর পড়তে ওর হাত থেকে লম্বা পিতলের লাঠিটা পড়ে যায়।

একটা চেয়ার উল্টে পড়ে আছে।
হতভাগ্য মেয়েটা মৃত্যুর আগে ছটফট করার সময় চেয়ারে পা বাঁধিয়েছিল নিশ্চয় – তাতেই উল্টে গেছে ওটা।
ফর্সা গলাটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার পর ক্যানভাসে আঁকা অদ্ভুত এক ছবিটার মত মনে হচ্ছে দৃশ্যটাকে। কয়েক ঘণ্টা আগে বের হয়ে যাওয়া রক্তগুলো হাল্কা জমাট বেঁধে থকথকে একধরণের ঘন তরলে পরিণত হয়েছে, রঙ পাল্টে হয়ে গেছে কালচে লাল।

জয়িতা!

বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ওর – কাঁদতে চাইছে, ফোঁপাতে চাইছে, চিৎকার করতে চাইছে, সব কিছু ভেঙ্গে ফেলতে চাইছে – কিন্তু কিছুই করতে পারে না ও।
পেছন থেকে মারুফ ভাইয়ের গুরুগম্ভীর গলাটা শোনা যায়, ‘বেডটাইম, শুয়োরের বাচ্চা।’

পিস্তলটা তুলে একবার আঘাত করেন তিনি তন্ময়ের ঘাড়ে।
কাটা কলাগাছের মত জয়িতার রক্তের ওপর শুয়ে পড়ে ও।

৬.
‘তোমার প্রেম দেখে তো আমারই চেতনাদণ্ড দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলো।’ ঘোলা ঘোলা চোখে তাকানোর সাথে সাথে প্রথম এই কথাটাই শোনে তন্ময়।
দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে দেরী হয় না ওর, ‘অ্যান্টি পার্টি।’
ঘর কাঁপিয়ে হাসেন মারুফ ভাই, ‘আর কে? তোমার দুলাভাইকে আশা করনি নিশ্চয়?’
‘ধরেছেন কেন আমাকে?’

শান্ত গলাতে প্রশ্ন করে এখন তন্ময়। জয়িতাকে নিয়ে হা-হুতাশের সময় এটা নয়, স্পষ্ট বুঝতে পারছে কেন তাকে আটকে ফেলা হয়েছে। বিরোধী দলের লোক এই মারুফ ভাই, এটা এখন স্পষ্ট। আর তার প্রতি আক্রোশ থাকার কারণ একটাই হতে পারে। তন্ময়দের দলের সেক্রেটারির মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো বিরোধীদল।

তাদের ওপর এমন একটি দায় চাপিয়ে দিয়েছিল তন্ময়, যে অপরাধটি তারা করেনি। আঙুল তোলা হয়েছিলো, মামলা করা হয়েছিলো, বিরোধীপক্ষের ১৪ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে জেলখানায় ভরে দেয়া হয়েছে, ইমেজের বাজানো হয়েছিল বারোটা। এদের মধ্যে অন্তত ৫ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হবে, সবাই জানে।

সব মিলিয়ে মাজা ভেঙে দেয়ার সব কাজই সম্পন্ন করা হয়েছে। ফলাফল হিসেবে জাতীয় নির্বাচনে এবার তাদের হয়তো হারতে হবে। কোন অন্যায় না করেও মাথা পেতে নিতে হবে শাস্তি। কাজেই পালটা আঘাত হানতে চাওয়া দোষের কিছু নয়।

এখন মারুফ ভাই তাকে কেন চেয়ারের সাথে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে রেখেছেন সেটা বেশ ভালোই বোঝে ও। এভাবেই অষ্টম অপারেশনের সময় রিজভী নামক এক পাতিনেতাকে ধরেছিলো ওরা। নিজের দলের ওপর থেকে মিথ্যে অভিযোগ সরাতে স্বীকারোক্তি দরকার ছিলো।

মারুফ ভাইয়ের হাতের হাতুড়িটা দেখে বোঝা যায়, খুন তিনি করবেন না, তবে স্বীকারোক্তি আদায় করে ছাড়বেন।

প্রশ্নটাও তন্ময় জানে : “তারেক আদনানকে কে খুন করেছিলো?”

মারুফ ভাই মুচকি হাসছেন, ‘কেন তোমাকে ধরে এনেছি তা বুঝতে তো কষ্ট হওয়ার কথা না। জয়িতা নিয়ে তোমার অবসেশন আমাদের নজরে পড়েছে। মনে করছ, তোমাদের মাথামোটা তারেক আদনান যে এক বেশ্যার সাথে থাকতো ময়মনসিংহে – সেটা আমাদের জানা ছিলো না? ঠিক সেই বেশ্যার ব্যাপারেই কেন এত আগ্রহ দেখাবে আরেকজন একই দলের লোক?’
‘নাটকীয় পরিচয় ছিলো আমার আর জয়িতার।’ শুধু এতটুকুই বলল তন্ময়, পুরো ঘটনা শুধু ইলোরা জানে, এই লোকের কাছে ইলোরা ওকে বিক্রি করে দিয়েছে কি না তা ওর জানা নেই। তবে ধরে নেয়, দেয় নি। সুযোগ কাজে লাগিয়েছে মারুফ সম্ভবতঃ।
‘নিশ্চয়, অপারেশন – কিলিং তারেক আদনানের সময় সেই নাটকীয় পরিচয়? ডেট আমাদের কাছে কালেক্ট করা আছে। ওই সময় তুমি তার সাথেই ছিলে।’
কাঁধ ঝাঁকায় তন্ময়, ‘তারেক আদনান ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিলো। বিশেষ একটা মিটিংয়ের উদ্দেশ্যে তখন দুইজনই ময়মনসিংহে ছিলাম।’
‘তাই?’ সরু চোখে তাকান মারুফ ভাই, ‘শেষ দিন তাহলে তারেকের মাগী তোমার বিছানাতে আসলো কী করে?’

চুপ হয়ে যায় তন্ময়।
এত কিছু জানার কথা নয় মারুফের। নিঃসন্দেহে ইলোরা সব বলে দিয়েছে। মেয়েটাও পার্টিতে ঢুকেছে নাকি?
তন্ময়ের জানা ছিলো না।
মারুফ ভাই হাতুড়ি নিয়ে এগিয়ে আসছেন। নির্যাতনটুকু হবে অবর্ণনীয়, জানে তন্ময়। ঠিক এভাবেই নির্যাতন করেছিলো ওরা পাতিনেতা রিজভীকে।

পিটিয়ে একটা একটা আঙুল ভেঙ্গে ফেলেছিলো ওরা। তারপর ইঞ্চি ইঞ্চি করে দুই হাতের চামড়া ছিলে ফেলেছিলো লোকটার। তারপরও কথা বলেনি হারামজাদা। তলপেটে দুইবার চাকু মেরেছিলো তন্ময় নিজ হাতে।
তার আধঘণ্টা পরও যখন অসহ্য গোঙ্গানী ছাড়া আর কিছু বের হয়নি লোকটার মুখ থেকে – রাগ সামলাতে না পেরে গলাতে চাকু লাথি মেরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ও।
আজ কি তার সাথে একই কাজ হতে যাচ্ছে? ওই পার্টির রিজভী সহ্য করেছিলো, তবুও স্বীকার করেনি।
আজ তন্ময় পারবে তো?

গলায় ছুরি নিয়ে ফোঁপানোর মত শব্দ করতে করতে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে মারুফ ভাই, তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে তন্ময়। তিক্ত সত্যটা মাত্র উপলব্ধি করতে পেরেছে।

পেছনে থর থর করে কাঁপছে ইলোরা।
কখন যেন গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে, ঢুকে পড়েছে এই বাড়ির ভেতর। তার কাঁপাকাঁপির রহস্যও স্পষ্ট; এই মাত্র মারুফ ভাইয়ের গলায় আস্ত একটা চাকু গাঁথিয়ে দেওয়ার মানসিক ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি বোধহয়।

‘হাত খুলে দে। কুইক!’ চাপা কণ্ঠে হুংকার দেয় তন্ময়।

পরিশিষ্ট
জন্তুর মত চিৎকার করছে ইলোরা, কান পর্যন্ত হাসি ছড়িয়ে পড়লো তন্ময়ের। সুইয়ের মত চিকন শিকটা ওপর থেকে ঢুকিয়ে স্তনের নিচ দিয়ে বের করে আনল আবারও।
তড়পে উঠছে মেয়েটার পা দুটো, দেখে সামান্যতম অনুকম্পা হয় না তন্ময়ের মনে।

‘আমার স্বীকারোক্তি বের করতে সব নাটক সাজানো হয়েছে – এটা খুবই ভালো একটা গল্প। কিন্তু তার জন্য বিন্দু আর জয়িতাকে কেন খুন হতে হবে? গল্পের অসমাপ্ত প্রশ্ন যে থেকে যাচ্ছে, ডিয়ার ইলোরা।’
‘আমি জানি না – ওহ গড – আমি জানি না -’ হাঁফাতে হাঁফাতে বলে ইলোরা, মেয়েটাকে এখন আরও সুন্দর লাগছে – মনে মনে স্বীকার করতেই হয় তন্ময়কে।

আচ্ছা, যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় কি মেয়েদের রূপ বেড়ে যায়?

‘মারুফ বেচারাকে পর্যন্ত টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছ তুমি, ইলোরা। জানতে তার মত সে এগিয়ে যাবে – পার্টির স্বার্থে দুটো বেশ্যা খুঁজে বের করা অথবা খুন করা তার জন্য ব্যাপারই না। তাছাড়া, মৃত্যুর আগে জয়িতার কাছ থেকে স্বীকারোক্তিও নিতে পারছে সে। কিন্তু, জয়িতার গলাতে ছুরি চালানোর দরকার ছিল না। জ্যান্ত জয়িতা আদালতে ভালো সাক্ষী হতে পারতো। কার হাত ছিলো ওই ছুরিটার হাতলে?’
‘আমি জানি না, প্লিজ, তন্ময়। পাগল হয়ে গেছ তুমি – একটা প্রস্টিটিউটের মৃত্যুতে -’

বিদ্যুতবেগে বাম হাতে হাতুড়িটা তুলে এনে দড়াম করে আছড়ে ফেলে ও মেয়েটার বাম পায়ের আঙুল গুলোর ওপর।
বিশ্রী একটা কড়মড় শব্দে ভরে যায় মাটির নীচের ঘরটা। আজ বিকেলে এখানেই নিয়ে এসেছে ও ইলোরাকে।

মেয়েটার গলা ভেঙ্গে গেছে চেঁচাতে চেঁচাতে। কুমীরের নিঃশ্বাস নেওয়ার মত শব্দ বের হচ্ছে এখন তার মুখ দিয়ে। হাত তুলে অন্য পায়ের ওপর হাতুড়ি নিয়ে আসে তন্ময়, ‘কে ছুরি মেরেছিলো? সত্য স্বীকার করে নাও – মুক্তি দেবো তোমাকে। নাহলে প্রতিটা হাড় ভাঙ্গব আজ তোমার।’
ঠাণ্ডা কণ্ঠটা তেমন ছোঁয় না ইলোরাকে বরং ছুঁয়ে যায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা – বাম পায়ের নিচের দিকটা গরম হয়ে গেছে, ফুলছে। হাড়গুলো ভেঙ্গেই ক্ষান্ত দেয়নি – থেঁতলে গেছে মাংস।

হাতুড়িটা শক্তি দিয়ে ডান পায়ের ওপরও নামিয়ে আনে তন্ময়, চোখ থেকে ঝর্ণার মত পানি বের হয়ে আসে ইলোরার। সত্যটা বললে ওকে মেরেই ফেলবে তন্ময়, কিন্তু আর যে পারছে না যন্ত্রণা সহ্য করতে!

‘আমি। ওহ প্লিজ, তন্ময়, আমি মেরেছি মাগীকে। তোমার সাথে আর কাওকে সহ্য হয় না আমার – যা করেছি তোমাকে ভালোবেসে – মরে যাচ্ছি তন্ময়, খুব ব্যথা, আমাকে খুলে দাও?’ হাঁফায় মেয়েটা, তন্ময় কিছু বলে না।
‘মারুফের ব্যাপারটা কন্ট্রোলে রেখেছিলাম, তন্ময়, তোমার কোন ক্ষতি হতে দিতাম না আমি – কিন্তু ওই বেশ্যাকে তোমার হতে দিতে পারতাম না আমি – প্লিজ বোঝ একটু- ‘ চোখ দিয়ে পানি পড়ার যেন কোন বিরাম নেই – তার মাঝেই ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলাতে বলে ইলোরা, ‘আমাকে খুলে নামাও? অনেক ব্যথা যে! পিপাসা খুব – একটু পানি খেতাম -’

খুব কাছে চলে আসে তন্ময়, বার দুই গাঁথিয়ে দেয় হাতের চাকুটা ইলোরার তলপেটে।
হেঁচকি ওঠানোর মত শব্দ হচ্ছে এখন মেয়েটার মুখ দিয়ে।
মরবে ও, তবে অনেক সময় নিয়ে।

ওর সামনে থেকে ঘুরে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য এগোয় তন্ময়। পেছনে কাতরাচ্ছে ইলোরা – দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দেয় ও।
খারাপ একটা মেয়ের রক্ত লেগে আছে শরীরে, গোসল করতে হবে।

— ০ —
রচনাকাল – সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৪

সন্তান

১.

‘আমার পেটে শাহেদের বাচ্চা।’

লিনিতার মেসেজটা দেখে পাছার ধাক্কায় চেয়ার উল্টে ফেললাম।
ছুটির দিন বাসায় বসে আয়েস করে ফেসবুকে চক্কর দেওয়ার মাঝে যে আনন্দ সেটা ব্যাচেলর ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। মাথার ওপর বন বন করে ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাস আর কানের মাঝে ঝনঝন করে বাজতে থাকা লিংকিন পার্কের ‘ক্রলিং’; ব্যাচেলর হৃদয় এসময়গুলোয় থাকে দুশ্চিন্তা মুক্ত। ‘কেয়ামত নামিয়া আসিতেছে’ জাতীয় সমস্যাগুলো ছাড়া এর ব্যত্যয় ঘটে না।
ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর পেটে বন্ধুবরের বাচ্চা – এটা একটা কেয়ামত নেমে আসার মতো সমস্যা। চেয়ার উল্টে ফেলার জন্য মনের ভেতর কোনরকম পাপবোধ অনুভব করলাম না।
থাবড়ে থুবড়ে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি অফ হয়ে আছে। চার্জ শেষ হয়ে গেছে কখন জানি। পাঁচ বর্ণের একটা ছোট অথচ উপর্যুপরি নোংরা গালি দিয়ে ওটাকে চার্জারের সাথে লাগালাম। দ্রুত হাতে অন করছি ডিভাইসখানা।

লিনিতা এরকম কঠিন সমস্যায় পড়ে মোবাইলে ফোন না দিয়ে কেন ফেসবুকে মেসেজ দিয়েছে – ব্যাপারটা আমার কাছে এখন পানির মতই পরিষ্কার। মোবাইলের চার্জ ইত্যাদি নিয়ে গতকাল রাত থেকে খোঁজ খবর কিছু নেয়া হয়নি। শুধু গতকাল রাত বলে নয় – মোবাইল পাগলা বলে এককালে পরিচিত আমি গত একটি বছর ওই যন্ত্রটার ব্যবহার প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম।
ওপাশে রিং হচ্ছে। প্রথমবারের পর দ্বিতীয় রিংটুকুর শব্দ আর হতে শোনা যায় না। লিনিতা রিসিভ করে ফেলেছে।

‘তুই কই?’ ফোন ধরতেই জানতে চাইলাম।
‘কাজী অফিসে রে। রাজাবাড়ীর কাজি অফিসে। তুই একটু দেখবি প্লিজ -’
‘শাহেদ কোথায়?’ পাল্টা জানতে চাইলাম আমি।
‘ও তো এখানে নাই – তুই একটু দেখবি ও কই? একা একা দাঁড়িয়ে আছি।’
‘ওখানে কি করছিস?’
‘আজকে আমাদের বিয়ে করার কথা ছিলো।’ ওপাশে ফোঁপানোর শব্দ শুনলাম। মেয়েটা কাঁদছে?
‘দাঁড়ায়ে থাক। আমি আসছি। পনের মিনিট দাঁড়া, ওকে? আর দেখছি শাহেদ্যা কোথায়। এসে শুনবো পুরো ঘটনা।’

লিনিতা কিছু বলতে চাইছিল হয়ত – ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। ঘটনা নিদারুণ প্যাঁচ খেয়েছে।
লিনিতার বাবার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির কথা আমার অজানা নয় – এর সাথে বিয়ের দিন ঠিক করে রেখে শাহেদের অন্তর্ধানটার ব্যাপারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সাবধানে আগানো দরকার। সব রিলেশনে ‘কাইজ্যা’ বাঁধে।
এবার লিনিতাদের রিলেশনে বেঁধেছে। ‘কাইজ্যা’র আকার নেহায়েত ছোট নয়। এটা ঠিকমত সামলাতে না পারলে মগডালে উঠে যাবে দুটোই। সাহায্যকারী হিসেবে আমি সেই গাছের তলে চাপা পড়বো।

শাহেদের প্রাণের বন্ধু মোস্তফাকে ফোন লাগালাম। সেই সাথে স্যান্ডোগেঞ্জির ভেতরে নিজেকে একটা সুইয়ের মত গলিয়ে দিচ্ছি। হাতে একেবারেই সময় নেই।
লিনিতা ওখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছে – বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে। ওর পেটে কি আসলেই শাহেদের বাচ্চা? মাথা ঘুরেটুরে পড়ে যায় যদি?

মোস্তফা ফোন ধরছে না।
শালার পরবর্তী চৌদ্দগুষ্টির উদ্দেশ্য গুণে গুণে সতেরটা গালি দিয়ে ইমার্জেন্সী ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে এক লাফে বাসা থেকে বের হয়ে যাই।
গন্তব্য – রাজাবাড়ির কাজী অফিস।
অথবা, গন্তব্য – লিনিতা।

২.
লিনিতা আমাকে দেখে ক্লান্ত ভঙ্গীতে একটু হাসলো। তারপর টলে উঠে একবার।
রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলে মাঝে মাঝে টলবেই। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে একহাতে ধরে ফেললাম।

‘শাহেদ কোথায়?’ দুর্বল গলাতে জানতে চায় লিনিতা।
আমি হাল্কা করে মাথা নাড়লাম, ‘শাহেদকে খুঁজে পাচ্ছি না। শালার মোবাইল বন্ধ, শালার ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই মনে হয় বিজি। তুই এখানে শাহেদের জন্য অপেক্ষা করবি?’

নিষ্পাপ শিশুর মত মাথা দোলায় লিনিতা। এক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলাম।
এক বছরে আরও সুন্দর হয়েছে মেয়েটা। পারফিউম দিয়ে এসেছে কি না বুঝতে পারছি না। তবে মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে আসছে। এটা স্মেল-গ্ল্যান্ড থেকেও আসতে পারে। নারীর বিশেষ গন্ধ শুধু ছেলেরাই পায়। তেমনটা হয়ত পাচ্ছি এখন আমি। কতদিন ওর সাথে এত কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলা হয় না!

‘শাহেদ এদিকে আসলে নিশ্চয় ফোন দেবে? তুই আমার সাথে চল তো। ছায়ায় বসা যাক।’
চারপাশে ইতিউঁতি তাকাই। দূরে নতুন রেস্টুরেন্টটা দেখা যাচ্ছে। লিনিতার হাত ধরে টান দিলাম, ‘চল, ওখানে ঢুকি।’
‘কিছু খাবো না তো।’ বিড় বিড় করে মেয়েটা।
‘লাচ্ছি খাওয়া যেতে পারে। রোদের মাঝে খুব বীরত্ব দেখাচ্ছিস। পিপাসা তো লাগার কথা।’

লিনিতা এবার আর আপত্তি করে না। দুইজন ওদিকে আগাচ্ছি, আড়চোখে লিনিতাকে একবার দেখে ‘কাইজ্যা’র গভীরতা মাপার চেষ্টা করলাম।
একহাতে একটা ডাফল ব্যাগ। ভ্যানিটি ব্যাগের সাইজও মাশাআল্লাহ – চায়ের আস্ত দুটো ফ্লাস্ক রাখা যাবে। সেই সাথে চোখ মুখের ক্লান্তি – একটা দিকই ইঙ্গিত করে।

বাসা থেকে এই মেয়ে ভেগে গেছে।
লিনিতার চোখে আড়চোখেই চোখ পড়ল। ওকেও দেখলাম আমাকে মাপছে। মুচকি একটা হাসি দেয় ও এবার।

‘কাঁধে ব্যাগ চড়িয়ে দৌড়াচ্ছিস কোথায়? যাচ্ছিলি নাকি কোথাও?’
‘যাচ্ছিলাম তো বটেই।’ সায় দেই আমি, ‘ভেগে যাচ্ছিলাম।’
‘আমার মেসেজ দেখেই বুঝে ফেলেছিস – বাসা থেকে পালাচ্ছি। তাই না?’
‘অতটুকুই। আর কিছু বোঝার সৌভাগ্য হয়নি আমার এখনও। তুই বোঝাবি – এই আশায় আছি।’

লিনিতার চলাফেরায় আগের মত উচ্ছ্বল ভাবটা লক্ষ্য করলাম না। ঢিলেঢালা পোশাক পরে আছে। বোঝার উপায় নেই তলপেটে আস্ত একটা বাচ্চা নিয়ে ঘোরাফেরা করছে কি না। তবুও অসভ্যের মত কয়েকবার তাকালাম।
লিনিতা মজা করেনি তো বাচ্চা প্রসঙ্গে? লেট ম্যান হিসেবে আমার সুখ্যাতি আছে। সেটা এড়াতেই কি একটা মিথ্যা বলে আমাকে ঘর থেকে বের করেছে ও?

ঠান্ডা এক কোণের টেবিল দখল করতে করতে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, লিনিতার বাবুর ব্যাপারে আমার মাথা ব্যাথা কিসের? শাহেদের সাথে চুটিয়ে প্রেম করেছে একটা বছর ধরে – একটা উইকএন্ডেও রাতগুলো শাহেদের বাসার বাইরে কাটায়নি লিনিতা। ওর পেটে বাচ্চা আসবে না তো কি আমার পেটে আসবে?

বোকা মেয়েটা সতর্ক হতেও শেখেনি। এখন লেগেছে ‘কাইজ্যা’।
বোঝ এখন!

আমার দিকে ক্লান্ত ভঙ্গীতে তাকালো মেয়েটা। তারপর কী বিষণ্ণ একটা মুখ নিয়েই না হেলান দিল চেয়ারে।
‘দোষ আমার। পিল নিতে ভুলে গেছিলাম।’ আস্তে করে স্বীকার করে লিনিতা।
‘নিজেকে দোষ দিস নে।’ আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম ওকে, ‘শুধু বল শাহেদের প্রতিক্রিয়া কি?’

উত্তরটা জানার জন্য আমার বুকের ভেতরটা ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। এরকম সময় ছেলেরা পল্টি মারে বলে শুনেছি। শাহেদ আমার বন্ধু, তবে খুব ঘনিষ্ঠ কেউ নয়।
তাছাড়া লিনিতার বয়ফ্রেন্ডের সাথে লুঙি শেয়ার করার মত বন্ধুত্ব হবে আমার – সেটাও আমি চাবো না কখনও।
সব মিলিয়ে শাহেদের মনের অবস্থা আমার বোঝার কথা নয়।

‘শাহেদ অনেক ভালো রে। মেনে নিয়েছে ও। তাছাড়া আগে থেকেই জানতাম কিছু একটা ঠিক হচ্ছে না। টেস্ট করে আমার প্রেগনেন্সির ব্যাপারে আগেই জানতাম। মাসখানেক হয়ে গেল। কিন্তু তখন আমরা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম সবকিছু। এর মাঝেই বিয়েটা করে ফেললেই ঝামেলার একাংশ মিটে যেত।’
বিরক্তি আর চেপে রাখতে পারলাম না, ‘তাহলে একমাস পর কেন বিয়ের জন্য ঘুরছিস? এতদিনে তো তোর শ্বশুর বাড়িতে চলে যাওয়ার কথা।’
‘বাবা মেরে ফেলত শাহেদকে।’ শান্ত গলাতে বলে লিনিতা। আর আমি হয়ে যাই চুপ।

হাল্কা নাক টানে মেয়েটা। চমকে ওর মুখের দিকে তাকাতেই দেখি কাঁদছে ও।
আস্তে করে ওর হাত নিজের হাতে তুলে নিলাম।
একটুও শান্ত হল না এতে ও, ‘আপুর একবার হয়েছিল – জানিস – রাজন ভাইয়ের সাথে রিলেশন ছিল আপুর – বাবা ভাইয়াকে … ’
‘আচ্ছা,’ তিক্ত গলাতে বললাম আমি, ‘রাজন ভাই গত তিন বছর ধরে এজন্যই নিখোঁজ, অ্যাঁ? গুলি করে ফেলে রেখেছে কোথাও, তাই তো?’

ক্যাম্পাস আলোড়ন উঠিয়ে উধাও হয়ে গেছিলেন আমাদের ডিপার্টমেন্ট সিনিয়র রাজন ভাই। পলিটিকস করতেন না। তবে জার্নালিজমের ক্ষেত্রে কাওকে ছাড় দিতেন না। আমরা তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।
নির্দিষ্ট একটি দলের বিরুদ্ধে তাঁর লেখা জ্বালাময়ী কলামই উনার মৃত্যুর পেছনের একমাত্র কারণ – সে ব্যাপারে আমাদের মনে কোনই সন্দেহ ছিলো না। মানববন্ধন, আমরণ অনশন – সবই করা হয়েছিলো।
কাজে দেয়নি।

এখন দেখছি ঘটনা ভিন্ন!

রাজন ভাইকে নিয়ে লিনিতার মাথাব্যাথা তেমন দেখলাম না। আমার হাত আঁকড়ে ধরেছে ও এই মুহূর্তে।
‘আপুর অ্যাবোরশন করিয়েছিলো বাবা। আমি আমার বাবুটাকে ওদের হাতে খুন হতে দেবো না, নীরব। প্লিজ, আমাকে একটু সাহায্য করবি? বাবুটাকে নিয়ে পালিয়ে থাকতে হবে আমাকে কয়টা দিন।’

একজন মা তার অনাগত সন্তানের জন্য কতখানি মায়া অনুভব করে সেটা আমি আগে বুঝতে পারিনি কখনও। এখন সেটা লক্ষ্য করে খেয়াল করলাম বুকের কাছে কোথাও দলা পাকিয়ে উঠছে। চার বছর ধরে মেয়েটাকে ভালোবাসি – তবে আজকের মত অসীম মায়া কোনদিন অনুভব তো করিনি ওর জন্য!

শক্ত করে ওর হাত ধরে বললাম, ‘লিনি, আমি আছি। তোমার বাবুকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কেউ না!’

পকেটের মাঝে মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে। হাত বাড়িয়ে ওটা বের করে আনলাম।
মোস্তফার ফোনকল দেখে অন্তরের অন্তস্থল থেকে শান্তি অনুভব করলাম। এই ব্যাটার নাগাল পাওয়া গেলে শাহেদকেও পাওয়া যাবে। গার্লফ্রেন্ডের পেট বাঁধিয়ে ভেগে গেছে নাকি শালা?

ছেলেজাতিকে কোন বিশ্বাস নেই।

রিসিভ করতেই ওপাশে মোস্তফার মেয়েলী গলাটা শুনতে পেলাম, ‘কি রে, ফোন দিয়েছিলি নাকি? গডজিলা দেখতেছিলাম। বালের মুভি। সময়টাই নষ্ট করে-’
‘তোমার মুভির আলাপ শোনার জন্য ফোন দেই নাই আমি।’ ক্যাট ক্যাট করে উঠলাম।

লিনিতা চমকে উঠে আমার দিকে তাকায়। বেশি জোরে তো বলিনি – তবুও চমকে গেছে।
নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে থাকি এবার। এত করেও মোস্তফার পরের কথা শুনে আমার মুখ থেকে বের হওয়া বাক্যটা বেশ জোরেই উচ্চারিত হল।

‘আর তুমি হাওয়ার নাতি আরাম করে মুভি দেখতেছ? শাওয়া!’ টেবিলে মোবাইল আছড়ে ফেললাম আমি।
‘কি হয়েছে?’ শিশুদের মত মুখ করে আমাকে প্রশ্নটা করে লিনিতা।

ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে হয় আমার।
ইচ্ছে হয় ওর ঘন রেশমী চুলে হাত ডুবাই।
শক্ত করে বুকে আটকে রেখে বলি, ‘কিছু হয় নি, লিনি সোনা। কিছু হয় নি, সব ঠিক আছে, তোমার বাবুটাকে আমি জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করব।’

কিন্তু এগুলোর কোনটাই করতে পারলাম না। শুধু শুকনো গলাতে বললাম, ‘গতকাল রাতে শাহেদকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। সম্ভবতঃ তোমার বাবার হাত আছে এর পেছনে।’

৩.
প্যাঁ-প্যুঁ করে লঞ্চটা ছেড়ে দিলো।
পারাবত – ১১।
গন্তব্য – বরিশাল।

বাইরে থেকে লিনিতার কেবিনে বার দুয়েক টোকা দিলাম। দরজা সাথে সাথে খুলে যাওয়ার কারণ নেই – রেইলিংয়ে এসে দাঁড়ালাম।
মিষ্টি বাতাস আমার মুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। বুড়িগঙ্গার করুণ হাল হতে পারে – লঞ্চগুলোকে বমি করে খোলা বড় নদীতে এই ছোট নদীটাই পাঠাচ্ছে। চারপাশে এর মাঝে আঁধার নেমে এসেছে। আগামীকাল সকাল নাগাদ পৌঁছে যাবো আমরা বরিশাল।

এই মুহূর্তে আর কোন ভালো সমাধান পেলাম না। বরিশালে আমার খালাতো ভাইটি আছে অনেকদিন ধরেই। কাশীপুরে থাকে, ব্রজমোহন কলেজের একজন নবাগত লেকচারার।
ভাইটির সাথে আমার বয়েসের পার্থক্য খুব বেশি না। বোঝালে পরিস্থিতি তিনি বুঝবেন বলেই মনে করেছি। আমার এখন আর আমাকে বা লিনিতাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে না। চিন্তা হচ্ছে শাহেদকে নিয়ে।
পুলিশের লোকেরা শাহেদকে নিয়ে সোজা লিনিতার প্রভাবশালী বাবার সামনে এনে ফেলবে সন্দেহ নেই।
তারপর কি হবে?

রাজন ভাইয়ের মত এই ছেলেও কি নিখোঁজ হয়ে যাবে না?
আমার মনের একটা অংশ গোটা ব্যাপারটায় পৈশাচিক একটা আনন্দ অনুভব করছে – বুঝে রীতিমত লজ্জায় ভরে গেল মনটা।
ছি ছি – এটা আমার ভাবা তো উচিত না। লিনিতার সন্তানটি এই শাহেদেরই – আর শাহেদেরই অধিকার সবচেয়ে বেশি লিনিতার ওপর। আড়াল থেকে মেয়েটিকে ভালোবাসতে পেরেছি এই তো যথেষ্ট।
দৃশ্যপট থেকে প্রেমিকার প্রেমিক সরে গেলে আনন্দে বগল বাজানোটা তো ছোটলোকি হয়ে যায়। আমি ওরকমটা কিভাবে করতে পারি?

তবে শাহেদ না আসলে আমার করণীয় কি সেটাও আমি জানি। আর একবছর পর জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাদের ব্যাচটাও বের হয়ে যাবে। নিজের একটা ভবিষ্যত আমি গড়ে তুলতে পারবো। আর তাতে থাকবে লিনিতা আর তার বাবুটা।

পেছন থেকে খুট করে দরজাটা খুলে যায়। চওড়া একটা হাসি উপহার দিলাম লিনিতার দিকে। তারপর সাবধানে ভেতরে ঢুকে যাই। কেবিনের ভেতরটা বেশি বড় নয়। তবে বেশ একটা ‘পানিতে আছি’ ‘পানিতে আছি’ ভাব টের পাওয়া যায় এখানে।

‘ভাবিস না। আর কয়েক ঘন্টার পর একেবারে রাডারের নিচে চলে যাবি। তোর বাবা তোকে জোনাকি পোকা জ্বালিয়েও খুঁজে পাবেন না।’ আশ্বস্ত করি ওকে, ‘কেমন লাগছে এখানে?’
আস্তে করে বাংকে পা দুলিয়ে বসে পড়ে মেয়েটা, ‘খারাপ লাগছে না। তুই আমার পাশে একটু বসবি?’

কোন কথা না বলে ওর পাশে বসে পড়ি। আস্তে করে আমার কাঁধে মুখ ঠেকায় মেয়েটা। তারপর একটু ঘুরে গাল ছুঁইয়ে রাখে।এক হাতে ওকে আমার সাথে জড়িয়ে রাখি আমিও। একটু কেঁপে কেঁপে ওঠে লিনিতার শরীর।

আমার দিকে বড় বড় চোখ দুটো মেলে দেয় তারপর, ‘গতকাল আমাকে আর শাহেদকে দেখে ফেলেছিল বাবার লোক।’
‘এজন্যই এতদিন পর তোরা ফাইনালি পালানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলি?’ বোঝার ভঙ্গী করলাম।
‘জানতাম তখনই। জানতাম, হাতে বেশি সময় নেই আর। কাল রাতেই যে বাবা ওকে ধরে ফেলবে সত্যি ভাবিনি।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, ‘ভাবিস না। আমি ওকে মুক্ত করে আনবো।’
কিছু না বলে চুপচাপ আমাকে ধরে বসে থাকে মেয়েটা। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ও নিজেও ফেলে।
একটু করে চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম ওর। এই বড় পৃথিবীটায় বেচারির কেউ নেই এখন, আক্ষরিক অর্থেই।

‘তোকে ধরে আছি বলে আমাকে খারাপ ভাবলি?’ আস্তে করে জানতে চায় লিনিতা।
মাথা নাড়ি আমি, ‘তা কেন? তোর ওপর দিয়ে অনেক কিছু গেছে। এখন কিছু না ভেবে চুপচাপ বসে থাক তো।’
‘আমার খুব একা একা লাগছে।’ শোনা যায় না প্রায় – এভাবে বলে মেয়েটা।
ওর থুতনীতে হাত রেখে তুলে ধরলাম আমার দিকে, ‘ভয় করছে?’

পাখির বাবুর মত মাথা দোলায় লিনিতা।
ওর ছোট একটা নাক, লালচে দুটো গাল, হাল্কা ঘাম ঘাম কপাল আর কপালে জমে থাকা চুলগুলো আমাকে স্থির থাকতে দেয় না। ওকে জড়িয়ে রাখি নিজের আরও কাছে। তলপেটটা একটু ফুলে আছে ওর, বাবুটা ওখানেই বেঁচে আছে নিশ্চয় – কি অদ্ভুত!
গলা নামিয়ে বললাম আমিও, ‘আমি তোর সাথে আছি। একটুও ভয় পাবি না তুই, হুঁ?’

সাথে সাথে চারপাশের আলো নিভে গেল দপ করে। চমকে উঠে আমাকে শক্ত করে খামচে ধরে লিনিতা।
ওর কপালে একটা চুমু খেলাম, ‘তুই চুপটি করে শুয়ে থাক। আমি দেখে আসছি।’

লিনিতা অনিচ্ছাস্বত্বেও আমাকে ছেড়ে দেয় আলিঙ্গন থেকে। ঠিক এই সময় দরজার ওপর জোরে আঘাত করে কেউ।
একবার।
দুইবার।
তিনবার।

এরপর ভেসে আসে ভারী গলাটা।
‘দরজা খুলুন, পুলিশ!’

চট করে একে অন্যের দিকে তাকাই আমরা। বাসা থেকে লিনিতার পালানোর পর প্রায় আঠারো ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে – কেউ কি দেখে ফেলেছে আমাদের এদিকে আসতে? লঞ্চে উঠতে খেয়াল করেছে লিনির বাবার কোন পোষা কর্মচারী?
এখন কি ওরা লিনিতাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে?

‘আমার বাবুটাকে ওরা মেরে ফেলবে!’ ফিস ফিস করে বলে লিনিতা।
অসহায়ের মত ওর দিকে তাকিয়ে থাকি আমি।

৪.
কেবিনের ঠিক বাইরে বের করে এনে আমাকে লঞ্চের দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে রাখা হয়েছে। পকেট থেকে একে একে বের হয়ে আসে আমার চকচকে স্মার্টফোন, একটা মানিব্যাগ, আর বাসার চাবিটা।

‘চাবি নিয়ে ঘোরেন কেন?’ ছোট খাটো একটা হাতির সাথে যায় – এমন আকারের পুলিশটি প্রশ্ন করল আমাকে।
পেছনের বডি বিল্ডার পুলিশটির চাপে আমার দাঁত খুলে যেতে থাকে, তার মাঝেই কোনমতে উত্তর দেই, ‘তালা খোলার জন্য।’
‘চেহারা দেখে তো পাক্কা চোর লাগতেছে, স্যার। এরে দিয়া এর চেয়ে বড় কাজকাম কিছুই হইবো না।’

এই পুলিশটার দিকে ঘাড় বাঁকা করে তাকালাম। রেইলিংয়ে পশ্চাদ্দেশ ঠেকিয়ে ডান হাতের কানি আঙুল দিয়ে ঘষঘষ করে কান চুলকাচ্ছে। ইচ্ছে করছিল এক ধাক্কা দিয়ে ব্যাটাকে রেইলিংটা পার করে পানিতে ফেলে দিতে।
কিন্তু পারলাম না।

‘এই শালার চেহারা সুবিধার লাগছে না।’ তিনজনের মাঝে নেতাগোছের পুলিশটি এবার বলে, ‘খিঁচে সার্চ কর তো, সোহরাব।’

সোহরাব আমাকে ‘জাতা’ মেরে দেওয়ালে এতক্ষণ চেপে রেখেছিলো নিশ্চয়। এবার তার হাত দুটো অসভ্যের মত আমার শরীরের ওপর ঘোরাফেরা করতে থাকে। ‘খিঁচে’ সার্চ করছে।
সমকামী নাকি?

কান চুলকানোর কাজ শেষ করে তৃতীয় পুলিশ আমার ব্যাগ নিয়ে পড়ল, ‘বিশ হাজার টাকা। নগদ। স্যার, এর মানে কি?’
‘স্যার’ দুই লাফে ব্যাগের কাছে চলে গেছেন ততক্ষণে, ‘আরে এই-ই তাহলে আমাদের সেই লোক।’
আমি ইঁদুরের মত শব্দ করে বললাম, ‘কোন লোক?’
‘শাট আপ!’ তড়পে উঠলেন পুলিশ ভদ্রলোক, ‘নগদ এত টাকা কেন? আর মাইয়া নিয়া চলতেছ – কিছুই বুঝি না?’

আমার বুকটা ধ্বক করে ওঠে। লিনিতার পালানোর খবর এরা জেনে গেছে নির্ঘাত! আর এজন্যই একেবারে দলবল নিয়ে হাজির হয়ে গেছে। মেয়েকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েই বাচ্চার বারোটা বাজিয়ে দেবে নিশ্চয় বাবা-মহাশয়। আর আমাকে ‘নাগর-প্রবর’ মনে করলে স্রেফ নাগরদোলায় চড়ানো হবে – এতেও সন্দেহের কিছু দেখলাম না।

আমাকে সার্চ করতে থাকা লোকটাকে বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললাম, ‘আর কত সার্চ করবেন? নগ্ন করে ফেলবেন নাকি?’
মুখ ঘষে নোংরা পুলিশটা, ‘হলে তো ভালোই হয়। অন্ধকারে সার্চ করা যায় না ঠিক মত।’
নেতা পুলিশটা আমার মাথার পেছনে রোলার দিয়ে একটা উপর্যুপরি গুঁতো দেয় এসময়, ‘ন্যাকামি হচ্ছে! বাচ্চাটা কই? অ্যাঁ? বাচ্চা কোথায়?’

মাথাতে এত জোরে আগে কেউ মারেনি আমাকে। গোঁ গোঁ করতে করতে পড়ে গেলাম।
লিনিতাকে দেখলাম শিউড়ে উঠেছে একেবারে। আমি মাটিতে শুয়ে পড়েছি ততক্ষণে। খুব বলতে চেষ্টা করলাম, ‘আমাকে মাফ করে দিস, লিনি!’
কিন্তু পারলাম না।

কান চুলকানি পুলিশ উঠে দাঁড়ায় আমার ব্যাগের ওপর থেকে। বলে, ‘বাচ্চা দেখলাম না, স্যার।’
স্যার মাথা দোলালেন, ‘টাকাটা রেখে দাও। শিওর তো?’
দাঁত কেলায় সোহরাব, ‘ওই কাজে আমরা কোনকালে শিওর ছিলাম না, স্যার?’
নেতা-পুলিশের অহংয়ে বাঁধল এবার, ভারী গলাতে বললেন, ‘আমি বাচ্চার কথা বলেছি।’
‘নাই, স্যর।’

মনে মনে আমি বললাম, ‘বাচ্চা তো লিনিতার পেটের ভেতর। ব্যাগের চিপাতে খুঁজে কে কবে পেয়েছে ওই জিনিস?’
মুখে কিছু বললাম না।
চিৎ হয়ে শুয়ে আছি – এই সময় কানে খাটো পুলিশটি স্যারের দিকে এগিয়ে যায়, ‘মোবাইলখান ভালো মাল স্যার।’
‘বেশি টেনো না, ইদরিস।’ সতর্ক করে লিডার-পুলিশ, ‘পরে ঝামেলায় পড়বে। টাকা নিয়েই আপাতত সন্তুষ্ট থাকো।’

আমার মোবাইল সম্ভবতঃ ওদের সাথে যেতে চাইছিল। হাহাকার করে রিংটোন বাজিয়ে ডেকে উঠলো ওটা।
আমি ধড়মড় করে উঠে বসছিলাম, তার আগেই নাফরমান পুলিশটা রিসিভ করে ফেলেছে। তাও আবার লাউডস্পীকারে।
আমি এখান থেকে রেজা ভাইয়ের গলাটা স্পষ্ট শুনতে পেলাম। ক্যাম্পাস সিনিয়র।

‘আরে মিয়া তুমি সারারাত ফোন অফ কইরা রাখছো! এখন আবার ফোন ধর না। কয়বার ফোন দিছি তোমারে?’

আমি মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছি রোলারের বাড়ি খেয়ে। কিভাবে রেজা ভাইকে বোঝাবো তখন আমি আমার স্বপ্নবালিকার হাত ধরে ছুটে পালাচ্ছিলাম। বালিকা পালাচ্ছিল তার বয়ফ্রেন্ডের বাচ্চা পেটে নিয়ে। মানে, বয়ফ্রেন্ডের অদৃশ্য হাত ধরে!
অভূতপূর্ব রোমান্টিক মুহূর্তগুলোয় রেজা ভাইয়ের ফোনকল কেটে দেওয়া ছাড়া আমার গতি ছিলো না। শালার পুলিশ – ধরেই ফেলল ফোনকলটা।

নেতাটি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘কথা বলেন।’
আমি খামচি দিয়ে ফোনটা ধরলাম, পুলিশ ইঙ্গিতে বলল ‘লাউডস্পীকার অন থাকুক’। চিংড়ির মত মুখ করে ফোনের সামনে মুখ নিতেই হল।

‘কি ব্যাপার, নীরব। কথা বলছ না কেন? মিউজিয়মে আমি প্রায় চার ঘণ্টা ধরে। তোমাকে সাথে করে আসতাম – তোমার খবর নেই কেন?’
আমি ফোন হাতে এবার বাঘ হয়ে গেলাম, ‘আমার গার্লফ্রেন্ড প্রেগনেন্ট। ওকে নিয়ে বরিশাল যাচ্ছি।’

পুলিশ তিনজন স্রেফ ‘দোচনা’ হয়ে গেছে। একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে ওরা। আমি নিশ্চিত, ফোনের ওপাশে রেজা ভাইয়ের প্রেশারও কয়েক ডিগ্রী বেড়ে গেছে। আর সব সময় চমকালে তিনি যা করেন –চোখ স্রেফ কপালে তুলে ফেলেছেন।

‘লে হালুয়া।’ বিড় বিড় করে বললেন তিনি।
‘ভাই মহা ঝামেলাতে পড়ে গেছি। কথা তো শোনেনা শিরিন। পিল নিতে মনে না থাকলে আমার দোষ?’
‘না না , তোমার আর কি … আচ্ছা, সরি, ঝামেলা সামলাও। আমি এদিকটা দেখছি।’

ফোন রেখে দিতেই পুলিশ তিনজন আমাকে ধরে বসালো, লিডার হাতের কাছে রোলার রাখলেও এখন বেশ কোমল তাঁর চেহারা, ‘ইয়ে, ইনি কে ছিলেন?’
দেওয়ালেই হেলান দিলাম আমি, ‘ক্যাম্পাসের সিনিয়র। আমাদের ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই। একটা কেস স্টাডির জন্য ডেকেছিলেন। আমার যাওয়া হয় নি।’
‘কেস স্টাডি?’
‘আমরা জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের।’

পুলিশ তিনজনের চেহারা হয়েছে দেখার মত।
নিমেষে হুংকার ছাড়লেন নেতা-পুলিশ, ‘ভাইয়ের জিনিস ফেরত দে। দেখ, সবকিছু ঠিকমত দিয়েছিস কি না। ভাইরে দেখা সব ঠিক আছে কি না!’
সোহরাব হারামজাদাকে দেখলাম পাছার ভাঁজ থেকে আমার বিশ হাজার বের করে আবার ব্যাগে রাখছে। মনটা চাইলো কানের ওপরে আর নিচে একটা করে বসিয়ে দিতে। কিন্তু লিনিতার কম্পমান শরীর দেখে কিছু বললাম না।
মেয়েটাকে ওরা সার্চ করেনি ঠিকই – কিন্তু দাঁড় করিয়ে রেখেছে।

পুলিশগুলো আমার জিনিস গুছিয়ে সাজিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দেয়। তারপর একবার ক্ষমাপ্রার্থনা করতে তারা ভোলে না। নেতাটিকে দেখলাম দাঁত বের করে একটা নোংরা জোকস শুনিয়ে দিলো।
আমিও শুকনো হাসার ভান করলাম। একটু আগে যে মাথার পেছনে গর্ত করে দিয়েছে রোলার মেরে – তার কৌতুক শুনে প্রাণ খুলে হাসা যায় না।

ওদের সামনেই লিনিতাকে জড়িয়ে ধরি। কাঁপছে মেয়েটা।
কানে কানে বললাম, ‘ভয় নেই, লিনি। শান্ত হও।’
মেয়েটা আমাকে চুপচাপ জড়িয়ে থাকে। কাঁপুনি আগের চেয়ে কমে গেছে।

শুনতে পেলাম, কান চুলকানো পুলিশ গলা নামিয়ে বলছে, ‘আগেই কইছিলাম না, মাইয়া পোয়াতী?’
আমি গলা চড়িয়ে জানতে চাইলাম, ‘শুনুন?’

নেতা পুলিশ চমকে ফিরে তাকায়।
হাসিমুখে তার দিকে এগিয়ে যাই, ‘কারেন্ট চলে গেল কেন?’
হতভম্ব দেখায় এবার পুলিশকে, ‘আমি তো ঠিক জানি না। সম্ভবতঃ পাওয়ারে কোন সমস্যা হচ্ছে। দেখছি আমি।’

মাথা দুলিয়ে লিনিতার দিকে ফিরে আসছি – নীচে কোথাও প্রচণ্ড শব্দ হল। তারপরই চিমনি বেয়ে লক লক করে আকাশের দিকে ছুটে যায় আগুনের শিখা।
নিচে কিসের শব্দ হয়েছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। মেরুদণ্ড শীতল হয়ে যায় আমার ওতেই।

শব্দটা বিস্ফোরণের!

৫.
লঞ্চ ডুবছে।
লিনিতার হাত ধরে ছুটছি প্রানপণে। একেবারে মাঝ নদীতে ডুবতে থাকা লঞ্চের ভেতর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়।
সবাই ছুটছে – যার যেদিকে মন চায়।
এদের অধিকাংশই সাঁতার পারে না।

সাঁতার পারলেও খুব একটা কিছু আসে যায় না। লঞ্চ ডোবার সময় ডুবন্ত একটি মগ যেভাবে বালতির পানি টেনে নেয় – সেভাবে সবাইকে টেনে নিবে নিজের ভেতরে। তারপর ডুববে।
এটার চেয়ে বড় সমস্যা হল আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলছে। ছড়িয়ে আসছে এদিকে।
লিনিতার হাত শক্ত করে ধরে আছি। ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যেতে ওকে আমি দেব না। অনেক দিন অপেক্ষার পরে এই মেয়েটিকে পেয়েছি। আর হারাতে চাই না ওকে আমি।

শাহেদের ওপর আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। যেই ছেলে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না – তার কি কোন অধিকার আছে লিনিতার ভালোবাসা পাওয়ার?
মেয়েটার দিকে একবার আড়চোখে তাকাই – ভীত হরিণীর মত দেখাচ্ছে ওকে। আগুণের হলদে আভা তার চোখে মুখে পড়ছে। আরও বেশি সুন্দর লাগে ওকে আমার এই মুহূর্তে।

শাহেদ তো ওর জন্য কিছু করে নি। বিয়েটা পর্যন্ত করতে পারলো কোথায়? বরং সন্তানের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।
সতর্কতা গ্রহণের জন্য তার কি কোন পদক্ষেপ নেওয়ার ছিলো না?
আগুনে ডুবন্ত একটা লঞ্চ থেকে ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে আমার লিনিতা – শাহেদ কোথায় এখন?

পাশের রেইলং টপকে এক মাঝ বয়েসী লোক পড়ে যেতে থাকে পানিতে – হয়ত কারও ধাক্কা লেগেছে, তাল সামলাতে পারেননি।
দৃশ্যটা আমাকে থমকে দেয়। লিনিতা পাশ থেকে তাড়া দেয়, ‘এগিয়ে চলো, নীরব। দাঁড়াবে না।’
ভয়ার্ত চোখে ওর দিকে তাকালাম, ‘যাবো কোথায়?’

কিছু বলল না ও, হাঁফাচ্ছে। একে অন্যের দিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে থাকি আমরা।
লঞ্চ আগের চেয়েও ডুবে গেছে এখন। আর আধঘণ্টার মাঝেই পানির তলে চলে যাবে একেবারে – যা মনে হচ্ছে।
কেউ একজন ফ্লেয়ার গান দিয়ে আকাশে একটা ফ্লেয়ার মারে। রাতের আকাশ কিছুটা আলোকিত হয়ে উঠেছে ওটার আলোতে।
কান না পাতলেও লঞ্চের যাত্রীদের চিৎকার, কান্না আর হাহাকারে পরিবেশ ভারী হয়ে আসতে শুরু করেছে এরই মাঝে। লিনিতা ঝট করে চোখ সরিয়ে নেয় ঠিক তখনই। আচমকা দৌড় দেয় সিঁড়ির দিকে।

সবাই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে এখন। ওপরের অংশ পরে ডুববে – ধারণাটাকে পুঁজি করে বাঁচার চেষ্টা একটা। সেই ভীরের মধ্য দিয়ে লিনিতা নিচের দিকে নামতে থাকে। কাজটা সহজ না – সবার ধাক্কা খাচ্ছে মেয়েটা।
বাবুটার গায়ে ওই ধাক্কাগুলো প্রভাব ফেলবে না?
ঠিকভাবে কিছু ভাবার আগেই ওর পিছু নিলাম।

ওপরের দিক থেকে দোতলা নেমে আসতেই সিঁড়ির গোড়ায় পানি দেখতে পাই। এই ফ্লোরে এখন একজন মানুষও নেই!
দূরে কোথাও চর চর শব্দ শোনা যাচ্ছে। আগুনের ধ্বংসাত্মক শব্দ!
লিনিতা এরই মাঝে গোড়ালি ডোবানো নদীর পানিতে নেমে পড়েছে। এই ফ্লোর এখন নদীর সারফেস লেভেলেরও আট ইঞ্চি নিচে!

ছুটে গিয়ে ওকে ধরলাম আমি, ‘পাগল হয়ে গেছিস তুই? ওপরে চল, পাগলামি করিস না!’
লোহার বালতিটা এই সময় লিনিতার পায়ে বেঁধে যায়। পড়েই যাচ্ছিল – দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ধরে ফেললাম।
ভারসাম্য সামলে নিয়ে আমার দিকে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটা। কেমন করুণ একটা অভিব্যক্তি ফুটে আছে ওর চোখে মুখে।
‘নীরব?’
‘ওপরে চল।’
‘আ’ম সরি…’

আচমকা পেছনের দিকে সরে গেছে লিনিতা – আমি নড়ে ওঠার আগেই বালতিটা তুলে এনে দড়াম করে আমার মাথাতে বসিয়ে দেয় ও। দুই পা পিছিয়ে গেছি – তারপর তৃতীয় পা পেছতে পারলাম না – সিঁড়িতে পা বেঁধে পড়ে গেলাম।
ঘোলা ঘোলা দেখতে পাচ্ছি – লিনিতা ওর ট্রাউজার খুলে ফেলছে। আমি নড়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মস্তিষ্কের কথা শুনছে না শরীর একদম। নদীটা ধীরে ধীরে উঠে আসছে ওপরের দিকে। আমার থুতনীর কাছে পানি চলে এসেছে এখন। লিনিতার নাভী পর্যন্ত ডুবে আছে।
টান দিয়ে কিছু একটা বের করছে ও ওখান থেকে।

আমি আঁতকে উঠি।
বাচ্চাটা মরে যাবে তো?

তারপর – অদ্ভুত এক অন্ধকারে ডুবে গেলাম আমি। পড়ে যাচ্ছি যেন অসীম শুন্যতায়!
তার মাঝেই দূরে একটা ছোট নৌকা দেখতে পাই আমি। জনকন্যাকে তুলে নিচ্ছে ওটা তার বিশাল বুকে।

পরিশিষ্ট
কে জানি বলছে, ‘শালা, ভেবেছিলাম নীরবই নিউজ হইয়া গেছে!’

ব্যাঙের মত বার কয়েক শব্দ করে চোখ মেললাম।
আছি কোথায়?
চারপাশে নোংরা পরিবেশ আর দরজাতে সাদা পর্দা দেখে বুঝলাম, জায়গাটা সরকারী কোন হাসপাতাল।

‘নবাবের জ্ঞান ফিরেছে।’ রেজা ভাইয়ের কণ্ঠটা চিনতে পারি এখন আমি।
ধড়মড় করে উঠে বসি আমি, ‘লিনিতা-’
‘হাওয়া। আমাকে যদি আরেকটু আগে জানাইতা তোমার সাথে তথাকথিত গার্লফ্রেন্ড লিনিতা – তাইলে এতক্ষণে ফাটকে পুড়ে ফেলা যেত ওকে।’
‘দোষটা কি ওর?’ কিছুটা আগ্রহী হই এবার আমাই। আধশোয়া হলাম বালিশ টেনে এনে।
‘মিউজিয়মে পরশু রাতে চুরি হল না? আরে সব ভুলে যাও তো – জার্নালিজমে কিভাবে উন্নতি করবা? ২০ ক্যারটের প্রাচীন ডায়মন্ড সাফা করে দিয়েছে খবর শোনো নাই?’

হাই আসছিলো, তবে সেটা চেপে ধরতে দরতে রেজা ভাইয়ের দিকে তাকালাম, ‘ওখানেই নিতে চাইছিলেন আমাকে গতকাল?’
‘হুঁ। নিজে তো ডায়মন্ড-চোরের সাথে ভাইগা গেছো মিয়া।’
‘বুঝলাম না।’
‘তোমার ওই লিনিতার বয়ফ্রেন্ড শাহেদের মাস্টার প্ল্যানিং পুরো চুরির ব্যাপারটা। সিসি ক্যামে সে নিজেকে বাঁচাইছে। কিন্তু মিউজিয়ম থেকে বের হয়ে রাস্তার অপোজিট ক্যামেরাতে এসে ধরা খাইছে। তখন পালাইলেও পুলিশ ওরে মার্ক করে ফেলছিলো। রাতের বেলাতেই শালাকে ধইরা ফেলছে ওরা।’
‘ওহ… কাহিনী তাহলে এটাই!’ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে আমার।
‘আরে আরও আছে। শাহেদরে ধরলেও তো আর ডায়মন্ড পায় নাই। পুলিশ তো জানতো না শাহেদের অ্যাসিস্টেন্ট আছে একজন। বাইরে ছিলো কোথাও এই মাল, তারে মাল দিয়া শাহেদ ফুটছে আগেই।’
‘লিনিতা।’ বিড় বিড় করলাম।
‘পুলিশ শাহেদকে পিটায়া রুট বের করে ফেলছে। ডায়মন্ড ওখান থেকে সোজা যাবে বরিশাল। কিন্তু পুলিশ শুধু এটাই জানত না – কার হাত দিয়ে সেটা যাবে। ‘ চোখ বড় বড় করে বলেন রেজা ভাই।
‘এজন্য ঢালাউ সার্চের ব্যবস্থা তারা করেছিলো।’ মাথা দোলালাম।

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন রেজা ভাই, ‘এটা হল ফ্যাক্টস। তবে বাকি কাহিনী আমার হাইপোথিসিস অনুযায়ী কইতে পারি। হাসবা না কইলাম। আমি মাত্র বাইর হইতেছি জার্নালিজম থেকে।’
‘হাসবো না।’ বলেই মুচকি হেসে ফেলি।
‘লিনিতা একা ছিলো না। শালীর সাথে অন্তত একজন ছিলো আরও। ওই ব্যাটাই লঞ্চে উঠে এসেছিলো পাশে স্পীড বোট ঠেকিয়ে। বোমা মেরে তোমাদের লঞ্চের ইঞ্জিন রুম দিলো উড়াইয়া। লাভটা বুঝতেছ না?’
চিন্তিত মুখে বললাম, ‘ডুবন্ত লঞ্চের লোক উদ্ধারের জন্য পুলিশের দম বের হয়ে যাবে। ডায়মন্ড চোর খুঁজবে কে ওই রুটে?’
‘ঠিক তাই। নৌকাতে করে ভেগে গেল তোমার প্রেম – লিনিতা। ডায়মন্ড শুদ্ধ।’

হেসে ফেললাম এবার আসলেই, ‘লজ্জা দেবেন না তো। আমাকে পেলেন কোথায়?’
‘ডুইবা ডুইবা সেকেন্ড ডেকে পানি খাইতেছিলা – ওখান থেকে উদ্ধার করছে তোমাকে। পারাবত – ০৯ লঞ্চটা কাছেই ছিলো।’
মাথা দোলালাম আমি, ‘বাচ্চা খুঁজছিলো পুলিশ। আর লিনিতা ছদ্মবেশ নিয়েছিল গর্ভবতী মেয়ের। কো-ইন্সিডেন্স?’
ঘর কাঁপিয়ে হাসলেন রেজা ভাই, ‘কি কও! লিনিতা প্রেগন্যান্ট মহিলার ছদ্মবেশ নিছিলো? স্রেফ রসিকতা – এই মাল পাচারের জন্য এর চেয়ে ভালা রসিকতা আর হয় না!’
‘কেন?’
’২০ ক্যারটের ডায়মন্ডটার নাম কি জানো? অফস্প্রিং। বাচ্চা এইটারে বলাই যায়।’

আস্তে করে বিছানাতে আবার শুয়ে পড়লাম।
অফস্প্রিং।
সন্তান।
বাচ্চা।

তাই তো – বলাই তো যায়।
পারাবত – ০৯ সময়মত চলে এসেছিলো দেখে নিজেকে ধন্যবাদ দিলাম মনে মনে। জার্নালিজমে উন্নতি করতে পারবো না – কথাটা হয়ত একেবারে মিথ্যা নয় – কারণ, সুযোগের সদ্যবহার করতে আমি পারি । লিনিতার উচিত ছিলো আমার মাথাতে বালতি দিয়ে আরেকবার বাড়ি মারা।
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যেন কয়েক ঘন্টা আগের দৃশ্যগুলো। মানিব্যাগে সব সময় রাখা ব্লেডটা খুব কাজে এসেছিলো। লিনিতার গলা ফাঁক করে দিতেই হারামজাদা বোট-ম্যানের চোখ কপালে উঠে গেছিল। আমার দিকে বোট থেকে নেমে এগিয়ে আসতে যাচ্ছিল অবশ্য, শালার মুখের ওপর আস্ত বালতিটা ছুঁড়ে মেরেছিলাম। তারপর সব ঠাণ্ডা। উজ্জ্বল সার্চ লাইটের আলোতে ব্যাটার গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়ার যোগাড়।

পারাবত -০৯ নদী কাঁপিয়ে আসছিলো – আমাকে ওখানে রেখে প্রাণটা নিয়ে পালানো ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না ওর।

আস্তে করে বেল্টের নিচে গোপন পকেটটার ওপর হাত বোলালাম।
আমার সন্তান নিরাপদেই আছে!

— ০ —

[ চ্যালেঞ্জ মিটিয়ে দিলাম। 🙂
এই গল্পটা লেখার কোন ইচ্ছে আজকে ছিলো না। দুটো লেখার শিডিউল আগে থেকেই ছিলো আজকের জন্য। এর মাঝে চ্যালেঞ্জের জন্য বাধ্য হয়েই লিখতে হল আমাকে।
যদি খারাপ লেগে থাকে – তাহলে পাঠকের কাছে আমি দুঃখিত। এক গল্প লিখতে লিখতে ওটা থামিয়ে রেখে বাধ্য হয়েই আরেক গল্প লিখতে হয়েছে আমাকে এখানে। একসাথে দুই গল্প লেখার প্যাড়া লেখক মাত্রই বুঝবেন। দুইটি প্লটকে আলাদা করে একটা ধরে লিখতে হয় তাঁকে। মানসিক টর্চার ছাড়া কিছু না।

তবে আমি সময়ের ভান্ডার আছে, অফুরন্ত সময় সেই ভান্ডারে– এমন একজন ‘লেখকে’র লেখা পড়ার অপেক্ষাতে আছি। দশটায় তাঁরও একটা গল্প দেওয়ার কথা কি না…

উল্লেখ্য, অপর গল্পটি লিখছিলাম ‘শুধুই গল্প – সংকলন বইমেলা ২০১৫’ উদ্দেশ্যে। 😉 ]

রচনাকাল – সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪

ইরোনিয়াস

১.
দরজা খোলার সাথে সাথে মধ্যবয়েসি ভদ্রলোকের মুখে হতাশার ছাপ পড়ল।
এমনটা দেখতে দেখতে অভ্যাস হয়ে গেছে – রায়হান স্বাভাবিকভাবেই তাকায় মানুষটার দিকে। চোখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি ঝুলিয়ে রাখতে ভোলেনি।

‘মি. রায়হানের কাছে এসেছি আমি। আবু মোহাম্মদ রায়হান।’ ভদ্রলোকের চোখগুলো ব্যস্ত হয়ে ঘরের এদিক থেকে ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে।

আলতো করে মাথা দোলায় রায়হান, এই মানুষটি ক্লায়েন্ট সেটা ও দরজা খোলার সাথে সাথেই বুঝে ফেলেছিলো। হতাশার দৃষ্টি এই গোত্রটির চোখেই ফোটে – কারণ, এরা আসেন বড় কোন প্রত্যাশা নিয়ে।

‘আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। প্লিজ, ভেতরে বসুন।’ সাদরে আমন্ত্রণ জানায় রায়হান।

ইতস্তত পায়ে ভদ্রলোক ঢুকে পড়লেন। নোংরা সোফা সেটটার কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেন তিনি। দামী পোশাকে ময়লা লেগে যাবে না কি – তাই ভাবছেন হয়ত। সেই সাথে হাল্কা কুঁচকে যাওয়া নাক দেখেই রায়হান বুঝতে পারে – এঁকে চা বা কফি সাধা চলে। কঠিন বা তরলেই এর সীমাবদ্ধতা। ধূমপান ইনি সহ্যই করতে পারেন না।

‘চা অথবা কফি?’ জানতে চায় রায়হান।
পাল্টা প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক, ‘মি. রায়হান কি ঘরে নেই? আমার আসলে তাড়া ছিলো।’
স্মিত হেসে হাত বাড়িয়ে দেয়, ‘আগেই খোলাসা করা উচিত ছিলো। আমিই আবু মোহাম্মদ রায়হান।’
হতাশার চিহ্নগুলো আরও প্রকটভাবে ফুটে উঠল এবার ভদ্রলোকের চেহারায়। তবুও হাত মেলালেন ভদ্রতার খাতিরে।
‘আমার নাম মোস্তফা কামাল। আপনাকে আরও বয়স্ক কেউ হবেন ভেবেছিলাম।’

রায়হান সামান্য হাসলো। কথাটার পিঠে কোনরকম মন্তব্য না করে আবার জানতে চাইলো, ‘তাহলে কফি চলতে পারে? আপনি কি কফিতে দুধ নেন?’
কাঁধ ঝাঁকান মোস্তফা, ‘দুটোই চলে।’

রান্নাঘরে ঢুকে তাকের দিকে এগিয়ে যায় ও। তিনটি ফ্লাস্কে ভর্তি করাই আছে এখানে চা আর কফি। সারা দিনে প্রচুর চা পান করে রায়হান। মাঝে মাঝে স্বাদ পাল্টাতে কফির দিকে ঝুঁকে যায়, তবে সেটা সচরাচর সকালের দিকে। কফির ফ্লাস্কটা হাতে নিতে নিতে এপর্যন্ত ভদ্রলোক থেকে যা জানা গেছে তা একবার ভাবে ও।
এঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, টাকার খুব একটা অভাব তার নেই। তবুও বিশেষজ্ঞের কাছে না গিয়ে রায়হানের কাছে এসেছেন। অর্থাৎ এমন কিছু ঘটে গেছে যেটা তিনি গোপন রাখতে চান। সম্মানরক্ষার অদ্ভুত এক ধারণা এই উচ্চশ্রেণির মানুষগুলো ধারণ ও বহন করেন।

আরেকটি ঘটনা হতে পারে, বিশেষজ্ঞ দিয়ে ইনার কাজ হয়নি। ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো হিসেবে রায়হানের কাছে এসে ধর্ণা দিয়েছেন।

বয়েস চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ – যে কোন একটা হতে পারে। কোন ধরনের সমস্যা সমাধান করতে এসেছেন বলাটা শক্ত। এই বয়েসের মানুষদের যে কোন মানসিক সমস্যা থাকতে পারে। অল্পবয়েসীদের কেসগুলো ধরাবাঁধা ছকের মধ্যে পড়ে। এদেরগুলো নয়। তবে সম্মানরক্ষার ব্যাপারটি এলে, খুব সম্ভব নিজের জন্য নয় সেই নাটক।

দুটো কাপ ট্রে-তে সাজানোর ফাঁকে রায়হানের মনে হলো, সমস্যাটা এই ভদ্রলোকের ছেলে অথবা মেয়ের হতে পারে। এঁর বয়েস থেকে অনুমান করা চলে, ছেলেটি বা মেয়েটি হবে একজন টিন এজার।

ট্রে-টা সামনের টি-টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে জানতে চায় রায়হান, ‘আপনার কি একটাই সন্তান?’

মোস্তফা কামাল হাল্কা চমকেছেন। মুখের ভাবটা গোপন করার চেষ্টা না করে উত্তর দিলেন, ‘না। দুইজন।’
একটা কাপ তুলে নেয় রায়হান হাতে, ‘চমৎকার। আপনার সমস্যাটি নিয়ে তাহলে আলাপ করা যায় এখন।’

দেখাদেখি কফির কাপ হাতে নিলেন মোস্তফা কামালও, ‘তার আগে আপনার ব্যাপারে বলুন। আপনি কি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ?’
মাথা নাড়ে রায়হান, ‘উঁহু। নিজেকে আমি বলে থাকি সাইক-ইনভেস্টিগেটর। মনোরোগ নিয়ে আমার কোন একাডেমিক পড়াশোনাই নেই। ঢাকা ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলাম। অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি। দুই বছর পর ছেড়ে দিয়েছি – আগ্রহ পাচ্ছিলাম না।’

‘সে থেকেই এই শহরে চলে এসেছেন?’ সন্দিহান কণ্ঠে বলেন ভদ্রলোক, ‘আপনার গল্পটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।’

‘কাওকে খুন টুন করে ভার্সিটি থেকে বের হয়ে আসিনি আমি – যদি তাই জানতে চেয়ে থাকেন।’ মুচকি হেসে মানুষটার প্রশ্ন আন্দাজ করে নেয় রায়হান, ‘বাবার টাকা পয়সার অভাব ছিলো না – এই বাড়িটা দেখতেই পাচ্ছেন। ও ছাড়াও শেয়ারগুলো থেকে প্রচুর টাকা আসে। কাজেই আমার অপছন্দের বিষয় নিয়ে পড়ার কোন মানে খুঁজে পাই নি।’
‘সাইকোলজি নিয়ে পড়লেই পারতেন। অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রির স্টুডেন্ট যখন – সাবজেক্ট চয়েজে ওটা নেওয়া খুব কঠিন কিছু হওয়ার তো কথা না।’
‘নিতে পারি নি সে সময়। আমার মা চান নি ওটা আমি নেই। বয়েস কম ছিল, বাবা-মা যেদিকে চালিয়েছে সেদিকে ঘোড়া দাবড়েছি।’ কাটা কাটা ভাবে জবাব দেয় রায়হান।

এই লোককে নিজের ব্যাপারে বলতে হচ্ছে দেখে বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। একটা কেস একজনের হাতে তুলে দেওয়ার আগে তার ব্যাপারে জানতে চাইবে ক্লায়েন্ট এটা খুবই স্বাভাবিক।

‘এ বাসায় তাহলে আপনি মায়ের সাথেই থাকেন?’ মোস্তফা কামালের প্রশ্ন শেষ হয় না।
‘না। একাই থাকি।’ শান্তভাবেই বলে রায়হান, ‘বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই আমার।’
‘কিভাবে মারা গেলেন তাঁরা?’ হাল্কা চালে জানতে চাইলেন তিনি।

‘এ নিয়ে কথা বলি না আমি। কেসটা যদি আমাকে না দিতে চান – সেক্ষেত্রে কফিটা শেষ করে আসতে পারেন।’ উঠে দাঁড়ায় রায়হান। মেজাজ একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে ওর।

মোস্তফা কামাল একটু হাসলেন।
‘বসুন, প্লিজ। আপনার ওপর ভরসা করা ছাড়া আমার আসলে উপায়ও নেই। বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর।’

‘আপনার মেয়ের বয়েস কত?’ চট করে জানতে চায় রায়হান।
ফ্যাকাসে হয়ে গেল মোস্তফা কামালের মুখ, ‘কিভাবে জানলেন-’
‘বয়েস কত?’
‘এগারো।’
‘আপনার ছোট মেয়ে।’
ফ্যাকাসে মুখটা আরেকটু বাড়ে ভদ্রলোকের, তারপর হেসে ফেললেন, ‘মাহফুজ আমার ব্যাপারে বলেছে আপনাকে ফোনে? তাই না? আর সেসব তথ্য গড় গড় করে বলে চমকে দিতে চাইছেন আমাকে?’
অবাক হয় রায়হান, ‘ওয়েস্ট-ইস্ট ইউনিভার্সিটির লেকচারার মাহফুজ? তার সাথে গত কয়েক মাসে আমার যোগাযোগ হয়নি। আপনার ব্যাপারে যা বলেছি সেটা আপনিই আমাকে জানিয়েছেন। মুখে না জানালেও আপনাকে হাল্কা পর্যবেক্ষণ করলে এটা অনুমান করতে পারবে যে কেউ।’
থমথমে মুখে মাথা দোলালেন মোস্তফা, ‘অর্থাৎ আপনি নিজের কাজে আসলেই ভালো। আপনাকে আমার সমস্যা খুলে বলবো। তবে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, কাওকে এ বিষয়ে সামান্যও জানাতে পারবেন না। আপনার বন্ধু মাহফুজকেও না।’
‘আমার ক্লায়েন্টের ব্যাপারে আমি কাওকে কিছু জানাই না।’

বুঝতে পারছে, মাহফুজের সাথে কোনভাবে এই ভদ্রলোকের পরিচয় আছে। তিনি হয়ত ব্যতিক্রমী কোন সাইকিয়াট্রিস্ট খুঁজছিলেন – বেচারাকে সে রায়হানের ঠিকানা ধরিয়ে দিয়েছে। নিজের অজান্তেই মাথা দোলালো একবার ও।
পুলিশ বাদে এই প্রথম মালদার পার্টি এভাবেই ওর কাছে এসেছে একারণেই!

‘সফল কেসের ক্ষেত্রে আপনাকে কত দিতে হয়?’ আত্মবিশ্বাস নিয়ে জানতে চাইলেন মোস্তফা কামাল।
‘ত্রিশ হাজার। কেস শেষে লিখে দেবেন । কেস ব্যর্থ হলে কোন টাকা-পয়সা আমি নেই না।’
‘ফাইন। আমার কোন আপত্তি দেখছি না।’ ঘাড় কাত করে বলেন তিনি, ‘তাহলে সরাসরি আমাদের সমস্যাতে চলে আসতে পারি?’
কিছু না বলে মাথা দুলিয়ে সায় দেয় রায়হান।

‘নতুন ডক তৈরী হয়েছে এদিকে একটা। জানেন বোধহয়, কৈলাকুটিরে। ওটা আমাদের।’ গলা খাঁকারি দেন তিনি, ‘মানে, মালিকানা আমাদের পাঁচজনের। ওখান থেকে ভালো লাভ আসতে যাচ্ছে – আর আমার পূর্বপুরুষের অঢেল জমি আছে এদিকে। কাজেই ঢাকা থেকে চাকরী ছেড়ে পরিবার নিয়ে আপনাদের শহরে চলে এসেছি আমি – মাস দুয়েক হল। উদ্দেশ্য – এখানে আরও কিছু বিজনেস সেক্টর বের করে নেওয়া।’

কফিতে চুমুক দিতে বিরতি নিলেন তিনি, তারপর আবার শুরু করলেন, ‘আমিও আপনার মত কিছুটা। পূর্বপুরুষের অঢেল সম্পত্তির বদৌলতে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু তাদের সম্পত্তির পরিমাণ আমি ভোগ করে ফুরিয়ে দিতে চাই না – বরং চাই আরও বেড়ে যাক ওটা। তাছাড়া শুয়ে বসে খাওয়ার অভ্যেস আমার নেই। তাই দশ বছর শুধু চাকরী করে গেছি এক কোম্পানিতে।’
কথা কেড়ে নেয় রায়হান, ‘অবশেষে ইচ্ছে হয়েছে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি থেকে আরও ভালো কিছু বের করা সম্ভব কি না – সেটা খতিয়ে দেখতে। এটুকু আমি বুঝতে পারছি, মি. কামাল। আপনি আসল কথাতে চলে আসুন।’

একটু বিভ্রান্ত মনে হয় এবার তাঁকে, ‘এ শহরে আমাদের পুরোনো বাড়িটিতেই উঠেছি আমরা। বাড়িটাকে নিয়ে অনেক গুজব আছে । গুজবটা মূলতঃ আমার প্র-পিতামহ মানে আমার দাদার বাবাকে নিয়ে।’
‘উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকের কথা তারমানে। বলে যান।’ তেমন আগ্রহ দেখা যায় না রায়হানের ভেতরে।
‘প্রচণ্ড নিষ্ঠুর ছিলেন তিনি। জমিদারী প্রথার প্রচলন তখন ছিলো। সমুদ্রের কিনারে এ এলাকাতে তেমন কেউ মনোযোগ দিতো না। এখানকার প্রজাদের হর্তাকর্তা ছিলেন আমার গ্রেট গ্রান্ডফাদার।’
সোফাতে হেলান দেয় রায়হান আরাম করে, ‘তাকে নিয়ে গুজবটা ঠিক কি ছিলো?’
‘গুজবটা তাকে নিয়ে নয়। ওটা আমাদের বাড়িটি নিয়ে। কয়েকবার ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমি ঢাকা থেকে। কিন্তু পারিনি। প্রতিটা পরিবার সরে গেছে। তাদের অভিযোগ – বাড়ির নারীসদস্যরা অস্বস্তি অনুভব করেছে সব সময়।’
‘নারী-প্রজাদের ওপর জমিদারবাবুর নিষ্ঠুরতার পরিমাণ কি পুরুষের চেয়েও বেশি ছিলো নাকি?’

মাথা নাড়লেন মোস্তফা কামাল, ‘পুরুষের ওপর অত্যাচারের কোন মাত্রা ছিলো না আমার গ্রেট গ্র্যান্ডফাদারের। খাজনা দিতে একদিন দেরী হলেই প্রজাদের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার অভিনব নজির তিনি রেখেছিলেন। তবে বাড়ির গুজব পুরুষাঙ্গ নিয়ে নয়।’
বুঝতে পারল রায়হান, তবে একমত হল না। বরং মাথা হাল্কা দুলিয়ে প্রশ্ন করল, ‘পুরুষাঙ্গবিহীন প্রজাদের স্ত্রীরা ঠিক কোথায় থাকতো তখন?’

গম্ভীর হয়ে যান কামাল, ‘গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার স্ত্রীদের দিকে চোখ দিতেন ঠিকই – তবে রতিক্রিয়াতে মেতে উঠতেন কন্যাদের সাথে। তাঁর পদ্ধতি ছিলো খুবই অভিনব। মা-মেয়েকে নিয়ে এসে মেয়ের ওপর চড়াও হতেন তিনি মাকে বেঁধে রেখে। ধর্ষণের ফাঁকে ফাঁকে নিজের যৌনসঙ্গীর মাকে ছুরি দিয়ে বার বার আঘাত করতেন। এটাই ছিলো উনার রুচি।’
“যে নারীর মেয়ে নেই?”
“তাদের মাকে ধরে আনা হতো, বয়েস যতই হোক।”
“যার মা এবং মেয়ে কোনটাই নেই?”
“স্বামীর পুরুষাঙ্গের সাথে যেত তাদের গর্দানখানাও।”
সামনের টেবিলে কাপ নামিয়ে রাখল রায়হান, ‘কাজেই – অসহায় সেসব নারী মারা পড়েছিলো আপনাদের ওই বাড়িতে। গুজবের শুরু ওখানে হওয়া মোটেও বিচিত্র নয়। কিন্তু ইতিহাস নিশ্চয় সমস্যা নয় আমাদের জন্য? আজ আমার বাড়িতে আপনি এসেছেন বাস্তব কিছু নিয়ে আলোচনা করতে। সে প্রসঙ্গে চলে আসতে পারেন।’

‘কিন্তু ইতিহাসের একটা ভূমিকা আছে। জমিদার-পূর্বপুরুষটি সব বয়েসী নারীদের সাথে বিছানাতে যেতেন না। শিশু আর কিশোরীদের সাথেই তিনি মিলিত হতেন।’ শান্ত কণ্ঠে আগের প্রসঙ্গেই ফিরে যান মোস্তফা কামাল, ‘আমার মেয়েটির বয়েস এখন ওই বয়েসসীমার ভেতরে।’
‘আপনি আপনার মেয়ের নাম এখনও বলেন নি।’ হঠাৎ বাঁধা দেয় রায়হান।
‘ঈপ্সিতা।’
‘কি ধরনের আচরণ করেছে আপনার মেয়ে?’

এক মুহূর্ত ইতস্তত করেন মোস্তফা কামাল। রায়হানকে বিশ্বাস করা যায় কতটুকু তা ভাবছেন।
তারপর গলা খাঁকারি দিলেন একবার।

‘কাজের ছেলে ছিলো একজন আমার বাসাতে। বয়েস বেশি না।’ চোখ পিট পিট করে তাকালেন ভদ্রলোক, ‘তিন রাত আগে ছেলেটির পুরুষাঙ্গ কেটে নিয়েছে ঈপ্সিতা।’

২.
‘এই ঘরে থাকতেন আফনে।’

যোবাইদা নামের কাজের মেয়েটা দেখিয়ে দিতে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে রায়হান। শহরের একেবারে অন্যপাশে এই বাড়িটা। ছোট একটা টিলার ওপরে। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়।
নিঃশব্দে যোবাইদা বের হয়ে গেছে – রায়হান ধীরে সুস্থে নিজের কাপড়গুলো বের করে করে খালি আলনাতে তুলে রাখে। বাইরের ঘরের মত এই ঘরের দেওয়ালেও ঝুলছে ছবি। ছবিগুলোর ভেতরের নারীরা প্রত্যেকে নগ্ন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাটে এসে বসে রায়হান। এই ছবিগুলো দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন মোস্তফা কামাল আজও? দুইজন আন্ডারএজড ছেলে মেয়ে এখানে বাস করে!

প্রশ্নটা ভদ্রলোকের সাথে দেখা হলেই জেনে নেওয়া যাবে।
গতকাল তাঁর সাথে তেমন কথা হয়নি। শুধু ঈপ্সিতার সমস্যাগুলো শুনেই আগ্রহী হয়ে উঠেছে ও কেসটার ব্যাপারে। কাজের ছেলেটার মৃত্যুর কথা একেবারেই চেপে যাওয়া হয়েছে। সবাই জানে, ছেলেটি বিশ হাজার টাকা সাথে নিয়ে পালিয়ে গেছে। পুলিশ জমিদারের বাড়িতে ঢুকে তদন্ত করবে না। তাদের কাছে বড়লোকের মুখের কথাই কাফি।

মোস্তফা কামাল থানায় ওই গল্পটিই জানিয়েছেন। যে কোন মূল্যে যেন ছোকরাকে গ্রেফতার করা হয়। নিজের মেয়ের কীর্তি ঢাকতে এটুকু তাঁকে করতেই হত – এ বলে কৈফিয়ত দিয়েছেন তিনি রায়হানকে। ও অবশ্য তেমন একটা গায়ে মাখে নি বিষয়টা। মানসিক কোন রহস্য থাকলে সেটা সমাধানে রায়হান আগ্রহী। কে কোথায় খুন হলো না পুরুষাঙ্গ হারালো তা দিয়ে তার কিছু এসে যায় না। পুলিশ মাঝে মাঝে তার সাহায্য নিয়ে থাকে – তার মানে সে ওদের একজন নয়। কাজেই আইনের দিক থেকে কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক তা নিয়ে চিন্তা করার প্রশ্নই আসে না।

ঘরের প্রতিটা আসবাবই জমিদারবাড়ির সমান বয়স্ক। অথবা ওরকম বলেই মনে হচ্ছে। এমনও হতে পারে মোস্তফা কামালের বাবার সময়কার এসব। আর ওটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। স্বাভাবিকের চেয়ে আকারে বড়। প্রাচীন যে কোন কিছুর মতই।

ভালো করে তদন্ত করে দেখার জন্য রায়হান তিনদিন এই বাড়িতে থাকতে চেয়েছে। ঈপ্সিতা তার কর্তন-কর্ম সেরেছে রাতের বেলাতে। কাজেই রাতে থাকাটা বিশেষ জরুরী। আর একটা কেস নিলে সাবজেক্টের মানসিক অবস্থা কী থেকে প্রভাবিত হতে পারে, তা জানা রায়হানের দরকার। সে জন্য সাবজেক্টের পরিবেশে দুই একদিন কাটানোটা দরকার। সতর্কতার জন্য একদিন বেশি নিয়েছে ও। তিন দিন তিনরাতের মাঝেই এই কেসটা সমাধান করা সম্ভব হতে পারে।

একটা ভাঁজ করার মত টেবিল নিয়ে যোবাইদা ঢুকে পড়ল। তার দিকে মুখ তুলে তাকালো রায়হান। মেয়েটা একবারও এদিকে নজর দিল না, চুপচাপ টেবিলটা ঘরের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে বের হয়ে যায়।
ঘরটার বিশালত্ব প্রথমবারের মত চোখে পড়ে ওর এবার। খাট, কাপড় রাখার বিশাল আলমারি, আয়না সহ একটা বড় ড্রেসিং টেবিল, আলনা আর বুক সেলফ রাখার পরও অনায়াসে ইনডোর ক্রিকেট খেলা যাবে। কাজের মেয়েটা এরই মাঝে আবার ফিরে এসেছে। হাতে বড় একটা ট্রে, নাস্তাগুলো টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল।

‘আমি নাস্তা করেই এসেছিলাম।’ মৃদু কণ্ঠে বলে রায়হান।
মুখ ফিরিয়ে তাকালো যোবাইদা, তবে সরাসরি ওর দিকে নয়, কেমন অস্বস্তিকর একটা ভঙ্গী যেন – রায়হান ঠিক ধরতে পারে না, ‘সাহেবে বলছেন আপনের লগে নাস্তা বইবেন।’
মাথা দোলায় ও , ‘ঠিক আছে।’

প্রায় সাথে সাথেই ঘরে ঢুকে পড়লেন মোস্তফা কামাল। চমৎকার চুলগুলো আজ ব্যাকব্রাশ করা, গাল হাল্কা নীলাভ হয়ে আছে। সম্ভবতঃ সদ্য শেভ করেছেন। চুল আর ত্বক দেখে মনে হচ্ছে মাত্রই গোসল করে এসেছেন। রায়হান বোঝে সাত সকালে এঁর গোসলের অভ্যাস আছে।
উঠে দাঁড়ায় ও, হাত বাড়িয়ে দেয় – নিঃসংকোচে হাত মেলালেন মোস্তফা।

‘আপনাকে খুব বেশি সময় বসিয়ে রাখিনি তো? গোসলে একটু দেরী হয়ে গেল।’ দুঃখপ্রকাশের ভঙ্গীতে নয়, যেন বলার জন্য বলছেন এভাবে বলেন তিনি।
‘না না, মাত্রই এলাম।’ আশ্বস্ত করে রায়হান।
চেয়ার এনেছে যোবাইদা একটা, ওটা টেনে নেন মোস্তফা, ‘হাত ধুয়ে বসে পড়ুন। আর বেলা করে কাজ নেই।’

কাজেই বসে পড়ে ও। ঢাকনা সরাতেই দেখা গেল মিহিভাবে বেলা রুটি আর নাম না জানা অসংখ্য পদের রান্না পরিবেশন করা হয়েছে।
‘চিনতে পারছেন না?’ রায়হানের বিভ্রান্ত দৃষ্টি লক্ষ্য করে হেসে ওঠেন মোস্তফা, ‘কচ্ছপের মাংস।’
চোখ কুঁচকে গেছে ওর, লক্ষ্য করে দ্রুত আবার বলেন তিনি, ‘স্যামন ফিশ। টিনে করে আনা। ডক কাছে হওয়াতে হয়েছে সুবিধে। সবকিছুই সামুদ্রিক। ওই মাছগুলো কেমন অদ্ভুত রকমের সুস্বাদু হয় খেয়াল করেছেন?’
একটু হাসে রায়হান, ‘কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে এদের। মিঠেপানির মাছ থেকে আলাদা লাগে খেতে। ভালোই।’

মোস্তফা কামাল চরিত্রটাকে ঠিক বুঝে উঠে না ও, গতকাল ছিলেন নিখুঁত ভদ্রলোক। ময়লা সোফাতে বসতে চাইছিলেন না। তারপর আজকে আতিথেয়তার চূড়ান্তে এসে মেহমানের ঘরে এসে একসাথে নাস্তা করতে চাইলেন এবং একেবারেই হঠাৎ খাবারের সময় বাজে রসিকতা – ঠিক শোভন নয় সেটা। স্বাভাবিক মোস্তফা কামালের সাথে যাচ্ছে না।
এক মানুষের ভিন্নরূপ দেখতে পেলে সেটা মাথার ভেতর নোট করে রাখতে হয় – অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এটা জানে রায়হান।

মোস্তফা কামাল সম্ভবতঃ রায়হানের অস্বস্তির কারণটা বুঝলেন। চট করে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলেন তিনি।

‘আপনাকে কেন ডেকেছি তা আশা করি বুঝতে পারছেন?’
রুটির টুকরোটা গিলে ফেলার আগে রায়হান উত্তর দেয় না, ‘আপনি চাইছেন ঈপ্সিতার ব্যাপারটা একটা সমাপ্তিতে আসুক। নিজের মেয়েকে চিনতে পারছেন না আপনি। হঠাৎ করে তার অচেনা হয়ে যাওয়ার কারণটাও ঠিক বুঝতে পারছেন না। কাজেই এখানে আমাকে দরকার হয়েছে।’
মাথা নাড়লেন মোস্তফা, ‘সেটা বড় ব্যাপার না। বড় কথা হল ঈপ্সিতা একজন মানুষ খুন করেছে। সে আবারও আঘাত হানবে কি না আমি জানি না। আপনার কথা সত্য – আমার মেয়েকে আমি চিনতে পারছি না। কিন্তু আমার চোখ থেকে দেখুন – আমার মেয়ে একজন খুনী। এই অনুভূতিটা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। তার বিচারের জন্য পুলিশের কাছে আমি যাবো না। তার কারণ এই না, ঈপ্সিতা আমার মেয়ে। তার কারণ এটাও না, ঈপ্সিতার বয়েস মাত্র এগারো। আমি পুলিশের কাছে বা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাই নি – কারণ আমার মনে হয়, বিষয়টা একেবারেই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ঘটে নি, মানে-’

শব্দের অভাব বোধ করছেন মোস্তফা কামাল, বোঝে রায়হান, তাঁর কথাটা সে নিজেই শেষ করে দেয়, ‘আপনি ভাবছেন এখানে অতিলৌকিক কিছু একটা আছে। নিজের জমিদার পূর্বপুরুষের বিদেহী আত্মা এই বাড়িতে আটকে গেছে এরকম কিছু একটা ভাবছেন আপনি।’
হাল্কা মাথা দোলান মোস্তফা কামাল, ‘বলতে পারেন। আসলে, আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছি না এমন কিছু। নিজেকে বাস্তববাদী মানুষ হিসেবেই চিনি। আবার উড়িয়েও দিতে পারছি না একেবারে।’
পানির গ্লাসটা টেনে নেয় রায়হান, ‘আপনার পূর্বপুরুষটি সম্পর্কে বলুন। আগে তেমন বিশদ জানা হয় নি।’

‘রুদ্রপ্রতাপ রায়। নামের প্রতি তিনি অবিচার করেন নি। জীবনটা কাটিয়েছেন প্রতাপের সাথে। রুদ্রমূর্তি ধারণে ইনার জুড়ি ছিলো না।’ মৃদু হাসলেন মোস্তফা কামাল, হাসিটা তিক্ততার, ‘হাল্কা ভাবে বলছি বটে, তবে নিজের পূর্বপুরুষের আচরণ নিয়ে আমি মোটেও গর্ব করার মত কিছু দেখি না। নিজের বংশ তো আর পাল্টানো যায় না। তাই না?’
‘তা বটে। জমিদারবাবুই কি এই বাড়ির পত্তন ঘটিয়েছেন?’
‘হুঁ। তার এই একটা কাজই লজ্জা পাবার মত নয়। আর সবই -’

এই বাড়ি তৈরি করতে যে পয়সা আর শ্রম নেয়া হয়েছে তা যে তার লজ্জাস্কর কর্মকাণ্ডের ফলাফল তা রায়হান মনে করিয়ে দিল না আর। যার বাড়িতে দাওয়াত, তাকে চটানো স্বাস্থ্যের জনয সব সময় উপকারী নয়।

‘স্বভাবের দিকে এঁর মৌলিক দিকগুলো তুলে ধরতে পারবেন? খেয়ালী হন এঁরা। ইনার খেয়ালটা কোনদিকে ছিলো?’
একটু ভাবলেন মোস্তফা কামাল, ‘আলাদা করে এভাবে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। তিন প্রজন্ম আগের কথা – বুঝতেই পারছেন। তবে পারিবারিক ডায়েরী থেকে যা জানতে পেরেছি – ইনার খেয়ালের অভাব ছিলো না। তীর ধনুক দিয়ে মানুষ শিকার করতেন ইনি। অযোগ্য বলে প্রমাণিত চাকর বাকর আর প্রজাদের হতে হত শিকার। ময়দানে তাদের পালানোর সুযোগ দেওয়া হত। ঘোড়া চড়ে একে একে সবাইকে শিকার করতেন। খাওয়ার ব্যাপারেও তাঁর খামখেয়ালীপনা ছিলো। মাসে একদিন রাজভোজ হত। সে ভোজে তিনি মেয়ে মানুষের বুকের মাংস খেতেন। অবশ্যই রান্না করা হত সেটা। কাঁচা মাংস আবার উনার পছন্দ ছিলো না।’
‘প্রজাদের ভোগের সামগ্রী ছাড়া আর কিছু ভাবেন নি দেখছি ইনি!’ তিক্ত কণ্ঠে বলল রায়হান, ‘আপনাদের পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো কবে?’
‘আমার দাদা করেছিলেন।’

চুপচাপ খাওয়াতে মন দেয় ওরা আবার।
রায়হানের মাথাতে নতুন তথ্যগুলো ঘুরছে। পারিবারিক ডায়েরীর কথা উল্লেখ করেছেন মোস্তফা কামাল। তবে সেটা রায়হানকে পড়তে দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি। অথচ ও জানে, সমস্যাটার গোড়া রুদ্রপ্রতাপ রায়ের ইতিহাসে থাকলে ওই ডায়েরী পড়া লাগবে ওকে। তবে এই মুহূর্তে ওটা না হলেও চলবে।

‘ঈপ্সিতাকে বলেছি আজ স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই।’ খেতে খেতে জানালেন মোস্তফা।
‘তা কেন?’ অবাক হয় রায়হান, ‘ওর স্বাভাবিক জীবনে বাঁধা দেওয়া যাবে না। ওকে অবশ্যই স্কুলে পাঠান।’
‘কিন্তু ভেবেছিলাম তার সাথে আপনি কথা বলতে চাবেন।’ অবাক হন মোস্তফা।
‘তা অবশ্যই বলবো।’ একমত হয় রায়হান, ‘তবে স্কুল থেকে ও ফিরে আসার পরও তা বলা যাবে। নয় কী?’
“অবশ্যই। সে কথাই রইলো তবে। তবে দয়া করে আপনি নিজের সত্যিকারের পরিচয় দেবেন না। আমি চাই না মেয়েটা জানুক আপনি তাদের পাগলামি সারাতে এসেছে। বিগড়ে যেতে পারে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন?”
মাথা দোলালো রায়হান, “অবশ্যই। চিন্তা করবেন না এ নিয়ে।”

আর কিছু বলল না ও। ঈপ্সিতা নামক সাবজেক্টটার রুমে একবার ঢুঁ মারতে হবে ওকে যখন সে তার ঘরে থাকবে না। স্কুলে গেলে সেই টাইম গ্যাপটা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। মূল লক্ষ্য ওটাই ছিল রায়হানের। মেয়ে স্কুলে গিয়ে বিদ্যাবাগীশ হবে এমন সদিচ্ছা থেকে স্কুলে পাঠাতে তোড়জোড় করেনি সে।

৩.
ছোট্ট মেয়েটা দুই হাত সামনে ছেড়ে দিয়েছে। ও অবস্থাতেই একে অপরের সাথে আটকে রেখেছে ওদের।
মুখটা একেবারেই নিষ্পাপ – এগারো বছরের শিশুদের মাঝে যেটা থাকে। চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে – কাঁধের ওপর এলিয়ে আছে ওগুলো। চোখের মাঝে নিরীহ একটা দৃষ্টি। বাবা যখন বলেছিল তার বন্ধু কথা বলবে ওর সাথে, ভেবেছিল অনেক বয়স্ক কেউ হবে। রায়হানকে দেখে অবাক হয়েছে। এরপর এরকম একটা নিরীহ দৃষ্টিই ফুটে উঠেছে ঈপ্সিতার মুখে।
অস্বাভাবিক কোন আচরণ রায়হান এখন পর্যন্ত দেখেনি।

‘দাঁড়িয়ে কেন? বস তুমি।’ একটু হাসে রায়হান, ‘তোমার নাম তো ঈপ্সিতা, তাই না?’
মাথা দোলায় মেয়েটা। কথা বলে উত্তর দেয় না, অথবা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
‘আগে ঢাকার কোথায় থাকতে তোমরা?’ ঘরোয়া আলাপের ভঙ্গিতে জানতে চায় ও।
প্রথমবারের মত কথা বলে ঈপ্সিতা, ‘ধানমন্ডি। তুমি চেন?’
‘হুঁ। সুন্দর জায়গা। ওখান থেকে এখানে এসে তোমার মন খারাপ করে না?’
চুল দুলিয়ে মাথা নাড়ে বাচ্চা মেয়েটা, ‘না। এ জায়গাটা আরও ভালো।’
‘পুরোনো বাড়ি ভালো লাগার কথাই অবশ্য। তোমাদের এই বাড়িটা বিশাল। তাই না?’
চোখ সরু হয়ে যায় ঈপ্সিতার, এতটাই আচমকা রায়হানও প্রস্তুত ছিলো না, ‘আপনি আমাকে কেন প্রশ্ন করছেন? আমি কি কিছু করেছি?’

রায়হান চাইলে বলতে পারতো, ‘প্রশ্ন নয়, ঈপি, তোমার সাথে এমনি আলাপ করছি।’ তবে এসব ভুজুং ভাজুং দিয়ে এই মেয়েকে ভোলানো যাবে না। মোস্তফা কামালের ধারণা ছিলো কাজের ছেলের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার ঘটনাটা ঈপ্সিতার মনে নেই। শকে চলে গেছিলো তখন মেয়েটা।
তবে এই মুহূর্তে রায়হানের মনে হয়, পুরো বিষয়টা সে মনে রেখেছে। কাজেই, বিপদের সম্ভাবনা দেখা মাত্র আক্রমণে চলে গেছে। মেয়েটি বয়সে ছোট বলে ওকে হাল্কাভাবে নেওয়ার কোন কারণ নেই আর। একে মুখ খোলাতে ভালো বেগ পেতে হবে।

কাজটা করার সময় কি এই ভূতুড়ে মেয়েটা ব্যাপারটিকে উপভোগ করেছিলো? ভাবনাটা মাথাতে আসতেই রায়হানের মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে শীতল প্রবাহ টের পায় ও।

‘তোমাকে প্রশ্ন করছি, কারণ – তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন, ঈপ্সিতা।’ সোজাসাপ্টা কথা বলছে এভাবে জবাব দেয় রায়হান, ‘আমি একজন লেখক। আর এবারে যে উপন্যাসটা লিখতে চলেছি – সেটা একটা পুরোনো বাড়ি নিয়ে। তোমাদের বাড়িটার মতই। আরও মজার ব্যাপার কি জানো? ’
ঈপ্সিতাকে দেখে মনে হয়, এই ব্যাখ্যাতে সে সন্তুষ্ট হয়েছে, জানতে চায়, ‘কী?’
‘গল্পের নায়িকা তোমার মত ছোট্ট একটা মেয়ে। কাজেই – তোমার সাথে কথা বললে মেয়েটাকে চেনা আমার জন্য সহজ হবে।’

মাথা দোলায় ঈপ্সিতা, যেন বুঝেছে সবই। রায়হান প্রশ্ন চালিয়ে যায়, ‘কাজেই, আমার জানা দরকার – বড় একটা শহর থেকে আমার নায়িকাটি যখন প্রাচীন এই জায়গাতে আসল, তখন তার ঠিক কেমন লেগেছে। মন খারাপ কতটুকুই লেগেছে পুরোনো জায়গা ছেড়ে আসতে, কতটুকু ভালো লেগেছে নতুন জায়গাতে আসতে। অথবা -’
‘আমি এখানে আমার পরিবারকে ফীল করি।’ উদাস একটা ভঙ্গীতে বলে মেয়েটা।
একটু গভীরভাবে ভাবে রায়হান, ‘পরিবার মানে, তুমি তোমার পূর্বপুরুষের কথা বলছ?’
‘ভালোবাসে আমাকে ও। অন্যরকম ভালোবাসা। জায়গাটা আমার খুব পছন্দ।’ মুচকি হাসে ঈপ্সিতা।

হাসির ধরন দেখে ভেতরটা কেঁপে ওঠে রায়হানের।
চারপাশে একবার তাকায় দ্রুত। দিনের আলো স্পষ্ট। তারওপর কথা বলছে একজন বাচ্চা মেয়ের সাথে। আচমকা কেন নার্ভাস লাগছে ওর – সেটা বুঝতে পারে না সে।
তবে একটা ভালো দিক হল, হঠাৎ নিজেকে খুলে দিয়েছে সাবজেক্ট। একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে অল্প সময়েই ক্লু দিয়েছে। এটুকু পেতে কারও কারও পেছনে সপ্তাহখানেক ব্যায় করা লাগে।

ও তাকে ভালোবাসে। ওকে মেয়েটা ফীল করে! ও হল পরিবার।

“ও” টা কে?

‘জায়গাটা আমারও ভালো লেগেছে।’ একটু হাসে রায়হান, ‘ও তোমাকে অন্যরকম ভালোবাসে – ব্যাপারটা ভালো।’
চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ঈপ্সিতার, যদিও কণ্ঠে রুক্ষতা এনে ফেলেছে, ‘আপনি কিছুই জানেন না।’
‘ওর নামটা বলবে আমাকে?’
‘তা দিয়ে আপনার দরকার কী?’ একেবারে হঠাৎ আক্রমণে চলে গেলো আবার ঈপ্সিতা।
‘তোমাকে বলতেই হবে, এমন কিছু না। ইচ্ছে না হলে থাকুক। তবে আমার গল্পের মেয়েটাও পরিবারের একজনের বিশেষ ভালোবাসা পায়। সেজন্য জানতে চেয়েছিলাম।’
সরু চোখে মেয়েটা তাকায় ওর দিকে, ‘আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না। ওর নাম বলতে পারি – তবে ভবিষ্যতে আমার সাথে কথা বলতে আসবেন না, এই কথা আপনাকে দিতে হবে।’
একটু ভেবে রাজি হয়ে যায় রায়হান, ‘কথা দিলাম।’
‘আমার বাবাকে বলে আমাকে কথা বলতে বাধ্য করাবেন না?’
‘করাবো না। তোমাকে আর ঘাঁটাবো না আমি।’ একটু হাসে রায়হান, ‘জোর করার মত মানুষ বলে ভাবছ হয়তো, আমি ওরকম নই।’

জ্বলন্ত চোখে চেয়ে থাকে মেয়েটি। ঠোঁটদুটো একে অন্যের সাথে চেপে বসেছে।
রায়হানের মনে হল এখনই চেয়ার থেকে উঠে বেড়িয়ে যাবে মেয়েটা, তাকে বিশেষ ভালোবাসতে থাকা মানুষটির নাম না বলেই।

ওর ধারণা সত্য প্রমাণ করার জন্যই উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা। চেয়ারটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় একপাশে। ঢোকার সময় যে শান্ত মূর্তি নিয়ে ঢুকেছিলো ও – তার ছিঁটেফোঁটাও এখন অবশিষ্ট নেই। চরিত্র যেন আচমকাই পাল্টে গেছে ওর।

দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার আগে ফিরে তাকায় ঈপ্সিতা।
হিস হিস করে হিংস্র একটা কণ্ঠে উচ্চারণ করে, ‘ওর নাম রুদ্র।’

৪.
বাগানের এক কোণে বসে সবুজ রঙের পেয়ালা থেকে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন মোস্তফা কামাল। সেদিকে এগিয়ে যায় রায়হান।
মোস্তফার সঙ্গে অসামান্যা সুন্দরী এক মহিলা আছে এখন। আর আছে চৌদ্দ-পনের বছরের এক কিশোর।
কাছাকাছি গিয়ে মুখে হাসি ফোটায় রায়হান।

‘যাক, আসতে পারলেন তাহলে।’ বিশাল এক হাসি দিয়ে রায়হানের হাসির জবাব দেন মোস্তফা, ‘বসুন। বসে পড়ুন। নিজে না গিয়ে যোবাইদাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছি বলে কিছু মনে করেননি তো?’
হাসিটা মোছে না রায়হানের মুখ থেকে, ‘আমি বাঙালী অতিথেয়তার চেয়ে ইংরেজ আতিথেয়তাকে বেশি পছন্দ করি। এটাই ঠিক আছে। নিজের বিকেল বেলার জগিং বাদ দিয়ে যদি আমার ঘরে গিয়ে ডেকে আনতেন– তবেই বিরক্ত হতাম।’
সোজা হয়ে বসেন মোস্তফা, ‘দারুণ লাগলো আপনার এই চিন্তাটা। আমিও এভাবেই ভাবি, বুঝলেন। অথিথিপরায়ণতার নাম করে আমরা আসলে পর-অধিকারচর্চা করে থাকি। তবে বাংলাদেশি সবাই এরকম ভাবে না। মানে ভাবতে চায় না… পরিচয় করানো হয় নি – মাফ করবেন।’
মহিলার দিকে ফিরলেন তিনি, ‘দিস ইজ মাই বিউটিফুল ওয়াইফ, রাইসা।’
মাথা দোলায় রায়হান, ‘প্লেজার টু মীট ইউ, মিসেস কামাল। ’
‘আর এ হল আমার বড় ছেলে, জাহিদ। জাহিদ, উনি হলেন মি. আবু মোহাম্মদ রায়হান, এসেছেন ঈপ্সিতার চিকিৎসার জন্য।’

ছেলেটা ভদ্র আছে, নিজের সীট থেকে উঠে এসে হাত বাড়িয়ে দেয়, ‘আপনার ব্যাপারে শুনেছি, স্যার। মাহফুজ ভাইয়া বলেছে, নিজের কাজে আপনার মত দক্ষ আর কেউ নেই।’
হাত মেলায় রায়হান, মুখে হাসি, ‘বন্ধুর ব্যাপারে যখন কোন বন্ধু প্রশংসা করে – হয়তো চাপাবাজি সেটা নয়, তবে বেচারা বন্ধুর প্রতি তার উচ্চধারণা থাকতে পারে। কাজেই সবকিছু বিশ্বাস করতে নেই।’
‘আপনার বিনয়ের ব্যাপারেও বলেছেন তিনি।’
‘আমাকে স্যার বলে ডাকবে না আশা করি। নাম ধরেই ডাকতে পারো। ওই যে বলেছিলাম – বাংলাদেশি-’
‘বুঝেছি।’ হেসে ফেলে জাহিদ, ‘আ’ম ওকে উইথ রায়হান।’
‘ঈপ্সিতার ব্যাপারে কি দেখলেন, মি. রায়হান?’ জানতে চাইলেন মোস্তফা কামাল।

মিসেস কামাল এক কাপ চা বাড়িয়ে দিয়েছেন ওটা হাতে তুলে নেয় রায়হান, ‘মেয়েটির ব্যাপারে আমার পক্ষে এখনও কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব না। তবে তার মুড ডিজঅর্ডার আছে। ঠিক কোনদিকে যাবে তা বের করতে সময় তো লাগবেই, এখনতক আমার বেট, ডিপ্রেশন।’
‘এগুলো কি খারাপ কিছু?’ শঙ্কিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন মিসেস কামাল।
‘খুব গুরুতর কিছু হতেই হবে এমন নয়। মেয়েদের পিএমএস থেকে শুরু করে সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার সবই এর মধ্যে পড়তে পারে। আগেই ভয় পাবার কিছু নেই। তবে ঈপ্সিতার কয়েকদিন আগের ইতিহাস যেহেতু আমরা জানি, হাল্কা করে নেবার উপায়ও থাকছে না। তবে এই মুহূর্তে আমি জানি না, এই মুড ডিজঅর্ডার ঠিক কি মীন করছে।’

পাশ থেকে প্রশ্ন করে জাহিদ, ‘এতে কি হয়, মুড পাল্টে যায় বার বার সাবজেক্টের?’
‘মুড স্বাভাবিক মানুষেরও পাল্টে যায়। তবে মুড ডিজঅর্ডার বলতে আরও স্পেসিফিক কিছু বোঝানো হয়। এটা বেশ ধ্বংসাত্মকও হতে পারে। ধর এই যে তুমি শান্ত ভঙ্গীতে চা খাচ্ছো – হঠাৎ প্রচণ্ড রাগ উঠলো তোমার – আমার মাথাতে চায়ের কাপটা আছড়ে ভেঙ্গে ফেললে। এটাই হল-’
‘মুড ডিজঅর্ডার।’ মাথা দোলায় জাহিদ, বোনকে নিয়ে বেশ চিন্তিত – বোঝাই যাচ্ছে।
‘কপাল খুব ভালো হলে ঈপ্সিতার কেসটা হল সিজো-অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার। কিন্তু এভাবে হুট করে রোগ নির্ধারণ করাটা আমার নীতি বিরুদ্ধ – তবুও এটা জানিয়ে রাখছি, কারণ আপনারা যতটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন তা থেকে সরে আসতে হবে। নিজেরা সুস্থ না থাকলে অসুস্থ মেয়েকে কীভাবে সহায়তা করবেন?’

ভ্রু কুঁচকে গেছে মোস্তফা সাহেবের, ‘তারমানে ও সিজোফ্রেনিক?’
মাথা নাড়ে রায়হান, ‘না। সিজো-অ্যাফেকটিভ। অর্থাৎ সিভিয়ার বাইপোলার ডিজঅর্ডার এবং মাইল্ড সিজোফ্রেনিয়ার মিশেল। বাইপোলার ডিজঅর্ডার থাকলে সাবজেক্টের মুড ম্যানিয়া আর ডিপ্রেশনের মাঝে সুইচ করে বার বার। সেই সাথে সিজোফ্রেনিয়ার হাল্কা উপসর্গ – প্যারানয়া, মিডিয়া অবসেশন, নিজের সম্পর্কে শারীরিক ভুল ধারণা আর ভিজুয়াল এবং অডিটরি হ্যালুসিনেশন। সিজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ বলতে অনেকেই শুধু এই হ্যালুসিনেশনটুকুকেই ধরে নেয় – অজ্ঞতা। যাই হোক, এই ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলতে চাই একান্তে। যদি সম্ভব হয়।’

ইঙ্গিতটা সাথে সাথে বুঝে যায় জাহিদ, ক্লাস এইটে পড়ে ও, একেবারে শিশু নেই এখন। বড়রা একা একা কথা বলতে চাইতে পারে। তখন ওদের থেকে দূরে চলে যাওয়া নিয়ম।

আস্তে করে উঠে দাঁড়ায় ও, হেসে জানালো, ‘আমার একটু ঘরে যেতে হচ্ছে। ডাউনলোড করতে দিয়েছিলাম একটা ফাইল – হয়ে গেছে বোধহয়। আপনারা কথা বলুন।’
রায়হান মাথা কাত করে সায় দিলো। ছেলেটাকে বেশ ভালো লেগেছে ওর। এই বয়েসেও ভদ্রতাবোধ শিখেছে বেশ।

চোখের সামনে থেকে জাহিদ দূর হতেই মোস্তফা কামালকে প্রশ্ন করে, ‘ঈপ্সিতা রুদ্রপ্রতাপ রায়ের ব্যাপারে কতটা জানে?’
‘ও ব্যাপারে খুব বেশি আলোচনা ছেলেমেয়ের সামনে তো করি নি।’ অবাক হয়ে যান মোস্তফা কামাল, ‘কেন?’
‘বাইরের মানুষ কেউ জানে?’
‘অনেক পুরোনো অধিবাসী যারা আছে। আর যারা আমার বাসায় ভাড়া থাকতে গিয়ে সাফার করেছে। তবে তাদের সাথে তো আমার ছেলে-মেয়েদের দেখা হয়নি। তখন ওরা ঢাকায় ছিল।’ অস্থির হয়ে উঠলেন মোস্তফা, ‘ঈপ্সিতা রুদ্রপ্রতাপের কথা জানে?’
‘শুধু জানে না। মেয়েটা ওকে দেখতেও পায় – যতদূর বুঝলাম।’

ঈপ্সিতার সাথে যা কথা বার্তা হয়েছে খুলে বলে রায়হান ওদের।
শুন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন দম্পতি। মেয়ের সমস্যাটা কোনদিকে গেছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না এখনও।

‘তা কি করে সম্ভব? আপনি নিশ্চিত ঈপ্সিতা রুদ্র বলতে আমাদের পূর্বপুরুষকে বুঝিয়েছে?’
‘জমিদারবাবু ছাড়া আপনাদের পরিচিত আর কোন রুদ্র কি আছে?’ পাল্টা প্রশ্ন করে রায়হান, ‘তাছাড়া সে শুধু রুদ্রের কথাই বলেনি – বলেছে এ বাড়িতে এসে সে তার পরিবারকে ফিরে পেয়েছে। এর অর্থ একটাই – ঈপ্সিতা রুদ্রকে দেখতে পায়।’

কেঁপে উঠলেন মিসেস মোস্তফা, ‘লোকটা একশ আগে মারা গেছে!’
হাসল রায়হান, ‘এবং মরেই আছে। ঈপ্সিতা দেখতে পায় বলে আমি বোঝাইনি সে মানুষটি এখনও হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। অথবা তার আত্মা এই বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব আজগুবি কিছু দেখিনি আমি আজতক। কাজেই – সমাধানটা সহজ, মেয়েটির ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।’

‘এ থেকে ওকে কিভাবে বাঁচাবো, মি. রায়হান!’ প্রায় কেঁদে ফেলেন মিসেস মোস্তফা।
‘শান্ত হও।’ পাশ থেকে আলতো করে বলেন মোস্তফা সাহেব।

দুইজনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রায়হান, ‘ওকে সুস্থ করতে হলে আমাকে তার সমস্যাটা পুরোপুরি জানতে হবে। ঈপ্সিতা যখন স্কুলে ছিলো ওর ভেন্টিলেটরের কিছু অংশ ভেঙ্গে ফোকরটা বড় করেছি।’
‘আপনি নিশ্চয় আমার মেয়ের ওপর –’
‘জ্বি, নজর রাখতেই চাইছি।’ মেয়ের বাবার আপত্তিকে দুই পয়সার মূল্যও না দিয়ে বলল রায়হান, ‘পেরিস্কোপের সাহায্যে। ওকে টের পেতে দেওয়া যাবে না। রাতের বেলাতে যেহেতু পাগলামি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিলো ওর – কাজেই ওকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে তখনই।’

৫.
আড়াল থেকে একজন মানুষের দিকে তার অনুমতি ছাড়া তাকিয়ে থাকার চেয়ে অসভ্য কাজ আর নেই। আর যদি সেটা কোন মেয়ের দিকে তাকানো হয় – মানসিক রোগী হোক আর যাই হোক – সেটি আরও বিতৃষ্ণার। তার ওপর সে তাকাচ্ছে একজন মেয়ে-শিশুর দিকে। এগারো বছর বয়স যার। এর থেকে খারাপ আর কিছু হতে পারে না।

রায়হানের ভদ্রতাবোধ বাংলাদেশীদের মত না হতে পারে – অন্যের ব্যক্তিগত অধিকার নিয়ে সে একটু বেশিই সচেতন। কাজেই যখন পেরিস্কোপে রাত সাড়ে বারোটার সময় ও চোখ রাখল, ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘কাজটা ঠিক করছো না, রায়হান।’

অস্বস্তিটা কিছুক্ষণের মাঝেই কাটিয়ে ফেলা যায়। পেরিস্কোপে চোখ রাখাটা একটা সময় স্রেফ দায়িত্ব বলে মনে হতে থাকে।
মেয়েটা অসুস্থ। তাকে তোমার সাহায্য করতে হবে!

প্রথম এক ঘণ্টাতে ঈপ্সিতার মাঝে কোন অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করে না রায়হান। ছোট্ট একটা মেয়ে যেভাবে ঘুমায় ঠিক সেভাবেই ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। বুকের কাছে চেপে রেখেছে একটা পুতুল।

আশ্চর্যের ব্যাপার হল কবে থেকে ঈপ্সিতা তার ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমায় – সেটা তার বাবা-মা লক্ষ্য করেননি। হঠাৎ এটা শুরু হয়েছে। একদিক দিয়ে এটা ভালো হয়েছে। তার অজান্তে তার ওপর চোখ রাখা যাচ্ছে। তবে এগারো বছরের একটা বাচ্চার কাছ থেকে এই দরজা লাগিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস ও আশা করে নি।

কিশোরীর কোন বৈশিষ্ট্য তার শরীরে ফুটে ওঠেনি এখনও। ঘুমালে ঈপ্সিতার মুখে নিষ্পাপ একটা ভঙ্গী ফুটে ওঠে – ওদিকে পেরিস্কোপ ঘুরিয়ে তাকাতে রায়হানের ভীষণ মায়া হয়। এই মেয়েটি একজন পুরুষের গোপন অঙ্গ কেটে নিয়েছে এটা যেন বিশ্বাসই হতে চায় না। কোন পর্যায়ের মানসিক চাপে থাকলে কোন শিশু এই কাজটি করতে পারে?

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, হাতের কাছে ছুরিই বা সে পেল কোথায় প্রয়োজনের সময়? এমন হতে পারে – কাজের ছেলেটা এখানে ভিক্টিম নয়, হয়তো মেয়েটিকে একা পেয়ে কোন কু-ইচ্ছে চরিতার্থ করতে চেয়েছিল সে। কাজেই প্রতিরক্ষার জন্য মেয়েটিকে কাজটা করতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। কিন্তু ও ব্যাপারে পরে ঈপ্সিতা কিছুই মনে করতে পারে নি। ব্যাপারটা পোস্ট-ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার হতে পারে।

নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। আরও কিছু থাকার সম্ভাবনা দেখে বলেই আজকে পেরিস্কোপে এসে দাঁড়াতে হয়েছে ওকে। মোস্তফা কামাল অবশ্য তাকে বসার জন্য একটা চেয়ার দিয়ে গেছেন।

একেবারেই হঠাৎ চোখ মেলে উঠে বসে ঈপ্সিতা এসময়। এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে হল ব্যাপারটা – চমকে উঠল রায়হান। সাধারণতঃ ঘুম থেকে উঠলে একজন মানুষ কিছুক্ষণ সময় নেয় নড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। আর সাথে সাথে নড়ে উঠলেও এক ধরনের জড়তা কাজ করে। ঈপ্সিতার মাঝে কোনটাই কাজ করে না। সে এমনভাবে উঠে বসেছে – যেন চোখ বন্ধ করে গত দুই ঘণ্টা শুয়ে ছিলো। এখন শুধু তাকিয়েই উঠে পড়েছে।

ঘড়ি দেখে রায়হান – রাত তিনটা বাজে প্রায়।
বিষয়টা ডানহাতের কাছে রাখা নোটবুকে টুকে রাখল ও। ঈপ্সিতার দিকে মনোযোগ দিল আবার, ভূতে পাওয়া মানুষের মত বিছানা থেকে নেমে পড়েছে মেয়েটা। বিড় বিড় করছে – এখান থেকে তাই মনে হয় রায়হানের। ও ঠিক করে রেখেছে, মেয়েটা দরজার দিকে এগিয়ে আসলেই পেরিস্কোপ নিয়ে সটকে পড়বে পাশের বাথরুমে। যত দ্রুত সম্ভব। দরজা খুলতে ওর একটু সময় লাগার কথা। সেই সময়ের মধ্যে পগার পার হয়ে যেতে পারবে।

ভেন্টিলেটরের খুব কাছ দিয়ে পায়চারী করে যায় মেয়েটা।
ঠিক তখনই স্পষ্ট শুনতে পায় রায়হান, মেয়েটা বলছে, ‘রুদ্র! অ্যাই রুদ্র। আজ আসবে না তুমি। রাগ করেছ, না? অ্যাই, রুদ্র ডাকছি তো তোমাকে -’

অতিপ্রাকৃত কিছুতে বিশ্বাস করে না রায়হান – তবে এই মুহূর্তে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে ওর। রোজ কি এসময় আসে ঈপ্সিতার ‘রুদ্র’? আজ ও নজর রাখছে বলে আসতে পারছে না?
মৃত্যুর পর কি যোগাযোগ করা সম্ভব এই জগতের সাথে? আসলেই সম্ভব?

ঘাড়ের কাছে কাঁপা দীর্ঘশ্বাসটা শোনার সাথে সাথে জ্ঞান হারায় রায়হান।

৬.
চোখ মেলতেই রায়হান দেখতে পেল, ঠাণ্ডা একটা মেঝেতে শুয়ে আছে ও। দেওয়ালের কাছে ঝুলছে ওর ডিজিটাল পেরিস্কোপ। অন্যমাথা ভেন্টিলেটরের সাথে আটকানো।

এক মুহূর্ত লেগে যায় একটু আগে ঠিক কি হয়েছে সেটা মনে করতে – তবে মনে পড়তেই লাফিয়ে ওঠে ও। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাওয়ার সময় হাত থেকে ছুটে গিয়ে দেওয়ালের সাথে বাড়ি খেয়েছে – ডিসপ্লের কাছে কিছু আঁচরের দাগ – এছাড়া ঠিক আছে যন্ত্রটা। পেরিস্কোপের নজর ঘুরে আছে ছাদের দিকে।

দ্রুত হাতে ওটাকে সরিয়ে আনতে থাকে রায়হান, খাটে দৃষ্টি দিতে ঈপ্সিতাকে ওখানে দেখা যায় না। ব্যস্ত হাতে ঘোরায় ওটা আবার। দূরবর্তী দেওয়ালের কাছে পড়ে আছে শরীরটা – দেখেই কেঁপে ওঠে রায়হান।
ঈপ্সিতার শরীরে একটি সুতোও নেই।

হাত থেকে পেরিস্কোপটা ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে উঠেছে ও – দরজাটা ভাঙ্গতে হবে।
তখনই প্রথমবারের মত লক্ষ্য করে – খুলে আছে ওটা। ভেতর থেকে এখন লাগানো নেই।

ছুটে ঘরে ঢুকে পড়ে রায়হান, ব্যস্ত পায়ে মেয়েটার কাছে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। শ্বাস ফেলছে এখনও।
তলপেটের নীচটা ভিজে আছে। বোঝা যাচ্ছে সামান্য সময় আগে যৌনসংগম করা হয়েছে মেয়েটার সাথে। জামা কাপড়গুলোকেও এবার দেখতে পায় রায়হান। কাছেই পড়ে আছে।

আচমকা ওর নিজেকে হতবুদ্ধি লাগে। এ অবস্থাতে মোস্তফা কামাল ওকে দেখতে পেলে তিনি কি ভেবে বসবেন না – রায়হান নিজেই অপকর্মটা করে বসেছে মেয়ের একাকীত্ব আর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে? আর যদি এখান থেকে ও বের হয়ে গিয়ে মোস্তফা সাহেবকে খুলে বলে ঘটনাটা – তাতেই কি তাঁকে বিশ্বাস করানো যাবে আর কিছু?

ঈপ্সিতাকে নজরে রাখছিলো রায়হান – তাকে চোখ এড়িয়ে আর কারও ঢোকার কথা নয় ভেতরে। রায়হান নিশ্চিত – অন্যকোন মানুষ ওই ঘরের সামনে আসে নি। চোখ পেরিস্কোপের ডিসপ্লের দিকে থাকলেও সামান্য নজর ও রেখেছিলো আর কেউ আসে কি না দেখার জন্য।

যে বা যা তাকে অজ্ঞান করেছে সে কী কোন বাস্তব কিছু? না – হলে ও দেখতে পেতো। আবার সেটা যদি সত্য হয়, সে কীভাবে অজ্ঞান হতে পারে? মানসিক কোন জটিলতা?

যদি মানসিক কোন সমস্যা তাকে ‘ব্ল্যাক আউটে’ নিয়ে যায় সেটাও ভালো কোন লক্ষণ নয়! প্রথমতঃ রোগির চিকিৎসা করতে এসে নিজের রোগ নিয়ে লড়াই করার মুডে ছিল না সে।

দ্বিতীয়তঃ ব্ল্যাকআউটে থাকা অবস্থাতে সাবজেক্ট অনেক কিছু করে আসতে পারে। সেটা তার স্মৃতিতে থাকে না।

এমন কি হতে পারে – অচেতন রায়হান হয় নি – বরং ওখানে সে অন্য একটা সত্ত্বাতে ঠিকই কর্মক্ষম ছিলো? ছোট্ট মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছে, নিজেকে পরিষ্কার করে বাইরে গিয়ে আবার শুয়ে পড়েছে? বাবা-মার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কথা ওর মনে পড়ে।
ঘাড় ঝাঁকিয়ে চিন্তাগুলো মাথা থেকে সরিয়ে ফেলে ও, এখন নিজের সাথে নিজের লড়াইয়ের সময় নয়।

ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে বাড়ির অন্য কোণে ছোটে ও – মোস্তফা কামাল নিশ্চয় স্টাডি রুমে আছেন। মেয়ের কর্তন-কর্মের পর থেকে তিনি ঘুমাতে পারেন না। রায়হানের সাথে তিনিও বসতে চেয়েছিলেন, তবে তাকে মানা করে দিয়েছিল সে। রোগির আত্মীয়স্বজন তদন্তে নামলে বায়াস বাড়ে। কাজের কাজ কিছু হয় না, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানে।

স্টাডিরুমের দরজা ধাক্কিয়ে যখন ভেতরে ঢুকে ও – লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

রায়হানকে ব্যকুল হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কি হয়েছে? কোন প্রগ্রেস?’
ও এবার চুপ হয়ে যায় , একজন বাবাকে কিভাবে সে বলবে, ‘আপনার মেয়েকে একটু আগে ধর্ষণ করা হয়েছে। আমি দেওয়ালের ওপাশে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। তাই কিছুই করতে পারিনি।’

চুপ থাকতে দেখে মোস্তফা কামালের মুখ প্রথমে দুশ্চিন্তার ছাপ– তারপর আতঙ্ক এসে ভর করে। কিছু একটা বলা দরকার, রায়হান শুধু বলে, ‘চলুন, আপনি দেখতে চাবেন এটা।’

মোস্তফা সাহেব ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হলেন। তারপরই জোরে পা চালালেন মেয়ের ঘরের উদ্দেশ্যে। তাঁকে হেঁটে অনুসরণ করতে গিয়ে হাঁফ ধরে যায় রায়হানের। বুকের ভেতরটা দুপ দাপ লাফাচ্ছে।

আরও জটিল হয়েছে রহস্য। আর বলা চলে ঈপ্সিতার বলা কথাগুলোর অর্থ ও খুঁজে পেয়েছে।

এজন্য জায়গাটাকে তার ভালো লাগে। রুদ্রের সাথে চুটিয়ে প্রেম করছে সে নিজের ঘরে। এই রুদ্র তার কল্পনার অংশ হতে পারে – তবে রতিক্রিয়ার চরম পুলকে এই কল্পনাটি নিয়ে যেতে পেরেছে ঈপ্সিতাকে। বিষয়টাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই।

এমন একটা অবস্থা হয়েছে – রায়হান নিজেই বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা কি স্বতঃমিলন ছিলো? নাকি একজন সঙ্গী ছিলো ওখানে মেয়েটির? ও নিজেই অজ্ঞান হয়ে গেছিলো কেন?
নাকি ওটা অজ্ঞান ছিলো না? নিজেই সে ধর্ষণ করে বসেনি তো ছোট্ট মেয়েটাকে?

ওর ভেতরে কি রুদ্রের আত্মা ভর করেছিলো?

জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে দিল রায়হান। এখন রুদ্রের প্রেতাত্মা-কাহিনী বিশ্বাস করার অর্থ এই রহস্যের সমাধান কখনোই হবে না।

মোস্তফা কামাল থেকে বেশ পিছিয়ে গেছে রায়হান। আগে ভাগে পৌঁছে গেছেন তিনি পেরিস্কোপের কাছে। ডিসপ্লেতে চোখ রাখছেন।
রায়হান তাঁকে বলতে গেছিলো, ‘দরজা খোলাই আছে।’

থেমে যায় ও দরজার দিকে চোখ পড়তেই।
অনড় দরজা একেবারেই বন্ধ হয়ে আছে। একটা ধাক্কা দিয়ে দেখে রায়হান। একচুল নড়ল না বিশাল পাল্লা।

‘মি. রায়হান?’ গমগমে কণ্ঠে ডাকলেন মোস্তফা কামাল। ‘এসব কী? কোন ধরনের প্র্যাংক?’

চমকে ওঠে রায়হান। মেয়ের অবস্থা তিনি দেখে ফেলেছেন, এবং বিশ্বাস করতে পারছেন না? তাঁর দিকে এগিয়ে যায় ও। আস্তে করে ওর হাতে ডিসপ্লেটা ধরিয়ে দেন মোস্তফা।

চোয়াল ঝুলে পড়ে রায়হানের।
ঈপ্সিতা বুকের মাঝে একটা পুতুল জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। চোখে মুখে নিষ্পাপ একটা ছাপ।
পোশাক সব পরেই আছে মেয়েটা। এটা স্বস্তি দেয় রায়হানকে।

কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়।
রুদ্রপ্রতাপ রায় তার ট্রেস মুছে ফেললেও – রায়হান জানে, একটু আগে ও ভুল দেখেনি।

৭.
ডায়েরীর পাতা খুলে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে রায়হান। এখন ওর ঘুমানো উচিত। ভোর হতে শুরু করেছে। মোস্তফা কামাল তাঁর ঘরে ফিরে গেছেন।

ইতস্তত হলেও মোস্তফা কামালকে সবকিছু খুলে বলেছে ও। শুনে তিনি মুখে কিছু না বললেও রায়হান জানে এক বর্ণও বিশ্বাস করেন নি তিনি। ধরেই নিয়েছেন ওই ভাড়া নিতে আসা বেকুবগুলোর মতো মাথা গেছে এই ছেলেরও। রায়হান জানে না, তবে মোস্তফা কামাল ওই মুহূর্তেই ঠিক করে ফেলেছেন, এই ছেলেকে তিনদিনের বেশি প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। বাঁদরকে কোলে বসতে দিলে ঘাড়ে উঠে বসে। বাঁদর বিদেয় করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। নিজের এগারো বছরের মেয়েকে নিয়ে রতিক্রিয়ার বাজে গল্প শোনার জন্য একে তিনি ভাড়া করেন নি।

এ বাসাতে ঢোকার পর থেকে দুটো চরিত্র রায়হানকে ভাবাচ্ছে। ডায়েরীতে সাবধানে কলম চালায় ও।

মোস্তফা কামালঃ
শুচিবায়ু। সৌখিন। মেয়েকে ভালোবাসেন। কুসংস্কারে বিশ্বাসী, তবে স্বীকার করেন না। পারিবারিকভাবে সুখী। পারিবারিক তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে স্পর্শকাতর। দরকার ছাড়া বহিরাগত কাউকে বলতে অনাগ্রহী। জমিদার রুদ্রপ্রতাপের ডায়েরিতে কি এমন কিছু ছিলো যা বাইরের কেউ পড়লে মোস্তফা কামালের পরিবারকে ঘৃণা করবে? তিনি ঠিক কি লুকোচ্ছেন?

ঈপ্সিতাঃ
কল্পনাবিলাসী। অতিকল্পনার ফলে হ্যালুসিনেশনের শিকার।
ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। শ্রেণিতে প্রথম।
বয়ঃসন্ধিকাল পেরুচ্ছে, শারীরিকভাবে এ বয়েসেই সক্ষম।

দুই সেকেন্ড লেখাটির দিকে তাকিয়ে থাকে রায়হান। একটু ভেবে বাকিদের ব্যাপারেও তুলে ফেলে।

রাইসা (মিসেস মোস্তফা কামাল)ঃ
সাধারণ গৃহিণী। স্বামীর প্রতি অন্ধবিশ্বাস আছে। ছেলের সাথে একটা কথাও বলেননি বিকেলে। অর্থাৎ মেয়েকে নিয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় আছেন। নিশ্চয় তাকে অতিমাত্রায় ভালোবাসেন। অতি ভালোবাসা সাবজেক্টের ক্ষতির কারণ?

জাহিদঃ
ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছেলে। পারিবারিক মায়া-মমতা প্রবল। খোলা মনের। বন্ধু মাহফুজের সাথে এর সম্পর্ক ভালো।

কলম থামায় রায়হান। মনে পড়ে একবার মাহফুজের সাথে দেখা করাটা দরকার। শহরের এপ্রান্তে এসেছে, তার রেকমেন্ডেশনেই এই কেস পেয়েছে, এরপর তার সাথে দেখা না করা অভদ্রতা হবে। কেসটা সলভ করেই দেখা করবে – ঠিক করল।

বিছানাতে পিঠ ঠেকানোর সাথে সাথেই ঘুমের অতলে চলে যায় রায়হান। তারমাঝেই যেন মনে পড়ে কিছু একটা নেই – কিছু একটা নেই –

*
মাত্র এক ঘণ্টা পর ঘুম ভেঙ্গে গেল ওর। এখন সে কোথায়? বুঝতে কিছুক্ষণ লাগলো রায়হানের। তারপর আরও গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্নটা জাগল, ঘুম ভাঙ্গল কেন?

দরজার নকটা শুনতে পেয়ে লাফিয়ে উঠে ও। দরজা খুলে যোবাইদাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। চোখের নিচে আচরের দাগ।

‘সাহেব অপেক্ষা করতেছেন। খাওয়ার টেবিলে।’ শুকনো কণ্ঠে জানায় মেয়েটা।
‘চোখে কি হয়েছে?’ জানতে চায় ও ভদ্রতার খাতিরে।
‘রান্নাঘরে কাজ করতে গিয়া কাটছে একটু।’

মেয়েটা একদিকে রওনা হয়ে গেলো। আর কথা বলার ইচ্ছে নেই। অদ্ভুত প্রশ্নটি রায়হানের মাথাতে আচমকাই উদয় হয়, ‘ভাড়াটেদের মাঝে নারী সদস্যারা অস্বস্তি বোধ করত।’ – বলেছিলেন মোস্তফা কামাল।
ঈপ্সিতাকে কেমন অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে সেটা দেখেছে ও। যোবাইদাও কি এরকম কোন সমস্যায় ভুগছে?

প্রশ্ন করলে জবাব মেলার সম্ভাবনা নেই। এই মেয়ে মুখে তালা মেরে রাখবে সেটা তাকে স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছে।
একটু প্রস্তুত হয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে রওনা দেয় ও। বাইরের রোদটা আজকে কড়া।
ডাইনিং টেবিলে ভেজা চুলে মোস্তফা কামালকে বসে থাকতে দেখা গেলো। রায়হানকে দেখে আগের দিনের মত হাসলেন না তিনি। চারপাশে তাকিয়ে মিসেস কামালকে খুঁজল রায়হান। তাঁকে দেখা গেলো না।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে টেবিলে বসে পড়ে ও, ‘গুড মর্নিং, মি. কামাল।’
মোস্তফা চোখ তুলে তাকালেন, দায়সারা ভাবে বললেন, ‘গুড মর্নিং।’
‘আর কাওকে দেখছি না।’
‘ওরা দেরী করে নাস্তা করে।’ আগের ভঙ্গীতেই বললেন ভদ্রলোক।
‘বেশ।’ রায়হান বসে পড়ল।

গতকাল রাতের কথা মনে পড়তে ভদ্রলোকের অস্বস্তির কারণ বুঝতে পারে ও। মেয়ের ব্যাপারে ওভাবে বলার পর যে কোন বাবাই স্বাভাবিকভাবে নেবেন না, যে বলেছে তাকে যত দ্রুত সম্ভব চিরস্থায়ীভাবে খেদাতে চাইবেন। কাজেই বিষয়টা এখানেই চাপা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হল রায়হান।

‘মি. কামাল, একটা বিষয় আমি খোলাখুলি জানিয়ে দিতে চাই।’ শুরু করল ও, ‘আপনার যদি আমার ওপর আস্থা না থাকে – আমাকে কাজ থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন। আমার ব্যক্তিগত কৌতূহল জন্মেছে এই কেসটা নিয়ে। তার অর্থ এই না – এই কাজটা আমি করতে বাধ্য। আপনি সাবজেক্টের বাবা এবং আমার কেসের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আপনার সাথে মন কষাকষি করে এই কেসটা সলভ করার ক্ষমতা আমার নেই। আসলেই নেই। এখন আপনার বিবেচনা।’

মোস্তফা কামাল ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকালেন। সময়ের সাথে সাথে সেই দৃষ্টি উষ্ণ হয়। অবশেষে একচিলতে হাসি ফোটে তাঁর মুখে।
‘সত্যিই দুঃখিত। আসলে, বাবা হলে বুঝতে পারবেন। গতকাল রাতটা ছিলো আমার জন্য শকিং।’
এবার একটু হাসে রায়হানও, ‘আপনার মেয়ে একটা সমস্যায় আছে। যতই ঝামেলার হোক, যতই অস্বস্তির হোক, এই সমস্যাটা আমরা সমাধান করব। কিন্তু সেজন্য আপনাকে শক্ত হতে হবে।’

মোস্তফা কামাল এই স্বল্প পরিচিত যুবকের দিকে তাকিয়ে থাকেন এক মুহূর্তের জন্য। নেহায়েতই তরুণ একজন মানুষ। জাহিদের চেয়ে দশ বছরের বড়ও হবে না। সুদর্শন বলা চলে একে অনায়াসে। তবে সেটা নয় – যে কারণে এই ছেলেকে ঈপ্সিতার কেসটা দিয়েছেন তিনি, সেটা এর চোখ।

ছেলেটা জানে তার কোন অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট নেই, তবুও সে যে কাজটা করেছে তাকে অনেকটা জীবনে মেডিকেল কলেজে না গিয়ে ক্লিনিক খুলে ডক্টর হিসেবে বসার মত বলা চলে। তার পরও তার পসার হয়েছে যথেষ্ট। তিন দিনের জন্য সে ত্রিশ হাজার দাবী করে নিঃসংকোচে। পুলিশ যখন কোন অপরাধীকে ধাওয়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যায় এর কাছেই তারা আসে। সাসপেক্টের নেক্সট মুভ এই ছেলে অনায়াসে বলে দেয়।
এই সাফল্যের পেছনে আছে ওই চোখ দুটো। ওখানে জ্বল জ্বল করছে আত্মবিশ্বাস। এ জানে কোনদিন পরাজিত হবে না সে। এবং সম্ভবতঃ এখন পর্যন্ত হয়ওনি।

এই মুহূর্তে ওই চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয়, আসলেই মেয়ের সমস্যা তেমন কিছু তো নয়! দু